অনুবাদ: মাসুদ খান
বুদ্ধদাস ভিক্ষু
(১৯০৩-১৯৯৩)
অন্ধ আঁখিগুলি, দেখতে-পারা চোখগুলি
তাকিয়ে থাকে পাখিদের ঝাঁক, অনেকক্ষণ কিন্তু কখনোই দ্যাখে না আকাশ
কখনো মাছের ঝাঁক দ্যাখে না পানিকে, ঠাণ্ডা ও পরিষ্কার
কেঁচোরা তাকিয়ে থাকে মাটি খায় দ্যাখে না মাটিকে
কীটেরা ময়লা ঘাঁটে দ্যাখে না ময়লাকে
মানুষ তো সবখানেই, অথচ দ্যাখে না দুনিয়াকে
তারা ভোগে, অবশ্যই ভোগে বিষাদে, উদ্বেগে
অথচ বৌদ্ধরা ধর্ম্মে শরণ নিয়ে তরিকামতে চ’লে
সত্যের সাথে থেকে, দ্যাখে সবকিছু, দেখার বাহির ব’লে থাকে না কিছুই
(Buddhadhasa Bhikkhu, Blind Eyes, Eyes That See.)
প্রেম ছায়া
(১৯১৫—১৯৮১)
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রাত
উষ্ণ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রাত নিঃশব্দ হয় না কোনোদিন
বরং মুখর তারা ধ্বনিতে, শব্দরাজিতে, আঁধারে যাদের রেশ থাকে দীর্ঘসময়;
ঘুগরা পোকার ডাক থামে না কখনো
সুরভিত ঘন বায়ুস্তর-কাঁপানো তীক্ষ্ন চিৎকার মেশানো সেই ডাক;
পদ্মপুকুরের ধারে গলাফোলা কোলাব্যাং তোলে সেরেনাদ, অদ্ভুত, কামদ;
গাছের চূড়ায় নীড়ে বসে, থেকে থেকে,
সাদাডানা কোনো ছোট্ট পাখিনী কলহ করে তার পাখিটার সাথে;
ভোর বলে ভ্রম হয় ক্ষয়ে-আসা চাঁদের মেকি আভায়,
জোরে বাক দিয়ে ওঠে বিনিদ্র মোরগ;
গুল্মের বেড়ার মধ্য দিয়ে চুপিচুপি এগিয়ে গিয়ে
ঘেউ-ঘেউ করতে থাকে কয়েকটি কুকুর, অদৃশ্য এক আকৃতিকে লক্ষ্য ক’রে।
অসঙ্গতির মাঝে এই যে সঙ্গতি,
অবাক অদ্ভুত, কী সুন্দর শান্ত করে দেয় আমাদের রোদঝলসানো ইন্দ্রিয়নিচয়,
আমাদের ক্লান্ত আত্মাদের ঘিরে ধরে মধুর নিদ্রায়,
যে-নিদ্রা জড়িয়ে রাখে আমাদের যতক্ষণ না উঁকি দেয় ভোর।
(Prem Chaya, The Tropic Night.
English Translation by Riem Eng)
লাখ-লাখ জখমের দাগে ভরা খাল
লম্বা-লম্বা ক্যাজুয়ারিনার বনে বয়ে যায় বাতাসের দীর্ঘশ্বাস
হাওয়া গুমরে মরে বাঁশঝাড়ে
পানির কিনারে,
দমকা হাওয়া ছোটে তারপর রোদে-সেঁকা পোড়া মাঠে,
পেছনে ফেলে আসে ছোট-ছোট কিছু নাচুনে ঢেউ—
ধানবোঝাই নৌকার বহর টেনে টেনে
ভাটির পানে ভটভট বয়ে চলে বাষ্পচালিত টাগবোট, ধানকলের দিকে—
আর সেই ভটভটি ছোট-ছোট হিল্লোলকে চ্ছলচ্ছল বদলে দেয় বড়-বড় কল্লোলে।
সওদাভরা সব হালকা-পলকা ডিঙিনৌকা,
প্রতিটি ঢেউ এসে আলতো দোলাতে থাকে তাদের,
নাচুনে ঢেউ তাদেরও নাচায়,
শেষে গিয়ে ঝাঁকিয়ে দেয় খালপাড়ের সবুজ নলখাগড়াদের,
যেখান থেকে উড়ে উঠবে লাখ-লাখ মশা, লাখ-লাখ জখমচিহ্নের মতো,
ডুবে যাবে ক্লান্ত সূর্য পশ্চিমে যখন।
এজন্যেই আমাদের বাপদাদারা খালটিকে বলতেন ‘লাখো জখমদাগী খাল’,
ঠিকই বলতেন।
(Prem Chaya, The Canal of A Hundred Thousand Sores.
