আবদুর রব
কানাডার নোভা স্কোশিয়া, প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড এবং নিউ ব্রান্সউইকে আমার ইণ্ডিয়ার সেভেন সিস্টারের অনুকরণে থ্রি সিস্টার বলে ডাকতে ইচ্ছে করে। এই তিন প্রভিন্স দেখার আগ্রহ ছিল অনেক দিনের। বিশেষত আমার স্ত্রী বেবী যখন নোভা স্কোশিয়ার সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্লোমা করতে যায় ২০০৫ সালে। সেই সুপ্ত ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ২০১৭ সালে কানাডা যাওয়ার আগে বিষয়টা মনট্রিয়লে বসবাসরত আমাদের ছেলে তুরীয়কে জানাতেই ও রাজী হয়ে গেল। জুলাই এবং আগস্ট হচ্ছে প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডে বেড়াতে যাওয়ার সব চেয়ে সুন্দর সময়। এখানে আগস্টের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে সমুদ্রের জল গরম হয়ে ওঠে। কোথায় থাকা হবে এবং কী কী দেখা হবে তাও পরিকল্পনা করে ফেলল তুরীয়। ঠিক হলো মনট্রিয়ল থেকে গাড়ি চালিয়ে ওরোমোক্টো গিয়ে রাত্রি যাপন করা হবে । এরপর বে অব ফান্ডি হয়ে মঙ্কটন, শেডিয়াক ও কনফেডারেশন ব্রিজ দেখে প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডে যাওয়া হবে।
মনট্রিয়ল থেকে জুলাইয়ের ৯ তারিখে তুরীয়, আমাদের বৌমা সেজা, বেবী আর আমি সকাল সকাল ট্রান্স-ক্যানাডিয়ান হাইওয়ে দিয়ে রওয়ানা হই প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের (পিইআই) উদ্দেশ্যে। এই হাইওয়ে কানাডার কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের যৌথ উদ্যোগ। বিনিয়োগও আসে প্রোভিন্স থেকে। এই পথ সমগ্র কানাডাকে মালার মতো গেঁথে ফেলেছে একই সূতায়।
তুরীয়’র নিজস্ব গাড়িতে করে আমরা রওয়ানা হয়েছিলাম। কারণ প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড এমন জায়গা নয় যেখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবহার করে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ানো যায়। দ্বীপের বেশিরভাগ জায়গায় পাবলিক পরিবহনে ভ্রমণ করার জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই। অতএব দ্বীপ দেখার এবং ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নিজেদের গাড়িতে ভ্রমণ। আর আমরা যেহেতু অল্প সময়ে অনেক জায়গা দেখার পরিকল্পনা করেছিলাম তাই নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থারও দরকার ছিল।
আমরা খুব সকালে আমরা মনট্রিয়ল থেকে বের হলাম। তাই কুইবেক সিটিতে এসে যাত্রা বিরতি দিয়ে লাঞ্চ সেরে আবার রওয়ানা হলাম। সন্ধ্যা নাগাদ ৮২৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ওরোমোক্টো পৌঁছালাম । রাতে থাকার জন্য ব্রাইসন বুলেভার্ডের ডেজ ইন উইন্ডহ্যাম ওরোমোক্টো কনফারেন্স সেন্টার এন্ড হোটেল বুক করা ছিল আগেই । অতএব রাত কাটানোর জন্য ব্যবস্থা হয় এখানে । পরদিন সকালে যাত্রার শুরুতে দেখা দিল এক বিভ্রাট। চাকায় হাওয়া নেই। কোনো রকমে একটা মটর রিপেয়ার শপে নিয়ে টায়ারটা দেখানোর পর ওরা জানালো টায়ারের সর্বোচ্চ সময়সীমা পার হয়ে গেছে এবং আর ব্যবহার করা যাবে না। বাধ্য হয়ে নতুন আরেকটা টায়ার কিনে, চাকায় লাগিয়ে রওয়ানা হতে হতে অনেকটা সময় গড়িয়ে গেল।
আজকের যাত্রাও ছিল হেকটিক। ওরোমোক্টো থেকে বে অফ ফান্ডি। দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। বে অফ ফান্ডি উত্তর আমেরিকার সাত বিস্ময়ের মধ্যে একটা। এই বে প্রাকৃতিক বিস্ময় কারণ কানাডার পূর্ব উপকূলের বিষুবরেখা এবং উত্তর-মেরুর অর্ধেকের মধ্যে অবস্থিত। ফান্ডি বে কেবল তার জোয়ারের জন্য নয়, ভূতাত্ত্বিক আবিষ্কার (ডাইনোসর জীবাশ্ম) এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের (তিমি) জন্যেও বিখ্যাত।
