অনেক কাল আগের কথা। সময়টা ১৯৬৪ সাল—আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র বরিশাল জিলা স্কুলে। বছরের মাঝামাঝি— প্রস্তুতি নিচ্ছি অষ্টম শ্রেনীর বৃত্তি পরীক্ষার জন্যে।পঞ্চম শ্রেনীর বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার কারনে মানসিক চাপ অনেক বেশী, উচ্চ প্রত্যাশা সবার ঐ ফলাফলের পুনরাবৃত্তির।
এই যখন অবস্হা, তখন একদিন রাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাঁ পায়ে অসহ্য ব্যথা— হাঁটু থেকে গোড়ালী পর্যন্ত। মনে হচ্ছিল সব ব্যথা গিয়ে জমা হচ্ছে হাড়ে। পাশের ঘরটিই মা-বাবার শোবার ঘর। ডাকতে হয় নি, আমার আর্তধ্বনিতেই তাঁরা উঠে এলেন। প্রথমেই দু’জনেই দেখলেন— বার করতে চেষ্টা করলেন ব্যথার কারণ। মা পায়ে হাত বুলোতে থাকলেন, বাবা নানান প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে থাকলেন— কোথাও পড়ে গিয়েছি কি না, কেউ মেরেছে কিনা। ক্রিকেট খেলতাম খুব। মা জানতে চাইলেন, ক্রিকেট বল পায়ে এসে লেগেছে কি না। কোন রকম ব্যথা যে পাই নি, তা তাঁদের নিশ্চিন্ত করলাম।
মা উঠে গেলেন, সরষের তেলের মধ্যে রসুন দিয়ে তেল গরম করে নিয়ে আসার জন্যে। তেল এলো, মা যত্ন করে মালিশ করে দিতে লাগলেন, বাবা মাথায় হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন— কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হল না। ব্যথার কোন কমতি নেই। প্রায় নিদ্রাহীন রাত কাটলো তিনজনারই। সিদ্ধান্ত হল যে, কালও যদি ব্যথা থাকে, তা’হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে আমাকে।
ব্যথায় হোক কিংবা ক্লান্তিতেই হেক, ভোররাতের দিকে তন্দ্রা মতন এলো। খুব ভোরে উঠে দেখলাম, কোন ব্যথা নেই, সব কিছু স্বাভাবিক। সবাই স্বস্ত্বির নি:শ্বাস ফেললেন। স্কুলে গেলাম, খেলাম-দেলাম, খেলতে গেলাম – ব্যথার চিহ্নও নেই। সুতরাং ডাক্তারের কাছে যাওয়ারও প্রশ্ন ওঠেনি। রাত এলো পড়া-টড়া শেষ করে শুতে গেলাম।
আবাও মাঝরাতে প্রচণ্ড ব্যথা- এই জায়গায়, একই রকমের। আবারো সবকিছু করা হোল, কিন্তু উনিশ-বিশ হোল না। পরের দিন আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক আমার বন্ধু বিভার (তখনকার বিভা মিশ্র এবং বর্তমানের বিভা মিত্র) মাতুল ডা: এস.সি রায়ের কাছে সদর রোডে দ্য মেডিকাসে নিয়ে যাওয়া হোল। তিনি খুব যত্ন করে পরীক্ষা করলেন। বললেন, হাড়-টাড় ভাঙেনি। পা টিপে-টুপে দেখলেন, কোন ব্যথা নেই। কিছু ওষুধ পত্র দিয়ে দিলেন। বাবা-ছেলেতে বাড়ী ফিরে এলাম।
আবার তৃতীয় রাতের মাঝামাঝি সময়ে ব্যথা—আর পরের দিন কিছু নেই। পরের দিনগুলোতে ব্যথা-ব্যথাহীনতার এই চক্র চলতেই থাকলো। এই চক্রের রহস্য কেউ ভেদ করতে পারলেন না। এক্স রে করা হলো, ওষুধ বদলানো হোল, অন্য চিকিৎসকদের পরামর্শ নেয়া হল। কিন্তু অবস্হা তথৈবচ।
মা-বাবা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। আমার মা ভাবতে থাকলেন, আমি পঙ্গুই না হয়ে যাই। যে যা করতে বলে আমার মা তাই করেন। সারারাত ধরে হারিকেনের ওপরে কাপড় গরম করে আমার পায়ে সেঁক দেন, গরম পানির বালতিতে পা চুবিয়ে রাখি, কাপড়ে বেঁধে পা উঁচিয়ে রাখি। শুধুমাত্র মা’র কথা মতো পানি পড়া খেতে, বাহুতে তাবিজ বাঁধতে এবং কোন এক পীরের দরবারে যেতে আমি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করলাম।
বাবা এ ডাক্তার ও ডাক্তারের পরামর্শ নেন। মাঝে কবিরাজী এবং হেকিমীও চেষ্টা করলেন। কিছুই হল না। এর মধ্যে ডা: মোজাম্মেল হোসনের ওখানে নিয়ে গেলেন আমার ইচ্ছেয়। পঞ্চাশের আমার মৃত্যুপথযাত্রী মা’কে টাইফয়েড থেকে বাঁচানো এবং আমার বাবার সারা জীবনের আলসার সারানোর কারণে মোজাম্মেল চাচার প্রতি আমার আস্হা আকাশচুম্বী। চাচা-চাচী আমাকে খুব ভালোবাসতেন। চাচা আমাকে দেখার পরিবর্তে আমাকে অনেক প্রশ্ন করলেন, অনেক কথা বললেন, অনেক গল্প করলেন। পরবর্তী সময়ে বুঝতে পেরেছি, তিনি বার করতে চেষ্টা করছিলেন যে আমার সমস্যাটি শুধু দেহজ না দেহ-মনোজাগোতিক। তা নৈলে ব্যথা কেন শুধু রাতে হবে, দিনে হবে না।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। আমার ব্যথার কথায় নানান জন নানান কথা বলছিল্ন। অনেকেই আমাকে আর বিশ্বাস করছিলেন না। তাঁরা বলছিলেন, এ সবই আমি বানিয়ে বলছি। বাবার অনেক সহকর্মীই বলছিলেন যে, হয়তো বৃত্তি পরীক্ষার চাপে এমনটা হচ্ছে। একজন বলে বসলেন, আমি বাল্যপ্রেমে পড়েছি কি না। ঠাট্টা করেই বলেছিলেন, কিন্তু আমার যুক্তিবাদী কিন্তু বিচলিত বাবার তা সহ্য হল না। তিনি প্রত্যুত্তর দিলেন, প্রেমে পড়লে বুকে ব্যথা হবে, পায়ে কেন ব্যথা হবে?
