নাহার মনিকা
মফস্বলের এই থানা শহরে সব দিন ইলেক্ট্রিসিটির মা বাপ থাকে না। সেদিনও ছিলনা। সূর্য ডোবার আগে আগে মুরগী-টুরগী খোপের মধ্যে ঢুকিয়ে বৌ-ঝিরা কুপি হাতে রান্নাঘর থেকে উঠান পার হয়ে বড়ঘরের মাটিতে পাটি বিছিয়ে স্কুলের পড়া মুখস্থ করা কিশোর বয়সী বাচ্চাকাচ্চাগুলোকে হ্যারিকেনের আলো উস্কে– ‘এই জোরে জোরে পড়, পাকের ঘর থেইকা য্যান শুনতে পাই’ –বলে আবার রান্না ঘরে ফিরে গিয়ে চুলায় খড়ি গুঁজে তুষের ছিটা দিয়ে বাড়ানো আগুনের তাতে লালচে মুখ নিয়ে কান খাড়া করলে সামান্য হৈ হট্টগোল তাদের কানে আসে, তখন তাদের কেউ কেউ কুপি হাতে কেউ বাতি ছাড়া উঠানে এসে জমা হয়ে ভেসে আসা কোলাহলের তেমন কোন সুরাহা করতে না পেরে বাড়ির পুরুষ মানুষদের ফিরে আসার অপেক্ষা করে। পুরুষেরা দোকানপাট বন্ধ করে বাড়ি ফিরে ঝাল তরকারী দিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলতে গিয়ে বৌদেরকে বলে– ‘আজকা তোজোর বড়ভাই মোজাম্মেল ফিরা আসলো, বার-তের বচ্ছর পরে।’
–‘তাই নাকি? বৌ পোলাপান সাথে আনছে?’
–‘নাহ, একলাই তো দেখলাম। ম্যালা পয়সা হইছে মনে হয়, স্যুট কোট পরনে, লগে দুই তিনটা স্যুটকেস, সবাই বলাবলি করতো না যে আর ফিরা আসবো না, মইরা টইরা গেছে।’
বৌরা তখন না দেখা তোজোর বড়ভাইয়ের টাকা পয়সা বানানোর খবরে ঈর্ষান্বিত হয়, আর একজন সফল মানুষের সঙ্গে নিজেদের তাস খেলোয়াড় স্বামীর তুলনা করে মনে মনে রুষ্ট হয়ে ওঠে এবং পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কোন ছুতায় তোজোদের বাড়ি গিয়ে তার ভাইকে দেখার বাসনা মনে পোষণ করে আধোয়া থালা-বাসন ঘরের কোনায় রাখা বড় প্লাষ্টিকের গামলায় স্তূপীকৃত করে।
তোজোর সঙ্গে তার ভাইয়ের দেখা তের বছর তিন মাস পরে। তোজোর মনে এত দিনক্ষণের হিসাব থাকার কথা না। সে তো তখন তার ভাইয়ের থেকে চৌদ্দ বছরের ছোট। অবশ্য এখনও তার ভাইয়ের থেকে চৌদ্দ বছরেরই ছোট। এমনতো না যে তের বছর না দেখা হওয়ায় সে আর তার ভাইয়ের বয়সের ফারাক কমে তিনে নেমে আসার কথা। তা হয়ওনি, তবে ছোট থাকার অভ্যাস মোটামুটি পরিত্যাগ করে তোজো সময়ের আগে, অথবা ঠিক সময়ই হয়তো, তার হাসিখুশী, কালো গায়ের রং চাপা বেগুনি আভা ছড়ানো শুরু করলে সে হোন্ডা চালিয়ে কলেজে ডিগ্রী পড়তে গেছে, আর এই হোন্ডা কেনার পয়সা কোথা থেকে আসে তা পাড়ার বৌরা তাদের স্বামীদের কাছ থেকে শুনে ফেলার পর পরস্পরের সঙ্গে দীর্ঘ অলস আলাপে মাতলে তাদের কারো কারো ভাত বসাতে দেরি হয়ে যায়। ফলস্বরুপ তাদের কপালে জোটে শাশুড়ীর শাপ-সম্পাত আর বেশি ক্যাচক্যাচ শুরু করলে দু’ একজন স্বামী এমন দু’একটা রাত যায় না যে হাতপাখার ডাঁট তাদের বৌদের পিঠে ভাঙ্গে না।
তোজো যখন হোন্ডার চাকায় ধুলার ঘূর্ণি উড়ায় আর সিল্কের শার্টে দুইটা বোতাম খোলা রাখে, চৌদ্দ বছরের ছোট ভাইকে হো হো করে হাসতে দেখে মোজাম্মেলের একটু-আধটু অস্বস্তিও হয় দু’এক সময়। কিন্ত তোজোর মত করিৎকর্মা ছেলেকে বলার মত কথার দরদাম সে করতে পারে না বরং দুই ভাই মিলে বাড়ির টুকটাক ভাঙ্গা সারে, গেটটাতে রঙ করালে কেমন হয়– বলা মাত্র তোজো এক কৌটা সবুজ রঙ এনে তাতে তারপিন মিশিয়ে পাতলা করে মরচে-ধরা টিনের গেটটাকে দু ঘন্টায় ফিকে সবুজ করে দিলে, তার রঙ পছন্দ করার কায়দাকে মোজাম্মেলের ভালো লাগে এবং মনে হয় যে তা মানুষের অর্ন্তগত ভাবকে তুলে ধরে। তোজোর মনের ভাব কচি পাতার মত সজীব– এই ভাবনা তাকে প্রসন্ন করলে সে ভাইকে বলে– ‘ল, সামাদ ভাইয়ের দোকানে মিস্টি খাইতে যাই।’
কিন্ত সামাদ ভাইয়ের দোকান গত তের শীতে রফিকের ভাই ভাই মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে রূপান্তরিত হয়েছে, তোজো তাকে এই সংবাদ দিলে মোজাম্মেলের চোখে চারপাশের পরিবর্তনাদি বেশি করে ধরা পড়তে শুরু করে।
