নাহার মনিকা
অন্ধত্ব বিষয়ে আমার আগ্রহ আছে। কোথাও অন্ধ মানুষ দেখলে বাড়তি মনোযোগ যে দিই তার বিশেষ কারণও আছে। তবু কেন যেন অন্ধ মানুষ দেখতে অস্বস্তি হয়— কেউ চোখের মধ্যে নিঃসীম অন্ধকার নিয়ে ডুবে আছে আর আমি সব কিছুতে চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করতে পারছি, প্রকৃতি আমাকে সুবিধাজনক অবস্থানে রেখে দিয়েছে বলে এক ধরনের আয়েশী অপরাধবোধ গ্রাস করে। যেদিন বাইরে যাই এই অপরাধবোধের পাতলা সর গায়ে মেখে বাসায় ফিরি। সবসময়ই ফিরেছি কিন্তু আমার মা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার একমাত্র মেয়েকে বৃত্তের বাইরে রাখতে চেয়েছিল বলে খুব একটা টের পায়নি যে আমিও বৃত্তের প্রান্ত ধরে ঘুরছি।
আমার মা খালারা সাত বোন— তাদের বাবা ‘খুবই ভাগ্যবান’— এই কথার পেছনে ‘সবগুলি মেয়েকে বিয়ে-শাদী দিতে পারলে সোজা বেহেস্তনসিব’ এই বিশ্বাসটা দানাদারের মতো, অন্তত সেই সময়ের মানুষের মধ্যে বেশ ভালোভাবেই পোক্ত ছিল। আমার মায়ের মতো কেউ কেউ হয়তো এখনো তা বিশ্বাস করে। মা’কে বড় মেয়ে হওয়ার রীতি মেনে তার বোনেদের সঙ্গে সেতুবন্ধন সামাল দিতে হয়েছে। না দিলেও কি কিছু হের ফের হতো? বিধবা হয়ে স্বামীর কিছু স্থাবর, অস্থাবর না পেলে মা ই কি পারতো? সাত মেয়ে বিয়ে দিয়ে গাজীপুরের কাটাকাপড়ের দোকানদার নানাজানের নিশ্চিতভাবে বেহেস্তবাস হয়েছে কি হয়নি জানার উপায় তো স্বাভাবিক নিয়মেই থাকেনা, কিন্তু জীবনের কত রকম বাঁক তার মেয়েগুলিকে খোলায় সদ্য ভাজা খইয়ের মত নানাদিকে ছড়িয়ে ফেলেছে। তবে মা মনে করে সাত মেয়ের জন্য না হলেও তার একটি মেয়ের জন্য নানাভাইয়ের বেহেস্ত নিশ্চিত, সবচেয়ে ছোট অন্ধ মেয়েটিকে কার সঙ্গে, কি শর্তে বিয়ে দিয়েছিলেন কে জানে। বোবার শত্রু নাই, প্রতিবাদের ভাষা না থাকাই ভালো এই বিবেচনায় দু একজন বাকশক্তিহীন মেয়ের বিয়ের কথা শুনেছি। কিন্তু আমার অন্ধ খালার বিয়ের ঘটনার সঙ্গে মায়ের পুরানো বিশ্বাস মাথার কোন প্রকোষ্ঠে— প্রায়ই দেখা যায় প্রতাপশালী সম্রাটের মতো সমাসীন হয়ে অনন্তকাল শাসন চালিয়ে যাচ্ছে! যদিও আমি ছোটকাল থেকে খালাকে নানার বাড়িতে একলাই বাস করতে দেখে আসছি।
কাজের মেয়েটা চা দিয়ে দরজার পাশে টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরের ঘুম থেকে জেগে এতদিন মা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো, আমাকে আর আমার ছেলে রাইয়ানকে দেখতো। আমি চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে ব্যস্ত বিকেলের মধ্যে নিজের ভেতরে নিমগ্ন হবার উপায় খোঁজায় নিযুক্ত হতাম, রাইয়ান আমার পায়ের কাছে বসে খেলতো, বিক্ষিপ্ত লেগোগুলো ওর হাতের নাড়াচাড়ায় অস্থির হয়ে উঠতো, রাইয়ান ওর হাত দিয়ে যাবতীয় শব্দ বোনার চেষ্টা চালায়। সেসব শব্দে সম্ভবত, সম্ভবত কেন নিশ্চিতভাবেই তার নানুকে গত মাস দেড়েক না দেখতে পাওয়ার আকুল শিশুতোষ প্রশ্নবাণে ভরা থাকে। রাইয়ান কথা বলতে পারে না। আমি এখনো মা ডাক শুনিনি কিন্তু আশা ছাড়িনি। মা ওকে একটা বোবাদের স্কুলে আনা নেয়া করেছে এতদিন আর আমি ওর মুখে বোল ফুটলেই সামনের গলির নার্সারী স্কুলের ভর্তি ফরম আনবো ঠিক করেছি। মায়ের সঙ্গে একটা অলিখিত চুক্তি ছিল যে আমার অনার্স ফাইনাল না শেষ হলে সে গ্রামের বাড়িতেও বেড়াতে যেতে পারবে না। সেই মহিলা যে মৃত্যুর মতো চিরবিচ্ছিন্নকারী প্রজেক্টের ফাইনাল ফেইজ হাতে নিয়ে বসেছিল, চুক্তিভঙ্গের শাস্তি আমি তাকে কেমন করে দিই?
