জাপানে রবীন্দ্রনাথের বাংলা বক্তৃতা

প্রবীর বিকাশ সরকার

১৯১৩ সাল থেকেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিকল্পনা করছিলেন ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথে য়োরোপ ঘুরে রাশিয়া পেরিয়ে জাপান ভ্রমণ করবেন। কিন্তু ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই য়োরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তাঁর এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। উপায়ন্তর না পেয়ে সমুদ্রপথে জাপান ভ্রমণের জন্য উদ্যোগ নিলেন তিনি। কিন্তু জাপান ভ্রমণের জন্য ব্রিটিশ-ভারত সরকারের অনুমতি পাওয়া নিয়ে কড়াকড়ি ছিল বলে জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা আমাকে একবার বলেছিলেন। এর কারণ হচ্ছে, জাপানি মনীষী শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন ১৯০২ সালে কলকাতায় গেলে পরে তাঁর সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপ্লবী সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। বাংলা প্রদেশে স্বাধীনতার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলনে সঙ্গে ওকাকুরার সম্পৃক্ততার কথা ব্রিটিশ সরকার ভালো করেই অবগত ছিল। রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবী না হলেও ভারতের স্বাধীনতাকামী একজন জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বেল ব্যক্তিত্ব। তাঁর আপন ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বাধীনতা আন্দোলনে গভীরভাবে জড়িত। তাঁর বাড়িতেই আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন ওকাকুরা। কাজেই রবীন্দ্রনাথ যদি জাপান ভ্রমণ করেন বা কোনো প্রকার সম্পর্ক রাখেন তা ব্রিটিশ সরকারের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না বলে সরকারের এরকম আশঙ্কা ছিল। যে কারণে রবীন্দ্রনাথকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯১৬ সাল পর্যন্ত।

১৯১৬ সালের এপ্রিল মাসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমেরিকায় বক্তৃতা প্রদানের জন্য আমন্ত্রিত হন। মে মাসের ১ তারিখ পিয়ারসন, অ্যান্ড্রুজ এবং মুুকুলচন্দ্র দেকে নিয়ে আমেরিকার দিকে রওয়ানা দেন। মাঝখানে জাপানে বিরতি দেবেন এই তাঁর পরিকল্পনা। কলকাতা বন্দর থেকে জাপানের “তোসামারু” নামক একটি জাহাজে চড়েন উল্লেখিত তিনজন সঙ্গীকে নিয়ে। কিন্তু চড়ে বসলেও জাহাজ ছাড়ল না অজ্ঞাত কারণে। ছাড়ল ৩ তারিখে। জাপানি জাহাজের অভিজ্ঞতা তাঁর এই প্রথম, এর আগে তিনি চার বার জাহাজে চড়েছেন সেগুলো ছিল য়োরোপীয়। জাপানি জাহাজে চড়ার পর থেকে তিনি ধীরে ধীরে অদেখা, অচেনা জাপানের আভাস যেন পাচ্ছিলেন। তাঁর “জাপান যাত্রী” গ্রন্থটি পাঠ করলে সেই অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়।

প্রায় এক মাস পর ২৯ মে জাহাজ এসে ভিড়ল জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোবে সমুদ্রবন্দরে। দীর্ঘ সমুদ্রপথে বাংলাভাষী কবিগুরু ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও কথা বলেছেন নিশ্চয়ই তরুণ মুকুল দের সঙ্গে। দেশ ছাড়লেই মাতৃভাষার টান খুব জোরে কণ্ঠ চেপে ধরে। কোবে অবতরণ করার পর তাঁকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয় জাপানি ভক্তদের মধ্যে, কে তাঁকে কোথায় নিয়ে আতিথেয়তা দেবেন! অসংখ্য সাংবাদিকও তাঁকে মৌমাছির মতো ঘিরে ধরেছিলেন সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। বিরক্ত হয়ে কবিগুরু জনৈক কোবে প্রবাসী অবাঙ্গালি ভারতীয়র বাসভবনে আতিথ্যগ্রহণ করেন। বলা বাহুল্য, তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান, বৌদ্ধপণ্ডিত ও ভিক্ষু কাওয়াগািচ একাই, দোভাষী হিসেবে বৌদ্ধপণ্ডিত ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক কিমুরা রিউকান/ কিমুরা নিক্কি, বৌদ্ধপণ্ডিত ও টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.তাকাকুসু জুনজিরোও প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিরা উপস্থিত হয়েছিলেন কোবেতে। এই সময় জাপানে বাঙালি বিপ্লবী কি কেউ ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। আগের বছর দুজন দুর্দন্ত বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ও হেরেম্বলাল গুপ্ত জাপানে পালিয়ে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন, পলাতক বিধায় তাঁরা কোবে যেতে পারেননি।

