কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর একটি চিরন্তনী উক্তি, “দেশের নাম বাংলাদেশ আর মানুষের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”— সেই মানুষ নামের এক নক্ষত্র তিনি, চলে গেলেন না—ফেরার দেশে। টরন্টোতে কবিকে কাছে পেয়েছিলাম। তাঁর একুশে পদক প্রাপ্তি উপলক্ষে ক্বণন সংগঠন থেকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল। খুবই অন্তরঙ্গ সময় ছিল আমাদের। আজ তাঁর বিদায় ক্ষণে মনে পড়ছে সেসব কথা। এর পরেও বাংলা একাডেমিতে, একুশের বইমেলায় দেখা হয়েছে। তবে সেদিনের স্মৃতিটা বড় বেশি অম্লান। মনে পড়ে, গদ্যকার প্রাবন্ধিক সুব্রত কুমার দাস কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী সম্পর্কে এবং তাঁর কবিতার প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছিলেন, ষাটের দশকের শেষার্ধে আবির্ভূত কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী মুক্তিযুদ্ধ ও আধুনিক বাঙালির সাম্প্রতিকতম বিবর্তনে নিজস্ব কাব্যধারা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন এবং তাঁর কবিতা সমাজ-ইতিহাস-সমকালের নান্দনিক সাক্ষী বটে। তিনি আরো উল্লেখ করেন, স্বাধীনতা পরবর্তী কবির কাব্যচর্চার উওরণের সময় সহযাত্রী ছিলেন অনেক প্রথিতযশা কবি, যাদের কারণে আজ বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য ঋদ্ধ ও শক্তিমান হয়েছে এবং সেই সাথে বাংলা সাহিত্যকে এনে দিয়েছেন নিজস্ব এক ধারায়; তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্যোগ্য ছিলেন কবি শামসুর রহমান, কবি শহীদ কাদরী, কবি রফিক আজাদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে কবি নিজেও বক্তব্য রাখেন,যেখানে তুলে ধরেন বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক বৈপরীত্য। নিজের কবিতার অংশ উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন,”ইতিহাস যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন মানষও নষ্ট হয়ে যায়।” একইদিনে টরন্টোর আরেক স্বনামধন্য মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ডঃ মোজাম্মেল খানের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘প্রবাস থেকে দেখা বাংলাদেশের রাজনীতি’র প্রকাশনা উৎসব ছিল। বলাই বাহুল্য যে, ডঃ মোজাম্মেল খান এবং কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী হলেন ঘনিষ্ট বন্ধু। তারই প্রেক্ষিতে কবি সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংগ্রামশীল ইতিহাস, মহান মুক্তিযুদ্ধ, মানুষ এবং প্রগতির অভিযাত্রা ভাস্বর হয়ে আছে তার প্রায় অর্ধশত কবিতা বইয়ে। শুধু কবিতা নয়, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর গদ্য যেন তার কবিতারই সহোদরা, আবার তা স্বতন্ত্রও বটে। তার বক্তব্যে বন্ধুত্বের হৃদ্যতা ভেসে ওঠে। জানি,আজ তিনি বন্ধু হারানোর বেদনায় ব্যাথাতুর হয়ে আছেন।
ক্বণন সংগঠনের আয়োজনে, যার কর্ণধার লেখক তাসরীনা শিখা, তারই পরিচালনায় অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। ক্বণন এবং পয়েম ওয়ার্ল্ডের এমন আয়োজনে কবির সান্নিধ্য পুরো অনুষ্ঠানে ভিন্নমাত্রা এনেছিল। কবির কবিতা আবৃত্তি ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মাহমুদ হাসান এবং আঞ্জুমান রোজী। কবির প্রতি শুভেচ্ছা বক্তব্য রেখেছিলেন লেখক তাসরীনা শিখা। পুরো অনুষ্ঠানটি ছিল যেন এক মিলন মেলা।
সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা বিষয়ভাবনার সুগভীর বৈচিত্র্য নিয়ে প্রকাশিত, যারমধ্যে রয়েছে অকপট শৈল্পিক সিদ্ধি। ব্যক্তির একান্ত চিন্তাভাবনাকে যেমন তিনি নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনায় প্রতিভাসিত করেন তেমনি সময়-সমাজ-দেশ ও বিশ্বপরিস্থিতির সহজ-সরল উদ্ভাসন ঘটে তাঁর পঙ্ক্তিতে আর অন্তর্নিহিত অনুভাবনে। বিবরণমূলক গদ্যধারার বিপরীতে সংবেদনশীল মনের বিচিত্র-বর্ণিল-ব্যতিক্রম ছায়া পড়েছে তাঁর প্রাবন্ধিক গদ্যগুচ্ছে; যা ধারণ করেছে বাংলা ও বিশ্বসাহিত্য-সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ। তাঁর আখ্যানমূলক ও আত্মজৈবনিক রচনাও অনন্যতার দাবিদার। এছাড়া অনুবাদ সাহিত্যে রয়েছে তাঁর অফুরান অবদান। বলতে গেলে এটি তাঁর প্রিয় ভুবন, যেখানে রুমী কিংবা রসুল হামজাতভকে আমরা বাংলায় পাই। শিশুকিশোর সাহিত্যে হাবীবুল্লাহ সিরাজী স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। আধুনিকমনষ্ক নতুন প্রজন্মের বোধে বিশেষ প্রিয়তায় ধরা দেয় তার ছড়া, কবিতা এবং এ জাতীয় শিশুতোষ-কৈশোরিক রচনা। সবমিলিয়ে বাংলা সাহিত্যে হাবীবুল্লাহ সিরাজী এক বিশিষ্ট নাম যার বিবিধ রচনা অনূদিত হয়েছে বহু বিদেশি ভাষায়।
