আনোয়ারা সৈয়দ হকের গল্প: সংকট

যে ঘরটার ভেতরে সে বসে আছে সেখানে আর কেউ নেই। পশ্চিম পাকিস্তানে নন কমিশন্ড একজন ফ্লাইট সার্জেন্ট এসে তাকে সেখানে যত্ন করে বসিয়েছে। সে নিজে একজন এয়ারফোর্সের বাঙালি অফিসার। আদতে একজন ডাক্তার। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট র‍্যাংক। আজ তার নিজের মেডিক্যাল স্কোয়াড্রনে ঢুকতেই ওপর থেকে একটা ফোন এলো তার স্কোয়াড্রনের হেড পশ্চিম পাকিস্তানী স্কোয়াড্রন লিডার মাহতাবুল রাহিমের কাছে। আর সেখানে কিছু কথা হতে স্কোয়াড্রন লিডার রাহিম তাকে ইন্টারনাল টেলিফোনে বলে উঠলেন, আর ইউ বিজি নাও, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আফসার?

নট অ্যাট অল, স্যার। এ প্রান্তে বিনীত ভাবে বলে উঠেছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আফসার। কিন্তু তার পর মুহূর্তেই বুক কেঁপে উঠেছিল কিছু একটা আশঙ্কা করে। কিন্তু কী যে, তা সে বুঝতে পারেনি।

একটু পরে স্কোয়াড্রন লিডার রাহিমের ঘরে ঢুকতে তিনি ভদ্রতা করে বলে উঠেছিলেন, ডক্টর সালেহা, ইউ হ্যাভ বিন কলড বাই দ্য স্টেশন কমান্ডার জাস্ট নাও, ক্যান ইউ গো দেয়ার টু মিট হিম?

বস- এর কথা শুনে একটু যেন ভীত হয়ে তাকিয়েছিল সালেহা। সালেহা আফসার। কারণ এই তিন বছরের ভেতরে কোনোদিন কোনো স্টেশন কমান্ডার তাকে তলব করেনি। সে পর্যন্ত সে এখনও পৌঁছতেই পারেনি। সে এয়ারফোর্সের সাধারণ একজন মেডিক্যাল অফিসার। র‍্যাংকটা শুনতে যত জমকালো মনে হোক না কেন, আদতে এর ভেতরের খবর খুব করুণ। এখনও সে আর্মি মেডিক্যাল কোরের নানাবিধ আদব কায়দা চাল চলন রপ্ত করে উঠতে পারেনি। এমনকি রাওয়ালপিন্ডি থেকে ছ’সপ্তাহের রগরগে লেফটরাইট ট্রেনিং করে আসার পরও। এখনও ঢাকা মেডিকেল কলেজের সেই বন্য এবং বেপরোয়া ভাব তার ভেতরে রয়ে গেছে। এই ধরণের চাকরি করার তার কোনো ইচ্ছেই ছিল না কোনোদিন। কিন্তু তার এক দূর সম্পর্কের দুলাভাই কোত্থেকে হাজির হয়ে ঢুকিয়ে দিল পাকিস্তান আর্মি মেডিকেল কোর-এ। সে নিজেও পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের একজন অফিসার। কিন্তু অন্য শাখায়। যে শাখার নাম সিগন্যাল কোর। দুলাভাই বলল, আরে শ্যালিকা, আর কতদিন তিনশো টাকার চাকরি করবে। বাবা মা ভাইবোন আছে না? বিয়ে থাওয়া করতে হবে না? এইভাবে কতদিন চলবে? ঢুকে পড় আর্মির ডাক্তার হয়ে। সারা পাকিস্তান বিনা খরচায় ঘুরে ঘুরে বেড়াবে ডাঁটের সঙ্গে। রেশন ফ্রি। দুদিন বাদে গাড়ি পাবে। জমিজমা পাবে। জীবন একবারে নিশ্চিন্ত। আর পশ্চিম পাকিস্তানে পোস্টিং হলে তো কথাই নেই। ফল খেয়ে খেয়ে এই মোটা তাজা হয়ে পড়বে অচিরেই!

তারপর তাকে ইন্টার্ভিউয়ের মাধ্যমে আর্মি মেডিকেল কোর-এ ঢুকিয়ে দিয়ে দুদিন বাদেই এয়ারফোর্সে ট্রান্সফার করে ফ্লাইং অফিসার র্যাংক-এ বসিয়ে সেই দুলাভাই পশ্চিম পাকিস্তানে ট্রান্সফার হয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল।

আর এদিকে উতলা একটা মন নিয়ে সালেহা অপেক্ষা করতে লাগল সামাদের দেশে ফিরে আসার। সামাদ তার দু’ক্লাস ওপরে পড়ত মেডিক্যাল কলেজে। এফ আর সি এস করতে গিয়েছে সে ইংল্যান্ডে। পার্ট ওয়ান পাশ করে ফেলেছে সেখানে যাবার পরপরই। কিন্তু এখনও পার্ট টু পাশ করতে পারেনি। আর পারেনি বলেই সে এখনও আটকে পড়ে আছে শেফিল্ডে। পাশ করার পরপরই সে দেশে ফিরে আসবে। তারপর তাদের দুজনের বিয়ে হবে। বিয়ের পর সে সামাদকে অনুরোধ করবে আর্মি মেডিকেল কোরেই জয়েন করতে। দুজনে মিলে এখানে চাকরি করলে তাদের আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না। সামাদকেও তো তার পরিবার দেখতে হবে। তারা দুজনেই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ে, তাদের কাঁধে অনেক দায়িত্ব।

