‘কবিতা কল্পনালতা’-য় আমি বিশ্বাস করি না’

সাক্ষাত্কার:  নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ________________

গত সাত দশক ধরে বাংলা কবিতায় অনন্য আভিজাত্যে বিরাজ করছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী । অষ্টআশিতে পা রেখে প্রবীণতম এই কবি কবিতাজগতে আজ অভিভাবকপ্রতিম। তবু, বয়সকে উপেক্ষা করে আজও সৃজনশীল এবং দেশ-কাল-সমাজ সম্পর্কে সমান সচেতন। সাহিত্য আকাদেমী-সহ  বহু পুরস্কারে ভুষিত এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি-লিট উপাধিতে সম্মানীত কবি তাঁর দীর্ঘ কবিজীবনের উপলব্ধি বিষয়ে কথা বলেছেন সৈয়দ হাসমত জালালের সঙ্গে।
__________________

রবিবারের সকালবেলা: নীরেনদা, আপনার কবিতায় শব্দ, ছন্দ, ব্যঞ্জনা এবং তার নির্মিতির ভিতরে সুসংহত গদ্যের অভিঘাত লক্ষ্য করেছি আমরা। অথচ আপনারই এক বিখ্যাত কবিতায় আপনি বলেছেন, ‘কবি, তুমি গদ্যের সভায় যেতে চাও?/ যাও।/ পা যেন টলে না…’ ইত্যাদি এবং শেষে বলেছেন, ‘সভাস্থলে/ আসবার ছিল না কথা, তবু সম্রাট এসেছেন।’ এটা কেন? কবিতার সাথে গদ্যের সম্পর্ক কীরকম বলে আপনি মনে করেন?

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী: যে কবিরা গদ্য লেখেন, তাঁদের নিয়ে লেখা আমার এই কবিতা। দেখো, আমি মনে করি, কবিরা গদ্য লিখলে রাজার মতো লিখতে হবে। এ প্রসঙ্গে কয়েকজন বিখ্যাত কবির কথা বলতে পারি, যাঁরা ভাল গদ্য লিখতেন। যেমন এলিয়ট। তারপর ধরো, যাঁদের তিরিশের কবি বলা হয়— অডেন, স্পেন্ডার, লিউইস— এঁরা খুব ভাল গদ্য লিখতেন। লিউইসের একটি অসাধারণ গদ্যের বই আছে। ‘পোয়েটিক ইমেজ’। কবিরা গদ্য লিখবেন, তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সে বিষয়ে কবিকে সতর্ক হতে হবে, তা হবে প্রকৃত যুক্তিগ্রাহ্য এবং আমি বলি, লিখতে হবে রাজার মতো। আমি ভাল গদ্য লিখতে পারি না । আমার গদ্য লিখতে ইচ্ছে করে না। আমি বলি, গদ্য আমার মাতৃভাষা নয়। এই নিয়ে শঙ্খ (ঘোষ) মজাও করেছে। আমার সম্পর্কে  বলেছে, গদ্য গূঢ় কৌশলে ওঁর কবিতায় এসেছে।

প্র: আপনার কবিতা এত নিখুঁত ছন্দময়, অথচ আপনি যেন তা বুঝতে দিতে চান না, অনেকটা গদ্যের চলন…

উ: দেখো, গদ্যেরও নিজস্ব ছন্দ আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘পৃথিবী’ কবিতাটা ভাবো। ‘অচল অবরোধে আবদ্ধ পৃথিবী, মেঘলোকে উধাও পৃথিবী, গিরিশৃঙ্গমালার মহৎ মৌনে ধ্যাননিমগ্ন পৃথিবী…’। গদ্যছন্দ কীভাবে কবিতা হয়ে উঠেছে। কবিতার ছন্দ আছে, গদ্যের ছন্দ নেই— ভাবলে খুব ভুল হবে। যারা ছন্দ বোঝে না তারা কবিতাই নয়, গদ্যও ভাল লিখতে পারে না।

