সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
একটি চিঠিপত্রের সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে, আমাকে লেখা বিভিন্ন সময়ে অনেকের লেখা চিঠি। তাতে ছাপা হচ্ছে সমীর রায়চৌধুরীরর কয়েকটি চিঠি। আমার স্মৃতিশক্তি ইদানীং দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, ঐ চিঠিগুলির বিষয়বস্তু আমার মনে ছিল না। সেই সব চিঠিতে বিধৃত হয়েছে হাংরি জেনারেশান গড়ার ইতিহাস আর কৃত্তিবাসের সঙ্গে সমীর রায়চৌধুরীর সম্পর্ক। আমার মনে পড়ে গেল, এক সময় আমি কৃত্তিবাস নিয়ে বেশ সংকটে পড়েছিলাম। আমার পাশে আর কেউ ছিল না। কৃত্তিবাস একেবারেই বন্ধ করে দেবার কথা চিন্তা করেছিলাম। তখন আমার পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল সমীর। সে আমাকে বুঝিয়েছিল যে কিছুতেই কৃত্তিবাস বন্ধ করা যাবে না। সে সবরকম সাহায্য করতেই প্রস্তুত, এমন কি টাকা-পয়সা দিয়েও।
সমীর অন্য অনেক সময়েও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। একই কলেজে পড়ার সুবাদে বন্ধুত্ব, যদিও আমাদের বিষয় ছিল আলাদা। সমীরের জীববিজ্ঞান আর আমার অর্থনীতি। কলেজে তো অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়, কিন্তু কারুর কারুর সঙ্গে সে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে ওঠে। গ্র্যাজুয়েশানের পর সমীর বেশ তাড়াতাড়ি চাকরি পেয়েছিল। আমি বেশ কয়েক বছর বেকার অবস্থায় টিউশানি-মিউশানি করে কাটিয়েছি। সেই সময় সমীর কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। হাংরি জেনারেশানের সঙ্গে কৃত্তিবাসের খানিকটা টানাপোড়েন তো ছিলই, সমীর সেটা মেলাবার অনেক চেষ্টা করেছে। ওর ছোটভাই মলয় রায়চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেফতার করে মামলা দায়ের করে, তাতে, হাংরি জেনারেশানের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও মলয়ের পক্ষে প্রথম সাক্ষী দিয়েছিলাম আমি।
বিহারে চাকরিরত হলেও সমীর কলকাতা থেকে একটি প্রকাশনা সংস্থা চালু করতে চেয়েছিল। তার প্রথম বই, আমার ‘একা এবং কয়েকজন’। তখন আমাকে কবি হিসেবে ক’জনই বা চেনে! তবু আমার কবিতার বই প্রকাশ করায় সমীরের অনেকখানি ঔদার্য প্রকাশ পেয়েছিল। সমীরের কাব্যগ্রন্থ বেরুলো, ‘ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি’। নামটা বোধহয় আমারই দেওয়া। প্রেসেও ছোটাছুটি করেছি আমি। সে সময় সমীর চমৎকার রোমান্টিক কবিতা লিখতো। পরে তার কবিতা একটা অন্যদিকে বাঁক নেয়। ঐ সংস্থা থেকে সমীরের আরেকটি বই বেরিয়েছিল, ‘আমার ভিয়েৎনাম’। পরে সেই প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
লেখালেখি ছাড়াও সমীরের সঙ্গে আমার একটা গভীর নৈকট্যের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়, যে-সম্পর্কের মধ্যে কখনো ভুল বোঝাবুঝির প্রশ্ন থাকে না। আমি জানতাম এই দীর্ঘকায়, সুঠাম চেহারার বন্ধুটির ওপর সব সময় নির্ভর করা যায়। আমার দিক থেকে ওকে কখন কী সাহায্য করেছি, তা বলতে পারি না। চাকরি সূত্রে সমীর যখন যেখানে বদলি হয়েছে, আমি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়েছি। যেমন, ডালটনগঞ্জ, দ্বারভাঙ্গা, চাইবাসা এবং ওদের নিজস্ব বাড়ি পাটনায়। সেই সময়কার আড্ডার উজ্জ্বল, মধুর স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। বিয়ের সময় সমীর বেশ একটা কৌতুক করেছিল। আমরা জানতাম, চাইবাসার বেলার সঙ্গেই ওর ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু সমীর রটিয়ে দিল, ও অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করছে। খুবই উদ্বিগ্ন অবস্থায় আমরা কয়েকজন বিবাহ-বাসরে যোগ দিতে গেলাম চাইবাসায়। সমীরকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে মুচকি মুচকি হাসে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে নববধূর মুখ দেখে আমার বুক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। লাবণ্যময়ী বেলা পরে সমীরের সব বন্ধুকেই আপন করে নিয়েছিল। স্বাতীর সঙ্গে আমার বিয়ের উপলক্ষেও সমীর আর বেলা দু’জনে এসে উপস্থিত হয়েছিল আমাদের দমদমের বাড়িতে। বউভাতের রাতে নববধূকে যে কিছু একটা উপহার দিতে হয়, সেটা আমার জানা ছিল না। জানবো কী করে, আমি যে কাঠ কাঙাল! সমীরই প্রায় শেষ মুহূর্তে সেই কথাটা মনে করিয়ে দেওয়ায় দু’জনে বেরিয়ে কিনে আনলাম একটা লেডিজ ঘড়ি, খুব সম্ভবত সমীরই সেটার দাম দিয়েছিল। তারপর দুই পরিবারের একটা ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়।
