শ্যারন ওল্ডসের কবিতা

ভাষান্তর ও ভূমিকা: সাবেরা তাবাসসুম

আমেরিকান কবি শ্যারন ওল্ডসের কবিতার সাথে আমার প্রথম পরিচয় কবি শামস আল মমীন অনূদিত ‘সাম্প্রতিক আমেরিকান কবিতা’র বইয়ের পাতায়। শ্যারনের প্রথম কবিতা পাঠের আবহ আমাকে চাবকে নিয়ে বেরিয়েছিল, মনে আছে। ভাবছিলাম, কী অকপট, কী সাংঘাতিক শক্তিশালী কবি! ২০১৮ সালে শ্যারন ওল্ডসের কবিতার বই Blood, Tin, Straw হাতে এলো। আরেকটু পাকাপোক্ত রকমের চেনা-জানা হতে থাকলো সেই থেকে। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় বইটি। নিজের ইংরেজি জ্ঞানের ওপর একটুও ভরসা না থাকা সত্ত্বেও একটা দুটো লাইন অনুবাদ করা শুরু করলাম। প্রিয়তম পুত্রকে সক্কাল সক্কাল স্কুলে পৌঁছে দিয়ে করোনা পরবর্তী সময়ে প্রায় হঠাৎ আবিষ্কার করা আমার প্রিয় কফি পার্লার প্রেজিতে বসে শুরু হলো শ্যারনকে পাঠের নিমগ্নযাত্রা। আমার পূর্বদেশীয় ‘কনফিউজড’ ‘আপাত কোমল’ এবং‘মারী ও মাধুর্য’ সংবলিত মন মনোযোগ দেবার অবসর পেলো পশ্চিমের কিঞ্চিৎ রুক্ষ্ণ শীতল ‘কমপ্লেক্স’ মনন ও সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায়।

কবি শ্যারন ওল্ডস রাজনৈতিকভাবে ভীষণ সতর্ক। তাঁর ভাবনায় এবং কর্মে নারীর পরিচয়, তাঁর শরীর ও যৌন অভিজ্ঞতাকে ঘিরে নির্মিত তকমা, ট্যাবু এবং ভূমিকা নিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নজরদারি এবং সেটার প্রায়োগিক কৌশলের মূলে আঘাত করেছেন দুর্দান্ত দক্ষতায়। তিনি সবসময়ই গুরুত্ব দিয়েছেন ‘কনটেক্সট‘ বোঝার দিকে। একটু মনোযোগী হলেই পাঠক বুঝে যাবেন জীবন যাপনের ‘আধুনিক’ ‘উন্মুক্ত’ ‘আমেরিকান পদ্ধতি’র অসাড়ত্বকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন তিনি। যে কারণে মাতৃত্বকে ‘সার্বজনীন মহত্বের’ ভার বইতে দেখে প্রশ্ন তুলেছেন, শিশুর পারিবারিক আবহ ও তার মানস নির্মাণের প্রক্রিয়া নিয়ে ‘ক্রিটিক্যাল’ থেকেছেন অথবা যৌনতাকে ঘিরে নারীর ভাবনা ও চর্চার বিষয়টিতে সরব হয়েছেন। না, কোনো ‘স্টেটমেন্ট’ দাঁড় করাচ্ছেন না; ‘প্রশ্ন-উত্তর’ পর্বও সাজাচ্ছেন না শ্যারন। এক ধরনের শক্তিশালী ‘ন্যারেটিভ’ উপস্থাপন করছেন তিনি পাঠকের সামনে। আমার মনে হয়েছে এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য। ওই ন্যারেশন বোঝার জন্যে পাঠকের প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমি।
শৈশবের বেড়ে ওঠায় নির্যাতনকারী মদ্যপ পিতা ও দুর্বল ব্যক্তিত্বের মায়ের কাছ থেকে পাওয়া অমধুর স্মৃতি শ্যারনকে তাড়িত করেছে বারবার। কিন্তু তিনি যে তিক্ততা পুষে রাখতে চাননি সেই প্রয়াসও উঠে এসেছে কবিতার হাত ধরেই। হতে পারে এই অভিজ্ঞতাকে উৎরে যাওয়ার উপায় হিসেবে নিজের মাতৃসত্তাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন তাঁর কবিসত্তার ভেতর দিয়ে। শ্যারন আমেরিকার যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক ভূমিকার সমালোচনা করেছেন চাঁছাছোলা ভাষায়। সে ভাষা, আমি বলব, একই সাথে সাংঘাতিক কড়া এবং সরস। একটা নির্মম সময়কে ধারণ করে তাঁর কবিতা। একই সাথে তাঁর কবিতার শ্বাশত সত্যও বিদ্ধ করে আমাদের মন-মননকে। ছোটখাটো বিষয় কবিতা থেকে একটু নমুনায় যাওয়া যাক—
—আমি আসলে
সেটাই করি যা আমি দ্রুত শিখেছি করা দরকার বলে,
আমি ছোট ছোট সুন্দরের দিকে মনোযোগী হয়েছি
আমার যা আছে তা দিয়ে ভালোবাসার বিষয়গুলো খুঁজি
যেন এটাই আমার দায়িত্ব, ভালোবাসা—
এই পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের বেঁধে রাখে।