চোখা রোদ বলে দিচ্ছে আজকের বিকেল নরম হতে দেরী হবে। যাবো তুরাগ নদীর কাছে, ঠিক নদীর কাছে না, আরো অনেক আগে আমাকে নামতে হবে। মা খালারা নাকি তুরাগের পার বলতো, তাদের ছোটবেলায় হয়তো নদী ঘরের কাছে ছিল। সময় পার হয়ে গেলে শৈশবের সব নদীই দূরে চলে যায়। হাতে গোনা দু একবার গেছি, তবু নদীর পারের নানার বাড়ি বলতে ভালো লাগে। সেখানে ছোট খালা থাকেন। তার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি, মায়ের জানাজা, কুলখানির ব্যস্ততায় তাকে দেখতে যাওয়ার ফুরসত হয়নি আমার। আজকে ভোর থেকে মনে হচ্ছে যেতেই হবে। না গেলে, আলো আর অন্ধকারের মাঝখানের শূণ্যতা আমার পিছ ছাড়বে না। আমার চারবছরের ছেলে, তার বড়মনের ছোটলোক বাপ আর আমার নিজের বেসামাল ভার নিয়ে আমি এখন কি করবো? —খালা ছাড়া আর কে বলতে পারবে আমাকে?
ছুটির দিনের বিকেল, সি এন জি, মোটামুটি ফাঁকা রাস্তায় ডাঁটের সঙ্গে দৌঁড়ায়। রাইয়ান আমার কোল ঘেষে বসেছে। ওর হাতে ওর প্রিয় ছবির বই, গ্লসি পেপারে পশু-পাখির জীবন্ত প্রিন্ট, ছবিগুলো ওকে খুশী রাখে, আঙ্গুলের ডগায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। আর আমি আহ্! গত কতদিন কোথাও যাওয়ার সময় এমন নির্ভার হয়ে বসিনি! কোন ভয়ভীতি নেই, উল্টোপাল্টা অজুহাত বানাতে হবে না, হ্যাঁ খালার বাসায়ই তো যাচ্ছি। ড্রাইভার ছেলেটি ভাসাচক্ষু, রোগা চোয়াল জুড়ে চোয়াড়ে ভাব, অল্প বয়েসী। গলা রাজহাঁসের মতো লম্বা করে আমার বলতে ইচ্ছে করে- “ যে খালার বাসায় যাইতেছি সেই খালা জন্মান্ধ, আমাকে সে দেখতে পাবেনা, আমিই খালি দেখবো”। সি এন জি তে ওঠার আগে তার সঙ্গে আমার ঠিকানা সংক্রান্ত কথাবার্তা হয়ে গেছে, আমি শেষ গেছি বছর চারেক আগে, তাও মায়ের সঙ্গে নিজের মাথায় একরাশ আচ্ছন্নতা নিয়ে। এই ড্রাইভারও আগে সরাসরি আজিমপুর থেকে গাজীপুর যায় নাই। তারপরও লম্বা রাস্তা ভাড়া বেশী, এইসব ভেবে রাজী হয়েছে। চেনে কিনা জানতে চাইলে বলেছে— “জিগায়া নিতে হইবো”। ঢাকা শহরের আশপাশ খুব দ্রুত বদলায়— এটা জেনে বুঝেই আমি তারপর রাইয়ানকে নিয়ে শিকের দরজাটি টেনে সামনে ছিটকিনি আটকে সুরক্ষিত হয়ে, ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে বসি। ছেলেটা মাথা ঘোরায় না, ওর সোজা শক্ত চুলের নীচে শীর্ণ কালো ঘাড় দেখে পত্রপত্রিকায় গলা কেটে খুন-খারাবির সংবাদ মাথায় আসে।
—“ আপ্নেই খালি দেখবেন এইটা ক্যান মনে করতেছেন? কানা মাইনসেও দেখে, তাদের চউখ আরো পরিস্কার বুঝলেন?”
