বেশ কয়েকটি কারণেই কবি শামস আল মমীনের কবিতা পড়তে আমার ভালো লাগে। প্রথম এবং সবচেয়ে বড় কারণ হল, তাঁর কবিতায় নিউ ইয়র্কের হাডসন নদীর বাতাসের ঘ্রাণ যেমন খুঁজে পাই আবার পাশাপাশি তাঁর কবিতা পড়লে বাংলার জলজধারার সংগীতটিও নাকে এসে লাগে। তাঁর কবিতায় আন্তর্জাতিকতাবাদ বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে উঠে আসে। আরেকটি কারণ হল তাঁর কবিতার ভাষা সহজ সরল হওয়ার কারণে কবিতাটি তখন আমার আত্মায় খুব জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠে। তাঁর কবিতা পড়লে একটি গল্প চোখের সামনে ভেসে উঠে। মনে হয় তিন যেন একটি সময়ের গল্প বলে যাচ্ছেন। আমি সেই গল্পটি মুগ্ধ হয়ে শুনছি। সদ্য প্রকাশিত তাঁর কবিতার বই ‘অনেক রাত জেগে থাকার পর’ এমনই একটি কাব্যগ্রন্থ।
কবি শামস আল মমীনের কবিতার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য স্পষ্টতই বিদ্যমান। তাঁর কবিতার পঙতিবিন্যাসে তাঁর নিজস্ব একটি রীতি লক্ষ্যনীয়। তিনি তাঁর কবিতার একটি স্বাতন্ত্র ভাষাও তৈরি করেছেন। কবিতার শব্দ, বিষয় এবং বৈচিত্রতা নির্মাণেও তাঁর আছে একটি দক্ষ হাত। প্রচুর দীর্ঘ কবিতাও তিনি লিখেছেন। সময়ের হিসাবকে দৈর্ঘ্য প্রস্থে ভাগ করলে দেখা যায় মানুষের মনজগতেও এই দৈর্ঘ্য প্রস্থের হিসাবের নিত্য কাটাকাটি চলে। এই ক্ষীণ বা ক্ষুদ্র জীবনে আমাদের রয়েছে দীর্ঘ নি:শ্বাস আর স্বপ্ন ছোঁয়া আকাশ। মানুষ স্বপ্ন দেখে দীর্ঘ কিন্তু সুখের আয়ু কতেই না অল্প!।এইতো জীবনের চমক! এই চমক কবি শামস আল মমীন তাঁর কবিতায় দারুণ শৈল্পিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন। একজন মানুষের যাপিত জীবনের গল্প তখন অনায়াসে বাসা বাঁধে মমীনের কবিতায়। জীবনের গল্পগুলোই তখন কবিতার আকারে ভুমিষ্ঠ হয়। সুখের গল্প, দুখের গল্প, স্বপ্ন, ভালোবাসা, স্বপ্নের আলো আধারে নিত্য লুকোচুরি খেলতে খেলতে কবিতার ভীত নির্মাণ হয়! শামস আল মমীনের কবিতার প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে সেই জীবনের ঘ্রাণ খুঁজে পাওয়া যায়। সেকারণেই তাঁর কবিতা শুধুই একটি কবিতা নয় তখন কবিতাটি হয়ে উঠে জীবনের গন্থে মাখামাখি কিছু গল্প। কবি শামস আল মমীনের এই কবিতার কয়েকটি পঙতিমালার দিকে লক্ষ্য করুন।
‘যখন একটি মেয়ে ভালোবাসে একটি ছেলেকে
আস্তে আস্তে
পৃথিবী বদলে যেতে থাকে।
আস্তে আস্তে মেয়েটি বদলে যেতে থাকে।’(যখন একটি মেয়ে)
একজন কবি বাস করেন তাঁর নির্মিত কল্পনার জগতে। কিন্তু সেই জগৎটিও নির্মিত হয় বাস্তব জীবনের নির্যাস দিয়েই। একজন কবি আধুনিক শহুরে জীবনে বসবাস করেও তিনি অনায়াসে ভেসে বেড়ান গ্রাম বাংলার সবুজ ছায় ঘেরা প্রান্তরে। এইতো কবিতার শক্তি! কবিতার কাজইতো হল উন্মুক্ত আর স্বাধীনভাবে সীমানা অতিক্রম করা, রাষ্ট্র থেকে বিশ্ব, জাতিয় থেকে আন্তর্জাতিকতার আকাশ ছুঁয়ে দেয়া। কবি শামস আল মমীন সে কারনেই আধুনিক জীবনের কবি বলা যায়। তিনি শহুরের উন্মাতাল জীবনে অবগাহন করেও যেমন বাংলার প্রান্তিক সমাজ আর বকুলের ঘ্রাণকে স্পর্শ করেছেন পাশাপাশি গ্রামের নির্মল প্রান্তরে বসে শহরের জীবনের চিত্র এঁকেছেন। এইতো কবির শক্তি! এইতো কবির কাজ! যদিও অনেক কবি মনে করেন যে জগৎ আমার অদেখা যে জগৎ আমি বিশ্বাস করি না সে জগতের ছবি আমার কবিতায় আসবে কীভাবে? শামস আল মমীন তাঁর কবিতার পঙতিতে তখন শহর-গ্রাম একাকার হয়ে যায়।
‘ আমি কি ভুলে গেছি ডালে ডালে বসে থাকা
হলুদ পাখিটার কথা, কেন যে আমাকে দেখলেই
পাখিটা উড়াল দিত?’(আমার বাড়ি) অথবা
‘ট্রেনে
সে আমার কাঁধে
হাত রেখে বলে
ভাই, আপনি বিদেশে লেখাপড়া শিখেও
যার তার সাথে
পথেঘাটে বসে গল্প করেন কিভাবে?’
