শরৎ
সরোবরে হাসছে কুমুদ কহ্লার
আকাশে শাদা মেঘ
ধনধান্যে গন্ধে মাতাল
চারদিকে নববেশ
ভেতর বাইরে স্নিগ্ধ ছায়া
আনন্দ উদ্বেল
জলবতী মেঘ খেলেছিল খেলা
সাঙ্গ হয়েছে রেশ
এবার আমার বিদায় লগ্ন আঁচল দিয়েছি বিছিয়ে
তোমাকে দিলাম বন বীথিকা
এই নাও অর্ঘ্য এই নাও পুষ্পডালি
এই নাও বনের স্নিগ্ধ শ্যামল নির্মল সমারোহ
এই নাও গগন উজ্জ্বল নীলিমা এই নাও অলস মেঘ
এই নাও তোমার অলসগমনা নদীর রূপালি ধারা
তোমাকে দিলাম পথের প্রদীপ তোমাকে দিলাম কমল
তোমাকে দিলাম ললিত রাগের সুরঝঙ্কার শিউলি ফুলের গন্ধ
তোমাকে দিলাম শুভ্র বর্ণ ভোরের ফোঁটা পদ্ম
ঈষৎ পক্ক শালীধান্য শ্বেত হংস রাতের চাঁদের আলো
নববধূ বেশে সমুখে দাঁড়িয়ে ঈষৎ হাস্যে ধরনী করেছো উতল
বোকাবুড়ো পাহাড় খোঁড়ে
বোকাবুড়ো পাহাড় খোঁড়ে
আমি খুঁড়ি পাথর
হাঁটতে গিয়ে মাঠের ভেতর
তাকিয়ে দেখি সবই গাছপাথর
শাদাপাথর কালোপাথর হলদেপাথর লালছে পাথর
নানা রকম পাথর
আমার মতন ক’জন আছে খুঁজছে বুকের ভেতর
নিরেট সোনার পাথর
একএক রকম মানুষ আছে স্বভাব নানা রকম
কেউ খুঁড়ছে কালো পাথর
কেউ খুঁড়ছে হলদে পাথর
কেউ খুঁড়ছে নীলা
খুঁড়তে খুঁড়তে মানুষগুলো হয়ে যাচ্ছে ধুলো
আমি দেখি আমার মতন
গাছের মতন
দাঁড়িয়ে আছে একএক মানুষ
মাঠের ভেতর
নিরেট একটা গাছপাথর
দাঁড়িয়ে আছে মাঠের ভেতর
অস্তিত্ব
পাঁচিলে শ্যাওলা জমেছে ইটে লেগেছে নুন
এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো ভাঙাচোরা খাপরা
ডুবা রয়না ডুমুর আশশ্যাওড়া পানশে মাঁদার
ভাঙা বাড়ির চাদ্দিকে প্রহরী সেজে আছে
জন্মভিটার ওপরের জায়গাটাতে চরণ রাখতেই
হুহু করে দখিনের বাতাস ছুটে এসে পুরোনো একটা গন্ধ
ছড়িয়ে গেলো
খোকন, কেমন আছিস, জন্মভিটার মাটির কথা কী মনে পড়লো?
এই ডুবা গাছের তলায় তোর কেটেছিল শৈশব
তখন জায়গাটা ছিলো ভারি মসৃণ সুন্দর
দুবলো ঘাসের ওপর ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটতে শিখেছিলি
জবেদা ফুপু তোর হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছিল
পাড়ার মনোহারী দোকান থেকে লবেন্চুস কিনে এনে
তোর গালের ভেতর গুঁজে দিত আরশাদ আলি চাচা
তুই চুকচুক করে জিভ নাড়ায়ে চাটতিস
সেই সব দিনের কথা কী তোর মনে পড়লো?
