১২.
আমাদের পিকনিকের দিন বারবার পিছিয়ে যায়। প্রতিবার পিকনিকের দিন পিছিয়ে যাওয়ার সময় কী যে যন্ত্রণা লাগে আমার। আমি আমার সমস্ত প্ল্যান নিয়ে একাই কাতরাতে থাকি।
আমি তো শুধু আমার লো’কে কাছে পেতে চাই। না, ওকে আমি আমার কোনো আদিম প্রবৃত্তি দিয়ে কখনো চাইনি। আমি চাইনি কখনো ওর কুমারীত্ব নষ্ট করতে। আমি শুধু ওকে ছুঁয়ে দেখতে চাই, ছুঁয়ে থাকতে চাই। ওর সমগ্র অস্তিত্ব, আপাদমস্তক। ওর শিরায় ও ধমনীর প্রতিটি স্পন্দন অনুভব করতে চাই ছুঁয়ে দিয়ে। ওর ঘ্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।
কিন্তু সুযোগের অভাবে আমি কখনোই পুরো স্বাদ নিয়ে আমার নিমফেটকে না পাওয়াটুকু আমাকে অধৈর্য করে ফেলছে। আর এর জন্য সবচেয়ে বড় বাঁধা ছিলেন মিসেস হেইজ। যদিও তিনি কখনোই জানেন না বা ভাবতে পারেন যে আমি লো’র প্রতি আগ্রহী। আমার পক্ষ থেকে লো’কে পাওয়ার ব্যাপারটা তাঁর চিন্তার বাইরে। তাঁর চিন্তা ছিল আমার ব্যাপারে লো’র আগ্রহ। সবকিছু মিলিয়ে আমি আবার কিছুটা অসুস্থ বোধ করছিলাম। যেজন্য আমাকে আবার কিছুদিনের জন্য স্যানিটোরিয়ামে যেতে হল।
আপনারা হয়ত ভাবছেন তাহলে আমাদের লেকের পিকনিকের ব্যাপারে কী হবে? আসলে পুরোটাই ছিল আমার ভাগ্যের খেলা। মিসেস হেইজ আমাকে জানাননি যে পিকনিকে আমাদের সাথে লো’র এক বান্ধবীও আসছে। মেয়েটার নাম ম্যারি রোজ হ্যামিলটন; কালো তবে বেশ আকর্ষণীয় দেখতে মেয়েটা। এটা কোনোভাবেই আমার জন্য সুখবর না। কারণ দেখা যাবে যে লো ওর বান্ধবীর সাথেই গল্প, আড্ডায়, খেলাধুলায় ব্যস্ত। এদিকে আমাকে সময় কাটাতে হবে মিসেস হেইজের সাথে। এরচেয়ে জঘন্য পরিস্থিতি আর কী হতে পারে?
আমি স্যানিটোরিয়াম থেকে আসার আগে মিসেস হেইজ প্ল্যান করছিলেন তাঁর পরিচিত একজনকে বাসায় রাখবেন। মহিলার নাম মিস ফলেন, চিরকুমারী। ওই মহিলার মা মিসেস হেইজের বাসায় রান্নাবান্না করে দিতেন আগে। আর মিসেস হেইজ পাশেই একটা শহরে মনমত একটা চাকরিতে ঢুকতে চাচ্ছেন। এরমানে হল বাড়িতে আমাকে ললিতা এবং ওই মিস ফলেনের সাথে থাকতে হবে। ললিতাকে একা করে পাওয়ার সুযোগ তাতেও নেই। যেন মনে হচ্ছিল মিস ফলেন নামের এক বাজপাখি তার বিশাল ডানার ভিতরে আমার ললিতাকে লুকিয়ে ফেলছে। উফফ!
মিসেস হেইজ রিসিপশনিস্ট হিসেবে পাশের শহরেই চাকরিতে ঢুকে গেলেন। আর আমার সৌভাগ্য প্রসন্ন হল যেদিন রামসডেলে আসলাম সেদিনই মিস ফলেন আছাড় খেয়ে কোমর ভেঙে বসলেন।
১৩.
