মুহসীন মোসাদ্দেক
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন আয়েশা সুলতানা, এক দৃষ্টিতে, বহুক্ষণ থেকে। একদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা তাঁর নিষেধ। তবুও তাকিয়ে আছেন, তাকিয়ে থাকেন।
একদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তাঁর মাথা ধরে যায়, চোখ ব্যথা করে। একটু পরেই হয়তো তিনি মাথা চেপে ধরে শুয়ে পড়বেন, একটু কোঁকাবেনও হয়তো। তবুও তিনি তাকিয়ে আছেন, তাকিয়ে থাকেন।
একটানা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে কিংবা হাঁটলে তাঁর পা ব্যথা করে। বাতের ব্যথা আছে তাঁর। তবুও দাঁড়িয়ে আছেন, থাকেন।
প্রকৃতিটাও কেমন! মাঝে মাঝেই এমনভাবে সাজে, দেখলেই মায়া লেগে যায় আয়েশা সুলতানার। এ মায়া এড়িয়ে ঘরে বসে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। প্রকৃতির এমন মায়বী সাজ দেখলেই তাই বেলকুনির গ্রিলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন আয়েশা সুলতানা। এক দৃষ্টিতে বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। নিষেধ, তবুও।
‘হায়! হায়! খালাম্মা, কী করেন আপনে!’
আয়েশা সুলতানা এই জগতে ছিলেন না। মায়াবী আবেশে কোথায় যেনো হারিয়ে গিয়েছিলেন, সবসময়ই যান। রেবু বুয়ার আর্তনাদে তিনি চমকে উঠলেন।
‘এইডা আপনে কী করতেছেন খালাম্মা! কাম সারছে! ভাইজান-আপুরা আমার জান শ্যাষ কইরা ফ্যালাইবো!’
আয়েশা সুলতানার দুই ছেলে আর এক মেয়ের কেউ এই বাড়িতে থাকে না, এই শহরেই থাকে না। তারা নিজ নিজ কর্মস্থলে বাস করে। আয়েশা সুলতানাকে তারা নিজেদের কাছে নেয়ার জন্য খুব চেষ্টা করেছে। কিন্তু আয়েশা সুলতানা যৌবন না ফুরোতেই হারানো স্বামীর এই বাড়ি ছেড়ে কোত্থাও যেতে রাজি নন। আয়েশা সুলতানার দেখাশোনার জন্য তাই ছেলেমেয়েরা রেবু বুয়াকে রেখে গেছে। আয়েশা সুলতানার কিছু হলেই সব দায় রেবু বুয়ার ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। রেবু বুয়া তাই মা যেভাবে ছোট বাচ্চাদের শাসন করে সেভাবে আয়েশা সুলতানাকে সারাক্ষণ শাসনে রাখে। রেবু বুয়ার উপর মাঝে মধ্যেই তাই খুব চটে যান আয়েশা সুলতানা।
আয়েশা সুলতানা গরম চোখে রেবু বুয়ার দিকে একটু তাকিয়ে থেকে আবার আকাশের দিকে তাকালেন। বেলকুনির পূর্ব কোণে সামনের দুইটা চারতলা বিল্ডিংয়ের মাঝের হাত দশেক ফাঁক দিয়ে দূরের গাছপালার মাথা থেকে খানিকটা উপরে পূর্ণিমার রূপালি পূর্ণ চাঁদটা আকাশে ভেসে আছে। রূপালি চাঁদটার কোমল আলোর ছোঁয়ায় আয়েশা সুলতানার শরীরে শীতল অনুভূতি ছড়িয়ে যাচ্ছে, শিরশির করে উঠছে তাঁর শরীর। এই দৃশ্য বেলকুনির এই কোণা থেকে মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। আয়েশা সুলতানা এই দৃশ্যের মায়ায় এতোটাই জড়িয়ে পড়েছেন যে ডাক্তার-ছেলেমেয়ের নিষেধ আর রেবু বুয়ার বিরক্তিকর শাসন অগ্রাহ্য করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এ দৃশ্য উপভোগ করেন।
‘ও খালাম্মা, এভাবে দাঁড়ায় আছেন ক্যান! বাতের বেদ্না উইঠা যাইবো তো!’
আয়েশা সুলতানা গরম চোখে রেবু বুয়ার দিকে তাকিয়ে খেকিয়ে বললেন, ‘তুই চুপ করবি রেবু! এখান থেকে যাবি!’
‘হ যামু, অবশ্যই যামু। তয় আপনেরে লইয়া যামু। চলেন, ঘরে যায়া শুইয়া পড়েন, আপনের পা টিপ্পা দেই।’
‘তুই সারাক্ষণ আমাকে এতো বিরক্ত করিস কোনোরে রেবু?’
