সুফিয়াদের বাড়ি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে হাঁটা পথ। নাকের ওপরে তিলবতী শ্যামলা মেয়েটি ক্ষণে ক্ষণে নিধিকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ভোমরাদহের ইসমত মাষ্টারের ছেলের বৌ বীণার সঙ্গে কোথায় যেন মিল। কোথায়? চেহারায়, পোশাকে তো মোটেই না, তাহলে কোথায়?
ডাক্তার বলে গেছে কাঁচা কলা সেদ্ধ আর ভাত খাওয়াতে, হন্তদন্ত হয়ে তারই জোগাড় করছে সুফিয়া।
সুফিয়ার হালচষা এক ভাই বাড়ি ফেরে, মুদিদোকানী আরেকভাই ছেলের হাত ধরে ফেরে। তার ভাবী বাজারের ব্যাগ খুলে মাছ কুটতে বসে। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ এই বাড়ির শোবার ঘরে বিছানায় শুয়ে নিধি এদের কর্মচাঞ্চল্য অনুভব করে। একা, অচেনা জায়গায় অচেনা মানুষের সঙ্গে তিষ্টে যাবার আতংক চলে গিয়ে এখন নিধির মনে হয় ভালোই হয়েছে। অসুস্থ্য কারোর সেবাযত্নের অভ্যাস হয়তো কুমকুমের নেই, ওদের সঙ্গে ফিরে যায়নি বলে ভেতরের মেঘলা আকাশের ভার এখন খানিকটা কম মনে হচ্ছে।
সুফিয়া টিউবওয়েল চেপে বালতি ভরে পানি দিয়েছে। স্যালাইনটা কাজ করেছে। নিধি গোসল করলে চুলে জোর করে নারকেল তেল ঘষে দিলো। কাচা কলা সেদ্ধ আর সামান্য লবন মেখে মুখে তুলে খাওয়ালো। তারপর নিজের ঘরের বিছানায় শুইয়ে মাথায় বালিশ উঁচু করে দিলে নিধি টের পায়, আসলে সুফিয়ার স্পর্শে মা’র আদল আছে, সেই রকম সংযত মায়ার হাত তার কপাল ছুঁয়ে দিয়ে দৌড়ে উঠোন পার হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।
সুফিয়ার পরিবার কুমকুমকে এত অল্পসময়ে ভালো কিছু খাওয়াতে না পেরে হায় আফসোস করে। তাদের খোয়াড়ের বড় হাঁসের ডিম ভাজি খেয়ে যেতে আবদার করে সুফিয়ার বড়ভাবী।
চাঁদ উঠলে উঠানে পাটি বিছিয়ে সবাই গল্পগাছায় বসে। সুফিয়ার এক ভাইয়ের বাঁশি বের হয়। তাতে ফু দিয়ে সুর তোলে, ঘরে শুয়ে সে সুর শুনতে শুনতে লিচু বাগানে ঘুরে বেড়ায় নিধি। লিচুগাছে সদ্য গজানো পাতার স্পর্শে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।
সকালে পাখ পাখালির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলে নিধি দেখে এ ঘরের জানলা গলে একটা লাউডগা, কতগুলো শাদা ফুল। সুফিয়া ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে আসে।
নিধি অনেক ঝরঝরে বোধ করছে। নাস্তা সেরে বসতে না বসতেই গাড়ি এসে হাজির। নিধিকে নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তায় ছিল, বোঝা যায়।
-‘ময়নার হাটে থেকে যাওয়া যায় না, একদম?’ কুমকুমের মত হাসিঠাট্টা দিয়ে বিদায়পর্ব সহজ করে আনে নিধি। আর সত্যি সত্যি তার এক মন থেকে যেতে চাইছে দেখে ভেতরে ভেতরে নিজেও অবাক হয়ে যায়। একি অনেকদিন স্নেহের ছোঁয়া না পাওয়ার ফল!