২০১৪ সালে বিশেষজ্ঞদের একটি আন্তর্জাতিক প্যানেল পৃথিবীর সর্বোচ্চ জোয়ার, বিশ্বের বিরলতম তিমি, মূল্যবান খনিজ, ডাইনোসর জীবাশ্ম ও বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক বিস্ময় হিসাবে সংরক্ষণের জন্য এই উপসাগরকে বেছে নিয়ে অর্থ সাহায্য দিতে সম্মত হয়েছিল।
স্রোতে ক্ষয়ে যাওয়া পাহাড় দেখে ভাবছিলাম কত শত বছর ধরে স্রোতের অভিঘাতে আজ এমন দশা হয়েছে। প্রকৃতির এই রূপ দেখে ব্যথিত হলেও এও যে প্রকৃতির রূপান্তর প্রক্রিয়ারই অংশ ভেবে সান্ত্বনা পেলাম। ঘোরাঘুরি, ছোটাছুটি ও ছবি তোলা শেষ হলে লোকাল একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে মঙ্কটনের দিকে এগুতে শুরু করলাম। প্রায় দুই/আড়াই ঘন্টার পথ। মঙ্কটন কানাডার নিউ ব্রান্সউইক প্রভিন্সের একটা শহর। এখানে এসে আমরা ম্যাগনেটিক হিল বা চুম্বক পাহাড় দেখতে গেলাম। শহরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে এই পাহাড় অবস্থিত।
ম্যাগনেটিক হিল একটা চৌম্বুকীয় বা মাধ্যাকর্ষণ শক্তিসম্পন্ন অপটিক্যাল ইলিউশন তৈরি করে। এতে পাহাড়ের নিচে সমতলে চৌম্বুকীয় এলাকায় গিয়ে গাড়ি নিউট্রাল করে দিলেও গাড়ি চলতে শুরু করে। গাড়ি চালকরা ২/৩ বার গাড়ি নিয়ে আসা-যাওয়া করে বিষয়টা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করে। বিষয়টা ১৯৩০ সালের দিকে যখন মঙ্কটনে মটরযান চলাচল বেড়ে যায়, তখন চালকরা আবিষ্কার করেন যে এই ছোট পাহাড়ে একটা রহস্যময় ঘটনা ঘটে। তারা পাহাড়ের নিচে সমান জায়গায় গিয়ে ব্রেক থেকে পা সরিয়ে নিলে গাড়িটি পিছনের দিকে গড়িয়ে যেতে দেখে হতবাক হয়ে যায়। এই অদ্ভুত ঘটনার কারণ হিসেবে কেউ বলতেন এলিয়েনদের কাজ। কেউ কেউ ভাবতেন এটা একটা প্যারানর্মাল ঘটনা। অনেকে আবার ভাবতেন এ ভূতের কারসাজি। বিষয়টা পরখ করার জন্যে দুই-তিনবার গাড়ি চালিয়ে দেখলো তুরীয়। আমরাও স্বচক্ষে দেখলাম ব্যাপারটা।
পাহাড়টা এখানকার একটা জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র। দর্শনার্থীরা বিশাল চুম্বক চিহ্নটি সন্ধান করে এখানে আসে। পর্যটনের ভরা মৌসুমে, যানবাহনপ্রতি প্রায় ৬ কানাডিয়ান ডলার চার্জ করা হয়। মজার এই অপটিক্যাল ইলিউশন অনুভব করার তুলনায় এই চার্জ খুব কম।
ম্যাগনেটিক হিল দেখা শেষ হলে নিউ ব্রান্সউইকের শেডিয়াকের দিকে এগুতে থাকে গাড়ি। আধা ঘন্টার ড্রাইভ। আটলান্টিক কানাডার সর্বাধিক পরিচিত ল্যান্ডমার্ক এবং সর্বাধিক ফটো তোলা হয় এখানে। এখানকার পর্যটন আকর্ষণ হলো জায়ান্ট লবস্টার। কানাডায় নিউ ব্রান্সউইকে রোড ট্রিপের সময় দেখার জন্য এ-একটা চমৎকার জিনিস। ১৯৮৯ সালে কংক্রিটের বেদীতে গ্লাস ফাইবার দিয়ে লম্বা পা-ওয়ালা বিশ্বের বৃহত্তম লবস্টারের এই মূর্তিটি এক লাখ সত্তুর হাজার কানাডিয়ান ডলার ব্যয় করে তৈরি করা হয়।
এটাকে বিশ্বের বৃহত্তম লবস্টার বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার রোজটাউনের বিগ লবস্টারটাই এখন সবচেয়ে বড়। প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ দর্শনার্থী শেডিয়াকের রোটারি পার্কে ভিড় করে এবং বিশ্বের বৃহত্তম এই লবস্টারটি একবার দেখার জন্য। ভাস্কর্যটি জাতীয় টিভি বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছে এবং অ্যামেজিং রেস কানাডার মতো টেলিভিশন শো’তে হিট হয়েছে। ১১ মিটার লম্বা, ৫ মিটার প্রস্থ, ৫ মিটার উচ্চতা এবং প্রায় ৯০ টন ওজনের এই শিল্পকর্মটি শেডিয়াক রোটারি ক্লাবের সৌজন্যে আলোর মুখ দেখে।