সুতরাং, অত্যন্ত শক্তিশালী ইরোটিক চিত্রকল্প ও বাক্যালঙ্কার ব্যবহার কিংবা একরোখা নারীবাদী কবিতার জন্য তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলে সেটা হবে শ্যারনের খণ্ডিত পরিচয়। কোনো একটি বিষয়কে নানা দিক থেকে দেখার সক্ষমতা এবং কবিতায় সেটার কৌশলী অথচ উন্মুক্ত উপস্থাপন কবি হিসেবে তাঁকে অনন্য করেছে। আর আমাকে আকৃষ্ট করেছে সেই দিকটাই।

আমার পাঠের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে খুব সহজবোধ্য নয় শ্যারনের কবিতা। আগে বলা কথার আবহ টেনে বলছি, সকল পাঠক প্রস্তুত নন তাঁর কবিতার রস আস্বাদনের জন্যে। কোনো ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে শ্যারনের কবিতাকে উপভোগ করার উপায় নেই। আপাত দৃশ্যে যে বিষয়গুলোকে ‘স্বাভাবিক’ বলে ভাবতে বাধ্য করে পুরুষতন্ত্র, ধর্ম কিংবা পুঁজিবাদী সমাজ— সেখানেই তাঁর প্রশ্ন। যৌনতা সম্পর্কিত ভাবনা ও অভিজ্ঞতা মানুষের চিন্তা ও কাজের প্যাটার্নকে যে প্রভাবিত করে, সে বিষয়টির দিকেও তাঁর ইশারা মেলে। মদ্যপ পিতার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে দেখা হওয়ার সময় কিশোরী মেয়েটির ‘জটিল’ মানসিক পরিস্থিতি, দুর্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী মায়ের প্রবল অপারগতা, ধর্মযাজকের যৌনতার ধারণা, আমেরিকার যুদ্ধবাজ বর্ণবাদী রাজনীতি, তীব্র দুর্যোগে প্রতিবেশী ভাইয়েদের ভয়ংকর স্বার্থান্ধতা, ধর্ষকের অবরুদ্ধ নিষ্ফল আত্মা, নারীর প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা কিংবা মাস্টারবেশন— এমন নানা বিষয়ের দিকে তিনি পাঠককে নজর ফেরাতে বাধ্য করেন। শ্যারনের বেশিরভাগ কবিতা মূলত বর্ণনামূলক। আগেই বলেছি তিনি এক ধরনের শক্তিশালী ‘ন্যারেটিভ’ উপহার দেন। তাঁর ভাষা কখনো শ্লেষাত্মক, কখনও নির্মোহ, কখনও সরস। শ্যারন কোনো কোনো কবিতায় ‘ডার্ক কমেডি’ উপহার দেন তাঁর পাঠকদের। উচ্চকিত না হয়েও শক্তিশালী হওয়ার উপায়টি তিনি রপ্ত করেছেন দক্ষতার সাথে। তাঁর কবিতা মনোলগ নয়, মনোস্তাত্বিক জটিলতার বয়ান নয়; সুবিন্যস্ত জার্নাল যেগুলো ভীষণভাবে ‘রাজনৈতিক’।