কিন্তু কবিতার কাজ কি শুধুই দৃশ্যমান জগৎ নির্মাণ করা? কল্পনার আশ্রয় নিয়ে কবি কি নতুন নতুন ভুবন তৈরি করেন না? করতে পারেন না? কবি শহীদ কাদরীকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কথাটা। আপনার কবিতায় দেখি আধুনিক মানুষের জীবন। শব্দ দিয়ে বুনেছেন আধুনিক শহুরে ভাষা, ইট, দালান, বাড়ি, গাড়ি ডলার পাউন্ড। অথচ আপনার কবিতায় আমাদের চিরায়ত গ্রাম বাংলার কোন ছবি দেখি না, বাংলার সাধারণ সহজ সরল জীবনের কোন অঙ্গিকার আপনার কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। কাদরী একটু খেকিয়ে উত্তর দিয়েছেলেন, “যে জীবন আমি জানি না, বুঝি না সেই জীবন নিয়া কবিতা কেমনে লিখি মিয়া?” কবি শামস আল মমীন যে এই শ্যূন্যতাকে অতিক্রম করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাঁর কবিতায় শহুরে পাথুরে জীবনের ঘ্রাণ পাই পাশাপাশি বাংলার মেঠো পথের মুর্ছনার সুরও কানে বেজে উঠে ।
‘ হাডসনে হাওয়া খায় শামস মমীন বহুদিন কিন্তু
কবিতা শোনায় মেঘনার, যমুনার…
মাঝে মাঝে কি যে হয়, মাঝরাতে শুনি
আহাজারি, কেন
‘আমি বন্দী খোলা জানালার কাছে’( বাংলা কবিতা ২০২০)
‘একদা এক জীবন ছিল’ কাব্যে কবি আর্তুর র্যাঁবো লিখেছেন, ‘একদিন সন্ধ্যায় সুন্দরকে কোলে বসিয়েছিলাম। ন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি দাঁড়ালাম।’সন্দেহ নেই র্যাঁবোর আত্মায় তখন চলছিল অন্যরকম এক কাটাকাটি। তখন তাঁর বুকে ছিল শূন্যতা! সুন্দরের খোঁজে হাটতে হাটতে কবির পা তখন রক্তাত্ব। কবি শামস আল মমীনের কবিতার সুরেও দেখি সেই একই কথা। কবির কবিতাতেও দেখতে পাই সেই একই শূন্যতা!
‘আরও কিছু
বলতে চেয়েছিলাম আমি।
কিন্তু… ভালোবাসার কথা
অত সহজে বলা যায় না।(মাধবীলতা)
লক্ষণীয়, প্রায় সব প্রধান কবিরাই প্রকৃতি নিয়ে প্রচুর কবিতা লিখেছেন। বাংলার কবিদের আবার সবার প্রিয় ঋতু বর্ষাকাল। বৃষ্টি নিয়ে তাদের অনেক কবিতা। কিন্তু এই দিক থেকে কিছুটা ব্যাতিক্রম লক্ষ্য করি কবি শহীদ কাদরী আর কবি শামস আল মমীন। তাঁরা দুজনই বৃষ্টিকে দেখেছেন ঠিক অন্যরকম ভাবে। কবি শহীদ কাদরী তার ’বৃষ্টি বৃষ্টি’ কবিতায় সমাজে লুকিয়ে থাকা ভণ্ড দৃবৃত্তদের তুলে এনেছেন। কবি শামস আল মমীন তাঁর ‘বৃষ্টি’ কবিতাতেও সেই ব্যাঙ্গ ফুটে উঠে।
‘এই বৃষ্টি বৃষ্টি দিনে, প্রাণীকুলে প্রাণপণ
ডাকাডাকি
বড়লোকদের অতিশয় মাখামাখি
ভালোবাসাবাসি
ভালো
সবই ভালো…কিন্তু
বৃষ্টি হইলেই গরিবের ভাতে টান পড়ে’(বৃষ্টি)
লক্ষ্য করে দেখবেন তাঁর বৃষ্টির কবিতা কিন্তু আমাদের যাপিত জীবনকে আকড়ে ধরে নির্মিত। কবিতার চিত্রকল্প তখন আমাদের অনেকদূর নিয়ে যায। তার কবিতার বৃষ্টির ফোটায় ফুটে উঠে একটি সমাজ, একদল মানুষের চোখ। আর সেই দৃশ্যগুলোকে এক করলে তৈরি হয় একটি কোলাজ। সেই কোলাজের দিকে তাকালে তখন আপনি দেখতে পাবেন একটি কিছু বিপন্ন মানুষের চোখ।
