যশোধরা রায়চৌধুরী
তোমার ভেতরে সব কিছু পাল্টে যাওয়ার আগে অব্দি তুমি নিজেকে চিনতে পারতে ভালোই । এখন আর পারো না। সকালে গল্প লিখবে? আজ লিখবে না? কেন? আজ তোমার মন ভালো নেই? শরীর? শরীরও ভালো নেই? নাকি, আজ তোমার কাছে কোন প্লট নেই? কোন গল্প নেই।
একদিন সকালের পর থেকে এরকম হয়ে গেছে। আর কোন গল্প নেই নবমিতার কাছে।
তাহলে নবমিতা, আজ তোমার সারা সকালের কাজ, শরীরের তিরিশ শতাংশ ভার বাঁ পায়ে আর সত্তর শতাংশ ভার ডান পায়ে দাঁড়নো, আর ঘুরে যাওয়া। এমন ভাবে ঘুরবে, যাতে ঠিক বিপরীত কোণে, মানে পুব থেকে পশ্চিমে, বা ঈশান থেকে নৈঋতে, ঘুরে যায় তোমার শরীর। আর তারপর, ঠিক উল্টো, মানে বাঁয়ে সত্তর, আর ডানে তিরিশ।
কল্পনা করো, তুমি আর তুমি নও, তুমি একটি পুতুল। আর তোমার মাথার ঠিক মাঝখানে, কল্পনা করো, উঠে গেছে একগাছি সুতো, কল্পনা করো, কল্পনা করো। এক বৃহৎ পুতুলনাচিয়ে তোমাকে ঝুলিয়ে রেখেছে শূন্যে, ওই সুতো স্বর্ণাভ এবং উজ্জ্বল, আকাশ থেকে, উপর থেকে নেবে এসেছে, অদৃশ্য কিন্তু সুদৃঢ় বন্ধনের মতো তোমাকে ধরে আছে, তোমার শরীরে আর কোনো ভার নেই, ঝুলন্ত মানুষের আর কোন ভার থাকে? তোমার পায়ের তলে আর কোনো মাটি নেই, কল্পনা করো, কল্পনা করো।
এ সবই সত্য। এমনই বলেছিলেন সেনসেই অরণ্য। কলেজে পড়তে, আর্ট অফ লিভিং ক্লাসে একবার জয়েন করেছিল। সেখানেই দেখা। দক্ষিণ ভারতীয় অ্যাকসেন্টে কথা বলেন, আর কথায় কথায় কাহিনি, মিথ, অ্যানেকডোট মিশিয়ে দেন। সেনসেই বলেছিলেন, কল্পনা করো, তোমাকে দোলানো হচ্ছে। তোমার শরীরের মুভমেন্ট হবে তেমনই সহজ সাবলীল। তোমার সমস্ত দুলুনি, তুমি ভেতর থেকে প্রবাহিত ঢেউয়ের মতো করো, আর চোখ বুজে ভাবো, ওই দুলুনি আসছে তোমার মূর্ধার ভেতর দিয়ে বাহিত এক গুছি স্বর্ণিল সুতোর থেকে। নিজের ক্রিয়া নয় এ। এ তোমার দায়িত্ব নয়। এ এক রিল্যাক্সেশন।
তারপর থেকেই রোজ সকালে নবমিতার রিল্যাক্সেশন এক্সারসাইজ। ভালো গল্পটা যে নেইই, না? সকালগুলো ভরাবে কি দিয়ে?