শ্যারন ওল্ডসের জন্ম ১৯৪২ সালের ১৯ নভেম্বর সানফ্রান্সিসকোয়। বেড়ে উঠেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে। ধর্মীয় দিক থেকে গোঁড়া এক পারিবারিক জীবনে নানা অনুশাসনের ভেতর বড় হয়েছেন। অনেক রকম প্রতিবন্ধকতা থাকলেও বই পড়ায় কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। অনুমান করতে পারি, বৈরি পরিবেশে বই হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রকৃত সঙ্গী। পাঠক হিসেবে শেক্সপিয়ার, এমিলি ডিকিনসন, ওয়াল্ট হুইটম্যান যেমন পড়েছেন, ভক্ত হয়েছেন তেমন এ্যালেন গিন্সবার্গের হাওল এন্ড আদার পোয়েমস-এরও। ইংরেজি, ইতিহাস ও সৃজনশীল লেখালেখি তাঁর পাঠের কেন্দ্রে রয়েছে। শিক্ষাজীবনে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং কোলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন।

শ্যারন লিখছেন ষাটের দশক থেকে। প্রথম বই `Satan says’ প্রকাশিত হয় ১৯৮০তে। বলা হয় ওতে তাঁর যৌবনের শুরুর দিককার যৌন-অভিজ্ঞতা মুদ্রিত হয়েছে খোলামেলা ভাষায়। একে একে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ ক’টি কবিতার বই। লিখেছেন গদ্য কবিতা, লিখেছেন ব্যলাডও। শ্যারন ওল্ডস ভূষিত হয়েছেন নানান পুরস্কারে। ২০১৩-এ পুলিৎজার পেয়েছেন তাঁর ‘Stag’s Leap’ বইয়ের জন্যে। ২০০৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ‘একাডেমি অফ অ্যামেরিকান পোয়েটস’-এর চ্যান্সেলর হিসেবে কাজ করেছেন। সম্প্রতি পড়াচ্ছেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামে। তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে বিশ্বের সাতটি ভাষায়। কবিতায় তিনি এখনও সচল। ১৯ নভেম্বর তাঁর বিরাশিতম জন্মদিন। কবিকে স্মরণ করি শুভকামনায়, ভালোবাসায়, আস্থায়। বাংলা কবিতার সচেতন পাঠকেরা শ্যারনকে গ্রহণ করবেন, এই আশা রাখি।

