মাথায় হাত রেখেই ফজু বুঝতে পারে যে তার মাথায় একটা গাছ গজিয়ে গেছে। সে তখন কপালে হাত দিয়ে বসে পড়ে। ‘হায় আল্লা, শ্যাষ পর্যন্ত এই হাল হইল!’
তার বুঝতে বাকি থাকে না যে এই গাছ গজানোর পেছনে কার হাত আছে। সে আক্কেলকে সমানে শাপ-শাপান্ত করতে থাকে। কারণ সে নিশ্চিত আক্কেলের দেয়া বুড়ো লাউয়ের বিচি খেয়েই তার এই অবস্থা হয়েছে। সেদিন লাউটা খাওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে যত বিপত্তি।
সেই কার্তিক মাস থেকে খান সাহেবের খামার বাড়ির কেয়ারটেকার কাম কামলা আক্কেল আলীর কাছে একটা লাউ খাওয়ার বাসনা জানাচ্ছে ফজু। শুরুতে লাউয়ের পাতা, তারপর লাউয়ের কচি ডগা, তারপর লাউ। প্রতিবারই আক্কেল হাতে থাকা আগাছা নিড়ানোর কাস্তে নিয়ে তেড়ে এসেছে। প্রায় হুঙ্কার ছুড়ে বলেছে, ‘ভাগ এইখান থাইক্যা; মালিকেরে এখনো একট পাতা খাওয়াইতে পারলাম না, অয় আইছে লাউয়ের পাতা খাইতে। কার্তিক মাসে জীবনে লাউয়ের পাতা চক্ষে দেখছস? লাউয়ের পাতা খাইতে চাও!’
আক্কেল যা-ই বলুক, যতই ভয় দেখাক আর হম্বিতম্বি করুক, সকালের রোদ পড়া চকচকে সবুজ লাউয়ের পাতাগুলো ফজুর জ্বিভে জল এনে দিতে একটুও কসুর করে না। ফজু তারপরও সাহস করে অনুনয় করে, ‘আক্কেল ভাই, গাছে তো হাজার হাজার পাতা, পাঁচ-দশটা ছিঁড়লে তো আর তোমার মালিক বোঝতে পারবে না।’
কি পিরিতের নাগর! সারা বছর কামলা খাটি আমি, গাছ লাগাই, সার দিই, নেট টানাইয়া ঘুরি দিই, কীটনাশক দিই—তহন তো কাউরে এক বালতি পানি দিতেও পাই না। আর যেই গাছ লকলকাইয়া উঠে অমনি তোমাগো জিহবারও লকলকানি শুরু হয়। ভাগ এইখান থাইক্যা।
আক্কেল ভাই এ্যাতো হম্বিতম্বি কইরো না তো। তুমি যে কি কি কর, কি কি খাও হেই সব আমরা দেহি। বস্তা বস্তা আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জামরুল, লিচু, নারকেল, শুপারি বিক্রি কর — ভাবো আমরা কিছু দেহি না! সব দেহি। কিছু কই না। এইবার তোমার সাহেব আর মেমসাহেব আইলে সব কমু। ভাবছ কি তারা তোমারে বিশ্বাস করে! তারা আাইয়া কি আমাগোর তোমার কায়কারবার নিয়া কিছু জিগায় না? জিগায় সবই জিগায়। আমরা বরং তোমার উপর দয়া দেহাইয়া কিছু কই না। ভাবি, খাউক ও খাইয়া বাঁচুক। একজন গরীব মানুষ তো খাইতাছে। কিন্তু সেই সুবাদে তোমার এ্যাতো ত্যাজ!
