দ্বিতীয়বার স্কুলে ভর্তি হতে ভোমরাদহ থেকে বাবার সঙ্গে আবার ঢাকায় ফিরতে নিধির ভালোই লেগেছিল। কমলাপুর থেকে বেবীট্যাক্সি করে শ্যামলী পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে ন’টা। ফুপু স্কুলে বেরিয়ে গেছে।
জালাল ফুপা দেখতে বেশ অভিজাত ছিল। টাই পরা ফর্শা গম্ভীর মানুষ খুব বেশী দেখেনি নিধি।
তাদের আসার খবর যে আগেই পাঠানো হয়েছে তা খাওয়ার টেবিলে বাড়তি নাস্তার প্লেট দেখে বোঝা যায়। খাওয়া হলে ফুপা অফিসে বের হবে। নিধি আর তার বাবার বিশ্রাম দরকার। অনেকদিন পর আবার খবরের কাগজ দেখতে পেলো তারা। মথুরাপুরে থাকতে বাবা একটা করে কিনতো, দু’দিনের বাসী কাগজ ঢাকা থেকে পৌঁছালে তারপর কিনে আনতে পারতো। মা কেমন হুমড়ি খেয়ে পড়তো সেটার ওপরে।
-‘আহ, টাটকা নিউজপেপারের স্বাদই আলাদা’!- বাবা আড়মোড়া ভাঙ্গে। গতকাল ভোমরাদহের খিটখিটে মেজাজ থেকে বাবাকে বেরিয়ে আসতে দেখে নিধির মন খুশী হয়ে ওঠে।
বিকেলে ফুপু ফিরলে শাদামাটা বিদায়পর্ব আর শীঘ্রি আবার আসার প্রতিশ্রুতি, বাবা চলে যায়। নিধি আবিস্কার করে যে ফুপুর বাসায় দুই বেডরুম, তাকে অয়নের ঘরে থাকতে হবে। ফুপু এর মধ্যেই আরেকটা বিছানা ঢুকিয়ে দিয়েছে ঘরে। অয়নের খাটের দিকে ব্রুসলি’র পোষ্টার। ঘরের পর্দা টানা, ছায়া ছায়া অন্ধকার।
অয়ন সামনের বছর ক্লাস ফোরে উঠবে।
নিধিতো এতদিনে অন্তত ক্লাশ টু থেকে থ্রি’তে উঠতে পারতো (দাদু আর বাবার ভোমরাদহের উঠানে বসে কথপোকথন)। আরো কি কি যেন হতে পারতো নিধি! বিছানায় চাদরে ঢোলকলমি’র ফুলের বড় ছাপ। দিনের বেলার অকারণ অন্ধকারেও ঘুম পায় না নিধির। ব্যাগটা খাটের নিচে রেখে জানালার পর্দা টেনে সরিয়ে দেয়। ভয় ভয় ভাবটা উড়ে গেল।
দাদুর বাড়ির কোলাহলময় উঠান মনে পড়ে, ঘরের ঘুলঘুলিতে পায়রার ভুরুক ভুরুক ডাক, লিচু বাগানের কিষাণগুলি- তাদের কাস্তে অভ্যাসী হাতের খসখসে চুনা রং মনে পড়ে।
-‘এ্যাই, আমার ঘরের পর্দ্দা সরিয়ে দিলো কে?’
অয়ন শিশুকাল থেকে মারমুখী (স্বার্থপরও)। ফুপু আক্ষেপ করে বলে- ‘আমার ছেলেটা কখনো কিছু দিতে শিখলো না!’
নিধিও যে লড়াই দেয়নি তা না-‘আমার দিনের বেলা লাইট ভাল্লাগে না’।
-‘আমার লাগে’– অয়ন শান্ত (তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া, তখন পর্যন্ত)
-‘যে জন দিবসে মনের হরসে’ (মা’র কাছ থেকে শেখা বিদ্যা) পড়ো নাই?
-‘পইড়া বাল হয়’ (অয়ন কিন্তু ক্লাশে প্রথম পাঁচজনের একজন)
-‘এই বাজে কথা বলবে না’ (নিধিও জানে আজেবাজে শব্দ)
-‘একশোবার বলবো (অয়ন মারমুখী), বাজে কথা তোর বাপের সম্পত্তি? আমার ঘর আমি পর্দা টানবো, লাইট জ্বালাবো, তোর কি?’ (নিধি এইবার চুপ)।
জীবনে প্রথম নিজস্ব মালিকানাহীন ঘর নিধিকে উদ্বাস্তু করে তোলে।
তাদের ঝগড়া থামাতে কেউ আসে না।
অয়নের শোরগোল ছাড়া বাসাটা নিঃশব্দ, অপরিচিত। অয়ন দিনের বেলা টেবল ল্যাম্প জ্বালিয়ে হোমওয়ার্ক করে। ফটাস ফটাস স্যান্ডেল বাজিয়ে বাথরুমে যায়, ভীষণ জোরে পানি ছাড়ে, ফ্রিজ খুলে বাটিতে ঢেলে আইসক্রীম খায়।
নিধি এসবের কোনটাই পারে না, তাকে তারপর প্রায়ান্ধকার দিন যাপন করতে শিখতে হয়।
কিছু বলতে গেলে অয়ন তার সামনে বকাবাজির একটা জলন্ত চুলা খুলে দেয়।
এখন নিধি জানে ওই সময় অয়নের বয়সী ছেলেরা বড়দের নকল করতে ভালোবাসে। কিন্তু মথুরাপুরের কথা কে তার সামনে এত চিত্রিত করে দিয়েছিল? আর এত আজেবাজে গালিই বা সে কোথায় শিখেছিল!