English Translation by Riem Eng)
একটি ভাবনা, সুবে সাদেকের কালে
অনন্তের কাননে একটি শিশিরফোঁটা—এ হচ্ছে তা-ই
যা আমরা, ভূলোকবাসীরা, নিরন্তর হতে চাই—
স্বর্গ-হতে-ঝরে-পড়া সেই বিন্দুশিশির ঝরায় মর্ত্যে তার দ্যুতিভার
অথচ যখন সূর্য ওঠে কুসুম-কুসুম, খুঁজে পাওয়া ভার চিহ্নটুকু তার;
দৈবাৎ একটি কুসুমের ‘পর ঝরতে পারে একটি শিশিরফোঁটা, হেথা কিংবা অন্য কোথা, অন্য…
ফুল ঝরা অব্দি সেই ফোঁটা ফুটিয়েই যাবে ওই ফুলের লাবণ্য।
(Prem Chaya, An Early-Morning Thought.
English Translation by Riem Eng)
বাঁশি
বহুবার, বহুবারই, এক পিচকালো ঝিরঝির-বৃষ্টিঝরা রাতে
শুনেছি বাঁশির ডাক, যার সবিলাপ সুর
উঠে যেত বৃষ্টির অনড় অবিচল টাপুরটুপুরের অনেক ওপরে
এবং মিলিয়ে যেত, আমার হৃদয়ে ফেলে রেখে যেত এক প্রতিধ্বনি;
যুদ্ধের চাকার অবিশ্রান্ত ঘর্ঘরের মধ্যে এক
দীর্ঘরেশ কান্নার আওয়াজ নিয়ত দোলাতে থাকে আমার হৃদয়।
(Prem Chaya, The Flute.
English Translation by Riem Eng)
অঙ্গকরণ কল্যাণাপং
(১৯২৬—)
কবির অন্তিম ইচ্ছাপত্র
শীত তাড়াবার জন্যে
গায়ে মুড়ি দিই নীলাকাশ
ভাতের বদলে খাই তারার আলোক
নিশীথের কালে।
আকাশের নিচে ঝরে ফোঁটা-ফোঁটা নিশির শিশির
সে-আমারই জন্যে, যাতে আমি খুঁজে পাই আর পিপাসা মেটাই।
ধারা ধরে বের হয়ে আসে সেই শিশির আমার কাব্য হতে
প্রভাতকে সালাম জানাতে আর টিকে থাকতে যুগ-যুগ।
আমার হৃদয়খানি, যা-কিনা কোরবান তার কবরের নামে,
পেয়ে যায় এক অলৌকিক তেজ;
আত্মা উড়ে স্বপ্নের প্রদেশে যায় আকাশের দূর প্রান্তে।
স্বর্গের নিকট থেকে চেয়ে নিয়ে দিব্যতাকে,তা ফিরিয়ে আনে মর্ত্যে
সুখ এনে, শান্তি এনে, শান্ত করে ধরিত্রীর বালু আর ঘাস।
এ-আমার যত-যত কবিতা রচনা
একটাই সে-অভিমুখ, উদ্দেশ্যে একটাই—আত্মার নাজাত।
যে-আত্মা সওয়ার
এখন, কালের দ্রুত দুর্বিনীত স্রোত আর ঢেউয়ের ওপর।
যদিও জীবন, ঊনদীর্ঘ,
ফুরিয়ে যাবে যে এত দ্রুত! কিন্তু,
হৃদয়ের ফরমান, দিব্য দ্যুতিমান,
টিকে থাকবে চিরকাল।
চিতায় পুড়ুক পোড়া শরীর তোমার—
দেহকে পোড়ানো যায়, কবিতাকে নয়;
তেজ আর মাধুর্য মিশিয়ে গড়া কবিতানিচয়।
যে-লোকেই পুনর্জন্ম হোক-না আত্মার
সেখানেই বয়ে যাবে বন্যা,
রামধনুদের—মহামূল্য, পূতপুণ্যা;
বন্যা বয়ে যাবে
দ্যুতিময় স্ফটিকের, জ্বলজ্বলে রত্নরাজির।
