মোস্তফা সোহেল
কনে দেখতে এসে আনিসের কি রকম অস্বস্তি হলো। আনিস একা আসেনি। সঙ্গে এসেছে ওর বড় বোন শেগুফতা, মামা ফয়জুর রহমান আর বাবা সোবহান তালুকদার। আনিস কাল এসেছে আমেরিকা থেকে। সেন্ট লুইসের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে পড়ায় সে। ওর বাবা-মার জোড়াজুড়িতে একরকম বাধ্য হয়েই ঢাকায় আসতে হয়েছে। ঢাকায় এসেই এই বিপত্তি। পত্রিকায় ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। তিন কলাম তিন ইঞ্চি। সেই বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে সোবহান সাহেব ঘোষণা দিয়েছেন- সাতদিনে সাত মেয়ে দেখবো। তোকে এবার বিয়ে দিয়ে দেবো ইনশাল্লাহ। গতকালকের বিজ্ঞাপন দেখেই জয়ন্তীর বাবা ফোন করেছিলেন। আনিসের মামা ফয়জুর রহমান কথা বলে আজ সময় ঠিক করেছেন।
আনিসের মা পুরবী বেগম অবশ্য রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত আছেন। কারওয়ান বাজার থেকে বড় বড় পাঁচটা ইলিশ মাছ কেনা হয়েছে। বেঙ্গল মিট থেকে ফ্রেশ গরুর মাংস আনা হয়েছে। নন্দন থেকে বোনলেস খাসির মাংস আনা হয়েছে। মোহাম্মদপুর বাজার থেকে আনা হয়েছে টাটকা ছোট মাছ। এগুলো রান্নাবান্না করতে গিয়ে তিনি আর সময় করে উঠতে পারেননি।
আনিসের মনে হলো, মা আসেনি। ভালোই হয়েছে। কনে দেখতে এসে নিজের পরিবারের পুরো সদস্যরা যা করছে তা রীতিমতো হাস্যকর। সোবহান সাহেব বললেন, ‘আমার ছেলে হলো জাত ব্রিলিয়ান্ট। চারটে ফার্স্ট ক্লাস। আমেরিকাতে পিএইচ.ডি করে ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করেছে। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। বেয়াই সাহেব কী বলেন? ’
আনিস বুঝতে পারছে না এর মধ্যে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড– কথাটা কেন আসছে। ইররেলেভেন্ট।
আনিস ফিসফিস করে । মামা রাজনৈতিক নেতাদের মতো ভাষণের সুরে সুরে কথা বলেন। তিনি বললেন, ‘আমরা চাই খুব সাধারণ এক মেয়ে। যে মেয়ে হবে বাংলাদেশের শাশ্বত নারীর মতো কোমল এবং সুলক্ষণা। আজ এখানে এসে মনে হচ্ছে আমরা বোধহয় সেইদিকে….’
মামা কথা হারিয়ে ফেললেন। মামার আর একটি সমস্যা হচ্ছে উনি পুরো কথা শেষ করতে পারেন না। অথচ বাংলাদেশের একটা বড় ট্রেডিং কোম্পানির ডিরেক্টর।
আনিস পত্রিকাটা হাতে নেয়। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। টিভিতে একটা হিন্দি সিরিয়াল চলছে। শেগুফতা সেদিকে চোখ-মন লাগিয়ে বসে আছে। টিভির সাউন্ড কম থাকায় মাঝে মাঝে তাকে বিরক্ত দেখাচ্ছে। আনিস এবার জয়ন্তীর দিকে তাকায়। সোফার এক কোণায় বসে আছে সে। সোফার বাম পাশে বসে আছে জয়ন্তীর বাবা রহমান সাহেব। শাদা টুপি আর শাদা টি-শার্ট পড়ে বসে আছেন ভদ্রলোক। পরিপাটি চেহারা। আনিস পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার জন্য বলে,
‘আমি কি জয়ন্তীর সঙ্গে একটু আলাদা করে কথা বলতে পারি?’
সঙ্গে সঙ্গে মামা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। বলেন, ‘তুই কী কথা বলবি? এখনো কি কোনো কিছু ঠিক হয়েছে?’
আনিস ফিসফিস করে উত্তর দেয়, ‘জ্বি না মামা। আমার ভুল হয়েছে।’
আনিস জয়ন্তীর মুখের দিকে তাকায়। মেয়েটা দেখতে সুন্দরী। ফর্শা। তবে ওর চোখে-মুখে কোনো কৌতূহল নেই। একটা সুতি শাড়ি পড়েছে সে। গলায় সবুজ পাথরের মালা। সবুজ দুল। সবুজ টিপ।
পায়ে ম্যাচিং করে সবুজ রঙের স্যান্ডেল। জয়ন্তীদের ড্রইংরুমের কার্পেটটাও সবুজ। জানালার পর্দাগুলো হালকা আকাশি। সবমিলিয়ে জয়ন্ততীকে একটু অন্যরকম লাগছিল। আনিসের খুব ইচ্ছা হলো জয়ন্তীর সঙ্গে একটু আলাদা করে কথা বলবে। তাকে নিজের এবং ওর পরিবারের লোকজন সম্পর্কে বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু মামাই ফ্লোর নিয়ে নিলেন। তিনি বললেন,
‘মা তোমার নাম কী?’
‘জ্বি জয়ন্তী।’
‘বাহ বেশ চমৎকার নাম। জয়ন্তী মানে জানো?’
‘জ্বি, না ঠিক মনে করতে পারছি না।’
মামা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন,
‘জয়ন্তী মানে হচ্ছে হিন্দু দেবী দুর্গা। ইন্দ্রের কন্যা। জয়ন্ত কে জানো?’
‘জ্বি না জানি না।’
‘জয়ন্ত হলো পুরাণক্ত ইন্দ্রের পুত্র। যাই হোক তুমি ভালো আছো?’
‘জ্বি ভালো।’
মামা উশখুশ করছেন। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। সম্ভবত কী কথা বলবেন বুঝতে পারছেন না। এরই মধ্যে সোবহান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। ভেতরের দরজার দিকে উঁকিঝুঁকি দেয়া শুরু করলেন তিনি। তারপর অনেকটা কৌতূহলের সুরে বললেন,
‘বেয়াইন সাহেব কই? ওনাকে দেখছি না?’
রহমান সাহেব হাসেন। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন। তবে খুব আস্তে আস্তে। লো ভলিউম।
‘জ্বি, ও আসবে। আপনারা এসেছেন তো। একটু ব্যস্ত আছে ভেতরে।’
‘না না ব্যস্ততার কী আছে,’
কথাটা বলেই সোবহান সাহেব কোনোরকম অনুমতি ছাড়াই ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলেন।
মামা বললেন, ‘মা জয়ন্তীর হাতের লেখা দেখতে চাই। তোমার নাম আর ঠিকানাটা একটু লেখ তো মা।’
বাবা এবং মামার কাণ্ড-কারখানা দেখে আনিস ভীষণ বিরক্ত। বিয়ের কোন কথাবার্তাই পাকা হয়নি অথচ বাবা জয়ন্তীর বাবা মাকে বেয়াই-বেয়াইন সাহেব ডাকছেন। সত্যিই আনিসের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। জয়ন্তী একটা কাগজ নিয়ে আস্তে আস্তে নাম-ঠিকানা লেখা শেষ করে। কনে দেখার বিষয়টি নিয়ে আনিস আসলে মনে মনে বেশ এক্সাইটেড ছিল। কিন্তু পরিস্থিতিটা যে এরকম হবে এটা বুঝতে পারেনি আনিস। মামা জয়ন্তীর লেখাটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করলেন না। দু’তিনবার গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়লেন। একটা এড্ড্রেস এতো আগ্রহ নিয়ে পড়ার কি আছে, আনিস বুঝতে পারছে না। মামা এবার মুগ্ধ হাসি হেসে জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মা তোমার চুলগুলোতো বেশ দীঘল! চোখ দুটাও খুব সুন্দর!
বলোতো মা বাইরের সৌন্দর্য আর ভেতরের সৌন্দর্যের মধ্যে পার্থক্য কি?’
জয়ন্তী মাথা নীচু করে থাকে। ফয়জুর হাসলেন। বললেন, ‘সময় নাও। তাড়াহুড়া নাই।’
এরই মধ্যে সোবহান সাহেব ভেতর থেকে চিৎকার করলেন।
‘ফয়জুর এদিকে আসো। ভেতরে আসো। আনিসকেও ডাকো। কথা আছে।’
মামা আনিসকে ডাকলেন না। তিনি খুশিতে টগবগ হয়ে ভেতরে চলে গেলেন। আনিস খুশি হলো। যাক, মামা বোধহয় তাকে সুযোগ করে দিয়েছে একা কথা বলার জন্য। এবার রহমান সাহেবকে বেশ সপ্রতিভ দেখায়। তিনি কথা বলা শুরু করলেন।
‘বাবা আমেরিকাতে আপনি আসলে কী করেন?’
‘জ্বি, একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াই।’
‘কি সাবজেক্ট?’
‘জ্বি, ল’। আইন।’
‘বাহ, ভালো ভালো। আপনার সিভিতে দেখেছি। আমার মেয়ে জয়ন্তী। সে’ও এবার অনার্স দিয়েছে ল’ থেকে। খুব ভালো রান্না করে। কবিতা আবৃত্তি করে। এবার একটা টিভি চ্যানেলে কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়েছে। ও তো রীতিমতো সেলিব্রেটি হয়ে গেছে। যেখানেই যায় লোকজন জেঁকে ধরে। একেবারে জোঁকের মতো। হা হা হা।’
আনিস কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না । সহজভাবে সে বলে, জ্বি, ভালো। জোঁকের মত লেগে থাকা ভালো ।
এতক্ষণ রহমান সাহেব কেন চুপচাপ ছিলেন বোঝা গেল না। রহমান সাহেব আবার বলতে থাকেন,
আমি তো রিটায়ার্ড করেছি গত বছর। নাম বলবো না। একটা বিশেষ চাকরীতে ছিলাম। ঘুষের চাকরি। ঘুষ যে একেবারে নিতাম না, সেটা বলবো না। তবে এটা বলতে পারি, আমি অসৎ ছিলাম না। যার কাছ থেকে নিয়েছি অত্যন্ত সিনসিয়ারলি তার কাজটা করে দিয়েছি।
আনিস অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মনটা একটু খারাপ হতে থাকে। দেশের লোকজন বোধহয় আজকাল অকারণে বেশী কথা বলে। নাকি আনিসই গত দশ বছর বিদেশে থেকে বদলে গেছে? কী জানি? আনিস পত্রিকাটা ভাঁজ করে রেখে দেয় টেবিলে।
শেগুফতার সিরিয়াল দেখা শেষ হয়েছে। সে এসে পাশে বসেছে জয়ন্তীর। রহমান সাহেব বলেন,
‘যে কথা বলছিলাম, জয়ন্তী আমার একমাত্র মেয়ে। তাই মেয়েকে আমি মানুষ করেছি নিজের আদর্শে।
আনিস বুঝতে পারছে না একজন অসৎ মানুষের আবার কী ধরনের আদর্শ থাকতে পারে। তবু সে হাসে। বলে,
খুব ভালো। খুব ভালো।
এরই মধ্যে সোবহান সাহেব আবার ড্রইংরুমে ঢোকেন। হেসে হেসে বলেন,
‘আনিস। ভেতরে আসো। দেখো বেয়াইন সাহেব কী কাজ করেছেন।
রান্নাবান্না মানে এলাহি কাণ্ড। তোমার মামা তো ওখানে বসে গরম গরম চপ খাচ্ছেন। দুটো চপ খাবি নাকি বাবা?
আনিস বললো, বাবা আমি চপ খাবো না।
সোবহান সাহেবের এসব কথা শোনার সময় নেই। তবু সে অবলীলায় বলে
বলে কি ছেলে? চপ তাহলে খাবি না? ঠিক আছে। তোরা গল্প কর। বেয়াই সাহেব চলেন আমরা ভেতরে যাই।
রহমান সাহেব উঠে দাঁড়ান। বলেন,
‘বাবা তুমি কথা বলো। আমরা ভেতরে যাই।
রহমান সাহেব ভেতরে চলে গেলেন। শেগুফতা বলে,
‘জয়ন্তী শোনো এই শাড়িটা কোথা থেকে কিনেছো? খুব সুন্দর।
‘সম্ভবত নবরূপা থেকে। আমার ঠিক মনে নেই।
শেগুফতা একটু রাগ করলো।
‘কী ব্যাপার? তোমাকে যা বলা হয় তাতেই উত্তর দিচ্ছ ‘মনে নেই’। তোমার সমস্যা কী?
‘জ্বি, না আপু। কোনো সমস্যা নেই। একটু নার্ভাস লাগছে।
শেগুফতা হাসলেন। তারপর ভেতরে চলে গেলেন।
এতক্ষণ পর জয়ন্তীকে কাছে পেয়ে আনিস যেন স্বর্গ পেলো। নিজের জায়গা বদল করে জয়ন্তীর খানিকটা পাশে এসে বসে সে। জয়ন্তীও চোখ তুলে তাকায়। হাসতে হাসতে বলে,
‘কি, কন্যা পছন্দ হইছে?
‘জ্বি হয়েছে।
‘তাইলে আমি এইবার দুইটা প্রশ্ন করি?
জয়ন্তীর কথার ধরন দেখে আনিস একটু অবাক হয়। সে হতাশ দৃষ্টিতে বলে,
‘জ্বি, করেন।
‘আপনার দাঁত কয়টা? বত্রিশটা উঠছে?
আনিস কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। ভদ্রলোকের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
‘জ্বি, বত্রিশটা আছে।
‘দেখি তো হাঁ করেন। গুনতে হবে।
আনিস মুখ হাঁ করবে কি-না বুঝতে পারছে না। এতো মহাযন্ত্রণার মধ্যে পড়া গেল। সে কি আসলে স্বপ্ন দেখছে? ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। আনিসের সব রোমান্টিসিজম উধাও হয়ে গেল মুহূর্তে। জয়ন্তী এবার আরো সামনে আসে। তারপর বলে,
‘একটা ইংরেজি ট্রান্সস্লেশন করেন।
‘জ্বি, বলেন।
‘আমি একটা গাধা– এটার ইংরেজি কী হবে?
আনিসের মাথা ঘুরে গেল। সে সত্যি সত্যি ট্রান্সস্লেশন করা শুরু করে দিল। এরই মধ্যে মামা আবার ঘরে ঢোকেন। আনিস যেন হাপ ছেড়ে বাঁচে। মামা জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বলেন
‘আসো মা কাছে এসে বসো
জয়ন্তী মামার সামনে এসে বসে। মামা বললেন
‘বাইরের সৌন্দর্য হলো ক্ষণস্থায়ী, আর ভেতরের সৌন্দর্য হলো দীর্ঘস্থায়ী। বুঝেছো?
জয়ন্তী হাসে। মাথা নাড়ায়। মামা এবার হাসেন। টিভির শব্দটা মিউট করেন। তারপর বলেন–
‘এবার একটা ধাঁধা দেই তোমাকে? আই কিউ টেস্ট!
জয়ন্তী মাথা নাড়ায় ।
মামা উৎসাহ নিয়ে বলতে থাকেন
‘একজন ধার্মিক বৌ সারাদিন তার শ্বশুর শাশুড়ির খুব যত্ন করেন। কিন্ত শ্বশুর শাশুড়ি তাকে দেখতে পারে না । কেনো?
জয়ন্তী এবার সিরিয়াস হয়ে তাকায় মামার দিকে। হেসে বলে
‘শ্বশুর শাশুড়ি কী অন্ধ?
‘না
জয়ন্তী এবার সত্যি সত্যি চিন্তায় পড়ে যায়। মামা হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললেন
‘ভাবো। চিন্তা করো!
জয়ন্তী হেসে বলে
‘বৌ’টা কি বোরখা পড়তো?
মামা চিৎকার করে উঠলেন
‘ভেরী গুড। হয়েছে । দশে দশ ।
এরই মধ্যে জয়ন্তীর মা ঘরে ঢোকেন। তিনি খুব বিনয়ের সাথে ওদেরকে খাবার জন্য ডাকলেন।
আনিস যন্ত্রের মতো উঠে দাঁড়ায়। তারপর জয়ন্তীর মায়ের পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকে।
জয়ন্তী হি হি করে হেসে ওঠে।
দুই
মামা বললেন, দুলাভাই মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে। বলেন– আলহামদুলিল্লাহ। মামার কথা শুনে বাবা-মা দুজনেই নীচু স্বরে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।
মামা হাসেন। তাকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। তিনি আবার বললেন, নীচু স্বরে বললে হবে না। উঁচা স্বরে বলেন
বাবা প্রায় চীৎকার করে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।
আনিস চুপচাপ বসে টিভিতে খবর দেখছে। মা এসে পাশে বসে । তারপর ফিসফিস করে বলে, তুই তো মানুষের বাড়িতে খেতে পারিস না। ইলিশের ডিম ভেজেছি। খাবি?
আনিস মাথা নাড়ে। মা প্রসঙ্গ পাল্টে বলে মেয়েটার ছবি দেখে তো মনে হলো ভালো। শেগুফতা কী বলিস?
‘না, মা আমার একটু কথা আছে।
‘কি, বল
‘মেয়েটাকে আমার অতটা পছন্দ হয়নি।
শেগুফতার কথা শুনে সবাই ওর দিকে তাকায়। শেগুফতা বলে,
‘মেয়েটা বেশ অহঙ্কারী। সব কথায় নাক সিটকানো অভ্যাস। আর একটা জিনিস ভালো লাগেনি।
কি?
মামা আশ্চর্য ভঙ্গিতে তাকায়।
‘ওরা যে মিষ্টিগুলো খেতে দিয়েছে সেগুলো কি ছোট ছোট ছিল দেখেছো? বাবারে কী কঞ্জুস!
বাবাকে খানিকটা উত্তেজিত দেখায়। সে বলে,
‘না না। কিন্তু ‘আইটেম’ করেছে তো দশ রকম। ওই মহিলা একা মানুষ। মাত্র একজন কাজের লোক। তাই নিয়ে কি দারুণ দারুণ রান্না করেছে।
মা কপট রাগ দেখাল।
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি যেন কিছুই খাও না তোমার বাসায়।
বাবা ব্যালান্স করার চেষ্টা করেন,
‘না না পূরবী। আমি বলছিলাম মহিলা বেশ এনার্জেটিক। কত তাড়াতাড়ি সব আয়োজন করে ফেললো। তোমারও ভালো লাগতো। পুরো পরিবারটাকে আমার কিন্তু খারাপ লাগেনি।
মামা হাসলেন। বললেন,
আমি জানি দুলাভাইয়ের অপছন্দ হবে না। আমার কিন্তু মেয়েটাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। খুব মিষ্টি।
মা বললেন, আনিস তোর সঙ্গে জয়ন্তীর কি কিছু কথা হয়েছে?
‘হ্যাঁ মা হয়েছে।
‘কী কথা?
‘এই সামান্য। কেমন আছেন, ভালো আছি টাইপের।
‘তোর কেমন লেগেছে?
‘ফেয়ার মতামত দেবো?
‘অবশ্যই।
‘ভালো লাগেনি।
সঙ্গে সঙ্গে মামা আর বাবা চুপসে গেলেন। মামার কেনো যেন প্রবল একটা ভালোলাগা ছিল মেয়েটার প্রতি। হতাশ গলায় বললেন
‘কেন কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?
‘না কোনো সমস্যা না।
‘তাহলে বললি কেন ভালো লাগেনি?
‘ভালো লাগেনি। ব্যস। আনিস মাথা নিচু করে থাকে।
সোবহান সাহেবের মেজাজ খারাপ হতে থাকে। মেজাজ খারাপ হলে তিনি অতিরিক্ত ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলা শুরু করেন
‘না পছন্দ হওয়ার তো কোনো কারণ আছে, তাই না ? কারণটা বল। শুনি!
‘আমি কারণটা বলতে পারবো না বাবা। আমার ভালো লাগেনি।
‘কারণ বিনা কার্য ঘটে না। নো স্মোকিং উইদাউট ফায়ার।
বাবা চোখ পিটপিট করে তাকান। আনিস মাথা নীচু করে থাকে। সোবহান সাহেব আর কথা বাড়ান না। বিড়বিড় করে গালি দেন। মা বলেন, এতো বড় ছেলেকে গালিগালাজ কোরো না।
মামা হাসেন। বললেন, নো প্রবলেম। আমার হাতে আরেকটা মেয়ে আছে। ছবি দেখবি?
আনিস তাকায়। কিন্তু কোনো উৎসাহ দেখায় না। সোবহান সাহেবের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। সে বলে,
মেয়ে কী করে?
দুলাভাই ডাক্তার।
বলিস কি? এটা তো আমার স্বপ্ন ছিল। ডাক্তার?
আনিস ভেতরে চলে যায়। নিজের রুমে গিয়ে দরজা লক করে দেয়। টিভিটা ছাড়ে। তারপর খুব অবাক হয়ে ভাবে। জয়ন্তী তার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করলো কেন? মেয়েটি কি আসলে মেয়ে দেখার এই প্রচলিত প্রথাকে অপছন্দ করে? ওইসব কথা বলে কি সে তাকে তিরস্কার করেছে?
জয়ন্তীদের বাসায় খাবার পর্ব শেষ করার পর অবশ্য ওকে আর আশপাশে দেখা যায়নি। আনিসও সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সরাসরি বাসায় চলে আসে। বাবা বা মামার সঙ্গে ওদের কী কথা হয়েছে, তাও জানে না সে। আনিস মনে মনে বলে, জয়ন্তী দশের ভেতরে পাঁচ নাম্বার পাবে। অতএব বাদ। ওকে নিয়ে আর চিন্তা না করাই ভালো। কাল এতো বড় প্লেন জার্নি করার পর এই প্রথম আনিসের ঘুম পেলো। আশ্চর্য ভীষণভাবে চোখের পাতা জড়িয়ে এলো তার।
মামা পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা মেয়ের ছবি বের করে আনেন। সোবহান সাহেব, তার স্ত্রী পূরবী আর শেগুফতা সেই ছবি নিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। আনিসের মা বলে,
‘মেয়ে দেখতে তো অসাধারণ। রূপসী।
শেগুফতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। বলে,
‘বেশ সুন্দর। মেয়ের সিভি কই মামা?
মামা গর্বিত ভঙ্গিতে বলেন, মেয়ের সিভি লাগবে না। বাবা রিটায়ার্ড কর্নেল। এখন ব্যবসা করেন। তার এক মেয়ে এক ছেলে। তবে ছেলেটার একটু সমস্যা দুলাভাই।
কেন? কী সমস্যা?