কিন্তু সেসব যেন ক্রমশ স্বপ্ন হয়ে যাচ্ছে। দুজনের ভেতরে শুধু এখন চিঠির যোগাযোগ। ভীষণ এক অপরাধবোধে ভুগছে সামাদ। শেষ বারের চিঠিতে লিখেছে, আমি কি ফাইনাল পরীক্ষাটা পাশ না করেই চলে আসবো, মনি জানো, তোমাকে না দেখে থাকতে থাকতে আমি যেন তোমার চেহারাটাই ভুলে গিয়েছি। নাকি, তুমি চলে আসবে এখানে?
না, সালেহা এখন সেখানে যাবে না। সে আর্মি মেডিকেল কোর থেকেই বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যাবে। সেরকম সুযোগ আছে এখানে। কিন্তু তার আগে তাকে পাঁচ বছর এখানে কাজ করতে হবে। তাছাড়া উচ্চশিক্ষার জন্যে তার ভেতরে অতোটা টানা পোড়েন নেই। এখন তাকে বিয়ে করতে হবে প্রথম। তারপর বাচ্চার মা হতে হবে। মেয়েদের রিপ্রোডাকটিভ পিরিয়ড খুব সর্ট। সময়ে সবকিছু সারতে হবে। বিদেশে বাচ্চা নিয়ে লেখাপড়া করা খুবই কষ্ট।

কিন্তু সেসব চিন্তা এখন স্কোয়াড্রন লিডার সালেহা আফসারের মনের ধারে কাছেও নেই। সে এখন এয়ারফোর্স স্কোয়াড্রনের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ উইং এর চৌকো অফিসঘরের ভেতরে চুপ করে বসে আছে। বসে থাকতে থাকতে তার নাক ঘেমে যাচ্ছে। ঘরের ভেতরে সিলিং ফ্যান ঘুরছে বোঁ বোঁ করে। তবু তার নাকে ঘাম জমে যাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে কি কোনো অভিযোগ? কোনো এয়ারফোর্সের ওয়াইফকে সে কি হেলাফেলা বা অযত্ন করে দেখেছে? অথবা তাদের পরিবারের কোনো সদস্যকে? সালেহার জানা মতে সে কোনোদিন কোনো অফিসারের স্ত্রী বা ছেলেমেয়েকে অযত্ন করে দেখেনি। নন কমিশন্ড অফিসারদের স্ত্রী বা তাদের ছেলেমেয়েদেরকেও নয়। কারণ সে জানে একবার যদি কোনো অফিসারের পরিবার বা অফিসার নয় কিন্তু বিমানবাহিনীতে চাকুরীরত ননকমিশন্ড কোনো কর্মচারী বা তার পরিবার কোনো প্রকারের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে এনে হাজির করে তাহলে তার চাকরির দফারফা।

হয়ত চাকরি চট করে চলে যাবে না, কিন্তু প্রমোশন আটকে থাকবে। জুনিয়ররা তর তর করে তার ওপরে উঠে যাবে বড় সব র্যাংক হাতের মুঠোয় ভরে। তাদের ইউনিফরমের কাঁধে লাগানো থাকবে সেইসব র্যাংকের মহিমা। আর সে পড়ে থাকবে যে তিমিরে সে তিমিরেই। সে এক যমযন্ত্রণা যে কোনো সামরিক অফিসারের কাছে। এবং লজ্জার ঘটনাও বটে! তাই এ ব্যাপারে সে সর্বদাই সতর্ক থেকেছে। সবসময় তারা আসা মাত্র হাসিমুখে তাদের অভ্যর্থনা করেছে। কোনো কোনো সময় তাদের চা দিয়ে আপ্যায়নও করেছে, যদি সময় হাতে পেয়েছে। অনেক সময় অফিসারদের স্ত্রীরা নিজেদের শরীরের ব্যাপারে কাল্পনিক সব অসুখের বিবরণ দিতে থাকলে তা কান পেতে এবং ধৈর্য ধরে দিনের পর দিন শুনতে শুনতে কখনো সে মনে মনে খাপ্পা হয়ে উঠেছে, কখনো বা মনে হয়েছে ধাক্কা মেরে রোগীকে চেয়ার থেকে ফেলে দেয়, যখন রোগীর শরীরে কোনো রোগের বালাই-ই নেই! তবু অকৃত্রিম হাসিমুখে সেই অত্যাচার সহ্য করেছে! মনে মনে বলেছে, সুখে থাকলে ভূতে কিলোয়! কোনো শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় না, কিছু করতে হয় না, তারপরও কোমর ব্যথা, মাথা ব্যথা। যতসব ঢং!

কিন্তু মুখ ফুটে কোনোদিন কাউকে কিছু বলেনি। কারণ এই চাকরি ধরে রাখার পেছনে সুখ আছে, স্বস্তি আছে। মাসের শেষে একটা সুন্দর খয়েরি খামে করে তার মাইনের বিবরণ চলে আসে হাতে। সেখানে সবকিছু যোগ বিয়োগ বাদে যে মাইনেটা হাতে আসে, তার পরিমাণ এত বেশি যে বাইরের যে কোনো বেসামরিক ডাক্তারের তিন মাসের অধিক বেতন। তার ওপর এতসব সুযোগ সুবিধে। এটা সিভিলিয়ানের চাকরি নয় যে মেডিকেল কলেজের পিয়ন বশির হাতে খোলা চেক ঝোলাতে ঝোলাতে ‘এই যে সালেহা আপা, আপনের তিনশো ট্যাকার মাহিনার চেক সচিবালয় হইতে আনছি। সেকশন অফিসারের পিএর ট্রের ভিত্রে পইরা ছিল।’ একথা বলে তার হাতে এনে দেবে।