আহার

মা, আমি কখনই ভুলব না, নাশতার টেবিলে
তোমাকে দেখার দৃশ্যটা
যখন আমি ফিরতাম স্কুল থেকে—
বসে থাকতে দেখতাম তোমাকে, চমৎকার ভঙ্গিতে
কটেজ চিজ ভরা সেই প্লেট আর চামচ নিয়ে,
নিজেকে জোর করে খাওয়াতে-থাকা তোমাকে
যদিও তুমি বেঁচে থাকতে চাইতে না,
নিজেকে খাওয়াতে সেটুকুই, যেটুকু খেলে অন্তত মরবে না
আর আমাদের মাতৃহীন করে চলেও যাবে না
তুমি বসে থাকতে সেই স্তনের মতো গোল
বাটিটার সামনে এবং একটা ঠাণ্ডা আলো ছড়াতে,
সেই জীবনের আলো, যা তুমি কখনো চাওনি,
তুমি সেখানেই যেন ধরে রেখেছিলে তোমার জীবনকে
এবং তাকাচ্ছিলে, একটা চল্লিশ বছর বয়স্ক এতিম যেভাবে
তাকায় বুকের দিকে, সদ্য তালাক পাওয়া বিরাশি পাউন্ডের
নারী তাকিয়ে থাকে চামচের দিকে যেন দুধ টকে গেছে,
একটি মেয়ে, যে সবসময় চায়, তার মা মরে গিয়ে
সবচে’ ভালো কাজটি তার জন্যে করে যেতে পারে।
আমি প্রতিদিন ঘরে ফিরতাম তোমাকে
সেইখানটিতেই দেখার জন্যে, শুকনো চোখে,
জেদী এক নারী, নাশতার ওপর যার তুখোড় নিয়ন্ত্রণ,
নাজুক ঠোঁট আর হাড় সমেত তোমাকে
চিজ সমৃদ্ধ খাবারের দিকে ঝুঁকে থাকতে দেখতাম
যেমন একজন মায়ের কুড়ি বছর বয়সী বুক ঝুঁকে থাকে
মাটির দিকে, এবং এখনও মনে করতে পারি যে
তোমার হাতে ধরা চামচটি ঘুরে যাচ্ছে একটি
মেয়ের দিকে যে হেঁটে যাচ্ছে আনন্দের পথে,
তোমার চামচ উঠে আসছে সাহসের সাথে,
কামড়ের পর কামড়ে, তুমি ওই প্লেটের ওপর কর্তৃত্ব
রেখে যাচ্ছো, যতক্ষণ না চামচটিকে ঝকঝকে করে
প্রস্তুত করে তুলছো আমার জীবনের জন্যে।

 

খাবার চোর
(উগান্ডা, খরা)

পুরো পথটাই তারা লোকটাকে তাড়িয়ে আনলো
যেমন করে তারা তাড়িয়ে নিত তাদের গবাদিপশু
যখন তাদের ঘর ছিল, জীবন্ত শিশুরা ছিল।
তারা লোকটাকে তাড়িয়ে আনলো বেত মারতে মারতে
যা গাছ থেকে বেছে বেছে আনা আর যা খাওয়ার যোগ্য নয়—
ভেঙে আনা ডাল, কেটে আনা নয় কারণ কারো কাছে
কোনো চাকু ছিল না আর খাওয়ার মতো কোনো
গাছের পাতা, কাণ্ড বা উপড়ে তোলা শিকড়ও;
তারা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, পেটাচ্ছিল
সরু সরু মানুষদের একটা হালকা জটলা, যাদের
প্রত্যেকের হাতে লাঠি, ধীরে ধীরে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল,
ধীরে ধীরে পিটিয়ে যাচ্ছিল লোকটা না-মরা অবধি
সে তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তার বাঙ্ময় শরীর নিয়ে,
তার থেঁৎলে যাওয়া কবজি আর শিরাগুলো ভেসে উঠছিল
শেকড়ের দৃশ্যমান হওয়ার মতো
তার মাথার ক্ষত পাকা ও রসালো, লাঙল চালিয়ে যাওয়া
মাটির নকশা, বীজবোনা ট্রেঞ্চের মতো
লোকটার চোখ দুটো ক্ষমাপ্রার্থী, ঘন কালো
পলকগুলো তার ত্বকের মতোই চকচকে
একটা বর্ষণমুখর ভারী সকালের মতো
মেঘমেদুর যার মাঝে সাদা সাদা রেখা,
তার ঠোঁট ভাইদের উদ্দেশ্যে ছিল খোলা
যেমন একটা নারী শরীর উন্মুক্ত হয়,
যেমন ধরণী দ্বিধাবিভক্ত হয়, ভাঁজ হয়
ভেজা এবং বীজলগ্ন হয়,
তার ঠোঁটের রেখাগুলো দেখাচ্ছিল মিহি
হাজার হাজার শাখানদীর মতো
লোকটা তাদের কাছে চাইছিল একটা জীবন
তার পুরো শরীর দিয়ে এবং তারা তার শরীরটাকে
তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল সারাটা পথ, কারণ তারা জানে
যে জীবন সে ফেরত চাইছিল সেটা আসলে তাদের।

