মীজান রহমান
আমার দীর্ঘ প্রবাসজীবন প্রায় সমাপ্তির পথে। অনেকদিন থেকেই বলে আসছি বেলা পড়ে এল। এবার বোধ হয় সত্যি সত্যি পড়ে আসবে।
কিন্তু তারপর?
তার আর পর কি। কিছুই না। পৃথিবী যেমন আছে ঠিক তেমনই থাকবে। তিলমাত্র নড়বে না কোনদিকে।
নিজেকে দারুণ গুরুত্ব দিতাম একসময়। এখন বুঝি নিজেকে যারা বেশি গুরুত্ব দেয়, সংসারে আর কেউ তাদের বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেয় না। বরং হাসে। যেমন আমি হাসি আজকে। নিজেকে নিয়েই। নিজের গুরুত্বহীনতা নিয়ে। নিজের মূর্খতা ও মূঢ়তা নিয়ে হাসতে পারার নামই আত্মজ্ঞান, আমার মতে।
লোকে আমার জীবনকথা জানতে চায়। আমাকে তারা দেখে সফল প্রবাসী রূপে। ‘সফল’ প্রবাসী কাকে বলে? যে সফলভাবে নির্মূল? সফলভাবে বাড়ির মর্টগেজ চুকে দিয়েছে? যার ছেলেমেয়েরা একশব্দ বাংলা বলতে পারেনা? যে তার ঠিকানা ভুলে গেছে বলে গোটা বিশ্বটাকেই ঠিকানা বলে চালিয়ে দেয়?
প্রবাসজীবনের তিনটে প্রধান অধ্যায়, আমার বিবেচনায়। প্রথমটিকে আমি বলি দিবাস্বপ্ন, দ্বিতীয়টি নিশাস্বপ্ন, শেষেরটি দুঃস্বপ্ন। বা ব্যর্থস্বপ্ন। মোটমাট পুরোটাই একটা স্বপ্নের ঘোর। একপ্রকারের বিমোহিত নৈশভ্রমণ। ইংরেজিতে sleepwalk. দুঃস্বপ্নের পর্যায়ে এসে অনেকে আবার নতুন স্বপ্নের আয়োজনে মেতে যায়—পরলোকের স্বপ্ন। পরলোকেও একটা রঙিন দেশ আছে, তার স্বপ্ন। অনেকের স্বপ্ন অমরত্বের। তারা বই লেখে। সে বই নিয়ে একুশের বইমেলাতে যায় প্রতিবছর। তারা বইয়ের মলাটে ছবি ছাপিয়ে অমর হয়। প্রবাসে এসে প্রথমদিকে আমরা পথ হারিয়ে ফেলি। বহু সাধ্যসাধনা করে যদিবা ফিরে পাই একসময়, হঠাৎ করে তাও উধাও হয়ে যায় একদিন। তারপর আমরা চোখ থেকেও অন্ধ।
পৃথিবীর সবচেয়ে নির্বোধ প্রশ্ন কি? ‘আমি কে’। আরে বোকা, ঢাকা শহরের যে কোন বলদও জানে তার উত্তর। ‘আমি’ কেউ নই। আমি একটা বেওয়ারিশ মানুষ। আমার নাম মিস্টার নোবডি। নাকি বলব ডক্টর নোবডি? একটা পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পেয়েছিলাম একদা, যেন কেউ ভুলে না যায় সেটা। যত সস্তাই হোক সে ডিগ্রি।(কমবেশি সব ডিগ্রিই সস্তা। সে কারণেই একটা দুমড়ানো কাগজ ছাড়া তার কোন দাম থাকে না শেষমেশ।)
লোকে বলে, আপনার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখুন। ঠিক আছে, লিখলাম। আপনি টাকা দিয়ে কিনবেন আমার বই? না, কিনবেন না। কেউ উপহার দিলে পড়বেন? না, পড়বেন না। আমার বই পড়ার সময় আপনার নেই। আমার বই না পড়ে চ্যানেল আইতে একটা ভাল নাটক দেখা অনেক ভাল। মাঝখান থেকে আমার এককাড়ি টাকা খরচ হবে বই ছাপতে। উদ্ভিদজগতের অনেকগুলো বৃক্ষের হবে অযথা অপচয়। তাছাড়া আমার লিখবার আছেই বা কি? অভিজ্ঞতার কথা বলছেন বুঝলাম, কিন্তু কি অভিজ্ঞতা? কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে শিখলাম, টয়লেটের ফ্লাশ টিপতে শিখলাম, মেয়েদের জন্যে দরজা খুলে রাখতে শিখলাম, এই তো? দু’চারটে ইংরেজি শব্দ শিখতে হয়েছে নেহাত্ জীবনরক্ষার খাতিরে। থ্যাঙ্ক ইউ। ইউ আর ওয়েলকাম। প্লিজ। ডু ইউ হ্যাভ হালাল মিট? কোরিয়াণ্ডার লিভস? গ্রিন চিলিজ? আমরা যেযুগে এসেছিলাম এদেশে সেযুগে এসব না শিখলে বড্ড অসুবিধে হত। এখন এসব কিছুই লাগে না। হালাল মিটের জন্যে পাকিস্তানী বা সোমালি দোকানেও যেতে হয় না, আই জি এ বা লব্লতে গেলেই পাওয়া যায়। কোরিয়াণ্ডার লিভস আর গ্রিন চিলি পাওয়া যায় ফার্মবয় আর প্রডিউস ডিপোতে। সমুসা আপনি কর্ণার স্টোরেই কিনতে পাবেন আজকাল। কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়া? আমেরিকানরাই খায় না আজকাল, আপনাকে খেতে হবে কেন? ডাল আর মাছের ঝোল কাঁটা দিয়ে খান কেমন করে দেখি। এমনকি টয়লেটও ফ্লাশ করতে হয় না বর্তমান যুগে, আপনাআপনিই ফ্লাশ হয়ে যায় কর্মসিদ্ধির পর। আর মেয়েদের জন্যে দরজা খোলারই বা কি দরকার? আজকালকার দরজাও তো সেই ফ্লাশেরই মত, নিজে নিজেই ফাঁক হয়, আবার নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যায়। তাছাড়া আপনি-আমি যে পাড়ায় থাকি সে পাড়ায় তো আমাদের দেশি ভাইবোনেরা ছাড়া কেউ থাকেও না। আমাদের মাবোনদের জন্যে আমরা কি দেশে থাকাকালে কখনও দরজা খুলে রেখেছি? নাকি আমাদের বাপদাদারা রেখেছে? তাহলে এখানে রাখতে হবে কেন? পরের দেশে এসেছি বলে পরের মত সবকিছু করতে হবে নাকি? করতে গেলে আমাদের মেয়েরাই ভ্যাবাচাকা খেয়ে যাবে দেখবেন। এদেশের সাদা মেয়েদের জন্যে করতে হয় কারণ তারা বড় বড় নখ রাখে। দরজা খুলতে গেলে ওদের নখ ভেঙ্গে যেতে পারে, সেজন্যে পুরুষেরা খাতির করে ওদের জন্যে দরজা ধরে রাখে। তাছাড়া জানেনই তো, এদেশে সবকিছুতেই একটু বাড়াবাড়ি।
আমাদের বাংলা ডিকশনারিতে সবচেয়ে কঠিন শব্দ কি? ধন্যবাদ। উচ্চারণ করতে দাঁত ভাঙ্গে। উচ্চারণ করার পর দ্বিধায় ভুগি শব্দটা একটু হিন্দু হিন্দু শোনালো কিনা। আশ্চর্য যে হিন্দুরাও বেশি ব্যবহার করেনা শব্দটি। সিনেমার নায়কনায়িকারা করে মাঝে মাঝে। গল্পউপন্যাসেও দেখা যায় এর ব্যবহার। কিন্তু বাস্তব জীবনে? আমাদের পূর্বপুরুষরা করেননি, তাঁদের পূর্বপুরুষরাও না। অর্থাৎ ‘ধন্যবাদ’ আমাদের কালচার বহির্ভূত শব্দ। আইডিয়াটা এসেছে পশ্চিম থেকে। তাই ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি অনেক সহজ হয় যখন সেটা ইংরেজিতে বলা হয়—থ্যাঙ্ক ইউ। তাতে হিন্দু হবার ভয় নেই। শরিয়া লঙ্ঘনের ভয় নেই। কালচারকে অসম্মান করার ভয় নেই। পশ্চিমমাফিক ভদ্রতা পালন করা, ব্যস। অর্থাৎ ভদ্র হওয়া, আধুনিক হওয়া। ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ না বলতে পারলে কি চীন আর ভারতের আউটসোর্সিং কোম্পানিগুলোর কোনও উপায় ছিল?