সুতরাং কে এরকম সম্মানের চাকরি একবার হাতে পেয়ে ছেড়ে দেবে? এমনিতে পূর্ব পাকিস্তানের কোনো তরুণ তরুণীদের তো সামরিক বাহিনীতে ঢোকার সুযোগ কম। তার দুলাভাই ছিল বলেই না এত সহজে সে চাকরিতে ঢুকতে পেরেছিল। নইলে হয়ত হাজার চেষ্টা করলেও এরকম চাকরি পেত না। তার আরও কিছু পুরুষ সতীর্থ ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করে পাকিস্তান আর্মি মেডিকেল কোরে-এ ঢুকেছে। তারা সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় চাকুরীরত। কেবল মাত্র সেই এখনও পূর্ব পাকিস্তানে। এই হিসাবে সে অবশ্যই খুশি। এখন মাকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারছে। ছোট দু ভাইবোনকে পড়াচ্ছে শাহিন স্কুলে। মাসের রেশন তুলে মায়ের হাতে দিচ্ছে। ক্যাটারিং ডিপার্টমেন্ট থেকে অতি অল্প দামে সে কিনে আনছে খাঁটি ঘি ময়দা বাসমতি চাল।
রেশন হাতে পেলে তার মা খুব খুশি হন। সালেহার বাবার অর্থাৎ সিভিলিয়ানদের রেশন ঘেঁটে তার বেশ অভিজ্ঞতা আছে, চালে প্রায় একটা বোঁটকা গন্ধ পাওয়া যায়, ডালের চেহারা নিষ্প্রভ। তেল, ডালডা যে খাঁটি নয়, তা তাদের দিকে একবার চোখ তুলে তাকালেই বোঝা যায়। কিন্তু সামরিক বাহিনীর রেশন এক অন্য জিনিস। তার মেয়ে সামরিক বাহিনীতে ঢুকে তাকে সুখের মুখ দেখিয়েছে। চাল, ডাল, তেল, ঘি, ডালডা, মাখন প্রতিটা খাদ্য খাবার এত তরতাজা আর ঝকঝকে যে, খাবার আগে শুধু তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে!

সালেহা মায়ের মনের কথা জানে। এবং জেনে খুব খুশি হয়।
এখন শুধু সামাদ তার পরীক্ষাটা পাশ করলেই হয়!

এতসব কিছু ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সালেহা আফসার ভাবছে ছোট্ট চারকোনা এই অফিস ঘরটিতে বসে। তার বাবার নাম আফসার উদ্দিন। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। ছোট একটা সরকারি চাকুরি করেন। অনেক কষ্ট করে তার প্রথম সন্তান সালেহাকে ডাক্তারি পড়িয়েছেন, কারণ সালেহা বরবরই লেখাপড়ায় ভালো ছিল।

সালেহার চোখের সামনে দেয়ালে ঝোলানো একটা ছোট্ট বোর্ডে লেখা আছে ‘ সিকিউরিটি অ্যান্ড ইউনিটি ইজ দি মটো অব নেশন’। আর বোর্ডের মাথার ওপরে কায়েদে আযম মোহাম্মাদ আলি জিন্নার একটি মাঝারি সাইজের ফটো। তার চেহারা রোগা কিন্তু রজু। মুখে হাসি নেই। কিন্তু কী যে আছে সেটাও ঠিক করে বলা যাবে না।

কিছুক্ষণ ফটোর দিকে তাকিয়ে থেকে সালেহা ভাবতে লাগল, কীসের সিকিউরিটি, কীসের ইউনিটি? কাদের উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে? কোন নেশন?

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সালেহা আফসারের মনের ভেতরে এখন হঠাৎ করে কেমন যেন করতে লাগল।

এদিকে দেশ জুড়ে চলছে অসহোযোগ আন্দোলন। সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। বাঙ্গালীর হাজার বছরের ইতিহাসে উত্তাল এক সময়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে সারা পূর্ব পাকিস্তানে এখন চলছে অসহযোগ আন্দোলন। কারণ সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচনে জিতেও তিনি পাকিস্তানের শাসনভার হাতে পাচ্ছেন না। পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলি ভুট্টো নির্বাচনের ফলাফল জানার পরপরই পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বৈরিতা শুরু করেছেন। জুলফিকার আলি ভুট্টো সামরিক শাসকদের উস্কানি দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে সমস্ত পাকিস্তানের শাসনভার তুলে না দেবার জন্যে। ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে বলছেন। পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শাসন, আর পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলি ভুট্টোর শাসন। এক পাকিস্তানে দু’জন প্রধানমন্ত্রী! এর ভেতরেই আবার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পহেলা মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছিলেন। কারণ তার ধারণায়, পাকিস্তান আজ চরম সংকটের সম্মুখীন। তাই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন তেশরা মার্চের পরিবর্তে অন্য কোনো এক তারিখে দেবেন বলে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার এই ঘোষণা পূর্বপাকিস্তানীদের আরও ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো জনসাধারণ বেরিয়ে পড়েছিল রাস্তায় সেদিন। সালেহা সেদিন স্কোয়াড্রনে ব্যস্ত ছিল। বাসায় ফিরতেই তার মায়ের মুখে কিছু কিছু শুনেছিল। তারপর বিকেলবেলা তার দুলু মামা ক্যান্টনমেন্টের বাসায় বেড়াতে এলে তার মুখে বিস্তারিত সবকিছু শুনেছিল। দুলু মামা বলেছিলেন, ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় নাকি মানুষের মুখে মুখে এমন সব স্লোগান উঠেছিল যা ক্যান্টনমেন্টের বাসিন্দারা কল্পনাও করতে পারবে না। স্লোগান উঠেছিল, বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। স্লোগান উঠেছিল, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। স্লোগান উঠেছিল, জাগো, জাগো, বাঙ্গালী জাগো, জয় বাংলা।