ফজুর কথায় আক্কেল এবার একটু নরম হয়। ফজু যে এভাবে মোক্ষম জায়গায় আঘাত করবে আক্কেল বুঝতে পারে নাই। সে তার চড়ায় ওঠা স্বরটা এবার একটু নরম করে বলে, বুঝিস তো ফজু— দুই একটু এদিক ওদিক করলেও আমার একটা ধর্ম আছে। ফল-ফলাদি, শাক-সব্জি যা-ই ফলাই প্রথম দফা মালিকেরে না দিয়া কোনো কিছুতে হাত লাগাই না। একু তর-স তোরেও দিমুনে। আগে হ্যাগোরে ঢাকায় পাঠাইয়া লই। এরপর স্বরটা আর একটু উচু গ্রামে নিয়ে গিয়ে বলে, তাছাড়া হ্যারা ক্যামন মানুষ ভাব, এই জায়গা জমির সব দায়িত্ব তারা আমার উপর দিয়া গেছে। ফল-ফলাদি যখন যেইটা পাকে তখন সেইটা না বেচলে চলব! তা টাকা যা হয় তা কি আমি একলা খাই নাকি? তাদের টাকা বুঝাইয়া দেই না? তারপরও এ্যাতো অবিশ্বাস আমারে, তরে পর্যন্ত জিগায়! এ কাজ আমি আর করমু না। এবার তারা আইলে সব বুঝাইয়া দিয়া চইল্যা যামু। শরীলে বল থাকলে কামের অভাব নাই।
ফজু এবার বিপদে পড়ে যায়। আক্কেল এই খামার বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে তারই অসুবিধা। আক্কেল তবু চাইলে মুলোটা, কলাটা, কচুটা তাকে দেয়। কিন্তু ওর বদলে আরো খ্যাচড়া কেউ এই বাড়ির কেয়ারটেকার হয়ে আসলে তো আরো বিপদ! তাই সে বলল, আক্কেল ভাই, তুমি মনে কিছু নিও না। মালিকরা ওরকম একটু আধটু অবিশ্বাস করে। সেইডা মনে রাইখ্যা চললে তো আর এমন রাজার হালে থাকতে পারবা না। নিজের সংসার তো ফুইল্যা ফাইপ্যা উঠছে, শুনলাম শশুর বাড়ির সংসারও এ্যাখন তুমিই টানতাছো।
আক্কেল আবারও কাছি নিয়ে তেড়ে আসে, যা এইখান থাইক্যা বদমাইশ!
ফজু সেইবারের মতো জান নিয়ে দৌড়ে আসে। তবে আক্কেল তাকে অসময়ে লাউয়ের কচি ডগা খেতে না দিলেও সিজন শেষে একটা লাউ দিয়েছিল। সেই বুড়ো লাউ খেতে গিয়েই হলো যত সমস্যা।
লাউ এমনই বুড়ো যে তার ভেতরে নখের আঁচড় বসানো সম্ভব ছিল না। কাটতে গিয়েও দা বটি দুটো অস্ত্রেরই সাহায্য নিতে হয়েছিল। এই লাউ সেদ্ধ করে খেতে গেলে যে স্বাদ টক হয়ে যাবে বুঝতে বাকী রইল না ফজুর। তাই সে বীচিগুলোকে বের করে নিয়ে পেঁয়াজ, রশুন আর শুকনো মরিচ দিয়ে শিল পাটায় ঘসে খাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে ফেলল। তবে তার বিচিগুলোও ছিল বেজায় শক্ত। সহজে শিলপাটার পিষুনিতে কাজ হচ্ছিল না। তার মধ্যে দু-একটা আস্ত রয়েই গেল।
সেই লাউয়ের বীচি ভর্তা খাওয়ার পর থেকে ফজুর পেটের মধ্যে কেমন যেন একটা অনুভূতি হতে লাগল। মাঝে মাঝেই মনে হয় পেটের মধ্যে কী যেন নড়ে চড়ে। মাঝে মাঝে মাথাও ঘুরায়, বমি বমি লাগে। এলাকার কোয়াক ডাক্তারকে ধরে রোগের বর্ণনা দিলে সে বলল, তুমি মেয়ে মানুষ হলে অন্য কিছু ধারণা করা যাইত ফজু, তয় যেহেতু তুমি পুরুষ মানুষ এইটা অন্য কিছু না, এ্যাসিডিটির সমস্যা। দিনে রাত্রে দু বেলা এ্যান্টাসিড খাও সব ঠিক হইয়া যাবে।