প্র: আপনি ভাল গদ্য লিখতে পারেন না, বলছেন, বা গদ্য লিখতে আপনার ভাল লাগে না। কিন্তু আপনার উপন্যাস ‘পিতৃপুরুষ’ অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল এবং তা তো দক্ষ গদ্যকারের লেখা—

উ: সেটা কথা নয়। প্রচুর প্রবন্ধ তো লিখেছি। খবরের কাগজে কাজ করেছি, কত রকম গদ্য লিখেছি। কিন্তু বলতে চাইছি, আমার গদ্য লিখতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, কবিতার হিস্যে থেকে সময় বের করে আমি গদ্যকে দিচ্ছি। ওই সময়টা কবিতাকে দিতে পারলে আরও ভাল হতো।

কবিতা বলতে কিছু গুণপনার কথা বুঝি, যা গদ্যের মধ্যে মাঝে মাঝে ঝিলিক মেরে ওঠে। তখন আমরা বলি, কবিতার মতো গদ্য। রবীন্দ্রনাথের ‘সহজপাঠে’ দেখো, জলে আছে মাছ/ গাছে থাকে পাখি/ বনে থাকে বাঘ।’ এই সব পঙক্তির মধ্যে ভারসাম্য আছে, যাকে কবিতা বললে কম বলা হয়। এ হচ্ছে কবিতার গুণের দ্বারা আক্রান্ত গদ্য।

প্র: আপনি গদ্যের যুক্তিনির্ভরতার কথা বলছিলেন—

উ: হ্যাঁ, গদ্য হচ্ছে যুক্তির ভাষা। কবিতার ক্ষেত্রে দেখো সাফাই দেওয়ার উপায় আছে। যেমন কবিতা সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে— আ পোয়েট টকস টু হিমসেলফ, উই ওনলি ওভারহিয়ার। কবিতা হচ্ছে কবির স্বগত সংলাপ, তা তোমার আড়ি পেতে শোনার কী দরকার ছিল! কিন্তু গদ্য একজন মানুষ আর একজন মানুষকে বলছে, যাতে বোধগম্য হয়। গদ্যের ক্ষেত্রে, গদ্য হচ্ছে প্রতিপাদন করার ভাষা, প্রমাণ করার ভাষা। ধরো বলছি, জালাল পাজি লোক। এটা সিদ্ধান্ত। এখন জালাল সম্পর্কে যথাসম্ভব  তথ্য সংগ্রহ করতে করতে প্রমাণ করতে হবে ওই সিদ্ধান্তকে। এখানে ‘হেতুবাক্য’ বলে একটা কথা আছে। রাম-শ্যাম-যদু-মধু— কত লোককে মরতে দেখেছি এবং  তা থেকে সিদ্ধান্ত করছি মানুষ মরণশীল। এটা হেতুবাক্য বা আশ্রয়বাক্য। এখন নীরেন্দ্রনাথ একজন মানুষ এবং মানুষ মরণশীল। অতএব নীরেন্দ্রনাথকে মরতে হবে। আমরা আগে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই, তারপর তথ্য বাছাই করি, তা করলে চলবে না। তথ্য সংগ্রহ করতে করতে দেখা গেল, জালাল পরের উপকার করে, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা করে। কিন্তু একদিন তাকে রাতে কোথায় ঘুরতে দেখা গিয়েছে বা কারো সঙ্গে  তর্ক করছে— শুধুমাত্র এইটুকু তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা হল সে পাজি লোক। কিন্তু সে পরোপকারী বা পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল— একথা বলা হল না। এরকম তথ্য বাছাই  করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কোনও গদ্য বা প্রবন্ধ দুর্বল হয়, তা শেষ পর্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে না।

