চক্রব্যূহ
যতোটা পাহাড় থেকে দূরে সরে যাই ততো বহু বছরের জমে থাকা বরফের শীর্ষে মমতা-পাথর নড়ে ওঠে। দুর্গাসাগরের মতো আমার নিজস্ব কোনো দীঘি নাই তথাপি কখনো পাতা পতনের শব্দে চমকিত হতে ভালো লাগে—
মনে মনে আমি এক অভিমন্যু অশোকের ছায়া
দুঃস্বপ্নে দুর্গের যতো কাছে আসি
শুনি ভেতরে অসংখ্য শঙ্খ-ধ্বনি, রণবাদ্য—
আসঙ্গের-হ্রেষা পিছে ফেলে চলে যেতে থাকি
কোথায় মৃগয়া
চক্রব্যূহ ছিন্ন করে ছুটে যায় তৃষ্ণার্ত যুদ্ধের ঘোড়া
ঘাম
রোদফুল
ফুটে থাকো রন্ধ্রে ও নিলয়ে
ফুটে থাকো ক্লান্ত কিশোরের ত্বকে
রোদের উৎসবে
নুনসাগরের জলে ভাসমান তুমি রুদ্রাক্ষের পুতি
ধমনীর ভিত ছুঁয়ে অনাদি ভ্রমণ
ভেতরে উল্লাসধ্বনি
ভেতরে ভাঙচুর
অবিরাম ভাঙনের স্রোত নিয়ে নিরন্তর বয়ে চলে রক্তের জলধি—
আর তুমি প্রস্বেদনে পরিশ্রুত করে দিয়ে মানবজমিন
রক্তদানা থেকে শুষে নিয়ে বিষবালি
নীরক্তের শীর্ষে বসে আছো মেঘবিরহের মালী
ভাইফোঁটা
আবার আসবো কিনা ভেবে দেখা যাক। কতোদূরে যাওয়া তবে সংশয়-ফাৎনা ফেলে রেখে দ্বিধাহীন এই আসমুদ্র দোলাচলে
দোলপূর্ণিমার রাতে চুপিসারে ফোটে যে দোলনচাঁপা তার আরতি কতোটা আকুল শুকনো পাতা ঝরে পরবার আগে লিখে রাখে তা। কোথাও ময়ূর ডাকে সহসা বৃষ্টির ছাটে বাদামের ডালে লুকিয়ে থাকা ফিঙের বাঁকানো লেজে কতোটা জল চুইয়ে চুইয়ে পড়ে এই দৃশ্যে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুটি বৃক্ষের কোনো অভিযোগ নেই
বেদুঈন মাছি কেবল পরিহাসপ্রিয়। শীতঋতু চলে গেছে কতোদিন দেখা নাই তার সাথে। হলুদ শস্যের ক্ষেতে এলিয়ে পড়া ঢেউ তবে কার প্রতীক্ষা করে?
খড়কুটো নয় ভাইফোঁটা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে আসে কোন্ পাখি?
সাঁতার জানে না নদী
পলাতক পাখি পালকে কুয়াশা ভরে নিলে
উড়ে যায় দিগন্তের চিল
নিশিস্রোতে ভেসে যায় দীর্ঘ সব মাতাল দেবদারু
দূর বনগ্রামে বনময়ূরের ডাকে জমা হয় মেঘ
প্রতিটি বৃষ্টির পর পরিত্যক্ত জলে
পিঁপড়ের আশ্রম ভেঙে গেলে গাঢ় হয় রাত
জল ডাকা রাতে সাঁতার জানে না নদী
শুধু ঘাসফুল জানে
চোখের ভিতর বরফ-বাঁধা শীত, তুমি তাকে বলো বাকুরার পথে যেতে— তুমি আসবা কি আসবা না ভেবে পানসি দেখো নিভে যায় জলে
কেউ নদী লিখতে গিয়ে ভুল করে একেঁ ফেলে ঘাসফুল
মৃদু টঙ্কারে ছলকে পড়ে আঁখি, কেউ একজন দূরে থাকুক মমতায়— বুঝে নিক অথবা না বুঝুক
শুধু ঘাসফুল জানে কে ভালোবাসে
কে তারে ভলোবাসে না…
ভ্রামণিক
বনের ভেতর এসে
কুঠার হারালে
কাঠঠোকরাদের কোনো বিস্ময় থাকে না
শুধু কাঠুরের শোকে বিহ্বল ছাতিম গাছ
তার শাদা পাতা দ্বিধায় জড়ানো
তার পুরোনো বাকলে ছত্রাক ছড়ানো ফেলে দেয়া আধখাওয়া ফল
তাতে জমে থাকা শিশিরের ফোঁটা
ভোরের কিঞ্চিৎ আলো তুলে নিয়ে
ধীরে ধীরে আরো বেশী লাল হতে থাকে
কিছু উষ্ণ হলে দিন
সকালের রোদ থেকে ফিরে যায় পাখি
ভাবি কে তবে নির্দয়া পাললিক
ফুঁসে ওঠা জল অগ্নি
অরণ্য না পাথরের গুহা,
অশ্বত্থের চারা যেভাবে গোপনে বেড়ে ওঠে
দালানের ফাঁকে,
তার বেড়ে ওঠার আকুতি নিয়ে
বহুদূরে
এক শতবর্ষী বটবৃক্ষ মমতায় বায়ুমূল মেলে দেয়
তার ফুলের বোটায় একা এক প্রজাপতি বসে
আধপাকা ফল ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যায় পাখি
