সুধাংশু শেখর বিশ্বাস ভ্রমণ গল্প: হরিণ সংঘাত

আমার ফোনটা ডিস্টার্ব দিতে শুরু করেছিল দেশে থাকতেই। আমেরিকা এসে সাউন্ড গেল পুরোপুরি অফ হয়ে। তবুও ফেলে দিতে পারি না, কি এক মায়ার বাঁধনে আটকে থাকি ফোনটার সাথে। আসলে নিজের পয়সায় আইফোন কেনার সামর্থ আমার নেই। ফোনটা উপহার দিয়েছিল আমার এক প্রাণের বন্ধু। সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী সে। তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ফোনটা হয়ে গেল আমার সঙ্গের সাথী।

ফোনের ব্যবহার আমার মূলতঃ কথা বলাতে। লেখালিখি শুরু করার পর বন্ধুদের পরামর্শে ফেসবুক একাউন্ট ওপেন করলাম। পাঠকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় ফেসবুক নাকি খুবই জরুরি। সে কারণে কষ্টেসৃষ্টে বারো হাজার টাকা দিয়ে কিনেছিলাম একটা স্মার্ট স্যামসাং এনড্রয়েড ফোন। মহানন্দে ব্যবহার করছিলাম সেটাই।

তখন আমি জয়েন্ট সেক্রেটারি। পোষ্টিং অর্থ মন্ত্রণালয়ে। আমার সেই সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বন্ধু হঠাৎ একদিন অফিসে এসে হাজির। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো- কেমন আছিস দোস্ত!
ভালই। বহুকাল পর দেখা হোল তোর সাথে। ভুলে গেছিস আমাদের?
সাত বছর তিন মাস এগারো দিন পর তোর সাথে দেখা হোল। এবার বুঝে দ্যাখ, মনে রেখেছি কিনা!

বলিস কি! একেবারে দিন তারিখ হিসেব করে মনে রেখেছিস?
রাখবো না! তোর কথা কি ভুলতে পারি?

খুশি হই। টাকা পয়সা হয়ে গেলে আজকাল কেউ আর পুরনো বন্ধুদের কথা মনে রাখে না। বিগলিত হয়ে জানতে চাই, ব্যবসা-বানিজ্য চলছে কেমন?
চলছে খুবই ভালো। সবই তোদের অবদান।

কি যে বলিস, আমাদের অবদান হতে যাবে কেন! পরিশ্রম আর চেষ্টায় তিলে তিলে গড়ে তুলেছিস তোর সাম্রাজ্য। প্রাথমিক কিছু হেল্প আমরা করেছিলাম বটে! তবে সে এমন কিছু না। পারষ্পরিক হেল্প তো লাগেই জীবন চলার পথে। তবে তুই যে সেটা মনের মধ্যে ধারণ করে রেখেছিস, বন্ধুদের জন্য সেটাই অনেক বড় পাওয়া।

লজ্জা দিস কেন দোস্ত। তুই যা করেছিস আমার জন্য, সে ঋণ কোনদিনই শোধ করার নয়।

কি আর করেছি। বন্ধুদের সবার চাকরি বাকরি হয়ে গেল। রয়ে গেলি তুই। না হয় একটু চা রুটি কলা খাইয়েছি তোকে। এই তো!

দোস্ত রে! অনেক ঘাত প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে আজ আমি এইখানে। জীবন কি, সেটা তোদের চাইতে অনেক বেশি চিনি আমি। বলতে পারিস, হাড়ে হাড়ে চিনি। এ জগতে মানুষ শুধু ত্যালা মাথায় তেল দেয়। আর তুই সেই বেকার জীবনে আমাকে থাকার জায়গা দিয়েছিস ঢাকায়। সারাদিন তোর অফিসে কাটিয়েছি। তোর কথা মতো ঘোরাঘুরি করেছি বিভিন্ন জায়গায়। গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের সাথে চেনা পরিচয় করিয়েছিস। তোর বন্ধু যদি আমাকে ম্যান পাওয়ারের লাইসেন্স না করে দিতো, যদি একশো লোক সৌদিতে পাঠানোর পারমিশনটা বের না করে দিতো, তাহলে কোথায় থাকতাম এই আমি! আর রুটি কলার কথা বলছিস! তখন কয় টাকা বেতন পেতিস তুই! সেই দুঃসময়ে তোর সামান্য আয় থেকে আমাকে ডেইলি রুটি কলা খাইয়েছিস, হাত খরচ পর্যন্ত দিয়েছিস। তার মূল্য তুই না জানলেও আমি জানি রে দোস্ত। ঠেকে ঠেকে জীবনে অনেক কিছু শিখেছি। অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।

তা তো নিশ্চয়ই! নইলে শুন্য থেকে এতবড় ব্যবসায়ী তুই হলি কিভাবে!