সারাদিনের গল্প খোঁজার গ্লানি, মেদমজ্জায় প্রবাহিত সারাদিনের উৎকন্ঠা, ভালো গল্পটা কোথায়? ভালো গল্পটা কোথায়? সবই তাকে পেড়ে ফেলত নইলে, দিনের শেষে। কাধে চাপচাপ ব্যথা, গলা ঘাড় ঘোরাতে না পারার যন্ত্রণা। ভালো গল্পটা তাকে যে লিখতেই হবে, এই টেনশনে তার মাথায় এখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা, চাপ আর ব্লাড প্রেশার। ভালো গল্পটা না লিখতে পারলে সে পিছিয়ে পড়বে। সে হেরে যাবে।
কিন্তু ভালো গল্প কোথায়? এতকিছু করেও তো ভালো গল্পটার নাগাল পাচ্ছে না সে! তার ভেতরে একটা চাপ, একটা অদম্য টেনশন থেকে যাচ্ছে, ভালো গল্পটা লিখতেই হবে। তার টাইপিং স্পিড হার মেনে যাবে এমন একটা গল্প। যা নিজেই সবেগে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আর সে গল্পে, ছোটবেলার ইশকুলের মাঠে যেভাবে মোজার ভেতরে চোরকাঁটা গেঁথে গেঁথে যেত, আর তা টেনে টেনে তুলে বিকেলদুপুরের অনেকটা সময় কেটে যেত, তেমন ভাবে গেঁথে গেঁথে থাকবে তার মেয়েজীবন, যাবতীয় মূল্যবোধ, মানে সাদাবাংলায় ভ্যালুসিস্টেম, তার পাপ, পূণ্য, তার পাওয়া, না পাওয়া।
আসলে ভালো গল্পটা নেই, হয়না। ওটাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক জিনিশ যেমন হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে। কিশোর কুমারের গান বা উত্তম সুচিত্রার সিনেমা।
২
এর ভেতরেই ফোন আসে নবমিতার বান্ধবী পরমা সরকারের। সে একজন বাঘা আমলা। রাইটার্সের পাশেই আর একটা কোন অফিসে বসে। পশ্চিমবঙ্গের নারী ও শিশুদের নিয়ে কী কী সব স্কিমের হর্তাকর্তা । খুব ব্যস্ত মেয়ে। এখন মহিলা। আগে মেয়ে ছিল। নবমিতারা একসঙ্গে ইস্কুলে পড়েছিল।
কী রে, নবমিতা ! আছিস কেমন?
এই চলে যাচ্ছে রে। ভয়ে ভয়ে বলল নবমিতা । ভয় এইজন্য যে পরমা ওর লেখার এক গুরুতর সমালোচক।
সমালোচনা করাটা আসলে মানুষের হবি। এবং পাঠক, জেনেরালি, লেখকদের থেকে বেশি শিক্ষিত, বেশি স্মার্ট, বেশি তুখোড়। অন্তত সেরকম দেখান চাই । ইস্কুলে পরমা নবমিতার থেকে বাংলায় বেশি নম্বর পেত। যেমন পেত ইতিহাস ভূগোল অংকেও । সেই সুবাদে ও বড় চাকুরে, জীবনে নবমিতার থেকে অধিক সফল, এবং ন্যাচারালি, ওর লেখালেখির সমালোচক।
এইবার কাগজের রবিবাসরীয়র সঙ্গে একটা পুল আউট বেরিয়েছে। বিয়ে নিয়ে বিজ্ঞাপনগুলো একজায়গায় করে। সঙ্গে একটা ছোট গল্প, যার বিষয়ও বিয়ে। সেটা পড়েই এই ফোন, খুব হেসেছি তোর লেখাটা পড়ে। এইসব ফালতু কাগজেও তোরা লিখিস তাহলে? হি হি। তাও শেষ অব্দি পড়েছি যদি কিছু পাই, শেষ হয়ে হইল না শেষ-এর মতো…
এবার ও নবমিতাকে অগভীর বলার সঙ্গে সঙ্গেই রবি ঠাকুরের শেষ হয়ে হইল না শেষ-ব্যাপারটার একটি ভাবসম্প্রসারণ করবে। এখনকার লেখকদের সবাইকেই অসফল বলবে, আর তারপর সামান্যীকরণ করবে, আজকালকার কোনো লেখাই, “কিচ্ছু হচ্ছে না”! ও যে এসব বলবে, এ আর আশ্চর্য কি! নবমিতার লেখালেখির ওই তো খদ্দের।
তা পাঠককে অতটা লঘুভাবে নেওয়ারই বা আছে কি। হাজার হোক সে একজন কনজিউমার। সে একজন ক্লায়েন্ট । তাকে খুশি করব না, হাতে মাথা কাটব, কথায় কথায় ট্যান যাব, আঁতলামি আর ফাঁকিবাজি করব তা ভাবাটাও লেখকদের ভুল।
ধরুন, ওই একই উপভোক্তা যখন ব্যাংকে যান । ব্যাংকের এফ ডি’র ইন্টেরেস্ট রেট বা ফ্ল্যাট কেনার ই এম আই নিয়ে আলোচনাতে তিনি ব্যাংক-কর্মীদের থেকে বেশি স্মার্ট প্রমাণ করার চেষ্টা করেন তো নিজেকে? তাহলে? অথবা তিনি যখন ডাক্তারখানায় যান। ডাক্তারের সঙ্গে এক্স রে-এর বিশ্লেষণ নিয়ে বা ওষুধের কোনটায় তার অ্যালার্জি, তা নিয়ে তর্ক করেন তো?
