মুম রহমান
মৃত্যু
মৃত্যুর চারদিন আগে থেকেই মা কথা বলতে পারতেন না। আমি দেখেছি তার নির্বাক চোখের চাহনি। মৃত্যু পথযাত্রী সব রুগীদের চোখে আমি সেই চাউনি দেখতে পাই। তবু আমি রুগীদের সাথে দূরত্ব বজায় রাখি। এরপরও অনেক রুগী সুস্থ হয়ে দেখা করতে আসে। রুগীর আত্মীয়স্বজনের সাথেও দেখা হয়ে যায় প্রায়ই।
কিন্তু এই কবরস্থানেও দেখা হবে এক রুগীর বাবার সঙ্গে তা ভাবিনি।
দুদিন আগে সে এসেছিলো। তার সঙ্গে ফুটফুটে একটি মেয়ে। তিন-চার বছর বয়স। লোকটি খুব কাঁদছিলো, ডাক্তার সাহেব আমার একটিই মেয়ে। অসহায় লোকটি পারলে আমার পা জড়িয়ে ধরে। আপনি আমার মেয়েকে বাঁচান।
আমি তাকে ধমক দিয়ে ওয়ার্ড থেকে বের করে দিয়েছিলাম। মেয়েটি কিন্তু একটাও কথা বলেনি। আমি জানি, তার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। সে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। আমার মায়ের সেই চাউনির মতো।
আমি মেয়েটিকে ফেরত পাঠিয়ে ছিলাম, খামাখা হাসপাতালে রেখে কী লাভ, একটা বেডের অপচয়।
এখন এখানে তাকে দেখে বুঝতে পারি, মেয়েটি মারা গেছে। আমি লোকটির কাছে যাই। হাত রাখি তার পিঠে। আপনার মেয়েটি মারা গেছে, তাই না?
সে নিরুত্তর।
আমার মাও মারা গেছে, তিন বছর আগে। আমার ডাক্তার হওয়ার একমাস আগেই।
সে নিরুত্তর।
আচ্ছা মানুষ মরে কেন?
এইবার সে চোখ তুলে তাকায়, নির্বাক চোখ। আমি আঁতকে উঠি। লোকটার চোখে, সেই চাহনি যা তার মেয়ের চোখে ছিলো, যা আমার মা’র চোখে ছিলো।
বুড়ো ও মৃত্যুদূত
এক হাড় জিরজিরে বুড়ো ছিলো। বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বুড়োর দিন চলতো।
বুড়োটা একদিন এক বাড়ির উঠোনে গিয়ে হাঁক দেয়, বাবাগো, মাগো, দুইটা ভিক্ষা দেন।
বাড়িতে তখন কেউ ছিলো না। খালি বাড়িতে মৃত্যুদূত এসে বসেছিলো। বুড়োর হাঁক শুনে মৃত্যুদূত বেরিয়ে এলো।
কে রে?
আমি হাড় জিরজিরে বুড়ো, আমারে গায়ের সব্বাই চেনে, তুমি চেনো না!
চিনিরে, তোকে ভাল করেই চিনি, প্রথমে বুঝতে পারিনি।
ও, তা তুমি কে বাপু?
আমি মৃত্যুদূত।
কে?
ঘাবড়াসনে বুড়ো, আমি মৃত্যুদূত।
ঘাবড়াবো কেন, আমি কি মরণকে ভয় পাই, তিনকুল গিয়ে চারকুলে ঠেকলো এখন আর মৃত্যুদূতকে ভয় কিসের!
তা ঠিক।
তো তুমি এখানে কী করতে এসেছো?
আমার যা কাজ!
কার জান নেবে তুমি?