সে কারণেই তো তোদের উপকারের কথা ভাবি। আজ আমাকে শত কোটি টাকা লোন দেবার জন্য ব্যাংক হা করে বসে আছে। অথচ সেদিন! ব্যাংক থেকে সামান্য পাঁচ লাখ টাকা লোনের জন্য দিনের পর দিন ম্যানেজারকে তেল দিয়ে বেড়িয়েছি। নিরুপায় হয়ে আবার তোর কাছে এসেই ধর্ণা দিয়েছি। তুই বলে না দিলে সেই লোনও আমি পেতাম না। তোকে ভুলি কি করে! শত কোটি টাকা দিয়েও কি সেই ঋণ শোধ হবার? অবশ্য তোর ঋণ আমি শোধ করার চেষ্টাও করব না। চিরঋণী হয়ে থাকতে চাই তোর কাছে। হা হা হা…
আমার মন ভরে যায় বন্ধুর কথায়। কৃতজ্ঞতাবোধ আছে ওর। জীবনে সে আরও উন্নতি করুক। মনে মনে প্রার্থণা করি।

শোন দোস্ত, না করতে পারবি না। আমেরিকা গিয়েছিলাম। বন্ধুদের সবার জন্য একটা করে আই ফোন নিয়ে এনেছি। তোর ব্যবহারের জন্য এইটা। একটা বক্স সে আমার

টেবিলের উপর রাখল।
আরে করেছিস কি!
কিছুই না। তুই হলি বাংলাদেশ সরকারের জয়েন্ট সেক্রেটারি। আই ফোন ছাড়া কি তোকে মানায়!

তো বন্ধুর দেয়া সেই আইফোনটা যক্ষের ধনের মতো বহু বছর আগলে রেখেছি। একদিন হাত থেকে পড়ে ফোনটার স্ক্রিন ফেটে চৌচির হয়ে গেল। সেটা বদল করতে গিয়ে বাঁধল ঝামেলা। অরিজিনাল পাওয়া যায় না। বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করে অরিজিনালের কাছাকাছি একটা চাইনিজ স্ক্রিন লাগালাম। তার বেশ কিছুদিন পর দেখা দিল সাউন্ড প্রব্লেম। বসুন্ধরা মার্কেট, ইষ্টার্ন প্লাজা, মোতালিব প্লাজায় অনেক ঘোরাঘুরি করেও সেটা আর ঠিক করা গেল না। আমেরিকা এসে সাউন্ড গেল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে। চার্জও থাকে না বেশিক্ষণ। নতুন একটা ফোন কেনা অতি জরুরি।

ওয়াশিংটন ডিসি-র প্রোগ্রাম শেষ করে গেলাম মিশিগান আমার বাবু অরণ্যর কাছে। সে থাকে সাগিনো সিটিতে। পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট সুন্দর শহর। বাবু আর তার বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করি ফোন কেনার বিষয়ে। ওদের মধ্যে ফোন বিশেষজ্ঞ রাহুল। সে বলল- আঙ্কল, অ্যাপল কোম্পানি ফোন চেঞ্জিং অফার দিয়েছে। পুরনো আইফোন বদলে কিস্তিতে নতুন আর একটা নিয়ে নিতে পারেন। এই যে দেখেন, আমি এনেছি সিক্স এস প্লাস। আমার তো আর আইফোন ছিল না। আমি এনেছি ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বাকিটা চব্বিশ কিস্তিতে। আপনি এই পুরনো ফোনের জন্য পাবেন দুইশো ডলার। সেটা ডাউন পেমেন্ট হিসেবে দিয়ে বাকি টাকা শোধ করবেন চব্বিশ কিস্তিতে। প্রতি মাসে দিতে হবে তেত্রিশ ডলার।