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী ৩১শে ডিসেম্বর ১৯৪৮ ফরিদপুর জেলার রসুলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৩২। এছাড়া উপন্যাস, শিশুতোষ গ্রন্থ, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা মিলিয়ে অর্ধ শতাধিক গ্রন্থের লেখক তিনি। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে আছে— দাও বৃক্ষ দাও দিন, মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি, মধ্যরাতে দুলে ওঠে গ্লাশ, নোনা জলে বুনো সংসার, সিংহদরজা, বেদনার চল্লিশ আঙুল, কতো কাছে জলছত্র, কতোদূর চেরাপুঞ্জি, সারিবদ্ধ জ্যোৎস্না, বিপ্লব বসত করে ঘরে, কাদামাখা পা, যমজ প্রণালী, হাওয়া কলে জোড়া গাড়ি,স্বপ্নহীনতার পক্ষে, পোশাক বদলের পালা, ছিন্নভিন্ন অপরাহ্ন, সারিবদ্ধ জ্যোৎস্না, মিথ্যে তুমি দশ পিঁপড়ে, আমি জেনারেল ইত্যাদি।
কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী ২০১৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়া ১৯৯১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ দেশি-বিদেশি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছেন। কবি সিরাজী ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে মৃত্যু অবধি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে তিনি খুবই বলিষ্ঠ হাতে সফল একুশের বইমেলা পরিচালনা করেছিলেন। তাছাড়া, আশির দশকে জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনে ভূমিকা রাখেন। হাবীবুল্লাহ সিরাজী জাতীয় কবিতা পরিষদে নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে চারবার দায়িত্ব পালন করেছেন। যদিও পেশায় ছিলেন বুয়েট থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত বিশিষ্ট প্রকৌশলী, তবে তিনি কবি হিসেবে বেশি সমাদৃত হয়েছেন। সোমবার (২৪ মে) রাত ১১টায় কবি চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিরনিদ্রায় শায়িত হন। আজ কবির অনন্ত যাত্রায় গভীর শ্রদ্ধাভরে অবনত মস্তকে বিদায় জানাই। জানি কবির মৃত্যু নেই। তাই কবিতায় খুঁজে নেই তাঁকে…
ভয় ও মৃত্যু
হাবীবুল্লাহ সিরাজী
ভয় সামনে এলে উল্টে যায় চিত্রফল
জলের বিলাস থেকে রৌদ্রের সাহস
সে সরল হ’তে পারে অথবা সবল
তাকে অতিক্রম করে খাটো তীব্র ফ্রেম
ফিরিস্তির কোনো অংশ বুঝি সত্য মৃত্যু
ভয় যদি নদী ও অন্ধকারের ঝুল
কিংবা কোনো নির্ধারিত যাত্রায় বদল
বালিঘড়ির ওপাশে পুষ্প কিংবা ফেনা
গিঁট ছুঁয়ে কোনো মুগ্ধ বুঝি মিথ্যা মৃত্যু
ভয় যদি আজ তবে মৃত্যুর আগামী
খুলে দেয় অন্ধ সম্মোহন
মেলে দেয় নগ্ন বিবেচনা
ফের দগ্ধ ফের মাটি
পুনরায় নবীন সূচনা।
আঞ্জুমান রোজী
আঞ্জুমান রোজী: ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি কানাডা প্রবাসী। কবিতার প্রতি প্রেম বেশি হলেও গদ্য এবং গল্প লেখায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।এ পর্যন্ত তার তিনটি কবিতাগ্রন্থ, দুটি গল্পের বই এবং একটি গদ্যের বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম কবিতার বই, ‘এক হাজার এক রাত’ (২০১০) , এবং গল্পের বই ‘ মূর্ত মরণ মায়া'(২০১২) সাকী পাবলিশিং ক্লাব থেকে প্রকাশিত হয় । ২০১৩ ও ২০১৫ তে নন্দিতা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কবিতার বই ‘বৃষ্টির অন্ধকার’ এবং তৃতীয় কবিতার বই ‘নৈঃশব্দ্যের দুয়ারে দাঁড়িয়ে’।২০১৭তে গদ্যের বই অনুপ্রাণন প্রকাশনা থেকে ‘মুখর জীবনগদ্য’ এবং চৈতন্য প্রকাশনা থেকে ২০১৯এ গল্পগ্রন্থ ‘সবুজ পাসপোর্ট ও অন্যান্য নিঃসঙ্গ গল্প’ প্রকাশিত হয়।ভ্রমণবিলাসী আঞ্জুমান রোজী লেখালেখির পাশাপাশি আবৃত্তি শিল্পের সঙ্গেও জড়িত আছেন । বাংলাদেশের অন্যতম সেরা আবৃত্তি সংগঠন- ‘কন্ঠশীলন’ এবং বাংলাদেশ গ্রুপথিয়েটারভুক্ত নাঠ্যসংগঠন- ‘নাট্যচক্র’র তিনি সদস্য ছিলেন।বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ করে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ সাক্ষী নিয়ে গঠিত গবেষণামূলক আর্কাইভ 1971GenocideArchive এর সঙ্গে জড়িত আছেন।