রবিবারে বেশ আগ্রহ নিয়ে বারান্দায় চেয়ারে বসেছিলাম। পায়ে পুরনো চপ্পল। এই একমাত্র জিনিস যেটা পুরনো। সকালের নাস্তা হয়ে গেছে। অপেক্ষা করছিলাম কখন মিসেস হেইজ এসে বিকেলে পিকনিকে যাবার কথা বলবেন। আবহাওয়াটাও সুবিধার ছিল। খুশি খুশি লাগছিল আমার। আবহাওয়া অফিস সব সময় তাহলে ভুল বলে না। কিন্তু সুখ এবারও সইল না। মিসেস হ্যামিলটন ফোন করে জানালেন তাঁর মেয়ের জ্বর এসেছে। এরমানে পিকনিকে যাওয়া ক্যানসেল। মিসেস হেইজ এসে এমনভাবে জানালেন যেন এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ব্যাপারটা যে স্বাভাবিক কিছু না সেটা লো বুঝিয়ে দিল। চার্চে যাবার কথা ছিল মা মেয়ের। লো রেগেমেগে বলল সে চার্চে যেতে পারবে না। মিসেস হেইজও কিছু বললেন না। ‘ঠিক আছে’ বলেই গজগজ করতে করতে চার্চের উদ্দেশে বেরিয়ে গেলেন।
আমি বারান্দা থেকে উঠে তখন শেইভ করছিলাম। দ্রুত শেষ করে বের হলাম নিচে। আমার পরনে সাদা পায়জামা। ওই লাইলাক ডিজাইনেরটা না। এটায় নীল রঙের ঝুমকা ফুলের ডিজাইন। সিঁড়ি দিয়ে নিচে আসতেই দেখলাম লো সোফায় বসে একতা আপেল খাচ্ছে। কেমন উত্তেজনা বোধ করছিলাম। বাড়িতে আমি আর লো ছাড়া কাকপক্ষীটিও নেই। ওর পরনে সুন্দর একটা জামা, গায়ের সাথে আঁটসাঁট। গোলাপি রঙের ছাপ, তার ভিতরে আরো গাঢ় গোলাপি রঙ। ঠোঁটটা টুকটুকে লাল করে লিপস্টিক। সুন্দর লাগছিল।
পাশে গিয়ে বসলাম। আমার হৃদস্পন্দন ঢোলের মত দ্রুম দ্রুম করে বাজছিল যেন। ওর সাথে খেলাচ্ছলে আপেলটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করলাম। ও আপেলটা শূন্যে একবার মজাচ্ছলে ছুঁড়ে দিল। আমি সেটা লুফে নিলাম।
‘দাও! আরে দাওনা!’ কেড়ে নেবার চেষ্টা করল আমার হাত থেকে। খুব ঘেঁষে আপেলটা নিয়ে নিল। একটা কামড় বসাল। আমি একতা ম্যাগাজিন টেনে পড়তে যাব তখন ও আমার ম্যাগাজিনটা কেড়ে নিয়ে নিজেই পড়তে লাগল। আমি ম্যাগাজিনটা দেখার অভিনয় করে ওর গায়ের সাথে আরো চেপে বসলাম। এতটা কাছে যে ওর চুলগুলোর ঘ্রাণ শুঁকে যেন মাতাল হয়ে যাচ্ছিলাম। ওর শরীরটা যেন একটা মন্দিরের মত; আমি সেই মন্দিরের পূজারী।
লো ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে পা এমনভাবে দোলাচ্ছিল যে আমার পায়ের সাথে বারবার ঘষা খাচ্ছে। আমার ভিতরে যেন অশরীরী এক কামনা ভর করে ফেলল। আমি পাঠককে আগেই বলেছি আমি লো’র কুমারীত্ব নষ্ট করতে চাই না; কোনোভাবেই না। আমি শুধু ওকে আমার নিজের কাছে টেনে নিলাম। আমার কোলের উপর চলে এলো লো। ম্যাগাজিনটা এমনভাবে মেঝেতে পড়ে গেল যেন কোনো ফুলগাছ থেকে একটা ফুল ঝরে মাটিতে পড়ে গেছে। আর আমার বাগানে যেন একটা ফুল খুব সুন্দর করে ফুটে উঠল।
