চারদিকে যুদ্ধ: সেলিম জাহান

ইদানীং সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে সতীর্থ ৬৯ এর বন্ধুরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নানান ছবি সাঁটছে অবয়ব পত্রে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে আছে শামীম (কবি শামীম আজাদ)। কোথা থেকে যে ও এতো ছবি পায়! ছবিগুলো নানান কিসিমের – বিভাগীয় ছবি, নাটকসহ নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ছবি, আড্ডার ছবি ইত্যাদি। সব ছবিই সাদা-কালো, আমরা তো আসলে ‘কালো-সাদা’ সময়েরই মানুষ!

স্বাভাবিকভাবেই চল্লিশ বছরের ওপারে তোলা এ সব ছবি আমাদের সবাইকে উদ্বেলিত করছে। আমরা স্মৃতি-লালিত হয়েছি সম্ভবত: তিনটে কারণে। এক, আহা, কত বয়স কম ছিল আমাদের তখন! দুই, কেমন করে মেঘে মেঘে এত বেলা হয়ে গেল— মনে তো হয় সেদিনের কথা? তিন, কত বন্ধু এর মধ্যেই চলে গেছে আমাদের ছেড়ে — ছবিতে আছে, জীবনে নেই।

কিন্তু স্মৃতিচারণার প্রথম তরঙ্গের পরেই বোঝা যায়— না, কথা আরো আছে। আরো গভীরতর কথা। ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক অর্থবহ মাত্রিকতা খুঁজে পাই আমি। আমার কাছে মনে হয় ছবিগুলো তো শুধু মানুষের ছবি নয়, ওগুলো তো আসলে একটা সময়েরও ছবি বটে। ছবিগুলো আমাদের সময়ের জীবন-চেতনা, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধকেও তুলে ধরেছে। সেই চালচিত্রে অন্তত: তিনটে জিনিষ বড় স্বচ্ছ আমার কাছে।

প্রথমত: এ সব ছবি তো অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। ছবি দেখে বোঝার কোন উপায় নেই ছবির মানুষগুলোর ধর্মীয় অবস্হান— কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ, কে খৃষ্টান। ঐ যে রোকেয়া হলের একটি ছবিতে খুকী, বাসন্তী আর শ্রাবণী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হল্লা করছে, তারা তো তিন ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ বলেই জানি। জানা না থাকলে বোঝা যায় কি ছবি দেখে? দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে সর্বদা একটি অসাম্প্রদায়িক আবহ, পরিবেশ ও সংস্কৃতিই তো থাকা দরকার— উপরোক্ত ছবিগুলোর মতোন। ওটাই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য। আছে কি তা আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে? নেই। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অসাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং ধর্মীয় বিভাজনটি চিহ্নিত হয়ে যায় পরিধেয়ের মাধ্যমেই।

দ্বিতীয়ত: এ ছবিগুলে আর্থ-সামাজিক শ্রেণীভেদের অনেক উর্ধ্বে। এখানে বিত্তশালী পরিবারের ছেলে-মেয়েরা যেমন আছে, তেমনি আছে কম বিত্তশালী মা-বাবার সন্তানেরা; গ্রাম থেকে আসা সতীর্থরা যেমন আছে, তেমন আছে শহুরে বন্ধুরা, ইংরেজী-মাধ্যমে পড়া ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন আছে, তেমনি বাংলা-মাধ্যমের পড়ুয়ারা। আলাদা করা য়ায় কি এক দলকে অন্য দল থেকে? পারিবারিক অসমতা কি ছিল না তখন? অবশ্যই ছিল। কিন্তু ছিল না তখন পোশাকের চাকচিক্য, ক্ষমতার দাপটের বিত্তের নগ্ন প্রদর্শনী। দামী শাড়ী আর গয়না পরে মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেই বোঝা যেত তার সদ্য বিয়ে হয়েছে।