এ বাড়ির বড় ছেলের। সেই জন্য অপেক্ষা করছি।
আহা, ছেলেটা নতুন বিয়ে করেছে, ওর জান নিয়ো না এখনি।
চুপ থাক বুড়ো, যেটা বুঝিস না সেটায় নাক গলাবি না।
তুমি বরং আমার জান নাও, আমার তো আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।
তোর জান নিয়ে কী লাভ, তুই তো এমনিতেই ঘাটের মরা।
খবরদার, ঘাটের মরা বলবি না বলে দিচ্ছি!
এই বুড়ো, এই, তুই আমাকে ভয় পাস না?!
তোকে ভয় পাওয়ার কী আছে? সবাই তো মরবে তাহলে মরণকে ভয় কিসের!
তবে জেনে রাখ বুড়ো, একদিন তুইও মরণকে ভয় পাবি, আর যেদিন ভয় পাবি সেদিনই আমি আসবো বলে রাখলাম।
কবি
লোকটা কোনো পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়নি। সেই নিয়ে লোকটার মনে কোন দুঃখ নেই। দুঃখ আছে তার আশেপাশের লোকদের। সে তাদের দুঃখ বুঝলে কিছু করতে পারে না। সবাই কি আর সফল মানুষ হয়! তবু শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের কী কৃপা, একটা জলজ্যান্ত মেয়ে লোকটাকে ভালোবেসে ফেললো। যদিও তার না আছে চেহারা-ছিরি, না আছে কোন গুণ-ধন!
মেয়েটি বলে ও একজন কবি, কত ভাবনাই না ওর মগজে ঘোরে।
লোকটা তো অবাক!
কবিতা, আমি তো কবিতা লিখতে পারি না! হ্যাঁ, এইটা ঠিক সারাদিন রাত আমি শুধু ভাবি, কি হলে কী হতো, কি না হলে কী হতো এই সব হাবিজাবি ভাবি, তা ভাবনাকে কেউ কবিতা বলে!
মেয়েটি কিন্তু ওইসব শোনে না। সে বলে, দেখো যা ভাবনায় আসে তাই লেখো।
কী আর করা। লোকটা কবিতা লিখতে লাগল। কিন্তু কবিতা তো ছাপাতে হবে। খুব ভয়, দ্বিধা নিয়ে সে গেল কাগজগুলোতে। সম্পাদক তাকে বলে, এইখানে তো চন্দ্রবিন্দু দিতে হবে, লোকটা মাথা নিচু করে থাকে। সম্পাদক বলে, এই ভাষায় তো কবিতা লেখা ঠিক না, লোকটা লজ্জা পায়। সম্পাদক বলে, ছন্দ কোথায়, লোকটা ফিরে আসে।
মেয়েটি খুব বিরক্ত হয়, ধুর, তুমি আসলেই একটা অপদার্থ, একটা কবিতাও ছাপাতে পারলে না!
লোকটা বলে, আমি তো আসলে কবি না।
তুমি আসলে কী?
আমি কিছু না।
ঠিক আছে, আমি চললাম।
মেয়েটি চলে যায়।
লোকটি তাকিয়ে থাকে।
দুঃখবাদী কবির সাক্ষাৎকার
আচ্ছা, আপনার কোনো দুঃখ নেই?
ঈশ্বরের দুঃখ থাকে আর আমার থাকবে না!
ঈশ্বরের দুঃখ, সত্যি আপনি বড় মজার মানুষ!
সত্যি, ঈশ্বর খুব শখ করে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন।
না, জানতে চাইছিলাম, আপনার জীবনের সেরা দুঃখ কি?
কেন, সেই দুঃখকে পুরষ্কার দেবেন?
না, আপনার ভক্তরা জানতে চায়, কী কী দুঃখ আপনার।
কি হবে সে সব জেনে?
আপনাকে ওরা ভালোবাসে।
ভালোবাসে!
জ্বী।
বেশ, কিন্তু আমি তো আমার দুঃখ দেখাতে পারবো না। আমি তো দুঃখের ছবি তুলে রাখিনি।
আপনি কি জানেন, আপনি কথা বললেই কবিতা হয়ে যায়?
