রওশন আরা মুক্তা
পুতুলজন্ম
আমাকে পুতুল পেয়েছিলে, তাই না? ফর্সা গোলাপি মুখ আর ছাগ-শিশুর মতো দাঁত। কোনো কোনো দিন প্যান্ট থাকত না ফ্রকের নিচে। তোমার বুকে উঠে বসত পুতুল। জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলতে, আল্লাহ! নেংতু কেন? তোমার সামনের দু’দাঁতের মাঝে ফাঁক আছে, গালে টোল পড়ে। তোমার নির্লোম বুকের উষ্ণতায় পুতুল ঘুম দিয়েছে, পুতুল স্বপ্ন দেখেছে, পুতুল ভেবেছে এই বুকে নেই সমাজ, এই বুকে নেই রাষ্ট্র নেই ধর্ম, এই বুকে নেই আস্তিক নেই নাস্তিক, নেই বউ পিটানো পিশাচ। তোমার পুতুল ভেবেছে, এই বুকেই পরম শান্তি, ভেবেছে এই বুকের যোগাযোগ সরাসরি পুতুলের রক্তে।
তোমার পুতুল যায় খেলার মাঠে, সেই মাঠ যার শেষে আকাশ মিশে গেছে, দৌড় আর দৌড় শুধু ছুটে চলা– পুতুল ছুটে চলে, আকাশ ছুয়ে দিতে, আকাশ! মরীচিকা! মরীচিকা ! মুখ ফোলায় পুতুল, নদীর ঘাটে মড়া-পোড়ানো দেখে বাড়ি ফেরে পুতুল, তালের গন্ধ মেশা ভাদ্রের দিনে। তুমি সাইকেলে তুলে দিলে পুতুলকে, আজও পুতুলের সাইকেল চালানো শেখা হয়নি।
এই খেলার মাঝেই পুতুল চেপে যায় কিছু গল্প, শুরু হয় নতুন খেলা। খেলাচ্ছলে পুতুলকে তুমি যে খেলায় নামালে– জানো না, কত পঙ্গু সে– মাঠে। সে আকাশ ছুঁতে চায় না আর, ঘাসেদের নিচে লুকাতে চায় কাঁকরমাটি হয়ে। কেউ মাড়িয়ে গেলেও যাতে পুতুলের অভিমান না হয়। মাটির কোন অভিযোগ থাকে না। পাথর বালির কোনো স্থায়ী ঠিকানা হয় না সিমেন্টের মিশেল ছাড়া। এ খেলায় কখনো কখনো তুমিও প্রতিপক্ষ, তুমি চাল দাও না, শুধু এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকো বিশপ হয়ে, এক কোনাকুনি নিষেধাজ্ঞার রেখা এঁকে দিয়ে। অতিক্রমে পুতুল তোমাকে পায়, তুমি চাল দাও না, তুমি দাঁড়িয়ে থাকো বিশপ। চাইলেই জীবন-শতরঞ্চি গুটিয়ে ফেলা যায় না; নইলে পুতুল অতিক্রম করে যেত মাটি পানির ভেদ…
পুরুষ
পুরুষ। ষাট পঞ্চাশ বা চল্লিশ। অথবা, পয়ত্রিশ ত্রিশ। আমার ভাই বলত তোকে তো এই ধরনের রিসার্চ করতে দেওয়া হবে না। তুই পাইছিস কী? সেটাই তো কী পেলাম! সত্যি বলতে কিছু তো চাইনি– যে পাব। ভাই বলত, তোর কপালে দুঃখ আছে রে। ভাই, তা কার কপালে নেই, বল তো? আরো বলত, স্ট্রিট গার্লদের মতো বদঅভ্যাস বানাইছস (ওর সিগারেটের প্যাকেটে সিগারেট কম পেয়েছিলো একদিন) ভাই, আসলে আমি তো রাস্তারই… দেহটা আটকে আছে শুধু ঘরে, আমি তো ঘুরে বেড়াই ব্রহ্মপুত্র আর ইছামতিতে, রাজারবাগ আর সাভারে।
পুরুষ। ষাট পঞ্চাশ বা চল্লিশ। অথবা, পঁয়ত্রিশ-ত্রিশ। বোন বলত, ভাই না ভালো এমন করে না। কেমন করব? যেমন বলিস, তেমন আমি পারি না। অনেক তো হল পুতুল খেলা। রাগ হয়ে বলত, কর যত খুশি নিজের ক্ষতি, প্রকৃতির ক্ষতি করিস না। কেন যে আমাকে এত ইম্পরট্যান্ট ভাবিস তোরা! আমি প্রকৃতির টিঁকিটি ছুঁতে পারি নাই। আমি একটা পুরুষকেও মারতে পারি নাই।
