জঙ্গলনামা: বনবিবির জঙ্গল, থিতু সেথা মঙ্গল
নাহার তৃণা
সুন্দরবন ঘিরে আছে নানা কিংবদন্তি। বনবিবি এবং দক্ষিণরায়ের উপাখ্যান তার মধ্যে বেশি আলোচিত।
জনপ্রিয়তার দৌড়ে দক্ষিণরায়ের হালুমকে পাত্তাটি না দিয়ে বনবিবি এগিয়ে আছেন। তার নানা অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন কাহিনি। আরণ্যক সমাজের বিপদসঙ্কুল জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ওই এলাকার জনগোষ্ঠী নানা দৈবসত্তার স্মরণ করতো। তাদের সেই বিশ্বাস ও পূজার রীতি আরণ্যক সমাজের অবদান। আজও বনবিবি দক্ষিণরায়সহ অন্যান্য দৈবসত্তা সুন্দরবনের দুই অঞ্চলের মানুষের মাধ্যমে শ্রদ্ধার সাথে পূজিত হন।
ভক্তি শ্রদ্ধা অর্জনের পাশাপাশি তাদের ঘিরে রচিত হয়েছে নানা যাত্রাপালা, পাঁচালি, ছন্দকবিতা ইত্যাদি। যার মধ্যে ‘বনবিবির জহুরনামা (Bonbibir Jahuranama) বহুল পরিচিত নাম। ‘বনবিবির জহুরনামা
(Glory to Bonbibi)’ এই একই নামে দুজন পুথিকার দুটি পাঁচালিকাব্য রচনা করেন। যার একটির রচয়িতা মুহাম্মদ খাতের (Mohammad Khater)’, অন্যটির রচয়িতা মুন্সী বাহানুদ্দিন (Munshi Bayanuddin)। পয়ার ছন্দে রচিত জহুরনামা আঠার- উনিশ শতকের সাহিত্য সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত। এই কাব্য মঙ্গলকাব্যের শৈলীতে রচিত হলেও এতে আল্লাহ্-রসুল, মক্কা, পির-পিরানি ইত্যাদি প্রসঙ্গ যুক্ত হয়েছে।
সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট এলাকা জুড়ে বসবাসরত জনবসতি, বিশেষ করে সুন্দরবন ঘিরে যাদের জীবনজীবিকা, তারা বনবিবিকে পিরানি বা দেবী জ্ঞানে শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকেন। রুজি রোজগারের তাগিদে বনে ঢোকার আগে তারা বনবিবির শুভকামনা লাভের আশায় নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তার আরাধনা করেন। সে তিনি মুসলমান-হিন্দু-খ্রিস্টান যে ধর্মেরই হোন না কেন। ‘বনবিবির জহুরনামা’য় বনাঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতির সুন্দর সহাবস্হানের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট করে বর্ণিত আছে। প্রকৃতির উপর মানুষের লাগামছাড়া অনাচারে বৈশ্বিক যে ছন্দপতন ঘটে চলেছে– সতর্ক হও ধ্বংস হবে’র ওয়েক আপ কল কান পেতে শোনার জন্য আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ‘বনবিবির জহুরনামা’ পাঠের প্রয়োজনীয়তা হয়তো ফুরিয়ে যায়নি। সেই পাঠে যদি মানুষের চোখ খুলে– দাম্ভিক লোভী দক্ষিণরায় আর ধনাই-এর মতো পাকে পড়ে যদি হুশ ফিরে।
মূল ‘বনবিবির জহুরনামা’ রচনায় আরবি, ফারসি ইত্যাদি ভাষার মিশেলের কারণে বাংলাভাষী সাধারণ পাঠকের জন্য সেটা পাঠ করা হয়তো সেরকম সুখপাঠ্য নাও হতে পারে। আহা নাগালগম্য ভাষায় লোক সংস্কৃতির এই উপাখ্যান ‘বনবিবির জহুরনামা’ যদি পাঠ সম্ভব হতো! এমন একটা চাওয়া বহুদিন আগে মনে বুড়বুড়ি কেটেছিল। দিন কয়েক আগে একটা বই তারই সহজ সমাধান নিয়ে উপস্হিত হলো। যা আমার মতো পাঠকের জন্য সুখবর। বইটার নাম ‘জঙ্গলনামা (Jungl enama)’। ইংরেজি ভাষায় বনবিবির জহুরনামা কাহিনি অবলম্বনে অমিতাভ ঘোষ ‘জঙ্গলনামা’ লিখেছেন। এটিকে বনবিবির জহুরনামা’র হুবহু অনুবাদ বলা চলে না। অমিতাভ ঘোষ একে মুক্ত রূপান্তর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মূলগল্পের বর্ণনাগুলোকে খুব আক্ষরিকভাবে বয়ানের রীতি তিনি অনুসরণ করেননি। কিংবদন্তি জড়ানো বনবিবির গল্পকে তিনি নতুন ভাবে উপস্হাপনের চেষ্টা করেছেন।
জহুরনামা উপাখ্যানে বনবিবির পাশাপাশি দক্ষিণরায়, ধনা, দুখের কাহিনিগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, এখানেও সেই চরিত্রগুলোকে গুরুত্বের সাথে উপস্হাপন করা হয়েছে। মন্দ স্বভাবের দক্ষিণরায়ের
দাপটে অসহায়ের প্রার্থনার অর্ন্তগত সুরে তাই খুব একটা পার্থক্য প্রতিধ্বনিত হয় না।
“This realm was once under the sway of Dokkhin Rai;
a mighty spirit feared by all under the sky.
He preyed on humans, in a tiger avatar;
whomever he wanted he’d take for his shikar.
Under his rule all beings shivered in terror;
day after day, they looked heavenwards in prayer.