কে কথা বললো? ড্রাইভার তো সোজা সামনে তাঁকিয়ে চালাচ্ছে। ওর ডানদিকে স্পিড-মিটারের কাটা গাই গুই-গাই গুই করে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে ওপরে। এখনো গ্রীনরোড পার হচ্ছি, বনানী, কামাল আতাতুর্ক য়্যাভিনিউ আরো দূরে। শহরে দিনের মারমুখী চেহারা একটু একটু করে ম্লান হচ্ছে। মাথার ভেতর সদ্য মুখচেনা সি এন জি ড্রাইভার কথা বললে খারাপ লাগে না, ইষৎ বিস্ময় নিয়ে আমিও জবাব খুঁজতে তৎপর হই। রাইয়ান মাথা কাৎ করে রাস্তাঘাটের বাজিমাৎ দেখে।
রওনা দেয়ার আগে ষ্টীলের আলমারী খুলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। খালার জন্য মায়ের একটা শাড়ি নিতে চেয়ে কোনটা নেব স্থির করতে পারছিলাম না। খান কয় শাড়ী থেকে সবচেয়ে ভালোটা দিয়ে দিলেই কি যাবে আসবে? অন্ধ মানুষের রং দিয়ে কি কিছু যায় আসে? জিজ্ঞেস করে পরে দিলেই হবে— ভেবেছি। তারপর অবশ্য নিয়েই নিলাম। অন্ধরা মনে হয় রঙ নিয়ে ভাবে। যার যা অভাব তাই নিয়েই তো মানুষ ভাবে বেশী। কিন্তু ঐ যে আবার, যে লোক জীবনে ক্যাসেট প্লেয়ার চোখেই দেখে নাই, সে ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনার অভাব বোধ করবে কি ভাবে?
—“আপনে এইরকম ভাবতেছেন ক্যান? অন্ধ মাইনসে তো সারাসময়ই রং এর কথা শোনে আর তাদেরও সৌন্দর্য জ্ঞান থাকতে পারে, বেশীই থাকতে পারে…”
সোজা ঘাড় আর শব্দ উচ্চারণের ধরনে কথোপকথনকারীকে নিয়ে আমার সংশয় বেড়ে চলে। এই সি এন জি ড্রাইভার আসলেই কি আমার সঙ্গে কথা বলছে?
—‘ না মানে, আমি অন্যভাবে ভাবছিলাম, স্বামী কি রঙের শার্ট পরলো খালার তাতে কি আসলো গেল? অবশ্য এইটাও ঠিক যে মেয়েদের পছন্দ নিয়ে আমাদের আগের জেনারেশনে কতজনই বা মাথা ঘামিয়েছে? কিন্তু আরো কংক্রীট কোন উদাহরণ— এই যেমন কাজের বুয়া তরকারীতে হলুদ দিলো নাকি শাদাই রান্না করলো সেই ফারাক খালা বুঝবে কিভাবে?’ নাহ এটা খুব গ্রহণযোগ্য যুক্তি হলো না— অন্ধের দৃষ্টি তাদের আর সব ইন্দ্রিয়তে ভর ক’রে সেগুলোকে আরো তীক্ষ্ণ করে, কাজেই এসব বোঝা কঠিন কিছু না।
রাস্তাঘাট অচেনা হতে শুরু করেছে। সি এন জির শিকের বেড়ার ফাঁকে রাস্তার সাইনবোর্ড পড়তে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখতে হয়, বিরক্তি লাগে। আপাতত সোজা হয়ে বসে চোখ খুলতে হলে খুলব, নইলে বন্ধ রাখবো। খালার বাড়ির কাছাকাছি হলে দেখা যাবে। রাইয়ান অবশ্য কোলের কাছ থেকে ঘন ঘন আলগা হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বাইরে দেখতে চায়।
খালার সাথে মায়ের ফোনালাপ হতো, খুব ঘন আর নিবিড় টান সমৃদ্ধ কথাবার্তা। ভাসা ভাসা যেভাবে জানি, মা কোনো কোনো খুচরো— নাতিদীর্ঘ প্রসঙ্গে যেমন বলেছে। খালার গল্প করতে চাইলে আমিই মাকে থামিয়েছি, একমাত্র মেয়ের কথা শোনার সময়ও তো তার থাকতে হবে, আসল কথা হলো— ওই সব গল্প আমার ভালো লাগতো না। তাদের সংগ্রহের সব স্মৃতিতে আমার নিজেকে অযাচিত মনে হতো। ইন ফ্যাক্ট, মৃত্যুর আগে আমার চক্ষুস্মান মা তার শেষ ফোনকলটা ঢাকা শহরের আমাদের সব আত্মীয় পরিজনকে অচ্ছুৎ রেখে এই খালাকে করেছিলো। এর কাছে মায়ের শেষ কন্ঠস্বর স্মৃতিবন্দী হয়ে আছে। আমিও ধারে কাছে ছিলাম না, আমাকেও ফোন করে নাই, সে কি যাওয়ার আগে সহোদরার চির অন্ধকারময় জগতের সঙ্গে একাত্মতা জানাতে চেয়েছে? আর একটা জিনিষ করতে দেখেছি মাকে, রাইয়ানের কানে ফোন দিয়ে ওকে বারান্দার মোড়ায় বসিয়ে দিয়েছে, সে চুপচাপ অনেকক্ষণ শুনেছে, কি বলতো খালা ওকে?