খটখটা রোদ উঠলেও গলির পাঁক না শুকানো পথের ইট দেওয়া নিশানা অনুসরণ করে তোজো তার হোন্ডা টেনে টেনে শুকনা পাকা রাস্তায় এনে মোজাম্মেলের সঙ্গে রেষ্টুরেন্টে যায়, ও দুইবার চেয়ে চেয়ে রসমালাই নেয় তারপর ঝাপসা বড় কাচের গ্লাসে ঢক ঢক করে পানি খায়। মোজাম্মেল যখন বলে– ‘চল তরে একটা শার্ট কিনা দেই,’ তোজো তখন কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্বের ধার না ধেরে বলে– ‘শার্ট তো অনেকগুলি আছে, একটা পাঞ্জাবী দাও’– এবং সে একটা সুরমা কালারের উপরে রূপালী কারুকাজ করা মটকার পাঞ্জাবী কিনে দোকানেই খালি গা হয়। ছোট ভাইয়ের লোমশ বুক আর বাহুতে প্যাঁচানো পেশী দেখে মোজাম্মেলের ভালো লাগে। একটু হিংসাও হয়। তোজো পাঞ্জাবীর বোতাম লাগাতে লাগাতে দোকানের আয়নায় নিজেকে দেখে, – ‘আমি গায়ের রঙ চ্যালেঞ্জ কইরা কাপড় পরি। কালো মানুষরে ডার্ক রঙে ভালো মানায়’।
তোজো কি গায়ের রঙ নিয়ে কি কোন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়? বড় ভাইয়ের ফর্সা লালচে গায়ের রঙ তাকে দুঃখিত করতেই পারে। মায়ের পেটের ভাই, একই শোণিতধারা নিয়ে তার মনের দিক নিশানা চিহ্নিত করতে না পারা সামান্য তাড়িত করলে মোজাম্মেল ভাইয়ের প্রতি নিজের পুরনো টান ফিরে পাচ্ছে দেখে ভালো বোধ করে। দেশের বাড়ি ফিরতে না পারার অপরাধবোধ মোছার জন্য এই টান দরকার আছে বলে মনে হয় তার কাছে। তোজোর পেছনে হোন্ডায় বসে তাকে ভালো করে জড়িয়ে ধরলে তার একাকীত্ববোধ সেই মুহূর্তের জন্য কমে আসে। এতদিন অন্য শহরে লক্ষ কোটি মানুষের মধ্যেও মোজাম্মেলের একা থাকার বিষণ্নতা দূর হয়নি, এখন গ্রামের ধুলাওড়া রাস্তায় ভাইয়ের সঙ্গে হোন্ডায় বসে তার বিশ্বাস জন্মে যে নিজের লোকবল হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
হোন্ডার শব্দ মাঠের খোলা প্রান্তরে রাজত্ব করে করে ঘুরে বেড়ায় আর উড়ে আসা ধুলোর মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মোজাম্মেলের চোখ রাস্তার দু’পাশের ধানক্ষেতে, সরিষা ফুলের হলুদে ছ্যাত ছ্যাত করে ছুঁয়ে যায়। দেশের প্রতুল সম্ভাবনা আর তার অপব্যবহার নিয়ে কথা শুরু করতে চাইলে আর তোজো হু হা জবাব দিয়ে চুপ থাকলে মোজাম্মেল একরকম নিরুৎসাহিত হয় ও একটু একলা বোধ করে।
বাড়ি ফিরলে আনুদাদার বৌ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে– ‘গোসল টোসল কইরা নিলে ভাত বাড়তাম’– শুনে তোজো– ‘অনেক মিস্টি খাইছি, এখন আর ক্ষিদা নাই ভাবী, আমি ভাত খামু না–’র শেষে লম্বা পা ফেলে বৈঠক খানা ঘরের দিকে হাঁটা দিলে মোজাম্মেলের, তার নিজের কেউ নাই কেউ নাই লাগা শুরু হ্য়।
আনুদার বৌ তাদের দুই ভাইয়ের জন্য রান্না করে আর দিনে দুই তিনবার বিড় বিড় করে– ‘এতদিন পর দুই ভাইয়ে দেখা, মন খুইলা কথাবার্তা নাই–’ যেন তোজোর আম্মা তাকে এই দুই ভাইয়ের মিলমিশের দায়িত্ব অর্পণ করে গেছে মরার আগে। অবশ্য তা সম্ভব হলেও হতে পারে। তোজোর আম্মা যখন ঢাকায় হাসপাতালে অপারেশনের জন্য ভর্তি হয়, তখন আনুদার বৌ তার সঙ্গে ছিল, আনুদা তখন দিনে ফয়জুলের মুদি দোকানের ক্যাশে বসে, রাতে তোজোদের বাড়ি পাহারা দেয়। মামার বাসা থেকে আম্মার জন্য রান্না করা খাবার আসতো এই কারণে যে আম্মার অসুখের মুখে হাসপাতালের আলুনি খাওয়া তার মুখে রুচতো না আর অন্য কারণটি না বললেও বেশ বোঝা যায় যে হাসপাতালের দেওয়া খাবার আনুদার বৌ বেশ আয়েশ করে খেতো, তার জন্য বাড়তি খাওয়া আনতে হতো না, একরকম বিনা খরচায় আম্মাকে দেখার জন্য কাউকে পেয়ে তোজোদের বড়মামী, নিজেকে মেদহীন রাখতে না পারার দৈনিক দুঃখ ভুলে বেশ খুশি হয়ে যান। আনুদার বৌয়ের হয়তো হাসপাতালের সেই আলুনি খাবার এত পছন্দ হয় যে এখন পর্যন্ত তার রান্নাবান্নায় লবণ কম হ্য় এবং তার রান্নায় যে লবণ কম এটা তার নিজের পক্ষে বোঝা সম্ভবপর হয় না। মোজাম্মেল এই প্রসঙ্গে কিছু বলা সমীচিন হবে না ভেবে চৌকির উপরে বিছানো হলুদনীল চেক চাদরে বসে মোজাম্মেল গুড়া মাছের আলুনি চচ্চড়িতে কাঁচা লবণ দিয়ে ভাত মাখায়।
দুপুরে ভাতঘুমের অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে আনতে দাদার আমলের কাঠের দোতলার ওপর তলায় শুয়ে উঠানের লম্বা রোদের বাড়া-কমা দেখে তোজোকে জোরে ডাকতে ইচ্ছা হয়–, ‘তোজো এইখানে উইঠা আয়…’
–‘আমি সিঁড়ি বাইতে পারতেছি না। এত উঁচা উঁচা বানাইছে ক্যান?’