এবার আমরা আমাদের মূল গন্তব্য প্রিন্স এডয়ার্ড আইল্যান্ডের দিকে অগ্রসর হলাম। এই দ্বীপের প্রবেশ পথ হচ্ছে কনফেডারেশন ব্রিজ। এই ব্রিজ একটা বিশ্ব প্রকৌশলগত কৃতিত্ব এবং প্রিন্স এডয়ার্ড আইল্যান্ডকে সেন্ট লরেন্স উপসাগরের দক্ষিণ অংশে নর্থম্বারল্যান্ড স্ট্রেটকে মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত করেছে। মোট ১২.৯ কিলোমিটার বা ৮ মাইল দীর্ঘ এই সেতু বরফে ঢাকা জলের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু। পার হতে সময় লাগে প্রায় ১০ মিনিট।
সেতুর সর্বোচ্চ বিন্দুর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০ মিটার উপরে, যা ক্রুজ জাহাজসহ বড় বড় সমুদ্র জাহাজগুলিকে সেতুর নিচ দিয়ে অনায়াসে চলাচল করতে দেয়।
সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৯৩ সালে এবং ১৯৯৭ সালের ৩১শে মে তা খুলে দেওয়া হয়। অনেক দ্বীপবাসী এখনও একে ‘লিঙ্ক’ হিসাবে উল্লেখ করে। অনেক আলাপ আলোচনা করে সেতুটি কানাডিয়ান কনফেডারেশন গঠনের নামে নামকরণ করা হয়। সেতু তৈরি করতে চার বছর সময় লাগে এবং এতে মোট ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। নিউ ব্রান্সউইক ফেরির জন্য এ-যেন কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার মতো একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় এবং দ্বীপের জীবনকে চিরতরে পাল্টে দেয়।
প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডে যাওয়ার আগে, নিউ ব্রান্সউইকের দিক থেকে চমৎকার দুটো স্থান আছে যেখান থেকে ব্রিজটাকে দেখা যায় সুন্দরভাবে। ব্রিজের নিচে, বে-ফিল্ডে, সমুদ্রের কাছে একটি ওয়াকওয়ে দিয়ে, উপকূলীয় বন এবং জলাভূমির মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। ওয়াকওয়ের চারপাশের জায়গাটা বেশ মনোরম। শেষ পর্যন্ত ওয়াকওয়েটা একটা ন্যাচারাল সেন্টারের সংযুক্ত। প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড থেকেও সেতু দেখার বেশ কয়েকটা জায়গা রয়েছে। আমরা এরকম একটা ভালো জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিলাম দ্বীপ ভ্রমণের স্মৃতি হিসেবে।
যদিও এই সেতু মূল ভূখণ্ডের সাথে আরও দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য সংযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে তবু এটা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় উত্তপ্ত বিতর্কের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৭৩ সালে প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড কনফেডারেশনে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযোগ বজায় রাখার গুরুত্বের কথা চিন্তা করে দ্বীপের রাজনৈতিক নেতারা সারাবছর দ্বীপের লোকেরা যাতে মূল ভূখণ্ডের সাথে সহজে যাতায়াত করতে পারে সেরকম একটা পরিষেবা প্রতিষ্ঠা এবং তা বজায় রাখার জন্য একটা ধারা কনফেডারেশনে যুক্ত করে। তবে প্রথম দিকে সেই প্রতিশ্রুতি পালন করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল কর্তৃপক্ষের জন্য।
শীতকালে পুরু বরফের কারণে জাহাজ চলাচল এবং ফেরি পরিষেবা প্রায়শ দিনের পর দিন ব্যাহত হত। বিষয়টা বিবেচনা করে ১৮৮৫ সালে, প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের সিনেটর জর্জ হাওলান প্রথম মূল ভূখণ্ডের সাথে একটি নির্দিষ্ট সংযোগ নির্মাণের ধারণা চালু করেন। হাওলান একটি সুড়ঙ্গের মতো কাঠামোর কথা ভেবেছিলেনে যা সমুদ্রের নিচে দিয়ে যাবে। এক বছর পরে দ্বীপের এক প্রতিনিধিদল লন্ডনে যায় একটা রেল সুড়ঙ্গের জন্য লবি করতে, কিন্তু তাতে কেউ কর্ণপাত করেনি। ১৯৬২ সালে প্রধানমন্ত্রী জন ডাইফেনবেকার ঘোষণা করেন যে অটোয়া গাড়ি ও ট্রেন পরিচালনা করবে এমন একটা ব্রিজ নির্মাণের জন্য ১০৫ মিলিয়ন ডলার দেবে। নির্বাচনে যদিও ডাইফেনবেকার পরাজিত হন, পরবর্তীতে লিবারেল সরকার এ প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে অবশ্য শীতকালের জাহাজ চলাচল এবং ফেরি পরিষেবা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে থাকে।