এখন সকলেই শিক্ষিত, সকলেই সচেতন। স্বাস্থ্যসেবা যদি কনজিউমার গুড হয়, এনটারটেনমেন্ট বিজিনেস তাহলে অনেক আগেই উপভোক্তাদের বিষয়। লেখালেখি তো এন্টারটেনমেন্টের মধ্যেই পড়ে। অত ঢাক ঢাক গুড় গুড় কেন?
সুতরাং এর পর পরমা নবমিতাকে এক ঘন্টা ধরে বোঝাবে যে ওর গপ্পটা পরমার কোন কোন জায়গায় অবাস্তব লেগেছে। কেন এই প্লট বস্তাপচা এবং গোলান।
-এই সব সমকামী প্রেম, এইসব ডিভোর্সি মহিলার আখ্যান, এসব বহুবার হয়ে গেছে, বুঝলি? তোরা নতুন কিছু লেখ। আমার কাছে অনেক গপ্প আছে, তোকে প্লট দিচ্ছি, সেগুলো লেখ।
ঠিক আছে, বল তোর গল্প। ওকে হাত তুলে দিয়ে সারেন্ডার করল নবমিতা। সত্যি ওর অনেক অভিজ্ঞতা। দিনের পর দিন ও বর্ধমানের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ডিউটি করেছে। অনেক একশো চুয়াল্লিশ ধারার কেস ওর চোখে দেখা। জমি ঘটিত পারিবারিক দাঙ্গা থেকে শুরু করে স্ত্রীঘটিত সম্পত্তিকোন্দল অব্দি।
তার ওপর ওর বন্ধু বান্ধবীরা সব এক একটি রত্ন । গল্পের ভান্ডার। সাধে কি টিভিতে রিয়ালিটি শোর ঝমঝমাঝম। বাস্তব ইজ স্ট্রংগার দ্যান ফিকশন। লালমোহন গাংগুলি এমনি এমনি বলেছেন!
এক বান্ধবী কাজ করে পরমার সঙ্গে । ডব্লিউ বি সি এস সে । তার বর ডাক্তার, লন্ডনে থাকে । ওদের লং ডিস্ট্যান্স ম্যারেজের সমস্যা নিয়ে লেখা হয়না কেন? ছেলে মেয়ে বছরের কিছু সময় মায়ের কাছে দেশে, কিছু সময় বাবার কাছে বিদেশে । এদের ভিসা সমস্যা নিয়েও তো নবমিতা লিখতে পারত!
পরমার আর এক সহকর্মিনী নিশার স্বামী ব্যাংকের ঘ্যাম চাকরি থেকে ভি আর এস নিয়েছে। তার অনেকদিনের স্বপ্ন পূরণ করবে । বুটিকের বিজনেস করছে । করতে করতে দশ লাখ টাকা খুইয়েছে। আজকাল এসব ব্যবসায় দশ কিসসু না। হাতের ময়লা। এখন বরের টাকা ফুরিয়ে গেছে । এরপর স্ত্রী নিজের টাকাও ব্যবসার জন্য তুলে দিয়েছে বিস্তর । সারা বাজারে অনেক দেনা । ফ্ল্যাট মর্টগেজ হয়ে গেছে । নিশা এখন ডিভোর্স চায়।
– এগুলোই আমাদের গল্প! এগুলোই এখনকার গল্প, বুঝলি? কোনো এক্সট্রা ম্যারিটাল প্রেম না, কোনো সেক্স সংক্রান্ত লটরঘটর না। বোঝ নবমিতা, বোঝ! এগুলোই এখনকার গল্প। তোরা যে কী কেবল একঘেয়ে কতগুলো প্রেম–অবৈধতা-রংচড়ানো শয্যাদৃশ্য লিখিস! এই তো একটা ম্যাগাজিন খুলেই দেখলাম এক লেখিকা গপ্পো শুরুই করেছে এক প্রৌঢ় কীভাবে একটি কচি কিশোরীর ব্রা খুলছে সেই বর্নণা দিয়ে। বাব্বাঃ পারিস বটে তোরা।
৩
শুধু পরমা না। নবমিতার ডাক্তার বন্ধু শুভাশিস ওকে অনেক গল্পের মশলা শোনায়। সে তো জানা কথাই হাসপাতাল মাত্রেই এক একটা গপ্পের আড্ডাখানা। আর সেই সব বনফুলটুলের মতো ডাক্তাররাও এখন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে গিয়ে আর গপ্প লিখতে পারেন না।
গপ্প সাপ্লায়ার তো এমনকি নবমিতার কলেজের হরিহর আত্মা বান্ধবী রমিতাও। ওদের কাজের মেয়েটির বর পালিয়ে গেছে । আর বরের মোবাইল ফোনে ফোন করলেই এখন অন্য এক মহিলা ফোন উঠায়, নাটকবাজি করে। মেয়েটি বলেছে আমি হয় গলায় দড়ি দেব, নয়ত ওই মেয়েটাকে ফাঁসিতে ঝোলাব । রমিতারা ওকে কাউন্সেল করাতে নিয়ে যাচ্ছে।
কাউন্সিলর, নয়ত কাউন্সেলর! হয় লোকাল পার্টি, আর নয়ত সাইকায়াট্রিস্ট। দুটো জায়গায়ই তো যাবার আছে, বল?