মুহূর্তে পা দুটো অবস হয়ে এলো
ঝোপঝাড়ের মধ্যে বাতাস এলোমেলো
রয়না ডুমুর আশশ্যাওড়া পানসে মাঁদার দোল খাচ্ছে
গাছের ছায়া মাটির ওপর হুমড়ি খেয়ে আছে
ঘাসের উপর ছড়িয়ে আছে ঝরে পড়া পাতা
পাতাগুলোয় পচন ধরেছে
হঠাৎ করে ভিজে মাটির গন্ধ ছুটে এলো।
খোকন, তুই দুষ্ট ছিলি ঘর পালানো দুষ্ট
পাড়ার ছেলে সঙ্গে নিয়ে দৌড়ে বেড়াতিস
হোইচোই আর হল্লা করে কেটে গেছে দিন
দুপুর বেলা মা জননী খুঁজতে এসে ডাকতো হাঁকার দিয়ে—
খোকন খোকন খোকন
গামছা পরে চুপিচুপি পালিয়ে যেতিস তুই
দুচোখ ফেটে গড়িয়ে পড়লো আমার চোখের জল
আমি তো সেই খোকন
হারিয়ে যাওয়া খোকন?
আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো
তিনি হেঁটে চলেছেন
মস্তকে তাঁর বেতের টুপি হিরক মুকুট নয়।
গ্রাম পথ ধরে হেঁটে চলেছেন পরনে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবী।
গৃহে পালঙ্ক নেই। রয়েছে কাঠের খাঁট।
রয়েছে কয়েকটি হাতলওয়ালা পুরানো কুর্সি।
খাটের উপর তোষক নেই – গদিও নেই
বিছানো রয়েছে চেঁচোর চওড়া পাটি।
গৃহে নেই কোনো বিলাস ব্যাসন। চোখ ঝলসানো টেবিলও নেই।
আলমিরা নেই।
আলপথ ধরে হেঁটে চলেছেন এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে
দেখছেন নিরন্ন মানুষের ঘরবাড়ি, শীর্ণ নদী, কানাপুকুর
গাছগাছালি, হেঁসেলের হাড়ি, উঠোন, গরুর গোয়াল, লাঙলের জোয়াল,
দেখছেন লেংটো ছেলেমেয়ে, কাঠের লাঙল,
হালের বলদ, রোগাটে গাভী, মুরগির খোপ
ছেঁড়া কাপড় আড়ায় ঝুলছে। বাতাসে পতপত করে উড়ছে।
চাষার গতরের তেলচিটে ঘামে ভেজা গামছাও।
ঢুকে যাচ্ছে তার চোখের ভেতরে এক একটা দৃশ্য।
তিনি হেঁটে যাচ্ছেন এগ্রাম থেকে ওগ্রামে।
যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই মানুষ। হত দরিদ্র মানুষ।
জলে ভাসা মানুষ। খরায় পোড়া মানুষ। হা অন্ন মানুষ।
দেখছেন মহাজনি হাত। দেখছেন চাষার ভয়ার্ত পলায়ন। ক্রন্দন।
দেখছেন ভূমিহীন মানুষ।
দেখছেন মারিমহামারি মড়কের দাপট।
দেখছেন দুর্ভিক্ষ। রোগাকীর্ণ মানুষের দেহের পাঁজড়।
শূন্য মাঠ। নদীর ভাঙাঘাট। পল্লীর হাট।
উজাড় বসতভূমি। স্তব্ধ লোকালয়।
গ্রাম পথ ধরে তিনি হেঁটে চলেছেন।
তিনি যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই দেখছেন শোষণ
তিনি যে পথ ধরে হাঁটছেন সে পথেই দেখছেন নিপীড়ন
ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘খামোশ’ —
খেটে খাওয়া মানুষকে বললেন, তোমাদের উদরে ও গতরে
অন্ন নেই – রক্ত নেই। যাঁরা অন্ন কেড়ে নিয়েছে, গতরের রক্ত
শুষে নিয়েছে, তারা শোষক, তারা নিপীড়ক।
বুক উঁচু করে দাঁড়াও।
যাঁরা বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে
তাদের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াও
তোমাদের রক্ত শুষে যারা প্রাসাদ গড়েছে,
তাদের পায়ের তলায় মাটি নেই। জোট বাঁধো। ঐক্যবদ্ধ হও।
গণসমুদ্রের জোয়ারে ওরা যাবে ভেসে। হাত উঁচু করো।
এই লড়াই অধিকারের লড়াই। এই লড়াই অস্তিত্বের লড়াই।
এই লড়াই শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের লড়াই।
তোমাদের উৎপাদনের খাদ্য লুট করে ওরা ধনবান হয়েছে। রুখে দাঁড়াও।
পশ্চিমের শোষক আর এদেশের শোষকের মধ্যে পার্থক্য নেই।
শোষকের ধর্ম শোষন। শাসকের ধর্ম ত্রাসন।
হত্যা, লুন্ঠন, গুম, সন্ত্রাস। এটাই ওদের ধর্ম। এটাই ওদের হাতিয়ার।
ঐক্যবদ্ধ হও। হাত উঁচু করো। গর্জে ওঠো – ‘খামোশ’।
তিনি হেঁটে চলেছেন খরা ও রৌদ্রে, হেঁটে চলেছেন বর্ষায়।
হেঁটে চলেছেন শীত গ্রীষ্মে মাথায় বেতের টুপি
হাওয়ায় উড়ছে শাদা পাঞ্জাবী, হাওয়ায় উড়ছে লুঙ্গি
যেখানে যাচ্ছেন, সেখানেই দেখছেন মানুষ। লক্ষ লক্ষ মানুষ।
খোলা ময়দানে লক্ষ জনতা – চারদিকে উঠছে ধ্বনি
কৃষকের মনি – শ্রমিকের মনি – মওলানা ভাসানী।
বজ্রকন্ঠে তিনি বললেন, – ‘খামোশ।’ শোনো বাংলার মানুষ,
আমার এই ডাক ক্ষমতা বদলের ডাক।
গদির উপর যাঁরা বসেছেন, তারাই করেছেন শোষন।
তাদের হাতে রয়েছে রক্তের দাগ।
মানুষকে তারা দাস বানিয়েছে। আমরাতো দাস নই।
এই লড়াইটা গদির জন্য নয়। গদির বিরুদ্ধে লড়াই। মুক্তির জন্যে লড়াই।
শোষনের বিরুদ্ধে লড়াই। ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই। মনুষ্যত্বের লড়াই।
ন্যায়ের পক্ষে লড়াই। তুমি খাবে আর আমি খাবোনা – এই দাবি নিয়ে লড়াই।
জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই। রক্ত চক্ষুর উৎপাটন চাই – চাই মহাবিপ্লব।
চারদিক থেকে হুঙ্কার উঠলো, বিপ্লব, বিপ্লব।
তিনি বললেন, যাঁরা ছিলেন অত্যাচারী, রক্ত শোষক শাসক,
যাদের হুঙ্কারে মেদিনী কাঁপত, তারা এখন কোথায়?
কোথায় তাদের প্রাসাদ? কোথায় বালাখানা? কোথায় সৈন্যদল?
কোথায় অর্থ? কোথায় বিত্ত? মাটির তলে মাটি হয়ে গেছে সব।
রয়েছে কেবল মাথার খুলি – রয়েছে দেহের হাড়।
অত্যাচারির দম্ভ তোমরা ভেঙে দাও পুড়িয়ে দাও
চারদিক থেকে গর্জন ওঠে, বিপ্লব। বিপ্লব।
দক্ষিণে মরলো সমুদ্র উচ্ছাসে হাজার হাজার মানুষ
মানুষের দেহ জলে ভেসে গেলো – ভেসে গেলো ঘরবাড়ি
চরাচরে লাশ – গবাদি পশু – তিনি চললেন হেঁটে
দু’চোখে দেখলেন বিরানভূমি দেখতে আসেনি শাসক
নেই কোন ত্রান, নেই কোন ঠাঁই বাতাসে আর্তনাদ
খোলা ময়দান খোলা আসমান, কাঁপে আল্লাহর আরশ
আকাশে তুললেন হাত। গায়েবি জানাজা। কণ্ঠে দারুণ জোশ।
তোমরা যারা শোষণ করেছ শাসন করেছ ভূমি, ‘খামোশ’-
এই জনপদে কসম করছি এবার করব দ্রোহ
চারদিক থেকে আওয়াজ উঠলো, বিপ্লব, বিপ্লব।