বাবু সাথে সাথে সায় দিয়ে বলল- বাবা, নিয়ে নাও। আমি তো কাজ করি। সেখান থেকে প্রতি মাসে তেত্রিশ ডলার দিয়ে দিতে পারবো। আইফোনে অভ্যস্ত হয়ে গেছো তুমি। অন্য ফোনে স্বস্তি পাবে না।

থ্যাংক ইউ বাবা। কাজ করে কটা টাকাই বা আর তুমি পাও। আমিই দিয়ে দেব।
না বাবা। তোমার জন্য এটুকু অন্ততঃ আমাকে করতে দাও।
কেন বাবা?

কারণ, তুমি আমার জন্য অনেক কষ্ট করে টাকা পাঠাও, সেটা আমি জানি। তাই এটুকু করার সুযোগ অন্তত আমাকে দাও।

বাবুর কথা শুনে ভালো লাগায় মন ভরে রইল আমার। খুশিমনে চললাম পুরনো ফোন বদল করে নতুন ফোন কিনতে। যেতে হবে ল্যানসিন সিটিতে। সেখানকার অ্যাপল স্টোরে এই অফার সুবিধা আছে। সাগিনো থেকে ঘন্টা দেড়েকের পথ। মন্দ কি! বেড়ানোর তালিকায় যোগ হোল আরেকটা নতুন শহর।

মিশিগান রাজ্যের মূল শহর ডেট্রয়েট। সংগত কারণেই ধরে নিয়েছিলাম, মিশিগান এর রাজধানীও নিশ্চয়ই ডেট্রয়েট। কিন্তু ইন্টারনেট ঘেঁটে বিস্মিত হই। ইউএস স্টেট মিশিগানের রাজধানী হল ল্যানসিন। ল্যানসিন মিশিগানের পঞ্চম বৃহত্তম শহর। ১৮৪৭ সালে স্টেট রাজধানী বলে ঘোষিত হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হোল, মিশিগান স্টেট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতিলাভ করে তারও দশ বছর পর। ল্যানসিনের জনসংখ্যা পাঁচ লাখের সামান্য বেশি। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ল্যানসিন এর আছে যথেষ্ট সুনাম। মিশিগান রাজ্যের অনেক সরকারি হেড অফিস এই শহরে। শিল্প-বানিজ্যেও ল্যানসিন সিটি যথেষ্ট সমৃদ্ধ।

দুটো গাড়ি নিয়ে আমরা দলেবলে চললাম ল্যানসিনের উদ্দেশ্যে। একটাতে নূর, বাবু, হাসি আর আমি। অন্যটাতে রাহুল, ধ্রুবনীল আর রুবাইয়াৎ। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম ল্যানসিন এর অ্যাপল স্টোরে। কিন্তু প্রথম ধাক্কাতেই হল আশাভঙ্গ। আমার পুরনো ফোনটার জন্য দুশো ডলার পাবো না। দেবে মাত্র একশো দশ ডলার।
কেন? জানতে চাই আমি।

সে ব্যাটা মেশিন এগিয়ে ধরে। সেখানে উঠে আছে একশো দশ।

কিন্তু আমার বন্ধু যে পেয়েছে দুইশো ডলার। এটা এত কম হবে কেন? এগিয়ে গিয়ে বলে রাহুল।

সেটা তো আমি বলতে পারবো না। সে উত্তর দিতে পারে শুধুমাত্র মেশিন। নির্লিপ্ত উত্তর সেলসম্যানের।

আমি আঁচ করে ফেলি ঘটনা। আমার ফোনের স্ক্রিন আসল নয়। চোখে দেখে বোঝা না গেলেও মেশিনকে ফাঁকি দেবে কীভাবে! স্ক্রিন বাদ দিয়েই হিসেব কষেছে নিশ্চয়। তাই বললাম, এটা তো এমনিতেই ফেলে দিতে হোত রাহুল। যা পাই তাইই লাভ।

