এক.
সমাধি সমান্তরাল হেঁটে যাই
সবটুকু আয়োজন কি নিজেকে নিয়ে
বৃত্তাবদ্ধ জমানার পাখি
এখানে এসেছে যে তাকে
কী করে বেঁধে রাখি, ভুলে থাকি বলো !
আজব গল্প শেষে
ধ্যানমঞ্চ থেকে নেমে আসে
একটু বাড়তি যত্নের আশায়
ঘুরেছিল পথে
সে কেমন উগড়ে দিলো
মৃত্তিকা পাহাড়, বারবার
সমাধি ভ্রমণ শেষে ফিরে আসে
সমাধিই আবার
দুই.
সমাধির কাছে গিয়ে কী লাভ
মৃত মানুষ তো ফিরে আসে না !
ভালোবাসা মাটি হয়ে মিশে গেছে
মৃতের ফসিল, জেগে না ঘুমিয়ে
কিছুই জানি না !
না জেনেও ফিরে আসি তার কাছে
সমাধি আইল ধরে হাঁটি আর ভাবি─
কী লাভ ! কী লাভ ! তাও তো আসি
দুপুরের তীব্র রোদ মলিন হয়ে এলে
শুরু হয় সমাধি ভ্রমণ, একাকী বিজন
নির্জন, হুহু বাতাস, প্রাচীন গন্ধ মাতন
জড়িয়ে কুঁকিয়ে ওঠে, তাও তো ডাকে
সেখানে কেন যে ভালো লাগে জানি না !
লোকাস্ট, মেপেল, পাইনের ছায়ায় পরস্পর
কাছাকাছি থাকি, এপিটাফে লেখা আছে
আফ্রিকান দম্পতির নাম, তার পাশে
সিংহল সমুদ্র বেয়ে আসা অভিবাসী
কারও কারও নামের সাথে ছবি
ভালো করে চেয়ে দেখি তাদের চোখে
অন্য এক মহাদেশ এখনো জেগে আছে
ফেলে আসা অন্য নামে পরিচয় ভাঙে
এখানে নিবিড় হয়ে ঘুমানোর আগে
আবারও কি মনে পড়ে সিলনের আকাশ !
তিন.
এই কঠিন নিদাঘ দুপুরে কিছু পাখি
সমাধিতেও আসে। ঘুরে মরে আকাশের ঘাটে
সমস্ত আগুনের উপবাস শেষে গ্রহণ করে তারা
স্মৃতির আহার। আমাকেও সঙ্গে রাখে, একত্রে খাই
পাথরের থালায় সাজাই নৈঃশব্দ্যের তুমুলতা
মাখন গড়ন কিছু উড়ু উড়ু তাপ
এখানে এসেছি দেখে ভালোলাগা ভালোবাসা
কেঁপে কেঁপে ওঠে, তার কোনো নাম নেই
পাখিদের জিজ্ঞেস করি, বলতো কেন আসি
কী এর নাম !
পাখি কেবল পাখা মেলে উড়ে উড়ে ঘুরে
বিরান বিষণ্ন এক চক্রাকার ঠোঁটে
বলে ওঠে, নাই নাই নাই ওরে কিছু নাই
পাবার আশায় ফিরে-আসা চিরকাল ডাকবেই
তবু
নাই নাই অবিশ্রাম ধুলো ওড়ায়
আমি দেখি
আমার ও সমাধির মিলিত যোগাসনে
নন্দন সভা বসেছে প্রকৃতির দেহ-অন্তরে
আলপনা চাদর গুটায় খুব ধীরে
সমাধি ভ্রামণিক একা খুঁজে বেড়াই
কতদূর চলে গেছে এই ছবি
আফ্রিকা, এশিয়ার বুকের ভিতর হাত দিলে
শুনতেও পারো কি সেই ধুক ধুক ধ্বনি
চার.
এইসব দূরদেশ, মাঝে মাঝে অসহ্য আত্মবিস্মরণ
মনে করি তাহার স্মরণ, ভুলে যাওয়া দিনলিপি
মুছে যাওয়া তারিখ বছরের পর বছর
খোঁটা দিয়ে বলে─ এই কি তোমার স্মরণ !
পশ্চিমে সূর্যোদয়, পুবের সূর্যাস্ত
নিভু নিভু বাতাসের মৃদু আলাপন
কতদিন ও রাত্রির আলোছায়ায় এঁকে গেছে
শিলালিপি ছবি
তবু মনে পড়ার এ-কোন প্রস্তুতি, এ-কোন যাত্রা !
মাদল বাজিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে খুব একান্ত সমাধি
অবিশ্বাসী নিশ্বাসের ঘড়ি ঢং ঢং বাজে
চমকে ফিরে তাকাই, ঘনঘোর বিজনতা
আমাকে বিশ্বাস করো, আমি জানি─
তারও চেয়ে দামী এই প্রকৃতি যাপন এবং
কালোরং পোশাকের মন্ত্র-উচ্চারণ
পাখিদের নিয়মিত খুদ দেই
পাখিরা এসে বসে, নিমেষের গল্প করি
ওরা এই সমাধির ইতিহাস জানে
কারা যায়, কারা আসে
কত কেউ একান্ত নির্জন অশ্রু সজল চোখে
বাইবেল থেকে বিদায়ের স্তোত্র পাঠ করে
বিবর্ণ স্বরে, বলে─
ভালো থেকো, ভালো থেকো হে আত্মার সাথি
উড়ে যাচ্ছ বহুদূরে, নিয়ে যাচ্ছ ঘুমন্ত মন্ত্রণা
শরবিদ্ধ কলিজার হাসি, তবু ভালো থেকো তুমি
সমাধি ভ্রমণ করি পাখি ও তাহাদেরই সাথে
পাঁচ.