নবমিতা বুদ্ধিমানের মতো হাসার চেষ্টা করল । নিজের কানেই বোকা বোকা ঠেকল। সত্যি করে বুকে হাত রেখে আর বলতে পারছে না নবমিতা, যা লিখছে তা পাঠকের কথা মাথায় রেখে। আর পাঠকই যদি খুশি নয়, তাহলে তাদের খুশি করছি এমন একটা ভাঁওতাবাজির মধ্যে থাকার দরকার কী বাপু? তার চেয়ে নিজেকে খুশি করার জন্য লেখাই ভাল।
ওর একটা ভালো গল্প চাই। নইলে দৈনিক সুভাষিতর রবীবাসরীয়ে ছাপবে না পল্টুদা। পল্টুদা, মানে পল্টু সেন, মানে একদা শুভব্রত বা দেবব্রত এমন একটা কিছু নাম ছিল, কিন্তু মিডিয়ার জগতে থাকতে থাকতে ওর পল্টু নামটাই ভীষণ ক্যাট হয়ে গেছে, যেমন পেজ থ্রিতে দেখেছে বিশাল ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের মধ্যে, পার্টি-হপার্সদের মধ্যে, গুলু বনসল, বা ডাব্বু বেদি, বা সুন্দরী এক্সপোর্টার বুবু চৌধুরীকে। ক্যালকাটা ক্লাবের পাপোশে পা না মুছলে যার উইকেন্ড কমপ্লিট হয়না।
পল্টুদা এক্স বিজ্ঞাপন সংস্থা, বিশাল র্যাালা। খুব সেন্স অফ হিউমার। বলেছিল, একটা ভালো গল্প দাও। বেশ মশলাটশলা থাকবে, কিন্তু মিটি হওয়া চাই। মানে, বডি যেন থাকে।
বডি। বডি। গায়ে বডি স্প্রে লাগাতে লাগাতে, কাঞ্জিভরমের একটা পাক দিয়ে শরীরকে আরো মোহনীয় করে তুলতে তুলতে, আয়নায় তাকিয়ে, ও ভাবল, আজকেই একটা গল্পের প্লট চাই আমার। কিন্তু বডি? ওয়ার ইজ দ্য বডি?