আমাদের সম্মতি পেয়ে ওরা প্রসেস শুরু করে দিল। একশো দশ ডলারের একটা ক্রেডিট কার্ডও ধরিয়ে দিল আমার হাতে। এটা দিয়ে শোধ হবে ডাউন পেমেন্ট। এখন দিতে হবে প্রথম মাসের ইনস্টলমেন্ট এবং ট্যাক্সের পুরো টাকা। মোট ছিয়াত্তর ডলার। নগদে পরিশোধ করা যাবে না। দিলাম আমার ক্রেডিট কার্ড। সেলসম্যান বলল, এই কার্ড চলবে না। যার স্যোশাল সিকিউরিটি নম্বর আছে, লাগবে সেরকম একজনের ক্রেডিট কার্ড।
কারণটা বুঝলাম। এই অফার আমেরিকান সিটিজেন বা আমেরিকাতে যাদের স্যোশাল সিকিউরিটি নম্বর আছে শুধুমাত্র তাদের জন্য। বাবু তার কার্ড ভুলে বাসায় রেখে এসেছে। সুতরাং ঠিক হল আগামিকাল আবার আসবো। কিন্তু, আমার পুরনো ফোন আর ওদের দেয়া একশো দশ ডলারের ক্রেডিট কার্ড কি করবো? সেলসম্যান বলল- তোমার কাছেই রেখে দাও। কাল আসার সময় নিয়ে এসো।

ভাবলাম, কত বিশ্বাস করে এরা মানুষকে। যদি আর ফিরে না আসি, তাহলে তো একশো দশ ডলারের পুরোটাই আমার। পরদিন আবার গেলাম। ভাবলাম, সব তো ঠিকঠাক হয়েই আছে। সময় লাগবে না তেমন। কিন্তু, বেঁধে গেল ফালতু ঝামেলা।

আমেরিকার সাধারণ মানুষ বোকার হদ্দ। একটু এদিক ওদিক হলে গুলিয়ে ফেলে সবকিছু। আর প্যাঁচাল পারতে থাকে অযথা।

ওদের দেয়া সেই ক্রেডিট কার্ড আর পুরনো ফোনটা জমা দিলাম। কাউন্টারে আজ অন্য এক সেলসম্যান। সে বলল- ফোন জমা দিচ্ছো এখন। তাহলে এই ক্রেডিট কার্ড পেলে কোথায়? তুমি কি আগে আরও একটা ফোন জমা দিয়েছো?

না না। এই ক্রেডিট কার্ড এই ফোনের জন্যই গতকাল তোমরা দিয়েছিলে আমাকে। কিন্তু ফোন জমা নাও নাই।
তা হতে পারে না।

কিন্তু,হয়েছে তো! ওই যে উনি দরোজায় দাঁড়িয়ে আছেন, জিজ্ঞেস করো উনাকে। গতকালের কাউন্টারে যে ছেলেটি ছিল তার ডিউটি আজ শোরুমে গেটে।
সে ব্যাটা তার কাছে গিয়ে কি যেন গুজগুজ করে ফিরে এসে আবার সেই একই প্রশ্ন করে আমাদের। বিরক্ত হয়ে বলি- মেশিনে চেক করো। আর নয়তো একশো দশ ডলারের আর একটা ক্রেডিট কার্ড আমাকে দিয়ে দাও। আমারই লাভ তাতে।
যেন অকূলে কূল পেল সেলসম্যান। নতুন করে পুরনো ফোন বাবদ ডলার দেবার প্রসেস শুরু করল। মনে মনে বলি, আস্ত গাধা একটা। মেশিনে চেক করলেই তো বলে দেবে, এটার জন্য ক্রেডিট কার্ড অলরেডি ইস্যু হয়ে গেছে।
যা ভাবা তাই। ব্যাটা হতভম্ব হয়ে বলে- সামথিং রং উইথ দিস ফোন।
রং কেন?
মেশিন বলছে, এর জন্য ক্রেডিট কার্ড গতকালই ইস্যু হয়ে গেছে।
সেই কথাই তো তোমাকে বললাম। আর এটাই সেই ইস্যু করা কার্ড। মনে মনে বলি, আস্ত আহম্মক একটা!