‘ও আল্লা, বিরক্ত করলাম কখুন! আপনের যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেইটা দেখনের জন্যই আমারে বেতন দিয়া রাখসে। আমি তো এইডাই করি, এইখানে বিরক্তির কি হইলো!’
‘বিরক্তির কিছু হলো না! এই যে এতো সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে, কী সুন্দর আবছা আলো চারিদিকে, কী মায়াবী একটা পরিবেশ, আর এর মধ্যে তুই আমার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করেছিস, এইটা বিরক্ত করা না?’
‘আমি বুঝি না খালাম্মা, চাঁন্দের মইধ্যে দেখার কী আছে! গোল একটা জিনিস আকাশে ভাইসা থাকে, যেটুকু আলো দেয় তাতে কোনো কাম হয় না, এইডা দেখতে যায়া আজাইরা মাথা-চোখ-ঠ্যাং বেদনা করনের কোনো দরকার আছে!’
আয়েশা সুলতানা গরম চোখে রেবু বুয়ার দিকে একটু তাকিয়ে থাকলেন। তারপর আবার আকাশের দিকে তাকালেন। চাঁদটা একটু সরে গেছে। একটু পরে চারতলা বিল্ডিংয়ের আড়ালে ঢেকে যাবে চাঁদটা। আবছা আলোটা ছাড়া চাঁদের অস্তিত্ব আর দেখতে পাবেন না আয়েশা সুলতানা। রেবু বুয়ার বেরসিক বক্তব্যে চাঁদটা আড়াল হওয়ার আগেই তার রূপ উপভোগ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন আয়েশা সুলতানা।
খুব খারাপ লাগছে আয়েশা সুলতানার। বাসায় বেরসিক মূর্খ রেবু বুয়া ছাড়া আর কেউ নেই কথা বলার মতো। এমন পূর্ণিমা রাতে ছাদে বসে একটু খোশ গল্প করতে খুব ইচ্ছে করে আয়েশা সুলতানার, ইচ্ছে করে জোছনার কবিতা আবৃত্তি করতে, মিষ্টি কোনো গান শুনতে। এই ইচ্ছেগুলো আয়েশা সুলতানার কাছে এখন সুদূরের কোনো কল্পনা!
আয়েশা সুলতানার ছেলেমেয়েরা বছরে দুই ঈদের বাইরে দুই-একবারের বেশি আসে না। যখন তারা আসে, ছেলে-মেয়ে-বউ-জামাই-নাতি-নাতনিদের কোলাহলে মেতে থাকে বাসা, তাঁর নিঃসঙ্গ হৃদয় ভূমিতে নামে পূর্ণ চাঁদের জোছনা। পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদটা যেমন তার মৃদু আলোকচ্ছটায় পৃথিবীর রুক্ষ ভূমিতে কোমল আবেশ ছড়ায়, তেমনি নাতি-নাতনিদের হাসি-ছুটোছুটি আয়েশা সুলতানার মৃত প্রায় হৃদয় নগরে প্রাণের অস্তিত্ব জাগায়।
কিন্তু কতক্ষণ! পৃথিবীর পূর্ণিমা যেমন দেখতে দেখতে মিলিয়ে যায়, তেমন আয়েশা সুলতানার হৃদয় নগরেও দেখতে দেখতেই তার রেশ মিলিয়ে যায়। আকাশে তবু তো কিছুদিনের ভেতরেই আবার পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদটা ফিরে আসে, আয়েশা সুলতানার চাঁদগুলো কবে আবার ফিরবে তার প্রতিক্ষা কেবলই শূণ্যতা বাড়ায়।
আসার পর থেকেই ছেলেমেয়েদের যাওয়ার তাড়া। ভীষণ ব্যস্ত তারা, বহু কাজ ফেলে রেখে আসে, মায়ের কাছে পড়ে থাকলে চলবে! কাজগুলো সময়মতো না করলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। মায়ের কাছে একটু কম থাকলে এমন কী ক্ষতি! মা তো আর হারিয়ে যাবে না, থাকবেই, চাইলেই আসা যাবে!
হারিয়ে যাবে না! কয়দিন থাকবে মা! এই বয়সের একটা মানুষ আর কয়দিন পৃথিবীতে থাকার অধিকার রাখে! আয়েশা সুলতানার তো মাঝে মধ্যেই মনে হয়—আজই তাঁর শেষদিন! আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু কিংবা একদিন তো ঠিকই তাঁর শেষদিন চলে আসবে!