সুফিয়া সম্পর্কে কিছুই জানা হলো না তার, অথচ তার সেবাযত্ন সঙ্গী করে ফিরে যাচ্ছে। গ্রামের বিবাহযোগ্য মেয়েটি কেন বাপের বাড়ি আছে- এর পেছনে না হোক কোন কষ্টের গল্প নিশ্চয়ই আছে।
মুখে যদিও বলে আবার আসবে সে ময়নার হাটে, কিন্তু নিধি জানে, কখনো হয়তো আর আসা হবে না। ছেড়ে যাওয়া জায়গায় নিধির ফেরা হয় না। সুফিয়ার গল্পটিও তার অজানা থেকে যাবে। আজপর্যন্ত ভোমরাদহ –ই গেল না একবার।
মনকে শাসিয়ে গাড়ির দিকে এগোয় নিধি।
ড্রাইভার নিধির জন্য পেছনের সীটে একটা বিছানাই পেতে দিয়েছে। নিধি হাসে- ‘এখনতো ভালো হয়ে গেছি!’
বারবারা’র সঙ্গে কাজ শেষ করে মাসখানেকের জন্য বাহরাইন চলে গেল কুমকুম। ওর সঙ্গে কাজ করে পাওয়া টাকায় প্রায় দু’মাস চললো নিধির।
ফুপু এর মধ্যে একদিন হলে এসে টাকা দিয়ে গেছে। বাবার পাঠানো, সম্পর্কের একমাত্র সূত্র এখন। টাকা পাঠিয়ে মেয়ের প্রতি দায়িত্ব শেষ। একবার চোখের দেখা দেখতে ইচ্ছে করে না?
আর ফুপুর মুখেও একদম কুলুপ আঁটা। নিধি হোষ্টেলে উঠে যাওয়ার পর কোন খবরাখবর কেউ তাকে দেয় না।
বাবার টাকা আর নিতে ইচ্ছে করে না নিধির।
প্রতিমাসে একবার ফুপুর বাসায় যাচ্ছিল ঠিকই, ফুপুও তাকে আসবার সময় ইলিশ ভাজা, মুরগীর তরকারী টিফিন ক্যারিয়ারে দিয়ে দিচ্ছিল। তার শাশুড়ি অসুখ শরীরে এসে পড়ায় নিধির আর রাতে থাকা হচ্ছিল না।
ফুপুকে নিধি ময়নার হাট যাওয়ার কথা বলেনি। কিন্তু অয়ন কোথা থেকে খবর বের করেছে। ফুপুর গম্ভীর মুখ- ‘জানায়া গেলে ভালো হইতো, কোন বিপদ হইলে?’
সেন্টার টেবিলে প্লেট রেখে সোফায় বসে অয়ন পরোটা কাবাব খাচ্ছিল, মুখের গ্রাস শেষ না করেই বলে- ‘জানাইলে তো এ্যাএশ করা যাবে না…’
বলে যাওয়ার কথা মাথায় আসেনি সেকথা বলে ঝামেলা বাড়ানোর মানে হয় না।
বিপদ হলে সামলানোর লোক ছিল, এবং সামলিয়েছে, এ ব্যাখ্যাতে আর যেতে ইচ্ছে করে না। নিধির ওপরে খবরদারি করার দায়িত্ব কে দিয়েছে অয়নকে! দু’একবার শরীর ছুঁতে পারার সুবাদে ভালোবাসার পরিবর্তে সবসময় নিগ্রহ নেবে নিধি, অয়ন বুঝি তেমনই ভেবেছে!