২
সারাদিনের ব্যস্ত সফর শেষে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছালাম। প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের সমাহিত পরিবেশে আস্তে আস্তে আমাদের গাড়ি নদীর ধারে এয়ারবিএনবি’র একটা ভাড়া করা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছিল। কোনো রকমে রাতের খাওয়া সেরে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে উঠে আমাদের আস্তানার পাশের সি-বীচ ঘুরে এলাম। এরপর নাস্তা করে বের হলাম “অ্যান অব গ্রিন গ্যাবলস” যে বাড়িটাকে বিখ্যাত করেছে তা দেখার জন্য।
বইয়ের বর্ণনার সাথে মিলিয়ে হুবুহ রিনোভেট করা হয়েছে বাড়িটাকে। ঢোকার প্রবেশপত্র কিনে পুরো বাড়ি ও এলাকাটা দেখার আগে বাড়ির সামনে রক্ষিত রিক্সায় চেপে বসে ছবি তুলে ফেললাম বেবি আর আমি।
তারপরে আমরা থিয়েটারে চলে যাই যেখানে লুসি মাউড মন্টগোমারি এবং অ্যান অফ গ্রিন গ্যাবলস সম্পর্কে ১৫ মিনিটের একটা চলচ্চিত্র গ্রিন গ্যাবেল এলাকা এবং বইয়ের পরিচিতি দেখায়। দেখলাম বর্ণনাকারী সারা বিশ্বের শিশুদের প্রিয় অ্যান যে আসলে কাল্পনিক চরিত্র তা পরিস্কার করে বুঝিয়ে বলছিলেন।
ভিডিও দেখা শেষ হলে, আমরা গ্রিন গ্যাবলসের দিকে রওনা হলাম। পার্কে তখন বেশ ভীড় ছিল এবং আমরা বাড়ির মধ্য দিয়ে যাওয়ার আগে কয়েক মিনিট দাঁড়াতে হলো। বাড়ির সামনে একটা মাঠ আছে যেখানে পিকনিকের মতো করে লাঞ্চ উপভোগ করা যায়। মাঠের চারপাশে কয়েকটা হাঁটা পথ আছে। আমরা লাভার্স লেন এবং হনটেড উডের মধ্য দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। পথে দর্শনার্থীরা একটা গাছে নিজেদের নাম খোদাই করে রেখেছে। গাছটাকে পাশে নিয়ে বেবি আর আমি একটা ছবি তুলে ফেললাম।
দিনটা ছিল অসম্ভব সুন্দর আর রৌদ্রকরোজ্জ্বল, এবং আমরা যে জঙ্গলে দাঁড়িয়ে ছিলাম সে সম্পর্কে লুসি মাউডের উদ্ধৃতি সহ পথের চিহ্নগুলি থেমে থেমে পড়তে থাকি। বিষয়টা বেশ উপভোগ করছিলাম।
অ্যান অফ গ্রিন গ্যাবলস™ বাড়িটা এখন রেজিস্টার্ড ট্রেডমার্ক যা প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড প্রদেশের কর্তৃপক্ষ এবং লুসি মাউড মন্টগোমারির উত্তরাধিকারীদের মালিকানাধীন। অ্যান সম্পর্কিত কোনো পণ্য উৎপাদিত হলে এই কর্তৃপক্ষ ও পরিবারকে রয়্যালটি দিতে হয়। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এর আওতামুক্ত অর্থাৎ তারা কোনো অ্যান আইটেম উৎপাদন করলে তার জন্য তাদেরকে কোনো রয়্যালটি দিতে হয় না।
লুসি মাউড মন্টগোমারি আসলে গ্রিন গ্যাবলসে স্থায়ীভাবে থাকতেন না—এটা তাঁর চাচাতো ভাইদের বাড়ি ছিল। তবে বাড়িটা অ্যান অফ গ্রিন গ্যাবলস উপন্যাস লেখায় যথেষ্ঠ অনুপ্রাণিত করেছিল। ভিক্টোরিয়ান যুগের এই বাড়ির ঘরগুলির মধ্য দিয়ে হাঁটলে একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়। আঠারো শতকের শেষের দিকে বাড়িটা রিনোভেট করা হয়। এখানে ঘোরার সময় কিচেন, লুসি মাউডের টাইপ রাইটার, গ্রামোফোন, ম্যানুস্ক্রিপ্ট, এবং কাঠের শেডে খামার জীবনের অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়।