যে তোমাকে মনে করে মেখেছে আলোর রেণু
তাকে দেখতে আসো না কেন? কেন ঘুম
এখানে প্রবল করে রাখে, আর তারা থেকে থেকে
হৃৎপিণ্ডের ধুক-ধুক একাগ্র ধ্বনি শুনে
মন্ত্রের মতো ধ্যানস্থ লেগে থাকে পোশাকের ভিতর
দিন শেষ একটানা বিচ্ছিন্ন অনুরোধ─
ভুলে যেও না আমাকে !
কে যে কাঁদে !
হেঁটে হেঁটে খুঁজে ফিরি, পাখিদের বাসা দূরে ভাসে
মেপেলের দিনে নরম স্পর্শ নিয়ে এসেছে যে কাছে
বিভ্রম আনন্দে তার জল-জীবন কাঁপে
ও আমার সমাধি ভ্রমণ, দুপুর এবং একান্ত আবৃত্তি
তোমার এপিটাফে এক এক করে গান গায়
চিরকালের সেই পাখি
যার আত্মা ঘুরে ফেরে মৃতের নগরে
দেহ রাখে ভ্রমণের দিনলিপি লিখে
রেখে আসে নিঃশব্দে একান্ত টানে
যে সমাধি ভেসে গেছে এপিটাফ প্লাবনে
সেখানে আরেকজন্মে দেখা হবে ক্লাব বা সমিতি গ্রহণে
এই ঘাসের নিচে মাটির আলিঙ্গন, হেঁটে হেঁটে কথা বলে
যেতে যেতে মাঝে মাঝে ঊর্ধ্বশ্বাস পেরিস্কোপ মুডে
দৈব যোগাযোগের প্রো্পেলার ঘুরে ওঠে
সহসাই মনে হয়─
রেশমীর সমাধিতে আজও যাওয়া হলো না তবে !
ছয়.
সমাধির নির্জনতা বারবার জানিয়ে দিয়ে যায়─
এখানেও জমা আছে জীবনের গল্পগুচ্ছ, কাশফুল নম্রতায়
ফালি ফালি ঝরে পড়া আয়ুকালের আলো
তাহাদের মিলিত কোরাস নৈঃশব্দ্যের দেশ থেকে
খুঁজে খুঁজে পরিয়ে দিয়ে যায় ফুল
রোদের দুপুরে মাঝে মাঝে চলে যাই তাদের কাছে
গল্প হয় খুব
গল্পেরা চতুষ্কোণ, গল্পেরা গনগন, মসৃণ বাতাসের লীলা
মৃত্তিকার কণা থেকে গান গায়, সৃষ্টি করে
এই যে আকাশ বাড়ি তা থেকে আড়াআড়ি
দুরবিন ডাকে, পাখি এসে বসে টেলিস্কোপের বাহুতে
রাতজাগা চোখেরা ঘুমদেশে পাহারায় ঝুঁকে থাকে
সমাধি জল-তরঙ্গে ঘুরে বাড়ায় যে, পাগল ডাকে তারে
কব্জির হাত ধরে এক একটি নিবন্ধন, ঝরে পড়া স্বাদ
ও দুরবিন
ও আলো
ও সমাধি
সকলে আছো তো ভালো !
না জানি কিসের তাপে ফুটে ওঠে ঘ্রাণ মাখা মুখ
বিজন জলকাটা আলো-হাত মুঠো করা
ধুম-রোদ, ঝুম-বৃষ্টি আজন্ম করাঘাত অঝর
…
ফেরদৌস নাহার
ফেরদৌস নাহারের জন্ম, বেড়ে ওঠা সবই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে। নেশা, দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো ও বইপড়া।
ফেরদৌস নাহার বাংলা ভাষার একজন শক্তিমান কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগীত রচয়িতা। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা: ১৫টি কবিতা ও ৩টি প্রবন্ধের বই। তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে একটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে অসংখ্য যৌথ কবিতা সংকলন। বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের দল ‘মাইলস’-এর অনেকগুলো জনপ্রিয় গানের রচয়িতা তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও কানাডা থেকে কম্পিউটার ট্রেনিং প্রোগ্রাম কোর্স করেছেন তিনি। কবিতার পাশাপাশি ছবি আঁকেন, গান লেখেন, ব্লগিং করেন, কফিশপে ধোঁয়া আর ঘ্রাণে আড্ডার ঝড় তোলেন। কিন্তু সবকিছুর উপরে এক বিশ্ব বোহেময়ান কবি আর চির তারুণ্যের নাম ফেরদৌস নাহার। মন চাইলে বেরিয়ে যান। ঘুরে বেড়ান খেয়াল-খুশি মতো, যাকে তিনি ‘ঘুরণ’ বলেন। ভালোবাসেন প্রকৃতি ও মানুষ। পথের নেশা তাকে করেছে ঘরছাড়া, ঘুরতে ঘুরতে এখন আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে, কানাডায়। সেখানে জীবন যাপনের পাশাপাশি জীবন উৎযাপন করেন কবিতা এবং লেখালিখির খরস্রোতা নদীতে বৈঠা বেয়ে। ইমেইল : [email protected]
বুকের ভিতর এক বিদর্ভ নগর
স্তুপ স্তুপ স্মৃতি জেগে ওঠে মধ্যরাতে
জেগে ওঠে মেঘ-সূর্য সখ্যের বরাতে
সেইখানে কাটা ঘুড্ডি অতীত
তুফান হাওয়ায় উন্মাতাল নাচে
অমন লহরীতে যেন এই কবিতা জুড়ে
অতীত খেলা করে