চলনে-বলনে একটি সরল সাদা-সিধে প্রক্রিয়াই আমরা সবাই অনুসরণ করেছি আমাদের শিক্ষা-যাত্রায়। পারিবারিক বৈভবকে আমরা বাড়ীতে রেখে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে টেনে আনিনি। আজ শিক্ষার্থীদের মধ্যকার আর্থ-সামাজিক ফারাকটা শুধু বড় বেশী সহজ-দৃশ্যমানই নয়, তার দৃষ্টিকটু প্রদর্শনীটি বড়ই উগ্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মেধা, বুদ্ধি, মনন আর সৃজনশীলতার চর্চা কেন্দ্রে এ জাতীয় প্রদর্শনী শুধুমাত্র অশালীনই নয়, অপাংক্তেয়ও বটে।

তৃতীয়ত: ছবিগুলোর মানুষেরা একটি একক আত্মসত্তার প্রতিনিধিত্ব করছে, এবং তা হচ্ছে বাঙ্গালীত্ব। সাধারণ শাড়ীতে, এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁতের শাড়ীতে, চুলে আর টিপে মেয়েদের সাজে চিরায়ত বাঙ্গালীত্বই তো দৃশ্যমান, ছেলেদের পোশাকও সাধারণ, সাদা-মাটা, আভরণহীন। আমাদের সময়ে একটি অন্যতম আভরণ ছিল রোদ-বাঁচানো কালো চশমা, চলচ্চিত্রের নায়িকা-নায়কদের মতো। সবচেয়ে বড় কথা, উদ্ভট পোশাক আর বিজাতীয় প্রতিকৃতিমূলক সাজ তো চোখ পড়ল না কোন ছবিতেই—যা এখন অতি মাত্রায় দৃশ্যমান বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনগুলোতে।

দেয় ছবিগুলো যে মূল্যবোধ প্রতিফলিত করে, তা বহন করেছে সনাতন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ষাট, সত্তুর আর আশির দশকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে আমার ২০ বছরের সময়ে তাই তো দেখে এসেছি। তাই তো মেনেছি আমাদের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ বলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের শিখিয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয় মানে ‘বিশ্বের বিদ্যালয়’ নয়, বিশ্ববিদ্যালয় মানে একটি ‘বিশ্ববীক্ষণ তৈরী করার ক্ষেত্র’— যেখানে জ্ঞানের সাধনা হবে, সনদের প্রত্যাশা নয়; যেখানে মানসিক দিগন্তের প্রসার ঘটবে, মননের ক্ষুদ্রতার বিস্তৃতি নয়; যেখানে মুক্ত-বুদ্ধি, মুক্ত চিন্তার এক মন তৈরী হবে, কূপমন্ডুকতার কুয়ো নয়। বৈশ্বিক দৃষ্টি ও জ্ঞানসম্পন্ন, উচ্চতর মানসিকতাসম্পন্ন, মুক্ত বুদ্ধি ও চিন্তাসম্পন্ন একজন বিশ্ব নাগরিক তৈরী করাই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য।

এটা করতে গেলে তিনটে জিনিষ বড় প্রয়োজন। এক, বিজ্ঞানমনস্কতা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় কোন কিছু দেয় নেই, কোন কিছু স্বত:সিদ্ধ নয়, কোন কিছু বিশ্বাসের ওপরে ছেড়ে দেয়া হয় না। প্রতিনিয়ত সব কিছুকে প্রশ্ন করে, সবকিছুকে যুক্তি-তর্কের ছাঁচে ফেলে, সাক্ষ্য-প্রমান উপস্হাপনা করে জ্ঞানকে বর্ধিত করতে হবে। উচ্চ শিক্ষা বিশ্বাসভিত্তিক হতে পারে না, তাকে যুক্তিভিত্তিক হতে পারে। বিশ্বাসভিত্তিক ধ্যান-ধারনা আঁকড়ে ধরে বিজ্ঞানমনস্কতাকে পরিহার করলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়।

