মীজান রহমান
ইচ্ছে করেই বাতিটা জ্বালিনি। অন্ধকারই ভালো। বেশ লাগে মাঝে মাঝে। নিজেকে একা পাই। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। বিশেষ করে আজকের মতো বৃষ্টি। সেই যে সকাল থেকে শুরু হয়েছে থামবার লক্ষণ নেই। দেশের ভাদ্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। ‘এ ভরা ভাদরে মাহ ভাদরে শূন্য মন্দির মম’। আমি বলি ‘শূন্য হৃদয়’। আজকের বিধুর বিধুর বর্ষায় হৃদয়ের শূন্যতাখানি ভালো লাগে। এতে আলোটা মানায় না। ক্যানাডার রাজধানীতে অন্ধকার এক দুর্লভ বস্তু। দুর্লভ এখানে ডোবার জলে ভেকের ডাক, ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝিঁপোকার কিচিরমিচির।
আমার স্ত্রী বেঁচে থাকাকালেও আমি এমনি করে আলো নিভিয়ে রাখতাম মাঝে মাঝে। ও বিরক্ত হত। ভাবত আমি খরচ বাঁচাবার জন্যে জ্বালছিনা। হাসতাম। আর যাই বল প্রিয়ে, খরচের মতো একটি স্থূল বিষয়ের প্রসঙ্গ তুলো না আজকে, দোহাই তোমার। আজকে বড় সুন্দর দিন। দেখনা এমনিতেই কত আলো। বৃষ্টির আলো। অন্ধকারেরও নিজস্ব আলো আছে, সেটা লজ্জাবতী তৃণের মতো বুঁজে যায় আলো জ্বলার সাথে সাথে।
ও আমার প্রলাপ শুনে মাথা নেড়ে হয়তো ভাবত পাগলটার মাথা জীবনেও ঠিক হবে না।
আচ্ছা বলুন তো, গত সপ্তাহে সেই যে বিশাল হার্ভেস্টমুন, মনে হচ্ছিল আকাশভরা হাজারদশেক আতসবাতি জ্বলে উঠেছে একসাথে, জানালায় এসে আমাকে অভিবাদন জানালো, সেটা কি দেখা সম্ভব হত আলো জ্বললে? হত না। প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে চাইলে প্রযুক্তির কাছ থেকে কিছুটা দূরত্ব রাখার প্রয়োজন হয়।
জানি কি বলবেন আপনি। লোকটা বুড়োবয়সেও নতুন-প্রেমে-পড়া কিশোরের মতো কথা বলছে। কথাটা আমি পুরোপুরি অস্বীকার করবনা, লজ্জা বা বিব্রতবোধ তো একেবারেই না। আমি আসলে প্রতিদিনই নতুন করে প্রেমে পড়ি। যেখানে যাই সেখানেই একটু একটু করে প্রেমে পড়ে যাই। কোনও বিশেষ ব্যক্তির প্রেমে নয় যদিও। হ্যাঁ, কৈশোরে তাই হত বইকি। প্রেমে পড়া মানেই ছিল একটি বিশেষ মানুষ যার কথা ভাবতেই মন কেমন করত, তাকে কাছে পাবার এক অদম্য স্পৃহা প্রাণমন আড়ষ্ট করে ফেলত। কিন্তু আজকের প্রেমে সেই বিশেষ ব্যক্তিরা সব আড়ালে চলে গেছে, স্মৃতির সিন্ধুতে পারিজাতের আকার নিয়েছে। তারা এখনও দেখা দেয় মাঝে মাঝে, ঘন অন্ধকার যখন চেতনাকে জড়িয়ে ধরে চাদরের মতো, যখন বৃষ্টির ঝাপটাতে জানালার কপাট কাঁপতে থাকে। আজকে এই বিপুল পারাবারের শেষ ঘাটেতে এসে পৌঁচেছি আমি, একা, শূন্যহস্ত, শূন্যহৃদয়। তবুও মন বলে আরো দাও। আর একটুখানি অপেক্ষা করো হে বিশ্ববিধাতা, আর একটিবার আমাকে প্রেমে পড়তে দাও। আর একটিবার যেন আমি অশনির ঝলকে চমকে ওঠার শক্তি পাই।
বৃষ্টি এলে এই হয় আমার। প্রেমে পড়ে যাই। সেই প্রথম যৌবনের মতো। ইচ্ছার পাখিরা দূর সমুদ্র থেকে উড়ে এসে ডালে বসে, ভেজা শরীরে। বৃষ্টিতে আমার মন ভাসে, চোখ ভাসে, দেহ ভাসে। আমি বৃষ্টিধোয়া দুর্বার মতো জেগে উঠি। দীঘির জলের মত আন্দোলিত হই। আমার স্ত্রী বলত: You are an incurable romantic. Thanks, বলে জবাব দিতাম আমি। আমি রোমান্টিক না হলে তোমার খোঁপাতে ফুল গুঁজে দিত কে। কে বলত তোমাকে যে ফুলের জন্ম সার্থক হয়েছে বাঙালি মেয়েদের খোঁপায় বসার পর।
কিন্তু আজ, আজ এই দীর্ঘ পথের শেষে আমার প্রেমে পড়া কোনও ব্যক্তির সঙ্গে নয়, প্রেমেরই সঙ্গে। আমি প্রেমে পড়ি আমার স্মৃতির মধ্যে, পুরনোদিনের অশরীরি আত্মার ছায়াঘন বৃষ্টির মধ্যে, আমার রুদ্ধ জানালার গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে। আজকে আমি একলা ঘরের নিঃশব্দতায় নিজেকে হারাই প্রতিমুহূর্তে, নিজেকে পাই প্রতিমুহূর্তে। চাওয়াপাওয়ার শঙ্খচিলেরা তো কবেই চলে গেছে মহাসিন্ধুর অপর পারে। তবু আমি তীরে বসে মূর্তি রচনা করি। তার কাছে পুষ্পাঞ্জলি দিই, আনত