তারপরও ঝামেলা ফুরায় না। কি করবে বুঝতে না পেরে সেলসম্যানটি ডেকে নিয়ে এল তার উর্ধতন এক মহিলা বসকে। সেই মহিলাকে আবার বোঝাতে হল গোড়া থেকে। তার হাবভাব দেখে মনে হল, যেন বিভ্রান্ত সেও। ভীষণ বিরক্ত হয়ে মহিলাকে বলি, এই সহজ বিষয়ট তোমাদের মাথায় ঢুকছে না! তাহলে এতবড় শো-রুম চালাও কিভাবে? তোমাদের এই ফালতু ঝামেলায় আমি আর থাকতে চাই না। এই নাও তোমাদের ক্রেডিট কার্ড। আর আমার ফোন আমাকে ফেরত দিয়ে দাও। তোমাদের কাছ থেকে ফোন কিনব না আমি।
ঝাড়িতে কাজ হল। সব ঝুটঝামেলা অতিক্রম করে অবশেষে ঘন্টা দুয়েক পর শেষ হল প্রসিডিউর। নতুন ফোনের বক্স আমাকে দিয়ে সেলসম্যান আমার পুরনো ফোনটা ড্রয়ার খুলে ঢুকিয়ে দিল। প্রথম প্রেমের মতো প্রথম আইফোন আমার। দীর্ঘদিনের সাথী। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ফোনের সাথে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসি অ্যাপল স্টোর থেকে। সাড়ে নয়টা বেজে গেছে তখন। প্রকৃতিতে নেমেছে গোধূলীর ছায়া।
সেলিব্রেশন হয়ে যাক তাহলে আঙ্কল। উৎসাহের সাথে বলল রাহুল। সায় জানায় নূর। গিন্নি হাসিও বলল, নিশ্চয়ই।

রুবাইয়াৎ সার্চ দিয়ে বের করে ফেলল একটা ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট। মাইল দেড়েক দূরে। রেষ্টুরেন্টের নাম ‘সোয়াগৎ’। আমরা হৈ হৈ করতে করতে চললাম সেদিকে। গেটে শাড়ি পড়া এক সুন্দরী নমস্কারের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। আসল নয়, বড় একটা প্ল্যাকার্ড। ছবিটি চমৎকার। রেষ্টুরেন্টের ইংরেজীতে লেখা নাম দেখে বুঝলাম, বাংলা করলে এর উচ্চারণ দাঁড়ায় ‘স্বাগত’। আমাদের ছেলেরা আমেরিকা থাকতে থাকতে বাংলা উচ্চারণ নিয়ে মাথা ঘামানো ভুলে গেছে।

আমি অবশ্য সবসময়ই বিদেশ ভ্রমণে কোন নাম দেখলেই তা বাংলার সাথে মেলাতে চেষ্টা করি। এটা আমার বরাবরের অভ্যাস। অনেকসময় মিলেও যায়। যেমন- থাইল্যান্ডে একটা হোটেলে ছিলাম, নাম ‘হোটেল সিয়াম’। এই নামে একটা ভ্রমণ উপন্যাসও লিখেছি। বাংলার সাথে মেলানোর চেষ্টা করতে করতে দেখি, আরে এতো আমাদের কালা কেষ্ট ঠাকুরের আর এক নাম ‘শ্যাম’। থাই উচ্চারনে ‘শ্যাম’ হয়ে গেছে ‘সিয়াম’।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, থাইল্যান্ডে ছিল একদা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রবল প্রতাপ। থাই ভাষার উদ্ভব পালি ভাষা থেকে। থাইল্যান্ডের পূর্বনাম ছিল ‘শ্যাম’। ইতিহাসে আমরা যেটাকে ‘শ্যাম দেশ’ বলে থাকি। কারো মতে, শ্রীকৃষ্ণের নামানুসারেই থাইল্যান্ডের এই নামকরণ হয়েছিল। অন্যমতে, থাইল্যান্ডের বিভিন্ন এলাকায় একদা শ্যামবর্ণের মানুষের প্রাধান্য ছিল। সে কারণেই নাম হয়েছিল ‘শ্যাম দেশ’।