At length their entreaties crossed the Empty Quarter;
from Araby there came two beings of great power.
One was the Mistress of the Forest, Bon Bibi;
the other was her brother, Shah Jongoli.
Bon Bibi was strong, but full of compassion;
her brother was a warrior, his powers were legion.”
হারপারকলিন্স ইন্ডিয়া (HarperCollins India: publisher) প্রকাশনী থেকে ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সালে কাব্য রীতিতে লিখিত উপন্যাস ‘জঙ্গলনামা’ প্রকাশিত হয়েছে। ৮৮ পৃষ্ঠার নজরকাড়া এই বইটি পাঁচালির ধরন অক্ষুন্ন রেখে’ পয়ার ছন্দেই লিখেছেন অমিতাভ। ছন্দময় ধাঁচে লেখা জঙ্গলনামা জুড়ে আছে নজরকাড়া চিত্রায়ণ।
‘জঙ্গলনামা’তে চিত্র জুড়ে দেওয়া প্রসঙ্গে এক আলোচনায় অমিতাভ ঘোষ বলেন– “আমার মনে হয়, ‘সিরিয়াস’ সাহিত্য বড্ড বেশি শব্দ-নির্ভর হয়ে পড়েছে। এটা বেশ সাম্প্রতিক একটা ঘটনা, আগে সবসময় লিখিত আখ্যানের একটা বড় জায়গা জুড়ে থাকত আঁকা ছবি বা নকশা, সে আমাদের তালপাতার পুঁথিতে হোক, রাজস্থানের অপূর্ব ‘আলোকিত’ ভাগবত পুরাণগুলোতে হোক, বা রাজমনামা, শাহনামার মতো পারসিক লেখাগুলোতে হোক— যেখানে মিনিয়েচার ছবির প্রাচুর্য দেখা যায়। ইউরোপেও, গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো সাধারণত ‘আলোকিত’ হত, এমনকী ছাপাখানা এসে যাওয়ার পরেও, বেশ কিছু দিন। এই ‘আলোকিত’ শব্দটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে মনে হয়, ছবির উপাদানগুলো নিজেদের আলো ফেলছে লেখার ওপর। এর বদলে শুধু ‘চিত্রিত’ বললে, মনে হয়, ছবিগুলো লেখার তুলনায় কম জরুরি। সেদিক থেকে দেখলে, এ বেশ হীনতাসূচক কথা।”
জঙ্গলনামা’র ছবিগুলো এঁকেছেন সালমান তুর। পাঁচালি ধাঁচের বই সাধারণত একা পড়ে মজা নেই। আগের দিনে অনেকে জমায়েত হয়ে পুঁথি-পাঁচালির পাঠ শুনতেন। জঙ্গলনামা’ও সেই রীতিতে শ্রুতি পাঠ সম্ভব। পাঠক চাইলে বন্ধুদের আড্ডায় আবৃত্তি-পাঠ করতে পারেন। যা নিঃসন্দেহে উপভোগ্য হবে। কিংবা সেধরনের আমেজ পেতে চাইলে আলি শেঠির কণ্ঠে এর শ্রুতি বয়ান শুনে নিতে পারেন। শ্রুতি বয়ানটিও চমৎকার।
জঙ্গল নামার শ্রুতি বয়ান আলি শেঠির কণ্ঠে
সুন্দরবন ঘিরে যাদের জীবন আবর্তিত হয় তাদের কাছে বনবিবি নিছক কোনো গালগপ্পো নয়- এ থেকে তারা তাদের বিশ্বাস, নির্ভরতা খুঁজে পায়। মায়ের মতো বহুকাল ধরে আরণ্যক জনগোষ্ঠীর সেই আস্হাকে যেন সস্নেহে আঁচলে বেঁধে রেখেছেন বনবিবি- বনদুর্গা। অমিতাভ ঘোষ তাঁর জঙ্গলনামায় সে কাহিনিই তুলে ধরেছে প্রাঞ্জল ভাষায়। যে ভাষা হয়ত আমার-আপনার মাতৃভাষা নয়। কিন্তু ভিনদেশে বসবাসকারী আমাদের আগামী প্রজন্মের ছেলে মেয়ে, যারা বাংলা ভাষাটা বলতে জানলেও পঠনপাঠনের বেলায় ত্রাহি মধুসূদন। ‘জঙ্গলনামা’ যেহেতু ইংরেজি ভাষার বই, কাজেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢঙে বাংলা বলিয়ে বর্তমান প্রজন্ম ‘বাঙাল আমি ফরতাম পারিনা’ বলে সটকে পড়বার চ্যান্স নেই একদম। এদের মধ্যে যারা জঙ্গলনামা পড়বার উপযুক্ত, তাদের জন্যে ‘জঙ্গলনামা’ হতে পারে বাংলার লোক সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার ছোট্ট এক জানালা।
নাহার তৃণা
জন্ম ২ আগস্ট ঢাকায়। বর্তমানে আমেরিকার ইলিনয়ে বসবাস। ২০০৮ সালে লেখালেখির জগতে প্রবেশ। দুই বাংলার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা এবং ওয়েবজিনে লিখছেন গল্প, প্রবন্ধ, গল্প, অনুবাদ, সাহিত্য সমালোচনা। একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০-এ পেন্সিল পাবলিকেশনস প্রতিভা অন্বেষণে তার ‘স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট’ সেরা গল্পগ্রন্থ নির্বাচিত হয়। একইবছর অন্বয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় ‘এক ডজন ভিনদেশী গল্প’। নাহার তৃণার প্রকাশিত বই দুটি এখন বইয়ের হাট প্রকাশনায় অ্যামাজন কিন্ডেলেও পাওয়া যাচ্ছে।