দুই, মানসিক দিগন্তের প্রসার শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক বা শেণীকক্ষের পঠন-পাঠনে নয়। ওগুলো সনদ প্রাপ্তির জন্য আবশ্যিক শর্ত, মানসিক দিগন্তের বিস্তারের জন্য পর্যাপ্ত শর্ত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক দিগন্তের প্রসারের কয়েকটি বড় অনুপান হচ্ছে বিবিধ গ্রণ্হের পঠন-পাঠন, শিক্ষা-বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং দেদার আড্ডা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। একটি মুক্ত-বুদ্ধি ও মুক্ত চিন্তা ধারণ না করে বিশ্ববদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সারাটি সময় সংকীর্ণ চিন্তা আর সীমিত বিচার-বুদ্ধিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখলে একটি হিরন্ময় সুযোগের অকাল মৃত্যু ঘটে— কিছু আসে যায় না সনদে প্রথম শ্রেনী থাকলেও।

যে জীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর জীবনধারার স্রোত-সলিলার সঙ্গে মেশে নি, সে জীবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছুই পায় নি, বিশ্ববিদ্যালয়কেও কিছু দিতে পারে নি, সমাজকেও কিছু দেবে না। এ ব্যর্থতা ক্ষমাহীন।

তিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্বীক্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে অবশ্যই ধারণ করতে হবে মানবতার মন্ত্র। ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য’, এ দীক্ষাটি জ্ঞানের সর্বোচ্চ পীঠে একান্তভাবে প্রয়োজন। মানবতার ধর্মই হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্ববীক্ষণ চর্চা কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় ধর্ম। সে ধর্মই তো আমাদের নৈতিকতার মূল চালিকা শক্তি। মানুষের নৈতিকতা তো স্বাভাবিকভাবেই মানবতার ধর্ম থেকে আসবে— তার জন্য অন্যকিছুর প্রয়োজন নেই।

যা মানুষ ধারণ করে আছে, আর যা মানুষকে ধারণ করে আছে, তাই মানুষের ধর্ম। এর মধ্যে মানুষের শিক্ষা, পারিবরিক মূল্যবোধ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, প্রকৃতি ও পরিবেশ সব কিছু আছে। সেই সঙ্গে থাকে তার বিশ্বাস, যা নিতান্তই ব্যক্তিগত, এবং যা পুরো ধারণকৃত বিষয়গুলোর একটি অংশ মাত্র। ধারণ করার পুরো আধারটিকে শুধুমাত্র শুদ্ধ বিশ্বাস দিয়ে ভরে ফেললে মানুষ তার অন্যসব অস্তিত্বকে হারায় এবং দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায় আত্বসত্তায়। এ অবস্হাটি বিপজ্জনক— ব্যক্তি মানুষের জন্যে এবং সেই সঙ্গে সমাজ ও জগতের জন্যেও।

চূড়ান্ত বিচারে, ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ’ ঐ বাণী অনুসরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তো কালে কালে উচ্চারণ করেছে, ‘অন্তর মম বিকশিত করো’। আমাদের পূর্বসূরীরা বলেছে এবং আমরাও বলেছি। ঐ যে আমাদের ছবিগুলোতে ঐ কথাগুলোই তো নীরবভাবে বাঙ্ময়। আমাদের পরে আমাদের উত্তুরসূরীরাও বহুদিন সে পথ ধরেই চলেছে। তাই যদি হয়, তা’হলে এখনও তা হবে না কেন? যুদ্ধটা তো সেখানেই— আর তা এখন না হলে কখন, এবং আমরা না করলে কারা?

 

সেলিম জাহান

ড: সেলিম জাহান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। কর্মজীবনে বছর দু’য়েক আগে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিচালক ও মূখ্য লেখক হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন।তার আগে তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যেগদানের আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর। উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্হাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top