হই বিনীত নম্রতায়। কে সেই উপাস্য মূর্তি আমার জানবে না তুমি প্রিয়তমা। সেখানে তুমি নেই, আবার তুমি ছাড়া আর কেউই নেই। সেখানে তুমি তুমিময় হয়েও তুমিশূন্য বিমূর্ততায় ভাস্বর। তোমাকে আমি নিজের মতো করে সাজিয়েছি এবার। এমনকি নতুন একটা নামও দিয়েছি। শুনবে তোমার নতুন নাম? সুন্দর—ছোট্ট তিন অক্ষরের নাম। এতকাল পরে আমি এই চিরসুন্দরের সাক্ষাৎ পেলাম তার সকল বিমূর্ততায়, তার অবয়বহীন পূর্ণতায় নিজের কল্পনার রঙমেশানো মূর্তি রচনা করে আমি সাঁঝের বেলার খেয়াঘাটে বসে আছি একা একা। অপেক্ষায়। তোমাকে কাছে পাবার অপেক্ষায়।
গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কিজের বিখ্যাত ‘Memories of my melancholy whores’ উপন্যাসের নব্বুই বছর বয়স্ক নায়ক তাঁর জন্মদিন উদযাপনের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন এক গণিকালয়ে। আসলে জন্মদিনটা ছিল উপলক্ষ্য মাত্র, সত্যিকার উদ্দেশ্য প্রেমের সন্ধান। জীবনভর নারীসঙ্গ তো ঢেরই পেয়েছিলেন তিনি, জৈবতৃপ্তির অভাব কখনোই ছিল না, তবু কেন সাঁঝের বেলার এই মূঢ় বাসনা। শেষ জীবনে হঠাৎ খেয়াল হল, নারী পেলেন বটে, দেহের ক্ষুধা মিটল অনেক, কিন্তু প্রেম? সে তো মরীচিকাই রয়ে গেল। গণিকালয়ের কোনও কিশোরীর বুকে যদিবা লুকিয়ে থাকে সেই অমূল্য মানিক্য, সেই আশা। বেছে বেছে সবচেয়ে সুন্দরি, অল্পবয়স্ক একটি সতেজ সরস তরুণীকে এনে দাঁড় করানো হল তাঁর সামনে। অভ্যাসমত মেয়েটি পরনের কাপড়চোপড় সব খুলে আদিম মূর্তিতে উপস্থিত হল বৃদ্ধের সামনে। ও বেচারির কাছে ছেলে-বুড়োর কি’ই বা তফাৎ—বেঁচে থাকার খাতিরে এই পেশাতে যোগ দেওয়া। তার কাছে ত্রিশ আর নব্বুই সব এক। কিন্তু নায়ক তার গায়ে হাত দিলেন না। শুধু তাকিয়ে থাকলেন এক বিহ্বল আবিষ্টতায়। সামান্য কটি মুদ্রার বিনিময়ে সাক্ষাৎ ভেনাস এসে উপস্থিত তাঁর সম্মুখে তার সকল লীলা আর লাস্যময়তায়। তাকে তিনি চর্মের স্পর্শ দিয়ে কলঙ্কিত করতে চাইলেন না। সারারাত জেগে জেগে মেয়েটির ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, এক অপার্থিব মুগ্ধতায়। এরই নাম কি প্রেম? এই অপরূপ কারুকার্যখচিত আদিম দেহ? এই ঝাঁঝাঁলো রূপ? প্রেম কি সেই পিপাসার নাম যার কোনও তৃপ্তি নেই? যার ধর্মই এমন যে যতই তার সুরা পান করবে তুমি ততই বৃদ্ধি পাবে তোমার তৃষ্ণার যন্ত্রণা? ঐ মেয়েটি জানল না এই যে বুড়োটি সারারাত বসে রইলেন তার শয্যাপাশে, আসলে তিনি অন্যত্র চলে গেছেন। যেখানে তিনি একেবারেই নিঃসঙ্গ, একা। হাজার প্রেমের মাঝেও তিনি প্রেম খুঁজে বেড়াচ্ছেন চিরকাল।
নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী এরুইন শ্রেডিঙ্গার কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্মদাতাদের একজন। পবিত্র কোরান পড়ার সময় যেমন বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতে হয় তেমনি শ্রেডিঙ্গার ইকুয়েশন দিয়ে শুরু করতে হয় আধুনিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার পাঠ। সেই মানুষটি কিন্তু চিরপ্রেমিকও ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনে। প্রেমিকাদের কাছে চিঠি লিখতেন কবিতায়। উপনিষদ আর গীতার দারুন ভক্ত ছিলেন। তাঁর বড় বড় আবিষ্কারগুলোর পেছনে প্রেমিকার উপস্থিতি ছিল প্রায় আবশ্যিক। না হলেই নয়। তাঁর জন্যে প্রেম ছিল জীবনীশক্তি—সৃষ্টির প্রেরণা। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর প্রেমের একটা স্থূল দৈহিক আবরণ হয়তো ছিল, কিন্তু প্রেমের সঙ্গে আসলে দেহের কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পূর্ণ বিদেহী জিনিস একটি। অতৃপ্তির কারণটাই এখানে—এটা না থাকলে সৃষ্টি বলে কিছু থাকত বলে মনে হয়না আমার। প্রেম হল একাধারে জীবনের সবচেয়ে সহজবোধ্য এবং সবচেয়ে দুর্বোধ্য বস্তু।