[বিশ-পঁচিশ বছর আগের একটা ডায়েরি। ভুলেই গেছি সেটার কথা। সিঁড়িঘরে ছিল। বৃষ্টির ছাটে ভিজে গেছে। কয়েকটি পাতা ত্যানা ত্যানা। স্বপ্না শুকাতে দিয়েছে। কয়েকদিন ধরে সেটা সে শুকালো। তারপর সেটা নেড়েচেড়ে দেখি তার ভেতরে অনেক কবিতা, ছাপা কবিতার বহু পেপারকাটিং। কিছু কবিতা বেশ ভাল। কিছু লেখা বোকা বোকা। সেখান থেকে গ্রন্থভুক্ত হয়নি এমন কয়েকটি লেখা রইল এখানে।]
বাবাকে যেদিন কবর দেওয়া হলো
আমার বাবাকে যেদিন কবর দেওয়া হলো, সমস্ত
গ্রামজুড়ে সেদিন কুলুঙ্গীর খোপে-ভরা অন্ধকার।
সারি সারি কুকুরের নিঃশব্দ আর্তনাদের মতো নৈঃশব্দ্য।
খানকা গলে মসজিদমতো হয়ে গেছে।
বুড়ো বেলগাছের মগডালেও পেকে নেই কোনো ফল।
পুকুর শুকিয়ে মাটির চৌবাচ্চা আর ভাঙা দরদালানের ছাতে
ওঠার কথা ভাবতেই আমার পায়ের তলা শিরশির করে উঠল।
সে কতকাল আগের কথা!
এরই মধ্যে তিনবার মৃত্যু হয়েছে এই চুনসুরকি কড়ি-বরগার।
এখন আমার পায়ের স্পর্শে পাতালে গিয়ে না সিঁধোয়!
বাবা বলে আর ডাকব না বলে দুঃখ হচ্ছে না কোনো।
আমরা বরং শটিফুল তুলি। এই একটি শটিফুল পৃথিবীর আর
কোথাও কখনও ফোটেনি। তখনও আমাদের ছোটখোকা
হয়নি। মসজিদঘরের পাশে একটি-দুটি খোকা আনারস
রুবির উজ্জ্বলতা নিয়ে জ্বলে আছে।
বাবাকে যখন বাঁশবাগানের পাতালে শোয়ানো হচ্ছে,
মেয়েরা তখন কলস্বরে কেঁদে উঠল দূরে, সারিবদ্ধ।
কুয়াশা নদীর ওপারে কখন তারা এসে দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দ,
ছোট একসারি দিগন্তের মতো।
সাঁই
[কবি মুস্তফা আনোয়ার স্মরণেষু]
শুনি নাকি ওইখানে নদীর ওইপারে সাঁই থাকে
মেঘের মণ্ডপ থেকে গলে পড়ে রঙ, মোমের প্রতিভা
খড়ের গম্বুজ থেকে উড়ে যায় পলাতকা পাখি
আর ঋষিবউ, বেতের টুকরি থেকে খসে ফল,
একটি ও দুটি, মাটির ওপরে
যদি পাই তৃণসুধা, তৃণ ও তৃণের সুধা
আমি আর আনু ভাই
পৃথিবীর দুই কবি, নীলগাড়ি রেখে দিই
তুলসীতলায়, মিহিফুল পড়ুক সেখানে
ব্যস্ত মহাজন, ত্রস্ত নাপিত, কাঁচি, কাদাজল ভেঙে
হেঁটে যাই, যদি পাই তৃণ, তৃণসুধা
বর্গাকারে থাকে ছবি, ছবিটির ওইপাশে নদী
শুনি নাকি সাঁই নাই, পুলিশের বয়ঃসন্ধি চলিতেছে
নদীটির ওইপারে, মাইল মাইল, কাশফুল ফুটে আছে
খঞ্জনা
আমাদের নৈবেদ্য ছিল জঙ্গলে, ঝোপে আর ঝাড়ে।
খঞ্জনা নদী পেরিয়ে যেইখানে মাতাল বন দুধজ্যোৎস্নায়
যাচ্ছিল ধুয়ে…
সেইখানে পর্ণমোচী বৃক্ষের উৎসব,
একতারা হাতে এক পাতার কুটির, অচেনা চাঁদের বহু নিচে
দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সেইখানে নৃত্যপর ছেলেদের দল,
মুঠো মুঠো ঘুঙুরের মতো কূজনবৃত্ত পার হয়ে পৌঁছুলো অক্লেশে।
তারাদ্বীপ হাতে এক একলা আকাশ,
মেঘপাতায় মোড়া বিপুলা দিগন্ত,