সমীরের সঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় প্রথমে আমিই করিয়ে দিই। তারপর শক্তি-সমীরের চাইবাসা পর্ব নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। বিহারে থাকলেও সমীর মাঝে মাঝেই কলকাতায় এসে অন্য সব লেখকদের সঙ্গেই পরিচিত হয়ে ওঠে।
হাংরি জেনারেশান আন্দোলন শুরু হবার পর ওদের সঙ্গে আমার খানিকটা দূরত্ব তৈরি হয়। আমার আনন্দবাজারে যোগ দেওয়া ও কবিতা ছাড়াও প্রচুর গদ্য লেখালেখি ওরা অনেকেই পছন্দ করেনি, শুনেছি। সেটা তো এস্টাব্লিশমেন্টের খপ্পরে পড়া, এবং কথাটা ঠিকই। কয়েক বছর পর শক্তিও অবশ্য আনন্দবাজার সংস্থায় যোগ দিল।
রাজনীতির মতন সাহিত্য জগতেও নীতিগত আপত্তি ও দূরত্ব তো থাকতেই পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে সেই দূরত্ব সৃষ্টি করার পক্ষপাতী আমি কোনো দিনই নই। হাংরি জেনারেশান পর্ব চুকে গেলে শক্তির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতায় সাময়িক সামান্য ফাটল খুব সহজেই জোড়া লেগে যায়। যেমন সন্দীপনেরও। কিন্তু কেউ কেউ দূরত্বটাই পছন্দ করে। সমীরের সঙ্গে বিচ্ছেদটাই আমার বেশি মনে লাগে। সমীরের লেখা, সাহিত্য সম্পর্কে ওর নানারকম পরিকল্পনা আমার বরাবরই পছন্দ ছিল। সবচেয়ে বেশি আপন মনে করতাম মানুষ সমীরকে।
জীবন কত নিষ্ঠুর! জীবনের গতি কোন সময় কোন বাঁক নেবে, তা আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। এক সময়কার সেই প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, আড্ডা, পানাহার, পরস্পরের স্বপ্ন বিনিময়, এসবই কখন যেন ধূসর হয়ে যায়। বিহার ছেড়ে সমীর এখন কলকাতারই উপকণ্ঠে বাড়ি করে সপরিবারে চলে এসেছে। অথচ ওর সঙ্গে আমার আর প্রায় দেখাই হয় না! কেন কে জানে! হয়তো আমার দিক থেকেই অনেক ত্রুটি আছে।
একটা সাম্প্রতিক ঘটনা বলি। চোখের চিকিৎসার ব্যাপারে স্বাতী আর আমি গেছি একটা চিকিৎসালয়ে। বেশ ভিড়। তারই মধ্যে স্বাতী আঙুল দেখিয়ে বলল, ঐ খানে সমীর বসে আছে না? কাছে গিয়ে দেখি, সত্যিই সমীর আর বেলা। কুশল বিনিময় হলো। ছেলে-মেয়েদের কথা হলো। একসময় আমি সমীরকে বললাম, কানাইলাল জানার বাড়িতে যে একটা উৎসব হলো ক’দিন আগে, শুনেছিলাম, তোরও সেখানে যাবার কথা ছিল। তুই গেলি না কেন, তোর বাড়ির তো কাছেই!
সমীর আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললো, আমি যাইনি, যদি তুই সেখানে আমাকে চিনতে না পারিস?
আমার বুকে যেন একটা বুলেট বিদ্ধ হলো। এ রকম নিষ্ঠুর কথা আমি বহুদিন শুনিনি। যে বন্ধুর সঙ্গে আমার তুই-তুই সম্পর্ক, যার সঙ্গে আমার কখনো ঝগড়াঝাঁটি হয়নি, কোনোদিন তিক্ততার সৃষ্টি হয়নি, তার সঙ্গে দেখা হলে আমি চিনতে পারবো না? এমন অভিযোগ শোনার জন্য কী দোষ বা অন্যায় করেছি আমি, তা জানি না। এরপর কয়েকদিন বেশ বিমর্ষ হয়ে ছিলাম। মনে হলো, জীবনের কাছ থেকে এরকম আকস্মিক আঘাত আরও কত পেতে হবে কে জানে!
হয়তো সমীরও কোনো গভীর অভিমানবোধ থেকে এই কথা বলেছিল। আমি নিজেই নিশ্চয়ই সে-রকম কোনও কারণ ঘটিয়েছি, কিন্তু তার বিন্দু-বিসর্গও আমার জানা নেই।
ছবির বর্ণনা:
১। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২। কলকাতায় বাড়িতে স্ত্রীর সাথে কবি সমীর রায়চৌধুরী
কাব্য পৃথিবীর শব্দ, দৃশ্য, স্পর্শ পেলাম। কবি জীবনের ঘটনাও কাব্যময়।
valo laglo, khub
I enjoyed the description but expecting to read on but could not find the link. Anyway, the initiative is great and to have such reputed writers contributing is a welcoming breeze for the development of literature.
bondhutter bondhon boie berak biramhin.