সিনেমা দেখতে যাবে ও। আগে আগে বিদেশি সিনেমা থেকে দেদার টোকা যেত। এখন বিদেশি সিনেমা টুকে হিন্দি ছবি আর হিন্দি ছবি টুকে বাংলা ছবি এমন রমরমিয়ে ব্যবসা করছে যে আর টোকার কোন জায়গাই বাকি থাকছে না। চাপ হয়ে যাচ্ছে। চাপ চাপ ব্যথা গলায়, ঘাড়ে।
কাল নবমিতা জিমে যাবে। কাকে যেন সেদিন বলছিল ও, এক্সারসাইজ করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে, যৌন উত্তেজনা হয়। হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে সাহিত্যের আড্ডা ছিল একটা। কে থ্রো করেছিল পার্টি, কে জানে, এখন আর মনে নেই। তবে ব্যাপারটা সেক্সি ঠিকই। লিখতেও ওর ভালো লাগে, যৌন উত্তেজনা হয়। এটাও কাউকে বলল নাকি? বললেও ভুলে মেরে দিয়েছে।
কিন্তু ভালো গল্পটা কোথায়? ও আজ অফিস থেকে ভালো গল্পের খোঁজে আটটা ফোন করে। আটজনের মধ্যে দুজন এন জি ও করে। সাংবাদিক রমা আবার ফেমিনিস্ট, তাই ওকে ট্যাপ করলে কিছু ইস্যু পাওয়া যাবে। তাছাড়া এন জি ওর রণেন এখন রেড লাইট এরিয়া নিয়ে কাজ করে। মার্কেটিং-এর নয়না ফোন করেছিল। ও একটা জীবনকথা বলেছে নবমিতাকে। সেইটা নিয়েও লেখা যায়। একজন ঘ্যাম মহিলা প্রফেশনালের কথা। সে প্রায়ই ফরেন ট্যুরে গিয়ে থাকে। ওর একটা ম্যাপ আছে, মানসিক ম্যাপ। সেটাতে অনেকগুলো শহরে লাল ফ্লাগ পুঁতে দেওয়া আছে। এদিকে ভিয়েনা, প্যারিস, হ্যামবুর্গ। ওদিকে লস এঞ্জেলেস। ব্রাজিল যাবে বলে সব ঠিকঠাক ছিল, ইতিমধ্যে মিনিসট্রি অফ এনভায়রনমেন্টের হিংসুটেগুলো ওর যাওয়া বানচাল করে দিল। কেলো আর কাকে বলে। সেবার ফুলহাতা ছটা কামিজ বানালো ও, ইরাণ যেতে হবে বলে। শেষমুহূর্তে ইরাণ ট্রিপ ক্যানসেল করে দিল বড়কত্তা। একটা মিটিঙের বাহানা করে, ওনার সাথে দেখা করল ও, প্রায় কাঁদতে বাকি রাখল, স্যার, এবার আমার এত ইনভেস্টমেন্ট হয়ে গেছে স্যার, এতগুলো জামা বানালাম, ওখানে কাভারড ড্রেসই পরতে হবে বলে, রিভিলিং ক্লোদস পরা যাবে না বলে, এই কলকাতায় গরমে এগুলোকে যে কী করি, আবার দর্জিকে দিতে হবে অলটার করতে, আর স্যার, আমার আবার মিডল ইস্টটা দেখার খুব ইচ্ছে। দুবাই গেছিল একবার, মস্কো যাবার সময়, পাস করেছিল। ওটাও ওর মানসিক ম্যাপে লাল ফ্লাগে সাঁটানো অবস্থায় আছে। তো সেই দুবাইতে সারারাত এক সোনার দোকান থেকে আর এক সোনার দোকানে ছুটে বেড়িয়েছিল, কী অসাধারণ সব জিনিস। গলার চেন কত রকমের। ইশশশ। কিনতে কিনতে ফতুর। আর অস্ট্রেলিয়া এবার যাবে, একগাদা অরিজিনাল রেভলন আর অরিজিনাল মেবিলাইন কসমেটিক আইটেম কিনবে।
পুরোটা শোনার পর অবশ্য নবমিতা আর কোন গল্পই খুঁজে পায়না । ওর হাই ওঠে। উফ বাবা, ভালো গল্পটা কোথায়?