অবুঝ ছেলেমেয়েদের অবহেলার পরও আয়েশা সুলতানা নিয়ত চেয়ে থাকেন ছেলেমেয়েদের একটু ছোঁয়া পাবার আকাঙ্খায়, চেয়ে থাকেন নিঃসঙ্গ-নিস্তব্ধ জীবনটার শেষদিনের প্রতীক্ষায়।
‘দোহাই লাগে খালাম্মা, একটু বসেন।’
চাঁদটা আর দেখা যাচ্ছে না, চারতলা বিল্ডিংয়ের আড়ালে পুরোটাই ঢেকে গেছে। কিন্তু তার কিরণ রশ্মিগুলোর আভা এখনো বোঝা যাচ্ছে চারতলা বিল্ডিং দুইটার মাঝের ফাঁক দিয়ে দূরের গাছপালার মাথার উপরে রাতের কালো আকাশে।
রেবু বুয়ার এগিয়ে দেয়া চেয়ারে বসলেন আয়েশা সুলতানা। রেবু বুয়া মেঝেতে বসে তাঁর পা টিপতে লাগলো।
সারাদিন শুয়ে-বসে খাওয়া-ঘুমানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আয়েশা সুলতানার। একটু কিছু করতে গেলেই রেবু বুয়া আর্তনাদ শুরু করে দেয়, ‘হায়! হায়! খালাম্মা, কী করেন! বাতের বেদনা উইঠা যাইবো তো! ভাইজান-আপুরা জানতে পারলে আমারে মাইরা ফ্যালাইবো!’
কথায় কথায় ‘ভাইজান-আপুরা জানলে মাইরা ফ্যালাইবো’ আর্তনাদটা শুনতে খুব বিরক্ত লাগে আয়েশা সুলতানার। মায়ের প্রতি যদি ওদের এতোই দরদ, একটা দিন মায়ের পাশে বসে একটু সময় গল্প করে কাটায় না কেনো! মায়ের চেহারাটা দেখতে, নিজেদেরটা দেখাতে একটিবার আসে না কেনো! এমন দরদের নিকুচি করেন আয়েশা সুলতানা!
পা টিপতে টিপতে একবার আয়েশা সুলতানার পায়ে একটু ঝাঁকি দিয়ে রেবু বুয়া বললো, ‘আচ্ছা খালাম্মা, আপনে সারাক্ষণ এ রকম মনমরা হয়ে থাকেন ক্যান? পোলা মাইয়ারা একগাদা টেকা পাঠায়, এতো এতো জিনিস দেয়, মোবাইলে দুইদিন-একদিন পর পর খোঁজ খবর নেয়— আপনের তো ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুইলা আনন্দে দিন কাটানোর কথা!’
মূর্খ রেবু বুয়াকে আয়েশা সুলতানা কী করে বোঝাবেন, ছেলেমেয়েদের টাকা-পয়সায় তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা হিসেবে পেনশন এবং দুইতলা বাড়ির নিচতলার ভাড়া বাবদ যে টাকা পান তাতেই তাঁর দিব্যি চলে যাবার কথা। ছেলেমেয়েদের পাশে থাকা, তাদের একটু ছোঁয়ার জন্য আয়েশা সুলতানার যে আকুতি দরিদ্র মূর্খ রেবু বুয়াকে তা কীভাবে বোঝাবেন তিনি!
আসলে যার যেটার অভাব, সেটাই তার কাছে অমূল্য। রেবু বুয়ার টাকার অভাব—টাকা তার কাছে অমূল্য, সন্তানদের ছোঁয়া তুচ্ছ। আয়েশা সুলতানার টাকার অভাব নেই— তাঁর কাছে টাকা তুচ্ছ, সন্তানদের ছোঁয়া অমূল্য। এমন আপেক্ষিকতার কারণে আয়েশা সুলতানা মনের কোনো কথা রেবু বুয়ার সাথে বিনিময় করে স্বস্তি পান না।
আয়েশা সুলতানা তাই রেবু বুয়ার কথার কোনো জবাব দিলেন না। নির্বাক চেয়ে থাকলেন চারতলা বিল্ডিং দুইটার মাঝের ফাঁক দিয়ে দূরের গাছপালার মাথার উপর রাতের কালো আকাশে, যে আকাশের পূর্ণ চাঁদটার কোমল আলোর ছোঁয়ায় আয়েশা সুলতানার শরীরে শীতল অনুভূতি ছড়িয়ে যাচ্ছে, শিরশির করে উঠছে তাঁর শরীর।
এমনি করেই তাঁর নিত্য চেয়ে থাকা। চেয়ে থাকা তাঁর সেই দিনের প্রতীক্ষায়, যে দিন ছেলেমেয়েরা কাছে এসে তাঁকে একটু ছুঁয়ে দেবে, শরীর তাঁর শিরশির করে উঠবে…