বঙ্কিমচন্দ্রের সব লেখালেখির ভিতরে যাচ্ছি না, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধের গদ্যকে আদর্শ গদ্য বলি। কারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে যুক্তি দিয়ে তিনি তা প্রমাণ করেন। তাঁর বাহুবল ও বাক্যবল প্রবন্ধটির কথা ধরো। প্রথমে তিনি বুঝিয়ে বলছেন বাহুবল কী, বাক্যবল কী এবং শেষে বলছেন বাহুবলের চেয়ে বাক্য কেন শক্তিশালী। এ অনেকটা জ্যামিতির প্রতিপাদ্যের মতো। যুক্তিবিদ্যার প্রথম সোপান জ্যামিতি। নজরুলকে খারাপ কবি প্রমাণ করার জন্য কেউ কেউ তাঁর ত্রুটিগুলো শুধু তুলে ধরে, কিন্তু নজরুল কেন এত মানুষের প্রিয়— সে কথা বলে না। আবার তুমি যা বলছিলে, কাউকে ভাল বলতে গিয়ে উচ্ছ্বাসের প্রকাশ দেখা যায়। আবেগ হচ্ছে দুধ, আর উচ্ছ্বাস হচ্ছে তার ফেনা। এই ফেনিলতা পছন্দ নয় গদ্যে।

প্র: কবিতা রচনার ক্ষেত্রে সব সময়ই কল্পনার অবকাশ থেকে যায়। কিন্তু আপনার কবিতা অনেকাংশেই সমাজবাস্তবতানির্ভর। সেখানে তেমন করে কল্পনার সুযোগ নেননি কেন?

উ: ‘কবিতা কল্পনালতা’-য় আমি বিশ্বাস করি না। আমি এমন কোনও মানুষ নিয়ে লিখিনি যাকে আমি দেখিনি, যার কথা আমি শুনিনি বা যে আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এমন কোনও রাস্তা নিয়ে আমি লিখিনি যার ধুলো আমাকে স্পর্শ করেনি। এমন কোনও গাছ নিয়ে লিখিনি যে গাছ আমি চিনি না । তবে কবিতার বাড়তি একটা ব্যাপার থাকে— যেটুকু বলছি, শুধু সেইটুকুই বলছি কি? যদি কবিতার মধ্যে বাড়তি কোনও ব্যঞ্জনা উঁকি না দেয়, তাহলে বুঝতে হবে সে লেখা হয়নি।

প্র: তাহলে আপনার কবিতা কি অত্যন্ত সচেতন ও সতর্ক নির্মাণ?

উ: দেখো, কবিতার প্রথম লাইনটা— তুমি কবিতা লেখো তুমি বুঝবে— একটা Key line – কে জড়িয়ে কবিতাটা হয়ে ওঠে। এই Key lineটা প্রথম লাইন বা মাঝের কোনও লাইনও হতে পারে। এই লাইনটা আচমকা পেয়ে যাই। ওটুকুর মধ্যেই মূল কবিতা। বাকিটা কারিগরি। একটা উদাহরণ দিই। প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটা কবিতা—‘ছাদে যেও নাকো/ সেখানে আকাশ অনেক বড়/ সিমাহীন।’ চমৎকার একটা ছবি। কিন্তু পরের লাইনগুলো দেখো— তারাদের চোখে এত জিজ্ঞাসা/ স্বপন সব হবে বিলীন।‘ এটা কারিগরি।

প্র: কবিতার জগতে আসা এবং তাতেই স্থিত হওয়া, এটা কি আপনার সচেতন সিদ্ধন্ত ছিল? নাকি ছেলেবেলার থেকে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ের মধ্যে এটা তৈরী হয়ে গিয়েছিল— ব্যক্তিত্বের অন্তর্গত একটা ব্যাপার?