–‘আয় আমি হাত ধরতেছি, হাতটা একটু লম্বা কর গাধা…’
–‘আমার হাত তো লম্বা, আপনের চে’ বেশি লম্বা, অন্যদিকে চায়া থাকলে দেখবেন ক্যামনে?’
হাতড়ে হাতড়ে তোজোর লম্বা আঙ্গুল নাগালে পাওয়ার চেষ্টায় মুহূর্তের স্পর্শে তার ভাই তাকে আবার হারিয়ে ফেলে।
ভাতঘুম ভাঙ্গলে বিকালের নরম আলোয় তোজো বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতির শেষ ধাপ হিসেবে বারান্দায় ঝোলানো বেতের আয়নায় চুল আঁচড়ায়, মোজাম্মেলের তখন বলতে হয়– ‘তোরে কিছু কথা বলতে চাই…’
–‘পরে বইলেন।’
–‘এখনই বলতে চাইতেছিলাম…’
–‘জরুরী কিছু নাকি?’
–‘না তেমন না…’
–‘তাইলে পরে বইলেন।’
তোজো উঠানে রাখা হোন্ডার হ্যান্ডেল ঘুরায় আর সতের লক্ষ বারের মত আবার মনে করে তাদের মা সে সময় ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি ছিল, তাদের দুই মামা পালাক্রমে খরচাদির জোগান দিতে দিতে অপারগতা তাদের চেহারায় প্রকাশ হওয়া শুরু করলে সে তার বড় ভাইকে দৃশ্যপটে দেখতে পায় না। এমন না যে সে সিনেমার দৃশ্যের মত মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে ট্রাকের নীচে চাপা পড়ে অথবা ধনী নায়িকার পাল্লায় পড়ে মায়ের অসুস্থতা ভুলে যায়। তার বড়ভাই যে কখন দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়েছে জানার উপায় হয়নি। সে বিমর্ষ মুখে মামাদের বিরক্ত চেহারার সামনে মায়ের অপারেশনের ক্ষত শুকানোর অপেক্ষা করে। কাউকে না বললেও তোজো আসলে তার মায়ের হয় সুস্থ হয়ে ওঠা অথবা মারা যাওয়া দুইটার একটা কিছুর অপেক্ষা করে কেননা তখন তার হাসপাতালে ডিউটি দেয়ার বদলে ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে বেশি ভালো লাগে আর সেটা ফেব্রুয়ারী মাস হওয়াতে ঢাকায় তখন বই মেলা চলছিল এবং তোজো প্রতিদিন বিকাল বেলায় বইমেলার মুখে টিএসসি’র সামনে অপেক্ষা করতো কখন তাদের গ্রামের স্কুলের হেডস্যারের মেয়ে সুরভি হলুদ বা শাদা চিকেনের সালোয়ার পরে বান্ধবীদের সাথে বিকালের মাথা না নোয়ানো রোদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে টিএসসি’র দিকে আসবে। তোজো আর ও অপেক্ষা করে কবে তার সাহস হবে সুরভিকে –‘এই সুরভি কই যাও?’ –বলে খুব চেনা একটা সপ্রতিভ ডাক দিয়ে বসবে।
ডাকটা আর দেওয়া হয় না, সে পরপর বেশ কয়েকদিন সুরভিকে আর বান্ধবী পরিবেষ্টিত অবস্থায় ঘোরাঘুরি করতে দেখে না। তার চিন্তা লাগে আর সেই চিন্তা লাগাকে সে একধরনের অভিভাবকসুলভ ব্যাখ্যার মধ্যে ফেলতে পারলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে টিএসসি’র দেয়াল থেকে নেমে হলের গেটে গিয়ে দাঁড়ালে হয়তো সুরভির খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। মেয়েটি যেহেতু তার এলাকার কাজেই কারো তেমন কিছু মনে করার অবকাশ নাও থাকতে পারে। হলের গেটে গিয়ে তোজো নিজেকে কিছু সময়ের জন্য এক মায়াপুরীতে আবিষ্কার করে– আসা-যাওয়ারত তড়বড়িয়ে ছুটে চলা মেয়েরা তাকে হঠাৎ করে গ্রামের এইটুকুন ন্যাংটা, কোমরে পিতলের ঝুনঝুনি বাঁধা তোজো বানিয়ে ফেলে। তার নাকে সিকনি, চোখে ঘুম ভাঙ্গা ময়লা, ঘ্যানঘ্যানে কান্না দেখে আম্মা দুই থাপ্পড় দিলে যেরকম ভয় লাগতো নিজেকে সে রকম ভীতু বানিয়ে তোজো কতক্ষণ দাঁড়ায় তার মনে থাকে না। হয়তো সূর্যটা মেঘের আড়ালে যাওয়া পর্যন্ত অথবা যতক্ষণ না হলগেটের বুড়া দারোয়ান তার আপাত-কঠিন জমিদারের ইমেজ ভেঙ্গে ইশারায় তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে যে সে কে এবং কেন এমন বিভ্রান্তের মত অধিকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে। তোজো তার অপেক্ষার কারণ বললে বিষয়টা একটু জটিল রূপ নেয়, সে যেহেতু সুরভির আসল নাম ভুলে গেছে, কিংবা কখনোই জানতো না, দারোয়ান তাকে দাবড়ানি দিয়ে বের করে দিতে উপক্রম করে। কিন্ত তার আগে তোজো হড়বড় করে আম্মার অসুখ আর তার এলাকার নাম বলে দারোয়ানের কাছে পেশ করে যে এই ঢাকা শহরে সে সুরভি ছাড়া আর কাউকে চেনে না। দারোয়ান ভাই যদি তাকে সাহায্য না করে, তার মা মৃত্যু শয্যায়। এই সব বৃত্তান্ত দারোয়ানের মনে দয়ার উদ্রেক করে নাকি দাদুর বদলে ভাই সম্বোধনে সে উৎসাহিত হয় জানার উপায় থাকে না কারণ সে ব্যাজার চেহারা করে হলের ভেতরে ঢোকার পথের দুপাশে সূর্যমুখী ফুলের গাছে পানিঢালারত চ্যাংড়া ছেলেটিকে গেট পাহারা দিতে বলে ভেতরে অফিস রুমে যায়। তোজো দুই গেটের মাঝখানে দাঁড়ানোর অধিকার পায় এবং শিক ধরে অন্তঃপুরে প্রবেশের পথ দেখতে দেখতে অপেক্ষা করে।