রবীন্দ্রনাথ প্রথম ভ্রমণের সময় জাপানে সর্বমোট ১১২দিন অবস্থান করেছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসের ১৮ তারিখে তিনি সদল য়োকোহামা সমুদ্রবন্দর থেকে আমেরিকার পথে যাত্রা করেন। এই তিন মাসের অধিক সময়ে তিনি একাধিক বক্তৃতা দিয়েছেন অবশ্যই ইংরেজি ভাষায়। প্রথম বক্তৃতা প্রদান করেন জুন মাসের ১ তারিখে ওসাকা শহরে অবস্থিত তেননোওজিকোওএন কোওকাইদোও মিলনায়তনে। বিষয়: “ইন্ডিয়া অ্যান্ড জাপান”, দোভাষীর কাজ কিমুরা রিউকান করেছিলেন বলে ধারণা হয়। যদিও সেইসময় ইংরেজি জানা জাপানি নিতান্তই স্বল্প, কবিগুরুর ইংরেজি বক্তৃতা জাপানি ভাষায় অনুবাদ করা ছিল খুবই দুরূহ।

জুন মাসের ৫ তারিখে কবিগুরু কোবে থেকে রাজধানী টোকিওতে আগমন করেন ট্রেন যোগে। টোকিও কেন্দ্রিয় রেল স্টেশনে শতাধিক ভক্ত তাঁকে ফুলেল অভ্যর্থনা জানান। টোকিওর আধুনিক উয়েনো শহরে শিল্পীবন্ধু য়োকোয়ামা তাইকানের বাসভবনে দশদিন আতিথ্য গ্রহণ করেন। ১০ তারিখ উয়েনোর পার্শ্ববর্তী ইয়ানাকা শহরে ওকাকুরা তেনশিন প্রতিষ্ঠিত “নিহোন বিজুৎসুইন” বা “জাপান আর্ট ইনস্টিটিউটে” কলকাতার জোড়াসাঁকোর “বিচিত্রা চারুকলা স্কুল চিত্রকর্ম প্রদর্শনী” উদ্বোধন করেন এবং “আইডিয়েলস অব আর্ট” বিষয়ে বক্তৃতা দেন। পরের দিন ১১ তারিখে টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে “এ মেসেজ অব ইন্ডিয়া টু জাপান” শীর্ষক এক দীর্ঘ বক্তৃতা প্রদান করেন।

রবীন্দ্রনাথের বাংলা বক্তৃতার জাপানি অনুবাদ

এই বক্তৃতায় তিনি জাপানের অতিরিক্ত পাশ্চাত্যপ্রীতি ও নির্ভরতা এবং উগ্র সমরবাদের তীব্র সমালোচনা করেন যা জাপানের বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক প্রতিবাদ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ঐ ১১ তারিখেই কবিগুরু সদল য়োকোহামাস্থ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অমরাবতী “সানকেইএন” বাগানবাড়িতে চলে যান। এর কর্ণধার ছিলেন বিশিষ্ট রেশম ব্যবসায়ী ও শিল্পকলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হারা তোমিতারোও। এই বাগানবাড়ি এবং হারা’র হাকোনো নামক শহরে অবস্থিত গ্রীষ্মাবাস মিলিয়ে ১০১ দিন অবস্থান করেছিলেন কবিগুরু। যাহোক, ১২ জুন জাপানের ঐতিহ্যবাহী মঞ্চ নাটক “নোহ্”র মঞ্চাভিনয় উপভোগ করেন তিনি।