যা হোক, স্বাগত রেষ্টুরেন্টে চেনা পরিচিত খাবার খেয়ে মন প্রফুল্ল হলো। ঢেকুর তুলতে তুলতে আমরা বের হলাম। রওনা দিলাম সাগিনোর উদ্দেশ্যে। সূর্য ডুবে গেছে সাড়ে নয়টার দিকে। সুতরাং এখন বলাই যায়, রাত পৌনে বারটা। এক গাড়িতে রাহুল, ধ্রুবনীল আর রুবাইয়াৎ। অন্য গাড়িটা আমার বাবু অরণ্য’র। বাবুর গাড়ি চালানোর পারমিট আছে, কিন্তু হাইওয়েতে চালানোর লাইসেন্স তখনও পায় নি বলে ড্রাইভিং সিটে বসেছে নূর। তার পাশে বসা বাবু। পেছনে হাসি আর আমি। গল্পে আড্ডায় সামান্য বিরতি দিয়ে সবে চোখ বুজেছি। ধম করে বিকট একটা শব্দে ঝিমুনি কেটে গেল। শুধু নজরে পড়ল কি যেন একটা ছায়ার মতো গাড়ির উপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। মেঘ নাকি! নাকি টায়ার বার্স্ট হল!
কি হোল নূর!

এক্সিডেন্ট আঙ্কল। ঠান্ডা গলায় বলে সে। নূর এমনিতেও খুব ধীরস্থির।

অবাক হয়ে ভাবি, ঘুমের ঝুলে অন্যকোন গাড়িকে মেরে দিয়েছে নাকি সে! কিন্তু সামনে কোন গাড়ি দেখি না। তাহলে কি পেছন থেকে অন্য কেউ আমাদেরকে ধাক্কা দিল!
কিন্তু, এক্সিডেন্ট এর কোন নমুনা তো দেখি না।
হরিনের সাথে এক্সিডেন্ট আঙ্কল।
বলো কি! হরিন এল কোথা থেকে?
হাইওয়ের দুইপাশের জঙ্গলে প্রচুর হরিণ আছে। ওরা অন্ধকারে অনেক সময় রাস্তা পার হয়ে এক জঙ্গল থেকে আরেক জঙ্গলে যায়। হঠাৎ গাড়ির লাইটে বিভ্রান্ত হয়ে লাফ দেয়।
সে হরিণ কই?

হরিণ তো আঙ্কল গাড়ির বনেটে বাড়ি খেয়ে গাড়ির উপর দিয়ে উড়ে পেছনে চলে গেছে।
বলো কি?

আমাদের ভাগ্য ভালো আঙ্কল যে, হরিণটা ছিল ছোট। মাথায় শিং নেই। বড় হরিণ হলে ধাক্কা খেয়ে গাড়ির সামনের কাঁচের উপর এসে পড়তো। কাঁচ ভেঙ্গে আমরা আহত হতে পারতাম। স্টিয়ারিং এর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গুরুতর এক্সিডেন্ট হতে পারত। মারাও যেতে পারতাম।

অতি সত্য কথা। কারণ, আমেরিকায় হাইওয়েতে গাড়ি চলে ঝড়ের গতিতে। আশি, নব্বই মাইল বেগে। কিলোমিটারে প্রায় দেড়শো। জায়গা বিশেষে গতি কমবেশি হয়। তবে ইয়ং জেনারেশন সুযোগ পেলেই মিটার নব্বই, পঁচানব্বই মাইলে উঠিয়ে ফেলে।
কিন্তু, আমাদের দেখা দিল অন্য সমস্যা। বন্ধ হয়ে গেছে গাড়ির স্টার্ট। নূর বেশ ঠান্ডা মাথার। সিগনাল দিয়ে আস্তে আস্তে ডাইনে নিয়ে রাস্তার বাইরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফেলল। ফোনে এক্সিডেন্টের কথা জানানো হয়েছিল রাহুল, ধ্রুবনীল আর রুবাইয়াৎকে। খানিক পরে ওরাও চলে এল। আমেরিকার নিয়ম হোল, এক্সিডেন্টের খবর সাথে সাথে পুলিশকে জানাতে হয়।

তাই পুলিশকে ফোন করা হোল। আমরা নেমে পড়ি গাড়ি থেকে। সামনে গিয়ে দেখি, বনেট ভেঙ্গে বাঁকা হয়ে তুবড়ে একেবারে ভিতরে ঢুকে গেছে। আমার বাবুর বড় শখের এই হাইব্রিড টয়োটা প্রিয়াস গাড়িটি। সার্ভিস ভাল, তেল খরচ কম। গাড়ির সামনের দুমড়ানো অবস্থা দেখে তার মুখ করুণ হয়ে গেছে।

