১. ঘাতক শহর
কিছুই নিরাপদ নয় গা-গতরে বেড়ে ওঠা ঘাতক শহরের হাতে।
আমি, গ্রাম, বৃক্ষ, ঘাস, নিরেট অন্ধকার, জোৎস্নার আলো,
জোনাকীর কারুকাজ, অলস দুপুর, কিছুই নিরাপদ নয়
ঘাতকের হাতে।
এখানে ক’দিন আগে কাশবন ছিলো, কেউ কি জেনেছে কখনো?
পৃথিবীর বয়সী সে বন হেরে গেছে কংক্রিটের জঙ্গলের কাছে।
দালানগুলোর ফ্রেমে বাঁধা জানালায় পুতুলের মত মানুষের মুখ
পাখির চোখে দেখে শহুরে পৃথিবীকে।
গা-গতরে বাড়ন্ত এই ঘাতক শহর পায়ে পায়ে মাড়িয়ে যায়
আমাদের সবকিছু মাটির নগণ্য কীটপতঙ্গের মত।
(ঢাকা শহরের উত্তরা ১৫-১৬-১৭-১৮ নাম্বার সেক্টরগুলোতে একসময় মাইলের পর মাইল বিস্তৃত কাশবন ছিল। সেই কাশবন ধ্বংস করে এখন তৈরি হচ্ছে একের পর এক দশ/পনের তলা বিল্ডিং। আজ থেকে প্রায় চার শ’ বছর আগে পর্তুগীজরা যখন তেজগাঁওতে তাদের আড়ং ও গির্জা তৈরী করে তখন তেজগাঁও ও এখন পুরান ঢাকা নাম পরিচিত সে সময়ের ঢাকা শহরের মাঝে গভীর বন ছিল, সে বনে বাঘ থাকতো। চল্লিশ বছর আগেও জয়দেবপুর চৌরাস্তার পর থেকেই শুরু হতো শালবন। এখন সে বন গাজীপুর চৌরাস্তা থেকেও দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে।)
২. কলোনির বিল্ডিংগুলো
বেশ ক’টা শ্বেতকায় ছ’তলা বিল্ডিং – কোন কর্পোরেশনের হবে,
ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি, কাছাকাছি ধুসর আকাশের নিচে।
কোন কিছুই ছোঁয় না ওদের। তপ্ত রোদে নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে;
মুশুল বৃষ্টিতে জবুথবু হয়ে ভেজে ইট-পাথরে গড়া নিরেট শরীর।
পুর্ণিমা চাঁদের জোস্না ওদের দেয়াল বেয়ে চুয়ে চুয়ে পড়ে।
শহুরে গোত্রহীন ক্ষণিক হাওয়া খোলা জানালার গ্রিল গলিয়ে
ফ্লাটগুলোর অপুষ্ট বুকে ঢুকে পড়ে অনাহুত, যখন তখন।
কারা এসেছিল, ক’টা বছর কাটিয়ে গেলো বুকের ভেতর
সুখ-দুঃখ মেশানো সময়; বিবর্ণ সামনের বস্তিটা উচ্ছেদ হলো
অবুজ বুলডোজারের ধাতব পায়ে; বিরান ভূমিতে মাটির
হাড়িতে এখনো ফুটছে চাল।
কোন কিছুই ছোঁয় না ওদের। ওরা কেবল ধুসর আকাশের নিচে
নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে পাশাপশি ইট-পাথরে গড়া নিরেট শরীর।
৩. ঢাকা – চিটাগাং হাইওয়ে
কালো নদীর মত বহমান ঢাকা-চিটাগং হাইওয়ে।
ঢেউহীন ওর বুকে ছুটে চলে অন্তহীন গাড়ীর মিছিল।
পিছন থেকে এক অদৃশ্য দানব দন্ত-নখরের ভয় দেখিয়ে
তাঁড়িয়ে নিয়ে চলে ওদের দূরের ঠিকানায়।
হাইওয়ের দু’পাশে চঞ্চলতা, মানুষের কর্মব্যস্ত ছুটোছুটি।
এপাশে ওপাশে সাপ্তাহিক হাট বসে; গুচ্ছ গুচ্ছ দোকানের সাঁড়ি।
টং-ঘরে চলে চায়ের আয়োজন; ত্রস্ত হাতে পান করে চা
মিশে যায় মানুষগুলো চেনা, অচেনা মানুষের ভীড়ে।
সন্ধ্যা এলে, সূর্য গেলে পাটে হেডলাইটের জোরালো আলো
ক্ষণে ক্ষণে তাঁড়িয়ে দেয় দূরে ওর কালো বুক থেকে
অন্ধকারের নেকাব পড়া মায়াবী রাতের প্রহর।
হাইওয়ের নিকষ কালো দেহ শীতে কুঁকড়ে থাকে,
গ্রীষ্মে উত্তপ্ত হয়, বৃষ্টিতে ভেজে আশ্রয়হীনার মত।
শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই, বর্ষা নেই, নেই দিন, নেই রাত,
শশব্যস্ত ঢাকা-চিটাগং হাইওয়ে বয়ে চলে অন্তহীন
কালো এক নদীর মত।
ফারুক হাসান
লেখক-গবেষক ফারুক হাসানের লেখা ও গবেষণার বিষয় বিচিত্র কিন্তু বিজ্ঞানমনষ্ক সমাজ গঠনে তা অবিস্মরণীয়। তিনি একদিকে লেখেন দক্ষিণ এশিয়ার নিউক্লিয়ার প্রোলিফারেশন সম্পর্কে অন্যদিকে লেখেন সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে। লিখেছেন চিত্রকলা ও ভাস্কর্য নিয়ে। ঢাকার চারশ’ বছরের ইতিহাস উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বোঝার জন্যে এর দশ হাজার বছরের প্টভূমিকেও সামনে এনেছেন তিনি। এ পর্যন্ত তিনি এরকম ১৭ টি গ্রন্থ লিখে মানুষের মননের উন্মেষ ঘটানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থের নাম ‘বাঙালির ধর্মবিশ্বাসে বিবর্তন প্রধান ধর্মসমূহে ঐক্য অনৈক্য’।
বর্তমানে তিনি কক্সবাজারকে আগামীদিনের একটি চমৎকার পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞে একজন অভিজ্ঞ পরামর্শক হিসেবে কাজ করে চলেছেন। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থিত VUB বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে স্নাতক পাশ করার আবার সেখান থেকেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল লোকেশান ও ডেভেলপমেন্টে স্নাতক করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশ ঘুরতে পছন্দ করেন।