শিশিরের ষোড়শী সময়
সুরম্য স্থাপত্যরাজি ধ্বসে যাবে —
ধ্বসে যাবে একদিন
আমি তার শব্দ শুনি …..
মগজে চুন, সুরকি, কড়িকাঠের মাতম নিয়ে
যখনই তুলোটে তোমার নক্সা আঁকি,
যুগল কুচের মতো সুগোল তুমি
শিশিরের ষোড়শী সময় ক্ষণিকা—
কামে দীপ্র নও,
প্রশান্তি ও যন্ত্রণার যুগল বলয়
তুমিই একমাত্র স্বজন,
শূন্য সংখ্যার বৃত্তে নিহত আমার প্রণয়।
যুগ যুগ তোমার ধ্বনি বাজে পৃথিবীতে…..
শর্করা সন্ধানী পিপীলিকার মতো কাটে কাল
দুঃসহ.. .. দুঃসহ,
শূন্যতায় শূন্যতায় ছড়ানো তোমার
নির্জন দেহ,
বৃত্তের প্রণয়ে এমনই জড়ালে
অধুনা সত্যিই দুর্লভ বিরহ।
কখনো নিসর্গে… কখনো যন্ত্রে… মানুষে
নিয়ত নিখুঁত রূপ বদলাও… হে বহুরূপী বিভা
শরীরে কুহক তৃষা নিয়ে
আমি নিদাঘ দুপুর শত অমা রজনী
তোমাকে দিলাম,
তুমি পঙ্গপালের মতো নেমে এসো
মগজের সবুজ কোষে,
দেহের ত্বক ও তন্তুতে
চঞ্চুতে অম্লের সৌরভ নিয়ে এসো;
আমরা প্রাণের যোগচিহ্নে কথা বলবো পরস্পর,
মৃত্তিকার মানুষী নয়—
তার চেয়েও অধিক অবাক রোমাঞ্চকর;
সেই সব নিদাঘ দুপুরে হংসমিথুন আহা
ধনুকের ভালোবাসায় অক্লান্ত স্থির হবে,
সেই সব অমা রজনীর কাজলে জ্বলবে
তেজস্ক্রিয় আঁধার।
বৃত্তের গভীরে হে উজাড় অপ্সরী
এসো…..
চঞ্চু রাখো
খিন্ন ললাটে এঁকে দাও চুমুর প্রবাল,
জানি— দেহ নয়
রোমাঞ্চিত হবে আমার কংকাল।
সম্ভ্রান্ত বিরহ
যে তুমি সভ্যতার প্রারম্ভে
হিংস্র পশু শিং এর তৈজসে পান করতে ভেষজ আরক,
অরণি চমকের মতো সে সব স্মৃতি জ্বলে চেতনায়—
কোন এক বাদকের উদাসীন ধ্বনির মতো
তোমার বেদনা এসে কানে বাজে;
এই তো সেই প্রস্তর যুগ হতে বহমান বাতাস
যেখানে তোমার দীর্ঘশ্বাসের প্রলাপ জড়ানো,
আমি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে যখনই অম্লজান পান করি
আদিম স্মৃতি কোলাহল করে কথা কয় ধমনীতে,
কালের করাল আক্রমণে আমি তো
তোমারই মতো হরিৎ— বিব্রত,
পৌরাণিক সাম্যবাদ আমারে করেনি সম্মানিত।
সময় অথবা দুঃসময়.. .. ..
প্রহরের অমোঘ আক্রমণে মলিন হয় মৃগের চিত্রল প্রচ্ছদ,
বনানীর সজীব রূপ মুছে গিয়ে জ্বলে কয়লার কৃষ্ণাভ আভা,
কিছুই শাশ্বত নয়— তুমি কিংবা আমি
ধ্রুব নয় মরালের মৌসুমী গতিপথ,
হাজার .. .. হাজার .. .. হাজার বছরে
বদলে যায় ধ্রুবতারার সবুজ স্বরূপ।
সারাদিন.. .. সারাদিন.. .. বালুকণা ধূসর
দুঃস্বপ্নের মতো নীলাভ হয়ে নামে রাত,
সৌরলোকের উত্তপ্ত আবিরে প্লাবন আসে পৃথিবীতে
বন্যায় ভাসে মৃত মানুষ.. .. গবাদিপশু..