ফজুর দুবেলা খাবারই জোটে না ঠিক মতো আবার ওষুধ! সে ওষুধ খাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। কিন্তু তা বলে অসুখটাকে শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারল না। তার মাথা ঘোরানো আর বমি ভাবটা বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে একদিন রাতের বেলায় ঘুমের মধ্যে সে প্রচÐ মাথা ব্যথা অনুভব করল। ভাবল ভোর হলেই ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওষুধটা নিয়ে আসবে। কিন্তু ভোর হতে হতে ব্যথা কোথায় উধাও হয়ে গেল। শরীর জুড়ে কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব। আগের সেই গা গুলানো বমি ভাবটাও নেই।
সকাল বেলার বাহ্যি সেরে প্রতিদিন সে তার মেঝ ভাইর বৌ এর কাছে যায় এক কাপ চা খেতে। তার এই মেঝ ভাইয়ের বৌ’র সকাল বেলা চা না হলে চলে না। তাদের বাড়িতে চায়ের চল নেই, কোনো কালেও ছিল না। সারাকাল মোড়ের চা দোকানই ভরসা। তবে সেখানে চা খেতে গেলে তো আর মাগনা মেলে না, নগদ পাঁচ টাকা ফেলতে হয়। ফজুর সেই টাকা কোথায়। কেউ মাগনা মুফতে খাওয়ালে চলে, নয় তো ভো-ভো।
তার মেঝ ভাইর বৌ মেয়ে মানুষটা একটু ভিন্ন কিসিমের। সে কোনো কিছুর ধার ধারে না। তার ভাই এই মেয়ে মানুষটাকে যাত্রা দল থেকে ভাগিয়েছে। যাত্রা দলের প্রিন্সেস শাকিলা, তার পিছনে যে সব মেয়েরা সখি হয়ে নাচে সেই সখিদের একজন এই মর্জিনা। রায়েরকাঠি এলাকার শফিক মেম্বার যেবার যাত্রাপালা নিয়ে এলো, সেবার সেই যাত্রা পালার প্যান্ডেলের টিকিট চেকার ছিল ফজুর মেঝ ভাই মজু। ভাই তার কামেল আছে। সেই টিকেট কাটতে কাটতেই কি করে যেন এই প্রিন্সেসের সখিকে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। মেয়েটার ভাব ভঙ্গি, ঠমক ঠামক দেখার মতো। গ্রামের অন্য আর পাঁচটা প্যাচপেচে পান্তা ভাতের মতো মেয়ে না। তাই তো সকাল বেলা পান্তাভাতের বদলে সে খায় চা মুড়ি। কখনো বিস্কুট পেলে তো কথাই নাই। ফজুর ভাই মজু মানে মুজিবর তার বৌএর কাছে কাউকে ভিড়তে না দিলেও ওই সকাল বেলা একবার ফজু এসে যে এক কাপ রঙ চা খেয়ে যায় এটা সে মুখ বুজে সয়ে নিয়েছে। তার বিশেষ কারণও আছে।
তবে ফজু এই রঙচায়ের বিশেষ করে মর্জিনার হাতের এক কাপ চা খাওয়ার প্রতিদান দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যায়। এ বাড়িতে তার হাঁড়ি-কাঠি আলাদা হলেও সে ভালো কিছু খানা-খাদ্য জোগাড় করতে পারলে মর্জিনাকে এনে দেয়। তাই তো আক্কেলের পেছন পেছন সে এতো ঘোরাঘুরি করে সময়ে অসময়ে।
রোজকার মতো সেদিনও সে সকাল বেলা পৌছে যায় মর্জিনার রান্নাঘরে। সেখানে তখন ধোয়া তুলে চুলো ধরানোর চেষ্টা করছে মর্জিনা। দাওয়ায় বসতে বসতে ফজু জিজ্ঞেস করে, আইজ চুলায় এ্যাতো ধোঁমা ক্যান ভাবি, কাঠ ভিজা ছিল নাকি?
কথা শুনে মর্জিনা জল ভরা লাল চোখ নিয়ে ফজুর দিকে তাকায়। জ্বালা করা চোখে প্রথমে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে নাই। কিন্তু পরক্ষণেই চিৎকার করে উঠল সে। ও ফজু ভাই, তোমার মাথায় ওইটা কি?
ফজু কিছু বুঝে ওঠার আগেই মর্জিনা অজ্ঞান হয়ে গেল। ফজু তো আবাক! হলো কি মাইয়ালোকটার চোখে ধোয়া গিয়া ভুল দ্যাখতাছে নাকি?