উ: জানি না।  আমি তো ছেলেবেলায় গানও শিখেছিলাম। কিন্তু গানের ভেতরবাড়িতে আমার যাওয়া হল না। আমি লেখাপড়ায় ভাল ছিলাম না। আমার বাবা, ভাই, ছেলে-মেয়েরা সবাই পড়াশুনায় খুব ভাল। বাবা ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক। আমার ভাই হীরেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান ছিল,  পরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কিউরেটর হয়ে যায়। আমার ছেলে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালইয়ে বাংলার অধ্যাপক, বড় মেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ায় আর ছোট মেয়ে লেডি ব্রেবর্ন কলেজের অধ্যক্ষ। আমি তো সেসব পথে যাই নি। আমার বাবা খুব ভাল ফুটবল খেলতেন। মোহনবাগানের শতবর্ষ নিয়ে লেখা বইয়ে আমার বাবার কথা আছে। আমিও ছেলেবেলায় ফুটবল খেলতাম। কিন্তু আমার শরীর-স্বাস্থ্য তো তেমন ছিল না। তাই ফুটবল-খেলোয়াড় হওয়া হল না। কিন্তু আমি খুব বই পড়তাম, বিভিন্ন ধরনের বই। আর কবিতা লিখতাম। এটা আমি পারি বলে মনে হয়েছিল আমার।

প্র: আপনার লেখা কোন কবিতা আপনাকে কবি হিসেবে প্রথম খ্যাতি এনে দিয়েছিল? প্রেক্ষিতটাও একটু বলুন।

উ: ‘শহীদ রামেশ্বর’। আমি তখন ল-কলেজের ছাত্র। ১৯৪৫ সাল, নভেম্বর মাস। ওয়েলিংটন স্কোয়্যার থেকে ছাত্রমিছিল বের হয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে। আমিও বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সেই মিছিলে যোগ দিতে যাচ্ছিলাম। ‘নিউ সিনেমার’ ওখানে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায়। তাতে রামেশ্বর নামে এক ছাত্র মারা যায়। ওখানে গিয়ে দেখি, রামেশ্বর মারা গিয়েছে। রাস্তায় ছিটিয়ে পড়ে আছে খাতা, বই, চশমা আর চাপ চাপ রক্ত। ওই মৃতদেহকে ঘিরে ছাত্ররা বসে আছে রাস্তায়। প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সেদিন রাত ন’টা সাড়ে ন’টা নাগাদ খুব ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরলাম । তারপর রাত জেগে কবিতাটা লিখলাম। পরের দিনই সেটা ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠালাম আর ওই সংখ্যা ‘দেশ’-এর পুরো একপাতা জুড়ে কবিতাটা বেরোল। আমার বয়স তখন কত— একুশ। পরে দেখেছি, ছাত্ররা রাস্তায় মিছিল করে যাচ্ছে ওই কবিতাটা আবৃত্তি করতে করতে।

এখানে একটা ঘটনার কথা বলি। কয়েক বছর আগেকার কথা। ফরোয়ার্ড ব্লকের আয়োজনে ‘চিত্ত বসু স্মারক বক্তৃতা’ দিতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আন্দোলন ও সাহিত্য বিষয়ে আমি বলতে গিয়েছিলাম। সেখানে ফরোয়ার্ড ব্লকের সভাপতি অশোক ঘোষ আমাকে বললেন— বক্তৃতা দিন, তবে ‘শহীদ রামেশ্বর’ কবিতাটা আগে বলুন। অশোক ঘোষ আমারই প্রায় সমবয়সী এবং ওই সময়ে তিনিও ছাত্র আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। তা এতদিন পরেও কবিতাটা অনেকে মনে রেখেছেন।

প্র: আপনার কবিতায় এভাবে বিভিন্ন  সমাজ বাস্তবতার ছবি বার বার এসেছে—

উ: ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি একটা সোশিও-ইকনমিক পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছি। বড় হয়েছি। এতগুলো বছর ধরে সেখানে নিঃশ্বাস নিচ্ছি,  চলাফেরা করছি—আমার জীবনে তার ছাপ পড়বে না? আর জীবনে ছাপ পড়লে কবিতায় তা পড়বে না? আবার বলছি, আমার কাছে কবিতা কল্পনালতা নয়। কবিতায় মিথ্যে কখনও লিখিনি। আমার কম বয়সে তখন আমরা মধ্য কলকাতার নূর মহম্মদ লেনে থাকতাম। (আমার সঙ্গী ফোটোগ্রাফারকে দেখিয়ে বললেন, ও নূর মহম্মদ লেনের ছেলে, ও পরিবেশটা জানবে।) সেখানে ঘুড়ি ওড়াতাম, কাচগুড়ো দিয়ে সুতোয় মাঞ্জা লাগাতাম। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ন্যাড়া ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিলাম— সে অন্য প্রসঙ্গ। তো, ওখানকার বাস্তবতা থেকেই লেখা আমার কবিতা— ‘ও খোকা তোর ঘুড়ি ওড়া’।