কাঠিন্যের মাত্রাতে ‘ধন্যবাদে’র এককাঠি ওপরে যে শব্দটি সেটা হল ‘অনুগ্রহ করে’। ইংরেজিতে ‘প্লিজ’। ধন্যবাদ তো তবুও নাটক-উপন্যাসে থাকে, চিঠিপত্রেও থাকতে পারে, ‘অনুগ্রহ করে’ তো একেবারেই ভিন্নগ্রহের। ‘দয়া করে’ তবুও চলতে পারে, কিন্তু অনুগ্রহ? না ভাই, তার চাইতে আমাকে ‘প্লিজ’ দিন, মেনে নেব। সেটাও আমি ব্যবহার করব সাধারণত বিদেশীদের সঙ্গে, বড়জোর লেখাপড়াজানা স্বদেশীদের সঙ্গে। কিন্তু নিজের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ‘প্লিজ’ বলতে কেমন বাধে, তাই না? চাকরবাকর-ড্রাইভার-পেয়াদা-চাষীমজুরের সঙ্গে তো প্রশ্নই ওঠে না। অত নিচে আমি নামতে পারব না। ‘প্লিজ’!
আরেকটা শক্ত শব্দ হল ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’। শব্দ তো নয়, শব্দগুচ্ছ। ইংরেজিতে যাকে বলে phrase. আচ্ছা, phrase শব্দটির বাংলা জানা আছে কারো? মানে এক শব্দের বাংলা? জানা থাকলে ‘দয়া করে’ আমাকে ই-মেইল করে জানাবেন। সাহিত্যসংসদের পরিশোধিত ও পরিবর্ধিত পঞ্চম সংস্করণে এর মানে দেওয়া আছেঃ “সম্পূর্ণ বাক্য না হওয়া সত্ত্বেও একটি নির্দিষ্ট ভাববিশিষ্ট শব্দসমষ্টি”। ইংরেজি একটা শব্দের অর্থ বুঝাতে কতগুলো বাংলা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে খেয়াল করেছেন? নয়টি! সাধে কি বাঙালি জাতিকে বাচাল বলা হয়? ইংরেজি-থেকে-বাংলা শব্দকোষগুলো অত্যন্ত বিরক্তিকর মনে হয় আমার কাছে। আমি চাই এক শব্দের বাংলা, পণ্ডিতমশাই আমাকে দশটা শব্দ দিয়ে তার ভাবার্থ বুঝিয়ে দিলেন। যেন ভাবার্থটি আমার নিজেরই জানা ছিল না। আমি তো ভাবার্থ চাইনি গুরুদেব আপনার কাছ থেকে, চেয়েছিলাম একক একটি শব্দ যা নেহাত মূর্খ বলেই আমি জানিনা।
যাই হোক, এক্ষেত্রে ইংরেজি-বাংলা দুটোই শব্দসমষ্টি। এবং একটি ‘সম্পূর্ণ বাক্যও’। আমি তোমাকে ভালবাসি। I love you. বাংলাতে আবার আরেকখানা হ্যাঙ্গাম আছে। হতে পারে যে আপনার প্রেমভাবটি যাকে নিবেদন করতে যাচ্ছেন তার সঙ্গে এখনও ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে আসার সুযোগ হয়নি। তখন বলতে হবে ‘আপনাকে আমি ভালবাসি’। অপরপক্ষ থেকে অনুকূল সাড়া পেলেই আপনি ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে অবতরণ করতে পারেন। আমাদের সামাজিক আচার আচরণে একটি বহুলপ্রচলিত শব্দগুচ্ছ হলঃ ‘আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন’। অবশ্য দুটির মধ্যে কোন্টি ব্যবহার করা হচ্ছে, আপনি না