মর্জিনার চিৎকার শুনে ঘর থেকে ছুটে আসে মজু। কি হইল কি তোর ভাবির! সে চিল্লায় ক্যান? ফজু তখন মর্জিনার চোখে মুখে পানি ছিটাতে ব্যস্ত। কাছে এসে মজু বলল, এ্যাই গাধা তুই মাথায় একটা কদু গাছ নিয়া ঘুরতেছিস ক্যান, নামা ওইটা মাথা থাইক্যা।
কথাটা শোনামাত্র ফজু মাথায় হাত রাখে, তার মাথায় কদুর চারা! কই সে তো কিছু জানে না! মাথায় হাত দিয়ে জিনিসটা সরাতে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যথায় কাকিয়ে ওঠে ফজু, আহ্!
তার ভাই বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে তোর আবার কি হইল, কাকাইতেছিস ক্যান? এ কিরে তোর মাথায় গাছ গজাইয়া গেছে দেখতাছি। ফজুর ভাইও ততক্ষণে অজ্ঞান।
২
ফজুর আসল নাম ফজলু। গরীবের নাম নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি থাকে না। যেটুকু নাম তাকে কেটে ছেটে সবাই বাদ দিতে পারলেই বাঁচে। গরীবেরে কেউ পুরো নামে ডাকতে চায় না। যে যত বড়লোক তার নাম তত লম্বা চওড়া হয়। ফজুর যদি অনেক টাকা থাকত তাহলে তাকে সবাই ফজলুল হক সাহেব বলে ডাকত তাতে কোনো সন্দেহ নাই। তবে ফজু শুধু গরীব তাই না সে শারিরীক প্রতিবন্ধিও। ছোটবেলায় পলিও হয়ে তার এক পা খোড়া হয়ে গেছে। সেই খোড়া পা নিয়ে ফজু কোনো কায়িক পরিশ্রম করতে পারে না। গরীবের কাজই সব শক্ত কাজ, আর ফজু তা পারে না। তাই সে জীবন বাঁচাতে যে সব কাজ করে তাকে বলে দুষ্ট কাজ। সে আগে খাল-বিল ডোবা-নালা থেকে বড়শি পেতে মাছ ধরত। এখন আর খালে বিলে মাছ পাওয়া যায় না। জায়গা জমির মালিকেরা পুকুর কাটিয়ে মাছ চাষ করে। ফজু মাঝে মাঝে চৌকিদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওইসব পুকুর থেকে মাছ চুরি করে। এইসব মাছ ধরা সোজা। মাছগুলা কেমন যেন বোকা বোক ধরণের। পুকুর পাড়ে গিয়ে একটু খাবার দিলেই একেবারে হাতের কাছে চলে আসে। তখন এদিক ওদিক তাকিয়ে কয়েকটা ঝাপির মধ্যে তুলে নিলেই হয়। তবে এই কাজটা সব সময় সম্ভব হয় না। কিন্তু খানা খাদ্য তো প্রতিদিনই জোটাতে হয়। পেট তো আর কোনো সুজোগের অপেক্ষায় বসে থাকতে চায় না। তার কাজই হলো সময় মতো ক্ষুধার জানান দেয়া। ফজু তাই ছোটে দুষ্ট কাজের নেশায়। মাঝে মাঝে সে এর মুরগি তার হাঁস চুরি করে। এ ছাড়াও আর একটা কাজ আছে তার। সেটলমেন্টের দালাল কৈলাশ নাথের কথামতো মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার কাজ করে সে। তাও দিতে হয় বুঝে শুনে। একই জাজের কোর্টে বারবার দাঁড়ানো যায় না। তারপরও তার কোনো বাঁধাধরা কাজ নেই। তাই তো প্রতি মুহূর্তে তাকে খাদ্যের খোঁজে ছুটতে হয়।
এখন সে ছুটছে আক্কেলের বাড়ির দিকে। কেন সে তার এমন ক্ষতি করল! এক বুড়ো লাউ তাকে গছিয়ে দিয়েছে বলেই তো তার মাথায় এখন গাছ গজিয়ে গেল।
আক্কেলকে পাওয়া গেল খান সাহেবের খামার বাড়িতে। সে ঢ্যাড়স গাছের গোড়ায় আগাছা নিড়ানী দিচ্ছে। এবার অসময়ে ঢ্যাড়স ফলাতে পারলে তার মনিব খুশি হবে। তার মনিব আবার ঢ্যাড়স খেতে খুব পছন্দ করেন। আক্কেল মন লাগিয়ে আগাছা পরিস্কার করছে, এমন সময়ে তার ওপরে এসে প্রায় হামলে পড়ল ফজু।
আক্কেল ভাই তুমি এইটা কি করলা!
