কাজী মাজেদ নওয়াজের একগুচ্ছ কবিতা

প্রাণন

তোমার অন্তর থেকে ছুটে আসছে
এক সরিষাক্ষেত সোনারঙ আলো

ছুটে আসছে—
সূর্যমুখীপাপড়ি
অতল গহ্বর থেকে ঘরে ফেরা
জোনাক-জোনাকী, ছুটে আসছে—
ফিনিকফোটা জ্যোৎস্নায়
খসেপরা সন্ধ্যার হিমরং

আসছে। ছুটে-ছুটে আসছে
আমাদের দিকে
সাঁঝলাগা স্বজনের দিকে

যারা দেখতে পায় না—
আলোর অন্ধকার অথবা অন্ধকারের আলো…

৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, যশোর।

 

বন্ধু, হাত ধরো

এই শহরের যমজশালিক উড়তে ভুলে গেছে
ব্যস্ত ভীষণ কাজে
একটি দিন খুঁজে পেল দুই-পালকের ভাঁজে

ঝকঝকে দিন বললো হেসে—
তোমরা কী-যে করো?
বন্ধু, হাত ধরো!

কাছে এলো ঘরেফেরা উড়োমেঘের বিকেল
পদ্মাঠোঁটে ঝিলিকমারা রৌদ্র-ইলিশ নিকেল
সাথে ছিল রাষ্ট্রবিহীন স্বাধীন দমকাহাওয়া
হঠাৎ পাওয়া একটিদিনের সময় থমকে যাওয়া…

১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, রংপুর

 

এক ভয়াল সন্ধ্যারঙ

এক সরিষাক্ষেত সোনারঙ আলো নিয়ে—
তুমি ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছো
কী গভীর অন্ধকারে!

সুবহে-সাদেকে জেগে ওঠার আহ্বান
তুমি কখনো শোনো নি

বাতাসের স্রোত ভেঙে-ভেঙে
প্রলম্বিত ঘন্টাধ্বনি
পৌঁছায় নি তোমার কান অবধি

তুমি ঘুমিয়েই আছো, আর
ক্রমাগত দুঃস্বপ্নের তরবারি দিয়ে
হত্যা করছো নিজেকে

মধ্যরাতে দপ করে জ্বলে ওঠা
এক গগনবিদারী রক্তসূর্য দেখে—
এখনও তুমি সূর্যোদয় বলে ভ্রমে মেতে আছো?

১৮/১০/২০২১, যশোর

 

আত্মজ

আচ্ছা, আয়ান কি কখনো এই পথে যাবে?
ও-কি আমার মতোই দেখতে পাবে—

পথের দু’পাশে জংলিসবুজ বর্ডার, ছোটো-ছোটো সাদা-সাদা হলুদ-হলুদ প্রজাপতি—ঝিকিমিকি?
পাশ কেটে যাওয়া দ্রুতগতি যানবকম্পন?
হঠাৎ দেখতে পাওয়া এক প্রবীন বাবলা,
অসময়ে তার ঝরিয়ে দেওয়া অনন্তকুসুম?

ও কি দেখতে পাবে—
ঝুঁকেপড়া জারুলের পার্পলচাহনি?
নাকি ঘুমিয়ে যাবে এলিয়ে দিয়ে শ্রান্তদেহ

আচ্ছা, আমার বাবাও কি এসেছিলেন
এ পথে কোনদিন?

সিলেট, ১৩ অক্টোবর ২০২১

 

সন্ততি

আমায় দেখতে না পেয়ে
দরজায় একটি শিশুর
ধাক্কাধ্বনি শুনি। ও-ঘর থেকে
এমনকি কবর থেকেও…

২১ মে ২০২২,যশোর

 

ইচ্ছেডানা

চার বছরের আয়ান বললো—
আমার দুই হাতে দুটো জিনিস আছে
আমি কিন্তু এটা নেব
এখন বল তুমি কোনটা নেবে?

সকলের ইচ্ছেডানা যদি দেখা যেত
উড়তে পারতাম একই আকাশে…

১২ নভেম্বর ২০২১, যশোর

 

ডাক

এখন আর মনে পড়ে না
তোমাকে ডাকার কথা, তোমাদেরও।
সাড়া না দিলেও, জানি
এখনও অপেক্ষায় আছো উপেক্ষা করার।

অপেক্ষায়-উপেক্ষায়
এক শীর্ণতরু বৃক্ষবট হয়ে আছি, যার
সোনালুলু ঝুরি ধরে
এখনো দোল খাও কত না অনুষ্ঠানে, আয়োজনে..

শোনো, তোমাকেই বলছি—
এতো ডাকি তবু সাড়া দেবার ভান করে
যারা এড়িয়ে চলেছো কালে-কালে

এক দুরন্ত কুয়াশা হয়ে
তোমাদেরই দুচোখ ঝাপসা করে
মিলিয়ে যাবো অন্তরালে…

২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ঢাকা

 

কাছের মানুষ

সব মেঘ একইরকম
এমনকি বৃষ্টি, ঢেউ…

বয়সেরও আছে
একান্ত চেহারা।
সময়েরও…

কাছের মানুষ ভেবে
এগিয়ে গেলেই
দেখি অন্য কেউ…

৩ ডিসেম্বর ২০২১, যশোর

 

জীবন

বড্ড বাঁচতে চাই
ভীষণভাবে বাঁচতে চাই

একবার জন্ম নিয়ে
বারবার মরতে-মরতে বেঁচে যাই।

২৪ মার্চ ২০২২, সিলেট।

 

প্রতিশোধ

ক্ষমা করো অথবা করো না। আজ নয়
এমনকি কোনদিনও কাউকে শাস্তি দেয়া
আমাদের কাজ নয়। জাস্ট ইগনোর

ক্রমেই রক্তাভ হচ্ছে ভোর

আমরা শাস্তি দিলে
তা হবে অনেক কম, যা তার প্রকৃত প্রাপ্য…
…..
২৯/৯/২০২১, যশোর।

 

কাজী মাজেদ নওয়াজ


জন্ম: ৩০ ডিসেম্বর ১৯৬৯, মাগুরা জেলার দ্বারিয়াপুর গ্রামে নানাবাড়িতে। পৈত্রিক নিবাস মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার মুজদিয়া গ্রামে। দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর।
তাঁর কবিতার সুর হলো মূলত হৃদয়গ্রাহী, ইন্দ্রিয় চেতন ও কাব্যিক শব্দচয়নে উত্তাপ ছড়ানো এক স্বপ্নময় আখ্যান। আর এই নিবিড় সুরের মূর্ছনা থেকেই জেগে ওঠে তার কবিতার অনুরণন। মাজেদের কবিতা কখনও স্নিগ্ধ রাতের মতোই রহস্যময় আবার কখনও প্রকৃতই রোদ্দুরে সবুজ।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: বলো, জলদ্যুতি

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top