তুমি, সেটা বড় সমস্যা নয়, বড় সমস্যা হল বলাটা। চিঠিপত্রে সেটা অনায়াসে বলা যায়। আগেকার দিনে পাতলা নীল কাগজের ব্যবহারই ছিল প্রধানত ঐ কারণে–‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ বলার জন্যে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা চিঠিপত্র লেখে না, ই-মেইল করে, চ্যাটরুমে চ্যাট করে, ফেইসবুকে প্রেম করে। সেটা দ্রুত, নিরাপদ ও ব্যক্তিগত। বাবার কাছে ধরা পড়ার ভয় নেই, এবং তৎক্ষণাৎ অন্যান্য মাধ্যমও ব্যবহার করা যায় অবশ্যি—সেলফোন, টেলিফোন, ব্লগ, ইউটিউব, টুইটার। ভবিষ্যতে আরো কত কি বেরুবে কে জানে। এসব যারা ব্যবহার করে তারা সাধারণত বাংলার ধার ধারে না তেমন। তাদের ভাষা একটাই—ইংরেজি। The global language of the global village! তারা বলবেঃ love you. না, ঠিক তা’ও নয়। বলবেঃ i lo’ u. মাঝখানে কষ্ট করে পুরো শব্দটি না লিখে হয়ত একটা হার্ট এঁকে দেবে, ব্যস, হয়ে গেল। তবে এ হল টিনেজদের জগত। প্রথম যৌবনের অতিরিক্ত হরমোন দ্বারা যারা নিত্য তাড়িত ও চালিত। বিয়েথা করে বাচ্চাকাচ্চা হবার পর কোন আক্কেলজ্ঞানসম্পন্ন বাঙ্গালি পরিবারে ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ জাতীয় বাক্য উচ্চারণ হতে শুনেছেন? আমাদের কালচারে আসলে এর কোন জায়গা নেই। আপনার বাবামাকে কখনো শুনেছেন পরস্পরকে ‘I love you’ বলতে? বা আমাদের ছেলেমেয়েরা শুনেছে আমাদের মুখে? বিয়েবার্ষিকীতে সাধারণত কি করি আমরা? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বামীদের মনেই থাকেনা দিনটা। থাকলেও ‘পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ’ হয়ে যাবার ভয়ে কোন উপহার কেনা হয়না, মোমবাতি জ্বালিয়ে দুটিতে মিলে নৈশভোজন হয়না। যা আমরা করি সচরাচর, বিশেষ করে প্রবাসে, তা হল গুটিকয়েক বাঙ্গালি পরিবার মিলে ঘটা করে খানাপিনার ব্যবস্থা করি। আজকাল অবশ্য একটু বদলাতে শুরু করেছি আমরা। স্বামীরা ফুল কিনছেন। এমনকি ঢাকাতেও। Globalization এর অন্তত একটা সুফল থাকতে হবে তো।
পশ্চিমে এসে পূর্বাঞ্চলের যুবকরা, অবিবাহিত ছাত্র, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, দূতাবাসের কর্মচারি, অথবা বিবাহিত-কিন্তু-স্ত্রী-সঙ্গে-নেই, এরা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে কি নিয়ে জানেন? সেক্স। SEX. পশ্চিমের sex প্রকাশ্য রাস্তায়, বিলবোর্ডে, গাড়িতে, বাসে, ট্রেনে, পার্কে, ময়দানে, দাঁতের