লো আমার কোলে বসে আপেলে কামড় দিল। আর গলা ছেড়ে ওর পছন্দের গানটা গাওয়া শুরু করল, কারমেন, ও মাই লিটল কারমেন। আমার কাছে মনে হতে লাগল কোন সুদূর থেকে এক মোহাবিষ্ট সুর ভেসে ভেসে আসছে, আমি সম্পূর্ণ মাতাল, পাগলে মত অনুভব করছি আমার ললিতার শরীরের সমস্ত স্পর্শ। আমার মন্দিরে আমি মনপ্রাণ সঁপে পূজা করছি। ওর শরীরের উত্তাপ নিয়ে বেঁচে থাকা কোনো কনকনে শীতের রাতে কাঁপতে থাকা হতো দরিদ্র বেচারা কারমেন আমি।
কীভাবে বোঝাব সেই অনুভূতি। সোফার উপরে আমি, আমার কোলে বসে আছে আমার ললিতা। ওর প্রতিটি নড়াচড়া আমার কোথাও এক অলৌকিক সুখ বয়ে দিচ্ছিল, শিহরিত হচ্ছিল আমার প্রতিটি শিরা উপশিরা পর্যন্ত। হৃদস্পন্দন যেন ভূমিকম্পের মত, আর বিদ্যুৎ ঝলকানির মত ভয়ংকর এক ভাল লাগা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। এই সুখ পাবার জন্য আমি আমার সারাটা জীবন আমার ললিতার পূজা করে যেতে রাজি। এক নিমফেট সুখ যাকে বলে। এরকম চুড়ান্ত উপভোগ আমাকে আদিম নিঃশ্বাসে পাগল করে ফেলছিল।
লো কিছু বুঝতে পারছিল কিনা আমি জানি না। ও একমনে গান গাচ্ছে, আপেল খাচ্ছে। আমি সম্মোহিতের মত আমার পাজামার ভিতরের শিহরণ উপভোগ করেই যাচ্ছিলাম। কী অসুস্থ কামনা। আদৌ কি অসুস্থ? আমি তো ওর কোনো ক্ষতি করছি না। যেন কোনো ঐশ্বরিক ব্যাপার ভর করে ফেলেছে। পৃথিবীর সময়ের বাইরে এই মুহূর্তগুলো। কোনো কিছুর বিনিময়েই একে পরিমাপ করা যাবে না। ওর ঠোঁট দেখে মনে হল এক নক্ষত্রের মত জ্বলজ্বলে। আমি এই সুখটাই পেতে চেয়েছিলাম সেইরাতে? সেই পুরনো একান্ত রাতে? আমার কৈশরের কামনা! যাকে অসম্পূর্ণ করে রেখেছিল ঈশ্বরের নিষ্ঠুর ইচ্ছা!
যাই হোক, কিছুক্ষণ পরে লো আমার কোল থেকে নেমে গেল। আমি আমার হাত দিয়ে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম, আর ও ভাবছিল এও এক খেলা কোনো! আসলে কি কোনো খেলা? নাকি আমার বেঁচে থাকার উৎসাহ? যার সম্পূর্ণ আবেগ জড়িয়ে রেখেছে ওই সুরটুকু! আমার প্রিয় সেই সুর, সেই গান। এরপর থেকে এই গানটা এত ভাল লাগত, যতবার শুনতাম, আমি অনুভব করতাম সেই মুহূর্তগুলো। উফফ! কী ঐশ্বরিক সেই গান। গানটা এরকম ছিল-
কারমেন, ও আমার নিতান্ত, হে কারমেন!
কিছু কিছু কিছু রাত, সেই রাতগুলো-
তারাগুলো, গাড়িগুলো, বার সব, আর বারমেন
আর আর হে আমার স্নিগ্ধ রৌদ্রময় লড়াইয়ের ধুলো।
সেইসব শহরের অনেক আনন্দে, হৃদয়ে হৃদয় মেখে যেন
আমরা ও আমাদের শেষ সারি গিয়েছিলো সেইসব ভূমি,
হায় কারমেন, যে বন্দুকে করেছি তোমাকে খুন, কেন-
সেই বন্দুকটাকে আজ ধরে আছি আমি!
১৪.