কবি শামস আল মমীন মাথা থেকে পা পর্যন্ত একজন নির্ভেজাল কবি। কবিতায় মেটাফর ব্যবাহারে তিনি যাকে বলে ওস্তাদ! সত্যি বলতে আমি খুব অবাক হয়ে যাই শব্দ ব্যবাহারে তার নৈপূন্য দেখে! তার কবিতা তখন যেন আর কবিতা থাকে না। কবিতা তখন চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দীনের ঘোড়ার মত টগবগিয়ে লাফিয়ে চলে। কবিতার শব্দ তখন বাক নেয় টেংগো নাচে! সেই নাচের ঘোরে পাঠকও ঘুরতে থাকেন। পাঠকও উড়ন্ত বল্লমের মত চকচকে চোখ নিয়ে কবিতার পাশে এসে দাড়ান। শামস আল মমীন এই চিত্রকল্প তৈরিতে ওস্তাদ। একটি উদাহারণ দেই।
‘গানের পাখিরা নির্বাক উড়ছে আকাশে
নিউইয়র্কের সমস্ত বেদনার ভার বুকে
হাডসন আর ইস্ট রিভারের উচ্ছল ঢেউ থেমে আছে স্থির’( নীরবে দেখছি সব, অসম্ভব অবিশ্বাস)
কিন্তু কবির আত্মাও প্রতিনিয়ত রক্তাত্ব হয়! এই সমাজ সংসারে সব কিছুই কি মানুষ পায়? পেতে পারে? কবি শামস আল মমীন দীর্ঘদিন ধরেই আমেরিকা প্রবাসী। আমেরিকার ধূলোবালি গায়ে মেখেই তিনি নতুন এক জীবনকে আলীঙ্গণ করেছেন। তার অভিবাসী মনের বেদনা তাঁর কবিতায় ফুটে উঠবে এইতো স্বাভাবিক!
‘ আমি আর কতকাল দেখব
বিদায়বেলায়
মায়ের চোখের কোণে জমে থাকা
টলমল জল?’(কবিও দুঃখ পায়)
কী নির্মম সত্য কথা! এই কথার মর্ম একজন অভিবাসী ছাড়া আর কে বুঝতে পারবে? এই সত্য উচ্চারণ অডেনও তাঁর ten songs কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন,
‘Say This City has ten million souls,
Some are living in mansions, some are
Living in holes;
Yet there’s no place for us’
তারপরও একজন কবির আত্মা নিত্যই রক্তাত্ব হয়। যে স্বাপ্নিক ভালোবাসার কথা কবি তাঁর শব্দ দিয়ে শিল্পরাজ্য গড়ে তুলেন সেখানে স্বপ্নের কতটুকুই বা বাস্তবায়ন ঘটে! জার্মান কবি রিলকের তাঁর কবিতায় নিজেকে প্রকৃতির কাছে সমর্পন করেও দেখেছিলেন আসলে তিনি সেখানেও কত একা! একজন কবি সেই একাকীত্বকে খুব সহজে নিতে পারেননা। অথচ এটাই জীবনের বাস্তবতা! এই অন্ধকার আবার এই সুদীপ্ত আলোর ছটা! ফরাসি কবি ত্রিস্তা জাঁরা হয়তো সে কারণেই তিনি কবিতাকে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাওয়া একটি আয়নার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। যে আয়নায় আকাশের নীল রং ধরা পরবে পাশাপাশি রাস্তার খনাখন্দ্ও ধরা পরবে। জীবনের এই নিগুঢ় তত্বটি আত্মায় গেঁথেছিলেন ফরাসি কবি বোদলেয়ারও। জীবন আর প্রকৃতির এই এবসার্ডিটি ফুটে উঠে শামস আল মমীনের কবিতায়।
দুঃখগুলো মাঝে মাঝে জোনাকির মতো নিবে জ্বলে
তবু মনে হয় কারও চোখে চোখ রেখে বলি,
জীবন আমার কাছে একটুও তুচ্ছ নয়। নদী
ও নারীর মায়া, উড়ে যাওয়া পাখিদের ছায়া, কুয়াশায়
ঢাকা রোদ আর ঘাসের শরীরে ঝুলে থাকা
একফোঁটা শিশিরও ফেলনা নয়’(একফোঁটা শিশিরও ফেলনা নয়)
কবি শামস আল মমীন সমকালকে নিয়ে ভাবেন, সমকালকে মহাকালের ছায়াপথের দিকে নিয়েও যান। সে কারণে সমকালীন সময়ের যুদ্ধ, বিগ্রোহ, সমাজের অধপতিত রূপ, মানুষ নামের অমানুষদের চেহারা তখন তাঁর কবিতায় স্থান পায়। সেসব বিবেচনায় কবি শামস আল মমীনের কবিতা একজন নিমগ্ন পাঠককে জাতীয় নিজস্ব পরিমনণ্ডলে চেনাজানা বেড়াজাল ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। কবি শামস আল মমীনের শক্তি এখানেই।