ছেলেটা মানুষ হয়নি। নেশাটেশা করে আর কি।
বলো কি!
ফয়জুর সান্ত্বনা দেয়। দুলাভাই, মেয়ের ভাইকে দিয়ে আমরা কী করবো? মেয়েটা ভালো কিনা সেটাই মূল কথা।
পূরবী বেগম অনরবত পান খাচ্ছেন। বোঝা যাচ্ছে উনি বেশ এক্সসাইটেড। তিনি মুখ টিপে হাসেন। বলেন, মেয়েটার নাম কি?
‘শ্রাবন্তী।
‘বাহ সুন্দর নাম তো।
পূরবী এবার ছবিটা ভালো করে খেয়াল করে। হাসে।
তারপর বলে,
ফয়জুর, তুই এই মেয়ের গার্জিয়ানের সঙ্গে কথা বল। আমরা এই মেয়েকে দেখতে চাই।
‘সত্যি দেখবে আপা?
‘হু। এবার আমিও যাবো দেখতে।
শেগুফতা কি চিন্তা করে বললো, মা আমার একটা কথা আছে।
‘বল।
আমার মনে হয় আনিস সবাই মিলে দেখতে চাচ্ছে না।
‘তার মানে?
সে আসলে প্রথমে একা দেখতে চাচ্ছে। একা কথা বলতে চায়। তারপর পছন্দ হলে সবাইকে ইনভল্ব করতে চায়।
মামা অসহায়ের মতো বললেন,
তার মানে কি আমরা ….।
ফয়জুর কথা শেষ করতে পারলেন না। সোবহান সাহেব বললেন,
ঠিক আছে। তাই হোক। আনিসকে ডাকো। কালই দেখা করুক।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে আনিস। প্রায়ই সে শৈশবের স্বপ্নটা দেখে। ওরা সবাই ওদের গ্রামের বাড়ি গেছে। শিশিরে ভিজে গেছে সারা মাঠ। সেই মাঠে ভোরবেলা একা একা আনিস হাঁটে। আর ওর বড় বোন শেগুফতা দৌড়াতে দৌড়াতে আসে। শেগুফতাকে তখন সত্যজিত রায়ের দূর্গার মতো লাগে।
আনিসের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আনিস ঠিক কোথায় বুঝতে পারে না। ঘরটা অন্ধকার। লো ভলিউমে টিভিটা চলতে থাকায় ফিসফিস করে একটা শব্দ আসছিল। আনিসের উঠতে ইচ্ছা করে না। ঘড়ির দিকে তাকায় সে। রাত দুটো। আনিস ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে হয়তো কেউ তাকে ডাকেনি। এই প্রথম ঘরটার দিকে তাকায় সে। আমেরিকায় যাওয়ার আগে এই ঘরটাই ছিল ওর জগৎ। এই ছোট্ট ঘরে কতো স্মৃতি আনিসের। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল শেষ করে নটরডেম কলেজ। তারপর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন টেস্ট। সেই ফাঁকে স্কলারশিপটাও হয়ে গেল মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে। প্রথমে ‘পাবলিক পলিসি’ নিয়ে এডমিশন। তারপর ইউনিভার্সিটি পাল্টে ব্রুকলিন ল’ কলেজে দুর্দান্ত রেজাল্ট। আমেরিকাতে আত্মীয়-স্বজন ছিল না বলে কি কষ্টই না করতে হয়েছে। বাবার ছিল ছোট চাকরি। কিন্তু এই ছোট্ট চাকরির আয়ের সিংহভাগ জমিয়ে বাবা বছর বছর টাকা পাঠানো শুরু করলো। আনিসকে এই বিষয়টি কষ্ট দিত। পড়াশোনার পাশাপাশি সে শুরু করে কাজ। তারপর বাবাকেই উল্টো টাকা পাঠাতে শুরু করে। বড় বোন শেগুফতার পড়াশোনার খরচ। বাবা-মায়ের খরচ। পুরো পরিবারটাই তখন আনিসের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। তবে বাবা-মাকে যেদিন সে টাকা পাঠায় সেদিনটা তার সবচেয়ে খুশির দিন। এরকম একটা খুশির দিনেই ইউনিভার্সিটির চাকরিটা পেয়ে যায় আনিস।
কিন্তু ইদানিং বিদেশের এই জীবনও তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। দশ বছর পর দেশে এসে তাই এখানে পুরোপুরি থেকে যাওয়ার লোভটাও বাড়তে থাকে। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধব পরিবেষ্টিত এই দেশে থাকার মজাটাই আলাদা। ভীষণ এক নির্ভার জীবন এদেশে– আনিসের মনে হয়। একটা সিগ্রেট খেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সিগ্রেটের গন্ধ পেলে বাবা দুনিয়া ওপার করে দেবে।
আনিস উঠে বসে। ভাবে সে বিদেশের এই জীবন সত্যিই তার কাছে নিরর্থক। রোবটের মতো জীবন। সকাল হলেই গাড়ি চালিয়ে ইউনিভার্সিটি। ক্লাস লেকচার রেডি করে ছাত্রছাত্রীদের মুখোমুখি হওয়া। তারপর ক্লাশ শেষ হলে আবার গাড়ি চালিয়ে বাড়িতে চলে আসা। আনিস থাকে ওদের এক সিনিয়র টীচারের বাসায় । পেয়িং গেষ্ট হিসেবে । তবে রান্না-বান্না থেকে শুরু করে সব কাজ নিজেরই করতে হয়। একরকম হাঁপিয়ে উঠেছে আনিস। মাঝে মাঝে উইকএন্ডে বন্ধুরা আসে। তবে তাদের আলোচনার বেশির ভাগ সময় জুড়ে থাকে বাংলাদেশের রাজনীতি নয়তো বৈষয়িক আলাপ। খুবই বিরক্তিকর। কিন্তু দেশের ব্যাপারে সবারই কিরকম একটা গভীর টান লক্ষ্য করেছে সে। ওখানে মহসিন আলী নামে এক ব্যবসায়ী থাকে। নিউইয়র্কে তার গ্রোসারী শপ আছে চারটা। আরো কিসব ব্যবসা আছে। সেই মহসিন আলী একদিন ভোরবেলা উত্তেজিত গলায় ফোন করলেন
‘আনিস ভাই তাড়াতাড়ি আমার বাসায় চলে আসেন।
‘কি হয়েছে মহসিন ভাই।
মহসিন আলী উচ্ছ্বসিত গলায় বলে ‘সাত রাজার ধন পাইছিরে ভাই। সাত রাজার ধন। তাড়াতাড়ি আসেন।
আনিস কোনো কথা না বাড়িয়ে গাড়ি চালিয়ে তার বাড়িতে চলে এলো।
ভদ্রলোক আনিসকে দেখে হাসতে হাসতে মহা উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এলেন। আনিস উৎসাহ নিয়ে বললো
‘কি পেয়েছেন মহসিন ভাই ‘লটারী নাকি!
‘আরে একটু ধৈর্য্য ধরেন। আস্তে আস্তে বলি।
আনিসের কৌতূহলটা আরো বাড়ে। সে বললো
‘কি হয়েছে ?
মহসিন ভাই তাকে সোজা ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গেলেন। বললেন
বসেন ভাই। মাথা ঠাণ্ডা করে বসেন। ঘটনাটি বলি।
আজ সকালে আমার মেয়ে এসেছে দেশ থেকে। দেশ থেকে সে কুমড়োর বড়ি নিয়ে এসেছে। একটা বক্সে ভরে টাকি মাছ ভর্তা নিয়ে এসেছে। সেটা দিয়ে সকালে গরম ভাত খেয়েছি । এখন আপনাকে খাওয়াবো। হে হে হে। আনিস বিরক্ত গলায় বললো
‘এই আপনার সাত রাজার ধন!
মহসিন আলী ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে বলেন, জ্বী ভাইজান সাত রাজার ধন।!
আনিস উঠে চলে এলো। কিন্তু গাড়ি চালাতে চালাতে নিজেও কিরকম পুরোনো স্মৃতির প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লো। আসলেই এসব দেশী খাবার সেও গত কয়েক বছর খায়নি। আশ্চর্য সারাদিন আনিসের কি রকম বিষণ্ণ কাটলো। কাজে ঠিকমতো মন বসাতে পারলো না। কোনরকম কাজটাজ শেষ করে বাড়িতে এসে গভীর ঘুমে ডুবে গিয়েছিল সে।
ইলিয়াস হোসেন নামের আর একজন ভদ্রলোক আছেন। মানি একচেঞ্জের ব্যবসা আছে তার। উনি কিছুক্ষণ পর পরই চোখের পানি ফেলেন। তার বাবা ফোন দিয়েছিলেন এক সকালে। ইলিয়াস সাহেব কেঁদে কেঁদে শুধু বলেন
‘আববাগো মাটি।
তার বাবা দেশে থাকেন । সহজ সরল মানুষ । তিনি ছেলের কথা বুঝতে পারেন না । রাগ করে বলেন
‘কি রে ব্যাটা সেই তখন থেকে শুধু মাটি মাটি করছিস? তোর কি মাথা খারাপ হইছে?
ইলিয়াস সাহেব আরো জোরে কাঁদেন।
আববাগো আমার মাথা খারাপ হইছে। নিজের দেশের মাটির জন্য মাথা খারাপ হইছে। আমি এই দেশ ছাইড়া চইলা আসমু। দাশের মাটি আমারে ডাকে।
সহজ সরল বাবা এই কথা শুনে আস্তে আস্তে বলেন, মোর পোলায় পাগল অইছে ।
এরপর থেকে নিউইয়র্কে ভদ্রলোকের নাম হয়ে গেলো ‘আববাগো মাটি’।
আনিসের মধ্যেও দেশপ্রেম প্রবল। সেটা টের পায় সে। একবার সে শুনলো ঢাকায় ভূমিকম্প হয়েছে। দেশের পত্রপত্রিকাগুলো বড় বড় হেডলাইন করেছে। এক পত্রিকা লিখলো– ‘বিশেষজ্ঞদের আশংকা’বাংলাদেশ সমুদ্রে তলিয়ে যাবে’।
আনিসতো টেনশনে শেষ। তাড়াতাড়ি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে বাসায় ফোন দিলো। মাকে ফোন করে বললো
‘মা তোমরা সব ঠিক আছো তো?
পুরবী বেগম আকাশ থেকে পড়েন
‘কিরে তুই কাদের কথা বলছিস?
আনিস কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যায়
‘শুনলাম তোমাদের ওখানে ভূমিকম্প হয়েছে। আমিতো অস্থির। কোনো সমস্যা হয়নি তো?
পুরবী বেগম রিসিভারটা ওর বাবার হাতে দিয়ে বলেন–
‘আনিস বলছে এখানে নাকি ভূমিকম্প হয়েছে। কখন হলো? আমিতো টের পেলাম না। দেখোতো ব্যাপারটা কি?
আনিস লজ্জিত হয়ে ফোনটা রেখে দেয়। কিন্তু অস্বস্তি কাটে না। তার মনে হয়, বিদেশে ভালোভাবে জীবনযাপনের অনুষঙ্গ আছে; কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য নিজস্ব কোনো স্বপ্ন নেই। নিজের দেশের মতো স্বাধীনতা নেই। অর্থময় কোনো প্রেরণা নেই।
আনিসের মাঝে মাঝে মনে হয় এখানে যে শুধুই সময় নষ্ট করছে। তখন আত্মঅহংকার প্রবলভাবে জেগে ওঠে। নিজেকে নতুন করে তৈরি করতে ইচ্ছে হয়। মনে হয় এখনও সময় আছে। দেশে গিয়ে নতুন করে সব কিছু শুরু করবে সে। আসলে তারই প্রস্ত্ততি নিতে দেশে এসেছিলো সে। কিন্তু জয়ন্তী নামের মেয়েটাকে দেখতে গিয়ে ভীষণ রকম অপ্রস্ত্তত হয়ে গেছে আনিস। একজন অপরিচিত মেয়ে এমন কঠিন আচরণ করবে এটা তার কল্পনায়ও আসেনি। অথচ মেয়েটা একবারও দুঃখ প্রকাশ করলো না? আশ্চর্য!
মনে মনে আনিস বেশ ক্ষেপে ওঠে। কোনো কিছু চিন্তা না করেই সিগ্রেট ধরায় সে। কিন্তু হুট করে মামা ঘরে ঢোকেন। মামা মুখ বিকৃত করে বলেন,
‘কিরে ঘরে বসে সিগ্রেট খাচ্ছিস? তাও আবার এতো রাতে!
আনিস তাড়াতাড়ি সিগ্রেট নিভিয়ে ফেলে। এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায় সে। মামা গম্ভীর হয়ে বলেন-
‘মদ-টদও খাস নাকি? চোখ দেখেতো মনে হয় খাস।
‘জ্বী না মামা ওগুলো খাই না।
মামা বিছানায় বসেন। তারপর বলেন–
‘তোমার ভাব সাব তো ভালো লাগতেছে না ! তোমার পেছনে তো স্পাই লাগাইয়া রাখতে হবে। বিদেশে থাকো । কি দিয়া কি করো আল্লাহই জানেন ।
আনিস হেসে বলে ‘মামা আমি তো দেশেই থাকতে চাই। দুটো ইউনিভার্সিটি আমায় ডেকেছে। একটু সময় দাও। এসেও পড়তে পারি।
মামা আবার মুখ বিকৃত করে বলেন ‘তুই চাইলেও এখন তা পারবি না। ওখানকার ক্রীম খেয়েছিস না? টাকা পয়সাতো ভালোই বানিয়েছিস? এখন বিয়ে করে বৌ নিয়ে চলে যাবি। এইতো?
আনিস কথা বাড়ায় না। চুপচাপ মামার দিকে তাকিয়ে থাকে। মামা বলে
‘শোন তুই যে ফর্মুলায় মেয়ে দেখতে চাচ্ছিস এই ফর্মুলা কাজ করবে না।
‘কোন ফর্মুলা!
‘এই যে একা একা মেয়ে দেখার ফর্মুলা। বিয়েতে মুরুব্বী লাগে। তারাই সব কথা-বার্তা বলে। কাজটাও তাড়াতাড়ি হয়।
আনিস হেসে বলে
‘ঠিক আছে তোমরা যা বলো!
মামা কাছে আসে। তারপর বলেন
‘কিন্তু তোকে এবার চান্সটা দিয়ে দেখতে চাই। তুই একাই মেয়ে দেখ। এই যে মেয়ের ছবি। ওর নাম শ্রাবন্তী। ডাক্তার। এটা ওর সিভি। এখানে ফোন নম্বর দেওয়া আছে। ভালো লাগলে মেয়ের সাথে কথা বলিস। ফোন করিস। আমি তোর নাম্বারও ওকে দিয়েছি। তুই এখন ঘুমুতে যা। অনেক রাত হয়েছে।
আনিস ছবিটা দেখতে দেখতেই মামা বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। আনিস ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। সিভিটা পড়ে। ছবি দেখে মেয়েটাকে ভীষণ শান্ত মনে হলো তার। মনে মনে ঠিক করে সে কালকেই ফোন করবে শ্রাবন্তীকে।
তিন
ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন
তবে কেন মিছে ভালোবাসা
মন দিয়ে মন পেতে চাহি। ওগো কেন
ওগো, কেন মিছে এ দূরাশা।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল জয়ন্তী। অনার্স ফাইনাল শেষ হবার পর হাতে বেশ কিছুদিন সময় আছে। মাস্টার্সের ক্লাস আরম্ভ হতে আরো মাসখানিক লাগবে। এ সময় বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা নয়তো বাসায় ঘুমিয়ে কাটানো। এই মোটামুটি রুটিন তার। কবিতা আবৃত্তির একটা নেশা আছে জয়ন্তীর। ইউনিভার্সিটিতে ‘মঙ্গল সন্ধ্যা’ নামে একটা আবৃত্তি গ্রুপের সাথে আছে সে। মাঝে মাঝে যায়। কিন্তু ইদানীং গ্রুপের সবাই অনিয়মিত হয়ে ওঠায় টিএসসিতেও যাওয়া বন্ধ।
জয়ন্তী ঘড়ি দেখে। এগারোটা। সকালের নাস্তা খেয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করে গান টান শুনে সময় কাটাবে ভেবেছিল। কিন্তু আলভীর ফোন পেয়ে খুশী হয় সে । ফোনটা করেই জয়ন্তী বলে, কিরে দোস্তাইন কি খবর?
ওপাশ থেকে ফিকফিক হাসির শব্দ। দোস্তাইন ভালো। তোর খবর কি?
মোবাইলটা আলতো করে ডানদিক থেকে বামদিকে নেয় জয়ন্তী। সেও ফিসফিস করে বলে
‘ভালো দোস্ত। খুবই ভালো।
‘আনিস সাহেবের খবর কি? আমেরিকান পাত্র?
জয়ন্তী হাসে। বলে
‘এক বক্সিংয়ে নকআউট।
‘কেনো কেনো?
জয়ন্তী এবার একটু গম্ভীর হয়ে যায়। বলে
‘আমিতো ভেবেছিলাম আনিস আধুনিক মনের ছেলে। কিন্তু একটা ‘খ্যাত’। টিপিক্যাল লোকদের মতো আমার হাতের লেখা দেখতে চায়। আমিও একা পেয়ে যা ইচ্ছে তাই বলেছি। বাপের নাম ভুলিয়ে দিয়েছি।
তারপর দুজনেই কিছুক্ষণ হাসে। আলভী বলে
‘ছবিতে তো দেখলাম বেশ স্মার্ট লুকিং।
লম্বা। বয়সও অনেক কম। মেরিটরিয়াস। সময় করে দেখতে পারতিস? অসুবিধা কি ছিল!
জয়ন্তী এবার একটু চুপ করে থাকে। ওপাশ থেকে আলভী বলে
:আই থিঙ্ক। ইট ওয়াজ এ গুড প্রপোজাল। কারো সাথে প্রেম যখন করিসনি তখন না হয় একটু প্রেম প্রেম খেলা খেলতিস? জাস্ট ফর গেইনিং এক্সপেরিয়েন্স।
জয়ন্তী হাসে। বলে’না বাবা। আমি এসব পারবো না।
‘তোর কি পছন্দ হয়েছে?
‘সময়টা আসলে এতো কম ছিল। বুঝতে পারছি না।
‘ডোন্ট ওরি দোস্ত। তুই ওর ফোন নম্বরে আবার ট্রাই কর।
‘ কিন্তু আমিতো অনেক উল্টা-পাল্টা বলেছি তাকে।
‘কেনো!
‘জানিনা। এতো যে রাগ হলো। আমার মাথা ঠিক ছিল না। তবে বুঝেছি ওভাবে আমি না বললেও পারতাম।
‘তাহলে তো ভালোই হলো।
‘মানে!
‘মানে স্যরি চাওয়ার একটা সুযোগ পাওয়া গেলো!
‘তুই ফোন করে স্যরি চা। দেখা কর। আলাপ-চালিয়ে যা। কিছু হলেও তো হতে পারে?
জয়ন্তী বলে ‘ঠিক আছে দেখি। রাখি দোস্ত। বাসায় আসিস।
‘আসবো।
লাইনটা কেটে দেয় জয়ন্তী। এতক্ষণ পর একটা অস্বস্তি হয় ভেতরে ভেতরে। সত্যিইতো আনিসকে সে অপমান করেছে। জয়ন্তী ভাবে। অস্থিরতার মধ্যে পড়ে যায় সে। তারপর মায়ের কাছে চলে যায়। ছোটবেলার অভ্যাস। সামান্য কিছু হলেই মায়ের সাথে আলোচনা। তারপর সিদ্ধান্ত। ওর মা ওর ভীষণ কাছের মানুষ। মা রান্না করছিলেন। জয়ন্তী এসে সরাসরি বলে
‘মা সেই পাত্রের কোন খবর আছে?
‘কেনো বলতো?
‘ওরা কি কোন খবর জানিয়েছে?
‘না।
‘তাহলে এখন আমাদের কি করা উচিৎ?
‘ওয়েট করা উচিৎ
‘যদি এর মধ্যে না জানায়?
জয়ন্তীর মা তখন মাথা তোলে। হাসে। বলে’ওরা কি ঢাকা শহরে তোর মতো মেয়ে আর একটাও পাবে? তিনি নিজেই প্রশ্ন করলেন– ফোন করবে না কেনো? অবশ্যই করবে। একশোবার করবে। দেখিস আজকেই জানাবে।
ওদের কথাবার্তা শুনে রহমান সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। আস্তে আস্তে বলেন
‘সোবহান সাহেব দেখছি একেবারেই অন্যরকম মানুষ। কোন রিএকশন নেই। ওনার কি উচিৎ ছিল না আমাকে একবার ফোন করা? পছন্দ-অপছন্দ বলবে না?
জয়ন্তী বলে : বাবা। ওদের দেশের বাড়ি কোথায়?
রহমান সাহেব ফিসফিস করে বলেন
: শুনেছি ওদের আদি বাড়ি রাজশাহী। কেনো মা?
জয়ন্তী হাসে।
আস্তে আস্তে বলে’কিছু না । এমনিই বলেছি ।
রহমান সাহেব বললেন’কিন্তু সোবহান সাহেব তো কিছুই জানালো না!
রহমান সাহেব কথাটা শেষ করেই প্রশ্ন করেন
‘ছেলেকে তোর পছন্দ হয়েছে মা?
জয়ন্তী কাছে আসে। বলে ‘বাবা ঠিক বুঝতে পারছি না।
রহমান সাহেব জয়ন্তীর কাঁধে হাত রাখেন । তারপর বলেন ‘তাহলে সময় নে। তাড়াহুড়োর দরকার নাই। কথা বল। ওদের ফ্যামিলি কালচার দেখ। ছেলেটাকে নিজের মতো করে এভালুয়েট কর। তারপর ডিসিশান নেয়া যাবে।
জয়ন্তী বলে ‘দেখি বাবা !
হঠাৎ করে রহমান সাহেব কাছে এসে বলেন ।
‘হাঁস বাবু কি আর ডিস্টার্ব করে?
হাঁসবাবুর কথা শুনে জয়ন্তীর চোখের কোণে চিকন একটা ভাঁজ পড়ে। বলে
‘না বাবা। সপ্তাহ দুয়েক ধরেতো ফোন করে না!