মৎস্যকিরণ মগজে নিয়ে তারা মিলিয়ে গেল গভীরে।
দূর থেকে তাদের ছায়াশিকারীর দল শুধু মনে হলো।
ডালপালাময় বোম্বেটে, কোনোদিন তারা ছিল কিনা তার
চিহ্ন রইল না।
শিশু বিষয়ক
তখন একদল লোক চিৎকার করতে থাকে যে─
তোমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা এসেছিল সেই লোকটির
কাছ থেকে যে সূর্যের আলো থেকে নিজের চোখকে
রক্ষা করতে জানত চমৎকার দুই খণ্ড কালো কাচ
দিয়ে এবং যে মাটিতে জলের ধারা পাল্টে তোমাদের
শস্যক্ষেত্রগুলি চিরকালের জন্যে উর্বরা করতে
চেয়েছিল, আর তাতে একদল লোক বিহ্বল হয়ে
ওঠে এবং বলে ওঠে, না, প্রকৃত লোকটির কণ্ঠ ছিল
বজ্রের মতো, সেই লোকটি মৃত্যুকে অবহেলা করেছিল
এবং তার অঙ্গুলি উত্তোলিত ছিল অনন্ত স্বাধীনতার
দিকে।
তখন একদল লোক লাল পতাকার তলে সকলকে
সমবেত হতে বলে আর জানায়, ‘সত্য ছাড়া
আর সব কিছুই ভ্রান্ত।’ এবং সেই সত্য নিহিত
রয়েছে তোমরা যে বস্তু দ্বারা গঠিত সেই বস্তুর
অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের ভেতরে, আর তখনই কৃপাণহস্তে
একদল লোক বিদেশী ভাষায় কথা বলে ওঠে আর
সবাইকে তাদের প্রতিপালকের ময়দানে জড়ো হতে
বলে। কিন্তু তখনও
আমাদের শিশুদের আত্মা এক অনন্ত সুন্দরের
স্বপ্ন দ্যাখে আর কখনও একদল লোকের হানাহানি
আর তর্কের অর্থ বুঝতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী
অবশেষে প্রধানমন্ত্রী আমাদের মফস্বলে এলেন।
সেই যে কারো হাত নেই, মুণ্ডু নেই, রক্তাক্ত
মার্বেলের মতো ছিটকে গেছে চক্ষু, ধড় নেই,
পা নেই, তীব্র ভিডিও আলোর নিচে যেন সাহারা
মরুভূমির ওপর ক্ষত আর বিক্ষত অসংখ্য মানুষের
টুকরো আর রক্তের নিঃশব্দ হোলি!
তো প্রধানমন্ত্রীর শোভাযাত্রাতেও পায়ে দলে একজনের
মৃত্যু হয়, যদিও সে মানুষ ছিলো না, ছিলো ১২/১৩
বৎসরের একজন পরিচয়হীন কিশোর।
পৌরমলের পাতলা হলুদ মেঘ তখন সমস্ত শহর
হালকা করে ঢেকে ছিলো, দুঃস্বপ্নতাড়িত নদী আর
আষাঢ়স্য আকাশের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মিছিল
শুরু হলো। তাঁর পেছনের সকল মহিলার পেট ছিলো
উঁচু আর থলথলে, তাঁদের সবারই কাণ্ড ছিলো মৃত
কদলীবৃক্ষের মতো আর তাদের দিকে তাকিয়েই
বোঝা যাচ্ছিল─ এই দেশে আর কোনো স্বপ্ন নেই।
আষাঢ়স্য দিগন্তের কোণ থেকে হঠাৎ ঝরা ফুলের
মতো বেরিয়ে এল এক ঝাঁক কাক। কা-কা করতে
করতে তারা ছড়িয়ে গেল সমস্ত আকাশে।
পিতৃনিবাস
আমার পিতার মুখ দরদালানের ’পরে
অতিকায় বিস্ময়শ্রী বসে আছে
ধ্বসে যাচ্ছে দালানের মতো তার ধ্বংসাবশেষ
ছুঁয়ে দেখি তার দুই নখের মসৃণতা
চোখের আশ্চর্য দিঘি, পরিচিত দাঁতের গহন
অসুস্থ বৃক্ষ যেন মৃত্তিকাদেয়ালে ঠেস দিয়ে আছে
বৃষ্টি হয়, রোদ নামে প্রতিদিন
