ব্যবহৃতা : যাপনের অন্ধকারগুলিকে জানা

শাহনাজ নাসরীন

২০১১ এর ফেব্রুয়ারিতে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল আনোয়ারা সৈয়দ হকের উপন্যাস ’ব্যবহৃতা’। স্টল থেকে লেখকের শুভেচ্ছাবাণীসহ বইটি কিনি প্রবল কৌতুহল নিয়ে। নাম থেকেই যেন চরিত্রগুলো ভেসে আসছিল চোখের সামনে। কত কত সমার্থক শব্দ ব্যবহার হয় তাদের পরিচয় দিতেÑ বারবনিতা, বারাঙ্গণা, দেহপোজীবীনি, দেহপসারিনী, রূপজীবী, পতিতা আর সবচেয়ে ব্যবহৃত একেবারে মাটি থেকে উঠে আসা অভিধা বেশ্যা। ভদ্রসমাজ তাদেরকে শ্রমিকের মর্যাদা দিতে গিয়ে যৌনকর্মী নাম দিয়েছে। এবার তার সাথে যোগ হলো ব্যবহৃতা। একি ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক প্রশ্ন জাগে মনে। শব্দের নাকি পাপ পূণ্য নেই তবু কেন জানি মন খারাপ হলো।

পাতা উল্টাতেই ছোট করে লেখকের মন্তব্য, “ব্যবহৃতা মূলত একটি সমীক্ষা উপন্যাস”। স্বীকার করছি সমীক্ষা উপন্যাস শব্দবন্ধটি দিয়ে গবেষণাধর্মী কিছু মনে হলেও উপন্যাস হিসেবে এর ধরণটি কেমন বুঝিনি ঠিকঠাক। তাই কৌতুহল আরো বাড়ে, বই পড়ার তাড়াও বাড়ে।

আনোয়ারা সৈয়দ হকের গল্প, উপন্যাসের সাথে কমবেশি পরিচয় অনেক আগে থেকেই ছিল। তাঁর চমৎকার বাক্যবিন্যাস মুগ্ধতায় জড়িয়ে রাখে। একটি গল্পে এক বাড়ির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “বনেদি কাঠামো ও কালের ভঙ্গুরতা এ দুয়ের মিশেলে আকীর্ণ” আরেক জায়গায় “ বাড়িটার উত্তর দক্ষিন উদোম বলে সন্ত্রাসী বাতাসের দাপটে এ বাড়ির আব্রু সর্বদাই নষ্ট হবার পথে” —ভাষার কুশলী কারিগর হিসেবে চেনা এই লেখককে ব্যবহৃতা পড়তে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলি! তার নেই কোন পেলবতা বা রহস্য। একেবারে সাদামাটা ভাষায় একের পর এক ডানা ঝাপটানো আকাঙ্খা কখনওবা অসহায়তার সত্য কাহিনী কেস হিস্ট্রির আদলে বলে যাওয়া… যৌনকর্মী শব্দের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া নারীর মতই কঠিন তার অবয়ব।

লেখক এজন্যই হয়ত প্রথমেই বলে নিয়েছেন উপন্যাসের ধরণ সম্পর্কে। একেকটি কেসহিস্ট্রি এমনই চমকপ্রদ যে লেখক কখনও আশ্চর্য হচ্ছেন, কখনও দুঃখিত, কখনও বা ভীত। বারো বা চৌদ্দ বছরের শিশুরাও এই পেশায় রয়েছে দেখে তিনি চমৎকৃত হন ভেঙে যায় তাঁর সমস্ত পূর্ব ধারণা। বারো বছরের নদী— বাস্তবতা তাকে এখনই জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে তুলেছে। লেখকের প্রশ্নের উত্তরে সে দার্শনিকের মতো বলে, “ আমি তো রাজি হইনি প্রথমে, তো তাতে কী! যা করতে হবে তাতো করতে হবেই।” তেমনি পাপিয়া নামে চৌদ্দ বছরের এক শিশু শুধুমাত্র সাজগোজ করার জন্য স্কুল ফাঁকি দিয়ে এই পেশার পার্টটাইমার হয়েছে। এই সত্য লেখককে হতবিহবল করে। এরকম কত কাহিনি উর্মি, যুথি, পুস্পা, শিউলিদের। কত কত নাম! কী সুন্দর সব নাম! নামগুলো হয়তো বানানো কিন্তু মানুষগুলো বানানো নয়। তারা কেউ এসেছিল বাসাবাড়িতে কাজ করতে, কেউ গার্মেন্টস এ চাকরি করতে। কিন্তু ব্যবহৃত হয়েছে ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত প্রতিটি পুরুষের দ্বারা, পুলিশের কাছে গেলে আরও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। নানামুখী অভিজ্ঞতায় খুব দ্রæতই তারা পুরুষ নামক শাসক শ্রেণীকে হাড়ে হাড়ে চিনে ফেলেছে। তাই বারো থেকে বত্রিশ সব বয়সের যৌনকর্মী জীবন বাস্তবতা সম্পর্কে লেখকের অজ্ঞতায় হাসে, কখনও উল্টে প্রশ্ন করে কখনও মমতায় লেখকের শিক্ষক হয়ে ওঠে।