ভ্রমণের কাঙ্খা নিয়ে যারা আসে
এই নিখিলের বনে
তারা সকলে অলখে তুলে নেয়
সংশয়-পালক
সঠিক অশ্বের মাপে
বনের ভেতরে অদৃশ্যে মায়াবী কিছু আস্তাবল থাকে
ঘোররাতে বুড়ো ঘোড়াদের জলপানের শব্দ শোনা যায়
অবিরল জলপতনের শব্দে ঘুম ভাঙে যাজকের
বনের গহীনে কোথাও প্রপাত আছে
ঝর্ণা পাথরের গান শুনে শুনে
অন্য কোনো সিসিফাস
কাঁধে তুলে নেয় অলঙ্ঘ্য পাথর
দীর্ঘ তৃষ্ণা বহুদিন
ডানা নেই কোনো
লেজ নেই দীর্ঘ মাছেদের মতো—
তবু উঠে যেতে হবে আদিষ্ট পাহাড়ে
অর্ধেক উন্মাদ বেবুনের চিৎকার থেমে গেলে
ভোর হয় বনে,
লতাগুল্মে কুয়াশার ছাপ ফেলে
পাতার মর্মর ছেড়ে
পাখিদের হলাহল ছেড়ে
অর্ধেক উন্মাদ বেবুনের চিৎকার থেকে
যতোটা সংশয় ফিরে আসে
তা থেকে নির্জনে তৈরী হয় মায়ার সংসার
বনের দুপাশে কম্প্রনদী—
ঢেউ পেরোতে পেরোতে স্বপ্নচারী লোকটি
কখনোবা কলমিফুলের ডাকনাম ভুলে যায়
কোথাও কি ফুটে আছে
থৈ থৈ জলের গম্বুজ
জল নেমে গেলে
অগভীর জলে ফুটে থাকা শাপলার ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে
কাঠুরের নাও ভেসে যায়…
নীল ভাঁটফুল
উপেক্ষা-মিনারে ফোটে
নীল ভাঁটফুল
হলুদ সন্ধ্যার পাশে
তোমাকে দেখেছি বহুদিন হলো
তুমুল বৃষ্টির ছাঁটে খোঁপা খুলে গেলে
হাতে রেখে দিয়ো একটা বকুল
একটি জলের রেখা ধরে দেখো
নেমে যাবে আয়ু
যশোর-কার্নিভাল
আপনাকে ভাবি যখন সায়াহ্নে লুপ্ত হয় সব ধুলিঘ্রাণ!
দড়াটানা মোড়ে দাঁড়ালে টাউন হল থেকে সব রাস্তা ধূসর মনে হয়।
দূরে মায়া কার্নিভাল, আরো দূরে শেষ ট্রেনের হুইসেল থেমে গেলে আপনার চোখ হেমন্তে বৃষ্টির ফোঁটার মতো অসামান্য দ্যুতি নিয়ে আসে।
মায়াকার্নিভাল থেকে ফিরে যে সংলাপ মনে পড়ে তার চেয়ে উজ্জ্বল সেই মুখচ্ছবি।
ভাবি চাবুক ও তিলকের মাঝে যে ভাষা থেকে যায় তার থেকে কোনো পরিত্রাণ হবে না…
তামসিক
বৃষ্টি হোক জমকালো,
পাথরে ঘর্ষণে কোথাও বিদ্যুৎ চমকালো।
সাদা মেঘ সরে যায়
হরিণনাভির থেকে ফিরে আসে ঘ্রাণ।
ছিলে ময়ূরের বেশে ছদ্ম পাখিদের পরিত্রাণ
মৃন্ময়ী এ কোন বৃক্ষের সন্তান।
তামসিক
ঝরে পড়া পাতার অধিক
এই হিমনিশি। পাখিদের গ্রামে
কতিপয় মেঘ কিংবা পাহাড়ের নামে
দেখো ফুল ফুটলো দূরে
ধূসর রাত্রির অগোচরে…
বিষফুল
পাতা উল্টানোর পরে
অটোগ্রাফ দেয়ার স্মৃতি ধূসর হয়ে আসে।
দূরে নীল দিগন্তে একেলা শঙ্খচিল আর সায়াহ্নে ভাসমান মেঘপুঞ্জ— যেন রক্তবিম্ব থেকে বের হয়ে আসা নীল প্রজাপতি। যদিও উড়ে যাওয়া মেঘের কাছে পাখিদের কোন গান জমা থাকে না
জলের তরঙ্গে দেখো পড়ে থাকে রাত কারো ঘুমহীন হাত…
পলক ফেলা প্রথম দৃষ্টির কাছে
উদাসীন এই মেঘ
শিথিল স্পর্শের লোভে বাষ্পীভূত হবে ধীরে ধীরে…
কোথাও একটা বিষফুল ভুলে ফুটে থাকে সায়াহ্নে
কবি হোসেন দেলওয়ার
মূলত কবি। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন ‘কবিতাপত্র’ নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা। সম্প্রতি নতুন উদ্যোগে নতুন যাত্রা শুরু করেছেন ‘দূরের সাইকেল’ সাথে নিয়ে। কবিজীবনের নানা ছেদ-বিচ্ছেদ সমেত তিনি নতজানু শিল্পের কাছেই। এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে তার চারটি কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে নীল ভাটফুল।