প্র: কবিদের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে একটা বিতর্ক বরাবরই আছে। আপনার কবিতায় এত রকমভাবে সমাজ উঠে এসেছে। আপনি এই দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

উ: সামাজিক দায়বদ্ধতা, বিতর্ক–টিতর্ক, ওসব কাজের কথা নয়। একজন চাষী যখন লাঙল কাঁধে যখন মাঠে চাষ করতে যায় বা একজন শ্রমিক যখন তার হেতের নিয়ে কারখানায় কাজ করে, তখন কি তারা সমাজের উপকার করছে বলে সেগুলো করে? তা তো নয়, তারা ওই কাজ করে তাদের জীবন ধারণের জন্য, খাওয়া-পরার জন্য। কিন্তু কাজগুলো এমনই যে তাতে সমাজের উপকার হয়। যে ভাল লোক, সে কারোর উপকার করতে না পারুক, অপকার তো করে না। কীটস্-এর কথা ধরো, তিনি কখনও সোশ্যাল কমিটমেন্টের কথা বলেননি, কিন্তু তাঁর কবিতা কি সমাজের কোনও অপকার করেছে? একজন কবি তাঁর নিজের মুক্তির কথা লিখছেন, তা পড়ে অন্যেরাও মুক্তি অনুভব করছে। কবি তো আর দেবী স্বরসতীর সঙ্গে দায়বদ্ধতার চুক্তি করে লিখতে বসছেন না। তবে কবির দায়বদ্ধতা থাকে কবিতার প্রতি, নিজের প্রতি। সাহিত্যের শর্ত তাঁকে মানতে হয়। যারা সাহিত্যের শর্ত লঙ্ঘন করে, তারা সাহিত্যের ক্ষতি করে।

প্র: চল্লিশের শুরুতে আপনার আত্মপ্রকাশ। তখন তো তিরিশের কবিদের প্রবল দাপট। ওই দাপুটে কবিদের প্রভাব কি আপনি বা আপনার সময়ের কবিদের উপর কোনওভাবে পড়েছিল?

উ: চল্লিশের কবি ছিলেন সুভাষদা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আমার চেয়ে বয়সে বড়। সমসাময়িক আর ছিল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ— এরাঁ। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বয়সে একটু বড়। তুমি যাঁদের দাপুটে কবি বলছ তাঁদের মধ্যে একমাত্র জীবনানন্দ নিজস্ব ভাষা তৈরী করতে পেরেছিলেন। বাকি সবাই ভাষার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের কাছে সরাসরি ঋণী। তবে তাঁরা সকলেই খুব সক্ষম কবি।

প্রশ্ন: আপনি জীবনানন্দের কবিতা প্রসঙ্গে কবির ‘আত্মঘাতী ক্লান্তির’ কথা বলেছিলেন এখনও কি জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে সেরকমই মনে করেন?

উ: নিশ্চয়ই। আমি ওই কথাটা লিখেছিলাম যখন, তখন আমার একুশ বছর বয়স। কিন্তু আমি জীবনানন্দের কবিতা ঠিকই বুঝেছিলাম। ওঁর কবিতায় মৃত্যুবাসনা প্রধান। অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়/ আরো  এক বিপন্ন বিস্ময়/ আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে, /আমাদের ক্লান্ত করে/ ক্লান্ত— ক্লান্ত করে, / লাশ কাটা ঘরে /সেই ক্লান্তি নাই।‘ একে কী বলবে?

প্রশ্ন: কিন্তু জীবনানন্দ কি ‘তিমিরহননের গান’ লেখেননি? বলেননি— মানুষের মৃত্যু হলে/ তবু ও মানব/ থেকে যায়’?