রহমান সাহেব মুচকি হাসি দিয়ে বলেন
‘যাক বাবা বাঁচা গেলো। সেদিনের কাউন্সিলিং-এ মনে হয় কাজ হয়েছে। যেভাবে হোটেলে নিয়ে মুরগী পোলাও খাইয়ে-দাইয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে কাউন্সিলিং করেছি না! কাজ হয়েছে। তবে সাবধান। এসব কথা ওই ফ্যামিলির কারো সামনে আবার বলিস না।
জয়ন্তী মুখ ঘুরিয়ে নিজের রুমে ফিরতে ফিরতে বলে, না বাবা। কাউকে বলবো না।
রুমে ফিরে কেনো যেনো জয়ন্তীর মন খানিক উতলা লাগে। একটা গান শোনে সে
তারে কেমনে কাঁদাবে যদি আপনি কাঁদিলে
কে তারে বাঁধিবে তুমি আপনায় বাঁধিলে।
গান শুনতে শুনতে ভাবে জয়ন্তী, একটা অসহ্য ঘটনা আছে তার জীবনে। ওদের এলাকার মাস্তান টাইপের একটা ছেলে ওকে বিরক্ত করে। পুলিশের খাতায় ওর নাম হাঁস বাবু। মোস্ট ওয়ান্টেড। হাঁসের মতো ফ্যাশ ফ্যাশ করে কথা বলার কারণে তার এই নাম দেওয়া হয়েছে। সেই হাঁস বাবু বেশ কয়েকটা চিঠি পাঠিয়েছে জয়ন্তীর কাছে। কোথা থেকে মোবাইল ফোন নাম্বার পেয়ে বিরক্ত করে প্রতিদিন। রাস্তায় কখনো কখনো দেখা হয়ে যায় তার সাথে। ভীষণ বিরক্তিকর সে মুহূর্তগুলো। সপ্তাহ দুয়েক আগে জয়ন্তীর বাবা গিয়ে তার সাথে দেখা করে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে এসেছে। তারপর থেকে অবশ্য ফোন টোন করে না। তবু ওর কথা মনে হলেই জয়ন্তীর সারা শরীর হিম হয়ে আসে। জয়ন্তী ভেবেই পায় না এতো মানুষ থাকতে ওর জীবনে এরকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে কেনো? মাস ছয়েক আগে প্রথম এই ঝামেলাটা টের পায় সে। রিকশায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে গলির মোড়ে দুটো ছেলে বিনয়ের সাথে রিকশাটা থামায়। তারপর বলে
‘আপু আপনার জন্য একটা ম্যাসেজ আছে।
‘কি ম্যাসেজ? কার ম্যাসেজ?
ছেলে দুটো খুব আগ্রহের সাথে একটা চিরকুট এগিয়ে দিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে চলে যায়।
চিরকুটে লেখা– আমি তুমাকে বহুৎ পেয়ার করি– ইতি হাঁসবাবু
প্রথমে মনে হয়েছিলো চিরকুটটা ফেলে দেবে জয়ন্তী। কিন্তু বেশ মজা লাগলো তার। বন্ধুদের নিয়ে মজা করবে ভেবে চিরকুটটা ব্যাগের ভেতর রাখে জয়ন্তী । সেই থেকে বিরক্তিকর চিঠি। তিনদিন পর পর একটা। জয়ন্তীর দম বন্ধ হয়ে আসে। এলাকার কয়েকজন মুরুব্বীকে বলা হয়েছে। কিন্তু কেউ আর বিষয়টা নিয়ে এগোতে চায়নি। তাই চুপচাপ এসব যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে।
তবে ওর চিঠি পড়ে বন্ধুদের নিয়ে বেশ মজা করেছে জয়ন্তী। চিঠিগুলো এরকম
চিঠি-০১ ‘তুমি আমার জানের জান/আন্ধার রাতের বাতি/জেনে রেখো/ হাঁস বাবু জমিদারের নাতি/টাকা পয়সার অভাব নাই/ক্ষমতাও আছে /কথা দাও/ সারা জীবন/ থাকবা আমার পাশে।’ কবি হাঁসবাবু।
চিঠি-০২ আমার পিস্তলের মতো দামী তোমার চোখ
আমার ছুরির মতো ধারালো তোমার নাক
আমার পিস্তলের গুলির মতো তোমার হাসি
তাইতো তোমায় এতো ভালোবাসি!
ইতি হাঁসবাবু।
চিঠিগুলোর কথা ভাবতেই ভীষণ হাসি পায় জয়ন্তীর। গানটা বন্ধ করে দেয় সে। অনেকদিন পর জানালাটা খোলে জয়ন্তী। চমৎকার একটা হাওয়ায় তার সারা চুলগুলো উড়তে থাকে।
চার
কাল রাতে শেগুফতার ঘুম হয়নি ভালো । বারবার জামানের কথা ভেবেছে সে। বেশ কদিন ধরেই মানুষটা উধাও । কোথায় গেছে, কেউ জানে না । পুরোনো অভ্যাস। এসময় বাড়ী থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হবার জন্য মোবাইলও অফ করে রাখে সে । মনে মনে বেশ বিরক্ত হয় শেগুফতা। ফিসফিস করে বলে সে-মানুষটা এমন কেনো?
কিন্তু ভোরবেলাই জামান এসে হাজির। ক্লীন শেভড। একটা সাদা ফতোয়া আর জিন্সের প্যান্টে তাকে দেখতে নায়কের মতো লাগছিল।
জামান এসেই হৈ চৈ শুরু করে দেয়।
‘এই আনিস তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি ওঠ’।
আনিস বিছানা থেকে ওঠে। চোখ মুছতে মুছতে বলে
‘দুলাভাই কখন এলে?
‘এইতো এইমাত্র।
আনিস হাসে ‘এতো সকালে!
জামান বলে :আরে পারলেতো রাতেই চলে আসতাম।
ঝামেলায় ছিলাম বলে আসতে পারিনি।
‘কি ঝামেলা?
‘আগে ওঠো। তারপর বলবো।
জামান গুনগুন করে গান গায়। এসময় পূরবী বেগম নামাজ পড়েন। কোরআন তেলওয়াত করেন। এটা জানে জামান। তাই সরাসরি শেগুফতার ঘরে চলে আসে সে । শেগুফতা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে ওঠে। হাসে। যেনো সে স্বপ্ন দেখছে । বলে
‘বাব্বা এতো সকালে! কেমন আছো?
জামান কাছে আসে। ফিসফিস করে বলে
‘ভালো আছি। কিন্তু তোমাকে ছাড়া জীবন অর্থহীন দেবী । তাই ফিরে এলাম ।
শেগুফতা কাছে আসে। তারপর ওর গাল টিপে বলে
‘আহা ঢঙ। তুমি কোথায়
গিয়েছিলে বলোতো?
‘খুলনা। মাছের ঘের করছি। সেটা দেখার জন্য।
‘কই আমাকে তো কিছু বলোনি
জামান হাসে। বিছানায় বসতে বসতে বলে
‘এটাতো বলার মতো কিছু না। তবে ঝামেলা একটা করেছি।
শেগুফতা অবাক হয়ে তাকায়। বলে
‘কি ঝামেলা করেছো?
‘মাইর দিয়েছি। মাইরের উপর বাঙালীর কোনো ওষুধ নাই।
‘মানে!
জামান হাসে। পা ছড়িয়ে বসে। তারপর বলে, সে এক জটিল ঘটনা শেফা। চেয়ার কোচে উঠলেই দেখবে কিছু লোক কোনোদিক না তাকিয়েই চেয়ারটা বিছানার মতো ভাঁজ করে বিনা দ্বিধায় ঘুমিয়ে পড়ে। কার কি অসুবিধা হলো তা দেখার সময় নেই। কাল ঢাকায় ফেরার সময় এরকম দু’জন লোকের সাথে মোলাকাত হয়েছিল। খুব ভালো ট্রিটমেন্ট দিয়ে দিয়েছি। হাগা করে দিয়েছে। হা হা হা ।
শেগুফতা অবাক হবার ভঙ্গী করে বলে
‘ট্রিটমেন্ট মানে? কি ট্রিটমেন্ট?
জামান আবার হাসে। হাসতে হাসতে বলে, মাইর দিয়েছি। কঠিন মাইর। বাবা গো, মা গো বলে যা চেচালো না! একেবারে কাপড় চোপড় নষ্ট। হা হা হা।
শেগুফতা বলে, কিন্তু কেউ যদি বাসে উঠে একটু ঘুমুতে চায়– তাতে দোষের কি?
জামান বেশ সিরিয়াস হয়ে যায়। তারপর বলে
না না তাতে তো কোন অসুবিধে নেই। তবে সীটটা ভাঁজ করার আগে পিছনের লোকের অনুমতি নিতে হবে। তাতো কেউ করে না। ওরা আমার সামনে বসেছিল। তারপর চেয়ারটা এমনভাবে ভাঁজ করলো যেনো জায়গাটা ওদের বাপের কেনা। আমরা রিকোয়েস্ট করলাম । বললাম ভাই একটু সোজা হয়ে বসেন ।
একজন বললো, ভাই এতো প্যাচাল পাড়েন ক্যান। না পোষালে অন্য বাসে যান।
আমি পুষিয়ে দিয়েছি। ওই লোক দুটোকে এমন মাইর দিয়েছি জীবনে আর কোনোদিন বাসে উঠে ব্যাকা হয়ে বসবে না। সোজা বসে থাকবে। হা হা হা।
বাদ দাও। বাবা-মা’র সাথে দেখা হয়েছে?
‘না। মা নামাজ পড়ছে। বাবা মনে হয় ঘুমুচ্ছেন। আর মামা মর্নিং ওয়ার্কে বেরিয়েছে। রুমে উকি দিয়েছিলাম। দেখলাম না। তবে আনিসকে তাড়া দিয়ে এসেছি। হয়তো এখনই উঠে পড়বে।
শেগুফতা বলে ‘বাবা-মা কেমন আছে?
‘ভালো আছে। তোমার কথা খুব বলছিলো। আমি বললাম আনিস চলে গেলে তারপর তুমি ফিরবে।
শেগুফতা মন খারাপ করে বললো
‘ওনাদের খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?
‘মনে হয়। কিন্তু এসব নিয়ে ভেবো না। ওরা সামলে নেবে। আনিস প্রায় কতো বছর পর এলো। ওকে তো সময় দিতে হবে ! আমি যাই হাত মুখ ধুয়ে আসি।
জামান বাথরুমে ঢুকে যায়। শেগুফতা জামানের দিকে তাকিয়ে ভাবে। কি করে দুটো বছর পার হয়ে গেলো ওদের জীবনে। এইতো সেদিনের কথা। মামা একদিন হুট করে বাবার সাথে ফিসফিস করে বললো, দুলাভাই ছেলেতো চাঁদের টুকরা। ঢাকায় দু’টা বাড়ি। মাস্টার্স দিয়েছে ইংরেজী থেকে। বাবা শিল্পপতি হাসান চৌধুরী। ছেলেটা দেখতেও স্মার্ট। বাংলা কথা তো একেবারে বলতেই চায় না।
মামার বাড়াবাড়ি টাইপের কথা শুনে বাবা একদম ইমপ্রেসড । উত্তেজিত হয়ে বললেন, বলো কি ফয়জুর? এই ছেলে তো হাতছাড়া করা যাবে না!
সেদিন রাতেই এলো ওরা। জামান কে দেখে সত্যিই ভীষণ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল শেগুফতা। জামান বলেছিলো– ‘আপনি যদি অনুমতি দেন একটু কথা বলতে পারি?’
শেগুফতা অবাক। হেসে বলেছিল
‘জী। অবশ্যই।
জামান হেসে বলেছিলো ‘আপনাকে অনেক ভালো লেগেছে। তবে আমার সমস্যা আছে। অনেক।
শেগুফতা অবাক হয়ে বলেছিলো
‘কি সমস্যা ?
জামান সাবলীল গলায় বলেছিল ‘আমার আসলে কোনো কাজ করতে ভালো লাগে না।
‘তাহলে কি অলস?
‘তাও না।
‘তাহলে ?
জামান হাসতে হাসতে বলেছিল
‘ভীমরতি। আমার যেনো কি হয়– জানেন। মনে হয় সারাদিন একা একা ঘুরে বেড়াই।
শেগুফতার ঐ একমিনিটের আলাপটাই ভীষণ ভালো লেগেছিল। পরে অবশ্য শেগুফতা জেনেছে। জামান আসলে একসাথে অনেকগুলো ব্যবসা দেখে। কিন্তু অভ্যাসটা এখনো আছে। মাঝে মাঝে সে হাওয়া হয়ে যায়। কোথায় যে যায়। তবে দু’তিনদিন পরে আবার ফিরে আসে। প্রথম প্রথম ভয় লাগতো। না বলে-কয়ে চলে যাওয়া! শেগুফতার বাবা-মাও ভীষণ চিন্তায় পড়ে যেতো। কিন্তু জামানের একটাই উত্তর। হারিয়ে যাই শুধু তোমার কাছে নতুন করে ফিরে আসবার জন্য।
আনিস আসার দিন ছয়েক আগে এবারও গিয়েছিলো সে। বাসায় কিছু করার ছিল না বলে এ বাড়িতে চলে এসেছে শেগুফতা। এখন জামানকে দেখে সত্যিই মনটা ভীষণ ভালো হয়ে যায় তার। অথচ কাল রাতেও মনটা খারাপ ছিল তার ।
তোয়ালে দিয়ে মখ মুছতে মুছতে জামান সোফার উপরে বসে। বলে ‘কাল রাতে একটা মজার স্বপ্ন দেখেছি শেগুফতা?
শেগুফতা কাছে আসে । বলে ‘কি স্বপ্ন?
‘দেখলাম আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে গেছি।
শেগুফতা উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে বলে
‘তারপর?
‘তারপর। প্রথম দিনই দুটো আইন করেছি।
তাই নিয়ে দেশে প্রচণ্ড হট্টগোল।
‘কি আইন?
‘এখনকার কিছু ছেলেদের দেখবে মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হয়। খুবই ইন্টারেষ্টিং এবং ভীষণ বিপজ্জনক। ঢাকায় এই জিনিষটা বেশি।
‘আর?
‘আর একদল ছেলে-মেয়ে আছে। যারা ইংরেজী টোনে অনর্থক বাংলা কথা বলে। টিভি নাটক আর রেডিও চ্যানেলগুলো এদের সর্বনাশ করছে বেশি। আমি স্বপ্নে দেখলাম এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। এদেরকে আমি পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছি।
শেগুফতা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। তারপর বলে
‘দেশ গড়ার সব দায়িত্ব তো তুমি নিয়ে ফেলেছো দেখছি?
জামান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে
‘হ্যাঁ। অনেকটা সেরকমই।
পাঁচ
এতো ভোরবেলা মোবাইল ফোন বাজতে দেখে আনিস বেশ অবাক হলো। আনিস তন্দ্রার ভেতরই মোবাইল ফোন তুলে বললো– ‘হ্যালো’।
আশ্চর্য! লাইনটা কেটে গেল। আনিস অবাক চোখে মোবাইলের দিকে তাকায়। বিছানায় উঠে বসে। মোবাইলটা আবার বাজে। আনিস সেটটা তুলে বলে, হ্যালো কে বলছেন?
কোনো উত্তর নেই। একবার নাম্বারটা দেখে। চেনা চেনা লাগে। কিন্তু বুঝতে পারে না। লাইনটা এখনও অন আছে। আনিস আবার বলে, হ্যালো।
ওপাশ থেকে তখন ফিসফিস করে আওয়াজ আসে। ‘আমি জয়ন্তী। স্যরি আনিস ভাই। আমি খুব স্যরি। সেদিনের ঘটনার জন্য। আপনি ভালো আছেন?’
আনিসের মন ভালো হয়ে যায়। সেদিনের সেই ঘটনার জন্য যে অভিমান বুকের ভেতর আগুন হয়ে উত্তাপ ছড়ালো তা হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়। সে উত্তর দেয়– ভালো আছি। তুমি?
জয়ন্তী বলে, জানেন সেদিন আসলে আপনার উপর আমার অনেক রাগ হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম আপনি বোধ হয় আমার ইমোশনটা বুঝতে পারবেন।
আনিস বলে, ‘আমি জানি তুমি কি বলতে চাইছো। কিন্তু আমিও আসলে অনেকদিন দেশে না থাকাতে রীতি-নীতি প্রায়ই ভুলতে বসেছি। কি করবো বলো? বাবা বা মামার উপরতো আমার কোনো কন্ট্রোল নেই!’
জয়ন্তী চুপ করে থাকে। তারপর বলে, আমরা কি একটু আলাদা করে কথা বলতে পারি?
আনিস কি বলবে ভেবে পায় না। সে বলে– অবশ্যই। কোথায়? কখন?
বিকেল চারটা। কফি ওয়ার্ল্ড। মনে থাকবে?
থাকবে।
আনিস মোবাইলটা রেখে দেয়। চোখটা বোঝে। মুগ্ধতার হাসি। তারপর জীবনান্দের কবিতা পড়ে সে
‘এইসব নিস্তব্ধতা শান্তির ভিতর
তোমাকে পেয়েছি আজ এতদিন পরে এই পৃথিবীর পর
দুজনে হাটছি ভরা প্রান্তরের কোল থেকে আরো দূর প্রান্তের ঘাসে
উশখুশ খোঁপা থেকে পায়ের নখটি আজ বিকেলের উৎসাহী বাতাসে
সচেতন হয়ে ওঠে আবার নতুন করে চিনে নিতে থাকে
এই ব্যস্ত পটভুমি; মহানিমে কোরালির ডাক
হঠ্ৎ বুকের কাছে সব খুঁজে পেয়ে… ’
আজ খাবার টেবিলে অদ্ভুত আনন্দ। বাবা, মা, মামা, শেগুফতা, জামান আর আনিস। মামা বললো
‘বহুদিন পর আজ আবার আমরা একসাথে হযেছি। তাই না আপা?
পূরবী বেগমের চোখ আনন্দে ছলছল করে ওঠে। সোবহান সাহেব বললেন
‘অনেক শখ করে বাড়িটা বানিয়েছিলাম। নাম দিয়েছিলাম আনন্দ বাড়ি। আজ মনে হচ্ছে ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়েছে !
জামান হেসে বলে এটা ঠিক বলেছেন বাবা। আমারও দারুন এক্সাইটিং লাগছে।
মামা বলেন, কিন্তু তোমাকে তো ঠিকমতো পাচ্ছি না।
জামান একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, বিভিন্ন ধরনের ঝামেলা নিয়ে থাকি মামা। সময় পাই না।
মামা বলেন, কিন্তু সময়তো করতে হবে। আনিসকে বিয়ে দিতে হবে না?
জামান বলে, আনিস অনেক যোগ্য ছেলে মামা। ওর বিয়ে নিয়ে আমি মোটেও ভাবিনা।
বাবা মুখ বিকৃত করে বলেন, কত যোগ্য লোক দেখলাম। বিয়ে করার সময় ঝিম মেরে থাকে। কিচ্ছু বোঝে না। মুরব্বী না থাকলে এসব বিষয় এগোয় না।
আনিস বলে, বাবা তোমাদের সবাইকে একটা সারপ্রাইজ দিতে পারি।
বাবা বলে, তুই আবার কি সারপ্রাইজ দিবি? আমার কপালে তোর বিয়ে দেখার ভাগ্য নাই।
সবার চোখে মুখে উত্তেজনা তখন। মা হেসে বলে
আমার আর সহ্য হচেছ না। প্রেসার উঠে গেছে। কি সারপ্রাইজ?
আনিস হেসে আস্তে আস্তে বলে
‘আজ জয়ন্তী ফোন করেছিল। আমার সাথে দেখা করতে চায়
সবাই হৈ চৈ করে ওঠে। মা বলে
‘কি? তুই যাবি?
‘যাবো না কেনো। অবশ্যই যাবো।
আনিস হাসে। মামাকে উত্তেজিত দেখায়। খাওয়া বন্ধ করে সে দাড়িয়ে যায়।
‘কি দুলাভাই আপনাকে বলেছিলাম না মেয়েকে ওর পছন্দ হবেই হবে।
বিকেলবেলা কফিওয়ার্ল্ডে গিয়ে আনিস বেশ অবাক হল। জয়ন্তীকে দেখাচ্ছে পরীর মতো। সাথে এনেছে এক প্যাকেট চকলেট, ফুল আর কার্ড। আনিস হেসে বললো,
‘স্যরি আমি যে কিছু আনিনি?
জয়ন্তী চোখ পাকিয়ে বলে,
‘লাগবে না। আপনি এসেছেন। তাতেই আমি খুশী। কি খাবেন?
আনিস হাসে। বলে ‘না এই ঝামেলাটা না হয় আমি করি।
বলেই সে ওয়েটারকে ডাকে। জয়ন্তী বলে
‘তারপর?
আনিস বলে ‘তার আর কোনো পর নেই।
‘মানে?
‘মানেটাতো জানিনা জয়ন্তী।
জয়ন্তী হেসে বলে ‘আমাকে কেমন লেগেছে?
‘ভেবে দেখিনি। আসলে ভুল বোঝাবুঝিটা হয়ে যাবার পর সব গুলিয়ে গেছে। কাল সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছি।
‘আমি আবার স্যরি চাইলাম আনিস ভাই।
আনিস হেসে বলে ‘না। না। বারবার স্যরি চাইতে হবে না। সব ঠিক আছে। আমি শুধু তোমার সম্পর্কে জানতে চাই। কিছু বলবে তোমার সম্পর্কে?
জয়ন্তী হাসে । চুলে বিলি কাটে। আনিসের চোখে চোখ রাখে । তারপর সাবলীলভাবে বলে,
‘আমি আসলে খুব সিম্পল মেয়ে। যদিও পড়াশোনা করেছি ইউনিভার্সিটিতে কিন্তু খুব বেশি স্বাধীনতা পাইনি। নিজের মতো করে একটা বৃত্ত তৈরি করেছি। সেই বৃত্তের ভেতরে ক’জন বন্ধু বান্ধব আছে। এইতো।
কথা শেষ করে সে প্রশ্ন করে
‘আপনার সর্ম্পকে কিছু বলবেন?