এর আগেও কয়েকবার ক্লাসের সামনে ক্যাম্পাসে হুট করে হাজির হয়েছে, তাতে কোন অসুবিধে ছিল না যদি না সে মুখ ব্যাঁকা করে নিধির বন্ধুবান্ধবদেকে কটুক্তি করা থেকে বিরত থাকতো, শ্লেষমাখা বাক্যবাণ বন্ধ রাখতো।
একজন তো বলেই ফেলেছে- ‘এইটা তোর কাজিন! ওর রুচি এত খারাপ ক্যান?’ অয়নকে মুখে কিছু বলার জো নেই, নিধি জানে বুমেরাং ফুপুর দিকে ফেরত আসবে। অয়ন এখন ওর দাদীর সঙ্গে ঘোট পাকিয়ে ফুপুকে তার ভাইঝি তুলে কথা শোনাতে পারে। ভেতরে ভেতরে একটা ‘যা খুশী করবো’ ভাবনায় ফুসে উঠলেও চুপ থাকে নিধি।
ফুপুর গম্ভীর মুখ আরেকটু কালো- ‘ সামনের সপ্তায় আরেকবার আয়, তোর বাবা এখনো টাকা পাঠায় নাই’।
ময়নার হাটের প্রজেক্ট এ কাজ করে কিছু আত্মবিশ্বাস বেড়েছে নিধির। কিছু একটা করার অদম্য তাড়না বোধ করে। তাহলে টাকার অপেক্ষা না করলেও চলবে।
কিন্তু কুমকুমের তো ফেরার নাম নেই। ভিন্সেন্টকে সে ব্যক্তিগতভাবে চেনে না। বারবারা’র ফোন
নাম্বার সে লাল ডায়েরীটায় লিখেছে। একটা ফোন করে দেখবে না কি? যেখানেই পাইবে ছাই- কথাটা যদি খেটে যায়!
ফুপুর বাসা থেকে বেরোলেও বিকেল গড়ায় না। হুডখোলা রিক্সায় নিধির বড় একা লাগে, হলে ঢুকলে নির্ঘাত শান্ত খালি রুম তাকে আরো একলা বানিয়ে দেবে।
মোহাম্মদপুরে এসে আড়ং এ ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করে, দোতলা, তিনতলার ফ্লোরে কানের দুল, মাটির ঘট এসব দেখে জামা কাপড় ঘেটে বেড়াতে ইচ্ছে করে, কিন্তু রিক্সা থামিয়ে নামে না নিধি। কী এক অস্থিরতা ভর করে তাকে, কোথায় যাওয়া যায়? কার সঙ্গে দেখা হলে মন শান্ত হবে বুঝে উঠতে পারে না। এ সময় আজমত কাকার কাছে থাকলে তার বুঝি সবচে ভালো লাগতো!
নাকি কুমকুম? নাহ, তাকে স্বস্তি দেয়ার বদলে একটা ঘোড় দৌড়ে জুতে দেয়। বসে থাকলেও মেয়েটা কেবল ছোটে, নিধির যে অসুবিধা হয় তা না, তবে এক পর্যায়ে সে ক্লান্ত হয়। ফুপুর কালো মুখ আজকে তাকে বিমর্ষ করেছে, তার প্রয়োজন নির্ভার কারো সঙ্গ।
নাহার মনিকা
উৎকর্ষের দিকে মনযোগী লেখকদের তালিকায় নাহার মনিকা একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নাম। ঈদসংখ্যা ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’-য় কবিতা দিয়ে নাহার মনিকা’র লেখা প্রকাশের শুরু। তারপর দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন দেশের জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাস নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ছয়।
উপন্যাস— ‘মন্থকূপ’ (বৈভব প্রকাশন, ২০১৯), ‘বিসর্গ তান’ (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ২০১৬)।
গল্পগ্রন্থ—‘দখলের দৌড়; ( পুথিনিলয় ২০১৯), ‘জাঁকড়’ (দিব্যপ্রকাশ, ২০১৪), এবং ‘পৃষ্ঠাগুলি নিজের (দিব্যপ্রকাশ, ২০১১)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ চাঁদপুরে আমাদের বর্ষা ছিল’(বাংলামাটি প্রকাশন)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Health Policy, Planning & Financing এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। বর্তমানে ক্যানাডা’র ক্যুবেক প্রদেশে সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত আছেন।
লেখালেখি নাহার মনিকা’র কাছে অপার স্বাধীনতার জগৎ, যেখানে লেখক একমেবাদ্বিতীয়ম।