পুতুল খেলা। পুরুষেরাই খেলেছে এই পুতুল। জরির-পাড় শাড়ি পরিয়ে, কাজল মাখিয়ে, ঠোঁটে রঙ মাখিয়ে। সেই কাজল লেপটে দিয়ে চোখের নিচে, সেই রঙ কিছু অসভ্যতায় গালে, থুতনিতে ছড়িয়ে– তার নাম দিয়েছ চুমু। কালো চামড়া ফর্সা করতে বানিয়েছ রঙ ফর্সাকারী ক্রিম। নানান ব্যবস্থা, একটাই শরীর, তোমরা তাতে কাপড় চড়াও– রুচি চড়াও– খাটো করো– লম্বা করো– প্যাঁচাও– চিরে দাও– ফেড়ে দাও। তোমরা বুক বের করো– তোমরা বুক ঢেকে দাও। তোমরা আবার ভড়ং করছ, মেয়েরা নাকি পুতুল খেলে, তোমরা খেল ফুটবল। তোমরা কাঁদো না, আসলে কাঁদতে চাও না, নারীর মুখোমুখি দাঁড়াবার শক্তি তোমাদের নেই, নারীর শক্তি অতিক্রম করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। পুরুষ, কাকে ঠকাচ্ছ? নিজে কি ঠকছ না একটুও?
সেই কাজল যখন কালি আর সেই রঙ ফর্সাকারী ক্রিম যখন চুন, এই চুনকালি তোমাদের মুখেই লেপে দেয় নারী। সেই ঠোঁটের রঙে রক্তলাল করে তোমাদের বসতভিটা তোমাদের সাজানো সংসার তোমাদের হৃদয়। তোমাদের পুতুল বিগড়ে গেছে বলে তোমাদের ধারণা হয়। পুতুল নাচে, তোমরাই শিখিয়েছ নাচতে হবে, পুতুল হাত তালি দেয় তোমরাই হাতে শক্তি জুগিয়েছ, পুতুল নরক অতিক্রম করে, তোমরাই নরক দিয়েছ।
চেনো তুমি লিটনের ফ্ল্যাট। জানো ডটেড নাকি রিবস, চকলেট নাকি মিন্ট। করো ধর্ষণ চাও ভার্জিন বউ। পুরুষ– জানে না… কী জানে না তার চেয়ে কী জানে সেটা গণনা করা সহজ।
নারী
কী?
তোমাকে আগে জানার কথা ছিল কিন্তু পরে জেনেছি। অথচ তুমিই আমার মা ছিলে।
অথচ নারী ঘুরে ফিরে তোমার প্রতি বোধ করি প্রেম। এবং সকল মানবীয় অনুভূতি।
প্রিয়াঙ্কার স্লিম পেটের প্রেমে পড়ে নারী তুমি ডায়েট কোক খাও, তুমি নিজেকে ফিতা দিয়ে মাপো সকাল বিকাল, কমলো কি একটু কোমরের মাপ? খাও তুমি হরতকি খাও কাঁচা আমলকী স্কিনটা রাখবে মোমের মতো, আগুন যাতে গলতে পারে! বয়ফ্রেন্ডকে জানিয়ে দাও ‘প্যান্টিন’ শ্যাম্পু আমার প্রিয়, ইন্ডিয়ান চুড়ি আমার প্রিয়, চওড়া লেস লাগানো ইন্ডিয়ান শাড়ি আমার প্রিয়। আমি পাকিস্তানি মেহেদি পরি হাতে, আমার অ্যামেরিকান ফেস পাউডার লাগে। ম্যাচ না করে আমি এক্সেসরিজ ইউজ করি না। যাকে তাকে আমি ফোন নাম্বার দেই না, আমার স্কিন খুব সেন্সিটিভ রোদে গেলে র্যাশ বের হয়, সোনা ছাড়া কিছু পরতে পারি না নাকে কানে ব্যথা হয়। বয়ফ্রেন্ডকে বলো , অ্যা মা! বাসায় তুমি লুঙ্গি পরো! কি আনসিভিলাইজড! ছি! তুমি সিগারেট খাও! কী ঘেন্না!