দারোয়ান ফিরে এসে ভাবলেশহীন জানায় যে হলের হাউস টিউটর আপারা তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে চায়। সোনালী ফ্রেমের চশমা আর হাল্কানীল শাড়ির হাউস টিউটর এইকথা সেইকথা জিজ্ঞেস করে কোক খেতে দেয় আর তোজো জেনে যায় যে তার এলাকার সুরভির আসল নাম সুরাইয়া পারভীন আর সে গত পরশুদিন হলের রুমে ফ্যানের সঙ্গে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। তাকে সামনের চেয়ারে বসিয়ে হাউস টিউটর চশমা খুলে ফোন উঠিয়ে কথা শুরু করলে তোজো দরদর করে ঘামে। ঘামতে ঘামতে তার জ্বর আসে, জ্বরের ঘোরে সে একটা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে গেলে তার ভাই তাকে তুলবে কিনা এটা নিয়ে তার সংশয় শুরু হয়।
দ্বিখণ্ডিত একটা ডানায় ওড়াউড়ি করে তোজোর ইচ্ছা। বড়ভাই তাকে জিজ্ঞাসা করলে আর নাও যদি করে, সেকি ভাইজানকে তার হাজতখাটার কাহিনী শোনাবে? নাকি কিছুই বলবে না। তোজো তার বন্ধুবান্ধবদের কাছে তার প্রায় সোয়া দুই বছরের হাজতবাসের অভিজ্ঞতাকে যেভাবে রাজনৈতিক অবয়ব লাগিয়ে তুলে ধরে সেটা ভাইজানকে আদৌ বলা দরকার কিনা, হাজত থেকে জেলখানার অভিজ্ঞতায়, অন্তত জেলখানার কাগজপত্রে তার হাজতি থেকে পাকাপাকি জেলী হবার অবস্থাগত ব্যাপারটা বদলানো হয়নি, ফলত সে একজন হাজতি হিসেবে দুই বছর জেলের ঘানি টেনেছে যা তোজোর কাছে কাছে শুরুর দিকে বিষময় মনে হলেও শেষের দিকে এই উপসংহার সে টানতে পারে বৈকি যে তার জেলজীবন তাকে সেই কোমরে ঝুনঝুনি বাঁধা কিশোর ছেলেটি থেকে পূর্ণবয়স্ক মানুষে রূপান্তরিত করেছে। বাপ মা বড়ভাই না থাকলেও যে মানুষের কেউ না কেউ থাকে, তোজোরও ছিল, জেলখানা। রাজনীতির পাঠ তাকে জেলের অভিজ্ঞতা দিয়েছে–, ঢাকায় মিছিলরত সহসা গ্রেফতার হয়ে যাওয়া তোজো বন্ধুদের কাছে, কলেজের মাঠে বক্তৃতায় এইসব কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা জমা হলে তার জেলজীবনের সেইসব দিনের কথা মনে পড়ে, যখন মৃত সুরভির ওপর তার বিতৃষ্ণা আসতো। সুরভির খোলা চুল, যা টিএসসি’র দেয়ালে বসে প্রায়ই তার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করতো, সেই চুলের চাবুক তৈরি করে সুরভির পিঠে লম্বা লাল গভীর দাগ বানিয়ে, তাকে গভীরভাবে ধর্ষনেচ্ছাটিকে কার্যে পরিণত করতে পারলে এই দোজখবাসের যন্ত্রণা কমবে এইরকম ভাবনা তাকে গ্রাস করতে করতে ক্লান্ত করলে তারপর তার ঘুম আসতো। জেলখানার ভারী দম বন্ধকরা বমি বমি ভাবের বাতাসে চলাফেরার সময় সুরভির কথা মাথা থেকে উড়িয়ে দেয়া তার জন্য যে ক্রমাগত দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছিলো, সেকথা গোপন রাখার ক্ষমতা অল্প চর্চায় দ্রুত আয়ত্তের মধ্যে এলে তোজোর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। আর একথা তো কাউকে বলার প্রশ্নই আসেনা যে বিকল্প হিসেবে সুরভির বাইরে অন্যকোন নারীসঙ্গ পেলে তার পক্ষে সুরভিকে মন থেকে উচ্ছেদ করা সহজ হবে। একধরনের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করলেও তোজো তার নিজেকে নিবেদনযোগ্য কোন নারীর সাক্ষাৎ পায়নি। মিথ্যার আশ্রয় না নিলে বলা যায় যে, জেলখানাতে, তার মত তেমন কেউ না টাইপের হাজতি বা জেলীর পক্ষে তা একান্ত অসম্ভবও ছিল।
ভাইজানকে এই কাহিনি কত বিস্তারিত বলা যায়? হলগেটে খবর নিতে এসে সুরভির ফাঁসির কেসে জড়িয়ে যাওয়ার কাহিনী ভাইজানকে বলতে গিয়ে তোজো তোৎলায়– ‘ফজলু স্যারের কথা মনে আছে?’