জালের কাঠির মতো নামে হিম
ধানের গোলার থেকে সারাদিন বাষ্প ওড়ে
হিম থেকে স্মৃতির উদ্ভাসন ঘটে যায়
ধীরজন্ম শাপলার রঙ
সিঁদুরের নির্জন কাহিনি ছড়ায় পদ্মের পাতা
চোখের দিঘিতে নামে মৃতদেহ
কোলবালিশের মতো ফুলে-ওঠা কর্তিত পা
ভয়ের বিষম ঢেউ
সারাদিন বৃষ্টি হয়, সমিধের গাঢ়তায়
উদ্ভিদের থিকথিকে প্রজনন ঘটে যায়
দালানের ফাঁকে ও ফোঁকড়ে বটবৃক্ষ
ভুলজন্ম নেয় অবিরত
আবার মৌমাছি
বন থেকে উড়ে এল যে মৌমাছি, আমি তার
পিছু পিছু এলাম।
ত্রেতা ও দ্বাপর যুগে, চারদিকে খনি-খনি গন্ধ,
অন্তর্গত বাদুড়ের ঝুলে-থাকা অন্ধকার, বিচ্ছুরিত
হ্রদ, সাঁতার-কাটা শিশু ইকথিয়ান্ডর বসে আছে
বালু আর রোদ্দুরে, কুমারী পদ্মের উপচানো গোলাপি
দু’কুল, রাশি রাশি দুলন্ত শৈবাল, হিমকণায়
ঝরে ঝরে পড়ছে।
তারপর ঝড়।
সেকি ঝড়! সেকি ঝড়!!
করোটির দুইপাশে অক্ষিগোলক। কোটি কোটি
গ্যালাক্সির বিরামহীন ঘূর্ণনে তা দিচ্ছে নির্জন
মৌমাছি।
আমি তার পিছু পিছু এলাম।
তার পাখার কারুকার্যে জেগে উঠছে অট্টালিকা,
ইতিহাস লিপি হয়ে গেঁথে যাচ্ছে তার শরীরে।
যে মোহন গন্ধ ছড়িয়ে সে উড়ছে আর উড়ছে,
দুইপাশে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে মন, জারুলের
বন, আমলকীর লাল চিরল পাতা।
এখনও উদ্যান
এখনও উদ্যান রয়ে গেছে।
জেটিতে ভিড়েছে জাহাজ, খালাসিরা ছড়িয়ে
পড়ছে যে যার কাজে আর আমি
আমার সংক্ষিপ্ততম জীবন লিখে চলেছি
মাইলফলকের মতো একখানি শাদা পাথরে।
গুপ্তঘাতক পুলিশ, তাদের মাড়-দেওয়া
বাদামি মলিন য়্যূনিফর্ম, নুলো ডাকাতের
পাশাপাশি সারারাত্রি আমার হাজতবাস,
কাচ্চাবাচ্চাসমেত কয়েকটি ছারপোকার
রহস্যময় ওঠানামা আর রক্তস্রাবের ফাঁক গলে
সারারাত সঙ্গমের গল্প।
শেষদৃশ্যে পেরিয়ে যাচ্ছি চন্দ্রাহত ল্যাম্পোস্ট।
কুয়াশায় ডুবছে সেই শাদা পাথর। পিছু পিছু
হেঁটে আসছে একটি গন্ধঅলা কুকুর। আমি
থামলে সেও থেমে যায়, আমি তাকালে সে
বিপন্নমুখে থমকে দাঁড়ায়।
আমার মগজের ভেতর ঘুরপাক খায় তিনটি
গাঢ়নীল ভ্রমর আর তাদের রঙধনুনীল
তিন জোড়া ছোট ছোট ডানা।
ভিয়েনা
চোখ খুলতেই একটি কালো পিঁপড়া হেঁটে যায়। পিঁপড়া।
ভ্রমরের মতো কালো তার গায়ের রঙ। এক জোড়া লাল
জুতা বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দ্যাখে।
যখন পর্যটক হাওয়া খুব দোল দিতে থাকে, ঈষৎ হালকা
ধাতব বর্ণের মসৃণ গাড়িগুলি গাঢ় সবুজের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে
থাকে, মেয়েটি তখন একা একা ফাইবার স্টেশনে দাঁড়ায়,
সোনালি বিয়ারের হলুদ মেঘে মসৃণ চুমুক ডোবায়।
পাতালের স্বপ্ন থেকে এক জোড়া লাল ট্রাম ফ্লুরেসেন্ট চোখ
মেলে শব্দহীন এসে থামে। তখন ঘন নীলাভ আলো ক্রমশ