আনিস গভীর ভাবে জয়ন্তীর কথা শুনছিলো । সে হেসে বললো : আমি পড়াশোনা করেছি আমেরিকাতে। ওখানে একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। এখানে এসেছি আসলে বিয়ে করতে। আমার গন্ডীটাও অনেক ছোট। তবে ঠিক কোথায় ফাইনালি সেটল করবো সেটা এখনো ঠিক করতে পারিনি।
জয়ন্তী খাবার খেতে খেতে খানিকটা আনমনা হয়ে যায়। বলে ‘তবে ঠিক বিদেশে সেটল করাটা লংটার্মের জন্য ভালো হবে কি-না ভেবে দেখা দরকার।
আনিসের কথাটা বেশ ভালো লাগে। সে মহা উৎসাহে শুরু করে ‘একজ্যাক্টলি। আমিও সেরকম ভাবছিলাম। ঐ জীবনটা এখন আমার কাছে সত্যিই অর্থহীন মনে হয়।
জয়ন্তী হেসে বলে ‘কেনো?
‘ওখানে ঢোকা থেকে বিপত্তি শুরু হয়। আর সেই একশন থাকে এক বছর। আমার সত্যি ভালো লাগে না।
জয়ন্তী কৌতূহলী হয় ‘মানে?
আনিস বিরক্তিভরা দৃষ্টি নিয়ে বলে ‘ইমিগ্রেশনে যেভাবে চেক করা হয় তাতে মনে হয় আমরা এক একটা চিড়িয়াখানার জন্তু। আর যতোবার আমার পাসপোর্ট থেকে ‘আহমেদ’ শব্দটা ওরা দেখে ততবারই খুব গুরুত্বের সাথে আমাকে চেক করে। আমি খুব বোরড।
জয়ন্তী হাসে । বলে ‘কিন্তু সিকিউরিটির স্বার্থে এটা ওরা করতেই পারে ‘তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে এপ্রোচটা ভাল্লাগে না। তবে এটাও মানি, ওদেরতো এছাড়া কোন অপশন নেই । যাক বাদ দাও ওসব। আমি সত্যিই এবার সিদ্ধান্তটা নেবো।
জয়ন্তী বলে ‘অথচ এতো সব সহ্য করেও তো থাকছেন! এবার কতদিন থাকবেন?
আনিস কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলে ‘মাসখানিক। তবে এর পরপরই আমার ভ্যাকেশন শুরু হয়ে যাবে। হয়তো চাইলে আরো কিছুদিন থেকে যেতে পারি।
জয়ন্তীই হঠাৎ করে বলে ‘আরে কি আশ্চর্য! আমরা তো ভীষণ সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলাপ করে যাচ্ছি।
আনিস হাসে। বলে ‘তাইতো! ঠিক আছে তোমার কথা বলো।
‘কি বলবো?
‘এই তোমার পছন্দ-অপছন্দ এসব বিষয়ে বলো।
জয়ন্তী বলে ‘আমি আমার কথা বলবো? এই আমি আবৃত্তি করতে পছন্দ করি। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ভালোবাসি। বন্ধুদের সাথে ফুচকা খেতে ভালো লাগে। স্টাডি ট্যুরে একবার কক্সবাজারে গিয়েছিলাম। আর আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় একবার ঢাকা ডিভিশনে ফার্ষ্ট হয়েছিলাম । এখন পর্যন্ত এটাই মেমোরেবল ঘটনা।
আনিস কফিটা শেষ করে। হাসে । তারপর বলে ‘তোমার সাথে আমার দুটো জায়গায় মিল আছে। আমিও কবিতা খুব ভালোবাসি। রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ করি। তবে খাবার ভালোলাগে মায়ের হাতে যে কোনো রান্না।
আনিস এবার উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। বলে ‘তোমার পার্সোনাল বিষয়ে কিছু বলার আছে।
জয়ন্তী হাসে। হাসতে হাসতে বলে ‘ব্যক্তিগত বিষয়, না। না। আমি আসলে কারো সাথে কখনোই ইমোশনালি ইনভলভড হবার সুযোগ পাইনি। তবে?
‘তবে কি?
‘তবে আমাদের পাড়ার মাস্তান টাইপের একটা ছেলে আমার পিছু নিয়েছিল। টেরিবল এক্সপেরিয়েন্স ।
আনিস কিছুটা অবাক হয়। বলে
‘ইন্টারেস্টিং। তারপর?
‘তারপর বাবা গিয়ে বুজিয়ে-শুনিয়ে এসেছে। গত সপ্তাহ দুয়েক আর কোনো ডিস্টার্ব করে না।
আনিস হাসে, :এটাতো স্বাভাবিক জয়ন্তী। তোমার মতো সুন্দরী মেয়েকে এরকম ঝামেলাতো পোহাতে হবেই।
‘কিন্তু এসব আমার ভাল লাগে না জানেন। ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভীষণ বিরক্ত।
আনিস হাসে। হাসতে হাসতে সে আর একটা কফির অর্ডার দেয়।
বলে, ‘একটা রিকোয়েস্ট করবো জয়ন্তী?
‘কি?
‘একটা গান শোনাবে আমাকে?
জয়ন্তী হাসে। চুলগুলো বিলি কাটে। বলে,
‘আমি আবৃত্তি করতে পারি। গান জানি না যে এতো ভালো।
‘না প্লীজ। একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। দুলাইন হলেও গাও।
জয়ন্তী হেসে বলে : আচ্ছা এটা কি গান গাইবার জায়গা?
আনিস নাছোড়বান্দা ‘শুনতে ইচ্ছা করছে । কি করবো?
:ঠিক আছে।
জয়ন্তী নীচু গলায় গান ধরে,
‘তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে
…………………….
যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি-
তবু মনে রেখো।’
গানটা শুনে আনিসের কি যে হয়– জয়ন্তীর হাতটা শক্ত করে ধরে থাকে সে।
ছয়
জয়ন্তীকে বিদায় দিয়ে কফিওয়ার্ল্ডের বাইরে মিনিটখানিক দাঁড়ায় আনিস। একটা সিগ্রেট ধরায়। কাল আবার দেখা হবে ওর সাথে। এখানেই। জয়ন্তীর দেয়া ফুল, চকলেট আর কার্ডটার দিকে তাকায় সে। আনিসের মনটা বেশ ফুরফুরে লাগে। অনেকদিন পর নিজেকে ভীষণ প্রাণবন্ত মনে হয়। ঠিক তখনই বাংলা সিনেমা স্টাইলে চারজন তাকে ঘিরে ফেলে।
হাসের মতো শব্দ করতে করতে একজন এসে বলে। ‘পাইছি হালার পুতরে। এই ধর ….।’
তারপর আনিসের আসলে কিছুই মনে নেই। ওরা তাকে একটা গাড়িতে তোলে। হাতের প্যাকেটগুলো বাইরে ফেলে দেয়। আনিস ঘুমিয়ে পড়ে তখন। শুধু মুখ থেকে অস্ফূট শব্দে বলে– ‘ক্রেইজি, ইউ কান্ট ডু দিস । ইঁটস আনফেয়ার।’
হাঁস বাবু বলে, চান্দু তো ইংলিশে কথা কইবার লাগছে। এই মুরাদ দ্যাখতো ঘটনা কি?
আনিস অনেকটা সংজ্ঞাহীন। নিজেদের তৈরি বিশেষ ধরনের ওষুধ দিয়ে তাকে এই কাজ করা হয়েছে। তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে মেঝেতে। কিরকম তন্দ্রাচ্ছন্নতা অথচ এ অবস্থায়ও সে ক্রমাগত কবিতা পড়ছে।
Sometimes
lips are sealed
tongue is tied
sometimes
hands can’t reach
the feelings are locked
Into these eyes
read the words unsaid
the feelings not laid
plunge deeply into my heart
every time
love is there
love is there…
মুরাদ বলে, বস হালায় তো কবি শেক্সপীয়ার। ননস্টপ কবিতা পড়তাছে। ঘটনা কি?
হাঁস বাবু বলে, এমন প্যাদানি দিমু, জয়ন্তীর নাম ভুইলা ‘মা দূর্গা’ কইয়া দৌড় দিব।
হাঁসবাবুর কথায় মুরাদ হেসে ওঠে। হাঁস বাবু বলে
মুরাদ, বাসু আর সবুজরে ডাক। কি করে ওরা?
মুরাদ কানের কাছে মুখ এনে আস্তে আস্তে বলে
‘ডাইল খায় ওস্তাদ। ডাকুম?
হাঁস বাবু বলে ‘ওদের ডাক। এইটা জটিল কেস লাগতাছে। চান্দু এতো ইংরেজী কয় কা?
ওরা একসাথে অন্যরুম থেকে বেরিয়ে আসে। বাসু বলে
‘ওস্তাদ ‘এ ধরনের মাল তো আইজ প্রথম দেখলাম। মনে হয় এদেশে থাকে না। ফরেন মাল
হাঁস বাবু মুগ্ধ হাসি হাসে। কোন কথা বলে না। মুরাদ বলে ‘জ্ঞান ফিরলে ঠাণ্ডা মাথায় ডিল করতে হবে। একসাথে দুই কেইস। জয়ন্তীও সাইজ আবার মুক্তিপণও হইবো ভালো।
হাঁস বাবু মন খারাপ করে তাকায়। বলে ‘মেয়ে মানুষ হইলো আগুনের জাত বুঝলি। শিক্ষিত মেয়ে দেইখা কতো কবিতা লিখলাম। নানাভাবে জানান দিলাম। কতভাবে ভালোবাসার কথা বললাম। জানটা দিতে শুধু বাকি রাখছি। কিন্তু আওয়াজ দিল না। শেষমেষ এই পোলার লগে ভিড়লো!
মুরাদ বলে ‘ঠিকই বলছেন ওস্তাদ। দুধকলা দিয়া সাপ পুষছি। তুইলা নিয়া আসি!
হাঁস বাবু হাসে। দুঃখের হাসি। সিগ্রেট ধরায়। বলে ‘এসব বহুত ভেজাল। মার্ডার কেসের চেয়েও ঝামেলার। তুইলা আনলে তো এতো মহব্বত দেখানোর দরকার ছিল না। আমি এইটা চাই না। আপোষে আইলে আইবো। নইলে আমি নাই। কি কস?
ওরা তিনজনই মাথা নাড়ে। হাঁস বাবু পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে আনে। তারপর আনিসের দিকে তাকায়। মুরাদকে ইশারা করে। মুরাদ ব্যাপারটা বুঝে আনিসের প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে। মানিব্যাগটা নেয়। অভ্যাস।
আনিস জেগে ওঠে। উঠে বসে। চারপাশে তাকায়। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে। সে বলে,
আমি কোথায়? তোমরা আমাকে ধরে এনেছো কেনো?
হাঁস বাবু, মুরাদ, বাসু আর সবুজ তাকে ঘিরে বসে থাকে। এ ওর দিকে তাকায়। আনিস লক্ষ্য করে একটা ছাদের উপর তোলা হয়েছে তাকে। তবে বিল্ডিংটার বোধ হয় কন্সট্রাকশন শেষ হয়নি। ড্রিম ড্রিম শব্দ আসছে পাশ থেকে। আনিস বললো, আমার মোবাইলটা দাও। আমি বাসায় একটা ফোন করবো।
হাঁস বাবু বলে, মোবাইল দেওয়া যাবে না।
আনিস একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বলে,
কেনো?
হাঁস বাবু সিগ্রেট ধরায়। হাসে। বলে ‘চান্দু এহনও বোঝো নাই ‘তুমি কই আসছো? তুমি শ্বশুরবাড়িতে আসছো।
আনিস ভালো করে হাঁস বাবু র দিকে তাকায় । বেশ লম্বা আর ফর্সা একজন যুবক । চুলগুলো কোঁকড়া । গোঁফ আছে বলে বয়সটা ঠিকমতো ধরা যাচ্ছে না । তবে জামা কাপড় বেশ পরিপাটী । সাদা টী শার্টের সাথে একটা ব্লু জিন্স পরে আছে সে । ডান হাতে সিগ্রেটের প্যাকেট । আনিস ওর দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে, বুঝতে পারছি। লেটস ডিল। কোনোরকম ঝামেলা করবে না। তোমরা কত চাও?
সরাসরি টাকার অফারটা পেয়ে আনিসের সামনে হাঁস বাবু র নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। তার হঠাৎ করেই মনে হয়– এ ধরনের ডিলে যাওয়া ঠিক হবে না । সে শক্ত গলায় বলে ‘না। আমরা টাকা চাই না। আপনি আমারে কত টাকা দিতে পারবেন? এই মিয়া ?
আনিস একটু অবাক হয়ে তাকায়। বলে : তাহলে আমাকে ধরে এনেছো কেনো?
হাঁস বাবু বলে ‘আমার নাম বাবু। মহল্লায় সবাই আমাকে সন্ত্রাসী বাবু বলে চেনে। আমি জয়ন্তীকে ভালোবাসি। আমি চাই আপনি ওখান থেকে সরে দাঁড়ান।
আনিস বেশ অবাক হয়। কিছক্ষণ আগেইতো জয়ন্তী এই লোকটার কথা বলছিলো?
আনিস বলে ‘তুমি কি হাঁস বাবু?
হাঁস বাবু ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
জামান বললো, আমার ব্যাডলাক মামা। আনিসকে ঠিকমতো পাচ্ছি না। ওর কথা শুনে ফয়জুর হাসে। বলে, ‘জয়ন্তী ডেকেছে না? ভাগ্নে তো গভীর প্রেমে মজে গেছে। ডিপ সী । গহীন সাগর। হা হা হা। ফয়জুর আবার হাসে। বলে, তোমার খবর কি বলো?
জামান বলে, ব্যবসা বাণিজ্য নিয়া ব্যস্ত আছি মামা। তবে সামাজিক কিছু বিষয় নিয়া চিন্তিত।
ফয়জুর উৎসাহ নিয়ে তাকায়। জামানের এইসব কাজের একরকম ভক্ত সে।
জামান হেসে বলে, একটা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন পড়লাম। তাতে দেখি দশ /বারোটা বিজ্ঞাপন। সবগুলোই পীর দরবেশ সংক্রান্ত। ওরা সবাই মুশকিল আসান করে। প্রেমে ব্যর্থতা থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নাই তারা সমাধান দিতে পারে না। সবাই জানে এসব ভুয়া। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।
মামা বলেন, তুমিতো বেসিক সমস্যায় যাও নাই। বেসিক সমস্যা হলো আমরা কেউই নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে জানি না। কনফিডেন্সের অভাব। তাই এত সমস্যা।
মামা হাসতে শুরু করেছেন। বলেন, শোনো। একবার লঞ্চে উঠে বরিশাল যাচ্ছি। গহীন রাত। লঞ্চ ভরা নদীর ভেতর দিয়ে টিপটিপ করে চলছে। অর্ধেক যাত্রীই ঘুমিয়ে আছে। এর মধ্যে কোন এক পাগল চেচিয়ে বলে উঠলো- ডোবছে ডোবছে। ডুইব্যা গেলে, ডুইব্যা গেলে।
কিছুই হয়নি। ঝড় নেই। বৃষ্টি নেই। শীতের রাত। পাগলের চিৎকারে কয়েকজনের ঘুম ভেঙে গেল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরেই নিলো লঞ্চ ডুবে গেছে। তারা কোনো কিছু না ভেবেই পানিতে লাফ দিয়ে পড়লো। পানিতে লাফ দেবার পর তারা বুঝতে পারলো তারা ভুল করেছে। আসলে কিছুই হয়নি।
এই হলো আমাদের দেশের মানুষ। সুতরাং ওরা বিজ্ঞাপন দেখে। সত্যিটা দেখে না।
জামান হেসে বললো, ঠিক বলছেন মামা। আমি শুনলাম সাতক্ষীরায় এক লোক স্বপ্নে দেখেছে তার বাড়ির আম গাছের পাতা খেলে সব রোগ সেরে যাবে। তিনি স্বপ্নে দেখার পর দুতিনজনকে আমগাছের পাতা খাওয়ালেন। পরেরদিনই দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসা শুরু করলো। এরপর সারা দেশ থেকে। তিনদিনের মধ্যে গাছের সব পাতা শেষ।
আমি ব্যাপারটা দেখার জন্য ঢাকা থেকে রওয়ানা হলাম। ওখানে পৌছলাম পরদিন। গেলাম দুপুরবেলা। দেখি কোনো ভীড় নেই। আমাকে দেখে একজন মহা উৎসাহে এগিয়ে এলেন। আমি বললাম, পীর বাবার সাথে দেখা করবো।
উনি আমাকে পথ নির্দেশনা দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। দেখি ভেতরে একটি কিশোর বয়সী ছেলে বসে আছে। সবুজ পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা। আমি বল্লাম,
‘আসসালামু আলাইকুম
‘ওয়ালাইকুম
‘আপনি কি পীর বাবা?
‘আমি পীর না, মুতা মিয়া।
‘আপনি কি স্বপ্নে দেখেছেন!
‘জ্বী।
‘কি দেখেছেন?
‘উনি পাতা খাইতে বলেছেন।
‘উকি কে?
‘পরওয়ারদেগার।
আমি অবাক হয়ে বল্লাম,
‘পরওয়ারদেগারকে স্বপ্নে দেখেছেন?
‘জ্বী না। গায়েবী আওয়াজ পাইছি।
আমি বললাম,
‘কিন্তু গাছের পাতাতো সব শেষ । এখন কি হবে?
কিশোর ঘোরলাগা চোখে বলে,
‘আবার হবে। সব পরীক্ষা।
জামান উৎসাহ নিয়ে বললো,
‘কি কি রোগ সারে এই পাতা খেলে!
পাশের লোকটি বলে,
‘সব রোগ জনাব।
আমি বললাম,
‘কোনো প্রমাণ আছে?
লোকটি হাসতে লাগলো। মুতা মিয়া বললো,
‘আপনি কি পুলিশের লোক!
‘জ্বী না। রুগী।
মুতা মিয়া কৌতূহলী হয়ে বললো,
‘কি রোগ আপনার?
আমি সহজ গলায় বললাম,
‘রোগটা গোপন অঙ্গে হয়েছে।
দেখাবো?
কিশোর বোধহয় খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেলো। তারপর বললো,
‘আপনি কি সাংবাদিক!
আমি ভাবলাম-ছেলেটাকে ঘাবড়ে দেই। বললাম,
‘জ্বী সাংবাদিক। আপনার উপরে একটা রিপোর্ট করবো।
মিনিট কয়েক পরে আশেপাশে সব ফাঁকা হয়ে গেলো। হুজুর মুতা মিয়া নির্দ্ধিধায় বললো, ‘আমি পায়খানায় যাই। আপনি বসেন।’
বলেই সে একটা বদনা নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো।
ঘটনাটা শুনে মামা হাসতে থাকেন। কিন্তু তিনি কিছু একটা নিয়ে টেনশনে পড়েছেন। বলেন, আটটা বাজে। এখনো আনিস আসছে না কেনো? দেখোতো জামান?
জামান বলে, আরে ফোন তো সেই বিকেল থেকে বন্ধ মামা । আমি ট্রাই করেছিলাম। ডেটিং করছে না?
ফয়জুর মিয়া আবার হো হো করে হাসতে থাকেন।
হাঁস বাবু বলে, তাহলে আপনিই সেই পাত্র?
আনিস বিনয়ের সাথে বলে ‘জ্বী।
হাঁস বাবু খানিকটা উত্তেজিত হয়ে যায়। বলে
‘আপনারে ভাই আমি গুলি করবো। দুই পায় দুটা।
মুরাদ বলে ‘না ওস্তাদ, পায়ে না, গলায় করেন । বহুতদিন মানুষ মারি না।
কথা শুনে ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে যায় আনিস। কিন্তু তার ভাবভঙ্গীতে সে রকম কিছু মনে হয় না। আনিস বলে, ‘আপনার কাছে পিস্তল আছে। আপনি চাইলেইতো গুলি করতে পারেন। কিন্তু আমারতো কোনো দোষ নাই বাবু ভাই! সে আমাকে ফোন করেছে। দেখা করতে চেয়েছে। আমি ভাই বিয়ে করার জন্য মেয়ে দেখছি। তাই গিয়েছি। আমিতো জানতাম না!’
হাঁস বাবু বলে, ‘তার মানে কি? এখনতো জানলেন।
আপনি আমারে ওয়াদা দেন। আপনি আর ওসব ঝামেলায় যাবেন না।’
আনিস কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। বলে,
‘একটা সিগ্রেট পাওয়া যাবে বাবুভাই?’
হাঁস বাবু সিগ্রেট এগিয়ে দেয়। লাইটারটা জ্বালিয়ে সিগ্রেট ধরিয়ে দেয়।
আনিস বলে, ‘একটা কথা বলবো বাবু ভাই?’
‘বলেন।’
‘আগে আপনার লোকগুলাকে সরান।’
হাঁস বাবু হাতের ইশারায় অন্যদেরকে সরে যেতে বলে। আনিস বলে,
‘ভাই নির্ভয়ে কিছু কথা বলবো?’
‘জ্বী বলেন।’
আনিস হাঁস বাবু র চোখের দিকে তাকায়। তারপর বলে,
‘আপনি তো একজন মার্কামারা সন্ত্রাসী। নিরক্ষর লোক। পুলিশের খাতায় মোস্টওয়ান্টেড। ফাঁসির আসামী । জয়ন্তী শিক্ষিত মেয়ে। মাষ্টার্স করছে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। আপনার কি মনে হয় আপনার এই যোগ্যতা দিয়ে আপনি ওকে বিয়ে করতে পারবেন?’
হাঁস বাবু থতমত খেয়ে যায়। কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। আনিসের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। আনিস বলে,
‘আপনি অনেক ভুল করে ফেলেছেন বাবু ভাই। কাউকে কাছে পেতে চাইলে ভয় দেখিয়ে হয় না। বন্ধুত্ব করতে হয়। আপনি বন্ধুত্ব করারও যোগ্যতা হারিয়েছেন ।’
হাঁস বাবু একটু নরম ভঙ্গীতে বলে,
‘মিয়াভাই আপনের নাম কি? কই থাকেন?’