অথচ নারী, তুমি তারই বীর্য চাটার বাসনা করো।
নেচে যাও নারী প্রেম করে যাও, ওদের নিচে শুয়ে যাও জন্ম দিয়ে যাও সন্তান– করে তোলো পুরুষ তাদের! এই দেশে যতগুলি ধর্ষণ হয় তার মূল আসামি তুমি, নারী তুমিই ধর্ষক। যতগুলি মুখ অ্যাসিডে পুড়েছে সেই মুখের অভিসম্পাত তোমার তরে নারী! তোমার তরে! যতগুলি খুন হয় তার পাপ তোমার, যতগুলি ছেলেমেয়ে নেশায় পুড়ে কয়লা হচ্ছে তার কালিমা তোমার গায়ে লাগে নারী! তোমার গায়ে!
নারী শোয়া কী জন্ম দেওয়া কী তা তো তুমি জানো, মা কী জানো?
তুমি আসলে খুব খারাপ, খুব পরস্পরবিরোধী, খুব ন্যাকা, খুব অবুঝ, খুব স্যাডিস্ট– খুবই মেয়েলি! এবং খুব বানরের মতো অনুকরণ করতে পছন্দ করো। খুবই পুরুষতান্ত্রিক! তুমি বোধহয় এভাবেই নিজেকে সর্বক্ষণ মেলে রাখো, – নিষ্পেষিত হওয়ার জন্য; খুব কামুক তুমি– পুরুষ ছাড়া কিছু বোঝো না– সে যা বলে যা করে তা-ই করো। সে ভালো বললে ভালো বলো খারাপ বললে খারাপ! হোক সেটা সুগন্ধি ফুলের কথা। তোমার চোখে ফুলের সৌন্দর্য আর ধরা পড়ে না। তুমি হও অন্ধ– পুরুষান্ধ। তুমি তো নিষ্পেষিত হবেই নারী, তুমি তো নিগৃহীত হবেই– নারী, তোমার জন্য করুণা হয় আমার।
চাবুক
তবু গ্রীষ্মের দুপুরই আমার প্রিয়। কই যাব না ভেবেই রিকশায় চড়ে বসতে ভালো লাগত দুপুরে। রিকশায় বসে যেসব ভাবনা আসত–জনসংখ্যা বাড়তির দিকে, লোকজনে গিজগিজ করে শহরের ভেতরের রাস্তাগুলো। খাটো চুল, লম্বা চুল, টাক মাথা এরা সবাই সেক্স করে। এমন একজনও নেই যে সেক্স করে না। কালো মেয়ে ফর্সা মেয়ে চাকুরে মেয়ে কামলা মেয়ে সবাই-ই সেক্স করে। এমন কেউ-ই নেই যে সেক্স করে না। হিজড়াদের সেক্স লাইফ জানি না। তবে তারাও সেক্স পায় বোধহয়। জানি না কেন ‘পায়’ শব্দটা এল।
সেক্স নাম শুনেই তোমরা নাক সিটকাবে। এই অবাধ তথ্য প্রবাহের স্রোতে সেক্স নিয়ে কথা বলা আর মল-মূত্র ত্যাগ করা নিয়ে কথা বলা এক পর্যায়ের অসভ্যতা। আগেও অশোভন ছিল শরম হায়ার বিষয় বলে। এই দুই অশোভন কালের মাঝে অল্প কিছু সময় গেছে, যেটা স্কিপ করে যাচ্ছ। সেক্স এডুকেশন। ঘোড়া কেনার আগে চাবুক কেনা যত হাস্যকর শোনাক, আগেই কিনতে হয় চাবুক। নইলে অবাধ্য ঘোড়া যে সওয়ারির বুকেই উঠে দাঁড়াবে না তা কে বলতে পারে! চাইলেই পারছ লোড করে নিতে চৌষট্টি কলা। চর্চাও করছ হরহামেশা। পুরুষ, সেক্স কী তাতো তুমি জানো, ধর্ষণের সংজ্ঞা জানো?