বইয়ে বর্ণিত ‘হন্টেড উডস’ এবং ‘বালসাম হোলো’ ট্রেইলগুলি ঘুরে বেড়ানো যায়। দেখতে দেখতে আপনি যেন অ্যান অফ গ্রিন গ্যাবলস-এর গল্পের ভিতরে প্রবেশ করবেন।
লুসি মাউড মন্টগোমারি ১৮৭৪ সালের ৩০ নভেম্বর প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের উত্তর তীরে ক্লিফটনে (বর্তমানে নিউ লন্ডন) জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা-মা ছিলেন হিউ জন মন্টগোমারি এবং ক্লারা উলনার ম্যাকনিল। যখন তিনি শিশু ছিলেন, তার মা মারা যান। তিনি তখন ক্যাভেন্ডিশে তার নানীর কাছে মানুষ হন ।
মন্টগোমারি অনেক ছোট ছোট কল্পকাহিনী, কবিতা এবং প্রবন্ধের পাশাপাশি নিউ মুনের এমিলি, লণ্ঠন হিলের জেন, সিলভার বুশ এবং স্টোরি গার্লসহ আরও ২০টা বেস্ট সেলার উপন্যাস লিখেছিলেন যার সবগুলোই প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডে সংরক্ষিত আছে। তিনি নিয়মিত জার্নাল লিখতেন। এই জার্নালে তিনি তাঁর সম্প্রদায়, পারিবারিক অসুস্থতা এবং মৃত্যু, যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং তাঁর নিজের বেদনা সম্পর্কে নানা তথ্য এবং চিন্তা প্রকাশ করেন। লিখতেন তার বিষণ্ণতা, ইতিহাস, জীবন, প্রকৃতি, সৌন্দর্য এবং বন্ধুত্বের প্রতি তাঁর ভালবাসার অভিব্যক্তির কথা।
লুসি মাউড মন্টগোমারি কালজয়ী এই “অ্যান অফ গ্রিন গ্যাবলস” উপন্যাসটা রচনা করেন ১৯০৫ সালে অর্থাৎ প্রায় একশ’ বছরেরও আগে। বেশ কয়েকজন প্রকাশক বইটি প্রথমে ছাপাতে অস্বীকার করে। এতে খুব হতাশ হয়ে তিনি পাণ্ডুলিপিটা একটা টুপির বাক্সে ফেলে রেখে দেন। বেশ কিছুকাল পর ছাপানোর উপযোগী করার জন্য পুনরায় পড়তে গিয়ে তিনি আবার নতুন করে লেখা শুরু করলেন। পুনর্লিখনের কাজ শেষ হলে তিনি এল.সি পেজ অ্যান্ড কোম্পানি অফ বোস্টনকে ডাকযোগে পাঠালেন। ১৯০৮ সালের জুন মাসে তারা অ্যান অফ গ্রিন গ্যাবলস প্রকাশ করেন। তাৎক্ষণিক ভাবে তা বেস্ট সেলার হয়, দেখতে দেখতে ১৯০০০ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। তখনকার দিনে একসাথে ১৯০০০ কপি বই বিক্রি হওয়া একটা বিরাট ঘটনা।
এ পর্যন্ত এই উপন্যাসের ৫৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে এবং ৩৬ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র লাল চুলের মেয়েটার গল্পের কল্যাণে কানাডার এই দ্বীপ প্রদেশ সারা পৃথিবীর মানুষের মনে একটা স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। ফলে প্রতি বছর ১,২৫,০০০ এরও বেশি মানুষ লুসি মাউড মন্টগোমারির ক্যাভেন্ডিশ এর এই ন্যাশনাল হেরিটেজ সেন্টার পরিদর্শন করেন।
“অ্যান অফ গ্রিন গ্যাবলস” এর নায়িকা, প্রিন্স এডওয়ার্ড দ্বীপের অ্যাভনলিয়া গ্রামের অবিবাহিত, মধ্যবয়স্ক ভাইবোন মারিলা এবং ম্যাথিউ ক্যাথবার্টের দত্তক নেয়া এক লাল চুলের অনাথ বালিকার ইতিহাস। এই বালিকার নাম অ্যান শার্লি। প্রাণবন্ত, আশাবাদী, অফুরন্ত কল্পনাশক্তি এবং উৎসাহ-উদ্যমে ভরপুর লালচুলের বহিরাগত বালিকা। যে তার তার বুদ্ধিমত্তা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় সবার আপন হয়ে ওঠে। চাল-চলনে সে একজন নারীবাদী, রোমান্টিক, গরম মেজাজের আবেগপ্রবণ বালিকা। এ্যান ছিল খুবই নাটকীয়, স্মার্ট, এক মজার চরিত্র। সে তার নামের শেষে একটি ‘ই’ দিয়ে বানানের উপর জোর দেয় কারণ তার ধারণা এতে তার নাম “অনেক সুন্দর দেখায়।” চিরকাল সে সোল সার্সিং বা “আত্মানুসন্ধান” করে গেছে। এ্যান গাছ, গল্প এবং বাদামী চুল পছন্দ করে এবং এগুলো সম্পর্কে স্বপ্ন দেখার সময় উনুনে যা আছে তা পুড়িয়ে ফেলে। সে ক্রোপ দিয়ে একটা শিশুকে সুস্থ করতে পারে, কিন্তু “রোমাঞ্চকর” মুহুর্তে ডিশওয়াশিং