এয়ায়পোর্ট ছাড়িয়ে সিন এন জি এ সময় উর্ধ্বগতির সরীসৃপ হয়ে উঠেছে। খালার বাসা বেশী দূরে না। মায়ের কাছ থেকে শোনা ছিটেফোটা কমেন্টস জোড়া দিয়ে পুরো ছবি চোখে ভাসে আমার। ঘরের শ্যাওলা সবুজ দেয়ালে ওৎ পাতা গভীর নিস্তরঙ্গ আলোর সামনে বসে খালা কি টিভি দেখে? রঙ্গীন টেলিভিশন! চ্যানেল বদলায় আর কিংখাবের ঢাকনা দেয়া পানবাটা থেকে পান খায়! খালার গায়ে মা তার মায়ের গায়ের গন্ধ পায়। সেই গন্ধ তারবিহীন টেলিফোনের সংযোগ বেয়ে এপাশে আমাদের আজিমপুরের বাসায় এসে বন্ধ দরজা দিয়ে ঢোকে। তারা দুজন তখন দুই শহরের দুই প্রান্তে বসে ধারাবাহিক নাটক নিয়ে মেগাসিরিয়াল জাতীয় কথোপকথনে মাতে। সেখানে অকস্মাৎ তাদের স্মৃতিবাহিত শৈশবের চরিত্রের সঙ্গে পর্দ্দার চরিত্রের মিল খুঁজে পেলে দুইবোন একযোগে আপ্লুত হয়। হঠাৎ ফোনে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে খালা হয়তো আবার হাতড়ে হাতড়ে নম্বর টেপে, ফোনের নয়তো টিভি রিমোর্টের। টিভি থেকে অথবা মোবাইল থেকে একই গানের সুর ভেসে আসে। খালা তখন কোনটা টিভির রিমোট আর কোনটা মোবাইল তার তফাৎ করতে পারেনা। স্থির মূর্তির মত বসে থাকলে তার অন্ধ চোখের মণি কেঁপে কেঁপে আরো শাদা দেখায় আর খালা পরম মমতায় দুটো যন্ত্রনির্ভর হাত আঁচল দিয়ে অবিরত মুছতে থাকে।
কোন কোন দিনে বাড়ির বাইরে উঁচু গলার ফেরিওয়ালা—“দাও বটি ধার দিবেন নি…” বলে হেঁকে যেতে থাকলে বোঝা যায় গলিতে ঠিকানা চিহ্নিতকারী নারকেল গাছ দুটোর ছায়া খর্বকায় হয়ে এসেছে। খালা উঠে রান্নাঘরের মেঝেতে টাল করে রাখা শাকসব্জির পাশ থেকে ধারহীন ছুরি, বটিগুলো হাতে নিয়ে মেইন গেইট খুলে বেরিয়ে আসে। ফেরিওয়ালা গলির মাথায়, খালা তার বিপরীত দিকে টলোমলো হাত নেড়ে ডাকে। তখন তাকে খোলা ধারালো বটি হাতে রণরঙ্গিনী মূর্তির মতো দেখায়, গলির লোকজন ভয় পেয়ে চিৎকার শুরু করে— “কানি বুড়ি মানুষ মারতে বাইর হইছে”। খালাকে একদঙ্গল ভীড়ের মানুষ কোরাসে ‘কানি ছেমড়ি’ থেকে ‘কানি মাইয়া’ থেকে ‘কানি বেটি’ থেকে ‘কানি বুড়ি’তে রূপান্তরিত করতে থাকে। সেই ভীড়ের ভেতর আমি নিজেকে কাতর কম্পনরত দেখতে পাই, দলা দলা ভয় পিড়পিড় করে বেয়ে আমার গলায় উঠে আটকে থাকে।
নানার বাসার ছোট বসার ঘরভর্তি লোকের মধ্যে আমার ঘেমে ওঠা নাকের সামনে খালা ছেলেটার চুলে হাত বুলিয়ে, কপাল মসৃণ হাতে লেপে, নাকের উঁচু নীচু ঢাল ইত্যাদি গভীর নিরীক্ষকের আঙ্গুলে ছুঁয়ে দেখে রায় দিয়েছিল-‘ ভালো, খুব বড় মনের মানুষ। বিয়া দেও’। তারপর সে রাতেই আমার আকদ হয়ে গেল। আমি তারপর নিজের বাসায় ফিরে তিন সপ্তাহ বড় মনের মানুষটাকে দেখলাম তারপর সে তার মন নিয়ে সাত সমুদ্রের পারে চলে গেল, আর আমার ভেতরে তার চিহ্ন রেখে গেল। কাগজপত্রের কি