৪
ছোটবেলায় ওকে রাখত যে বুনুমাসি, সে বলত: ক্ষ্যামতা কত দেকিয়ে দাও তো মামণি। ক্ষমতা, হ্যাঁ ওটাই ঠিক শব্দ। পাওয়ার আসলে, সবটাই পাওয়ার প্লে। মানুষের মন নিয়ে অকাতরে খেলতে পারাও তো পাওয়ার প্লে।
আসলে আমাদের জীবনে যা যা ঘটে, তার জন্য আমারাই দায়ী। যখন দায়ী ছিল না, নবমিতা গল্পের ভেতরে দিয়ে সেই সময়টাকে মুছতে চায়। হিরণকাকু যখন গায়ে হাত দিয়েছিল, নিরিবিলিতে জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে ব্রা না পরা শরীর ঘেঁটেছিল, ওকে বোকা, ক্যাবলা, যাচ্ছেতাই লাজুক পেয়ে, সব কিছুর পরেও, হিরণকাকুর কোনো শাস্তি হয়নি, কারণ কাউকে বলতেই পারেনি নবমিতা : সেই সময় ও দায়ী ছিল না। কিন্তু ও সেই পাস্টকে, সেই জঘন্য এপিসোডকে মুছে ফেলতে পেরেছে। ওরকম কোনো ঘটনা যে কখনো ঘটেছিল, ও ভুলে যেতে পেরেছে। কারণ সেটা নিয়ে একটা গল্প লিখতে পেরেছিল।
তারপরেও তো থেমে থাকেনি ওর আত্ম আবিষ্কার প্রবণতা। হিরণকাকু এপিসোড ততদিনে পুরোনো। একটা সিনেমাহলের পেছনের বাথরুমে একটা অচেনা লোক ওকে জড়িয়ে ধরেছিল, তখনো ও এগারো কি বারো মাত্র। কিন্তু যখন ও পনেরো ও ষোল, ও তো আবিষ্কার করেই ফেলেছিল ওর নিজের রাজ্য, স্বপ্নরাজ্য। সেটা তো ওইরকম ভয়ের, চটচটে, ক্লেদাক্ত নয়। প্রথম ঋতুর মতো, অদ্ভুত, বিদঘুটে, কাদার মতো ব্রাউনিশ নয়। ওর স্বপ্নগুলো ফুরফুরে আবার ভীষণ বডি তাতে। ওর একটা ঘর দিয়েছিল মা তখন, হয়তো ভুল করে ভেবেছিল পড়াশুনার সুবিধে হবে। একটা জানালা, একটা সিংগল খাট, একটা হালকা ফুলছাপ চাদর, বইয়ের অগোছালো টেবিল। সেই খাটটা নৌকোর মতো পাল তুলে চলে যেত। ওর ফ্যান্টাসির নৌকো, কোনো আগল ছিল না আর। সারাটা দুপুর বুকে বই উল্টে রেখে ওর সিলিঙে তাকিয়ে ফ্যান্টাসি, দুটো চরিত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সম্পৎ আর সুচরিতা। ওদের প্রেম দেখত ও, ওদের প্রথম ঘটে ওঠা চুমু দেখত, মান অভিমান, বিবিধ অছিলায় পরস্পরের কাছে আসাআসি। দিনে দুপুরে, সন্ধে রাতে, যখনই ও একলা, ওর একটা হাত অন্য হাতকে স্পর্শ করছে, ওর একটা আঙুল ওর নিজেরই কাঁধে, বুকে, পিঠে স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে। স্পর্শ, স্পর্শ আর স্পর্শ, বিশুদ্ধ ছোঁয়ার ভেতরে ও নিজেকে আবিষ্কার করছে। কিন্তু আসলে ও না, আবিষ্কার করছে সুচরিতা সম্পৎকে, এবং সম্পৎ সুচরিতকে।
এখন সেইসব নিয়েও গল্প লেখে নবমিতা। গল্প লিখেই চলতে পারে। জীবনে এর পরেও ভুল হয়েছে, কিন্তু সেজন্য আর হাত কামড়াতে হয় নি। রিগ্রেট? নৈব নৈব চ। কারণ এখন যা কিছু ঘটে, সবকিছুর থেকে ও একটা গল্প লিখে ফেলতে পারে। একটা করে গল্পের মালমশলা গুঁজে গুঁজে রাখা আছে ওর প্রতিটা ঘটনায়, ঘটা বা না ঘটা। এভাবেই, ক্ষমতার খেলায় ও জিতে গেছে।
অন্তত সেইরকমই মনে হত তিরিশ ছোঁয়ার আগে অব্দি। নবমিতা দাস যখন রমরমিয়ে লিখে নাম করছে, চারিদিকে নানা পত্রপত্রিকায় ওর লেখা ছয়লাপ হচ্ছে। বিয়ের আগে পর্যন্ত।
বিয়ের আগে পর্যন্ত অনেক ভুল সম্পর্ক করেছে নবমিতা। একলা থেকে অনেক আত্মরতিও। ওই অব্দি, নবমিতা যা করেছে, তা ওকে ভালো ভালো গল্প দিয়েছে। প্রতিমকে বিয়ে করার আগে অব্দি। শরীরকে নিয়ে তো ও খেলেছে, কিন্তু সেটা ওর নিজের শরীর। কার তাতে কি? জীবনকে নিয়ে ও খেলেছে, কিন্তু সেটা ওর নিজের জীবন । জাস্ট গেট লস্ট, ইয়ার! আমার ভুল আমার, আমার পাপ আমার।
প্রতিমের সঙ্গে জীবনটাকে জোড়ার পর পর দেখা গেল, খেলাটা অত সোজা নয় আর। অত সহজে সবকিছুকে গল্প করে ফেলা যায়না। রেস্পন্সিবিলিটি নিতে হয়। তখন আর একার জীবন নয়। তখন দুজনের। তাই তা নিয়ে গল্প লিখে ফেলা যায়না। নৈতিকতঃ, যায়না।
৫
-আমাকে নিয়ে কোনো গল্প লিখবে না তুমি, ঠিকাছে? বলে দিলাম এই। যদি দেখি কোনো গল্পে আমি আছি, যদি দেখি আমাকে চরিত্র বানিয়েছ কোনো গল্পের, সম্পর্ক কিন্তু সেখানেই শেষ। আমি তোমার গপ্পের বিষয় হতে তোমাকে বিয়ে করিনি, মনে থাকবে?