এর মতো কাজে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারে না। মারিলা এবং ম্যাথিউ ক্যাথবার্ট অবশ্য সে যাতে তার সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে তার সব রকম সহায়তা দিত। এই দুই অবিবাহিত ভাইবোনের জীবনে সে ছিল সমস্ত আনন্দের উৎস আর বেঁচে থাকার অবলম্বন। প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের লুসি মাউড মন্টগোমারি ইনস্টিটিউট লুসির জীবন ও কাজ নিয়ে গবেষণার জন্য প্রতি দুবছর পরপর একটা দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করে। উত্তর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, চীন, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাবিদ এবং গুণগ্রাহীরা এই সম্মেলনে যোগ দেয় ।
ফেরার সময় সেজা আমাকে এ্যান অফ গ্রিন গ্যাবেলস বইটা উপহার দিল যা এই দ্বীপ ভ্রমণের এক অমূল্য স্মারক হয়ে আছে।
৩
প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের সি-বীচে না যাাাওয়ার কথা ভাবা যায় না। কানাডার ক্ষুদ্রতম এই প্রদেশে আছে চিত্তাকর্ষক ২৩টা সি-বীচ। ১০৯৪ কিলোমিটার বা ৬৮০ মাইল উপকূলরেখার বীচগুলোতে রয়েছে সাদা, সোনালি, গোলাপী এবং লাল বালি। সবগুলোতে যাওয়া সম্ভব ছিলনা। আমরা তাই গ্রিনউইচ ডিউনস বীচে গেলাম। বীচটা যেন লুকোনো রত্ন।
এটা গ্রিনউইচ ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্ভূক্ত তাই পার্কের ভিতর দিয়ে হাঁটা পথ ধরে বীচে পৌছাতে হয়। তবে বীচে যাওয়ার আগে আবার বেশ কয়েকটি ওয়াকিং ট্রেইল বা কাঠের সাঁকো ধরে যেতে হয়। বালুতে জন্মানো গেগেনওয়ালে, ম্যারান ঘাস, লবণ-সহনশীল এবং ক্ষার-সহনশীল উদ্ভিদগুলোকে বাঁচাতে এবং হুইল চেয়ারে চলার জন্য এই ব্যবস্থা।
ঘাস আর উদ্ভিদ্গুলো বালু রক্ষার জন্য জীবন্ত জাল হিসাবে কাজ করে। কারণ ঘাস চলে গেলে, বাতাসে উন্মুক্ত বালি উড়ে গিয়ে ব্লোআউট নামক দৈত্যাকার গর্ত তৈরি করে। এই বীচের সাদা বালিতে হাঁটার সময় শব্দ হয় যেন বালির গান বাজতে থাকে। বীচের আশেপাশে অনেকগুলো বালুটিলা আছে তাই এই বীচের নাম গ্রিনউইচ ডিউনস । এই ধরনের বালুটিলা উত্তর আমেরিকায় বিরল। বীচে তেমন কোনো ভীড়ভাট্টা নেই তাই পিকনিক বা মধ্যাহ্নভোজনের জন্য ডুব দেওয়ার একটা দুর্দান্ত জায়গা। এখানে দারুণ সময় কাটলো আমাদের! আমরা যেন একেবারে শিশু হয়ে গেলাম।
প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের বেসিন হেড ফিশারিজ মিউজিয়ামটিও এখানে অবস্থিত। উপকূলীয় মৎস্যচাষের ঐতিহাসিক বিষয়গুলো এখানে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা আছে যা আপনাকে অতীত দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। এখানকার ক্যানারিতে আছে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে এমন সব মাছ ধরার গিয়ার বা উপকরণ। বীচ থেকে ফেরার পথে আমরা এক ঝলক দেখে নিলাম সেসব।
৪
এই দ্বীপে প্রচুর ঐতিহাসিক লাইটহাউস বা বাতিঘর রয়েছে। প্রত্যেকটা বাতিঘর স্থাপত্য এবং অবস্থানের দিক দিয়ে একে অপরের থেকে বেশ আলাদা। এগুলো সমুদ্র সৈকতে, পাথুরে চূড়ায়, খামারের মাঝখানে, জঙ্গলে এবং ব্যক্তিগত বাগানেও অবস্থিত। যারা বাতিঘর দেখতে চান প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড তাদের জন্য তীর্থস্থান। লাইটহাউস আমার খুব ভালো লাগে তাই এগুলো সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিল। তুরীয় ও সেজারও আগ্রহ দেখলাম। বিশেষত লাইটহাউসের উপর থেকে দূরে দেখতে কি যে ভালো লাগে! ভাবতে অবাক লাগে এই ছোট্ট একটা বাতিঘর কতশত দূরগামী জাহাজগুলোকে দিশা দেয় বছরের পর!