মাজনে, টেলির বিজ্ঞাপনে, পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায়। বাচ্চার ডাইপারই বলুন আর কিশোরীর অন্তর্বাসই বলুন, একটা-না-একটা মেয়েলোকের হয় ঠ্যাং থাকবে, নয় অর্ধেকটা বুক। সেক্স নিয়ে তাদের কোন ঢাকাঢাকি নেই, চাপাচুপি নেই, একেবারে খোলাখুলি ব্যাপার। কিন্তু প্রাচ্যের সেক্স মস্তিষ্কে, চিন্তায়, স্বপ্নে, অপূর্ণ কামনায়। লুকোনো playboy ম্যাগাজিনে, body shop থেকে কেনা বিবিধ সামগ্রীতে, নীল সিনেমার ম্যাটিনি শোতে, এবং সন্ধ্যার পর অগোচরে ঘরে-নিয়ে-আসা বিদেশী বান্ধবীতে। দীর্ঘ প্রবাসজীবনে এর অনেকটাই আমার স্বচক্ষে দেখবার সুযোগ হয়েছে। পশ্চিমের সেক্স হলঃ পিপাসা পেয়েছে? জগ থেকে জল ঢেলে খেয়ে ফেল। প্রাচ্যের সেক্সঃ পিপাসায় মরে যাচ্ছ তুমি, তবুও কলসের ওই পরিষ্কার পানিটা খেতে বারণ তোমার জন্যে। তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে যেতে হচ্ছে ডোবার ময়লা জলের কাছে। কিম্বা তারও চেয়ে অধম কোন স্থানে।
ইদানিং একটা ভাল বই পড়লাম। White Tiger. বাংলায় কি হবে? শ্বেতশার্দুল? নাকি সাদাবাঘ? অসাধারণ বই। মাত্র ৩৪ বছর বয়স্ক লেখক অরবিন্দ আদিজা। এবং এটিই তাঁর প্রথম বই। সাড়া তুলে দিয়েছে সারা বিশ্বে। ২০০৮ সালের Man Booker Prize পাওয়া বই। ভবিষ্যতে আরো কত কি অসাধ্য সাধন করবে এই লোক কে জানে। বইটা পড়ে একটা উপকার হল আমার। নিজের সম্বন্ধে একটা পরিস্কার ধারণা সৃষ্টি হয়ে গেল। আমি আসলে লেখক নই। লেখাটা বন্ধ ছিল ৩০ বছর, সেভাবেই থাকা উচিত ছিল। মাহমুদুল হাসানের ‘মাসিক বাংলাদেশ’ যদি অটোয়া থেকে প্রকাশ না হত ‘৯০ তে তাহলে হয়ত থাকতও সেভাবে। অরবিন্দ আদিজা হলেন সত্যিকারের লেখক। আধুনিক উপন্যাস কিভাবে লিখতে হয় তিনি জানেন। তিনি আধুনিক, তরুণ, মেধাবি, তাই তিনি জানেন। আমি আধুনিক, তরুণ বা মেধাবি, কোনটাই নই। তাহলে আমি আধুনিক উপন্যাস লিখব কেমন করে? আদিজার বই এমনই এক উপন্যাস যাতে কোন নায়িকা নেই। সত্যিকার অর্থে কোন নায়কও নেই। প্রধান চরিত্র দুটি। মোটাপেটের ভারত ও খালিপেটের ভারত। এমন একটা দুরূহ বিষয় নিয়ে ৩০০ পাতার বই লিখে ফেলা, যা পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না, ভেবে দেখুন কোন্ মার্গের লেখক তিনি। তাঁর বই হাতে নিয়ে আমি নিজেকে লেখক বলে দাবি করছি, এর চেয়ে বড় ধৃষ্টতা আর কি আছে।