মন খারাপ হয়েছে নবমিতার। মন খারাপ হয়েছে, মানে, মনের একটা অংশ মরে ঝরে যাওয়ার আগে, কেমন যেন শুকিয়ে পতপত করে ঝুলছে।
মন খারাপের কয়েকটা ক্যাটেগরি আছে, নবমিতা জানে, প্রথম চিহ্ন হল, বুকের ভেতরে, ঠিক গলার কাছটায়, ঠান্ডা ঠান্ডা একটা অনুভূতি, কেমন যেন নেমে গেছে একটা হাওয়ার দলা, হঠাৎ একটা ভ্যাকুয়াম তৈরী হয়, বুকের ভেতরে এক মুহূর্তে একটা ফাঁকা ভাব।
এই মন খারাপটা সবসময়ই হয়, প্রতিমের কাছে থেকে অপমান ও আঘাত এলে। একসময় মা বা দিদির এক একটা ব্যবহারে চমকে উঠে ও দেখেছে কেমন একা লাগছে, যেন চারিদিক থেকে সব দেওয়ালগুলো খসে খসে পড়ে গেল, ঘরটা হঠাৎ মাঠ হইয়ে গেল, সন্ধে হয়ে আসা একটা মাঠের মধ্যে সে দাঁড়িয়ে আছে।
মা বা দিদির সাথে এরকম হবার পর, ক্লস্ট্রোফোবিয়ার পর পর হঠাৎ খোলা তেপান্তরে নির্বাসনের অনুভূতি। এই অদ্ভুত ফিলিংটা বারবার ফিরে আসে। চিড়িয়াখানায় একবার হারিয়ে গিয়েছিল নবমিতা, বেশ ছোট বয়সে। কুমিরের খাঁচার সামনে খুব মন দিয়ে কুমির দেখতে হঠাৎ ঘাড় উঠিয়ে দেখল চারপাশ ভোঁভোঁ, কেউ কোথাও নেই, দু পা এক পা করে এদিক ওদিক ঘুরল, কাউকে দেখতে পেল না, তাকিয়ে দেখল চারিপাশে অচেনা লোকেরা। একজন বোধহয় বললও, খুকি তুমি কি হারিয়ে গেছো? তারপর অসহায় ও একটা বেঞ্চিতে বসে হু হু করে কেঁদে ফেলার মুহূর্তটায় বুকটা ওরকমই ফাঁকা হয়ে গেছিল। একটু পরেই মা ফিরে এসেছিল তাকে খুঁজতে, কিন্তু সেটা আর মনে নেই, শুধু ওই সর্বহারার মতো কান্নাটা মনে আছে।
আবার অনেকদিন পরে, বুকের মধ্যের ফাঁকাভাবটা এরকমই লেগেছিল প্রতিমের সাথে। প্রথমবার শরীরী সম্পর্ক হবার পর পরই সেই ঘটনা নিয়ে একখানা দিব্যি জব্বর গল্প ফেঁদেছিল নবমিতা। আর সেটা, রগরগে ডিটেলিং সহ, ছেপেও দিয়েছিল বড় কাগজ।
তার পর থেকেই প্রতিম প্রতিশোধ নিতে শুরু করল ওর উপরে, ব্যক্তিগত জীবনকে পাবলিক করার প্রতিশোধ। শোবার ঘরকে বসবার ঘরে আনার প্রতিশোধ। তখনো বিয়ের ছ মাসও হয়নি, মোহ ঘুচে গেল ওর। ওকে বলত তুমি সুন্দর, কিন্তু ততক্ষণই তোমাকে ভালো লাগে যতক্ষণ তোমার মুখ বন্ধ থাকে। মুখ খুললেই তুমি নিষ্ঠুর, কদর্য। আর লিখলে, তুমি খতরনাক। তুমি আমাকে গল্পের বিষয় করে চুষে চুষে মাকড়শার মতো রসহীন, ফোঁপরা করে দিয়েছো, নবমিতা! তোমার আত্মজৈবনিক গপ্পো তুমি আগে যতখুশি লিখেছ লিখেছ। এখন তোমার আত্মজীবনীর মধ্যে তো আমিও ঢুকে গেছি । আর এটা করতে পারো না তো তুমি।