–‘হুঁ, ইংরাজী পড়াইত,’ –ভাইজান একটু সোজা হয়ে বসে।
–‘পরে হেডমাষ্টার হইছিল।’
–‘তাই নাকি? আমাগো ইংরাজী নিতো ক্লাস সিক্স, সেভেনে। ফজলু স্যার আমারে কর্ণার আর এঙ্গেল এর মানে শিখাইয়া দিছিল, একদিন কিছুতেই বুঝতে পারতাছিলাম না, বুজলেও মনে থাকতাছিল না। স্যারে আমারে ব্লাকবোর্ডের কাছে নিয়া কর্ণার আর ঘরের কোণায় নিয়া এঙ্গেল বুজাইল। তারপরে বুজলি, আর কোনদিন ভুলি নাই’…বড়ভাইকে কথায় পায়।
–‘স্যারের মেয়ে…’
–‘স্যারে তো বিয়া করছিল একটা হিন্দু মেয়েরে। সবিতা, নাম বদলায়া সাবিহা রাখছিল। তুই তো তখন ছোট আছিলি মনে থাকার কথা না। খুব সুন্দরী আছিল। সাবিহা হইয়া খুব পরহেজগার হইল, সবাই কইতো ফজলু স্যারের পুরা বংশের নামে বেহেশত লেখা হইয়া গেল। ফজলু স্যারের বাপে পয়লা প্রথম ত্যাজ্য করবো এইসব কইলেও পড়ে সওয়াবের কথা ভাইবা মাইনা নিল। হুজুর রাইখা আরবী, সিপারা পড়াইল। হালদারগো মেয়ে ভাইগা গেল সেই দুঃখেই, নাকি আগে থেইকাই প্লান আছিল, বাপ মা সবাই ইন্ডিয়া গেল গা’।
তোজোর চোখে তখন ফজলু স্যারের বৌয়ের মেচেতাঅলা মুখ, বৈঠক খানার পেছনে পাছা আলগা দিয়ে বসে গোবরের চটা বেড়ার গায়ে লাগানো হাত, শুকনো হাতে কাচের চুড়ি, উড়ে যাওয়া মাথার ঘোমটা, চওড়া সিঁথিতে আধা কাঁচা-পাকা চুলের চিমসানো খোঁপা ভাসে।
সূর্য ডুবিডুবি বারান্দায় রংচটা কাঠের চেয়ারে বসে আনুদার বৌয়ের বাড়ানো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অতঃপর দুই ভাইয়ের গল্পের প্রসঙ্গ পালটে যায় শৈশবের ধোঁয়া ওড়া চরে। সেখানে চউরারা খেড়ের গাট্টি জমিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। মোজাম্মেল কলই ক্ষেতের কলই কলাপাতায় মুড়ে গুজে দিয়েছে আগুনের মধ্যে, আর প্রায় সেদ্ধ হবো হবো করলে সে দেখেছে গায়ে মায়ের চাদর জড়ানো, খালি পায়ে তোজো এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে।
জেলখানা প্রায় বাড়িঘর হয়ে যাওয়ার গল্প তোজো যখন তার বন্ধু বান্ধবদের কাছে করে তখন আশপাশে যারা থাকে তারাও গালে হাত দিয়ে কপাল কুচকে মনোযোগী শ্রোতা হয়ে যায়। এমন না যে তোজো খুব রসিয়ে গল্প বলতে পারে, তার নিজস্ব কিছু বর্ণনার বাইরে তার শব্দভাণ্ডার বেশি বড় না তাই তাকে ‘আশি দিনে ভূ-প্রদক্ষিণ’এর উদাহরণ দিয়ে উপসংহার টানতে হয়। ক্রমে ক্রমে পাড়ার বৌ ঝিরাও জানতে পারে জেলখানা কি ভয়ঙ্কর জায়গা। অপরাধ করেছো কি করো নাই তার সঙ্গে হাজত খাটার কোন সম্পর্ক নাই। তোজো যে সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিল এবং তাকে কোনোরকম সাক্ষী-প্রমাণ ছাড়াই হাজতে আটকিয়ে রাখা হয়েছিল এটা সে সোয়া দুই বছরে কোন কাকপক্ষীকেও বোঝাতে সমর্থ হয় নাই। জেলখানার দারোগা, পুলিশ এমন কি ঝাড়ুদারনী, যাকে তোজো দুই একবার ছাপা শাড়ি গাছ-কোমর বেঁধে হাঁটাচলা করতে দেখেছে আর ক্রমাগত সুরভির চিন্তাকে স্থানান্তর করতে তার দিকে কাতর চোখে তাকিয়েছে, সেও কাঠের পুতুলের মত, কেবল টাকা দেখলেই হা করে। তবে পাড়ার বৌ-ঝিদের বিবেচনাবোধ তাদের স্বামীরা একদম উড়িয়ে দেয় না, যে, রাতারাতি তোজোর একটা রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে ওঠা, বিশেষ করে জেলে যাওয়ার আগে তোজো মোটামুটি ভ্যাবদা টাইপ ছিল, আর তার মামা আধা ব্রিফকেস ভর্তি টাকা পয়সা নিয়ে উপস্থিত হবার সম্ভাবনাকে আমল দেওয়া যায় না কারণ পূর্তমন্ত্রণালয়ে কাজ করে তার কেরানীমামি কতই বা ঘুষ পায়, যার স্বামী আবার একরকমের বেকার। ব্যবসাপাতি ধরে-ছেড়ে দুই রুমের সরকারী বাসায় মুরগীর মত ঝিমানোর খবর ঢাকা শহর থেকে দ্রুত না হলেও একসময় ঠিকই এসে পৌঁছায়।
দুইয়ে দুইয়ে তারা চার মেলাতে পারে যখন সুরভির লাশ মর্গে কাটাকাটি শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লেখা মাইক্রোবাসে করে ফজলু স্যারের উঠানে নামানো হয় আর সুরভির মা দিন দুনিয়া ভুলে– ‘হা ভগমান হা ভগমান’–বলে ছিটকে ঘর থেকে বের হয় আর পিছনে ফজলু স্যার যখন তার মুখ চেপে ধরে জোর করে ঘরের ভেতরে ঠেলতে ঠেলতে ঢোকান। তখন তোজোকে কেউ ভীড়ের মধ্যে দেখতে পায় না। লাশের সঙ্গে ভ্রমণকারী খবর তাদেরকে আকালের দিনে ধানের যোগানের মত গল্পের বিষয়-আশয় দিলে তারা আর অবাক হওয়ার সুযোগ পায় না।
তারপর দিন যায়, তোজো ফিরে না আসলে পাড়ার চ্যাংড়া-প্যাংড়া ছেলেপেলে তাদের উঠানে দাঁড়িয়ে আমের আঁটি চুষে চুষে খায়। তালামারা ঘরে বাদুড় ঝাপ্টাঝাপ্টি করে। তাদের খাওয়া আমের আঁটিগুলোতে চারা গজায় আর প্রায় হাঁটুসমান লম্বা হয় যখন তোজো ফিরে আসে। দুই দিন সে ঘুমিয়ে কাটায়, পাড়ার যারাই তখন এসেছে তাকে ঘুমে দেখতে পেয়েছে, তার জ্বলমান, ক্ষয়াটে আর ক্রুদ্ধ চেহারা দেখতে পায়নি, অন্তত তখনকার মত। পরের সপ্তায় সে আনুদাদার বৌয়ের কাছ থেকে বটি চেয়ে নিয়ে বাড়ির আনাচ-কানাচ আগাছামুক্ত করে। তারপর একদিন গাঝাড়া-দেওয়া হাঁসের মত সাজগোজ করে বাইরে গিয়ে, সন্ধ্যায় হোন্ডা চালিয়ে ফিরে আসে। পাড়ার মানুষদের বুঝতে সময় লাগে, তারপরও তারা সিদ্ধান্তে আসতে পারে না যে তোজো কি আসলেই জেলখানায় ছিল। সুরভি হত্যা বা আত্মহত্যা মামলার খবর জানার জন্য তারা চায়ের দোকানে খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। কোথাও কোন খবর খুঁজে না পেলে বলে– ‘মাইয়া বহুত চালু আছিল, তোজোরে বিট্রে করছিল। প্রতিশোধ নিতে চাইছিল, বুজলা না? কয়ডার লগে ঘুরতো কে জানে। নিজে ফাঁসি দিছে না খুন হইছে কইবো কেডা?’