টোকিওর উয়েনো কানয়েইজি বৌদ্ধমন্দিরে প্রদত্ত সংবর্ধনা সভায় রবীন্দ্রনাথ

১৩ জুন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উয়েনো শহরস্থ প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির “কানয়েইজি”র প্রাঙ্গণে এক মহাসংবর্ধনা প্রদানের আয়োজন করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়। বিভিন্ন শাখার বৌদ্ধপুরোহিত, ভিক্ষু, পণ্ডিত; খ্রিষ্টধর্মের বিশিষ্ট ব্যক্তি; শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, কণ্ঠশিল্পী, চিত্রশিল্পী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ তাতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তৎকালীন সংবাদপত্র থেকে জানা যায় যে, প্রায় ২১৮ জনের মধ্যে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী, প্রসিদ্ধ ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কাউন্ট ওওকুমা শিগেনোবু, শিক্ষামন্ত্রী শ্রী তাকাদা, কৃষি মন্ত্রী শ্রী কৌনো, টোকিও মহানগরীর মেয়র শ্রী ওকুমা, ব্যারন শ্রী কানদা, ব্যারন শ্রী তাকাগি, ব্যারন শ্রী ওকুরা, টোকিও রাজকীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য শ্রী ইয়ামাকাওয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভায় এসেছিলেন। তাঁর মাথায় ছিল লাল-বেগুনি রঙের আকর্ষণীয় তুর্কি টুপি। তাঁর একপাশে বসেছিলেন প্রধান মন্ত্রী, অন্যপাশে জেন্ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান মহাপুরোহিত মোকুসেন হিয়োকি।

রবীন্দ্রনাথকে এক নজর দেখার জন্য মন্দিরের তোরণ-দ্বারের বাইরে প্রচুর ছাত্রছাত্রী ও নাগরিকের প্রচণ্ড ঠেলাঠেলি, চেঁচামেচি ও হৈচৈ হয়েছিল। মঞ্চে টাঙানো দুই প্রাচীন চীনা ঋষির ছবির মাঝখানে কবিগুরু তাঁর নির্দিষ্ট আসনে উপবেশন করেন। মঞ্চের ওপরে ম্যাগনোলিয়া ফুলে সাজানো বৃহৎ ফুলদানি শোভা পাচ্ছিল। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক, সংবর্ধনা সভার সভাপতি ড.তাকাকুসু জুনজিরোও মঞ্চে দাঁড়িয়ে সভার উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

রবীন্দ্রনাথের সম্মনার্থে বক্তৃতা শুরু হয় বিশিষ্ট প্রবীণ জ্ঞানীজন কাওয়াসে শুউজি’র মাধ্যমে, তিনি বলেন, “বৌদ্ধধর্ম শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায়–ভারত। প্রাচীনকালে জাপানের এক রাজপুত্র শোওতোকু তাইশি মহাযান বৌদ্ধধর্মকে রাজনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে বৌদ্ধধর্মের সুন্দর নীতিসমূহ মর্মস্থলে প্রবেশ করে আজও পর্যন্ত আমাদের জীবনধারায় অবিচ্ছিন্নভাবে বয়ে চলেছে।” এরপর মহাভিক্ষু মোকুসেন হিয়োকি বলেন, “রবীন্দ্রনাথের ভাবধারা বুদ্ধের চিন্তাধারার সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে।” বক্তৃতার পর তিনি কালো রঙের দানপাত্রের ওপর রক্ষিত সম্মানজনক স্মারক উপহার হিসেবে পষড়রংড়হহব াধংব কবিগুরুর হাতে তুলে দেন। উক্ত মূল্যবান উপহার রবীন্দ্রনাথ হাত জোড় করে অত্যন্ত বিনয় ও সৌজন্য প্রদর্শনের মাধ্যমে গ্রহণ করেন। সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখে সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত সকলেই রোমঞ্চিত হয়ে ওঠেন।