ঘরে তার জায়গা যখন অয়ন বাইরে থাকে, আর তা নইলে বারান্দায় প্লাষ্টিকের চেয়ার। বাতাস গলির গন্ধ উড়িয়ে নিয়ে দোতলায় আসে, দূর থেকে উড়ে আসে তেলে ভাজা কিমাপুরীর ঘ্রাণ। নিধি অপরিসর গ্রীলের ফোঁকর দিয়ে পারলে পুরোটা মুখ বের করে দেয়, বাহুমূল অব্ধি। পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে রাস্তার ওপারে নির্মীয়মান ছয়তলা দেখে। এক মহিলা কোমরে সিল্কের শাড়ি জড়িয়ে রোজ তদারকি করতে আসে। গাড়ির দরজা খুলে বের হলে নিধি তার চুলে মেহেদীর রং, গাঢ় লিপষ্টিক, আর রোদচশমা (যা হামেশাই মাথার ওপরে তোলা থাকে) দেখতে পায়, রেলিং ছাড়া সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠে একটু থামে, প্রতি তলার নির্মাণকাজ খুঁটিয়ে দেখে, কোন কোন দিন কন্ট্রাক্টর বা মিস্ত্রীদেরকে ডাকে। তারপর মুখচোখে খোদাই করা বিরক্তি নিয়ে কথাবার্তা বলে চারতলার ছাদে উঠে যান।
দূর থেকে নিঃশব্দ চলচ্চিত্রের মত দেখে যায় নিধি। চারতলার ছাদে গেলে তাকে ঘাড় লম্বা করে উঁচু হতে হয়, মহিলাকে একটু সরু আর ছোট দেখায়, তার আশপাশে দাঁড়ানো মিস্ত্রী, মজুরদের আরো ছোট (ছোট পাখি আরো ছোট হয়ে যায় আকাশের বুকে তিল)। ভোমরাদহের নির্জনতা ছেড়ে শ্যামলী’র হৈ হট্টগোলে নিজেকেও এই মিস্ত্রীগুলির মত অপরিচিত লাগে নিধির।
একদিন মিস্ত্রীদের মধ্যে কি নিয়ে যেন খুনোখুনি লেগে গেল, তিনতলার অসমাপ্ত সিঁড়ির কোনে যেন একদলা অন্ধকার মুখোমুখি ফুঁসছে। সেদিন আর চলচ্চিত্র নিঃশব্দ ছিল না, তবে দূর্বোধ্য ছিল। চিৎকার শুনতে পেলেও তা কোন অর্থবোধক মানে নিয়ে লাফিয়ে রাস্তা পার হয়ে নিধির কানে আসছিল না। একটা লিকলিকে লোককে তিনজন (তারাও কেউ এমন কিছু মুশকো জোয়ান কিছু না) মিলে মারছিল, কিল ঘুষি। রোগা লোকটাকে ভোমরাদহের লিচুগাছের শুকনো ডালের মত লাগছিল, ডালগুলি নিধি হাঁটুতে ঠেকিয়ে মট করে ভেঙ্গে ফেলতে পারতো। অন্য লোকগুলির একজন যখন ছুটে একটা রড নিয়ে এলো, নিধি চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল- এরা ওকে ওইরকম মট করে ভেঙ্গে ফেলবে না তো!