–‘এইখানে থাকতে তো ভালই মনে হইতো।’
–‘আরে থোও তোমার ভালো। ঢাকা গেলে সবাইর পাখনা হয়, সুরভিরও হইছিল।’
…………………………
সকাল সকাল রওনা দিলে সন্ধ্যার আগে ফিরে আসা যাবে। আনুদাদার বৌয়ের পরটা ভাজার ঘ্রাণে ফ্যাকাশে ভোরের হালকা বাতাস অল্প ভারী হয়ে উঠলে তোজো আর মোজাম্মেল দ্রুত চায়ে চুমুক দেয়। দুই বাটির টিফিন ক্যারিয়ার আর মিনারেল ওয়াটারের বোতল তোজোর হোন্ডার ক্যারিয়ারে তোলা হলে বোঝা যায় তাদের গন্তব্য নানীর বাড়ির ভিটা। হোন্ডা ষ্টার্ট নিলে ভোরের শান্তভাবে চিড় ধরে আর ঘুমন্ত ধুলোকে পিষে তোজো উড়ে যায়। তার কোমর শক্ত করে জড়িয়ে পেছনে বসা ভাইজান। বৃষ্টি শেষের শুকনো রাস্তায় তারা খুব সহজেই মফস্বল ছাড়িয়ে গ্রামের পথটি খুঁজে পায়। লম্বা একটানা আলুক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কাঁচা সবুজ তাকে মুগ্ধ করলে মোজাম্মেলের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে। গ্রামদেশ বেশি বদলায় নাই বলে একটা আলাপ তোলার চেষ্টা করেও থেমে যায় সে, আরেকটু বেলা হোক। বেলা হলে তারা শহরের বাইরে প্রথম গ্রামটির কার্লভার্ট পার হয়। নীচে নালার পাশে ঘাসের মধ্যে অজস্র নীলশাদা বেগুনি ছোট ফুল, আর পানিতে কচুরীপানার সঙ্গে লাল শাপলা। মোজাম্মেল উচ্ছ্বসিত খুশি ধরে রাখতে পারে না, তার ক্যামেরা খুলে ফটোর পর ফটো নেয়।
তোজো বলে –‘শাপলা তো তরকারী। এখন বাজারে বিক্রি হয়’।
–‘তাই নাকি’? বলে মোজাম্মেলের মনে পড়া গল্প বলে যে সে কিশোর বয়সে বিল থেকে মায়ের জন্য শাপলা তুলে আনতো আর মা সেখান থেকে ডাঁটা নিয়ে ইলিশ মাছের মাখা মাখা চচ্চড়ি রান্না করতো। বোটা ছেঁড়া ফুল দিয়ে মালা বানিয়ে দেবার আবদার করলে মা কাঁথা সেলাইযের সরঞ্জাম খুলে পাড়ের সুতা দিয়ে মালা বানিয়ে দিলে সে তা গলায় পরে খেলতে বের হয়ে যেত। এভাবে সে খেলার সময়ই যে ফজলু স্যারের বোনের দেখা পায় আর কেমন কেমন করে একদিন মায়ের বানানো তাজা শাপলার মালাটা ফজলু স্যারের বোনের গলায় ঝুলতে দেখা যায়, সে কথা সে তোজোকে বলবে কিনা ঠিক করতে না পেরে উপসংহার টানে– ‘শাপলা তাইলে খাইতে হইব একদিন, যাওয়ার আগে’।
‘যাওয়ার আগে’ বাক্যটা তোজোকে হোন্ডার সীটে হেলান দিয়ে দাঁড় করায়। এই সংবাদ সে জানে, তারপরও ধাক্কা লাগে আর তাতে কাৎ হতে হতে নিজেকে সামলায় তোজো–‘কবে যাইবেন?’
–‘টিকেটের ডেইটতো আর দুই সপ্তা পরে’।
–‘ও’…
–‘তোজো তোরে একটা কথা বলতে চাই।’
বাতাসের সাঁই সাঁই শব্দ কেটে হোন্ডা বেরিয়ে যায়। তোজো ঘাড় না ঘুরিয়ে বলে– ‘পরে বইলেন’।