আনিস হেসে বলে, ‘আমার নাম আনিস। কলাবাগানে থাকি।’
হাঁস বাবু কাছে আসে। বলে, ‘সত্যি আনিস ভাই। আপনে ওস্তাদ মানুষ। পারলে আমারে হেল্প কইরেন। স্যরি ভাই আপনাকে এভাবে ধরে আনার জন্য ।’
আনিস উঠে দাঁড়ায়। মুরাদ ততক্ষণে তার মোবাইল আর মানিব্যাগ নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো নিতে নিতে সে বলে, ‘বাবু ভাই। আমি হেল্প করবো। সত্যি হেল্প করবো।’
সাত
অদ্ভুত এক অনুভূতি। নীল আকাশের ভেতর সাদা সাদা মেঘ পরীরা যে রকম উড়ে বেড়ায় কিংবা সবুজ বনের সবুজ মাছরাঙা যেরকম গহীন অরণ্যে হারিয়ে যায়। জয়ন্তীর সেরকম লাগছিল। মনে হয় অদ্ভুত এক মায়াচ্ছন্ন অরণ্য তাকে ডাকছে। হাতছানি দিয়ে।
এই গহীন অরণ্যের ভেতরে থাকার আকাঙ্ক্ষার নাম কি তবে প্রেম! কৈশোর, উদ্ভিন্ন যৌবন এবং এই দূরন্ত সময়ে কতভাবে তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছে পাড়ার রোমিওরা। স্কুল, কলেজে এবং শেষমেশ ইউনিভার্সিটিতেও কম যায়নি। কিন্তু সত্যিকার ভেতরের টান ছিল না তখন। করমচা ফুলের চাটনীর মতো একধরনের টক মিষ্টি অনুভূতি ছিল তবে সেখানে কোনো প্রেম ছিল না। ইউনিভার্সিটিতে যখন ফার্স্টইয়ারে পড়তো জয়ন্তী তখন পলা নামের এক বান্ধবী তাকে বলেছিল, প্রেম হলো রূপনগরের রাজকুমারীর মতো। টিপ টিপ বৃষ্টির মতো সে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
জয়ন্তীর তখন কি হয়েছিল। বলেছিল, যাহ কোনোদিন ভিজবো না। কিন্তু সত্যিই বুকের ভেতরে তখন তুম্বকী শব্দের মতো তুলকালাম বৃষ্টি। আজ প্রথম আনিসের সাথে একা একা গোপনে কথা বলা। আনিসকে গান শোনানো, আনিসের হাতের স্পর্শ সবকিছুই তাকে সেই বৃষ্টির মত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
যেনো সেই গোপন আর মায়াচ্ছন্ন অরণ্য। এক নিরবিচ্ছিন্ন আকাঙ্ক্ষা। একটু একটু করে সমুদ্রের জলের মতো বাড়ছিল ।
আজ কোনো ভয় নেই। আনিসকে সে ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছে।
অনেকদিন পর নিজের ঘরটার দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে জয়ন্তী। সারা ঘরটায় ফিল্ম স্টারদের ছবি। এক কোনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি। কম্পিউটার। সিডি প্লেয়ার। বইয়ের সেলফের পাশে নানা ধরনের গানের সিডি। আর ছোটবেলায় বাবা যখন মাঝে মাঝে বিভিন্ন সেমিনারে এটেন্ড করার জন্য বিদেশে যেতো, পকেট ভর্তি করে সে নিয়ে আসতো বিদেশী কয়েন। সেসব জমিয়ে রেখে নিজের শখের জিনিসগুলোকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে সাজিয়ে রাখতো।
আজ যেনো সেসব কিরকম অর্থহীন হয়ে পড়ে তার কাছে। মনে হয় আনিস অন্য সব অনুসঙ্গগুলোকে তুচ্ছ করে নিজেকে মেলে ধরেছে তার সামনে। এক অদ্ভুত মায়ার ঘেরাটোপ।
এখান থেকে কোনোদিন সে বেরিয়ে আসতে পারবে না।
একটা লাল নীল পরী হয়ে সত্যি সত্যি মেঘের ভেতর ভেসে যাচ্ছিল জয়ন্তী।
আজ কেন যে ভীষণ ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে তার। যখন স্কুলে পড়তো, ক্লাশ এইট অথবা নাইন জয়ন্তী দেখতে ছিল পুতুলের মতো। পুতুলের মতো ফ্রক পড়তো। চুল ঝুঁটি করে বাঁধতো। আর খুব মিষ্টি করে হাসতো কথায় কথায়। তখন আবিদ নামের এক টিচার তার বুকের ভেতর ঝড় তুলেছিলো।
আবিদ দেখতে ছিল অসাধারণ। লম্বা। চোখগুলো ছিল শান্ত নদীর মতো । সে একদিন ওর হাত ছুঁয়ে বললো। ‘এই মেয়ে তুমি ক্লাশের ভেতর এতো হাসো কেনো? আর হাসবে না। হাসবে না।’ বলে নিজেই হেসে কুটিকুটি।
জয়ন্তী ভীষণ লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। কেনো হেসেছিল আবিদ স্যার। পরে জেনেছিল ক্লাসের ভেতর কে যেনো লাফিং গ্যাস ছেড়ে দিয়েছিল।
পরেরদিন যখন স্কুলে গিয়েছিল শুনতে পেরেছিল আবিদ স্যার ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেছে। এমার্জেন্সী ট্রান্সফার। পুরো ঘটনাটা ঠিক মনে নেই। তবে এরকম কোনো বিষয় ছিলো। খুব মন খারাপ হয়েছিল তার। এই যে কারো জন্য মন কেমন করে– এর নাম কি ভালোবাসা? কি জানি!
কলেজে ছিল স্কুলের মতোই জীবনযাপন। কো-এডুকেশন ছিল না। মেয়েরা মেয়েরা যুদ্ধ। ঝগড়া। রাগ। অভিমান আবার বন্ধুত্ব। এর ভেতরেই অন্য কলেজের সিনিয়র ভাইয়ের প্রেমের প্রস্তাব। অন্য কলেজের মেটরাও পিছিয়ে ছিল না খুব একটা। নানা ধরনের যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে । কিন্তু মনের জানালা খুলতে ইউনিভার্সিটিতে এসে এতো বেশি ব্যস্ততা, চারদিকে এনগেইজমেন্ট। কবিতার দল। নাচের স্কুল। সবকিছু মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ততায় কেটেছে সখের সময়গুলো।
তারপর প্রতিদিন টিউটোরিয়াল। ক্লাশ টেষ্ট। সেমিষ্টার। ফাইনাল পরীক্ষা। এক অদ্ভুত জীবনযাপন।
সময় ছিল না কোনো।
তবু আজকের এই দু’ঘণ্টার আলাপ পুরো জীবনের ছক পাল্টে দিতে শুরু করেছে তার। আনিসকে বড় বেশি কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। মনে হয় সারারাত কথা বললেও ওর কোনো কিছুই বলা হবে না।
কিরকম একটা ঘেরাটোপের ভেতর জয়ন্তী। আনুশকা ফোন করেছিল। ধরেনি। আলভী ফোন করেছিল। কথা বলা হয়নি। এখন কি ওদের রিং ব্যাক করবে সে। না। নিজে নিজেই ফিসফিস করে বলে জয়ন্তী।
একটা বুদ্ধি আসে মাথায়। দরজাটা বন্ধ করে দেয় সে। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে সে বলে,
‘ক্যামন আছো জয়ন্তী?
‘ভালো।
‘বিকেলটা কেমন কাটলো?
‘চমৎকার। ফ্যান্টাসটিক। আরো কিছু অবজেকটিভ দিতে পারলে ভালো হতো।
‘তুমি কি আনিসকে পছন্দ করে ফেলেছো?
‘জানিনা।
‘না না তোমাকে সত্যি সত্যি বলতে হবে।
‘হ্যাঁ। আমি ওকে পছন্দ করেছি।
‘কেনো?
‘অনেকগুলো কারণ আছে।
‘যেমন?
‘যেমন ও ভীষণ ম্যাচিউরড। চেহারাটা মায়া মায়া। দেখতে কালো কিন্তু কথা বলে সুন্দর করে। সংবেদনশীল। শিক্ষিত। স্মার্ট।
‘তাহলে তুমি ওর সাথে সেদিন এরকম ব্যবহার করলে কেনো?
‘আমি ভুল করেছিলাম জনাব। ভুল করেছিলাম।
জয়ন্তী হাসে। মনে মনে ভাবে– আনিসকে একটা ফোন করা দরকার।
হাঁস বাবু গ্রুপের কাছ থেকে ছাড়া পাবার পর আনিস ভেতরে ভেতরে বেশ হতাশ হয়ে পড়ে । বাড়ী ফিরে এসে বিষয়টা নিয়ে কারো সাথে কথা বলেনি সে । অপ্রসন্ন ভঙ্গীতে একটা তন্দ্রাচ্ছন্নতা তাকে গ্রাস করে নিঃশব্দ স্রোতের মতো । বাড়ীর সবাই যখন বিয়ের কেনাকাটা আর গল্পসল্প নিয়ে ব্যস্ত, আনিস তখন নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে গভীর ঘুমে ডুবে যায় । ঠিক কতক্ষণ মনে নেই । আনিসের যখন ঘুম ভাঙে তখন গভীর রাত । আনিস জানে এসময় মামা আর জামান দুলাভাই ছাড়া বাড়ীর অন্যরা গভীর ঘুমে অচেতন । তাই সে দরজাটা খোলে না । আশ্চর্য এক ভয়ে তার সারা শরীর ছমছম করে । তবে বাংলাদেশে কদিন এসে একেবারে নিজের কৃত্রিমতার খোলস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে আনিস ।
একদিকে জয়ন্তীকে জয় করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অন্য দিকে দুর্ধর্ষ এক সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করে আনার সাফল্য তাকে হঠাৎ করে খানিকটা উদ্দীপ্ত করে। ভয়টা তখন উড়ে যায় নিঃশব্দ অরণ্যের ভেতর । সিগারেটের তেষ্টা পায় খুব। পকেট হাতড়ে পাওয়া যায় না। কি মনে হতেই মোবাইলের দিকে তাকায় সে। চারটা মিস কল। জয়ন্তীর। আশ্চর্য ঘুমের ভেতর টের পায়নি সে। ঘড়ির দিকে তাকায় আনিস। রাত দুটো। এতক্ষণ কি জয়ন্তী জেগে আছে? আনিস মোবাইলের বাটনটা টেপে। ও পাশে রিং বাজে কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। আনিস জয়ন্তীকে একটা এসএমএস পাঠায়। রবীন্দ্র সঙ্গীতের দুটো লাইন।
‘এত দিন যে বসে ছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুনে
দেখা পেলেম ফাল্গুনে’
আট
আন্ডারগ্রাউন্ডে আজ ফায়ার ক্যাম্প বসেছে। হাঁস বাবু, বাসু, সবুজ আর মুরাদ। বাবুর মন ভালো নেই। বিকেলে আনিস চলে যাবার পর কয়েক পশলা বৃষ্টির মতো বিষাদ ছুঁয়েছে তার মন। আনিসের কথাগুলো সাপের ফণার মতো লক লক করে মাথার ভেতর। ভাল্লাগে না। মুরাদ হুইস্কি নিয়ে এসেছিলো। বাবু সেটা ছুঁয়েও দেখেনি।
শুধু বলেছে, কেনো আনলি? তোরা তো জানিস আমি খাই না!
মুরাদ হেসে বলেছিলো, কেনো ওস্তাদ! একদিন খেলে কি হয়?
বাবু মাথা নাড়ে। সিগ্রেট ধরায়। ছাদের ফুটো দিয়ে তখন আকাশের চাঁদ রুপোলী ইলিশের মতো ঝকমক করে। নক্ষত্রগুলো উছলে পরে আলোর ছটায়। একঘেয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার তাণ্ডব যেনো বিষণ্ণতা ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। এরকম পরিবেশে তাই বাবুর কি রকম নিঃসঙ্গ লাগে ।
মুরাদ একটু কাছে আসে। গলা নীচু করে বলে, ওস্তাদ খুউব মন খারাপ হইছে!
বাবু মাথা নাড়ায়। বলে, জানিস ছোটবেলায় নন্দিনী নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। আমার বয়স তখন সতেরো আঠারো হবে। সবেমাত্র ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি। পাড়ায় নন্দিনীকে প্রথম দেখে আমার ঘুম আসে না। আমার দিন কাটে না।
মন কেমন উদাস উদাস করে। কিন্তু কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই নন্দিনীর বিয়ে হয়ে গেল।
সেদিন রাতে আমি প্রথম মদ খেলাম। আমাদের পাড়ার উল্টোপাশে ছিল মেথরপট্টী। সেখানে সুমন্ত নামে এক ছেলেকে চিনতাম আমি। তার বাড়িতে গিয়ে জীবনে প্রথম কি ভীষণ বাজে একটা জিনিস গলায় ঢাললাম। কি রকম খারাপ লাগা অনুভূতি। একটা সময় দেখলাম আমি ঠিক আছি। কিন্তু পুরো পৃথিবীটা ওলটপালট। নন্দিনীর বাড়ির সামনে গিয়ে সেই প্রথম চীৎকার করে বল্লাম, নন্দিনী আমি তোমাকে ভালোবাসি।
সারা পাড়া মাথায় করে বাড়িতে এলাম। ভয়, দ্বিধা, লজ্জা। বিড়ালের মতো চুপচাপ বাসায় ঢুকে কারো সাথে কোনো কথা না বলেই ঘুমিয়ে পড়ি আমি। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়ি ভর্তি লোক। আমার নামে নালিশ জানাতে এসেছে সবাই। গত রাতে আমি মদ খেয়ে কি কি করেছি সেই বর্ণনা।
বাবার ভয়ে তখন আমার সারা শরীর হিম হয়ে এলো। বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়াতে পারি না। মাথা নীচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
কিন্তু বাবার অন্যরকম চেহারা দেখে অবাক হলাম। বাবা বললো,
আমার ছেলে যদি মদ খায়। খাক না।
ওতো কারো সমস্যা করছে না। ছেলেমানুষ। যেদিন ও বুঝবে সেদিন ঠিক ছেড়ে দেবে।
বাবার এই নির্বিকার তত্ত্বে সবাই ঘাবড়ে গেলো। একজন বললো,
‘তাই বলে পাড়ায় মাতলামি করবে?
আমার মেয়েকে উল্টাপাল্টা বলবে?
বাবা বল্লেন, মদ খেয়ে মাতলামি করাটা অভদ্রতা। মেয়েদের টীজ করা অসভ্যতা। আমি ওকে বুঝিয়ে বললো।
সবাই চলে যাবার পর বাবা আমার ঘাড়ে হাত রেখে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘পাগলা ছেলে। তোর কষ্ট কিরে! আমি আছিনা!’
আমার ব্যাপারটা কি বাবা বুঝে গিয়েছিল? তাকে কখনো বলা হয়নি। সেই থেকে আমি আর মদ খাইনা। মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাই না। ভাল্লাগে না। আর মদ জিনিসটা দেখলেই বাবার কথা মনে পড়ে। আজ অনেকদিন পর। বাবাকে খুব মনে পড়লো।
বাবুর কথা মন দিয়ে শোনে মুরাদ। কিছুটা আবেগী হয়ে ওঠে সে । বলে,
‘ওস্তাদ আপনি যাদু জানেন। আপনার কথা শুনলে আমার চোখে শুধু পানি আসে।
কথাটা বলেই সে হু হু করে কেঁদে ফেলে।
বাবু বলে, এই পথে আমি আসতে চাইনি জানিস। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় আমি মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে যখন কলেজে ভর্তি হলাম একটা রাজনৈতিক দলের ক্যাডার বনে গেলাম ছয় মাসের মধ্যে। হঠাৎ করেই কলেজে একটা খুন হলো। পলিটিক্যাল মার্ডার। আমি আসলে ইনভলব ছিলাম না। কিন্তু পুলিশের খাতায় আমার নাম উঠে গেলো।
বাবা এই কথা শুনে হতভম্ব। মা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিলেন । একদিন গভীর রাতে বাবা আমার রুমে এসে ফিসফিস করে বললো, ‘পালা বাবু, আমি জানি তুই এসবে নেই। তুই ধরা পড়লে আমার সহ্য হবে না।’
সেই থেকে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এরপর অনেকদিন চলে গেছে। একদিন বাবা মারা গেলো। মা মারা গেলো। আমার কাছে খবর এলো। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ভীড়ের ভেতর ওদেরকে শেষবারের মতো দেখে এলাম। ব্যাস এটুকুই। আমার এখন দূরন্ত জীবন যাপন। পুরান ঢাকায় আন্ডারগ্রাউন্ডে কিলিং অপারেশন। এই বয়সে মাথার উপরে চারটে খুনের মামলা। একটা মামলার রায়ে আবার ফাঁসি হয়ে গেলো। কি অদ্ভুত জীবনযাপন আমার!
মুরাদ বলে ওস্তাদ তোমার মন খারাপ হইলেতো আমাদের ভালো লাগে না। আমরা কি করবো! কেনো বলছো এসব?
হাঁস বাবু এতোক্ষণ পর হাসে। বলে, না না আমার মন খারাপ না। তবে এটাও বলি… আমি আসলে খামাখাই জয়ন্তীর পেছনে ছুটেছি। আনিস কত ভালো ছেলে। শিক্ষিত। স্মার্ট। সাহসী। আমি চাই জয়ন্তী সুখী হোক।
সবাই চুপ করে থাকে। বাবু সিগ্রেট ধরায়। রিং বানিয়ে বানিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে উপরে। তারপর ফিসফিস করে বলে– যাহ ছেড়ে দিলাম আজ থেকে। জয়ন্তীর কাছে আর কখনো যাবো না আমি।
বাসু আর সবুজ এতক্ষণ বাবুর কথা শুনছিল মন দিয়ে।
বাবু যখন কথা বলে ওরা কোনো প্রশ্ন করে না। শোনে।
আজও তাই হলো। বাসু বল্লো, ওস্তাদ আমি একটু কথা বলবো।
বাসু তাকায়। বাসু বলে, জয়ন্তীরে আমরাতো ছাড়তে পারবো না ওস্তাদ।
বাবু অবাক হয় । বাসুর চোখ মুখ শক্ত ।
বাসু সিগ্রেট জ্বালায়। উঠে দাঁড়ায়। সিগ্রেটে টান দেয়। বলে–
যে মেয়েকে আপনি ভালোবাসেন তারে তো এমনি এমনি ছেড়ে দেবো না ওস্তাদ। তারে আমি তুইলাই আনবো।
বাবু কাছে আসে। তারপর আস্তে আস্তে বলে,
কি লাভ? যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয় আছে। আনিস আমার চোখে আঙুল দিয়া দেখাই দিছে। আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি। তুই আর এসব করিস না।
বাবুর কথায় জেদ আরো বাড়তে থাকে বাসুর। বোঝা যায় । বেশ ক’টা টান দিয়ে সিগ্রেটটা একনিমিষে শেষ করে পা দিয়ে পিষে ফেলে সে। বলে,
ওস্তাদ তুমি সেদিন আনিসরে ছাইড়া দিছ।
আমি হইলে দিতাম না। তুমি বার বার তোমার প্ল্যান চেঞ্জ করতাছো।
তবে আমি কথা দিলাম। জয়ন্তীকে তোমার কাছে নিয়া আসবো। সাতটা দিন সময় দাও। সব ফাইনাল কইরা ফালামু।
বাবু উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তারপর বলে, এসব ঝামেলায় যাসনা বাসু; সমস্যায় পড়বি !
নয়
আনন্দবাড়িতে আজ উৎসব। জয়ন্তীরা আসবে আনিসদের বাড়ি। বিয়ের কথাবার্তা পাকা করতে। সে উপলক্ষে আনিসদের বাড়ি আজ সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। মামা সকাল থেকেই বেশ উত্তেজিত অবস্থায় ঘোরাফেরা করছেন। তার মুখ গম্ভীর। তিনি সকালে ঘোষণা দিয়েছেন– ছেলেদের সবাইকে লাল পাঞ্জাবী পড়তে হবে।
কিন্তু তিনি নিজে তার ঘরে রাখা লাল পাঞ্জাবীটা খুঁজে পাচ্ছেন না। সকালবেলা আলাউদ্দীন মিয়া সেই ঘোষণা শুনে মামার রুম থেকে একটা লাল পাঞ্জাবী খুঁজে পড়ে ফেলেছে। মামা সন্দেহ করছেন। কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না।
মামা আনিস আর জামানকে ডাকলেন। বললেন–
‘তোমরা কি লাল পাঞ্জাবী পেয়েছো?’
আনিস বিরক্ত গলায় বলে,
‘মামা কি সব নিয়ম-কানুন করেন। আমার তো এসব কেনা নেই।’
মামা বললেন, ‘সে জন্যইতো তোমাদের ডেকেছি। আমারও নেই। মানে খুঁজে পাচ্ছি না। তোমরা যখন দোকানে যাবে আমার জন্যও একটা পাঞ্জাবী কিনে আনবে। অন ক্যাশ।’
জামান হেসে বলে– ‘সাইজ কতো মামা?’
মামা গম্ভীর হয়ে বললেন– ‘ফর্টি এইট’
মামা একটু কাছে আসলেন, বললেন,
ঐ আলাউদ্দীন মিয়া একটা চোর। ও আমার ঘর থেকে পাঞ্জাবীটা নিয়ে সেটা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার হি হি করে হাসছে। কত বড় সাহস। আগে বিয়েটা হোক। ওকে বিদেয় করে দেবো।
কথা শুনে আলাউদ্দীন মিয়া ফোকলা দাঁত বের করে হাসে। বলে,
‘মামা দেখেন তো লাল পাঞ্জাবীতে আমারে কেমুন লাগতেছে? গুলিস্থান দিয়া তিনশো টাকায় কিনছিলাম। তিন বছর আগে। সুন্দর না?’
মামার রাগ বাড়তে থাকে। উনি দাঁত কটমট করে তাকিয়ে আছেন।
আনিস বলে, তোমাকে সুন্দর লাগছে তবে এতো পুরোনো পাঞ্জাবী আর পরার দরকার নাই। আমি নতুন একটা কিনে আনবো।
আলাউদ্দীন মিয়া দাঁত বের করে হেসে চলে যায়। মামা বললেন,
‘ভালো একটা দিনে মুডটা খারাপ করলাম না। শোন তোদের বলছি আজকের দিনের সব খরচ আমার!
তারপর একা একাই বললেন, ইটস রিয়েলি এ লাভলী ডে।
আজ দুপুরের মেন্যুটা ফাইনাল হয়নি। আজ বিশেষ একটা দিন । জয়ন্তীদের নিমন্ত্রণ তাদের বাসায় । তাই সোবহান সাহেব বাজারে এসেছেন। তবে এ নিয়ে আনিসের মা মানে পূরবীর সাথে কথাবার্তাও হয়নি। তার আগেই তিনি চলে এসেছেন বাজারে। কেনাকাটা করতে গিয়ে তাই বার বার সমস্যা হচ্ছে। কি রকম কনফিউশন তৈরি হচ্ছে।
গরুর মাংসের দোকানদার বললো, স্যার মাংস কয় কেজি দেবো, পাঁচ?