 

ধর্মযাজকের যৌনাঙ্গ

ওটা ঝুলে থাকে তার আলখেল্লার গভীরে,
একটা ঘণ্টার মাঝখানে সূক্ষ্ম হাততালির মতো।
ওটা নড়ে ওঠে যখন সে নড়ে,
রুপালি সমুদ্র-শৈবালের এক ভূতুরে মাছ
যৌনচুলগুলো দুলতে থাকে অন্ধকারে, উত্তাপে—
এবং রাতে, যখন তার চোখ নিদ্রামগ্ন
ওটা উঠে দাঁড়ায় ঈশ্বর বন্দনায়।

 

পরিত্যক্ত নবজাতকটি

যখন ওরা তোমাকে খুঁজে পেল,
নিঃশ্বাস বন্ধ ছিল তোমার
দিনটা ছিল মাইনাস দশ ডিগ্রির
তুমি মোড়ানো ছিলে প্লাস্টিকের একটা ব্যাগে
ময়লার ঝুড়ি থেকে তোমাকে তোলা হলো
ঘুমন্ত শিশুকে দোলনা থেকে তোলে যেমন
ওরা তোমাকে বাজারের থলে থেকে বার করলো
সব শেষ হয়ে গ্যাছে ভেবে উদ্বিগ্ন ছিল সবাই
তুমি কিছুই অনুভব করতে পারছিলে না
সব থেমে ছিল কিছু সময় আগে
তোমার বুকের ওঠা নামা ফিরিয়ে আনার জন্যে
ওরা ঝুঁকে পড়ে সিপিআর দিচ্ছিল
জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, বার বার, যতক্ষণ না
জীবনের যন্ত্রণায় তুমি আবার ফেরো;
ওরা তোমাকে নিয়ে এলো নীরবতা ও
অন্ধকার থেকে জন্মের ভেতর
নিঃশ্বাসে, উজ্জ্বল আলোয় ওরা ওদের
অলৌকিকত্ব অর্জন করল
বছরের দ্বিতীয় দিনটায় ওরা তোমাকে ফিরিয়ে
আনলো এমন এক বালক হয়ে উঠতে, যার
বাবা-মা তাকে ফেলে গ্যাছে ময়লার ঝুড়িতে
জরুরি বিভাগের সকলেই কাঁদছিল তোমার
ছোট্ট শরীরের পুনরায় নড়ে-ওঠা দেখার জন্যে
আমি তোমাকে দেখেছি খবরে,
ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রামের চকচকে ডিস্ক
মেডেলের মতো সেঁটে ছিল তোমার শরীরে
ঢেউ খেলানো ঘন চুলগুলো যেন শৈবাল
তোমার বুদ্ধিদীপ্ত চওড়া কপাল
হাসপাতালের আলোয় ম্যাটম্যাটে লাগছিল
মুখটা বেঁকে ছিল এমনভাবে যেন খুব রেগে আছ
ওপরের ঠোঁটে লেগে ছিল নাকের শুকনো শ্লেষা
আর আমি ভাবছিলাম কীভাবে তুমি গড়পরতা
আমেরিকান শিশু হলে, আমাদের সকলের শিশু,
ভীষণভাবে আমেরিকান তোমার বাবা-মায়ের শিশু
দুজন তরুণ চিকিৎসক লি মার্কলিন এবং
ফ্রাঙ্ক জেনিংস-এর শিশু যারা তোমাকে
ফিরিয়ে এনেছে জীবনে, তাদের পদবি দিয়েছে,
ঠেলে দিয়েছে এই ছোট্ট বয়সেই আমেরিকান
হয়ে ওঠার নির্মম প্রক্রিয়ার দিকে
যদিও আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার পথে
বিছানো রয়েছে অসংখ্য কাচের টুকরো, বিষ্ঠা,
পরিসংখ্যান বলে— তুমি সেই পুরুষ হয়ে উঠবে
যে তার নবজাতককে প্লাস্টিকে মুড়িয়ে ময়লার
ঝুড়িতে ফেলবে— একই সাথে আমি সেই আলোও
দেখতে পাচ্ছি যা তুমিও দেখেছিলে, জোর করে
দ্বিতীয়বারের মতো, দুচোখের রুপালি বরফে
আমি আনন্দিত, তোমার নতুন মুখটা আমাদের
মাঝে দেখতে পেয়ে, লি ফ্রাঙ্ক মার্কলিন জেনিংস,
আমি দাঁড়িয়ে আছি এখানে, তোমাদের জীবনের জন্যে—
ভোঁতা আমেরিকান প্রশংসার জীবন।