তারপর থেকে একেকটি দিন যেন একেকটি ইতিহাস। প্রতিদিন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা এখন ইতিহাস রচনা করে চলেছে। তাদের অজ্ঞাতেই তারা যেন শুনতে পেয়েছে মহা সাগরের কল্লোল।

বাসায় পাকিস্তান অবজারভার রাখে সালেহা। এটা এক ধরনের জায়েজ পত্রিকা, যা যে কোনো সামরিক অফিসাররাই পড়তে পারে। অফিসেও এই পত্রিকা আসে রোজ।
আবার বাসায় আছে সাদা কালো টেলিভিশন। পিটিভি। পাকিস্তান টেলিভিশন, ঢাকা। সেখানেও রোজ খবর শোনে সে। তবে খবর শোনার চেয়ে নাটক দেখতেই তার বেশি ভালো লাগে। তাই বেশির ভাগ খবর তার মানুষের মুখে মুখে শোনা। সে নিজের বাসার টেলিফোনেও কারও সাথে দেশের রাজনীতির বিষয়ে আলোচনা করে না। সামরিক বাহিনীতে যোগ দিলে এসব ব্যাপার একেবারে নিষিদ্ধ। তবে নিষিদ্ধ কেন, সেটা বুঝতে পারে না ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সালেহা। কারণ আজ কতবছর ধরে তো সামরিক শাসনই চলছে পাকিস্তানে। তাহলে রাজনীতি তো সামরিক অফিসারদের ঘরে ঘরে!
তবু কথা আছে। সিগনাল ডিপোর কে কোথায় বাঙ্গালী অফিসারদের টেলিফোন ট্যাপ করছে কেউ জানবে না।

সেদিন একজন বাঙ্গালী অফিসারের স্ত্রী টেলিফোন করে বলেছিলেন, ম্যাডাম, দেশের অবস্থা এত খারাপের দিকে যাচ্ছে যে তা আর বলার মতো নয়। আর এর মধ্যেই আমার স্বামীর পোস্টিং দিয়ে দিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায়। কীভাবে এখন আমরা সেখানে যাবো বলেন তো!

তার কথা শুনে কোনো উত্তর না দিয়েই সালেহা টেলিফোন রেখে দিয়েছিল। তার মনে এমনও সন্দেহ হয়েছিল যে হয়ত পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারদেরই কেউ তাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে বাঙ্গালী অফিসারের স্ত্রীকে দিয়ে ফোন করিয়ে তার মনের কথা শুনতে চাচ্ছে!

মেডিকেল কলেজে থাকতে সে অগ্রগামী পার্টি করত। সেই পার্টি ছিল পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার এক পার্টি। একবার ছাত্র নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সে জিতে গিয়ে সাহিত্য সম্পাদকও হয়েছিল। একটা ম্যাগাজিন বের করেছিল। এই পার্টির ছেলেমেয়েরাই ছায়ানটের রবীন্দ্র শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বটতলায় যোগ দিয়েছিল। সে তখন তুখোড় কবিতা মুখস্থ করতে পারত। বিশেষ করে রবি ঠাকুরের কবিতা তার খুব প্রিয় ছিল। সে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে গিয়ে বটতলায় দাঁড়িয়ে এক ফাঁকে খুব জোরে জোরে আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের প’র আবৃত্তি করেছিল। তখন তারা কেউ মোনায়েম সরকারের অনুশাসন মানেনি। তারা প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করত। সালেহাও তাদের সাথে ফেব্রুয়ারির ভোরে খালি পায়ে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো বলে গান গেয়ে বেড়িয়েছিল রাস্তায়।

কিন্তু সেসব তো স্টুডেন্ট থাকা কালীন। কতকাল আগের সব ঘটনা। জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে তখন তার কতটুকুই বা সম্পর্ক ছিল? তাছাড়া সে যদি পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে এতই বৈরী মনোভাব পোষণ করত, তাহলে কি সে পাকিস্তান আর্মির মেডিকেল কোর এ যোগ দিত? সে কি এখন কথায় কথায় উর্দু বলে না? এসব নিয়ে তার মনে এখন কোনো দ্বিধা নেই। এখন চাকরিতে ঢুকে সে রীতিমত একজন পাকিস্তানী নাগরিক। সৎ, সজ্জন, নারী নাগরিক।

কেউ এখন পর্যন্ত ঘরে কেউ ঢুকছে না কেন? ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সালেহা মনে মনে অস্থির হয়ে ভাবতে লাগল। স্টেশন কমান্ডার ঘরে ঢুকলে সে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্যালুট করবে। ভদ্রলোককে সে শুধু দূর থেকে দেখেছে। খুব লম্বা এবং ফর্সা স্বাস্থ্যবান চেহারা। ভিড়ের মধ্যে দু একবার কুশল বিনিময়ও হয়েছে। কিন্তু সেই পর্যন্তই শেষ। তার স্ত্রীও খুব লম্বা, কিন্তু রোগা। শরীরে মেয়েলি চর্বি বলতে যেন কিছু নেই, বিশেষ করে নিতম্বের কাছে। ফলে বাইরে গেলে তাকে একটা নিতম্ব প্যাড পরে থাকতে হয়! যদিও এটার দরকার ছিল না, তবু তিনি হয়ত এ ব্যাপারে সচেতন। বিভিন্ন ফাংশনে তাকে দেখে সালেহার এরকম মনে হতো। মনে মনে হাসিও পেত তার। কিন্তু হাসতে সে সাহস পেত না। এসব ব্যাপারে সে খুব শৃঙ্খলা মেনে চলত।