হর্ষে প্রাণিত হয় নিষ্প্রাণতা
লিখিত শব্দের মাজেজায়,
যেইমতো উত্তাপ নেভায়
বেহেশতের মহামূল্য তুমুল বর্ষণ।
হৃদয়কে ক্ষিপ্র উড়িয়ে নিয়ে চলে
স্বপ্ন দেখতে লোকান্তরে, অপর ভূমিতে।
বড়ই মধুর ঘ্রাণ ইহজীবনের।
আর পরজীবনে পড়বে ছায়া সেই মাধুর্যের।
ত্যাজ্য করে দিতে চাই আমার জীবন
চাই সত্যি ছুঁড়ে ফেলে দিতে তাকে।
আমি তো কেবলই চাই মহার্ঘ জিনিশ,
দীপ্তিমান, এবং নতুন।
নিশ্চয়ই সকল শিল্পের মধ্যে
কবিতাই সবথেকে পূত ও পবিত্র,
মায়া ও ম্যাজিক,
যেন-বা ললিত সব কুসুমস্তবক,
বহুমূল্য বন থেকে চয়ন, এবং
ঝরেছে আকাশ থেকে।
(Angkarn Kalayanapong, The Poet’s Testament.
English Translation by Sulak Sivaraksha and Hiram Woodward)
হাতা ভরে ভরে সমুদ্র তুলে আনো
হাতা ভরে ভরে যাও তুলে আনো গহিন দরিয়া সাদা-সাদা ভাতের ভোজে আকীর্ণ থালায়
খাবে বলে খামচে তুলে নাও মুঠিভর্তি লবণমেশানো নক্ষত্রকুচি
দ্যাখো নেচে নেচে গীত গেয়ে গেয়ে গোল হয়ে জড়ো হয় কাঁকড়া ও শামুকের দল
চাঁদ-সূর্য ধরে ধরে খাবে বলে ওড়ে গিরগিটি আর কেন্নোর দঙ্গল
কুনোব্যাং গিয়ে ওঠে সোনার পালকিতে স্বর্গের স্রোতের ‘পর ভাসমান সফর
তার সাথে সাথে কোলাব্যাং যায় ফেরেশতা পালায় গিয়ে নারকেল-মালায়
নিদ্রা যায় যারা নীলাকাশে, সেসব কুমারীদের, তরুণী অপ্সরাদের কেঁচোরা ফুসলায়
প্রত্যেকটি কোষ আর প্রতিটি মুখ তোলে সাফল্যে উজ্জ্বল
বেহেশতি বালাখানায় হাঁপিয়ে-ওঠা ঈশ্বর গু খেতে হামলে পড়ে মর্ত্যের ওপর
অপূর্ব স্বাদের ওই বর্জ্যের তারিফ করে উদ্বৃত্ত কথায়
তরুবীথি, জঙ্গল ও ঝোপঝাড় পারে তারা ব্যক্ত করতে গভীর দর্শন
করাতে-কাটা কাঠের গুঁড়া বিড়বিড় করে ঘুমের ভেতর হিসাব কষে ছায়াদের কতটা ওজন
ওই গুঁড়া, চমৎকার, চালাতে পারে আকাশে বাদশাহি ওই গুঁড়া থেকে যায় মাটি-ঝোঁকা, দুনিয়াবি, নিচু, এক
ফচকে ফাজিল
জগৎ, লালসা আর উন্মত্ত ক্রোধের রে হাবার দল, চল্, হাতিয়ে নিই বেশি-বেশি ক’রে
(Angkarn Kalayanapong, Scoop Up the Sea.
English Translation by John T Mattioli)
মন্ত্রী উমাবিজানি
(১৯৪১-২০০৫)
ফিরে দেখা
ফের দেখা হলো ব্যাপারটা:
কোনো জিনিশের ছায়া
অবয়বহীনতার চেয়ে ঊন, অংশত;
এবং পূর্ণত, এক জাল—
ছুঁড়ে দেওয়া উড়ন্ত পাখির দিকে
(Montri Umavijani, A Revisit.)