আমার জমিনে আমিই থাকব ছাড়ো এই দখলদারি
মানিনা হুকুমদারি। আমার মাটি মুক্ত করব। ‘খামোশ।‘
আলপথ ধরে হেঁটে চলেছেন মাথায় বেতের টুপি
বাতাসে উড়ছে শাদা পাঞ্জাবী কপালে ঝরছে ঘাম।
সারা জনপদে হেঁটে যাচ্ছেন। মানুষ দেখছেন। জাগো বাঙলার মানুষ।
মানিনা কারো হুকুমদারি। মানিনা দখলদারি। এইতো আমার দেশ।
আমার জমিনে আমিই থাকব।
চারদিক থেকে আওয়াজ উঠলো, বিপ্লব, বিপ্লব।
ভিটে
বহুদিন পর ফিরে এলাম গ্রামের বাড়িতে
পূর্বপুরুষের ভিটে। একতলা ভাঙা দালান। আর একটি পুকুর।
এই বাড়ির দক্ষিণে ছিল বিশাল আম্রকানন।
তার কোনো চিহ্ন নেই । আছে কেবল হেলে পড়া পাঁচিল।
উত্তরে কবরখানা শুয়ে আছে পূর্বপুরুষেরা।
বহুকাল হয়ে গেল আমি আছি বিদেশ-বিভূঁয়ে।
গ্রামের পথঘাট অজানা-অচেনা এখন
কেউতো চেনেনা আমাকে। জানেনা কেউ আমার নাম।
হেরাজতুল্লাহকে চেনে। তিনি ছিলেন আমার বাবা।
কোথায় যে কবর তার। তাও আমি জানিনে।
দেখছি দাঁড়িয়ে আমি চৌদ্দপুরুষের ভিটে।
একতলা ভাঙা দালান। মজে যাওয়া পদ্মপুকুর।
ঝোপ জঙ্গলে ঢাকা। কেউ বসত করেনা এখানে।
কারো কোনো স্মৃতি নেই। বাড়িটা চলে গেছে ভুতের দখলে।
দালানের কার্নিশে মাথা তুলে আছে বেওয়ারিশ গাছ
পশ্চিমের দালান ভেঙে পড়ে আছে।
বাতাসে ভেসে আসছে তক্ষকের ডাক।
একজন মধ্যবয়সী চাষি ঝোপের ওপারে দাঁড়িয়ে
গলা খাকারি দিয়ে ডাকলো আমাকে হাত নেড়ে
ওইখানে কেডাগো তুমি রয়েছো দাঁড়িয়ে?
কয়েক পা এগিয়ে এসে অবাক হয়ে দেখলো আমাকে।
এখানে কী গো তোমার। বলোতো কোথাকার লোক
বাড়িটা ভুতুড়ে বাড়ি। ভূত-পেত্নী থাকে এখানে
দেরাজতুল্লাহর ছেলে হেরাজতুল্লাহ নেই। শুয়ে আছে কবরে।
তার এক পুত্র ছিল। বাস করে কোন বিভূঁয়ে
কোন দেশে আছে সে আমরা জানিনে।
শুকচানের বউছেলে থাকতো এই দালানে
পনেরো বছর হলো চলে গেছে অন্য এক গ্রামে
হারানের কঁচি মেয়ের একদিন পাওয়া গেল লাশ
দালানের কড়িকাঠে ঝুলেছিল মুখ বাঁকিয়ে
আহা, কি করুণ দৃশ্য। কঁচি মেয়ের কঁচিবুকে ছিল দাঁতের কামড়।
এখন বাড়িটা চলে গেছে ভুতের দখলে।
কেউ বলে পোড়োবাড়ি। ভূতেরা নাচে এখানে।
কোথায় দেরাজতুল্লাহ কোথায় হেরাজতুল্লাহ কোথায় তার ছেলে
কোথায় বংশধর, আমরা কাউকে চিনিনে।
আমি খুঁজি বাপ-দাদার ভিটে।
আমি খুঁজি শৈশব। আমি খুঁজি খেলার উঠোন।
আমি খুঁজি ঘরের বারান্দা। আমি খুঁজি পুকুরের সিঁড়ি।
আমি খুঁজি মায়ের আঁচল।
আমি খুঁজি গরুর গোয়াল।
আমি খুঁজি দুপুরের আকাশ। আমি খুঁজি দুপুরের রোদ।
আমি খুঁজি বিকেলের ছায়া। আমি খুঁজি সন্ধ্যার মেঘ।
আমি খুঁজি আমারই। আমি খুজি আমারই কেবল।
কোথাও তো দাদা দাদির স্মৃতিচিহ্ন নেই।
কোথাও তো বাবা মার পদচ্ছাপ নেই।
আমি এখন বেগানা পুরুষ থাকি বিভূঁয়ে।
ভিটেটি চলে গেছে ভূতের কবলে ।