ওপেনলি ওকে বলত এটা।
ও বিদ্রোহ করল। মনে মনে বলল, আমি লেখক। আমি তো জন্ম থেকেই লেখার জন্য বলিপ্রদত্ত ! লেখা ছাড়া তো আমি কিছু করিনি। আমি তো তোমার সঙ্গে অসতিপনা করিনি, একস্ট্রা ম্যারিটাল করিনি, বিশ্বাসঘাতকতাও করিনি। আমি শুধু কয়েকটা গল্প লিখেছি। আমি, শুধু আমি বলেই কি প্রতিম, তোমার অসুবিধে হবে? হচ্ছে? জাস্ট বাই বিয়িং মাইসেলফ, আমাকে এত কথা শুনতে হবে। নিজেকে পাল্টাতে হবে? কেন, প্রতিম, নিজেকে পাল্টাতে পার না তুমি? আমি কেন আমাকে বদলাতে যাব?
তারপর প্রতিম রেগে গেল। নবমিতা রেগে গেল। ব্যাপারটা সাংঘাতিক। কারণ রাগ ওদের ভেতরটাকে কুরে কুরে খেয়ে নিয়ে একটা পোড়া অঙ্গারের রেখা রেখে গেল।
সেই ঘটনার আগে অব্দি দিব্যি তো চলছিল, নিজের ভুলগুলোকে নিয়ে লিখে লিখে লিখে, জীবনের ওর সঙ্গে করা অত্যাচারগুলোকে নিয়ে লিখে লিখে লিখে। আজকাল লিখতে বসলেই একটাই সমস্যা। একটাই কনফিউশন। ভালো গল্পটা কোথায়?
এরকম কোনো যোগাযোগ কি আছে, যারা ভালো গল্পটা ফোকটে ওকে পাইয়ে দিতে পারে?
৬
আসলে ভালো গল্পটা নেই, হয়না। ওটাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক জিনিশ যেমন হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকে। কিশোর কুমারের গান বা উত্তম সুচিত্রার সিনেমা।
হারিয়ে গেছে শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাসের মতো স্পষ্ট সুন্দর। হারিয়ে গেছে নরেন্দ্র মিত্তিরের সুবোধ ঘোষের ছোটগল্পের মতো নিঁখুত পূর্ণাঙ্গ বিস্তার। সব হারিয়ে গেছে, শুধু পড়ে আছে আত্মজৈবনিক। আর নবমিতা, নিজের এই খোঁজের কথাটাই শুধু পাতা জুড়ে জুড়ে লিখবে। যেভাবে পিঁপড়ে বয়ে নিয়ে যায় চিনির ডেলা।
হয়তো এ সমস্যা থেকে তারপর একদিন সে উদ্ধার পাবে। হয়তো পাবে না। সব ভালো জিনিশ অনেক অনেক হয়ে যাবার পর যে ক্লান্তির সর পড়ে থাকে বিচ্ছিন্ন অনেকগুলো জীবনে, সেইরকম ছিঁড়েখুঁড়ে ছেতরে পড়ে থাকবে পরমার বলা গল্পগুলো, শুভাশিসের বলা গল্পগুলো, নয়নার বলা গল্পগুলো, রণেন বা, এমনকি প্রতিমের নিজেদের জীবনের গল্পগুলোও। সব আলাদা আলাদা। সব যুক্তিশৃংখলহীন, উদাস। সুতোয় না গাথা মালার মতো।
ভালো গল্পটাও চলে গেছে জীবন থেকে, যেভাবে পাপ পুণ্য, স্বর্গ, নরক। যেভাবে সত্তার মূল অবলম্বন। নবমিতার মধ্যবিত্ত বলয়ে এখন হাওয়া দেয়, আর ছেঁড়া ছেঁড়া সেই গল্পগুলো পতপত করে ওড়ে। একলা হাওয়ায়।