এই ঘরটার দুদিকে দরজা। যেদিক থেকে সে ঢুকেছে সেটা ছিল বাইরের দরজা। আর একটা দরজা ভেতরের দিকে। দুটো দরজাতেই দামী কাপড়ের লাল পর্দা ঝুলছে। পর্দার গায়ে কেমন যেন ছোট ছোট চকমকি লাগানো। ফলে পর্দা একটু বাতাসে দুলে উঠলেই চকমকিগুলো ঝিলিমিলি করে উঠছে। দেখে মনে হচ্ছে এই ঘরে মাঝে মাঝে মিটিং বসে।
তার ভাবনার মাঝখানেই টপ করে একজন অফিসার ঘরে ঢুকল। সালেহার কাছে মনে হল, এ যেন শুধু ঘরে ঢোকা নয়, এ হল যেন এক আবির্ভাব! কিন্তু ইনি স্টেশন কমান্ডার নয়। সালেহা, মানে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আফসার উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম জানালো। অফিসার তার চেয়ে বড় র‍্যাংকের, একজন উইং কমান্ডার। লাল টকটকে পাকিস্তানী চেহারা। মুখে দাড়ি বা গোঁফের কোনো বালাই নেই। একেবারে ক্লিন সেভ।
প্লিজ, সিট ডাউন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। বলল অফিসার। এই অফিসারকে সালেহা চেনে। ইনি হেড অফিসে বসেন, অর্থাৎ সালেহা এখন যে এরিয়ায় বসে আছে।
অফিসার বলল, কেমন আছেন?
ভালো স্যার। বিনীত ও মৃদু হেসে বলল সালেহা।
আপনি তো ফ্যামিলি উইং এর দায়িত্বে আছেন। তাই না?
জি স্যার। বলল সালেহা। ইতোমধ্যে একজন ল্যান্স নায়েক বিনীত হয়ে ঘরে ঢুকে সোফার সামনে টেবিলের ওপর চা ও বিস্কুট নামিয়ে রাখল।
অফিসার সালেহার দিকে তাকিয়ে বলল, প্লিজ, হ্যাভ সাম টি। অনেকক্ষণ আপনাকে বসিয়ে রেখেছি। আসলে স্টেশন কমান্ডার নয়, আমিই আপনার সাথে একটু আলাপ করব। কিন্তু আমি একটা জরুরি কাজে আটকে গিয়েছিলাম। অবশ্যই এটা আমাদের স্টেশন কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে।

উত্তরে চুপ করে থাকল সালেহা। কারণ তার এখানে কোনো বক্তব্য নেই।
অফিসার এবার নিজের হাতে সালেহার চায়ে এক চামচ চিনি মিশিয়ে তারপর নিজের কাপে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল, প্লিজ, চা খান। বিস্কিট নিন। এই বিস্কিটটা রাওয়ালপিন্ডি থেকে আসে। খেতে বেশ সুস্বাদু, খান।

এক পলক বিস্কুটগুলোর দিকে তাকিয়ে সালেহা ভাবল, এই বিস্কুট রাওয়ালপিন্ডি ছাড়া আর কোথা থেকে আসবে? এরকম ভোমা চেহারার বিস্কুট সে এর আগে চোখে দেখেনি।
সে বিনীত ভাবে মাথা নেড়ে বলল, ধন্যবাদ স্যার। আমি একটু আগে ব্রেকফাস্ট করে এসেছি।

আপনি থাকেন কোথায়? অফিসার চায়ে আরাম করে একটা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
তোফায়েল কলোনিতে, স্যার।
ও। তাহলে তো ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই। বলল অফিসার।
জি। মাথা নেড়ে সমর্থন জানালো সালেহা।
অনেকে দেখি আবার বাইরের ভাড়া বাসায় থাকেন তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
জি, আমি তা জানি। বলল সালেহা। কারণ অনেক এয়ারফোর্স অফিসারদের সে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে হলিক্রস স্কুলের পেছনে থাকতে দেখেছে।
আপনি কি আগে কোনোদিন, মানে স্টুডেন্ট থাকতে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন?

আচমকা এই প্রশ্নে সালেহার পেটের ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল। বুঝল, তাকে এখানে ডাকার আসল উদ্দেশ্যটা হচ্ছে তার অতীতের কার্যকলাপের একটা ফিরিস্তি নেয়া।
কিন্তু এসব ভেরিফিকেশন তো চাকরিতে ঢোকার আগে পুলিশ করে পাঠিয়েছে।

রাজনৈতিক কোনো সংশ্রব থাকলে তার কি সামরিক বাহিনীতে চাকরি কোনোদিন হতো?
মাথা সজোরে নেড়ে সালেহা বলল, না, স্যার। আমি কোনোদিন রাজনীতি করিনি।
বা অন্য কোনো সংগঠন?

জি, হ্যাঁ, আমাদের একটা স্টুডেন্ট সংগঠন ছিল, সেখানে আমি একবার ভোটে জিতে সাহিত্য সম্পাদক হয়েছিলাম।

বাঃ, শুনে খুশি হলাম! তার মানে আপনি আর্ট কালচার ভালোবাসেন? লেখালেখি ভালোবাসেন?

উত্তরে হ্যাঁ কি না বলবে বুঝতে না পেরে শুধু মাথা নাড়ালো সালেহা।
এরপর দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগল। তার যেন মনে হল, রোগীদের কোনো অভিযোগে তাকে হেড কোয়ার্টারে কেন ডেকে পাঠাবে। তার জন্যে তো তাদের মেডিকেল স্কোয়াড্রনে স্কোয়াড্রন-লিডার রাহিম সাহেবই যথেষ্ট। তার জন্যে তাকে এই পর্যন্ত আসতে হবে কেন?
কথাটা হঠাৎ মনে আসায় তার বুক শুকিয়ে গেল চিন্তায়।
আপনি কি ঢাকার মেয়ে? অফিসার এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করল।
না, স্যার, আমার বাড়ি খুলনা। সুন্দর বনের কাছে। উত্তরে বলল সালেহা।
সুন্দর বনে গিয়েছেন কোনোদিন?