আক্কেল কাজ না থামিয়েই বলল, কেন এখন আবার কি হইল?
ফজু খেয়াল করে দেখেছে বেশিরভাগ লোক তার সাথে কথা বলে তার দিকে না তাকিয়েই। কারো দিকে তাকালে তাকে যে একটা গুরুত্ব দেয়া হয়, সেই গুরুত্বটা সাধারণত গৌণদের কেউ দিতে চায় না। আক্কেলও তাই করল।
তারপরও চিৎকার করে বলতে লাগল, তুমি আমারে বীজকদু দিলা! খাইয়া আমার মাথায় গাছ গজাইয়া গেল।
কস্ কি! ফাজলামির জায়গা পাওনা? এখন এইখান থাইক্যা যা তো, কাজের সময় বিরক্ত করিস না।
আমি তোমারে বিরক্ত করতেছি? বিরক্ত করতেছি তোমারে? এই আমি থানায় গেলাম, পুলিশ আইস্যা পেদানি দিলেই বোঝবানে কি করতেছি না করতেছি।
পুলিশের কথা শুনে আক্কেলের টনক নড়ল, সে এবার তাকাল ফজুর দিকে। একি! সত্যিই তো তোর মাথায় একটা কদু গাছ গজাইছে, আশ্চর্য তো!
তুমি তাইলে স্বীকার করলা এইডা কদু গাছ !
হ, সেই রকমই তো দ্যাখা যায়।
এইডাই আমি শুনতে চাইছিলাম।
ক্যান?
কারণ বীজ কদুডা তুমি আমারে খাইতে দিছিলা।
তা কি হইছে?
এখন আমি গিয়া পুলিশরে হেই কতা কমু।
না, তুই যাবি না।
গ্যালে কি হবে?
কি হবে দ্যাখ, বলে আর একটুও সময় নষ্ট না করে ফজুকে আড়াআড়ি ধরে কোলে তুলে নিয়ে ডোবার পাশে বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের জন্য বানানো বড় গর্তটার মধ্যে তড়ি ঘড়ি পুতে দিল আক্কেল।
পাহাড় সমান আক্কেলের সামনে হালকা পাতলা ফজুর কোনো প্রতিরোধই কাজে লাগল না।
ফজু এবার পুরোপুরি গাছ হয়ে গেল। সে সমানে চিৎকার করছে কিন্তু কেউ শুনতে পাচ্ছে না। চিৎকার করতে করতে এক সময় তার গলা বসে গেল। এমন সময় পাশের গাছটা বলল, চিৎকার করে কোনো লাভ হবে না ভাই, তোমার কথা কেউ শুনতে পাবে না। তুমি এখন আর মানুষ নাই গাছ হয়ে গেছ।
৩
তবে গাছ জীবন ফজুর মন্দ লাগতেছে না। শুধু হাঁটাহাঁটি করতে পারতেছে না এই যা। অন্য সব কিছু ভাল। খানা খাদ্যের কোনো অভাব নাই। শরীর একটু দুর্বল হয়ে পড়লেই সার দেয়া হয় গোড়ায়। পোকা মাকড়ে ত্যাক্ত বিরক্ত করলে কীটনাশক ছিটাইয়া দেয়া হয়। মানুষ থাকা অবস্থায় তারে কতই না মশার কামড় খাইতে হইছে রাইতের পর রাইত। মশারির অভাবে গরমকালেও কাঁথা মুড়ি দিয়া মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছে। আর এখন, একটা ফলবান বৃক্ষ হইয়া যাওয়াতে তার কতই না কদর! কিন্তু ফজুর তারপরও মনে শান্তি হয় না। তার মনের মধ্যে এক নতুন বোধের জন্ম নিছে। এই বোধ তার মানুষ থাকতে ছিল না। তাই তার দুঃখ কষ্টের অনুভূতিগুলো ছিল ভিন্ন। কিন্তু এখন সে খুব সামান্য ব্যাপারেই কষ্ট পায়। যেটা তার মানব জন্মে পাইত না। যেমন, এখন কোনো গাছ থেকে কেউ ফল ছিড়লে সে কষ্ট পায়। সেদিন আক্কেল ডোবা থেকে কুচো চিংড়ি ধইরা নিয়া ভর্তা বানানোর জন্য যেই পেড়াইতে দিল, অমনি তার প্রাণের মধ্যে হু-হু করে উঠল। তার শেকড়ের কম্পন বাইড়া গেল। আহারে জ্যান্ত প্রাণী ওরা ক্যামনে কাইটা কুইটা পোড়া দিতেছে! এর পর কী করবে! খাইয়া ফেলবে নাকি? অথচ মানুষ থাকতে সে তো এসব কাজই কত করছে। তখন কিন্তু পরাণের মধ্যে এমন অস্থির অস্থির লাগে নাই।