একটি হোটেলে যৌনকর্মীদের রেস্টরুমে বসে তাদের সাথে কথা বলতে বলতে লেখক আমাদের অষ্টম পরিচ্ছেদ পর্যন্ত নিয়ে যান। এখানে লেখকের সাথে থাকেন আউটরিচ ম্যানেজার, থাকেন পিয়ার এডুকেটর। যৌনকর্মীদের জীবন বাস্তবতার কাছে তাদের প্রত্যেককেই কেমন জোকার মনে হয়। পিয়ার এডুকেটর নিরাপদ সেক্স সম্পর্কে মেয়েদের সচেতন করেন। যেন তারা ক্লায়েন্টকে কনডম পরতে বাধ্য করে। নইলে যেসব যৌনরোগ হবে তার বিশদ বিবরণ দেয়। মেয়েদের এসব কথা শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গেছে কিন্তু সে যখন পিয়ার এডুকেটরকেই জিজ্ঞেস করে, যেসব পুরুষ কনডম পরতে চায় না, হাতে ধরিয়ে দিলেও বলে একশ’ টাকা বেশি নিস কনডম পরুম না আর জোর করলে তোর সাথে শুমু না বলে অন্য কোথাও চলে যায় তখন তো তার ব্যবসায়িক লস… তো এর সমাধান কী? তখন পিয়ার এডুকেটর কী উত্তর দেন? লেখক জানাচ্ছেন তিনি কাশেন। তারপর লেখক উপসংহার টানেন “ শিক্ষার সাথে বাস্তবতার ফারাক তিনিও কি জানেন না? খুব জানেন। তবু।” হ্যাঁ তবু। তবু এই মকারি। না, হেসে উঠতে পারিনি। একশ্রেণীর পুরুষের যথেচ্ছাচারের, বিকৃত রুচির নমুনাগুলো পড়তে পড়তে রাগ, ক্ষোভ উথলে উঠছে ভাতের মাড়ের মতো। লেখক নিজেও হতবুদ্ধি হয়ে যান। নিজেকে প্রশ্ন করেন, “ জীবনে তাহলে কোনটা সত্যি, সতীত্ব নাকি খেয়ে পরে জীবিত থাকা। একজন নারীর জীবনে সতীত্ব কি একটা উপরি খোলস, নাকি এটা তার সত্ত¡ার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত! নাকি এসব কিছু না, সবকিছু একটা ক্ষমতায়নের বলয়ের ভেতরে ঘূর্ণিত হচ্ছে?”
ক্ষমতায়নের বলয়, এই বলয়ের নিয়ন্ত্রণ পুরুষের হাতে। তাই উচ্চবিত্ত বৃদ্ধ একটা দাঁতও যার অবশিষ্ট নেই সেও নকল দাঁত লাগিয়ে বারো থেকে বত্রিশ যে কোন নারী বেছে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। নারীর সাধ্য নেই তাকে অপছন্দ করার। বিজলির বক্তব্য Ñপুরুষেরা নারী পুরুষের সমতার কথায় হেসে বলে, “নারী পুরুষের সমতা শুধু একটি বিশেষ জায়গায়, সেই জায়গাটি যা শরীরের নীচে অবস্থান করে। তাছাড়া আর কোথাও নারী পুরুষের সমতা নেই(ব্যবহৃতা পৃ:৫৩)।” নেই-ই তো। এজন্যই পুরুষের সতীত্বেরও বালাই নেই শুধু নারীর সতীত্ব লাগে।