তার প্রশ্নে সালেহার চোখের সামনে যেন সুন্দরবন ভেসে উঠল। ছেলেবেলা থেকে সে দেখে এসেছে সুন্দর বনের সৌন্দর্য। একবার বা দুবার বাবার সঙ্গে সে সুন্দর বনের ভেতরেও ঢুকেছিল। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। তবে বেশি করে চিনেছিল নিজের দেশের নদনদী আর গাছপালা। একবার সে জঙ্গলের ভেজা মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপও দেখেছিল।সে জানত না সেটা বাঘের পায়ের ছাপ। বাবা বলেছিল, একটু আগেই নাকি বাঘটা নদী থেকে পানি খেয়ে গেছে।
সেই পায়ের ছাপের দিকে তাকিয়ে সালেহার বুক কেঁপে উঠেছিল।
কিন্তু বাইরে এখন চুপ করে থাকল সালেহা।
সময়টা এখন কত? একথা ভেবে একবার সে আড় চোখে ঘড়ির দিকেও তাকাল। সকাল সাড়ে ন’টা। প্রতিদিন ভোর সাতটায় তার অফিস। আজ অফিসে যাবার পথে মায়ের সাথে তার দেখা হয় নি। মা তখন রান্না ঘরে কী যেন করছিলেন। ছোট্ট ভাইবোন দুটো তখনও অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। সে গোসল সেরে ইউনিফরম পরে একটা রিকশয় চেপে চলে এসেছিল মেডিকেল স্কোয়ড্রন। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সব অফিসারদের একটা ঘরোয়া পরিবেশ। এখানে বাইরের মানুষের অতো আনাগোনা নেই, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া। আসার পথে সে দুজন মিলিটারি পুলিশের স্যালুট গ্রহণ করেছিল মুখে যথেষ্ট গাম্ভীর্য ধরে রেখে।

তারা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সালেহা আফসারকে ভালো করেই চেনে। তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য দেখভাল করে সে। তাদের স্ত্রীদের পেট থেকে বাচ্চা ডেলিভারি করে বড় নিপুণতার সাথে।
তারপর তো এই।

হঠাৎ সালেহা লক্ষ্য করল ঘরের ভেতরে একটা নিস্তব্ধতা যেন নেমে এসেছে। আর ঘরের কোনে যে ঘড়িটা ঝুলেছিল, যার দিকে সালেহার নজর পড়েনি, সেটা টিকটিক করছে আপন মনে। এবং শব্দটা খুব একটা মৃদু নয়!

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আফসার, এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করি, আপনি কি সাতই মার্চে শেখ মুজিবের বক্তৃতা শুনতে রেসকোর্সের মাঠে গিয়েছিলেন?
প্রশ্নটা আচমকা যেন সালেহার মাথায় একটা বোমা ফাটার মতো শব্দ করল।
সে যেন হতভম্ব হয়ে উইংকমান্ডারের মুখের দিকে তাকাল।
সে নির্বাক।

প্রশ্নটা আবার হল, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আফসার, আমি যে প্রশ্নটা করেছি, আশা করি আপনার কাছ থেকে সঠিক উত্তরটা পাবো। আপনি জানেন, আমাদের দেশে এখন রাজনীতির নামে বিশৃঙ্খলা চলছে, অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য এইসব বিশৃঙ্খলা সাপোর্ট করতে পারে না। শেখ মুজিবের কার্যকলাপ এবং বক্তৃতায় পাকিস্তানের অখণ্ডতা আজ হুমকির মুখে। অফিসার, ডিড ইউ অ্যাটেন্ড দ্য মিটিং অন সেভেন্থ অব মার্চ অ্যাট রেসকোর্স মায়দান?
সালেহা তাকিয়ে থাকল। না, সে রাজনীতি করে না। কোনোদিন রাজনীতি করেনি। তার বংশে কোনো রাজনীতিক নেই। কোনোদিন ছিল না। সে অবশ্যই অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী। সে পাকিস্তানের মাটিতে তার ভালোবাসার মানুষ সামাদকে নিয়ে সুখের ঘর বাঁধতে চায়। সে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতেই তার জীবনের ক্যারিয়ার গড়তে চায়, মানে এই সেদিন পর্যন্ত চেয়েছিল।
সেদিন মানে এই সেদিন।
কিন্তু দুলু মামা একটা কালনেমির মতো সাতই মার্চের আগের দিন তার বাসায় এসে হাজির। বলল, যাবি নাকি, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে? শুনছি খুব বড় একটা জনসভা হবে। ঐ দিনই বোঝা যাবে আমরা পশ্চিম পাকিস্তনের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে থাকবো কী না।
না, আমি যাবো না, দুলু মামা। তাৎক্ষণিক ভাবে বলে উঠেছিল সালেহা। কিন্তু সালেহার মা বললেন, আমি যাবোরে দুলু, সালুও যাবে। এই বক্তৃতা তো শুনতেই হবে। ধর, যদি বঙ্গবন্ধু হঠাৎ দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তো আমরা তখন কী করবো? আবার কি ফিরতে পারবো ক্যান্টনমেন্টে? ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ছাড়তে হবে! টুনু পুনুকেও সাথে নিয়ে যাবো!