বাতিঘরগুলোতে সংরক্ষিত পুরোনোদিনের বাতি ও অন্যান্য জিনিসগুলো দেখলে কেমন একটা নস্টালজিক অনুভূতি ভর করে।
যাহোক, আমরা প্রথমে যাই পয়েন্ট প্রিম লাইটহাউসে। এই লাইটহাউস প্রিন্স এডওয়ার্ড দ্বীপের প্রথম এবং প্রাচীনতম বাতিঘর। ১৮৪৫ সালে প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড কনফেডারেশনে যোগদানেরও প্রায় ৩০ বছর আগে এটা নির্মিত হয়। এই বাতিঘর অনন্য, কারণ প্রিন্স এডওয়ার্ড –আইল্যাণ্ডে এটাই একমাত্র বৃত্তাকার ইটের বাতিঘর আর সারা কানাডার যে তিনটা বৃত্তাকার ইটের বাতিঘর আছে তার মধ্যে অন্যতম। স্থপতি আইজ্যাক স্মিথ এর ডিজাইন করেন এবং রিচার্ড ওয়ালশ ১৮৪৫ সালে তা নির্মাণ করেন। স্মিথ শার্লটটাউন প্রভিন্স হাউসও তৈরি করেন।
পয়েন্ট প্রিম লাইটহাউস মাটি থেকে ১৮.২ মিটার উপরে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪.৪ মিটার উপরে এবং নর্থম্বারল্যান্ড স্ট্রেটের একটা দর্শনীয় বাতিঘর।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কানাডা ও ইউরোপের মধ্যে সমুদ্র বাণিজ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে সমুদ্রে জাহাজডুবি এবং দুর্যোগও বৃদ্ধি পায়। বিশেষত, শার্লটটাউনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম তখন দ্রুত বৃদ্ধির পাচ্ছিল। ফলে পণ্যদ্রব্যের চাহিদা মেটাতে শিপিং ট্র্যাফিক বেড়ে যায় আর সেকারণেই জাহাজডুবির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখলাম অপূর্ব চারপাশের দৃশ্যাবলী। আমরা ঝটপট ছবি তুলে রাখলাম উপরে ওঠার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য।
লাইটহাউস কক্ষে দেখলাম সামুদ্রিক কাচ ও ঝিনুকের একটা শোকেস, পুরোনো দিনের হারিকেন, কুকিং স্টোভ, হ্যাচাক লাইট সংরক্ষণ করা আছে। আমরা ঘুরে ঘুরে বাতিঘরের উপরে উঠে চারপাশটা দেখলাম।
এরপর আমরা সৌরিস ইস্ট লাইটহাউস দেখতে যাই। ১৮৮০ সালে নির্মিত, সৌরিস ইস্ট লাইটহাউস সাদা এবং লাল বর্গাকার কাঠের একটা টাওয়ার যা নাইট পয়েন্টের খাদের উপর ১৪.৩ মিটার উপরে দাঁড়িয়ে সৌরিস শহরকে ছাড়িয়ে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দর্শনার্থীরা এর লণ্ঠন কক্ষে উঠতে পারেন, বারান্দায় যেতে পারেন। সেদিন পরিষ্কার দিন ছিল তাই বন্দর, সৌরিস শহর, বে, নর্থম্বারল্যান্ড স্ট্রেট, ডি-লা-ম্যাডেলিন ফেরি এবং কেপ ব্রেটন হাইল্যান্ডসের প্যানোরামিক দৃশ্যগুলি প্রাণ ভরে উপভোগ করলাম। বাতিঘরের পাশে রয়েছে সৌরিস বাই দ্য সি ট্রেজারস, গিফট শপ যা সামুদ্রিক-কাচের ইতিহাস, বাতিঘর এবং সৌরিস বন্দরের বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরে। এছাড়াও এখানে সামুদ্রিক-কাচ, পাথর, কাঠের কাজ, ফিউজড গ্লাস, আর্টওয়ার্ক, বই, টি-শার্টসহ নানারকম স্যুভেনির পাওয়া যায়। লাইটহাউস ভ্রমণের পরে, আমরা টুকটাক গিফট কিনে বেরিয়ে এলাম।