মোজাম্মেল কাঁধ আঁকড়ে থেকে তোজোর নিস্পৃহতা টের পেলে চুপ করে থাকে আর চারপাশের গাছ পালা, ছনের বাড়িঘর তার সানগ্লাস পরা চোখের ওপর তরতর করে বয়ে চলে। তোজোর শক্ত কাঁধ, হাত রাখতে ভালো লাগে। খটখটা গরমে পানি খেতে মন চাইলে শক্ত কাঁধে ঝাঁকুনি দিতে হয়। তোজো একটা গাছের নীচে হোন্ডা থামালে পানি খাওয়া হয়। তোজো খায় না। তার পিপাসা গরম কিছুতে মেটে, তাকে বাজারের দোকানের চা খেতে হবে।
আধা নামানো ঝাঁপের ভেতর নীচু হয়ে ঢুকে বসলে ছায়ার গোমড়ামুখ অন্ধকারে ভাইকে ভালো করে দেখতে চায় মোজাম্মেল। পিরিচে ঢেলে চা খাচ্ছে, বেড়ার দিকে চোখ। তোজো তখন কত বড়, সাত নাকি আট? মোজাম্মেল যখন ভোররাতে রওনা দিচ্ছিল, ও তখন চৌকির উপরে কাঁথা গায়ে ঘুমায়। ঘুমন্ত মুখটা কতদিন মোজাম্মেলের পেছন পেছন ঘুরলো, একসাথে হেঁটে হেঁটে নদীর ধারে গেল, নৌকায় পার হয়ে বাজারের কাছে থেমে থাকা বাসে উঠলো, তারপর ঢাকায় মামার বাসা, তারপর পাসপোর্ট অফিস, আদম ব্যাপারীর গ্রীন সিগন্যালের জন্য একঘেয়ে অপেক্ষা, বিদেশী এয়ারপোর্টে ভীত চোখে চারদিকে তাঁকানো– সব সময় তোজোর ঘুমন্ত মুখ তার সঙ্গে সঙ্গে। আর সে ঘুরেছে অন্তর্গত এক অনুশোচনার পেছনে পেছনে। এতদিন পরে তার সেই অনুশোচনা মনে মনে অন্য রকম ভালোলাগায় রূপ নেয়, সে ভাইকে বলতে পারে– ‘তোজো আমার সঙ্গে চল? তরে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি। তোর যা বয়সে তাতে আর স্পন্সর করতে পারবো না, কিন্ত ভিজিট বা স্টুডেন্ট ভিসা নিয়া আইসা পর, দুই ভাইয়ে একলগে থাকুম নে।’
চা খেয়ে তোজো পানি খায়। তারপর আধা গ্লাস পানি দিয়ে ঘরের কোনায় গিয়ে ছিটিয়ে ছিটিয়ে মুখ ধোয়। ভেজা মুখেই বাইরে এসে হোন্ডা ষ্টার্ট দেয়ার আগে ভাইজানের মুখের দিকে বরাবরের মতই না তাঁকিয়ে বলে– ‘নাহ, আর বিদেশ টিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা নাই।’
আবার তারা হু হু করা মাঠের মধ্যে দিয়ে হোন্ডা ছোটায়, জলাকীর্ণ নাব্য ধানক্ষেত পার হয়। কাজ করতে থাকা মানুষের উৎসুক চাউনি পার হয়ে কোন এক রাস্তার পাশে টং দোকানের সামনে থেমে সিগারেট কিনে আবারো পাঁচ সাত মিনিট জিরায়। মোজাম্মেল চুপ থাকে, তোজো আরো চুপ থাকে।
……………………………
নানীর বাড়ির ভিটায় তোজোদের খাতির যত্ন হয়, ডাবের পানি আসে, পেয়ারার টুকরা আসে। তোজো পেয়ারায় কামড় দেয়, আর ভাইজানের সঙ্গে মামার শালা বা এই জাতীয় কারো কথাবার্তা শোনে। একসময় উঠানে শুকাতে থাকা কলইয়ের শুকনা ডাল জুতার নীচে মাড়িয়ে তারা বাড়ির পেছনে মায়ের কবর দেখতে যায়। লম্বা লম্বা শুপারি আর সিঁদূরে আম গাছের নীচে তোজোদের আম্মার কবর, আরো কারো কারো কবর।
–‘আম্মার কবর কোনটা? আগে আসে নাই নাকি’– ইত্যকার প্রশ্নে তোজো কাঁধ ঝাঁকায়।
–‘কবরে আইসা কি হইব?’