এমন যখন অবস্হা, তখন একদিন আমাকে দেখতেএলেন, আমাদের বাড়ীর পুরোনো রাজনিস্ত্রী মিলন খাঁ। বয়স তখন তাঁর আশির ওপরে – শক্ত সমর্থ মানুষ। আমাদের পরিবারের খুব কাছের ছিল তাঁদে পরিবার। বছর সাতেক পরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাদের বাড়ীতেই আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। বাড়ীর বড় ছেলে বলে তিনি আমাকে ‘বড় সাহেব’ বলে ডাকতেন।
সব দেখেশুনে খুব কুণ্ঠিতভাবে তিনি বাবাকে বললেন, ‘স্যার, নানান রকম চিকিৎসা তো হচ্ছে। যদি কিছু মনে না করেন, আমি একটি কথা বলবো?’ অনুমতি তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘এখান থেকে চাখার যাওয়ার পথে গুঠিয়া বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে একজন কবিরাজ আছেন, যিনি একটা বাতের তেল আবিষ্কার করেছেন। সে তেল এর ধ্বনন্তরি। বড়-সাহেবকে সে তেল মালিশ করে দেখতে পারেন’।
ডুবন্ত মানুষ সবকিছুকে আঁকড়ে ধরে। ছেলের মঙ্গল কামনা। আমার মা-বাবা তখন সব কিছু করতে প্রস্তুত। সমস্যা হল কে সেই ওষুধ আনতে যাবে? মিলন খাঁ বললেন যে, আগামী কাল তিনি গিয়ে গুঠিয়া থেকে সেই তেল নিয়ে আসবেন। পরের দিন সারাদিন নষ্ট করে তিনি সেই তেল নিয়ে এলেন।
সে রাতে যখন তেলের বোতল খোলা হলে, তখন তার উৎকট গন্ধে ভিমরি খাওয়ার অবস্হা। গন্ধে-বর্ণে অনেকটা তিলের তেলের মতো। এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। প্রতিরাতে বাবা নিজ হাতে সেই তেল দিয়ে আমার পা মালিশ করে দিতেন। তেলের সেই বিটকেল গল্ধ লেগে থাকতে জামা কাপড়ে। তারপর আস্তে আস্তে ব্যথা কমে আসতে শুরু করলো। সপ্তাহ দু’য়েক পরে সেই ব্যথা একদম চলে গেলো – এবং সে ব্যথা আর কখনো ফিরে আসে নি।
কেউ এ রহস্যের ব্যাখ্যা করতে পারে নি—না আমার মা-বাবা, না আমার চিকিৎসকেরা, না আমি নিজে। সে ভীষণ ব্যথার কথা, সে কষ্টের কথা কিছুই আমার মনে নেই। শুধু সেই সব রাতের কথা মনে আছে যখন আমার প্রয়াত পিতা পরম যত্নে আমার পায়ে গুঠিয়ার বাতের তেল মালিশ করতেন—তাঁর হাতের স্পর্শ এখনও অনুভব করি। সেই সঙ্গে সেই তেলের গন্ধটাও টের পাই আমি—আর সে গন্ধটি আর উৎকট মনে হয় না আমার কাছে।
সেলিম জাহান
ড: জাহান লেখালেখি করছেন গত চার দশক ধরে। আশির দশকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এ সাময়িকীতে নিয়মিত লিখেছেন। রেডিও ও টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জননন্দিত উপস্হাপক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মহাসচিব ছিলেন।ইংরেজী ও বাংলায় তাঁর প্রকাশিত গ্রণ্হের সংখ্যা এত ডজন এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ: বেলা-অবেলার কথা, স্বল্প কথার গল্প, পরানের অতল গহিণে, শার্সিতে স্বদেশের মুখ, অর্থনীতি-কড়চা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি, Overcoming Human Poverty, Freedom for Choice, Development and Deprivation.