আগুনের পাখি; ফিনিক্স
ভস্মস্তূপ থেকে আবার এসেছে উঠে, অবিনশ্বর আগুনের পাখি; ফিনিক্স ।
প্রতিবন্ধী এক ঈশ্বরকে যূপকাষ্ঠে বলি দেবার পরে
যারা সন্ন্যাসীর বাঘছাল দিয়ে বানিয়ে নিয়েছিল ট্রাম্পেট
আর সেই প্রচণ্ড ঢাকের শব্দ ছড়িয়ে দিয়েছিল বাতাসের পরতে পরতে
তারাও কি পথ ভুলে নেমে গেলো কালো এক অন্ধকার গুহার দিকে?
ভুল করে বন্ধ গুহার ঘুলঘুলি খুলে গেলে
অবাঞ্ছিত রোদ
রবাহূত শব্দের হৈচৈ ওঠে।
বন্ধ গুহাই নিরাপদ। বন্ধই থাক।
যুগে যুগে মানুষ কেবল শুনেছে
আগুন উগরে দেওয়া পাহাড়ের কথা।
লারারিয়ায় এখনো অঙ্কিত আছে ভিসুভিয়াসের সাপ।
তীব্র হুইসেলের শব্দে দুলে ওঠে জলসাঘরের ঝাড়বাতি;
অস্থির আলোর রেখাপথ ধরে আত্মবিনাশকামী পতঙ্গ ওড়ে ।
অগ্নি-রহস্যসন্ধানী পতঙ্গেরা
বারবার সে রহস্য জানতে চেয়েছে
কী এমন ক্ষোভে ভলকানোর আচমকা এমন তীব্র ফুঁসে ওঠা।
অবশেষে
সমস্ত জমাট বরফ গলে গেলে দেখা গেল
রক্তমাংস নয়, রঙিন পোশাক মোড়া কংকাল ছিল।
জানালার পাশে ছাইবর্ণ মেঘ
ঈশানকোণের বার্তা নিয়ে আসে…
ছায়াপথ ধরে আবার আসবে ফিরে কফিনবন্দী ঘুঙুরগুলো ;
যারা এখনো খুলেনি নাচের পোশাক,
ভুলেনি কত্থকের ‘তেরে কেটে ‘ মুদ্রার বোল
একে একে ফিরবে সব নাচঘরের বেলোয়ারী-আলোর বাসরে।
আবারো
অদ্ভুত জোনাকির আলো থেকে আসবে উঠে সেই নৃত্যপটিয়সী ময়ূরগুলো
যারা অবারিত জলনৃত্যের শ্রান্তিতে রঙিন পালক ঝরিয়ে দিয়ে
উড়ে গিয়েছিল অচেনা মেঘপথের উজান-সন্ধানে।
আবারো নতুন আঁচড়ে আঁচড়ে বিক্ষত হবে সোনালি ডানার রেখাচিত্রগুলো;
পালকে জলের ভার অসহ হয়ে গেলে
আবারো জন্মান্তরের পথে ফিরে যাওয়া ?
অঝোর বৃষ্টি নামুক
আজ এমন মনপোড়ানো চাঁদ উঠলো কেন?
জ্যোৎস্নার তীব্রকলরবে ভেসে যাচ্ছে চরাচর।
চাঁদনি চাইনি।
বৃষ্টি চেয়েছি।
আজ এই শহরে অঝোর বৃষ্টি নামুক।
সবুজপাতারা সারাদিন বৃষ্টি-প্রত্যাশায় আছে।
বাচাল এক টুকরো ঝড়ো হাওয়া নীপবনের গল্প শোনাতে এলে,
বলি-চুপ করে থাকোনা আরো কিছুটা সময়।
মেঘের ভেলায় চড়ে বৃষ্টিধারায়
নেমে যাবে একঝাঁক সাদা রাজহাঁস ;
কোলাহলে থমকে গেলে, ফিরে যেতে পারে।
যখন কাশগুচ্ছমেঘদল ভিড় করেছিল
কামিনী-ঝোপের মাথার উপরে; দেখা হয়নি।
অন্যমনে ভাবছি তখন অঝোর-বর্ষণের কথা।
এই অভিমানে জলরাশি দূরে সরে গেছে; জানা হলো না।
আজ তুমুল বেজে যাচ্ছে বৃষ্টি-শৈশবের স্মৃতিমেদুরতা।
ভীষণ দুলছে কাগজের নাও;
অতলজলের দেশে মৎসকন্যা;
নোলক হারিয়ে গেছে পাতালপুরীতে;
প্রবলধারার ভেতরে রেণু রেণু ছড়িয়ে গেল,
প্রথম কদমদিনের পাপড়িগুলো।
এক খণ্ড অলস উড়োমেঘ খুব উদাসীনতায় ঈশানকোণের দিকে
উড়ে গেলে মনে হলো আজ আর বৃষ্টি হবেনা।
চাতকেরা অভিশাপ ছড়াতে ছড়াতে দূরনীলিমার পথে
হারিয়ে গেলে
বাতাসের মীড়ে মীড়ে মিশে গেল বিষাদের সুর।
ধারামগ্নতায় জলপাহাড় গড়েছি আজ সারাটা বিকেল
ছড়িয়ে দিয়েছি ঘাসে ঘাসে
ফড়িংয়ের ঠোঁটে ঠোঁটে সেই শুভসংবাদ পৌঁছে গেছে
গাছে গাছে, লতায়পাতায় ;
কেতকীকেয়ার ফুটি ফুটি কুঁড়িগুলো প্রতীক্ষায় আছে।
আজ কেন তবে বৃষ্টি হবেনা?