উ: হ্যাঁ বলেছেন। কিন্তু আধুনিক মানুষের অনিশ্চয়তা তিনি খুব ভাল ধরতে পেরেছিলেন। ওঁর চাইতে ভাল আর কেউ ধরতে পারেননি। দেখ জীবনবাসনা থাকলেই কেউ বড় কবি হয়ে যায় না বা সে লেখা কবিতা হয় না। কবিতায় মৃত্যুবাসনা থাকা মানেই তা খারাপ নয়। ব্যাপারটা কবিতার নিরিখে বিচার করতে হবে।

প্র: জীবনানন্দের প্রভাব ঠিক কীরকম বলে আপনার মনে হয়?

উ: তাঁকে ভালবাসতে হয়, কিন্তু তাঁর লাইন ধরতে নেই। আমি ওঁর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পেয়ে এক রাতে পড়ে শেষ করেছিলাম। এ এক অন্য জগৎ। আই অজ সাকড ইনটু আ ডিফারেন্ট ওয়ার্ল্ড। এ এক অন্য অভিজ্ঞতা। কিন্তু ওঁর মতো লিখতে নেই। যাঁরাই ওঁর মতো করে লিখতে গিয়েছেন, তাঁরা ওখান থেকে বেরোতে পারেন নি। যেমন বিভূতি চৌধুরী, রামেন্দ্র দেশমুখ্য। জীবনানন্দের কবিতা ‘কামট’-এর মতো টেনে নিয়ে যায়।

প্র: কিন্তু জীবনানন্দের কবিতা আপনার ওই ম ন্তব্য সম্পর্কে জীবনানন্দ তো খুব তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন?

উ: হ্যাঁ। ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় এ নিয়ে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। তবে পরে এক সময় দেখা হলে তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম। তিনি বুঝেছিলেন এবং হেসেছিলেন। তাঁর রাগ চলে গিয়েছিল। তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। এই দেখো ‘ধূসর পাণ্ডূলিপি’ বইটি তিনি আমাকে নাম লিখে দিয়েছিলেন, ওই ঘটনার অনেক পরে।

প্র: আপনার ঠিক পরবর্তী সময়ের কবিদের কবিতা সম্পর্কে আপনার অভিমত?

উ: সুনীল (গঙ্গোপাধ্যায়) গদ্যে চলে গেল। কিন্তু ওর কবিতার রেঞ্জ ছিল বিশাল। শক্তি (চট্টোপাধ্যায়), বিনয় (মজুমদার) ওরা ভাল লিখেছে। কিন্তু সুনীলের ‘কথা দিয়েছিলে, তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে’ কিংবা ‘ব্রিজের নিচে মানুষ’— একদম অন্য রকম।

প্র:সুনীলদার কবিতায় খুব ঝকঝকে ব্যঞ্জনাময় গদ্যের ব্যবহার আমি দেখেছি। এটা কি আপনার ঘরানারই উত্তরাধিকার?

উ: (সলজ্জ হেসে) না, না। ও বেশ কিছু অসম্ভব ভাল কবিতা লিখেছে। ও কবিতাকে আরও কিছু দিতে পারত।

প্র: এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন করি, নীরেনদা। সুনীলদার কবিতায় বা আরও অনেকের কবিতায় নারী-পুরুষ সম্পর্ক অনেকটা জায়গা নিয়ে আছে। কিন্তু আপনার এ ধরনের কবিতা দেখি না, কেন?