জটিলতায় সে আমাদেরকে নিজের কাছে নিতে পারছে না। রাইয়ানের দু মাস বয়স থেকে এই বড়মনের মানুষ আমেরিকায় বসে ছোটলোকি করে যাচ্ছে। ছোটলোকি মানে আমি প্রেগন্যান্ট বলে সে আমার পড়া বন্ধ করতে চাইলো। খুব কাকুতি মিনতি করে এইচ এস সি দিলাম। ভালো রেজাল্টের ফটোকপি পাঠিয়েছিলাম। ফোনের ওপাশে কাষ্ঠ হাসির সঙ্গে পড়াশোনা রদের আদেশ জারী হলো। ওখানে গেলেতো কাজ হবে হয় ফ্যাক্টরী না হয় গ্রোসারী ষ্টোর। লেখাপড়ায় জাহাজ হওয়ার কি দরকার? খুবই যুক্তিযুক্ত কথা। কিন্তু আমার তো ততদিনে একটু চোখ ফুটে গেছে, ফোঁকর গলে বাইরের দৃশ্য দেখা গেলে খোলা জানালা দিয়ে দেখার সাধ যে বেড়ে যায়। আমার কান্নাকাটি দেখে মা তার অন্ধ বোনের সঙ্গে আবার শলা পরামর্শ করে। খালা তার শাদা চোখের মণিতে তরঙ্গ খেলিয়ে আপ্তবাক্য দেয়, “আমরা যা পাই নাই মেয়েকে তা দিতে পারাই তো সার্থকতা” মেনে নিয়ে মা আমার বুক ধুক পুক বজ্রপাতের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে আমাকে ভর্তি পরীক্ষা দিইয়েছে। নাই নাই করে ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে আমি গুপ্তবিদ্যাধারীর মত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ফাইনালও দিয়ে দিলাম। ঢাকা শহর ভর্তি আমার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় স্বজন। খালার পরামর্শে আমি বোরকায় আপাদমস্তক ঢেকে ক্লাশে যাই। দিবা রাত্রির চক্রও সহায়ক থাকে আমেরিকায় দিন হলে ঢাকা শহর ঘুমে বিভোর। খালার বুদ্ধিতে ধরা পড়িনা, আর ধরা পড়িনা বলে আমার খালার ওপরে বিশ্বাস বাড়ে, হেলেঞ্চা শাকের মত নির্ভরতা তির তির কাঁপে। কিন্তু একদিন ধরা পড়ে গেলাম, রাইয়ান তখন তার স্পেশাল স্কুলে ছবির বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দু চোখে বিস্ময় জাগাতে শিখে গেছে।
মা খালারা পরস্পর পরস্পরের বাড়ি যাবেই। কিন্তু খালা কখনো আমাদের বাসায় আসে না। কিন্তু অন্ধরা কি যায়না কোথাও? নিশ্চয়ই তারা ভ্রমণ করে, ভ্রমণ তাদেরকে অলৌকিক চাঁদের গুহায় নিয়ে যায়— এমন কিছু কি কোথাও পড়েছিলাম? কালে ভদ্রে, সুখের দুঃখের উছিলাগুলোতে খালা নিশ্চইয়ই কারো হাত ধরে সিঁড়ি ভেঙ্গে আমাদের বাসায় এসেছে। বারান্দায় যক্ষ হয়ে বসে থাকা পুরান চেয়ারটায় কেউ বসিয়ে দিয়ে গেলে সে উঠে দাঁড়িয়ে গ্রীলের ফাঁকে হাত বাড়িয়ে বাতাসের রেনু ছোঁয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। পাশে হয়তো আমার মায়ের হাত, দৃষ্টিবিহীন আর চক্ষুস্মান দুই সহোদরার হস্ত স্পর্শ, এদের অনুচ্চ কন্ঠস্বরের নিবিড় দোল কেন কখনো আমার চোখে পড়লো না? আমি ভার্সিটিতে ক্লাশে, নইলে আর কোথাও গেছি সব সময়! খালার মুখ সময় সময় তাই আমার কাছে পরিস্কার হয়ে ফোটে না। আবছা