আজ এই শহরে অঝোর বৃষ্টি নামুক।
রাতের আকাশ চিরে বেজে যাক জলঝরনামৃদঙ্গের তান।
খেলা হার অথবা জিতের
কেউ কেউ পারে মেঘের ডানায় চড়ে রামধনু-প্রজাপতি হয়ে যেতে।
কেউ কেউ
ডিসটেম্পারড দেয়ালের ফ্রেমবন্দী ছবি।
ড্রপসিন পড়ে গেছে ;
নাচঘর থেকে ফিরে যাচ্ছে নূপুরের সাথে যুদ্ধুক্লান্তপায়ের নর্তকীরা।
এও তো যুদ্ধজয়— ক্ষয়কাশ রোগীর মতো ধুকতে ধুকতে বিশুদ্ধ-নিঃশ্বাসে ফিরে আসা।
এও তো যুদ্ধজয়— বেয়াড়া বন্যার স্রোতেও পাড়ের লতাগুল্মে জড়িয়ে থাকা।
সংক্ষিপ্ত ট্রেইলারে লোভনীয় দৃশ্যক্রম।
ঠান্ডা ছবিঘরে সাজানো নায়কনায়িকা এবং চতুর কাহিনীবিন্যাস ;
কাটছাঁট ইতিহাস—সেলুলয়েড-ফিতের বাইরে।
প্রবল আবেগ-স্রোতে পেরিয়েছি দীর্ঘকুয়াশাভেজা হিমকালোমাঠ,
অন্যপাশে আলো আছে ভেবে।
আলো নয়
আগুনও নয়
মরীচিকা ছিল।
অনুচ্চারেই বাঙময় হয়ে রইল সব অনুযোগ-অভিমান
তবু
বিহগদূতির ঠোঁটে দিয়েছি তুলে ভাষাঅভিজ্ঞান।
রণক্ষেত্র থেকে দূরে,
ভিন্নপথের খোঁজে ,
ব্যস্ত হাতের মুঠোয় কেন যে আচম্বিতে উঠে আসে আগ্নেয়াস্ত্র
সংঘাত কেন যে এত অনিবার্য হয়ে ওঠে!
ঘড়ির কাঁটার সাথে পালটে যাচ্ছে রণকৌশল।আর
অবিশ্রান্ত যুদ্ধে যুদ্ধে ক্ষয়ে যাচ্ছে আয়ু
কখনো একটু বিরাম তো চাই
তবে, সাদা পতাকাকে আত্মসমর্পণের ঝাণ্ডা ভেবে নিলেই
বিপর্যয় ; হিসেবের গরমিল।
যুদ্ধশেষের আবছা ঘন্টাধ্বনি বাজছে কোথাও?
কে হারলো?
জিতলো কি কেউ?
নাজনীন খলিল
জন্ম ৬ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে, বাংলাদেশের সিলেটে।
পড়াশুনা সিলেটেই, সরকারী মহিলা কলেজ এবং মুরারীচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ(এমসি কলেজ) থেকে স্নাতক।
লেখালেখির শুরু ৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে। তখন থেকেই রেডিও বাংলাদেশ সিলেটের একজন নিয়মিত কথক, গ্রন্থক এবং উপস্থাপক। সেই সময় থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখির পাশাপাশি সম্পাদনারও কাজ শুরু। সাহিত্য-সংস্কৃতি মাসিক ‘ সমীকরণের’ নির্বাহী-সম্পাদক হিসেবে ১৯৮০ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত সিলেট থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনধারা নামে একটি পত্রিকার প্রকাশক এবং সম্পাদক ছিলেন। লেখালেখির বিষয়বস্তু মূলতঃ কবিতা এবং কথিকা।
প্রকাশিত কবিতার বই:পাথরের সাঁকো; বিষাদের প্রখর বেলুনগুলো; ভুল দরোজা এবং পুরনো অসুখ; একাত্তর দেখবো বলে (ব্রেইল,যৌথ);গুপ্তপধানুকী অথবা মাংসবিক্রেতা।