কোনটা আম্মার কবর মামার শালা বা এইজাতীয় কেউও বলতে পারে না। তারা কবরের বয়স, আশপাশের গাছ গাছালির গড়ন দিয়ে আম্মার কবর শনাক্ত করার উদ্দেশ্য কোন বয়স্ক কাউকে ডাকতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গেলে দুই ভাই গাছের ফাঁকে ফাঁকে পা উঁচু করে হাঁটে, পাতা টাতা পায়ের নিচে পিষে পিষে পথ খুঁজে বের করতে চায়। গাছের ফাঁক দিয়ে লম্বা তেছরা আলোর শাদা রেখা তাদের চোখে ঘাই মারে। মোজাম্মেল তার গলায় ঝোলানো সানগ্লাস আবারো চোখে উঠায়। এক সময় তারা পাতলা জঙ্গলের শেষ মাথায় পৌঁছায়, সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে অগভীর এক পাতকুয়া। এখানে পাতকুয়া কি করে? মোজাম্মেল কুয়ার পানিতে চেহারা দেখে, একটু জোরে শ্বাস ছুড়ে দেয় নিচের দিকে আর তা ওপরে ফিরে আসলে দুই ভাই হাসে। তোজোকে আবার আপন-আপন লাগা শুরু হয় মোজাম্মেলের। সে কুয়ার মুখে শরীর আধাভাঙ্গা করে ঝুঁকে থাকে।
–‘ফজলু স্যারের বইনটা আসলে আমার জন্যই কুয়ায় পইরা মরছিল।’
তোজোর দিকে না তাকিয়ে মোজাম্মেল তার জানা, অল্প জানা কিংবা সবার জানা আপাত-গোপন কাহিনীর শেষ লাইন আওড়ায়। সেইসব দিনে কোন কোন মধ্যরাতে ফজলু স্যারের বোনের নরম শরীর তাদের বাড়ির পিছনে খড়ের গাদায় বিহ্বল হয়ে ছড়ালে তার সালোয়ারের ফিতা একটানে পুরোটা খুলে গেলে, তারপর অন্ধকারে একটা সেফটিপিনের অভাব নিয়ে মধ্যরাতের আখ্যান সে এখন তোজোর কাছে কিভাবে উন্মোচন করে?
–‘আপনের জন্য মরছে বইলা কি আপনের কোন অসুবিধা আছে?’
তোজোর কন্ঠস্বর কি শক্ত শোনায়?
–‘এক সময় খারাপ লাগতো, নিজেরে মনে হইতো আমি বিট্রে করছি। পরে অবশ্য ভাবছি খালি খালি মরলো, আমি বিয়া করি নাই বইলা মইরা না গিয়া অন্য কোন অবলম্বন কি পাইত না?’
–‘অন্য মানুষ?’
–‘মানুষই তো অবলম্বন।’
–‘আপনের অবলম্বন কই?’
মোজাম্মেল হাসে, তোজোর কাঁধে হাত রাখে–‘এই যে তুই।’
তোজোর হাতের সরানো দুরত্ব তাদের সাথে সাথে বাড়ি ফেরে। আবারো তারা টং দোকানে থামে, সিগারেট ধরায়। মোজাম্মেল মিনারেল ওয়াটার কেনে।
পাড়ার গলির মোড়ে ঢুকতে গিয়ে তোজোর হোন্ডার টায়ার পাংচার হয়। তোজো হোন্ডা ঠেলতে ঠেলতে গলিতে ঢোকে। পাড়ায় ইলেক্ট্রিসিটি নাই, ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়িঘরের কথাবার্তার আওয়াজ গলির মধ্যে চলাফেরা করে। তোজো হোন্ডা ঠেস দিয়ে দাঁড় করায়, কণ্ঠস্বর নীচু করে আচমকা বলে– ‘সুরভি কিন্ত আমার জন্য ফাঁসি দেয় নাই ভাইজান।’
মোজাম্মেল কিছু বলে না আর মোজাম্মেলের ফর্সা মুখও অন্ধকারে দেখা যায় না। পাড়ার লোকজন আনাগোনা করে। গলির মোড়ে দুই ভাই চুপচাপ কারেন্ট আসার অপেক্ষা করে, কেউ তাদেরকে চিনতে পারে না।