ফটোর মতো শুধু চোখের ধুসর কোটর দেখা যায়, সে কোটরের গহীনকে মনে হয় গভীর ঘুমন্ত জলপ্রপাত। মা প্রায়ই আমাকে তার মোবাইল হাতে ধরিয়ে দিয়েছে, ওপাশে খালা। ফ্যাশ ফ্যাশে নীচু সুদুর এক কন্ঠস্বর। দুই তিন বাক্য পূনরাবৃত্তি করে ছটফট করে ছেড়ে দিয়েছি। খালার প্রতি একরকম ভয় আমার ভেতরে ল্যাবের ভাইরাসের মতো অতি ধীরে বড় হয়, প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়ে। মনে হয় আঙ্গুল ছুঁতে দিলেই খালা কোন অতিপ্রাকৃত শক্তি চোখের ভেতরে ধারণ করে আমার ভেতর দেখে ফেলবে। মা বলে- “দ্যাখ, ওকে দেখলে কে বলবে অন্ধ? … আর তুই যখন পেটে তখন ও আমার পেট হাতায়া না দিলে ঘুমাইতাম না আমি…” মা তখন মোড়ায় ঢিলেঢালা হয়ে বসে, আর খালা কাঠের চেয়ারে সিনেমার নায়ক-নায়িকা সংবাদ-পাঠ শোনে আর মায়ের মাথার ঢেলা উকুনগুলো হাতড়ে হাতড়ে হারিয়ে ফেলে। সামনের অপরিসর শূন্যে তার শাদাটে চোখের বিকল মনি নিক্ষিপ্ত হয়ে নাক চোখ, মুখ বসিয়ে নায়িকার কল্পিত মুখ আঁকে। মায়ের টুকরো টুকরো গল্প এক ফিতায় ধরার চেষ্টা করি আমি।
এয়ারপোর্টের কাছে ওভার ব্রীজ পার হয়ে গেলে ড্রাইভার আমাকে বলে কোন দিকে যাব? প্রায়াতিক্রান্ত এই বিকেলের ভীড়ে আমার মন বলে বাঁয়ে, আর হাত স্বয়ংক্রিয় উঁচিয়ে তাকে ডান দিক দেখায়। ডান দিকে ভরন্ত নদীর বাঁকের মতো টইটম্বুর পথের বাঁক, কালো পিচের চাদর ঢাকা। সি এন জি ঘুরে ডাইনে এলে কোন ফ্যাক্টরী, গার্মেন্টস হতে পারে, তবে ছাদের ওপরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে মনে হয় অন্য কোন কিছুর উৎপাদন স্থল। একটু দূরে মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ, জার্সি গায়ে উৎসাহী তরুণেরা উদ্বাহু দৌঁড়ায়। রাইয়ান শিকের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়, ওর মনে হয় মাঠে নামতে ইচ্ছে করে। আমার কোলের ব্যাগে মায়ের ব্যবহার করা শাড়ি, খালার জন্য শেষ চিহ্ন। বের করে শাড়িটা দেখি, ছোট চেক, বুটি। শিকের একপাশ দিয়ে ফৎ ফৎ বাতাস এসে মায়ের ঘ্রান-গন্ধী শাড়ি উড়িয়ে বাইরে নিতে চায়।
হঠাৎ খেয়াল করি দুপাশে কোন বাড়িঘর, মানে, আবাসিক এলাকা দেখা যায় না। আছে, তবে দূরে। খালার বাড়ি তো রাস্তার লাগোয়া কোন গলিতে। এখানে একটু ক্ষেত, সরকারী কোনো অধিদপ্তরের একমাপের দোতলা বিল্ডিং বাড়ি। হয়তো এগুলো পার হয়েই খালার বাড়ি, ইপ্সিত সবুজ দেয়ালের ঘর। কিন্তু এখানে দেখি তিন রাস্তার মোড়! তীর চিহ্ন দিয়ে একদিকে অচেনা জায়গার দিক নির্দেশ। সি এন জি ঘ্যাচ করে থেমে যায়— “অহন কোন্দিক যামু?’
— ‘আপনার না ওভারব্রীজের উল্টাদিকে যাওয়ার কথা?’
আমি ভেতরের শংকার স্বেদ চেপে চেপে শুকিয়ে ফেলতে চাই।
— ‘আপা, উল্টাদিকেই তো আইছি। অহন কই যামু?’