টুলু মামা এরপর কী ভেবে সালেহাকে বললেন, কাল তো রবিবার, তোর অফিস বন্ধ, ইউনিফরমও গায়ে চাপাতে হবে না। তাহলে আর কথা কি? আমরা সরাসরি তো ময়দানে যাবো না, ওখানে অনেক ভিড় হবে। আমরা যাবো আর্ট কলেজে। ওখানে দোতলায় উঠলে খুব সহজে আমাদের চোখে বক্তৃতা মঞ্চ পড়বে। আর মাইকে তার বক্তৃতাও শুনতে পাবো।

দুলু মামা আর্ট কলেজের শিক্ষক। শিল্পের ইতিহাস পড়ান। তার কথা শুনে সালেহার মনের ভেতরে কীরকম যেন সাহস হলো। বিশেষ করে মা যখন বললেন। তার মা কোনোদিন রাজনীতি সচেতন নয়। বরং মাসে মাসে রেশনের জিনিসপত্র হাতে পেলে সেগুলো নিয়েই সংসার করতে ভালোবাসেন। সালেহা তার বাবার ভেতরেও কোনোদিন দেশের ভালোমন্দ নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখেনি।

কিন্তু এখন সময়টা এমন যাচ্ছে যে গতানুগতিক জীবন যাপনের ফর্মুলাও যেন আর তার পথ ঠিক রাখতে পারছে না।

হ্যাঁ, সালেহা তার মা, দুলু মামা, আর টুনু পুনুকে নিয়ে শেখ মুজিবের বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিল। এর আগে সে সাক্ষাতে কোনো রাজনীতিবিদের বক্তৃতা শোনোনি। তাদের কারও সাথে তার চাক্ষুষ দেখাও হয় নি। শুধু একবার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান, হঠাৎ করে একদিন মেডিকেল কলেজ পরিদর্শন করেছিলেন। তারা তার আগমনের সংবাদ জানত না। লাইব্রেরিতে বসে তারা মেয়েরা তখন লেখাপড়া করছিল। হঠাৎ চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে টুপি পরা, মোটা, বেঁটে-খাটো এবং ফর্সা চেহারার একজন মানুষকে দেখেছিল। তার পেছনে অতি বিনীত ভঙ্গিমায় কলেজের প্রিন্সিপালকে দেখেছিল; যে প্রিন্সিপ্যালকে তারা যমের মতো ভয় করত। তার তখন অন্যরকম চেহারা। তড়াক করে বই ফেলে উঠে দাঁড়িয়েছিল তারা। আর গভর্নর মোনায়েম মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিলেন, এই যে মেয়েরা, তোমরা দেখি কেউ মাথায় ঘোমটা রাখো না, কী ব্যাপার?
আর তার কথা শুনে পেছনে দাঁড়িয়ে হাত ইশারায় কলেজের প্রিন্সিপাল ব্যাকুল মুখে মেয়েদের মাথা ঢাকতে বলেছিলেন। তার ইশারা পেয়ে মেয়েরা সকলে মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলেছিল। আর মোনায়েম খান তাদের দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে বলেছিলেন, এই তো!

এরপর তিনি লাইব্রেরির দরজার চৌকাঠ পার হতেও পারেন নি, মেয়েরা হাসতে হাসতে মাথার কাপড় খুলে ফেলে আবার পড়তে বসেছিল।
তো এই পর্যন্ত।

কিন্তু সেদিন দুলু মামার কথায় তার কী যে হল। সে তার মা ও ভাইবোনদের সাথে করে রওনা হয়ে গেল রেসকোর্স ময়দানের দিকে। কিন্তু সেখানে পৌঁছতে গিয়ে তারা অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের সম্মুখীন হল। দেখল হাজার হাজার মানুষ হাতে বাঁশের লাঠি আর তীর ধনুক নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। কারও কারও হাতে নৌকার পানি ঠেলার লগি এবং বৈঠা। তাদের মুখে মুখে এমন সব স্লোগান যা শুনলে নিরীহ কোনো মানুষের ভেতরেও যেন আগুন জ্বলে উঠবে। আর সেই আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যাবে মিথ্যা আর বানোয়াট সবকিছু। আকাশের সামিয়ানা ঢেকে বাতাসে উড়ছে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা লক্ষ লক্ষ লাল সূর্যের পতাকা। স্লোগান দিচ্ছে সব ছাত্র নেতারা। আর লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে ফিরে আসছে স্লোগানের জবাব। দেখে ভয়ে, শঙ্কায়, গৌরবে, আনন্দে শরীর কেঁপে উঠেছিল সালেহার। সে দুলু মামার মুখের দিকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে বলে উঠেছিল, মামা, এবার কী হবে?
মামা তড়িঘড়ি করে তাদের আর্ট কলেজের দোতলার খোলা বারান্দায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিচে ছুটতে ছুটতে চলে গিয়েছিলেন। যাবার আগে উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, তোরা এইখানে থাক, কোথাও যাবিনে, আমার মনে হচ্ছে আজই বঙ্গবন্ধু বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন।

আর দুলু মামা তাদের ওখানে রেখে যাবার পর পর আকাশে হেলিকপ্টার উড়তে শুরু করেছিল। মাথা উঁচু করে সালেহা বার কয়েক সেদিকে তাকিয়ে দেখেছিল। তার মনে হয়েছিল বুঝি কোনোকিছু বেকায়দা দেখলে তারা ওপর থেকে গুলি ছুঁড়বে। কারণ প্রায় প্রতিদিনই বাঙালিরা দেশের কোথাও না কোথাও মারা যাচ্ছিল।