এই কয়দিন রবীন্দ্রনাথ কেবল ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন। এবার বর্ণাঢ্য মর্যাদাসম্পন্ন সংবর্ধনা সভায় তিনি যে অত্যন্ত আনন্দিত, আন্দোলিত এবং আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন তা আর না বললেও চলে। তিনি কোন্ ভাষায় সংবর্ধনার জবাবে বক্তব্য রাখবেন এই নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় তাঁর নিজের মধ্যে এবং ভক্তকুলেও। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে দোভাষী বন্ধুবর কিমুরা রিউকানকে বাংলায় জানান যে, তিনি বাংলায় সহজ করে বলবেন, কিমুরা যেন জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে দেন। তাই সিদ্ধান্ত হয়। এখানে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবোধের প্রমাণ পাওয়া যায়। মঞ্চের আসন থেকে দাঁড়িয়ে তিনি বাংলায় নাতিদীর্ঘ বক্তব্য প্রদান করেন। সেই বক্তব্য শুনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অভিভূত হন উপস্থিত সকলেই। তাঁদের কাছে সুদূর ভারতবর্ষের অন্যতম ভাষা “বাংলা” এই প্রথম শোনা। কবিগুরু ধীরস্থির শান্ত কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলেন, যা সুরমধুর জলপ্রবাহ ও সঙ্গীতের মতো শোনাচ্ছিল বলে জানা যায়। স্বয়ং প্রধান মন্ত্রী শ্রী ওওকুমা এবং আচার্য ড.ইয়ামাকাওয়া প্রবল আবেগে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন।
কবিগুরুর এই বক্তৃতাটি লিখিত ছিল কি না জানা যায় না। এটাই তাঁর জাপানে প্রথম বাংলা বক্তৃতা। বাংলা ভাষায় সুদক্ষ দোভাষী কিমুরা’র সুচারু অনুবাদ শুনে জাপানি অতিথিরা যে আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন বলাই বাহুল্য। জাপানি ভাষায় প্রদত্ত অনুবাদ লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাকেদা তোয়োশিরোও, ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ তরুণ সংস্থার প্রথম সভাপতি, বিশিষ্ট লোকসাহিত্য গবেষক, বৌদ্ধপণ্ডিত এবং গ্রন্থকার। জাপানি ভাষায় বক্তৃতাটি আবিষ্কার করেছি একটি পুরনো স্মারক গ্রন্থ থেকে।

স্মারক গ্রন্থ ঋষি টেগোর

১৯১৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রথম জাপান ভ্রমণ উপলক্ষে একটি স্মারক গ্রন্থ “সেই তাগো-রু” বা “ঋষি টেগোর” নামে প্রকাশিত হয়েছিল। তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট বিদগ্ধজনেরা তাঁকে নিয়ে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচার লেখেন। সেইগুলোর সঙ্গে সেই সময় জাপানে প্রদত্ত দুটি বিখ্যাত বক্তৃতাসহ বাংলায় প্রদত্ত উক্ত বক্তৃতারও জাপানি অনুবাদ গ্রন্থস্থ করা হয়েছে। বক্তৃতাটি জাপানি ভাষা থেকে জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন এবং তাঁর রচিত “উজ্জ্বল সূর্য” গ্রন্থে মুদ্রিত আছে। এটাকেই ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন সুপ্রিয়া রায় “টক্স ইন জাপান” গ্রন্থের সম্পাদক ২০০৭ সালে। প্রকৃতপক্ষে, দুটি গ্রন্থেই প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতাটি সম্পূর্ণ নয়, বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বাদ পড়ে গেছে। তাই আমি মূল জাপানি থেকে বাংলায় অনুবাদে ব্রতী হলাম। কেননা এই নাতিদীর্ঘ বক্তৃতাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ আমাদের বাঙালিদের জন্যেও। এবার পড়া যাক উক্ত সংবর্ধনার জবাবে কবিগুরু জাপানিদের উদ্দেশে কী বলেছিলেন?:

“ভারত ছেড়ে এই প্রথম আমি সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের যে স্থানে পৌঁছেছি সেটা কোবে। কোবে শহরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলাম, এখানে পাশ্চাত্য ধারায় তৈরি বাড়িঘর যেমন আছে, তেমনি জাপানি শৈলীর বাড়িঘরও ছিল। আবার মানুষজনের মধ্যে জাপানি যেমন ছিল, পাশ্চাত্যজনও ছিল, পাশ্চাত্যসদৃশ লোকও ছিল। আমি কোবেতে যখন ছিলাম জাপানের স্বাদ গ্রহণের চেয়ে বরং অশুভ ড্রাগন তার ভয়ঙ্কর দাঁত বের করে গিলে ফেলবে এমন জায়গায় যেন এসে পড়েছি! না এলেই ভালো ছিল বলে অনুভব করেছিলাম।
কিন্তু টোকিওতে আসার সময় মাঝখানে যখন বৌদ্ধভিক্ষুরা ধূপ-ধুনো দিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন, সেই মুহূর্তেই আমি সত্যিকারের জাপানকে অনুভব করতে পারলাম। যখন আমি টোকিওতে পৌঁছলাম, তখন আমার মনে হয়েছে–টোকিওবাসীদের আচার-ব্যবহার সব যেন কবিতার মতো, আর আমি যেন ফুল ফোটানো চেরী গাছগুলির মধ্যে ঢুকে পড়েছি। এই কয়েক দিন জাপানের স্বরূপ ও সৌন্দর্য দেখে আমার মন ভরে উঠেছে। প্রাণঢালা অভ্যর্থনায় আমি খুব সংকোচ বোধ করছি। এটা চীন, কোরিয়া ও মঙ্গোলিয়ায় শিক্ষকস্বরূপ বুদ্ধের দেশে আমি জন্মেছি বলেই সম্ভব হয়েছে, তাই আমিও বুদ্ধকে ভক্তি জানাই।

দুই হাজার বছর পূর্বে বুদ্ধ জাপানের চিন্তাজগৎকে অধিকার করেছেন, তিনি যদি তখন জাপানে আগমন করতেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই অসামান্য অভ্যর্থনা লাভ করতেন। আমি ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় গিয়েছি। কিন্তু সেখানে দেখেছি অর্থ, ক্ষমতা আর বস্তুবাদের জগৎ। জাপানে এসে প্রেমের, নান্দনিকতার, পুন্যাত্মা মানুষের জীবনাচারের জগতে এই প্রথম আমি কবি হিসেবে আসন লাভ করলাম।

এই দেশের শিশু এবং পূর্ণবয়সীদের কথা এককথায় বলতে গেলে, তাদের অন্তরে সদাই জাগ্রত ভালোবাসা ও ধর্ম। আমাদের ভারত হচ্ছে কথা সর্বস্ব দেশ। বিপরীতে জাপানিরা দয়ালু, বাচাল নন। ধর্মের সঙ্গে, জন্মগত বিশ্বাসের সঙ্গে, জীবনাচারের সঙ্গে মৃত্যুবরণ–জাপানিদের এই চিন্তাধারার মধ্যে বুদ্ধের শিক্ষা মূল শেকড় হয়ে আছে বলে মনে হয়।

আমার পর্যবেক্ষণকে যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে জাপানের মধ্যে দুটি জাপান বিদ্যমান। একটি হচ্ছে পুরনো জাপান, অন্যটি নতুন। নতুন জাপান পাশ্চাত্য সভ্যতাকে হুবহু ধারণকৃত বলে দেখতে পাচ্ছি। তার বিপরীতে, পুরনো জাপানে দেশগঠনের অতীত ভাবমূর্তি এখন পর্যন্ত অস্তিত্বমান বলে জানান দিচ্ছে। যদি বর্তমানের তরুণ শিক্ষার্থীরা অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্ম পুরনো জাপানকে ভুলে যায় তাহলে জাপান নিঃসন্দেহে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আমি এখানে উপস্থিত আপনাদের কাছে অন্তরমথিত আকাক্সক্ষা করি, পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে শ্বাশত জাপানি সভ্যতার সমন্বয় সাধন করত, শেষদিন পর্যন্ত আবহমান জাপানের পুরনোকে ভিত্তি করে নতুন গৃহ নির্মাণ করবেন।