সেদিন তো তার প্রায় হার্ট ফেল হয়ে যাইতেছিল। হৃদকম্পন এতেটাই বাইড়া গেছিল যে গোটা শেকড়শুদ্ধ কাঁপাকাপি। কারণ ওই খুন খারাবি।
আক্কেলের মনিব, খান সহেবের এলেম আছে। তার সাথে সমাজের উচু উচু লোকজনের ভাব। সেইসব বন্ধুবান্ধব নিয়ে তিনি সেদিন বেড়াতে আসছেন তার বাগান বাড়িতে। একবেলা থাকবেন, আমোদ ফুর্তি করবেন। এরা সবাই সমাজের উচু পদের লোক। আমলা, বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য খাদ্য পানীয় ছাড়াও কিছু সুন্দরী নারীও আসছেন। এই সব নারীদের দেখলেই ফজু বুঝতে পারে। তার মেঝভাবির মতো এদের ভাবভঙ্গি। এদের কখনো কারো মা, বোন, কন্যা, ভাবির মতো মনে হয় না। তারা নিজেদেরকে খাদ্যের মতো উপাদেয় করে রাখতে চায় সব সময়।
আহা ফজুর হঠাৎ ওই মেয়ে মানুষটার কথা মনে পড়ে বুকের ভেতরটা কেমন আনচান আনচান করে উঠল। তবে তার সেই আনচান ছাপিয়েও যে জিনিসটা এখন তাকে আমূল কাঁপিয়ে দিচ্ছে তা হলো মুরগি আর ছাগলের চিৎকার। অতিথীদের জন্য একের পর এক মুরগি খসি জবাই হচ্ছে। এদের গগনবিদারী চিৎকারে ফজুর মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। অথচ সে যখন মনুষ ছিল তখন খাসি মুরগি জবাই তো দূরের কথা মানুষ জবাই হইলেও তার ভেতরে কোনো প্রতিক্রিয়া হইতো না। তাইতো সে কৈলাশ নাথের কথা মতো মাত্র পাঁচ হাজার টকার বিনিময়ে আকরাম আলীর খুনের আসামী জমির শেখের পক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্যি দিয়া আসছিল। সেদিন তার কি যে আনন্দ! মর্জিনা বেগমের জন্য সে এক জোড়া নুপুর কিনে নিয়ে গেছিল। তার মন জুড়ে ছিল মর্জিনার খুশি ভরা মুখ দেখার কামনা।
কই তখন তো তার একটুও খারাপ লাগে নাই! সে তো তখন মানুষ ছিল, সৃষ্টির সেরা জীব। অথচ তখন সে এ্যাতো অনুভূতিহীন ক্যামনে ছিল! এ্যাতো নির্দয় ক্যামনে হইতে পারছিল! শুধু কি ওই প্যাটের দায়ে? তখন তার খাদ্যের এমন নিশ্চিত ব্যবস্থা ছিল না তাই? না, তা তো না। মানুষ যারা বড়লোক, খানা খাদ্যের অভাব নাই, তারাও তো কত কত খারাপ কাজ করে। জঘন্য সব অন্যায় করে। কেন করে? অস্তিত্ব টিকায়ে রাখার জন্য? ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সেরা হওয়ার তাড়নায়? না কি তাদের মধ্যে মানুষ হওয়ার কোনো বোধই কাজ করে না!
গাজী তানজিয়া
জন্ম: ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭। পিরোজপুর, বাংলাদেশ। পেশা: লেখক
উপন্যাস: ১. জাতিস্বর;২. পৃথিবীলোক
গল্প:১. সবুজ ঘাসে মুক্ত বেশে
রাজনৈতিক নিবন্ধ: অরক্ষিত দেশে অবরুদ্ধ সময়ে
পুরস্কার: আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১০