 

পৃথিবী আসলে কী

পৃথিবী একজন ঘরহারা মানুষ
অথবা পৃথিবীর ঘর এই বায়ুমণ্ডল
কিংবা বায়ুমণ্ডল এই পৃথিবীর পোশাক,
এর স্তরগুলো পৃথিবী গায়ে পরে আছে,
পৃথিবী একজন ঘরহারা মানুষ
হয়তো এই বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর রেশমগুটি,
নিজেই ঘোরে, পৃথিবী একটি শুঁয়োপোকা
কিংবা বায়ুমণ্ডল এই পৃথিবীর ত্বক—
পৃথিবী এবং বায়ুমণ্ডল আসলে এক,
একই রকম ঘরহারা।
হয়তো পৃথিবীর কক্ষপথই তার ঘর
কিংবা কক্ষপথ শুধুই একটি পথ,
পৃথিবী একজন ঘরহারা মানুষ।
অথবা পৃথিবীর কক্ষপথ আসলে
নরকের বৃত্ত, বৃত্ত ঘরহারাদের।
কিন্তু পৃথিবীর একটা নিজস্ব জায়গা আছে,
অগ্নিবলয়কে ঘিরে, আমাদের নক্ষত্রের চুলায়
পৃথিবীর ঘর আছে,
পৃথিবী ঘরহারাদের আশ্রয়—
খাবার ও উষ্ণতার জন্যে,
আশ্রয় ও স্বাস্থ্যের জন্যে,
তাদের আছে ভূমি ও আগুন,
আছে বাতাস ও জল,
ঘরের জন্যে সেইসব উপকরণ আছে
যা দিয়ে তারা নিজেরা তৈরি, যেন
প্রতিটি ঘরহারা মানুষ
দুধ ও শস্যদানা দিয়ে তৈরি
এক একটা পৃথিবী,
শস্য দেবতা সেরাসের মতো
এবং একজন আরেকজনকে
খেয়ে ফেলতে পারে—
যেন প্রতিটি মানুষ আসলে ঈশ্বর,
ঘরহারাদের ঈশ্বর,
যারা পৃথিবীকে খেয়ে ফেলতে পারে।

 

সাবেরা তাবাসসুম


কবিতা লেখা শুরু পিতা মোঃ সাইদুল হক ভুইয়ার অনুপ্রেরণায়। পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বই ১৪টি। ১৩টি মৌলিক কবিতা এবং একটি হিন্দী ও উর্দু কবি গুলজারের কবিতার অনুবাদ-গ্রন্থ। একমাত্র পুত্রকে নিয়ে বেশিরভাগ সময় কাটে। চলচ্চিত্রের প্রতি রয়েছে তীব্র টান। সবকিছু্র বাইরে কবিতাই সাবেরার আরাধ্য ভূমি, পাশাপাশি অনুবাদ ও মুক্ত গদ্য লেখা তো আছেই।

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top