কোথায় যেন পড়লাম সেদিন। এক শিল্পী বহুদিন থেকে তাঁর গুরুর আশীর্বাদলাভের চেষ্টা চালাচ্ছেন। একের পর এক ছবি এঁকে তাঁকে উপহার দিচ্ছেন, উৎসর্গ করছেন। গুরু কোনরকম মন্তব্য করছেন না। শুধু বলছেনঃ বেশ বেশ, এঁকে যাও, এঁকে যাও। শিল্পী তাঁর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন একাগ্রচিত্তে। একক প্রদর্শনী করছেন নানা শহরে। দর্শকদেরও প্রশংসা কুড়োচ্ছেন প্রচুর। তাঁর কাজ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে পত্রপত্রিকায়। সবই হচ্ছে, শুধু একটা জিনিসই হচ্ছেনা যার জন্যে এত বছর ব্যাপী সাধনা চালিয়ে যাওয়া—তাঁর নিজের শিক্ষকের অকপট ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রশংসা। শেষে একদিন মরিয়া হয়ে গুরুর বাড়িতে হাজির হলেন কতগুলো ছবি সহকারে।
গুরুদেব, এতকাল হয়ে গেল, আপনি আমাকে উৎসাহ দিয়ে গেলেন, সহায়তা দিলেন নানাভাবে, কিন্তু কোনদিন হাসিমুখে প্রাণখুলে আমার কাজের ভূয়সী প্রশংসা করলেন না। কোনদিন বললেন না, তুমি একদিন বড় শিল্পী হবে। আমি আর সইতে পারছিনা আপনার নীরবতা। এবার আপনাকে বলতেই হবে কিছু-না-কিছু।
গুরু তাঁর শিষ্যের প্রতিটি ছবি গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করলেন। মাথা নেড়ে অনুমোদনসূচক ইঙ্গিতও করলেন কোনটাতে, ভাবলেশহীন নির্বিকার কোনটাতে বা। দেখা শেষ হলে মৃদু হেসে, শিল্পীর কাঁধে হাত রেখে, সহানুভূতির সুরে বললেনঃ সৃষ্টিকর্মীদের জীবনের সবচেয়ে নির্মম সত্য কি জান বাপু? সত্য হল, দীর্ঘ সাধনার পর একদিন যখন তারা বুঝতে পারে তাদের সীমাবদ্ধতা, বুঝতে পারে যে মহত্ত্বের সেই বিরল পরশপাথরটি নিয়ে তারা জন্মগ্রহণ করেনি, অট্টালিকার মাঝসিঁড়ি পর্যন্তই তাদের সীমানা, তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। জীবনের আর সকল দরজাই একে একে বন্ধ হয়ে গেছে তাদের জন্যে। নিজের মিডিওক্রিটির উপলব্ধি নিয়ে ঘুম থেকে সহসা জেগে ওঠা জীবনের মাঝপথে, এর চেয়ে বিড়ম্বনা আর নেই সংসারে।
সৌভাগ্যবশত: সেই মাঝসিঁড়ি পর্যন্ত ওঠার আগেই আমি দম হারিয়ে ফেলেছি।
(লেখাটি পড়শী তৃতীয় সংখা জুন -জুলাই ২০১০-এ প্রথম প্রকাশিত হয়)
ফ্রিমন্ট, ক্যালিফোর্নিয়া,
২২শে জানুয়ারি, ২০০৯
মুক্তিসন ৩৮
শ্রদ্ধেয় মীজান রহমানের লেখার বিষয়ে আমি বরাবরই infatuated. যথারীতি তথ্য ও অভিজ্ঞতা চ্ছাদিত অনুভূতিপ্রবণ লেখা দিয়ে মুগ্ধ এবং ঋদ্ধ দুটোই করে চলেছেন. সর্বশক্তিময়ের কাছে কামনা করি তিনি আরো দীর্ঘদিন এই রকম লেখা দিয়ে আমাদের আভারিত করুন.
valo laglo. Shuvechcha janben.