— ‘আরেকটু সামনে যান দেখি— সোজা যান সোজা’।
সোজা গেলে পথের দুধারে গাছ শুরু হয়। এক একটা করে গাছ গুনি। সোজা রাস্তা বাঁক নিতেই সূর্য তার ছায়া পেছনে ফেলে ডুব দিতে চায়। সামনে লালচে আকাশের আঁচ মেখে একটা সাইকেল সারাইয়ের দোকান, পাশে ছোট্ট চায়ের স্টল, দুটোরই ঝাঁপ তুলে লম্বা বাঁশে ঠেকা দিয়ে রাখা। সি এন জি থামলে চায়ের দোকান থেকে একজন বেড়িয়ে আসে। আমি গুইসাপের সতর্কতায় শিকের দরজা ঠেলে চোখ, মাথা বের করি। তারপর ঠিকানা লেখা কাগজটা।
— এইটা ভাই’… সে সি এন জি ওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘পুরা উল্টাদিকে। ঘুরায়া যান, ওভার ব্রীজ পার হইবেন, মনে হয় পয়লা গল্লি’।
সি এন জি গিয়ার চেপে রিভার্স করে, তাল সামলাতে রাইয়ানকে নিজের দিকে টানতে হয়। বাতাস শোঁ শোঁ করে বিকেলটা বুড়ো বানিয়ে তুলছে।
ওভারব্রীজের পরের প্রথম গলিতে কাঁচা বাজার। রাস্তার ওপরে সব্জির ভ্যান, এয়াল্যুমিনিয়ামের চ্যাপ্টা পাত্রে অল্প পানিতে এই বিকেলেও গা ঘষটে মন্থর অস্থিরতা প্রকাশরত জিয়ল মাছ। ঠেলার ওপরে হাঁপিয়ে ওঠা শাকসব্জি আর এলে বেলে রিক্সার ভীড়। একটু এগিয়ে আবারো ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে হয়। এবার আমি নামি। ফার্মেসীর বয়স্ক ভদ্রলোক লাইট জ্বালিয়ে দোয়া পড়ছেন। দোকানের সামনে সচল, শব্দউদ্গীরণকারি সি এন জি রাইয়ানকে নিয়ে অপেক্ষা করে। ভদ্রলোক তার নামাজ শেষ করেছেন, চেহারায় সেই স্বস্তি মাখানো। মাথার টুপি খুলে রেখে আমার ঠিকানা লেখা কাগজটা দেখে নিশ্চিত করেন যে আমি সম্পূর্ণ উল্টোদিকে এসেছি। আমাকে ওভারব্রীজ পার হয়ে আবারো অন্যপাশে যেতে হবে। কিন্তু ঐপাশের লোক যে বললো?
—“আরে ধুর, এই সব রাস্তাঘাটের মানুষে এলাকা চিনে নাকি?” ভদ্রলোক অভিজ্ঞতার হাসি হাসেন।
সি এন জি ওয়ালাকে আবারো উল্টোদিকে যেতে বলি। পূর্বাপর দৃশ্যপট অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। সাইকেল সারাইয়ের দোকানে লম্বা তারে লাইটের বাল্ব ঝোলে। সেই লোকটা তখনো চায়ের দোকানে, চোখের রোদ চশমা মাথার ওপরে উঠে আসায় তাকে একটু অন্যরকম দেখায়। এবারও আমি নামি, ঠিকানার আরো নিশ্চিত দিক নির্দেশনার আশায়।
— ‘আপনেরা কাউলা বাজারে আইসা এই জাগা বিচরাইতাছেন ক্যান? হ, এই জাগার নাম কাউলা বাজার। এইখানে কেউ আব্দুল্লাপুর বিচরায়? হোনেন আফা আপনে যেইখানে যাইবেন তাগোরে মোবাইল দেন, নাই মোবাইল?
ঘোর ভেঙ্গে সম্মিত ফিরে আসার মতো আমার চমক ভাঙ্গে। তাইতো, মা’র মোবাইল তো সেই ইস্তক আমার ব্যাগেই আছে, এখনো সীম যেমনকে তেমনই আছে। আমি দোকানে ঢুকে আলোতে ব্যাগ হাতড়ে মোবাইলটা বের করি। খালার নাম প্রথম দিকেই। আমার মুখের দিকে সেই লোকটা আর দোকানদার অস্বস্তিকর চাউনি ফেলে রাখে। সি এন জি অলা বেহদ্দ বিরক্তি নিয়ে বসে আছে, রাইয়ানের চোখে মুখে ক্লান্তি আর বলতে না পারার অস্থিরতা। সুদূর ফ্যাস ফ্যাসে কন্ঠ ভেসে আসলে আমি ডাঙার মাছ ফের পানিতে পড়ার আনন্দ পাই, হঠাৎ খালার কন্ঠ এত ভরসা যোগায়! খালা অপেক্ষা করে আছে, কেন এখনো পৌঁছাচ্ছি না। ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছিনা শুনে খালা বলে খুব সোজা। আমি তাকে সরাসরি সি এন জি ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে বলি, কেন না সেই আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে। শিকের চৌখোপ দিয়ে মোবাইল হস্তান্তর করলে ড্রাইভার এককানে আঙ্গুল দিয়ে কথা বলে। দু এক বার হু হ্যা বলার পর সে আমাকে মোবাইল ফিরিয়ে দেয়।
-‘আপা, কি জাগার কথা কয় কিছুই তো বুঝতে পারি না’।