এবার লেখক তথ্য উপস্থাপন করছেন পৃথিবীব্যাপী এই বৈষম্য নিয়ে। নবম পরিচ্ছেদে তিনি জানাচ্ছেন হাজার বছর ধরে শাসক পুরুষ কী করে নারীর মানুষ হিসেবে উত্তরণের পথটি অমসৃণ করে রেখেছে। ধর্মে, শিক্ষায়, রাজনীতিতে, আইনে, সামাজিক, আর্থিক সবদিক দিয়ে তাকে পঙ্গু করে রাখতে চেয়েছে নিকট অতীতেও। মাত্র ১৯৫৬ সালে মেয়ে শিক্ষক ও পুরুষ শিক্ষকের বেতন সমান হয়েছে, মাত্র ১৯৬৯ এ নারী স্বামীকে তালাক দেয়ার অধিকার পেয়েছে, ১৯৪৮ এ প্রথম একজন মাত্র নারী ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  স্নাতক ডিগ্রী নেয়ার অনুমোদন পেয়েছে আর ইংল্যান্ডের মতো বনেদিয়ানার গর্বে গর্বিত দেশও ১৯৭৫ সালে নারী পুরুষ সমতা আইন এবং মাত্র তেত্রিশ বছর আগে ১৯৮৫ সালে “ইকুয়াল পে অ্যাক্ট” চালু করতে বাধ্য হয়েছে কারণ সেই পুরুষালী আধিপত্য।

তারপরেও বিশ্ব জুড়ে এখনও বন্ধ হয়নি নারীর প্রতি সহিংসতা বদলায়নি নারীকে দ্বিতীয় লিঙ্গ ভাবার মানসিকতা। এখানে লেখক যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা কবিতা ইসলাম নামে এক নারী যিনি হেলথ সেন্টারে চাকরির সুবাদে কিছু কেসহিস্ট্রির বর্ণনা দিয়েছেন। সেই কেসহিস্ট্রিগুলো আর একই সাথে রয়েছে এই কাজ করতে গিয়ে কবিতা ইসলামের মানসিক বিপর্যয়ের বর্ণনা। এই মেয়েদের অসহায়ত্ব আর তাদের সাহায্য করার ভানকারীদের দেখে দেখে দুঃখে ভয়ে একরকম পালিয়ে বাঁচেন কবিতা ইসলাম। তবে সেই অবস্থান থেকেই ঢাকার বাইরের একটি ব্রথেলে যেয়ে বাস্তব অবস্থা দেখার সিদ্ধান্ত নেন লেখক। সত্যের আগুনে ঝাঁপ দেয়ার এই প্রবণতা আছে বলেই লেখক তিনি। তবু কঠিন সত্য তাঁকে বিকারগ্রস্থ না করলেও হতভম্ব করে বৈকি। কিছু পুরুষ গর্ভবতী মেয়ে পছন্দ করে তো কিছু পুরুষ অল্পবয়সী ছেলে খোঁজে, মা নিজেই অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে টাকার লোভে পুরুষের হাতে তুলে দিচ্ছেন জেনে হতবাক হন লেখক। অনেক বয়স্ক পুরুষেরই শিশু যৌনকর্মী পছন্দ বলে শিশু পতিতায় ভরে গেছে পতিতালয় জানান তিনি। আর এও বুঝেন যে সবাই সব জানে। প্রশাসনের নাকের ডগাতেই সব চলছে। তাদের সাথে সমঝোতা করেই চলছে।

কবিতা ইসলামের কেসহিস্ট্রি আর তার নিজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে তিনি জেনে যান সারা দেশটাতে ছড়িয়ে আছে যৌনকর্মী। আর্মি অফিসার, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কেউ বাকী নেই। কবিতা ইসলামের হাহাকার আর লেখকের হাহাকার মিলেমিশে একাকার হয়ে নারী পাঠককেও আক্রান্ত করে, “ এখন আমার বুকের ভেতর ফারাও এর বুকের ফাটল! অসংখ্য অজস্র ফাটল। আর সেই ফাটলের ভেতর দিয়ে যেন পায়রার মতন বেরিয়ে যাচ্ছে মানুষের প্রতি আমার আশা, আমার বিশ্বাস, আমার শ্রদ্ধা, আমার প্রেম, আমার আস্থা। … যে পুরুষ আমার বাবা, আমার ভাই, স্বামী, পুত্র তাদের ভালবাসতে পারছিনে কেন, শ্রদ্ধা করতে পারছিনে কেন?  স্নেহ করতে পারছিনে কেন?…”

 

শাহনাজ নাসরীন

জন্ম  ও বেড়ে ওঠা কুমিল্লায় ।

দেয়াল পত্রিকায় ছড়া লেখা দিয়ে লেখালেখির শুরু। গল্প ও কবিতা দুটোই লিখে থাকেন। চল্লিশটির মতো গল্প একটি উপন্যাস অল্প কিছু কবিতা আর  প্রবন্ধ লেখা হয়েছে এ যাবৎ।

এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে পাঁচটি কবিতা, তিনটি গল্প, একটি উপন্যাস ও দুটি জীবনী গ্রন্থ।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top