সোবহান সাহেব বললেন, না তিন। পাঁচ। সাত।
দোকানদার বলে, স্যার অতো টাইম নাই। জলদি কন কয় কেজি দিমু?
সোবহান সাহেব অসহায়ের মতো তাকান। বললেন, একটু ধৈর্য ধর। তিনি মোবাইলটা বের করে ফোন করলেন পূরবী বেগমকে। পুরবী বেগম আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, তোমাকে এখন বাজারে যেতে বলেছে কে?
সোবহান সাহেব অসহায়ের মতো বললো, কেনো বাজার করবো না? কোনো সমস্যা?
পূরবী বেগম হাসেন। বলেন, আরে না না, ফয়জুর সব দায়িত্ব নিয়েছে। তোমাকে কিছু বলেনি?
সোবহান সাহেব লাইনটা কেটে দিলেন।
মনে মনে বল্লেন, ঐ গাধাটা কি দায়িত্ব নেবে? দোকানদারকে রাগে কটমট করে বল্লেন ‘দাও দশ কেজি দাও।
দোকানদার মহাউৎসাহে দশ কেজি মাংস মাপা শুরু করে দেয়।
এর মধ্যে ফয়জুরের ফোন।
‘দুলাভাই আপনি চলে আসেন। জব ওয়েল ডান।
‘‘জব ডান’ মানে।
‘সোনারগাঁতে অর্ডার দিবো। দে উইল সার্ভ আওয়ার ফুড।
সোবহান সাহেব কর্কশ গলায় বললেন,
টাকা দেবে কে?
ওপাশ থেকে ফয়জুর হাসে। হাসতে হাসতে লাইনটা কেটে দেয়।
সোবহান সাহেব একা একা বল্লেন– না। না। এ হয় না। ও বাড়ি থেকে লোকজন আসবে আর আমরা তাদের জন্য অর্ডার দিয়ে হোটেল থেকে খাবার আনবো ? এটা আনফেয়ার।
তাছাড়া ফয়জুরের কথাও বিশ্বাস হলো না তার।
তিনি বাজার করা শুরু করলেন।
জামান বলে ‘মামা আপনার ম্যানেজমেন্টে তো দেখছি ঝামেলা আছে।
‘কেনো!
‘আপনি পুরো প্রোগ্রামের দায়িত্ব নিয়েছেন অথচ বাবাকে বলবেন না!
তাছাড়া নতুন অতিথিরা আসছে। বাইরে থেকে খাবার আনলে তারা কি মনে করবে?
‘কিচ্ছু মনে করবে না। বরং খুশী হবে। দিস ফুড উইল কাম ফ্রম হোটেল সোনারগাঁ। ইটস এ হেভী ডিল। আমি তোর বাবাকেও ফোনে বলেছি।
আনিস হেসে বলে ‘মামা এটা কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো।
ফয়জুরকে চিন্তিত দেখায়। সে হেসে বলে,
‘ঠিক আছে জনতা যেদিকে আমিও সেদিকে। তাহলে দুলাভাইকে বলি বাজারটা চালিয়ে যেতে। কি বলিস?
আনিসের কাছে কালকের ঘটনার বর্ণনা শুনে সারা শরীর হিম হয়ে এলো জয়ন্তীর। জয়ন্তী কি বলবে বুঝতে পারছে না। আনিসের একটা হাত ধরে বলে
‘বাসায় কাউকে জানিয়েছো?
‘না। তবে জামান দুলাভাইকে বলেছি।
তুমিও আপাতত কাউকে জানিও না। ওনারা খামাখা চিন্তা করবে। আমি ঠিক হ্যান্ডেল করে নেবো।
জয়ন্তীর মন খারাপ হয়ে গেলো কথা শুনে। সে বললো,
‘এটাতো কোনো কথা হতে পারে না। আমরা চুপচাপ বসে থাকবো কেনো! আমাদের পুলিশের কাছে সব খুলে বলা উচিৎ। তাহলে নিশ্চয় একটা উপায় হবে।
আনিস হাসে। সিগ্রেট ধরায়। সিগ্রেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে,
‘বাবুর প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। সে আসলে তোমাকে গভীরভাবে ভালোবাসে। হি রিয়েলি লাভস ইউ।
‘মানে!
‘হ্যাঁ। ওর চোখ-মুখের এক্সপ্রেশন, অসহায়ত্ব সব কিছুই আমাকে ভীষণ টাচ করেছে। তুমি একটা কাজ করতে পারো জয়ন্তী?
‘কি?
‘তুমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলতে পারো?
‘মানে!
‘মানে হলো তোমার প্রতি ওর একটা অবসেশন তৈরি হয়েছে। এখানে যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্ন নেই। ও শুধু তোমাকে চায়।
ওর যে ক্ষমতা তোমাকে বহু আগেই তুলে নিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি। কিন্তু আবার এটাও ঠিক শুধু বিরক্ত করার জন্যও তোমার সাথে এসব করছে না সে। সে জন্যই তুমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলো। সব কিছু বুঝিয়ে বললে হয়তো সে তার সমস্যাটা বুঝতে পারতো। আর কখনো ঝামেলা করতো না।
জয়ন্তী হেসে বলে
‘তুমি কি করে সিওর হলে সে আমাকে ভালোবাসে?
আনিস বলে ‘ভালোবাসার মানুষকে তো বোঝাই যায়। যায় না?
জয়ন্তী চুপ করে থাকে। এরই মধ্যে জামান, শেগুফতা আসে। বলে,
‘চলো খাবার দেয়া হয়েছে। খাবে না?
জয়ন্তী হেসে বলে ‘কে রান্না করেছে? মা?
আনিস হেসে বলে ‘আমার প্রিয় খাবার সব রান্না করা হয়েছে তোমাকে খাওয়াবে বলে।
ডাইনিং টেবিলে এসে ভীষণ অবাক হল জয়ন্তী। নানা ধরনের খাবার রান্না করা হয়েছে ওদের জন্য। জয়ন্তী, ওর বাবা রহমান সাহেব আর মা সাহারা রহমান এসেছেন আজ। আনিসের বাবা-মা’র আতিথেয়তায় একেবারে মুগ্ধ তারা।
সোবহান সাহেব বল্লেন, বিয়েটা আমি খুউব ধুমধাম করে দিতে চাই রহমান সাহেব।
রহমান সাহেব উৎসাহ নিয়ে তাকান। কিন্তু কোনো জবাব দেন না। ফয়জুর বলে আমি চাই ওর পুরো প্রোগ্রামটা হবে সোনারগা’তে।
সোবহান সাহেব হাসেন। মাথা ঝাঁকান। সাহারা রহমানও মামার দিকে তাকান। সাহারা রহমান বলেন, আমরা ভাই মধ্যবিত্ত মানুষ। আমাদের জন্য একটু টাফ হবে। তবে মেয়েকে আমরা সাজিয়ে-গুছিয়ে দেবো।
আনিস একটু বিব্রত হয়। জামানের দিকে তাকায়। ফিসফিস করে বলে দুলাভাই এখন আবার এরা দেনা-পাওনার কথা না তোলে।
জামান হাসে। শেগুফতা বলে,
‘না, না, ওয়ার্নিং দেয়া আছে। অসুবিধা নাই।
কিন্তু পরিস্থিতিটা আসলে সে দিকেই এগোলো। রহমান সাহেব বলেন,
‘জয়ন্তী আমাদের একমাত্র মেয়ে। আমরা ওর জন্য সবই করবো। তবে আমি কি একটু এ বিষয়ে খোলামেলা আলাপ করতে পারি? বিয়েতে ভাই আগে থেকেই দেনা-পাওনার ব্যাপারে সব ক্লিয়ার করা উচিৎ। ফয়জুর আর সোবহান সাহেব নড়ে চড়ে বসে। সোবহান সাহেব কি বলবেন সেটা মনে মনে ঠিক করলেন।
কিন্তু আনিস বললো,
‘আমার একটু কথা আছে। আমি কি কথা বলতে পারি?’
সবাই তাকায় আনিসের দিকে। আনিস জামানের দিকে তাকায় একবার।
শেগুফতা বলে,
‘আমিই বলছি। আমাদের দিক থেকে কোনো দাবি দাওয়া নেই। এটা আমরা পরিষ্কার জানিয়ে দিলাম।
আনিস আর জামান মাথা নাড়ে। বিষয়টা বুঝতে পেরে সোবহান সাহেব বলেন,
‘দ্যাটস রাইট। আই …. ওয়ান্টেড টু সে লাইক দিস।
রহমান সাহেব কথাগুলো শুনে স্বস্তির হাসি হাসেন। বলেন,
:সেটা আমরা আগেই বুঝতে পেরেছি।
তবে আমরা আমাদের সাধ্যমতো দেবো।
আনিস হেসে বলে।
:ওভাবে ভাববেন না। আমি আসলে এই দেওয়া-নেওয়ার বিষয়েরই মধ্যে নেই।
জামান আনিসের দিকে আড়চোখে তাকায়।
ফিসফিস করে বলে,
‘শুধু জয়ন্তী হলেই ওর চলবে।
রহমান সাহেব হাসেন।
বলেন, ‘আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে এনগেইজমেন্ট আর বিয়ের ডেটটা ফাইনাল করতে চাই।’
সোবহান সাহেব হাসেন। বলেন। ফয়জুর পঞ্জিকাটা কই।
ফয়জুর পঞ্জিকাটা এগিয়ে দেয়। সোবহান সাহেব নিজেই সেটা দেখেন। বলেন,
‘আনিসের হাতেতো এবার এতো বেশি সময় নেই। আমরাও বেশ তাড়াতাড়ি চাই সবকিছু।
যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে।’
সাহারা রহমান বলেন,
‘না না আমাদের আপত্তি নেই কোনো
আনিস আর জয়ন্তীর চোখাচোখি হয়।’
জয়ন্তী হাসে। সোবহান সাহেব বললেন,
‘এইতো তারিখ পাওয়া গেছে।
চৌদ্দই জানুয়ারি। শুক্রবার। আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত লগ্ন।
কি বলেন বেয়াই সাহেব?’
আনিস অপ্রস্ত্তত হয়ে তাকায় । ওর ধারণা ছিল, মুসলমানদের বিয়েতে লগ্নের ঝামেলা নেই।
রহমান সাহেব উৎসাহী দৃষ্টিতে তাকান। বলেন,
‘খুব ভালো। আমরা রাজী। তবে এনগেইজমেন্ট এর ডেটটা!
সোবহান সাহেব বললেন সেটা ওরা দুজনে সময়মতো ঠিক করে নেবে। কি বলেন?
রহমান সাহেব মাথা নাড়েন। ফিসফিস করে বলেন, ‘দেন মোহর!’
জয়ন্তী মুখ তোলে। আনিসের দিকে তাকায়। বলে,
‘আমি মোটেই চাই না বাবা।’
আনিসও চোখ তুলে তাকায়। বলে,
‘ঠিক আছে। আমরা ওটা ঠিক করে নেবো।’
ফয়জুর মামা বলেন, ‘আহা তুই আবার কেনো কথা বলছিস। এটা আসলে ঠিক করা দরকার।’
রহমান সাহেব বললেন,
‘বেয়াই সাহেব। ওটা নিয়ে সমস্যা হবে না। ওটা আমরা ঠিক করে নেবো।’
পূরবী বেগম বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। সব কথা যখন শেষ তাহলে চলেন এখন খেয়ে নিই।’
সাহারা বেগম মুগ্ধতার দৃষ্টি নিয়ে বলেন, ‘জ্বী। ঠিকই বলেছেন।’
আলাউদ্দীন মিয়া টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। পূরবী বেগম বললো,
‘বেয়াইন সাহেব। এ হচ্ছে আলাউদ্দীন মিয়া। আনিসের জন্মের পরের বছর থেকে এ বাড়িতে আছে। সে’ও কিন্তু খুউব ভালো রান্না করে।’
সাহারা বেগম বলেন,
‘কি আলাউদ্দীন। অনেক কষ্ট হয়ে গেছে না?’
আলাউদ্দীন বিনয়ের হাসি হাসে।
‘জ্বী না। এতো আমাদের কর্তব্য।’
মামা চোখ মুখ কুচকে তাকায় তার দিকে। বেসিনে হাত ধুতে ধুতে তিনি মনে মনে এতক্ষণে আলাউদ্দিনের জন্য একটা কঠিন শাস্তির কথা ভাবতে থাকেন। আলাউদ্দীন মিয়াকে বাংলা সিনেমা স্টাইলে দুহাত আর পা বেঁধে ফেলা হয়েছে। মামা কাছে এসে তার জামাটা খুলে দেন। লুঙ্গিটা টান মারেন।
আলাউদ্দীন মিয়া ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
‘মামা আপনি এতো বড়ো শাস্তি দেবেন বুঝতে পারি নাই। ছোট অপরাধ কিন্তু বড় শাস্তি।’
মামা সিনেমার ভিলেনের মতো হো হো করে হাসতে থাকেন। বলেন,
‘রেডি থাক। কালকে তোর ফাঁসি দেবো।’
মামা খাবার টেবিলে যাবার আগেই আলাউদ্দীন মিয়া তার পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে,
‘মামা একটা কথা বলবো?’
‘কি বল।’
‘আপনার লাল পাঞ্জাবীটা পাওয়া গেছে।’
মামা বিস্মিত দৃষ্টিতে বললো,
‘এখন খাবার সময় এসব বলছিস কেনো? এখন কি এসব আলোচনা করার সময়?’
আলাউদ্দীন মিয়া নির্বিকারভাবে বলে, ‘আপনার টেবিলের উপরে আছে। দেইখা নিয়েন।’
মামা বিব্রত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।
দশ
‘আমরা পাপী তাই ঈশ্বরের সত্যিকার ভালোবাসা বুঝতে পারি না’
হাঁস বাবু হাসে। তারপর উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকায়। সিগ্রেট ধরায়।
বলে
এই ঈশ্বরের ভালোবাসাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতদিন।
মুরাদ আর সবুজ চুপ মেরে বসে থাকে। শুধু বাসু নেই। তবে আজ ঢাকার আর এক ত্রাস নিরঞ্জন এসেছে। নিরঞ্জন এর সাথে এসেছে মাইকেল আর জোসেফ। বাবুই ওদেরকে ডেকেছে। কেনো ডেকেছে-এটা কাউকে বলেনি সে। নিরঞ্জন শুধু ত্রাস নয়; ঢাকায় এ মুহূর্তে শীর্ষ খুনী। তাই ওর আসাটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ ।
বাবু বলে, ‘ঈশ্বর পবিত্র আর মানুষ পাপী। দুজনের ভেতরে তাই পার্থক্য অনেক। এই পাপী মানুষগুলো কখনোই ঈশ্বরের কাছে পৌছাতে পারে না। কিন্তু তারপরও দরজায় কড়া নাড়লে যেমন গৃহকর্তা দরজা খুলে দেন, ঈশ্বরও তেমনি। ক্ষমা চাইলে উনি আবার মানুষকে কাছে টেনে নেন।’
নিরঞ্জনের একটু খটকা লাগে। বলে
‘বাবু কি ব্যাপার? কি হয়েছে?’
বাবু সিগ্রেটটা ফেলে দেয়। বলে,
‘ব্যাপারতো একটা আছেই দাদা। তা না হলে কি আর আপনাকে ডাকি!’
বাবু মুরাদের দিকে তাকায়। বলে,
‘বাসু কই?’
মুরাদ আমতা আমতা করে বলে,
‘ওস্তাদ সকাল থেকেই দেখছি না। বললো নাস্তা খেতে বাইরে যাচ্ছে। তারপর আর আসেনি। ফোন দেবো?’
বাবু হাত তোলে। বলে,
‘না আমার এখন শুধু নিরঞ্জন দাদাকে দরকার।’
নিরঞ্জন উৎসাহী ভঙ্গীতে তাকায়। বলে,
‘প্রয়োজন না হলে তো তুমি আমারে ডাকতা না।
বলো তোমার জন্য কি করতে পারি?’
বাবু আবার সিগ্রেট ধরায়। সেকেন্ড তিনেক চুপ করে থাকে। বলে,
‘দাদা কনফেশন বোঝেন?’
নিরঞ্জন খানিকটা বোকার মতো মাথা নাড়ে। জোসেফ আর মাইকেল চোখ বড় বড় করে তাকায়। সম্ভবত তারা ব্যাপারটা বোঝে। বাবু বলে,
‘কনফেশন হলো নিজের অপরাধ স্বীকার করা। আমি অকপটে আমার সব অপরাধ স্বীকার করছি।’
জোসেফ হেসে বলে,
‘কিন্তু বস, আমাদের ধর্মে আমরা যেমন প্রার্থনার ভেতর থেকে ‘গড’ কে পাই। আবার চার্চে ফাদারের মাধ্যমে আমরা ‘গড’ এর কাছে আমাদের সব কৃতকর্ম সম্পর্ক কনফেইস করতে পারি। এভাবেই আমরা নতুন জীবনের সন্ধান করি।’
বাবু বলে, ‘তুমি ঠিক বলেছো জোসেফ। আমার ফাদার হলো এই নিরঞ্জন দা। যে আমাকে প্রায় কলেজজীবন থেকে এখন পর্যন্ত শেল্টার দিয়ে আসছে। আমি আজ দাদাকে বলছি– এখন থেকে আমার এলাকার সব কর্তৃত্ব আপনাকে দিয়ে দিলাম।’
নিরঞ্জন একটু অবাক হয়। হেসে বলে,
‘কেনো! তুমি যাইবা কোথায়?’
বাবু বলে, ‘দাদা আমি পুলিশের হাতে ধরা দেবো। দিস ইজ ফাইনাল।’
মিনিটখানিক স্তব্ধতা। মুরাদ আর সবুজ কিছু বলতে গিয়ে আটকে গেলো। বাবুকে কোনো কিছু থেকে ফিরিয়ে আনা ঝামেলার ব্যাপার।’
বাবু বললো, ‘দাদা আমাকে আপনি না করবেন না। তবে আমার সাথে যে ছেলেরা কাজ করে তাদেরকে দেখতে হবে আপনার। নিরঞ্জন কিছু বলে না। চুপচাপ সিগ্রেট ধরায়। বাবু হাসে।
বলে,
‘কি হলো ঘাবড়ে গেলেন নাকি দাদা?’
নিরঞ্জন কোনো উত্তর দেয় না। অন্ধকারের ভেতর তার মুখ ভালোভাবে বোঝা যায় না।
নিরঞ্জন দাঁড়ায়। সাথে সাথে জোসেফ আর মাইকেলও। নিরঞ্জন কাছে আসে। তারপর বলে, আমি আজ যাইরে বাবু। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তুমি পুলিশের কাছে ধরা দিবা ক্যান?
বাবু কোনো উত্তর দেয় না। নিরঞ্জন বাবুর হাতটা ধরে বলে,
‘কি হইছে?’
বাবু নিরঞ্জনের হাতটা শক্ত করে ধরে। বলে,
‘আমার সময় শেষ দাদা। আমি বুঝতে পারি।’
নিরঞ্জন বলে,
‘কেনো তুমি খামাখা এই কাজ করবা?’
তুমি তো মিয়া ফাঁসিতে ঝুলবা!’
বাবু চোখ মোছে। বলে,
‘আমি জানি দাদা। তারপরও আমার ডিসিশান ফাইনাল।’
নিরঞ্জন কিছক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর জোসেফ আর মাইকেলকে ইশারা করে। ওরা বেরিয়ে যায়।
নিরঞ্জন বেরিয়ে যেতেই মুরাদ আর সবুজ কাছে আসে। মুরাদ বলে
‘ওস্তাদ সিদ্ধান্তটা কেনো নিলা?’
‘জানিনা।’
‘আমাগো কি হবে!’
‘তোদের ব্যবস্থা তো করেই রেখেছি।’
মুরাদ বললো ‘ওস্তাদ আমিও তোমার লগে ভেতরে যামু’
বাবু হাসে। বলে,
‘পাগলামী করিস না। একটু এদিকে আয়।’
কথা আছে।
মুরাদ কাছে আসে। বসে
‘কি ওস্তাদ!’
বাবু ফিসফিস করে বলে, ‘জয়ন্তীর সাথে দেখা করবো।’
মুরাদ হাসে। মুগ্ধতার হাসি।
‘ওস্তাদ কিভাবে দেখা করবা?’
‘ওদের বাসায় যাবো?’
‘কখন যাবা?’
‘এখনই।’
বাবুর কথা শুনে এই প্রথম সিগ্রেট ধরায় মুরাদ । তারপর সিনেমার ঢঙে গান গাইতে শুরু করে …তুমি যেখানে আমি সেখানে. . .
বাবু আর মুরাদ বেরিয়ে পড়ে। তবে এখনও বাইরেও বেরুতে হয় খুব সাবধানে।
মুরাদ বলে,
‘ওস্তাদ তুমি ধরা দিবা ক্যান?’
বাবু হাসে। বলে ‘আমার সময় শেষ মুরাদ।’
‘বস, একটা কথা বলবো?’
‘বল।’
‘ধরা পড়লে কিন্তু হালুয়া টাইট, বিনা বাক্যে ফাঁসি।’
‘কিছু যায় আসে না। সব কৃতকর্মের ফল।’
মুরাদ আর একটা সিগ্রেট ধরায়। তারপর বলে,
‘ওস্তাদ গাড়ি নিবো?’
‘নে।’
বাবুর গাড়িটা থাকে নীচের গ্যারেজে। পুরোনো মডেলের এলএক্স লিমিটেড। দূরে কোথাও গেলে বাবু এই গাড়িটি ব্যবহার করে। তবে আজ পথটা বেশ ছোট। আধা কিলোমিটার। গাড়িতে উঠেই বাবুর মনটা কি রকম বিষণ্ণ হয়ে গেলো। জয়ন্তীকে আজ সত্যি সত্যি মুখোমুখি জানিয়ে দেবে সে তাকে ভালোবাসে। তবে তার কাছে গিয়ে সে কোনো জোড় জবরদস্তি করবে না। শুধুমাত্র জানিয়ে দেয়া। ব্যাস। তারপর থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা দেবে সে। এই মোটামুটি প্ল্যান তার।
মুরাদ আবার বলে ওস্তাদ সত্যিই তুমি ধরা দিবা?