মেঘ মৌসুমের রূপালি বরষায়ও
হয় না সুদূর.. মরুভূমি—
পিপাসিত দহনে ফাটে ছাতি
এমন বিশুষ্ক সময়
আমার রক্তপাত
মর্মান্তিক মৃত্যুতেও সৃজিত হয় না
ফণীমনসার সজল উদ্যান।
হায় অজর সময়—
তোমার চোখে ইয়াজিদের নির্মম .. .. নির্মম দৃষ্টি,
বিরুদ্ধ প্রতিবেশে বৃত্ত রচনা করে সশস্ত্র সেনানী;
পরিত্যক্ত প্রান্তরে অস্ত্রহীন নিঃসঙ্গ একা.. একা,
পরাজয় নিশ্চিত জেনে নিজেই খুঁড়ি কবরের অন্তিম পরিখা।
প্রস্তর যুগ হতে বহমান বাতাসে আজো লেগে আছে
তোমার দীর্ঘশ্বাসের সৌরভ
আরকের মাধুরী,
আমি নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে স্মৃতিময়
অজর অম্লজান পান করি..
জানি আমার এ সম্ভ্রান্ত বিরহ নিয়ে
কোন দিন কেউ ভাববে না,
ভেবে ভেবে নিশি জাগবে না,
তবে কেন এ মর্ম বিধুর বিলাপ বলো।
সর্বহারা গোলাপ
সারারাত ভর চেয়ে থাকি …
চোখে অতলে জ্বলে দৃশ্যের আঁধার
বুঝিবা নর্তকী এক উজাড় করেছে বুকের চন্দ্রিমা—
সারারাত ভর চেয়ে থাকি,
এই কৃষ্ণপক্ষের ঘোরলাগা নিশীথ
অবাক দৃশ্যের চাঁদনী,
আমাকে নভশ্চরের মতো মেঘে মেঘে
উড়াল দিয়ে নিয়ে যায়—
বুঝিবা পৃথিবীর অনন্ত আঁধারে
নেপচুন ফিরেছে সুবর্ণ আলোর রেখা,
কতকাল…
কতকাল…
এমন নিরজনে স্পন্দন, উচ্ছ্বাস, প্রাণ নেই।
এখন দ্যাখো
চেয়ে দ্যাখো…
চন্দনের তন্বী উদ্ভিদ নর্তকীর মতো ছড়ায়
জ্যোৎস্নার তরতাজা সৌরভ,
তার শাখায় ঝাঁক ঝাঁক টিয়ে—
সূর্যাস্ত রঙিন ঠোঁট;
পালকে আধফোঁটা কিশোরীর উচ্ছ্বাস
তবু তারা উড্ডীন হবে না,
যাবে না মহাকাশ কুহেলিতে;
সবুজাভ ষোড়শীরা হরিৎ পৌরুষের কাছে
রেখেছে যৌবন বাজি…
সারারাত ভর চেয়ে থাকি—
ডাহুকের করুণ অশ্রুর মতো শিশির ঝরে
ভিজে যায় টিয়ের চোখ, চন্দনের শরীর;
যে সব দৃশ্যের বর্ণীল শাঁকচুন্নি
আজীবন আমাকে
কামে.. .. ক্রোধে.. .. অপমানে অপচ্ছায়ার মতো
ক্লান্ত করেছে
ক্লান্ত করেছে
এখন দ্যাখো
চেয়ে দ্যাখো
তারা সব সর্পখোলসের মতো পড়ে আছে
নেপচুনের কুহক আলোয়;
বুঝিবা হরিৎ প্রণয়ে আমি সব হারিয়েছি
হৃদয়ের অনুপম উষ্ণ অনুরাগ,
যেন বা আমারই সব হারানোর সর্বহারা গোলাপ —
কৃষ্ণপক্ষে রূপালি চাঁদনী…..
চন্দন বনে
সে কার… প্রার্থনার
গাঢ় উচ্চারণের মতো
বাজে বাতাসের করুণ খেয়াল।
মঈনুস সুলতান
জন্ম সিলেট জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিষয়ে ডক্টরেট করেন। বছর পাঁচেক কাজ করেন লাওসে-একটি উন্নয়ন সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ হিসাবে।
খণ্ড-কালীন অধ্যাপক ছিলেন ইউনিভারসিটি অব ম্যাসাচুসেটস এবং স্কুল অব হিউম্যান সার্ভিসেস এর। কনসালটেন্ট হিসাবে জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিক, মেসিডোনিয়া ও কিরগিজস্তান প্রভৃতি দেশে কাজ করেন অনেক বছর।
ইবোলা সংকটের সময় লেখক ডেমোক্রেসি এন্ড হিউম্যান রাইটস নামে একটি ফান্ডিং কর্মসূচির সমন্বয়কারী হিসাবে সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউনে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাভানা শহরে বাস করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রাচীন মুদ্রা, সূচিশিল্প, পাণ্ডুলিপি, ফসিল ও পুরানো মানচিত্র সংগ্রহের নেশা আছে।
বাহ্, অনেক ভালো লাগলো…