আবার, পুতুলজন্ম
আমাকে পুতুল পেয়েছ, তাই না? প্রসাধনী চাপা পড়া হৃদয়ের একটা একটা ব্রণ খুঁটিয়ে তুমি পুতুলকে করে তুলছ অপরূপা। আজকের এই ব্যথা ভবিষ্যতে ইতিহাস হবে। আজকের এই রক্ত কাল মুছে গিয়ে ফুটে উঠবে তোমার ফুটফুটে পুতুল। তোমার বুকে পুতুল ঘুমিয়ে ছিল এতকাল, পুতুল, ঘুম-জড়ানো চোখে দেখে– যুগ যুগের সাধনা সিদ্ধির অপেক্ষায়। মেলে রাখতে পারে না, পুতুল চোখ খুলে রাখতে পারে না, পুতুল বার বার তোমার নির্লোম বুকে ঘুমিয়ে পড়তে চায় শৈশবের মতো। পুতুল ভাবে– এই বুকে ঘৃণা নেই, এই বুকে সমাজ নেই, রাষ্ট্র নেই, ধর্ম নেই, নাস্তিক নেই, আস্তিক নেই, বউ পিটানো পিশাচ নেই– এই বুকে চব্বিশ ঘণ্টা একটা মাংসপিণ্ড পুতুল নাম পাম্প করে যায় তোমার পা থেকে মাথা। পুতুল ভাবে; এই বুকের যোগাযোগ পুতুলের প্রতিটা রোমকূপের সাথে, এই যোগাযোগ– এই পৃথিবীর নয়, যে মাটিতে গড়া তোমার বুক, সেই মাটিতে গড়া এই পুতুল তোমার।
তারপরও তো লোকে বলে, কেউ কি নিজেকে ঘুমন্ত দেখতে পারে? যখন কাম থাকে না তখন প্রেম কই থাকে? – কই থাকে? কাম যদি নাই-ই থাকে প্রেম কি প্রেম না? যদি শুধু কাম-ই তবে চোখে জল কেন আসে? কাম যখন না থাকে প্রেম তখন থাকে না, যখন প্রেম থাকে না তখন মানবজন্মে কী আর থাকে? যদি এ স্বপ্নই তবে, দেখব এমন স্বপ্ন, যদি এ ঘুমই তবে ঘুমাব জীবনভর।
কেবল আমি মুগ্ধ হয়ে আছি।।অথবা অনুভুতি সেই আগের মত করেই বলি
“কথা গুলি বিমূর্ত থেকে মূর্ত-, তারপর,
রেল গাড়ি হয়ে হুটে চলা, অনেক দূর…।
প্রথম ট্রেন দেখার অনুভুতি মনে নেই আজ
তবু সেই সোজা টানা রেখা্য অনেক্ষন যেমন-
ততক্ষন আটকে আছি ফসিল হয়ে, তোমার
প্রতিটি শব্দ-পাথরে, নেশা গ্রস্থ লাইন গুলিতে-
যতক্ষন না শেষ হল এই রেলের পথ চলা।”
simply beautifull
ক্রমশ আপনি আমার একজন প্রিয় কবি হয়ে উঠছেন।
Mukta,
I read your poems 15/16 days earlier at bdarts first.That series was beautiful. Here, I read ‘nari’ only just now and could not resist myself from telling you my reaction to the poem. A line like, ‘Nari shoa kee jonmo deya kee ta to tumi jano, maa kee jano?’, generally is the peak point of a poem. One, i mean the poet just has to maintain the descend (whether it is balanced with the riding) from the peak while dealing rest of the poem. The poem had the very potentiality to be good one, but the last stanza killed the spirit. I mean no offence, it is MY observation only.
Over all you kick-off is a real one and nice to read. I hope and pray your success in this field.
Now I am going to read the other poems and already being thrilled as i’ve started liking your poems.
….Tariq Al Banna
PS: Another thing, don’t you ever count the number of comments. The best decision, according to me, is not to pay any serious attention to who says what, if not you don’t read them at all.
Ora tomar matha kharap kore debe.
Asola amra akhono nare r purosar vatory ache…..kinto ar bayra ja pokrete r tar bisalota acha ta akhono dakta paccena………….toba lakhagolo nalo lagacha
apurbo.oshadaron chilo.
লেখাগুলো অদ্ভুত, খুব শক্তিশালী গোছের। কিন্তু ঘুরে ফিরে একটি জায়গাতেই হিট করছে, মডার্ন সিভিলাইজেশন। আর এর মাধ্যম হিসেবে আপনি নিয়েছেন সেক্স। কিন্তু এটা ছাড়া কিন্তু আরও অনেক উপাদান আছে জেমনঃ অর্থ, সামাজিক মূল্যবোধ, চারিত্রিক স্খলন, ভালবাসা ইত্যাদি। তবে আমি আপনার শুভ কামনা করছি।