ফুপুর বাসায় ফিরতে দেরী হচ্ছিল। কেউ তাকে বারান্দা থেকে সরিয়ে নিতে আসে নি। নিধির শুধু মা’র কথা মনে পড়ছিল। বাড়ি নির্মাণ তদারক করতে আসা মহিলার সঙ্গে তার মা’র কোন মিল নেই, তবু নিধির মনে হয় কিছুদিন বাদে এই মহিলা হয়তো ছাদের কোনায় একটা কদবেলের চারা এনে টবে লাগাবে।
গ্রীলের গায়ে নিজের মুষ্ঠি ঠেসে ঘুষি মেরেছিল নিধি, কেউ কেন তার মা’র খোঁজ এনে দেয় না। তার মা’কে চাই, প্রচণ্ড গরমে মথুরাপুর পাওয়ার হাউসের ক্যানেলে সে মা’র সঙ্গে গলা ডুবিয়ে বসে থাকতে চায়, তার ছবির বইয়ের মহিষ আর বাচ্চার মত। সে ক্যাঙ্গারুর মত মায়ের খোলা পেটের সঙ্গে সেঁটে থাকতে চায়।
নিধি হাত সরিয়ে মাথা ঠুকতে থাকলে ফুপু ত্রস্তে এসে (হয়তো কিছুক্ষণ আগে ফিরেছিল) তাকে সরিয়ে নিয়ে যায়। তার গায়ে গুড়ো সাবানের সঙ্গে ঘি’এর গন্ধ মিশে আছে। আগামী কাল ছুটির দিন, গুড়ো সাবানে ভিজিয়ে কয়েকটা শাড়ি বালতিতে রেখে ফুপু রান্নাঘরে নানা আয়োজন ব্যস্ত ছিল। নিধিকেও ডেকে নেয়। নিধি ততক্ষণে আবার নিধিতে ফেরত এসেছে।
মেঝেতে প্রায় উপুড় হয়ে বটিতে কাঁকরোল কুচি করছে বুয়া। নিধি মশলা পাতির কৌটা নেড়ে চেড়ে দেখে। জানালার গ্রীলে কালো গাদ জমে আছে, একটা ফুলতোলা চিনামাটির ডিশে কতগুলো মুরগীর ডিম, সিংক এ বরফ জমাট মাংস ভেজানো। সবুজ রঙ্গের প্লাস্টিকের ঝাঁঝরে সেদ্ধ আলু ছড়িয়ে দেয় ফুপু।
-‘কি বানাবে ফুপু?’
-‘আলু কিমার কাবাব, তুই পছন্দ করস না?’
নিধি’র মন পরে থাকে সামনের নির্মীয়মান বিল্ডিং এ, মিস্ত্রীরা কি ঐ রডটা দিয়ে কি মারামারি করেছে পরে? অয়নের কার্টুনের বইয়ের কোন কোন ছবির সঙ্গে এই দৃশ্যের কি ভীষণ মিল!
-‘তোকে আমার স্কুলেই ভর্তি করে দিতেছি নিধি (যেন অন্য কোন স্কুল বললেই নিধিকে নেবে), চল আজকে খাওয়া শেষ হইলে তোর স্কুল ব্যাগ কিনে আনি’।
-‘আমারতো স্কুল ব্যাগ আছে’- নিধি বলতে চায়।
তার আগেই ফুপু নিজের কথা লম্বা করে- ‘তোর আগের ব্যাগটা আমি কবে বুয়ারে বলছি ষ্টোররুমে ঢুকায়া রাখতে। তোর আরো কি কি হাবিজাবি ছিল না? সেগুলি শুদ্ধা। নতুন স্কুলে যাবা, নতুন ব্যাগ কিনবো, তাই না মামণি?’
ব্যাগটা আছে, ষ্টোর রুমে, ব্যাগের ভেতরের দিকে পকেটে নিধির চিঠিগুলি, আছে। বাবাকে লেখা মা’র চিঠি। আছে- ভাবতে আশ্বস্ত হয় নিধি। আচ্ছা, সত্যি সত্যি বাবাকেই লিখেছিল মা? তার বাবা, কই চিঠিগুলির খোঁজ করেনি তো! কেন? তার ব্রীফকেস থেকে একতোড়া কাগজ (চিঠি যদি নাও হয়) নাই হয়ে গেল, আশ্চর্য, সে কারো কাছে কিছু জানতে চাইল না!
নাহার মনিকা
উৎকর্ষের দিকে মনযোগী লেখকদের তালিকায় নাহার মনিকা একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য নাম। ঈদসংখ্যা ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’-য় কবিতা দিয়ে নাহার মনিকা’র লেখা প্রকাশের শুরু। তারপর দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন দেশের জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। কবিতা, ছোটগল্প এবং উপন্যাস নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ছয়।
উপন্যাস— ‘মন্থকূপ’ (বৈভব প্রকাশন, ২০১৯), ‘বিসর্গ তান’ (বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ২০১৬)।
গল্পগ্রন্থ—‘দখলের দৌড়; ( পুথিনিলয় ২০১৯), ‘জাঁকড়’ (দিব্যপ্রকাশ, ২০১৪), এবং ‘পৃষ্ঠাগুলি নিজের (দিব্যপ্রকাশ, ২০১১)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ চাঁদপুরে আমাদের বর্ষা ছিল’(বাংলামাটি প্রকাশন)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Health Policy, Planning & Financing এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। বর্তমানে ক্যানাডা’র ক্যুবেক প্রদেশে সরকারী স্বাস্থ্যবিভাগে কর্মরত আছেন।
লেখালেখি নাহার মনিকা’র কাছে অপার স্বাধীনতার জগৎ, যেখানে লেখক একমেবাদ্বিতীয়ম।