বাবু কোনো কথা বলে না। পকেট থেকে সিগ্রেট বের করে। ধরায় না।
এদিক-ওদিক তাকায়।
মুরাদ বলে, ওস্তাদ আমাগো ফালাইয়া এতো বড় ডিসিশান নিলেন? কথা শুনে বাবু আবার হাসে…
বাবুরা যখন জয়ন্তীদের বাসার সামনে এলো তখন বেশ একটা জটলা দেখতে পেল বাড়ীর সামনে। মুরাদ গাড়িটা থামায়।
বাবু বলে, ‘কি হয়েছে রে?’
মুরাদ বলে, ‘ওস্তাদ তুমি বসো। আমি আগে দেইখা আসি।’
মুরাদ মাথা নাড়ায়। সিগ্রেট ধরায়। জটলাটা বাড়ছে। হঠাৎ করেই পুলিশের গাড়ির শব্দ। অন্যদিন হলে সে তাড়াতাড়ি সড়ে পড়তো। কিন্তু আজ কেনো জানি তাড়না নেই। ভয় নেই। নিজেকে সমর্পণ করার মধ্যে অন্য ধরনের উপলব্ধি থাকে। সেই উপলব্ধির ভেতর দিয়ে নীরবে হাটতে থাকে বাবু।
মুরাদ তড়িঘড়ি করে যে খবর নিয়ে এলো তাতে বাবু দিশেহারা হয়ে পড়ে। শরীরটা রাগে রিন রিন করতে থাকে। সে ফিসফিস করে বলে,
‘জয়ন্তীকে তুইলা নিয়া গেছে।
কে?’
মুরাদ গাড়ি ষ্টার্ট দেয়। বাবু বলে, ‘আমার কাছে হিসাব-নিকাশ পরিষ্কার। বাসু কই? বাসুকে একটা ফোন দিতে হবে। এক্ষুণি।’
বাবু বাসুকে ফোন দেয়। কিন্তু ফোন বন্ধ। বাবুর বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। কি করবে সে বুঝে উঠতে পারে না। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে থাকে। বলে, ‘চল বাসুর বাড়ি যাই।’
‘বাসুর বাড়িতো পুরান ঢাকা। হাজারীবাগ।’
‘অসুবিধা নাই। চল। আমি নিরঞ্জনরে ফোন দিচ্ছি।’
বাবু মোবাইলটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এগারো
জয়ন্তীর কিডন্যাপ হবার খবরটা প্রথম শোনে ফয়জুর মামা। খবরটা পেয়েই তিনি অফিস থেকে বাড়িতে চলে এলেন। বাড়িতে তখনও উৎসবের আমেজ শেষ হয়নি। চিটাগাং থেকে আনিসের বড় খালা এসেছেন। গ্রামের বাড়ি থেকে আনিসের চাচা এসেছেন। সিডনী থেকে আনিসের ছোট চাচা আসবেন আগামীকাল। এই নিয়ে মহা হুলুস্থুল।
বাসায় সবাইকে নিয়ে সোবহান সাহেব আড্ডা বসিয়েছেন। আনিস তখনো ঘুমচ্ছিল। দুতিনবার মোবাইলে ফোন করেছেন মামা। কিন্তু মোবাইলটা ‘সাইলেন্স মুডে’ ছিল বলে টের পায়নি সে। জামানও সব কাজকর্ম বাদ দিয়ে এই বাড়িতে রয়ে গেছে।
ফয়জুর মামাকে ক্লান্ত লাগল। সে এসে বললো,
‘দুলাভাই আপনার সাথে আমার কথা আছে।’
আনিসের বড় খালা রুমানা বেগম কিছুক্ষণ পর পরই দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। ফয়জুরকে ব্যতিব্যস্ত দেখে তিনি আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ফিসফিস করে বললেন,
‘ও ফয়জুর কিতা হইছে!’
ফয়জুর জবাব দিল না। সোবহান সাহেবকে নিয়ে অন্যরুমে চলে গেল সে।
পিছনে গুটিগুটি পায়ে আনিসের বড় খালাও গেলেন।
ফয়জুর কান্না কান্না গলায় বললো,
‘সর্বনাশ হয়ে গেছে দুলাভাই।’
‘কি হয়েছে? তাড়াতাড়ি বল। আমার ব্লাড প্রেসার উঠছে।’
‘দুলাভাই জয়ন্তীকে কে বা কারা সকাল বেলা বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে।’
‘কি বলছো এসব? তুমি জানলে কি করে?’
‘জামান সাহেব ফোন দিয়েছিলেন। ওনারা ভীষণ কান্নাকাটি করছেন। আপনাদেরও ট্রাই করেছিল। পায়নি। আমাদের বোধহয় এখনই ওখানে যাওয়া দরকার।’
এটুকু শুনেই আনিসের বড় খালা বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর তিনি
চীৎকার চেচামেচি শুরু করলেন,
‘এই তোমরা কে কোথায় আছো; সর্বনাশ হয়ে গেছে
জয়ন্তীরে কিডন্যাপ করেছে। কিডন্যাপ করেছে।’
বড় খালার চীৎকারে ঘুম ভেঙে গেল আনিসের। সবাই সে রুমে জড়ো হলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মামা বললেন,
‘এই তোরা আমারে ধর। আমার বুকে ব্যথা উঠছে …’
সোবহান সাহেব আর খালা দৌড়ে গেলেন মামার কাছে।
আনিস হতবাক হয়ে একবার মামার দিকে আর একবার নিজের মোবাইল ফোনের দিকে তাকায়। বেশ কটা মিস কল। জয়ন্তীর বাবার। কি করবে সে ভেবে পায় না। জামান বলে,
‘আনিস একটু বাইরে আসবে?’
‘কি?’
‘মামার মনে হয় ষ্ট্রোক করেছে।’
‘বলেন কি!’
আনিস কিছুটা বিচলিত হয়ে তাকায় । জামান বলে, ‘কোন চিন্তা করো না । হার্ট হসপিটালে আমার বন্ধুবান্ধব আছে । আমি খবর দিচ্ছি ।’ জামান দ্রুত দু’একজায়গায় ফোন করে ফিরে আসে ।
কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে, ‘সমস্যা নাই।’ এম্বুলেন্স আসছে ।
মিনিটখানিকের মধ্যে বাসায় ভয়ানক এক পরিবেশের সৃষ্টি হলো । আনিসের মা, খালা আর শেগুফতার কান্নাকাটিতে পরিবেশ ভারী হয়ে এলো । আনিস হতভম্ভ । পাশের বাসার কাদের সাহেব রীতিমতো হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বাসায় চলে
এলেন । আনিসকে দেখে কৌতূহলী গলায় বললেন, সোবহান সাহেব মারা গেছেন নাকি? অসুবিধা কি হইছিল?
আনিস উত্তর দিল না । কাদের সাহেব উওরের জন্য অপেক্ষা করলেন না । তিনি ভীষণ বিচলিত অবস্থায় বাড়ীর ভেতরে ঢুকলেন । আনিসও ঢুকলো । মামার অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে সে । মামা এতক্ষণে মেঝের উপরে উঠে বসেছেন । সোবহান সাহেব মামাকে প্রায় কোলে করে এনে বিছানার ওপর শোয়ালেন । বিছানায় শুয়ে তিনি আবার জ্ঞান হারালেন ।
কাদের সাহেব বললেন, ‘উনি তো মারা যান নাই!
আপনারা এত টেনশন করছেন কেনো? হার্টের প্রোবলেম । মাইনর প্রোবলেম। এম্বুলেন্স খবর দেয়া হয়েছে?’
জামান বিনয়ের সাথে বললো, ‘জ্বী খবর দেওয়া হয়েছে । এম্বুলেন্স আসছে ।’
বড়খালা ততক্ষণে ভাওয়াইয়া সুরে কান্নাকাটি শুরু করলেন, ‘ওরে আমার সোনামনি, যক্ষের ধন ভাই রে। তোরে আমি এই অকালে হারাইলাম রে… ওরে আমার ফজু রে…’
এম্বুলেন্স চলে এলো । এম্বুলেন্স থেকে ফায়ার সার্ভিস ষ্টাইলে দুজন লোক নেমে পড়েছেন । তাদের মুখ হাসি হাসি । একজন বললো, ‘রুগী কই? উনার কি জ্ঞান আছে না নাই?’ অন্যজনের চোখে কৌতূহল। তিনি বললেন, ‘তাড়াতাড়ি
করেন ।’ প্রথমজন বললো, ‘রুগী অজ্ঞান থাকলে বিশেষ ব্যবস্থা আছে ।’ সোবহান সাহেব বললেন, ‘জ্বী উনার জ্ঞান নাই ।’
কথা শুনে দুজনকেই বেশ বিচলিত দেখা গেল ।
সোবহান সাহেব সময় নষ্ট না করে মামাকে ওঠালেন এম্বুলেন্সে । উনি আনিসের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি আর তোমার মা যাচ্ছি আপাতত ।
তোমরা জয়ন্তীর ব্যাপারটা দেখে তারপর আসো!’ এম্বুলেন্স ষ্টার্ট দিতেই আনিস আর জামান বেরিয়ে পড়ে ।
বাসু বললো, আমি আপনেরে তুইলা আনছি বাবু ভাইকে শিক্ষা দেবার জন্য। সে যা পারে নাই তাই কইরা আমি দেখাইলাম।
জয়ন্তী চুপ করে থাকে। বাসু বলে,
আপনি আমার ওস্তাদরে বহু কষ্ট দিছেন। আমি আপনেরে উচিত শিক্ষা দেবো।
জয়ন্তী তাকায়। বাসুর দিকে ভালোমতো তাকায়। উস্কোখুস্কো চুল। নেশা-করা চোখ। একটা টি-শার্ট পরে আছে জিনস প্যান্টের সাথে। বয়স তিরিশ/বত্রিশ হবে। ঘরটার দিকে লক্ষ্য করে সে। একটা পুরোনো গুদাম ঘরের মতো ভেতরটা। সেখানে একটা চেয়ার এনে জয়ন্তীকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। জানালার দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হল জয়ন্তী। বেশ কয়েকজন তরুণ বয়সী ছেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিস্পলক। সম্ভবত ওরা বাসুর লোকজন। বাসুকে এর আগে একবার দেখেছে জয়ন্তী। সম্ভবত হাঁস বাবুর চিঠি দেবার সময় সে এসেছিলো।
জয়ন্তীর মনের ভেতরে এক ধরনের ভয় উঁকিঝুঁকি মারছিলো। বাসুকে তার নেশাখোর মনে হচ্ছে। নেশাখোরদের কোনো নৈতিকতা থাকে না। তারা যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। জয়ন্তী ভাবে, আনিসরা ঘটনাটা জানলে হয়তো জয়ন্তীর বিয়েটাও ভেঙে যেতে পারে। আনিসের কথা মনে হতেই কেন যে চোখে পানি এসে গেলো তার!
বাসু বলে,
কান্নাকাটি তো শুরুই হয়নি। তোকে আজ রেপ করবো। তারপর খুন করবো। তোর দুনিয়া খতম।
জয়ন্তী শুধু ফিসফিস করে বলে, এতো বড়ো সবর্নাশ করবেন আপনি? আমি তো কোনো অপরাধ করিনি।
বাসু বলে, তুই তো জানোস না তুই কতো বড়ো অপরাধ করছিস?
জয়ন্তী বলে, আমাকে মাফ করে দেন ভাই। আমি আপনার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাই।
বাসু হো হো করে হাসে। একটা পিস্তলে গুলি লোড করে। তারপর সিনেমা স্টাইলে জয়ন্তীর মাথায় ঠেকায় সে। জয়ন্তী কাঁপতে কাঁপতে বলে- ভাই প্লিজ আমাকে মারবেন না। জয়ন্তী জ্ঞান হারায়।
আনিস আর জামান এলো থানায়। ওসি সাহেব অন্যান্য কনস্টেবলদের নিয়ে কী এক মিটিং করছিলেন। ওদেরকে দেখে উনি চোখও ফেরালেন না। সাবলীল ভঙিতে কথা বলে যাচ্ছিলেন তিনি। অন্যান্য কনস্টেবলরা খুব আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনছিল।
আমার মনে হয় ঐ জাগাডায় কোনো সমস্যা আছে। বুঝতে পারিছেন?
না স্যার। সমস্যা সেখানে না। সমস্যা ঐ জায়গায়।
না। কিন্তু জাগাডা কুথায়?
এইজাতীয় কথাবার্তা শুনে জামান একটু তড়িঘড়ি করে বললো
স্যার সমস্যা! আমাদের একটা সমস্যা হয়েছে। একটু যদি আসেন।
অন্য কনস্টেবলরা মুহূর্তে ঘুরে তাকায়। ওসি সাহেবকে যেরকম মনে হচ্ছিলো আসলে উনি সে রকম নন। বেশ সিরিয়াস ভঙিতে বললেন
কী সমস্যা?
স্যার আমার এক বোন কিডন্যাপ হয়েছে। মাস্তানদের হাতে।
ওসি সাহেবকে বিচলিত দেখায়। তিনি বলেন, কখন। কোত্থেকে?
ধানমন্ডী সাত নম্বর থেকে। জয়ন্তী নাম।
কাউকে সন্দেহ হচ্ছে?
জ্বী। এলাকার সন্ত্রাসী হাঁস বাবু ওকে ডিসটার্ব করতো। সেই এ কাজ করতে পারে।
ওসি সাহেব কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর বলেন, আমরা এখনই এ্যাকশনে বেরিয়ে যাবো। তবে আপনাদের একটা মামলা করতে হবে। আপনারা ওর কী হন?
আনিস বললো, আমি কি জয়ন্তীর বাবাকে ডাকবো?
ওসি সাহেব বললেন, তাহলে ভালো হয়।
আনিস হন্তদন্ত হয়ে ফোন করা শুরু করে সোবহান সাহেবকে।
বাবু, মুরাদ আর সবুজ গাড়িটা নিয়ে এলো হাজারীবাগ। গাড়িতে বসেই মুরাদ তার প্রিয় রিভলবার আর ড্যাগারটা কোমরে গুঁজে ফেলে। বাবু একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকায়,
: তোকে না বলেছি জিনিস সব সময় নিজের কাছে রাখবি? গাড়ির সিটের নিচে রাখিস কেন?
: ওস্তাদ জিনিস সাথে থাকলে অস্থির লাগে।
বাবু চুপচাপ বাসুর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। নিরঞ্জনদেরও খবর দেয়া হয়েছে। ওদের জন্য সে অপেক্ষা করছে। মিনিটখানেকের মধ্যে নিরঞ্জন তার দলবল নিয়ে হাজির হয়ে গেলো। তারপর দুজন দুজনকে ইশারা করে বাসুর বাড়িতে ঢুকে পড়লো ওরা।
জয়ন্তীর মা-বাবা অসহায়ের মতো বসে আছেন। যেন আত্মসমপর্ণ যাবতীয় অসুন্দরের কাছে। দু চোখে ক্লান্তি। একধরনের অসহায়ত্ব। পৃথিবীতে নিজের সন্তানকে হারিয়ে ফেলার দুঃখ কাউকে বোঝানো যাবে না। জয়ন্তীর মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
আমার মেয়ের এতো বড়ো দুর্ভাগ্য হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
রহমান সাহেব শিশুদের মতো কান্না শুরু করেন।
সোবহান সাহেব জয়ন্তীর মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বলেন, আল্লাহ আমাদের উপর নাখোশ হয়েছেন। ওদিকে আনিসের মামাও হসপিটালাইজড। কী যে করি!
সাহারা বেগম অঝোর ধারায় কাঁদছেন। শুধু বলেন, তুমি আমার জয়ন্তীকে এনে দাও।
এরই মধ্যে ফোনটা বাজে রহমান সাহেবের। রহমান সাহেব চিৎকার করে কথা বলতে শুরু করেন,
হ্যাঁ আনিস। বাবা বলো।
ওপাশ থেকে আনিসের কণ্ঠ ভেসে আসে-
: আঙ্কেল আপনাকে একটু আসতে হবে
: কোথায়!
: ধানমন্ডী থানায়। একটা মামলা করতে হবে।
: আসছি। আমি দ্রুত আসছি। বলেই রহমান সাহেব কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন।
মামার জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফেরার পর তিনি কারো সাথে কথা বলছেন না। ঝিম মেরে শুয়ে আছেন। মামার পাশে বসে ছিলেন সোবহান সাহেব আর পূরবী বেগম। বড়খালা, শেগুফতা বসে আছেন সোফার উপর। বড়খালা তসবি পরছিলেন। মামাই নীরবতা ভাঙলেন।
ডাক্তার রিপোর্ট দিয়েছে। হার্টে দুটা ব্লক ধরা পড়েছে। ভেরি ক্লোজ টু ডায়িং।
সোবহান সাহেব বললেন, মিয়া মৃত্যু এত সহজ না। এসব ফাও চিন্তা বাদ দাও। ডাক্তার বলেছে দ্রুত অপারেশন করতে।
মামা আঁতকে ওঠেন, অপারেশন মানে?
সোবহান সাহেব নিচু স্বরে বললেন, তোমার হার্টে রিং পরাতে হবে। খুবই মাইনর অপারেশন।
বড়খালা আঁতকে উঠলেন। বললেন, আমাদের বাড়ির পাশে এক ভদ্রলোকের রিং বসিয়েছে। শুকাইয়া কাঠ হয়া গেছে।
সোবহান সাহেব ধমকে ওঠেন, বলেন, এটা মায়া কান্নার জায়গা না। সমস্যা আসলে ফেস করতে হবে। আমি ডাক্তারকে বলে এসেছি। আজ রাত আটটায় অপারেশন।
মামা অসহায়ের মতো বললেন, এই কথা আগে বলবেন না দুলাভাই ? আমি কিন্তু অপারেশন করবো না!
মামা আরো কিছু বলতে যাবার আগেই ডাক্তার ঢুকলেন। সাথে একজন নার্স। ডাক্তারের মুখ হাসি হাসি। তিনি ফয়জুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি ফয়জুর সাহেব, পুরো হাসপাতাল ভর্তি করে ফেলেছে আপনার ভিজিটররা! ঘটনা কী?
মামা বিনয়ের সাথে বললেন, ওরা আমার অফিসের লোকজন ডাক্তার সাহেব!
ডাক্তার আবার হাসলেন, বললেন, এটা এখন আর খুব বড় ধরনের অপারেশন নয়। তবে খাওয়া-দাওয়া খুব কন্ট্রোল করতে হয়। বেশি টেনশন করা যাবে না। প্রেশারটা খুব কন্ট্রোলে রাখতে হবে।
মামা যেন কথা শুনে বেশ কষ্ট পেলেন, বললেন, ডাক্তার সাহেব আমি আর কখনো কোন কিছু খেতে পারবো না ?
অবশ্যই পারবেন। তবে কিছুদিন একটু কন্ট্রোল করতে হবে এই যা।
ডাক্তার আবার হেসে বললেন, তাহলে আমি এখন যাই। দেখা হবে।
ডাক্তার চলে যাবার পর মামা আবার ঝিম মেরে থাকেন। আনিস আর জামান ততক্ষণে ফিরে এসেছে। মামা আনিসের দিকে তাকিযে বললেন, জয়ন্তীর কোনো খবর পেয়েছিস?
আনিস মাথা নিচু করে থাকে। কোনো উওর দেয় না। মামা হঠাৎ আনিসের হাতটা ধরেন। বলেন, আনিস আমি তো বিয়েই করলাম না জীবনে। তোদের নিয়েই আমার সংসার। তোদের সুখই আমার সুখ। আমি কায়মনোবাক্যে দোয়া করছি জয়ন্তীর জন্য। ও ঠিকই সহিসালামতে ফেরত আসবে।
মামা শিশুর মতো হু হু করে কেঁদে ফেললেন।
বারো
হাঁস বাবু ও নিরঞ্জনকে একসাথে দেখে বাসু ভীষণ ঘাবড়ে গেলো। বাবু বললো, বাসু কাজটা তুই খুব খারাপ করলি। এর জন্য তোকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।
বাসু কাঁদতে কাঁদতে বলে ওস্তাদ। তোমারে কথা দিছিলাম সাত দিনের ভেতর তুইলা আনবো।
বাবু বলে, তোকে আমি নিষেধ করেছিলাম। তাছাড়া আমার জন্য ওকে তুলে আনলে তো তুই আমার কাছে নিয়ে আসতি। এখানে আনলি কেন?
বাসু বলে, আমাদের আস্তানায় পুলিশের চোখ থাকে সব সময়। তাই অন্য পথে নিয়া আসছি।
বাবু জয়ন্তীর কাছে আছে। তারপর গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। জয়ন্তীর এলোমেলো দৃষ্টি। অস্থির। জয়ন্তীকে দেখে বাবুর কী রকম যেন হয়। অনেক দিনের পুরোনো প্রেমিক নন্দিনীর মতো মনে হয়। বাবু কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকে তার দিকে। বলে- তোমার কোনো ভয় নেই জয়ন্তী। আমি আসলে জানতাম না ও এই কাজ করবে। আমি এক্ষুণি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবো। তোমার কোনো চিন্তা নেই।
জয়ন্তী হা করে তাকিয়ে থাকে বাবুর দিকে। বাবুর চোখ দুটোর ভেতর কী রকম আশ্চয শূন্যতা। শান্ত। ঠিক যতোটা সিরিয়াস মনে হয়েছিল সে রকম না। মনে হয় তার সাথে কথা বলা যায়। নির্ভরশীল মানুষের মতো লাগে তাকে।
হাঁস বাবু হঠাৎই বাসুর দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠে-
: তোকে আমি খুন করবো শুয়োরের বাচ্চা।
বাসু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায়। নিরঞ্জন না সূচক মাথা নেড়ে বাসুকে নিজের কাছে নেয়। শুধু বলে, বাবু তুমি জয়ন্তীকে নিয়ে চলে যাও। যতো তাড়াতাড়ি পারো। যেকোনো মুহূর্তে পুলিশ আসতে পারে। তখন অন্যরকম ঝামেলা শুরু হবে। আমি ওর ব্যবস্থা করতেছি।
হাঁস বাবুর দৃষ্টি কী রকম ভয়ার্ত দেখায়। সে বলে, না দাদা ওকে শাস্তি পেতেই হবে।
নিরঞ্জন বলে, শাস্তি আমি দিতাছি। বলেই সে পয়েন্ট টু বোরের একটা পিস্তল লোড করে বাসুর পায়ে গুলি করে। বাসুর চিৎকারে ভয়ার্ত এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
নিরঞ্জন বাবুর দিকে তাকিয়ে তাড়া দেয়- যাও বাবু তাড়াতাড়ি যাও!