দুপুরে বাইরে খেতে বের হলাম একা। মনে হচ্ছিল আমি বছরের পর বছর ধরে না খেয়ে আছি; এতটাই ক্ষুধার্ত লাগছিল নিজেকে। বিকেলটা শুয়ে বসে কাটালাম। ভাবতে লাগলাম সকালের ঘটনা নিয়ে। আহ! কী আবেশ নিয়ে আমার ভিতরে সেই অনুভূতি দোল খেয়ে যাচ্ছে।
খুব ভাল লাগল এইভেবে, আমার যৌনতা তৃপ্তি পেয়েছে, কিন্তু লো’র কুমারীত্ব নষ্ট করিনি আমি। এরচেয়ে ভাল আর কী হতে পারে! ওর কোনো ক্ষতিই আমি করিনি। আমি অপরাধী নই। যেন কারো জামার উপর কেউ শ্যামপেইন ঢেলে দিয়েছে, কিন্তু জামার কোনো ক্ষতিই হল না। যেন আমার ললিতা ঠিক ললিতা নয়, ললিতাতর কেউ। বা এরচেয়েও বেশি কিছু হয়ত।
সবচেয়ে ভাল ব্যাপার হল, ললিতাও কিছু বুঝতে পারেনি। আমি তো ওর কিছুই করিনি। ফলে নিজেকে অপরাধী ভাবার কোনো সুযোগই নেই। আমি এই সুযোগ বারবার পেতে চাই। বিকেলের শেষের দিকে আমার এই কামনা আরো গভীর করে জেঁকে বসল। এই ভাল লাগা আরো চাই আমার! যে করেই হোক। আমার ললিতাকে আমি শুদ্ধ রাখতে পেরেছি, ললিতা শুদ্ধই থেকে যাবে। আমার চাইতে আর কারো কাছেই সে এতটা নিরাপদ নয়।
আমি আমার এতগুলো বছরের জমানো সব ব্যথা বেদনা মুছতে শিখে যাচ্ছি। রাতে খাবার টেবিলে দেখলাম মিসেস হেইজ যথেষ্ট আপ্যায়ন করছেন। কারণটা ধরতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পরে খাওয়া যখন শেষ তখন বোম ফাটালেন যেন। জানালেন, মিসেস চেস্টফিল্ডের মেয়ে ফিলিস আগামীকাল সামার ক্যাম্পে যাচ্ছে কিছুদিনের জন্য। প্রায় তিন সপ্তাহ সেখানে থাকবে। উনি ললিতাকেও সেখানে পাঠাতে চান। স্কুল শুরু হবার সময় চলে আসবে।
আমার মনে হচ্ছিল কেউ আমার কাছ থেকে নির্মম নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত কোনো শাস্তি দিচ্ছে আমাকে। কেউ আমার ললিতাকে কেড়ে নিতে চাচ্ছে। আমি যে ললিতাকে আমার করে নিয়েছি, আমার অবিচ্ছেদ্য এক অংশ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছি তা কি কেউ বুঝতে পারে না? কতটা আবেগ ওর প্রতি আমার! কেউ বোঝার নেই? আমাকে দেখে কিছু একটা ভাবলেন ভদ্রমহিলা। বললেন, ‘মসিয়ে, কোনো সমস্যা হচ্ছে?’
বললাম, ‘আমার দাঁতটা প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে।’
উনি বললেন, ‘আমার পরিচিত একজন ডেন্টিস্ট আছেন। কাছেই থাকেন। ড. কুইল্টি। আপনি চাইলে তাঁর কাছে যাওয়া যেতে পারে।’
‘না, দরকার নেই। সেরে যেতে কতক্ষণ।’
‘তা ঠিক। আর ডলরিসকে পাঠানোর ব্যাপারে আপনার কী মতামত? আমার ধারণা ও আপনাকে খুব জ্বালাচ্ছে বাড়িতে অলস থেকে থেকে। এরচেয়ে ভাল ওর স্কুল শুরু না হওয়া পর্যন্ত সামারক্যাম্পে থেকে আসুক দুইমাস। ফিলিস চমৎকার মেয়ে। ওকে অপছন্দ করবে না নিশ্চয়ই। ওর সময়টা ভাল কাটবে।’
বোকা বোকা ভাব নিয়ে বললাম, ‘আপনি কি শিউর, ও ওখানে ভাল থাকবে?’
‘নিশ্চয়ই। ক্যাম্পটার দায়িত্বে আছে শিরলি হোমস। উনি যথেষ্ট ভাল। ডলরিস উনার কাছে অনেককিছু শিখতে পারবে। বিশেষ করে অন্য কারো সাথে কী রকম ব্যবহার করতে হয় সেটা ভালই শিখবে। আচ্ছা, আপনার দাঁত কি খুব ব্যাথা হচ্ছে? আপনি চাইলে এখনই ড. ইভর কুইল্টির সাথে যোগাযোগ করতে পারি।’
‘না, তার দরকার হবে না। আমি একতা ব্যথার ওষুধ খেয়ে নিব।’
‘আচ্ছা। তবু যদি কাল সকালে ব্যথা থাকে তাহলে তাঁর কাছে যেতেই হবে। হেলাফেলা করা ঠিক হবে না। চলুন পিয়াজ্জায় কিছুক্ষণ বসি? নাকি শুয়ে পড়বেন? দাঁতের বিশ্রাম দরকার।’
দাঁতের বিশ্রাম নেয়াই ভাল তাঁর সাথে পিয়াজ্জায় বসার চেয়ে।
রনক জামান
কবি ও অনুবাদক ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১, মানিকগঞ্জে জন্ম। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : অগ্রন্থিত ওহী [তিউড়ি, ২০১৯] এবং ঘামগুলো সব শিশিরফোঁটা [অনুপ্রাণন ২০১৬]