চারদিকে ছড়িয়ে যেতে থাকে, সন্ধ্যা হয়।
চোখ খুলতেই একটি চকিত উজ্জ্বল পাথুরে ইটের চত্বর,
চারপাশে রহস্যময় স্ফটিক আর পাথরের স্বচ্ছ বর্ণালি দোকান।
দূরে দূরে মোমের মতন জ্বলন্ত টাওয়ার, মাথায় নীল আগুনের
নরম আলপনা। সর্বত্র পিছলে পড়া নানাবর্ণ বেগুনি আলোর
তরলতা। ধাতব পাথরের ওপর টুইস্টের ট্রাস ট্রাস শব্দ,
গিটারের চিকন ঝঙ্কার আর সেই মেয়েটির ফুলে ফুলে ওঠা
ক্ষীরবর্ণ চুল।
রোবটপ্রণালী
কালে কালে কতদূরে চলে গেলে তুমি!
উপত্যকার বাদুড় ঝুলছে গাছে গাছে,
চিনির সাগর নিচে, ভাঙা-ডানা পরী পড়ে আছে,
একফালি হলুদ প্যাস্টেল, বুনো-ঝুলো ফুল,
দেবতারা প্রসাধন সেরে উড়ে চলে গেল।
এইখানে বসেছিলে তুমি এই পাথরের ’পরে,
মসৃণ কালো লোমে ঢাকা, পানিতে ডুবানো পা,
অস্থির চোখের কাচ, পলক পলকহীন মেলে ছিলে।
মনুমেন্টের চারপাশে হেঁটে যাচ্ছে দেবদেবী,
তাদের বাচ্চারা, রোদের ভেতর ঝলোমলো,
এদের ভেতরে দেখি তুমিও হাঁটছ একা একা।
মুখোমুখি হতে গিয়ে দেখি সেই চোখ─
এখনও পলকহীন, কপোট্রনের আলোয় এঁকে
নিচ্ছ আমার গ্রাফিক্স, মেমরির সেল জুড়ে
আমাদের যৌথ শৈশব, ওড়াওড়ি, হাঁটাহাঁটি,
আরো কত কি যে!
হে শীতলতা
শ্যামল ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটছি
আর যেন কাঠ শুকিয়ে পড়ো-পড়ো─
নাটবল্টুতে আটকে রয়েছে বহুদিনের কাঠ,
ফুটি ফুটি জল এসে পড়ছে শরীরে
নাইতে নেমেছে যে কিশোরী তার উঁচু
বুকের শাদা জ্যোৎস্নার ঢেউ এসে লাগছে
ব্রিজের পায়ে, মন্থর হাঁসের সাথে এগিয়ে
আসছে ঘাস, লতাপাতার বেষ্টনী, দূরের শহর
অ্যাপার্টমেন্টের প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে
এসেছি ঘরে, স্লিম ফ্যানের অদৃশ্য হাওয়ায়
উড়ছে মিহি শিফনের নদী, উপচে পড়া
লাবণ্যের ওপর জমে উঠছে তোমার শিশির
বরফজলের গ্লাসে ছবি হয়ে উঠছে
রাইনোসোরাস, বহুমুণ্ড বাইসন…
নান্নু মাহবুব
জন্ম: ১১ জুন, ১৯৬৪, যশোর। লেখালেখির শুরু ৮০’র দশকে।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ: রাত্রিকালীন ডাকঘর (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫)
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ: পুনরুত্থিত শহর (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৫)
তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ: আজ কী ফুল ফুটিয়েছো, অরণ্য? (প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৩)
প্রতিভাস, কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ইউ জী কৃষ্ণমূর্তির
সাক্ষাৎকারভিত্তিক ৪টি অনূদিত গ্রন্থ:মাইন্ড ইজ আ মিথ, নো ওয়ে আউট, থট ইজ
ইয়োর এনিমি, ও মিস্টিক অব এনলাইটেনমেন্ট।
……….