গরু, ঘোড়া, ব্যাঘ্র বস্তুবাদী শক্তির দিক থেকে মানুষকে পরাজিত করে যদিও, আধ্যাত্মিক শক্তির ক্ষেত্রে (মানুষ) নিজেই তাদের চেয়ে মহাশক্তিশালী। জাপানের মানুষ নিশ্চিতভাবেই আধ্যাত্মিক শক্তি, প্রাণশক্তির ধারক স্বীকার করি। আমি চাই যে-কেউ চিরদিন এটা ধারণ করুক।

এখন আমার একটিই প্রত্যাশা যে, পাশ্চাত্য সভ্যতাকে আমদানি করে তার সংস্পর্শে থেকে প্রাচীন জাপানের সভ্যতা দৃঢ়ভাবে সংরক্ষিত হবে। এভাবে লভ্য নতুন জাপানের সভ্যতা দ্বারা পশ্চিমও একদিন আলোকিত হবে। এভাবেই পূর্বদেশের তীর থেকে ক্রমান্বয়ে পশ্চিমের মহাদেশ আলোকিত হবে। আমি সেই আলোক-জ্যোতির প্রার্থনা করছি, এবং এর লক্ষ্যে করজোড়ে করছি উপাসনা। আমার মতো বিদেশিরাও ঐ জ্যোতির আশায় সাগ্রহে প্রতীক্ষিত। আরও বলতে চাই কিন্তু শেষ হবে না, যাহোক, এখানেই শেষ করছি।”

সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে আগত অতিথিদের সঙ্গে একটি স্মারকচিত্র গৃহীত হয় মন্দির প্রাঙ্গণে। এরকম বহুজন পরিবেষ্টিত ছবি রবীন্দ্রনাথের আর দ্বিতীয়টি আছে বলে জানা নেই। এতে বোঝা যায়, এশিয়ায় অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে প্রথম নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কী রকম জনপ্রিয়তা ছিল জাপানে!

 

প্রবীর বিকাশ সরকার

শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক।

জন্ম ১৯৫৯ সালে। সাহিত্যচর্চার শুরু ১৯৭৬ সালে। জাপানে গমন ১৯৮৪ সালে।
‘বাংলাদেশ সোসাইটি জাপানে’র সাংস্কৃতিক এবং প্রকাশনা সম্পাদক (১৯৮৭-৯০)।
‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখা’ গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা (১৯৯০)।
‘আড্ডা টোকিও’সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য (১৯৯৪)।
‘সাংবাদিক-লেখক ফোরাম জাপানে’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক (১৯৯৮)।
মাসিক ‘মানচিত্র’ প্রকাশ ও সম্পাদনা (১৯৯১-২০০২)।
জাতীয় শিশু সংবাদপত্র ‘কিশোরচিত্র’ প্রকাশ ও সম্পাদনা (২০০৭)।
জাপানের তাকুশোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি গবেষক (২০০৪-৫)।
গিফু মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দক্ষিণ এশিয়া গবেষণা কেন্দ্র জাপান এর বিশেষ অতিথি গবেষক (২০২০-২১)।
গ্রন্থ : অসংখ্য গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। উল্লেখ যোগ্য গ্রন্থগুলো- জানা অজানা জাপান ১.২.৩
খণ্ড, জাপানের নদী নারী ফুল, জাপানে গণিকা সংস্কৃতি, Rabindranath Tagore: India-Japan Cooperation Perspectives, রবীন্দ্রনাথ ও জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক ১.২.৩ খণ্ড, জাপানে রবীন্দ্রনাথ, জাপানি ব্যবসায়ীদের মননে রবীন্দ্রনাথ, সূর্যোদয়ের দেশে সত্যজিৎ রায়, অতলান্ত পিতৃস্মৃতি, কলকাতার স্মৃতিকথা এবং নিহোন গা আজিয়া অ মেজামে সাসেতা (জাপানি)।
সম্মাননা : নিহনবাংলা.কম বিশেষ সম্মাননা ( ২০১৫)
গুনমা, সাইতামা এবং তোচিগি প্রবাসী বাংলাদেশী বিশেষ সম্মাননা (২০১৯)
বিবেকবার্তা বিশেষ সম্মাননা ( ২০১৯)

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top