কি কবিতা হবে আর কি কবিতা হবে না সে তো আপনারা জানেন।
আপনি কি সমোলোচকদের কথা বলছেন?
না, আমি পাঠকের কথা বলছি, পাঠক যাকে কবিতা বলবে তা-ই কবিতা।
পাঠক তো সবাই।
ঠিক আছে, কথা হচ্ছিল দুঃখ নিয়ে।
দুঃখ যদি ছবি হতো, ফটোগ্রাফার হতাম আমি, আমি আপনাকে দেখাতে পারতাম তার কালার, কম্পোজিশন।
কিন্তু আপনি তো কবি, আপনার কবিতাতেই আপনি দুঃখ তুলে ধরেছেন।
তাহলে এতো প্রশ্ন কেন?
আপনার মুখ থেকে জানতে চাই, মানে পাঠকের প্রশ্ন, কী এমন দুঃখ আপনার যার জন্য আপনার সব কবিতাই জলে ভেজা?
মুখের কথা তো কবিতার চেয়ে সত্যি নয়।
তা নয়, তবে কবিতায় তো সব কেমন সাজিয়ে গুছিয়ে বলা হয়।
ঈশ্বরও তো সাজিয়ে গুছিয়ে সব সৃষ্টি করেছেন।
আপনি খুব ঈশ্বর মানেন?
ঈশ্বর দুঃখের মতোই মহান।
ছোটগল্প
প্রেম আসেনি কখনও আমাদের বাড়িতে। প্রেমের ছোট বোন এসেছিলো আজ অফিসে। হাত ধরে বইমেলা নিয়ে গেল [এসবই জয় গোস্বামী জানে], বইমেলা নিয়ে গেল ছোট বোন। বলে, পছন্দ করুন দেখি দুটো কবিতার বই। না, না কবিতা নয়, আমি বেছে নেই ছোটগল্প। কবিতা নয়, ছোটগল্প হোক।
প্রেমের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল চিঠিতে। ব্যাপারটি ঠিক পত্রমিতালি নয়। চট্টলা গিয়েছিলাম নাটক করতে। সেখানেই নাটকের মেয়ে প্রেমের সাথে দেখা। ফিরে এসে চিঠিতে ধন্যবাদ। সে বয়সে কখনো নিজেকে পত্রী’র শুভংকর, কখনো গুহ’র রাজর্ষি মনে হয়। প্রেম কিন্তু অনেক প্র্যাকটিকাল। ভাঙে কিন্তু মচকায় না কিছুতেই। শুধু চিঠি নয়, মাঝে মাঝে উপহারও আসে কুরিয়ারে। জন্মদিন, ভ্যালেন্টাইন ডে-তে বোনাস হিসাবে পাওয়া যায় টেলিফোন।
কিন্তু কবিতা নয়, প্রেম শুনতে চায় ছোটগল্প। কি করি আমি, কতটাকা বেতন, বাড়িটা নিজেদের কিনা, এর আগে কোন মেয়ের সঙ্গে ইয়ে হয়েছে কিনা– প্রেমের প্রশ্ন এসব গদ্য জুড়েই।
একদিন চিঠি দেয় প্রেমের ছোট বোন– কি, ছোট বলে আমাকে এত অবহেলা, কেন একটাও চিঠি দিন না আমাকে, আপনি ভীষণ… জান, বলবো না ছাই! শুনুুন, সামনেই আসছি ঢাকাতে এসেই করব টেলিফোন, তখন দেখি কী করে এড়ান আমাকে!
এড়াতে চাইনা মোটেও, কেন এড়াবো! কী আমার মেয়ে ওইটুকু মিহিদানা! এসেছো যখন ব্যাস চল বইমেলা। হাত ধরো, মেলায় অনেক ভিড়। তারপর বল কেমন আছে প্রেম?
না, না, কবিতা নয়, ছোটগল্পই নেব আজ।