হাঁস বাবু জয়ন্তীর হাত ধরে। তারপর বলে- চলো।
অপারেশন থিয়েটারে যাবার আগে মামা খুব শান্ত হয়ে গেলেন। হেসে বললেন, আমার নিজেকে কোরবানির গরুর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে আমার কোরবানি হচ্ছে। হে হে হে…
সেই কথা শুনে বড়খালা চোখ ভিজিয়ে ফেললেন। পূরবী বেগম বললেন, আপা ভাইজানের মনে হয় খুব কষ্ট হচ্ছে।
সোবহান সাহেব ধমকে উঠলেন। অদ্ভুত রকমের শব্দ হলো, কিন্তু কোনো কথা বোঝা গেল না। পূরবী বেগম মুখে কাপড় চাপা দিয়ে দাড়িয়ে রইলেন।
আনিসের মনের ভেতরে কী রকম অস্বস্থি তখন। কেন যেন পুরোনো সব কথা মনে পড়ছে তার। মামার মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে বার বার।
এত হাসিখুশি মানুষটা যে এরকম ঝামেলায় পড়বে, এটা তার কল্পনায়ও আসেনি কখনো!
মোটামতো দুজন নার্স ঢুকলেন। চিকন গলায় একজন বললেন, একটু সাইড হবে ভাই, রুগী নিয়ে যাব!
আনিস সরে দাঁড়ায়। মামা চোখ বন্ধ অবস্থায় ভেতরে চলে গেলেন।
বাইরে তখন মামার অফিসের লোকজনের হৈ হল্লা। পুরো অফিসের স্টাফরা ভীড় করে আছে আইসিইউর সামনে। আনিস এগিয়ে গেল কথা বলার জন্য। এক ভদ্রলোক খুব উৎসাহ নিয়ে সামনে এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন,
: আপনি কি স্যারের ভাইগ্না?
: জ্বী
: আসেন মোসাহাবা করি। বলেই তিনি আনিসের হাত ধরে বসলেন। আনিস অতি বিনীত ভঙ্গিত বলে, মামার বোধ হয় অপারেশন শুরু হয়ে গেল!
: অপারেশন ভালোই হবে। আপনার খবর বলেন। ডলারের রেট কতো এখন!
আনিস হাতটা তুলে কোনো উওর না দিয়ে উঠে এল। জামান ততক্ষণে আনিসের পাশে এসে বসেছে। কী রকম নিশ্চুপ বসে আছে সে। কোনো জিজ্ঞাসা নেই। কোনো প্রশ্ন নেই। যেন নিবির্কার এক মানুষ। আনিস তাকাতেই জামান ফিসফিস করে বললো, সব মিলিয়ে মামার ঘন্টাদুয়েক লাগবে। আনিস চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।
তারপর বলে, এদিকে জয়ন্তীর খবরও তো পেলাম না?
জামান বলে, দেখবে একইসাথে দুটো ভালো খবর পাবো। আনিস হাসে। বলে, তোমার কথা যেন সত্যি হয়। আনিস ফোন দেয় রহমান সাহেবকে-
: আঙ্কেল জয়ন্তীর কোনো খবর আছে ?
: না বাবা এখনও তো কোনো খবর পাইনি। তবে পুলিশ খুব চেষ্টা করছে। আমাকে কয়েকবার ফোন করেছিল। তোমার মামার খবর কী?
: মামার অপারেশন চলছে। এখনো হয়তো আরো কিছুক্ষণ লাগবে।
: ঠিক আছে বাবা দোয়া করি ফ্রি হলে বাসায় চলে এসো।
আনিস পায়চারি করতে করতে চেয়ারে বসে। উত্তরের জানালা থেকে তখন ফুরফুরে একটা হাওয়া আসছিল। সত্যি সত্যি সে তখন ঘুমিয়ে পড়ে। আনিস কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল ঠিক মনে করতে পারে না। তবে ঘুম থেকে উঠে আনিস বেশ অবাক হলো। দুজন ডাক্তার হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন ডাক্তার হেসে বললেন, অপারেশন সাকসেসফুল। আমরা সফলভাবে হার্টে রিং বসিয়েছি। হি ইজ সেইফ নাউ। আপনারা চাইলে দেখা করতে পারেন।
মনের ভেতর একটা তীব্র আনন্দ উঁকিঝুঁকি মারে আনিসের।
জয়ন্তীরকাছেপুরো ব্যাপারটাই দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো। সে আসলে কী বলবে সেটাও ভেবে পাচ্ছিল না। তবে মাথাটা লাটিমের মতো ঘুরছিল তার। এদিকে রাতও বাড়ছে।
বাবু খুব শান্ত ভঙ্গিতে গাড়িতে বসে। জয়ন্তীকে ডাকে। তারপর স্টার্ট দেয়। বলে, তোমার কোনো ভয় নেই। আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।
এই প্রথম জয়ন্তী যেন একটু সাহস পায়। সে বলে,
: আপনি কি বাবু ভাই?
: হ্যা আমি বাবু ভাই।
বাবু হাসে। মুগ্ধতার হাসি। বোঝাই যায় না এই কিছুক্ষণ আগে কী এক নারকীয় পরিস্থিতির মধ্য থেকে উঠে এসেছে সে। বাবু বলে-
: অনেকদিন পর একটা ভালো কাজ করলাম। জয়ন্তী। আমার খুব ভালো লাগছে।
জয়ন্তী স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছে। কিন্তু গত কয়েক ঘণ্টা তার জীবনের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তার কষ্ট কাউকে বুঝিয়ে বলা যাবে না। জয়ন্তীর দু চোখে তখন জল। এই দৃশ্য দেখে বাবুও কী রকম দ্রবীভূত হয়। সে চোখ মোছে।
জয়ন্তী অবাক হয়ে তাকায়। বাবু বলে-
: তোমার কোনো কষ্ট সহ্য হবে না আমার। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি জয়ন্তী। কিন্তু আনিস আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।
জয়ন্তী কিছু বলে না। বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবু বলে-
: আমি ভীষণ লজ্জিত জয়ন্তী। এরকম একটা পরিস্থিতি তোমার জীবনে আসবে আমি কখনো ভাবিনি। তবে আর যাই হোক ওরা কি তোমাকে অপমান করেছে?
জয়ন্তী মাথা নাড়ে। বলে, না। না। ভয় দেখিয়েছিল। তবে সে রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।
বাবু বলে, তুমি কি জানো আমি বেশ বড় মাপের একজন সন্ত্রাসী।
: জ্বি জানি।
: কিন্তু আজ যে আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
: কী!
: আমি পুলিশের হাতে ধরা দেবো। আজই। কিছুক্ষণ পরে।
কথাটা শুনে জয়ন্তীর কী যে হয় সে হু হু করে কেঁদে ফেলে।
জয়ন্তীর বাড়ির সামনে এসে গেছে ওরা। বাবু বলে-
: কাঁদছো কেন?
: জানি না।
বাবু খুব সাহস করে জয়ন্তীর হাতটা ধরে। বলে-
: আমি ভেতরে যাবো না। ভালো থেকো।
: খুব ভালো থেকো। তোমার বাবাকে সালাম দিও। উনি অনেক ভালোমানুষ।
জয়ন্তী বলে, আর আমাদের দেখা হবে না বাবু ভাই? বাবু কিছু বলে না। শুধু গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে নামতে নামতে জয়ন্তী বলে, আপনাকে আমার চিরজীবন মনে থাকবে। আমি অনেক কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।
বাবু কাছে আসে। ফিসফিস করে বলে, যদি কখনো ভুলত্রুটি করে থাকি ক্ষমা করে দিও।
জয়ন্তী আবার হু হু করে কেঁদে ফেলে।
তেরো
আনন্দবাড়িতে গোপন বৈঠক বসেছে। আনিস, বাবা, মামা আর জামান। মামা কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন। আনিস চুপচাপ। বিরাট মানসিক ধকল গেছে সকাল থেকে। রাতে একবার ভেবেছিল জয়ন্তীকে ফোন করবে। ইচ্ছে করেই করেনি। তবে জয়ন্তীর খবর নিয়েছে সে। জয়ন্তী বেশ স্বাভাবিক আচরণ করছে। সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে সে।
মামা গম্ভীর মুখে বললো-
সবই নসিব বুঝলা। সবই নসিব। ফুলের মতো মেয়েটার কী অবস্থা! আল্লাহ সবাইকে মাফ করুক
সোবহান সাহেব বললেন-
: আনিস তোমার কাছে একটা কথা শুনতে চাই বাবা।
: বলো।
: জয়ন্তীকে তো ধরে নিয়ে গিয়েছিল গুন্ডারা। থানায় মামলা হয়েছে। একটা বড় পত্রিকাতেও নিউজটা এসেছে। লোকজন জানাজানি হয়ে গেছে।
: জ্বী তাতে অসুবিধা কী? ওতো ফেরৎ এসেছে?
: না মানে আমি বলছিলাম তুমি কি জয়ন্তীকে এই অবস্থায় বিয়ে করবে?
আনিস বাবার কথায় একটু অবাক হয়। বলে-
এই ঘটনাটা তো বিয়ের পরও তো হতে পারতো। তাহলে কি আমি ওকে ছেড়ে বলে আসতাম?
মামা বলে,
বিষয়টা তোমার কাছ থেকে আবার ক্রসচেক করে নিচ্ছি। আমাদের কোনো সমস্যা নাই। উই আর ফাইন উইথ হার।
আনিস একটু বিরক্ত হয়। বলে, এটা তো কোনো ইস্যুই হওয়া উচিত না। দ্যাট ওয়াজ জাস্ট এন এ্যাক্সিডেন্ট। সো উই শুড ড্রপ ইট ইমিডিয়েটলি এ্যান্ড ট্রাই টু ইনসাপায়ার হার ইন অল রেসপেক্টস।
বাবা হাসলেন। বলেন-
আমার তাহলে আর টেনশন রইলো না।
ওকে আই অ্যাম ফাইন উইথ ইউর ডিশিসন।
তবে?
তবে কী?
যেহেতু জানাজানি হয়ে গেছে বিষয়টা। তাই আমাদের সময়ও বেশি নেয়া ঠিক হবে না। যতো দ্রুত সম্ভব বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে।
আনিস হাসে। বলে
বাবা আপাতত তোমরা মুখ বন্ধ রাখলে ভালো হয়!
বাবা আর মামা হাসে। মামা বলে বিশ্বাস কর আমাদের মনে খারাপ কিছু নাই। আমরা আসলে তোর মনের অবস্থাটা বুঝতে চাইছিলাম।
আমার মনে হয় তোর এখনই যাওয়া উচিত। তুই ওকে নিয়ে আয়। আনন্দবাড়িতে আমরা আজ সবাই মিলে ভীষণ মজা করবো। হৈ হল্লা করবো। আনিস মাথা নাড়ে।
চৌদ্দ
আনিস যখন জয়ন্তীর বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন ভরা দুপুর। লোকজন কম। রাস্তায় গাড়ি বা রিকশাও তেমন চোখে পড়লো না। আনিস মুহূর্তের জন্য দাঁড়ালো কিছুক্ষণ। আজ যেনো কী রকম দ্বিধা লাগে তার। জয়ন্তীর জীবনে এতো বড়ো একটা ঝড় বয়ে গেলো। অথচ সে সময় আনিস তার সাথে থাকতে পারেনি। এক ধরনের অপরাধবোধও খানিকটা কষ্ট দিয়েছে তাকে। আসলে ওর তো কিছুই করার ছিল না। তবে কাল ফোনে কথা না বলে অন্যায় করেছে আনিস। আসলে জয়ন্তীকে কিছুটা নিজের জন্য সময় দিতে চেয়েছিল আনিস। তবে এখন মনে হচ্ছে কাল ওর সাথে কথা না বলে ভুলই করেছে সে। কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি।
হঠাৎ তার মনে হলো জয়ন্তীকে কিছু ফুল দেওয়া উচিত। এখানে ফুল কোথায় বিক্রি হয় ঠিক মনে করতে পারে না সে। রাস্তার একটা লোককে ডেকে বললো-
ভাই এখানে ফুল কোথায় পাওয়া যাবে?
লোকটা গম্ভীর হয়ে তাকায় তার দিকে। তারপর আকাশের দিকে হাত তুলে বলে ঐ তো ওখানে পাওয়া যাবে।
আনিস কিছুটা বিব্রতভঙ্গিতে তাকায়। হঠাৎই তার মনে পড়ে শাহবাগে ফুল বিক্রি হয়। ড্রাইভারকে গাড়িটা ঘুরিয়ে শাহবাগের দিকে যেতে বলে সে।
রাস্তায় এখন জ্যাম দেখা দিয়েছে। আশ্চর্য। আনিস ঘামছে। কী রকম উত্তেজনা হয় ভেতরে ভেতরে। তখনই জয়ন্তীর ফোন
কী হলো তুমি কোথায়?
এই তো আসছি
আমি মরে গেলে তারপর তুমি আসবে?
আনিস ভয় পেয়ে যায়
কী হলো? কোনো সমস্যা?
না। তুমি আসলে এখন কোথায়?
শাহবাগে যাচ্ছি। ফুল কিনতে
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ
ফুল দিয়ে কী হবে?
আনিস একটু লজ্জিত হয়
না মানে তোমার জন্য
আমার জন্য কেন?
তোমাকে ভালোবাসি তাই!
কেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন?
মিথ্যে কথা। আমাকে ভালোবেসে একজনই।
জয়ন্তী ফোনটা রেখে দেয়। আনিসের এই প্রথম কীরকম একটা ভয় তীব্র ঝাঁকুনির মতো সারা শরীর কাঁপিয়ে নিয়ে যায়। অস্বস্তি লাগে। ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বলে সে।
জয়ন্তীর বাসায় যেতে যেতে টেনশনটা বাড়তে থাকে। বার বার জয়ন্তীর মুখটা ভাসে। আনন্দবাড়িতে আজ উৎসব। সবার মুখে হাসি। সবাই অপেক্ষা করে আছে জয়ন্তীর জন্য। আনিস ও বাসায় গিয়েই জয়ন্তীকে নিয়ে যাবে।
আনিস ড্রাইভারকে আবার তাড়া দেয়। জয়ন্তীর কথাগুলো কীরকম বেমানান লাগে। মনে মনে ভাবে সে, কোনো সমস্যা হলো নাকি?
জয়ন্তীদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় সে। এত পানির তৃষ্ণা লেগেছে তার। ধীর পায়ে ঘরের ভেতরে ঢোকে সে।
কারো মুখে কোনো কথা নেই। হাসি নেই। জয়ন্তীর বাবা মা ড্রইংরুমে বসে আছেন মুখ কালো করে।
আনিস বলেন, আন্টি জয়ন্তী কই?
জয়ন্তী ততক্ষণে আনিসের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার মুখে রাজ্যের বিস্ময়। যেন সে আনিসকে দেখেনি কখনও। ফিসফিস করে সে বলে
আপনি কি আনিস?
হ্যা। জয়ন্তী তুমি কেমন আছ?
জয়ন্তী অচেনা মানুষের মতো তাকায় আবার। বলে আনিসকে পাঠান।
আনিস হতবাক। জয়ন্তী বলতে থাকে আনন্দবাড়িতে আমার বিয়ে। আনিস আসলে আমি তার সাথে যাবো। আপনি চলে যান।
বিকেলের নরম আলো তখন ড্রইংরুমের ভেতরে এসে পড়েছে। অপূর্ব রঙের সেই রোদের দিকে তাকিয়ে থাকে আনিস। এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল সে সেখানটায়।
জয়ন্তীর বাবা মুখ খোলেন। জয়ন্তী ইজ কমপ্লিটলি আউট অফ অর্ডার। সকাল থেকেই এরকম করছে সে, আমি এখন কী করবো। আই রিয়েলি নিড ইউর হেল্প। তোমার সাহায্য দরকার আনিস।
আনিস মাথা নাড়ে। ফিসফিস করে বলে, আমি পাশে আছি। থাকবো। কালই আমি ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। যতদিন জয়ন্তী ভালো না হয়ে ওঠে, ততদিন অপেক্ষা করবো। তবে সিরিয়াস কিছু না আঙ্কেল। হয়তো খুব শক্ড্। ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বলে, জয়ন্তী আমি ফিরে যাচ্ছি আনন্দবাড়িতে। তুমি যাবে আজ?
জয়ন্তী কোনো কথা বলে না। হাসে। তারপর ধীর পায়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায় সে।
ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। শুধু নিঃস্তব্ধ অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসে।
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
কোনো মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না?
……..
আর কারো পানে চাহিব না আর, করিব হে আমি প্রাণপণ
তুমি যদি বল এখনি করিব বিষয়বাসনা বিসর্জন।
Porlam. Valo legese. Apnar aro aro lekha chai!
Uponnas er golper gathuni ta sadharon! Kintu chomotkar lekhar kousol apni ropto koresen! Execellent! Great going!
Shaitycafe ke dhonnobad-erokom ekta lekha hazir korar joyyno. Beche thakun valobasha r bishwas e!
Apurbo Shayan
Baily Road,Dhaka
I have reviewed your novel titled Anondobari! I am really impressed to review this novel.
It’s a full of satire. Satire is primarily a literary genre or form, although in practice it can also be found in the graphic and performing arts. In satire, vices, follies, abuses, and shortcomings are held up to ridicule, ideally with the intent of shaming individuals, and society itself, into improvement. Although satire is usually meant to be funny, its greater purpose is often constructive social criticism, using wit as a weapon.
I really found in many artistic forms of expression, including literature, plays, commentary, and good script in it.
Best of Luck!
Rohan
hay bijoyee bir, nobo jiboner prate, nobin ashar khorgo tomar hatay,
jirno abesh kato shukothor ghate, bondhon hoke khoy…
bhengeche duar, eshecho jyotirmoy, tomari hoke joy…..
Excellent! Tobe seshta aro interesting hote parto!
Uponnasti pore mone hoyese Humayun Ahmed ke anusoron kora hoyese. Sotti naki? Lekhok ki jobab deben?
Monsur Ahmed
Banai Bazar, Dhaka
Mostafa Sohel er uponnasti pore mone hoyni o kau ke anusoron kore. Lekhar style, manner and attitude sohel er motoi different. Sotontro!
Valo legese lekhati!!!
মোস্তফা সোহেল এর লেখা এই প্রথম পড়লাম.
উপন্যাসটি বেশ ভালো লাগলো.! লেখাটি খুব সহজ আর প্রাঞ্জল.! আশা করি ওর আরো লেখা পাব.!
উত্তরা, ঢাকা
উপন্যাস পড়ে একটু আলাদা ফিলিংস হলো ! আনিস আর জয়ন্তী’র ভালবাসাবোধ, পরিশীলিত নাটকীয়তা এবং মার্জিত চরিত্র বিন্যাস অন্যরকম এক আবহ তৈরী করে! সমকালীন তরুণদের ভেতর এই প্রচেষ্টা অনেকটা কম বলেই হয়ত সাহিত্য কাফে লেখাটি নির্বাচন করেছে! তবে একটা মেয়েকে গুণ্ডারা উঠিয়ে নিয়ে গেলেই যে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে তাও কিন্তু ঠিক নয়। মেয়েদের শক্তির
প্রতি আর একটু কনফিডেন্ট হলে ভালো লাগত!
তবু মোস্তফা সোহেলকে ধন্যবাদ জানাই এই কারণে যে খুব সিরিয়াস বিষয় উনি খুব সহজভাবে তুলে এনেছেন!
নাজমা জাকারিয়া, ঢাকা
By far the best.. as good as it gets, my dear! I have always requested you to write more and more.. it surely will get to where it should go.. some one like you may become a very powerful writer in a while if you keep practicing like this..
About influences from other writers.. don’t worry about it! Soon you’ll develop your signature style of writing… not far from now:-)
Lots of blessings..
Shiblee
from my beautiful farm house in Kuakata
Could you please post something about the writer?
Valo legese!
একজন বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পেরে সাহিত্য কাফে খুঁজে আপনার লেখাটি পড়লাম. আপনার লেখা অন্য অন্য পত্রিকার সাহিত্য পাতায় দেখতে চাই ! আপনার সম্পর্কে খানিকটা জানতে পারলে আরো ভালো লাগত!
সুন্দর লেখেন আপনি !
সোহেল.. আপনাকে শুভকামনা!
রুপা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
মোস্তফা সোহেল এর লেখা পড়ে ভালো লেগেছে! তবে উপন্যাস এর নামটা নিয়ে আরো একটু ভাবা যেত!
খায়রুল ইসলাম, বগুড়া
আপনার লেখাটি পরে মন খারাপ লাগলো! কেন জানিনা মনে হলো আনিস এর প্রতি একটু অবিচার করা হয়ে গেল! বেচারা!
মুর্শিদ আলম, ঢাকা বিশ্ববিদালয়!
On behalf of Shilalipi publication, we are interested to publish this novel in the upcoming ekhushey book fair-2012. We are requesting you to contact us accordingly through Humayun Bhai ASAP.
God bless you!
Moin, Banglabazar, Dhaka
Contact: 01711 463072
Excellent!!!
তরুনদের ভেতর এত জনপ্রিয় হওয়া সত্তেও আপনাকে মেনস্ট্রিম এর পত্রিকাগুলোতে লিখতে দেখিনা! কেন? আপনার লেখাটি মজা লেগেসে! ভালো থাকবেন!
সম্পাদক, জলছবি!
আপনার আরো লেখা চাই! আর একটা উপন্যাস পেলে ভালো লাগত!
মুজিব হাসান, গুলশান-২, ঢাকা
Well Done… I am so impressed! Would you please post your pic and brief write up on you!
61 DB Road, Mymensing
very interesting and thoughtful also.
Chomotkar! Moja peyesi!!
Sohel, Shilpacharjo Sahityya Puroskar-2011 pabar joynno ovibadon!!! Apnar e lekhati ekhon porsi.. shesh hole motamot janabo!!
Pranab Chakroborty, Dhaka
প্রিয় সোহেল
সাহিত্য কাফে’তে প্রকাশিত তোমার উপন্যাসটি পড়লাম। আমার এখনও মনে হচ্ছে তোমার বড় মাপের লেখায় হাত দেয়াই ঠিক হবে।
তালিব বাশার নয়ন
সম্পাদক
পলিমাটি
ত্রৈমাসিক লিটল ম্যাগ (কৃষি-প্রৃকৃতি-পরিবেশ-প্রান্তসমাজ-গণসংস্কৃতি)
৪২ মাগুরা রোড (নিচতলা), ঝিনাইদহ-৭৩০০
মোবা: ০১৭১৫-২৫১ ৭১৯
ইমেইল: [email protected]