একটি চশমা ও একটি ধূমপানের পাইপ
মোটা ডাটা। মোটা চশমা।
টেবিলের উপর পড়ে আছে।
পড়ে আছে ধূমপানের সৌখিন পাইপ।
চেয়ারটাও পড়ে আছে। নিঃসঙ্গ। খালি।
চশমার ভেতরে তার চোখ।
তাকিয়ে দেখতেন শ্যামাঙ্গ বঙ্গভূমি
নদ-নদী, বিলবাওড়, সমুদ্র পাহাড়।
দৃষ্টিতে ভেসে উঠতো ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল
বৈচিত্র্যময় এই ভূমি- এই তার দেশ।
,
চশমার ভেতরে বঙ্গভূমি। গ্রাম। মানুষ। লোকালয়।
চাষিরা লাঙল চষছে। ফসল বুনছে। ফসল কাটছে।
জেলেরা ধরেছ জলাশয়ে মাছ।
কামারেরা হাতুড়ি ঠুকছে। অস্ত্র বানাচ্ছে।
কুমোরেরা বানাচ্ছে হাঁড়িকুড়ি, থালা, বাসন, রঙ বেরঙ।
তাঁতিরা তাঁতে বুনছে শাড়ি, ছুঁতোররা তৈরি করছে লাঙল। গরুর গাড়ি।
মাঝিরা বৈঠা নিয়ে চালাচ্ছে নৌকা। বাতাসে উড়ছে পাল।
চেয়ারে বসে আছেন তিনি। চশমার ভিতর চোখে জল।
ছায়া হয়ে আছে দুঃখ বেদনা শোক। দুর্ভিক্ষ মহামারী
এই তার দেশ। এই তার জন্মভূমি।
চেয়ারে বসে আছেন তিনি। পা দুটো সামনে ছড়ানো
মধুবন্তী
উতলা দুপুর ঝলসানো রোদ পুড়ানো মাঠের ঘাস
মাতাল হাওয়া কৃষ্ণ মাছির গুঞ্জনে দিগ ভরাট
সূরা গন্ধে মৌতাতে দগ্ধ এখন জষ্টি মাস
যৌবন সুন্দর নৃত্য মত্ত চৌকোণ তল্লাট
দেহে সৌষ্ঠবে রূপ লাবণ্য দামিনি উত্তাল
মদিরা বাতাসে ভেসে আসছে আম কাঁঠালের ঘ্রাণ
মধুবন্তীর উতল হৃদয় আবেগে কম্পমান
রসে টম্বুর উদাস ভঙ্গি এখন যুবতী কাল
পশ্চাদে হেলানো শরীরের বাঁক সুচারু অঙ্গদেয়াল
অধরে রঙিন ডালিম্ব রস চন্দ্রিমা ভরাকোটাল
বক্ষযুগল মধুচক্র আঁচলে রয়েছে আড়াল
মধুবন্তীর উদাস দৃষ্টি এখন যুবতী কাল
হোসেনউদ্দীন হোসেন
ইতিহাসবিদ, উপন্যাসিক, কবি ও সাংবাদিক। প্রবন্ধ/গবেষণা শাখায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০২১ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। হোসেনউদ্দীন হোসেন ১৯৪১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম কবিতা কলকাতার দৈনিক পত্রিকা লোকসেবকে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তার বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ঢাকা ও কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া শুরু করে। ১৯৬৫ সালে তিনি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে, নষ্ট মানুষ, অমৃত বৈদেশিক, সাধুহাটির লোকজন, ইঁদুর ও মানুষেরা, প্লাবন এবং একজন নুহ, ভলতেয়ার ফ্লবেয়ার কলসত্ব ত্রয়ী উপন্যাস ও যুগমানস, ঐতিহ্য আধুনিকতা ও আহসান হাবীব, বাংলার বিদ্রোহ, সমাজ সাহিত্য দর্শন প্রবন্ধ, রণক্ষেত্রে সারাবেলা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, লোকলোকোত্তর গাঁথা কিংবদন্তি, বনভূমি ও অন্যান্য গল্প, অনন্য রবীন্দ্রনাথ।