গাড়ি আর স্টার্ট নিচ্ছে না। রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে চলে যাওয়ারও নিয়ম নেই। টো করে এখান থেকে গ্যারেজে বা বাসায় নিয়ে যেতে হবে। পুলিশের সাহায্যে নিতে হলে খরচ অনেক বেশি।

নূরের কাছে ফোন নম্বর ছিল এরকম একটা কোম্পানির। তারা টো করে অকেজো গাড়ি নিয়ে যায়। ফোন করা হল তাদেরকে। এরমধ্যে চলে এল পুলিশ। তারা সবকিছু নোট করে নিল। চলে এলো টো করে নিয়ে যাবার জন্য কেরিয়ারও। সবকিছু কেমন যেন ঘোরের মধ্যেই ঘটে গেল।

আমরা ফিরে যাচ্ছি সাগিনোর দিকে। যে আনন্দ নিয়ে আমরা এসেছিলাম ল্যানসিন সিটিতে, সে আনন্দ আমাদের বিষাদে পূর্ণ হয়ে গেল। আমাদের বাবু তার গাড়ির শোকে মন খারাপ করে বসে রইল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি আর আমারও খুব খারাপ লাগতে লাগলো।

আমার মনের মধ্যে বাজতে থাকে অন্য এক করুণ সুর। আহা, বেচারা হরিণটার কি হল! সেকি বেঁচে আছে! কাতরাচ্ছে যন্ত্রনায়! নাকি ইহলীলা সাঙ্গ হয়ে গেছে তার!

 

সুধাংশু শেখর বিশ্বাস

বিসিএস ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। সহকারী সচিব হিসেবে কর্মজীবন শুরু। মাঠ পর্যায়ে ছিলেন ইউএনও, এডিসি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আরডিএ, বগুড়ার পরিচালক। কাজ করেছেন উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। অবসর নিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে। উচ্চতর পড়াশুনা করেছেন লন্ডনে। প্রশিক্ষণ, সেমিনার, সরকারি কাজে ঘুরেছেন ইউরোপ, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, এশিয়ার বহু দেশ।

অবসর জীবন কাটে ঘোরাঘুরি আর লেখালিখি করে। লিখেছেন নমশূদ্র সম্প্রদায়ের জীবনধারা নিয়ে গবেষণাধর্মী উপন্যাস ‘নমসপুত্র’। পেলেন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। লিখলেন মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায় নিয়ে ‘শরণার্থী’, গণ জাগরণ মঞ্চ নিয়ে ‘দ্রোহের দীপাবলি’। লিখে চলেছেন একের পর এক উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিগল্প, ভ্রমণ কাহিনী।জন্ম ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার প্রত্যন্ত বিলের মধ্যে মধুপুর গ্রামে। বাবার কর্মসূত্রে শৈশব, কৈশোর কেটেছে খুলনা, যশোর, বরিশাল এলাকার বিভিন্ন জেলায়। স্কুল জীবন থেকেই যুক্ত ছিলেন ছাত্র রাজনীতি এবং ‘উদীচী’ ‘খেলাঘর’ এর মতো সংগঠনের সাথে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স করেছেন অর্থনীতি বিষয়ে।
প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পনের। উপন্যাস (৪)- নমসপুত্র, নমস উপাখ্যান, শরণার্থী, দ্রোহের দীপাবলি। ভ্রমণ কাহিনী (৬)- ম্যাকেলিনা, হোটেল সিয়াম, সাগিনো ভ্যালি, ঘুরে দেখা আমেরিকা, হোয়াইট চ্যাপেল, মস্কোর ঘন্টা। গবেষণা গ্রন্থ (১)- বিলের জীবন: নমশূদ্রদের বার মাসের তের পার্বণ। ছোটগল্প সংকলন (১)- স্ট্যাটাস। স্মৃতিকথা (৩)- সোনালি ডানার চিল (শৈশব), সোনালি ডানার চিল (কৈশোর), সোনালি ডানার চিল (যৌবন)।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top