তো তখন সে, তার মা আর ভাইবোনেরা কেমন যেন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই খোলা বারান্দায়। শুধু হতবাক নয়, কেমন যেন মন্ত্রমুগ্ধও। চোখের সামনে তারা সমুদ্রের মতো জনসমুদ্র দেখছিল। জনসমুদ্রের প্রথম সারিতেই অগনিত নারীদের দেখছিল। তাদের পেছনে হাতে বাঁশের লম্বা লাঠি আর নৌকার বৈঠা দেখছিল। লাঠির মাথায় উঁচিয়ে ধরা মাছ ধরার জাল দেখছিল। উঁচিয়ে ধরা লক্ষ লক্ষ হাতে সাদা কালো ফেস্টুন দেখছিল, দেখছিল লক্ষ, লক্ষ লাল সবুজ পতাকা। বাতাসে উড়ছিল পতাকা। অবিরত গর্জনের মতো মানুষের মুখের স্লোগান শুনছিল। আর সেই জনসমুদ্রের ভেতরে যেন বড় সাবলীল ভাবে শালপ্রাংশু একটি দেহশ্রী নিয়ে ইতিহাসের এক মহনায়ক ধীর পায়ে হেঁটে এসে উঠেছিলেন মঞ্চে। এরকম মানুষ সালেহা কোনোদিন এর আগে চাক্ষুষ করেনি। কোনোদিন এরকম কোনো মানুষের সান্নিধ্যে আসার তার সুযোগ ঘটেনি। সে কোনোদিন রাজনীতি করেনি। কোনো রাজনীতিকের বক্তৃতা শোনেনি। জীবনের প্রথম সে এসেছে এরকম কোনো মানুষের বক্তৃতা শুনতে।

সে কম্পিত শরীরে অস্থির চিত্তে চারদিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টি ফেলতে ফেলতে অপেক্ষা করছিল।
এমন সময় যেন আকাশ বাতাস মানুষ চরাচর, এবং দৃষ্টির সীমানায় যাবতীয় যা কিছু আছে সবকিছুকে মুহূর্তের ভেতরে পরিবৃত করে বজ্র নির্ঘোষে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন এমন কিছু—
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আফসার, প্লিজ ডোন্ট লুক অ্যাট মি লাইক দ্যাট। উই নো দ্যাট ইউ হ্যাভ অ্যাটেন্ডেড দ্য মিটিং, দ্যাট শেখ মুজিব, দ্য ট্রেটর অব পাকিস্তান-
উইং কমান্ডার আরও কিছু বলতে লাগল। আর তাকে বাঁধা দিয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আফসার হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ইয়েস স্যার, আই হ্যাভ অ্যাটেন্ডেড দ্য মিটিং, বিকজ আই হ্যাড নো আদার অলটারনেটিভ চয়েস দ্যাট ডে, নো বেঙ্গলী হ্যাড এনি অলটারনেটিভ চয়েস দ্যাট ডে একসেপ্ট টু অ্যাটেন্ড দ্য মিটিং। অ্যান্ড অলসো, স্যার, দে ডিডিন্ট ওয়ান্ট এনি অলটারনেটিভ চয়েস আইদার।

এরপর যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আফসার, বলে চলল, জাগিয়া উঠেছে প্রাণ, ওরে উথলি উঠেছে বারি, ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি। থর থর করি কাঁপিছে ভূধর, শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে, ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল, গরজি উঠিছে দারুণ রোষে—

 

পরিচিতি

কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক ১৯৪০ সালের ৫ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর জেলার চুড়িপট্টি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গোলাম রফিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন একজন ব্যবসায়ী ও মা আছিয়া খাতুন একজন গৃহিণী। শৈশব ও কৈশোর কাটে যশোরে।
লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয় মায়ের কাছে। তিনি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে চাইলেও বাবার আগ্রহে ১৯৫৯ সালে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস পাস করেন। পরে ১৯৭৩ সালে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন যান। সেখান থেকে ১৯৮২ সালে মনোবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে মনোরোগ বিভাগে সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তী ছ’বছর যুক্তরাজ্য ও স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন হাসপাতালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার বারডেম হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত আছেন।

সাহিত্য জীবন :
আনোয়ারা সৈয়দ হকের প্রথম ছোটগল্প পরিবর্তন ১৯৫৪ সালে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত হয়। কলেজে পড়াকালীন সময়ে নিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্প, কবিতা লিখেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াকালে লেখালেখির পাশাপাশি কলেজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে ছিলেন। প্রথম উপন্যাস ১৯৬৮ সালে সচিত্র সন্ধানীতে প্রকাশিত হয়। তার ‘সেই প্রেম সেই সময়’ ও ‘বাজিকর’ উপন্যাসে সাধারন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বর্ণিত হয়েছে। ‘নরক ও ফুলের কাহিনী’ উপন্যাসে লিখেছেন তার ছেলেবেলার কথা। ‘বাড়ি ও বণিতা’ উপন্যাসে চিত্রায়িত হয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারের সামাজিক সমস্যা।
তিনি বিশাল একটি সাহিত্য ভাণ্ডার তুলে দিয়েছেন পাঠকের হাতে। এপর্যন্ত ১১টি ছোটগল্প, ৩৩টি উপন্যাস, ৬টি কাব্যগ্রন্থ, ৭টি প্রবন্ধ, ২৫টি শিশুসাহিত্য, ১টি অনুবাদ, ১টি
স্মৃতিকথা ও ১টি ভ্রমণকাহিনী রচনা করেছেন। আশার কথা তাঁর কলম এখনও সচল ও বেগবান।

পুরস্কার ও সম্মাননা :
• ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক- ২০১৯
• উপন্যাস শাখায় নৃ প্রকাশনী থেকে ছানা ও নানুজান-এর জন্য পাঞ্জেরী ছোটকাকু আনন্দআলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার – ২০১৯
• উপন্যাসে অবদানের জন্য বাংলা এলাডেমি সাহিত্য পুরস্কার- ২০১০
• কবীর চৌধুরী শিশুসাহিত্য পুরস্কার – ২০০৭
• ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার – ২০০৬
• অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার
• মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার
• শিশু একাডেমি পুরস্কার

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সহধর্মিনী। তাঁদের দুটি সন্তান, কন্যা বিদিতা সৈয়দ হক ও পুত্র দ্বিতীয় সৈয়দ হক।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top