আমার ছেলেবেলা
ভাসানের চেনা প্রতিমায় ডুবে গেলে পঞ্চমির চাঁদ
রাস-পূর্ণিমার ঠাণ্ডা নেমে আসে প্রতিবেশি ছাদে;
কলমির ফুল ফোটে সুচিত্রা যুগের নায়িকার মতো
ছাদ বাগানের টবে।
পরিযায়ি পাখিরা আসে, সার্কাসের মেয়ে হয়ে
হাত ছেড়ে উড়াল দেখায়,
ডিগবাজি দেয়—
ঝাঁপ দিয়ে নামে সুপারম্যান সেজে
নর্তকীর নাচে মেতে ওঠে;
উঠোনের ধানে ভরে যায় কৃষানির গায়ে
নেপথোলিনের গন্ধ,
ঠাকুমার রান্না করা আগুনে খলসে মাছ ছটফট
করতে করতে পুঁথিপাঠ জমে ওঠে, নবান্নের মেলায় বসে
আমার ছেলেবেলা— খেলা করে।
শরত পোষাক বুনছি শিশিরে—
ভেবেছ সবুজ হবে? সম্মুখে ফসল কাটা গ্রাম;
তোমার শরীর জুড়ে শরত পোষাক বুনছি শিশিরে—
উলের কাঁটায় ফোড় তুলে নি:শ্বাস হারালে…
একাকি দাঁড়িয়ে থাকে লাল শান্ত জামরুল গাছ।
তুমি জান?
পোকারা রৌদ্রের গায়ে রান্না করে গরম খাবার;
শস্যেরা উত্তাপ খেয়ে গর্জে ওঠে…
হেমন্তের খড় !
আমি জানি, সেই আগুনের ব্যুহে জ্বলজ্বল করে,
বাঘের মুখোশ পরা—শীতের সকাল…!
একরাত্রি অন্ধকার ছিল
দুপায়ের পাশে আরও পড়ে আছে বহু পায়ের মিছিল—
পথের ধুলোয় আমি অজন্তার পরাজিত মুখ দেখি:
একরাাত্র অন্ধকার ছিল,
আলো ও আঁধার পরষ্পর বন্ধুত্বের একটাই গ্রাম ছিল—
তুমি ছিলে, কীর্তনখোলার পাড়;
ঝাউয়ের সারি…হোগলার বন—
এবারো ঠাণ্ডায় তুমি শীত হয়ে এলে,
রাশি রাশি অনুভবে পরিযায়ি দূর্গাসাগরের পাখি—
মিশ্রণে হারালে, যতোবার মানুষের
ভিড়ে ডুবে যাও;
ততোবার ভেসে উঠি আমি… নদীর ওপাড়,
বালুজলের ঘূর্ণিতে, পাস্তুরিত হতে হতে বহুবার
গাভীর ওলানে চুর হয়ে মিশে আছি দুধে;
অথচ তোমায় দেখি, পাট ভেজানো পচন জলের গাজলায়
মিশে আছ বুদবুদে।
সোমা বস্ত্রালয়ে
বাগানবিলাস ফুটলে ঈর্ষায় গুঞ্জরিত হত মনখারাপ;
প্রজাপতি রঙিন স্কার্ফ পরে ফুলের সৌরভে ভরে যেতো
পাড়ায় পাড়ায় দিদিদের বাগান।
একঝাঁক বন্ধু ছিলো—
বেদনার কবুতর ওড়াতে জানতো।
একঝাঁক শত্রু ছিলো—
ভালোবাসা রঙের সবুজ ছড়িয়ে ছবি আঁকত ভ্যানগ্যঁগ…
ঘুঙুর পরালে রবীন্দ্র জয়ন্তী নেচে উঠতো
ক্ষেতের ধানের নবান্ন উৎসব,
টি-শার্টের মতো পাল্টে ফেলছে এখন সোমা বস্ত্রালয়ে সব
গরম কাপড়।
চোলাইয়ের ঝাঁজ…
বুড়ো লোকটি ফুলকপি নিয়ে বাড়ি ফিরছে ফুটপাতে ভাপাপিঠার উষ্ণতা ছড়াচ্ছে কিছু লাউয়ের ডগা লকলক করে সাঁতার কাটছে লেকের দুইপারে কুকুরের আনাগোনা প্রস্রাব পঁচা দুর্গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছে এখনি শীতের সন্ধে নেমে আসবে লোকাল বাসের যাত্রিরা আবার ফিরে যাবে—কাছেই তো চৌমাথা বাজার বসে জিয়ল মাছের হাটবার আজ ঝর্ণালালের চোলাইয়ের ঝাঁজ…।
এখানে রড়রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে কেঁঁপে ওঠে পায়ের গোড়ালি সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক যাচ্ছে ত্রিশগোডাউনের দিকে কীর্তনখোলা নদীর কাছে বধ্যভূমি সেখানেই সৌধের সিঁড়িতে বসে এডাল্ট চেলেমেয়েরা চুমো খাচ্ছে যেরকম চানাচুর বিক্রেতা হাঁঁক দিয়ে যাচ্ছে : —এইইই…ঘডিইইই…গরমমম…
…
হেনরী স্বপন
হেনরী স্বপনের জন্ম কবি জীবনানন্দ দাশের বরিশালে, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারী । বরিশাল বিভাগের অন্যতম পত্রিকা দৈনিক মতবাদের যুগ্ম-সম্পাক হিসেবে কাজ করছেন। অবসরে পড়া, লেখালেখি নিয়ে সময় কাটে। স্ত্রী: মারিয়া লাকী সরকার এবং একমাত্র কন্যা আমেরিকা প্রবাসী কসটিকা চিনতী এবং তার বর, নাতি-নাতনী এই তার সংসার।
প্রকাশিত গ্রন্থ: কীর্তনখোলা (একফর্মা ১৯৯৪); মাটির বুকেও রৌদ্রজ্বলে (একফর্মা ১৯৯৪); বাল্যকাল ও মোমের শরীরে আগুন (দুইফর্মা ১৯৯৮); জংধরা ধুলি (২০০১); কাস্তে শানানো মোজার্ট (২০০৪); ঘটনার পোড়ামাংস (২০০৯); হননের আয়ু (২০১১); উড়াইলা গোপন পরশে (১৪১৮); শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১৫); মৃত মনিয়ার মতো (২০১৮); আলপথ দূরে (১৮২৬ ত্রিপুরা); অম্লজান (২০২২)।
গদ্য সংকলন: ছোটকাগজের ক্রান্তিকাল ও অন্যান্য
লিটেলম্যাগ: জীবনানন্দ কবিতাপত্রের সম্পাদনা এখন অনিয়মিত !
হেনরী স্বপনের কবিতায় ভিন্ন স্বর। নির্মাণশৈলী সম্পূর্ণ আলাদা। কবিতায় পাই আমাদের ভূখণ্ডের ঘ্রাণ। এক কথায় অসাধারণ। কবির জন্য শুভকামনা রইলো।