সর্বশেষ যে লাইট হাউজে যাই তার নাম পোর্ট বোর্ডেন ফ্রন্ট রেঞ্জ লাইটহাউস। এটা কনফেডারেশন লাইটহাউস নামেও পরিচিত। এই লাইটহাউসটি ১৯১৭ সালে নির্মিত হয়। ১৯৯৭ সালে যখন কনফেডারেশন ব্রিজ ভ্রমণকারীদের জন্য উন্মুক্ত হয়, তখন এটা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কনফেডারেশন ব্রিজের পাশে ইস্ট প্রিন্স আরসিএমপি বোর্ডেন-কার্লেটনের মেরিন রেল পার্কের অন্তর্ভূক্ত করে নেয়া হয়।
বাতিঘরটি বর্গাকার, কাঠের, পিরামিড কাঠামো, বেস থেকে ১২.৮০ মিটার লম্বা, লোহার রেলিং দেওয়া গ্যালারি পিছনে টাওয়ারের বর্গাকার লণ্ঠন কক্ষকে ঘিরে রেখেছে। প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডে তখন ডাক এবং যাত্রী পরিবহনের জন্য আইসবোট বা বরফ-নৌকা ব্যবহার করা হত। এজন্য দ্বীপে দুটো বন্দর ব্যবহার করা হতো, একটা উড দ্বীপপুঞ্জে, যা পিকটু, নোভা স্কোশিয়ার সাথে সংযুক্ত, এবং আরেকটা কেপ ট্র্যাভার্সে, যা নিউ ব্রান্সউইকের কেপ টেমটেনিনের সাথে যুক্ত ছিল। কেপ ট্র্যাভার্স এবং কেপ টেমটেইনের মধ্যে এই রুটগুলির দূরত্ব ছিল দ্বীপ এবং মূল ভূখণ্ড থেকে সাড়ে আট মাইলেরও কম।
বাতিঘর দেখতে দেখতে আর তার ইতিহাস শুনতে শুনতে আমরা যেন সেই অতীত দিনে ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু ফেরার তাড়া ছিল তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও গাড়িতে উঠলাম। বারবার মনে হচ্ছিল আর কি কখনও এমন করে ঘোরার সুযোগ হবে এই ‘অ্যান অফ গ্রিন গ্যাবলস’-এর দেশ প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডে? ভবিষ্যৎ জানে। সারাপথ যেন স্বপ্নের মতো করে ভাবতে ভাবতে ফিরে চললাম মন্ট্রিয়লের উদ্দেশ্যে…।
আবদুর রব
কবি, অনুবাদক, অনলাইন ম্যাগাজিন সম্পাদক ও অর্থনীতিবিদ।পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি।পৈত্রিক নিবাস যশোর। বর্তমান বসবাস ঢাকায়। একটি আন্তর্জাতিক কন্সাল্ট্যান্সি ফার্মে কর্মরত। শৈশব থেকে লেখালেখির শুরু। এ পর্যন্ত ছ’টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ছোটদের জন্য চিনা গল্পের ৩টি অনুবাদ গ্রন্থও আছে তাঁর। বেশকিছু ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন তিনি।
ভ্রমণ কাহিনি বরাবর খুব টানে। দেরিতে হলেও সেই টানে আগ্রহ নিয়ে পড়ে ফেললাম “অ্যান অফ গ্রিন গ্যাবলস-এর দেশ প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড।” এসব ভ্রমণ কাহিনির ছুতোয় কত অচেনা জায়গা আর ইতিহাসের জগত ঘুরে নেওয়া যায়। চমৎকার একটা ঘুরন্টি হলো এই লেখার হাত ধরে। আরো একবার ‘প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ড’ ঘুরে নেবার সুযোগ জুটে যাক লেখকের সেই কামনা রইল। মনোজ্ঞ লেখাটির জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।