উ: (হেসে) ওইভাবে ভাবনা আমার আসে না। মনের গঠন অন্যরকম। তাই বলে মেয়েদের ভালবাসি না, তা  নয়। দেখো, মেয়েদের সঙ্গে পঞ্চান্ন রকম সম্পর্ক হয়। দিদির সঙ্গে যে সম্পর্ক, বোনের সঙ্গে সেরকম নয়। পিসিমার সঙ্গে সম্পর্কের চেয়ে মাসিমার সঙ্গে সম্পর্ক একটু আলাদা। আবার কাকিমা এবং জেঠাইমার সঙ্গে সম্পর্ক একরকম নয়। আসলে এক-একটা সম্পর্কের মধ্যে এক-একরকম ‘শেড’ । এই শেডগুলো দেখতে আমার ভাল লাগে।

প্রশ্ন: ‘পিতৃপরুষ’- এর পর আর কোনও উপন্যাস লিখলেন না কেন? ওটা তো কিছুটা আত্মজৈবনিক ছিল?
উ: ওটা চোদ্দ আনা নিজের কথা। আর দু’আনা তো মেশাতেই হয়। সুনীল উপন্যাসটার খুব প্রশংসা করেছিল। আর একজন খুব নামী লেখক শুধু প্রশংসাই করলেন না, আমাকে আরও একটা উপন্যাস লিখতে বললেন। আমি ঘাবড়ে গিয়ে আর লিখলামই না। (পরে হাসি থামিয়ে) আসলে আমার ভয় হল, আমি কবিতা থেকে সরে যাব।

প্র: কিন্তু আপনি তো অনেক রহস্যকাহিনি লিখেছেন?

উ: হ্যাঁ, ওগুলো লিখে আমি আনন্দ পাই— একধরনের রিল্যাক্সেশন। রহস্যগল্প আমায় খাবে না। কিন্তু উপন্যাস আমাকে খেয়ে ফেলত, আমি কবিতা থকে সরে যেতাম। তোমরা হয়ত জানো না, আমার প্রথম লেখাই গল্প, ১৯৪২ সালে, ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। পরে ‘শঙ্কুর বাবা’ নামে একটি গল্প স্বপ্নময় চক্রবর্তী  একটি সংকলনে নিয়েছে।  নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা। সবাই খুব প্রশংসা করেছিল।

প্র: এরকম আর কোনও গদ্য লেখার কথা ভাবছেন না?

উ: না, তবে আমার আত্মজীবনী ‘নীরবিন্দু’র পরবর্তী অংশের লেখাটা এইবার শুরু করব।

প্র: আপনার এত দীর্ঘ কবিজীবন, এত মানুষ, এত দেশ দেখেছেন, এত অভিজ্ঞতা— এর কতখানি আপনার সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করছেন?

উ: জীবনে অনেক পেয়েছি, তার এক আনাও দিতে পারিনি। কবিতাভাবনা মাথায় যা আসে, তার ছ’পয়সাও কবিতার মধ্যে আসে না। বড়দের কাছে যেমন পেয়েছি, তেমনই বয়সে ছোট এমন অনেকের কাছেও পেয়েছি অনেক কিছু। এ জীবনে এমন অনেকের কাছেই কৃতজ্ঞ রইলুম।

প্র: তরুণ কবি-লেখকদের জন্য আপনার কোনও উপদেশ বা পরামর্শ?

উ: অনেকেই ভাল লিখছে। এদের পরামর্শ দেওয়ার মতো বোকামি করব না। গৌতম বুদ্ধ গৃহত্যাগ করার পর একবার গৃহে এসেছিলেন। তখন তাঁর স্ত্রী তাঁর পুত্র রাহুলকে বলেছিলেন বুদ্ধের অনেক সম্পদ আছে, তাঁর কাছ থেকে তা চেয়ে নিতে। সেই মতো রাহুল বুদ্ধের কাছে সম্পদ চাইলে বুদ্ধ বলেছিলেন আত্মদীপ ভব। নিজেকে প্রজ্জ্বলিত করো। কবি-লেখকদেরও নিজেই নিজেকে প্রজ্জ্বলিত করতে শিখতে হয়।

(সাক্ষাৎকারটি গত  ৩০ অক্টোবর ২০১১ কলকাতার রবিবারের সকালবেলা পত্রিকায় ছাপা হয়। সাহিত্য ক্যাফেতে প্রকাশিত হল কবি-লেখক সৈয়দ হাসমত জালাল-এর সম্মতিতে)

ছবি: শ্যামল চক্রবর্তী

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top