আমার কানে তখন খালা ফিস ফিস করে জোড়া নারকেল গাছের কথা বলে যায়। তাদের কোনাকুনি আর আড়া আড়ি পাতার ধাক্কা খাওয়া বাতাস গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজে মিশে যে গলিতে অন্যরকম শব্দ তৈরী করে, যেখানে মোড়ের বাঁক নিলে এক দঙ্গল শিশুর কলকলানি কানে আসে, সেটা নাকি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গলি দিয়ে রকমারী ফেরীওলার বর্ণিল কন্ঠ ভেসে আসে, হাঁকগুলি স্তিমিত হতে হতে মিলিয়ে যেতে থাকলে বুঝতে হবে গলির শেষ মাথায় পৌঁছে গেছে বিক্রেতা। পঁচিশ কদম এগোলে মুদিদোকান থেকে হিন্দি গান ভেসে আসে… ‘ দূর তক আপকি পিছেএ এ… পিছে এ এ… মেরি আওয়াজ চলি যায়েগি…’ প্রতিদিন তারা একটা গানই বাজায়। খালার তখন দূরের কোনো বাউলরূপী ছায়ার পেছনে ছুটে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
আমি খালাকে আবারো সরাসরি সি এন জি’র ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে বলি। হাজার হলেও রাস্তাঘাট চরানো মানুষ, অল্প ইঙ্গিতেই হয়তো বুঝবে। ড্রাইভার দুই চার কথার পরে আমাকে মোবাইল দিয়ে বলে- “উল্টাদিকে যাইতে হইবো”।
দোকানের লোকটাকে মোবাইলের আইডিয়াটা দেয়ার জন্য ধন্যবাদ দিই। ওভারব্রীজের ওপারে কাঁচাবাজার তখনো বিজ বিজ শব্দে সজাগ, চলমান। আমরা আরেকটু ভেতরে যাই, কিন্তু ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসা রাস্তা দেখে ঠাওর করা যায় না— কোথায় এলাম। দুজন লোককে দাঁড় করিয়ে জানা যায়, — এদিকে কোন আব্দুল্লাপুর নেই। হয়তো ওভারব্রীজের উল্টাদিকে। আরেকবার খালাকে ফোন দিলে খালা জানায়— ওভার ব্রীজের উল্টাদিকেই তো কিন্তু ডান দিকে না বাঁদিকে সেটা খালা নিশ্চিত নয়। তার কাজের বুয়া ওভারব্রীজের কাছে কোনদিন আসে নাই। এই মূহুর্তে বাড়ির ঠিকানা চেনানোর মতো নির্ভরযোগ্য কেউ নাই। আচ্ছা আব্দুল্লাপুর কি কাউলা বাজার পার হয়ে? মাথার প্রকোষ্ঠে স্থানের নামগুলো পর পর সাজিয়ে খালা বেড়ে উঠেছে, কিন্তু কাউলা বাজার পার হয়ে আব্দুল্লাপুর নাকি তার উল্টোদিকে খালা জানে না। আমি তবু সি এন জিকে আরেকবার জোর করি উল্টোদিকে যাবার জন্য এই শর্তে যে এবার খুঁজে না পেলে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য থাকব।
আমার খালার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়া খুব দরকার। মাকে এতকাল পরামর্শ দিয়ে আমার ভবিতব্য নিয়ে চাল দেয়া গুটির পেছন পেছন আমি হেঁটে যাচ্ছি। এখন মা নেই, আমার বোরখা পরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিদ্যা দিয়ে বোবাছেলে নিয়ে আমি কোন আমেরিকার পথ চেয়ে বসে থাকবো? খালা কি তার নাই চোখের দিব্যদৃষ্টি দিয়ে আমার জন্য কোনো সুরক্ষিত বর্ম তৈরী করে দেবে? অন্তত বলে দেবে!
সি এন জি অলা যারপর নাই ত্যাক্ত। তার মিটারের কাটা অন্য সময় হলে আমার মাথা ধরিয়ে দিতো। আজকে যথেষ্ঠ টাকা নিয়ে বের হয়েছি। ঠিকানায় পৌঁছালে বেশীটাকা দেয়ার কথা বার বার আশ্বস্ত করার পরেও ওভার ব্রীজের নিচে গিয়ে সিএন জি থামিয়ে দেয় ড্রাইভার, আর যাবে না। ব্রীজের গোড়ায় ঘরমুখী মানুষের অবিন্যস্ত চলাচল। সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে গাড়ি বাস পার হয়ে যাচ্ছে। আমি দু একবার প্রলোভন দিই— টাকা বাড়িয়ে দেয়ার। ড্রাইভার ক্লান্ত, আর কিছুতেই যাবে না। আমার রোখ চেপে যায়। শিকের ভেতর দিয়ে তার আধময়লা শার্ট টেনে আমি চিৎকার করে উঠি, —“খবরদার নামতে বলবেন না। এই ঠিকানা খুঁইজা বাইর করতেই হবে, তা না হইলে আমি চিৎকার কইরা লোক জড়ো করবো, চালান এখন, উল্টাদিকে যান…”। সি এন জি ওলা বিতৃষ্ণ চোখে হ্যাণ্ডেল ঘুরায়, রাইয়ান আমার কোনে মাথা এলিয়ে দিয়ে ক্লান্তির শেষ চিহ্ন দেখায় আর আমার মাথা চক্কর দিয়ে চারপাশ কালো ছাইবর্ণ হতে আরম্ভ করে।