সাগুফতা শারমীন তানিয়া
ভেসে যাই, পরিণামসিন্ধুজলে
আমার কেন যাচ্ছেতাই সব জিনিস অসময়ে মনে পড়ে সেটা কে বলবে?
ফেইসবুকে অন্যে লেখে─ মাশাল্লা হ্যাপি ফ্যামিলি, ছবিতে প্রজননক্লান্ত মা আর হাসির চকমকি ঠোকা বাপের কোলে নবজাতক, আমার কেন মাশাল্লা─ হ্যাপি ফ্যামিলি মনে হয় না, কেন মনে হয়─ ‘কেউ মরে বিল সেঁচে/ কেউ খায় কই’
যশুয়া আমাকে একটা রোমানেস্ক গীর্জা দেখাতে নিয়ে গেছে। আগের রাতে ওর সাথে বসে দেখেছি ‘ক্যাসাব্লাংকা’। গীর্জার ভিতর থমথম করছে বরফকলে জমানো নিস্তব্ধতা। সারি সারি উপাসক-উপাসিকা। রঙিন কাঁচের জানালা আর মোমবাতি। উপাসনাগীত শুরু হলো। আমি যশুয়াকে বল্লাম─ “এই এই, এরা কি গাইছে? আমার কানে কেবল ক্যাসাব্লাংকার স্যামের ‘উই আর ইন ট্রাবল’ বাজছে…আমি কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে গেয়ে ফেলব…”
যশুয়া বিপর্যস্ত মুখে আমাকে টেনে বের করে আনে, “প্লিজ, উই উইল বি ইন রিয়াল ট্রাবল যদি এখন এই প্রার্থনাসংগীত ভেঙে তুমি গেয়ে ফেল এটা…”
যশুয়া আমাকে পাড়ার লাইব্রেরিতে বাচ্চাদের রাইমটাইম দেখাতে নিয়ে গেছে। আমাদেরও যেন বাচ্চা আছে, আমরাও যেন অনেক সুখী হ্যাঁ এইরকম ভাব করে আমরা আর সব মা-বাবাদের পাশে পা গুটিয়ে মেঝেয় বসি। রাইমস শুরু হয়। একসময়─ ‘ও দ্য গ্রান্ড ওল্ড ডিউক অফ ইয়র্ক’ শুরু হয়…
And when they were up, they were up,
And when they were down, they were down,
And when they were only half-way up,
They were neither up nor down.
আমি সমবেত সংগীতের উপরে একটা শূন্য ক্যানোওর মতন ভাসতে ভাসতে দুলতে দুলতে হঠাৎ ভেবে ফেলি─ এটা তো আমার মুডের সংগীত। কিংবা, আরে, এটা ইরেকটাইল ডিসফাংশনগ্রস্ত পুরুষের জাতীয় সংগীত…যশুয়াকে বলতেই সে গুম করে কিল বসায় আমার পিঠে। ফিসফিসিয়ে বলে─ “আর একটাও কথা নয়। উঠে এসো।”
অতএব আমার মুখর অসম্বৃত মন নিয়ে আমি বড় আতান্তরে পড়ি।
১
জেগে উঠে কেন জানি না আমার কানে রাগ ভূপালী বাজতে লাগলো। ইত্না যোভান্ দা মান্ না করিয়ে–এ–এ–এ… এই এতখানি ছোট্ট যৌবনের অভিমান করো না, গর্ব রেখো না…ছোটবেলায় গানের স্কুলে যখন লক্ষণগীতের ভাষাই বুঝতাম না, দ্রুতবন্দিশের মতন কোঁকড়া চুল পিঠে মেলে তখন ভূপালীতে এই লাইনে নিচের সা থেকে তারার সা-তে যেতে গিয়ে চোখ চলে যেত জানালার হলুদ বিকেলের আকাশে, মনে হতো, যৌবন বড় হাহাকারময় বস্তু, এর জন্যে রেলওয়ের ফেঁড়ে ফেলা কোনো ধূলার মাঠে বসে দেহাতি কোনো নারীর হৃদয়ফাটা কান্নার সুর বুঝি এটা। পাশের ক্লাস থেকে ভেসে আসতো, ‘আঁখিয়া–আ–আ লাগি’, আশাবরীর সুর, সেও যেন বিরহীর আর্তনাদ। বিরহ বুঝতাম নাকি তখন? ‘গাও হে কাফী রাগ হারা–প্রিয়ে…পঞ্চম বাদি সুর সমবাদি’…প্রিয় হারানোর বেদনা ঠিক কত বছর বয়স থেকে সক্রিয় হয়? (আচ্ছা, পরে শুনেছি এটা ‘হারাপ্রিয়ে’ নয়, ‘হরপ্রিয়ে’) ‘আলমপিয়া রহে কওন বিদেশভা…কাগুয়া তু যা যা রে লাও সন্দেশভা’…আমরা হেসেই কুটিপাটি, কাককে সন্দেশ খাওয়াবার আহবানে।
২
আমার জ্ঞান ফিরেছে বলে সাইকিয়াট্রিস্ট মহিলা এসেছেন, রুটিন ভিজিটে। নরম গলায় প্রশ্ন করছেন─ “তুমি যা করেছ, তা নিয়ে এখন কি কথা বলতে চাও?”
─ “না চাইনা।” (মনে মনে)
─“বলো, বলতে চাও? আমরা কি এই নিয়ে একটু আলাপ করতে পারি?”
─“আলাপ, সেকি? আলাপ প্রলাপ অপলাপ বই তো নয়। তুমি কি দেখনি আমি কখনও চিরকুট লিখিনি। এভাবেই কিনা জানিয়ে যেতে চেয়েছি, তোমাদের আমি পুঁছি না…এখন আলাপ করে আমার যোভান দা মান কেন ভাঙব? বলো বলো বলো?” (মনে মনে)
─ “তুমি কি আমার কথা শুনতে পারছ? বুঝতে পারছ? আমি কি আরেকটু আস্তে কথা বলব?”
(এইখানে এই দ্বীপখানা ঘিরে সমুদ্র। কেমন এ সমুদ্র…সর্বপ্লাবী অহর্নিশ বলে যায় হ্যাঁ তারপর না, তারপর না, না (পুনরপি) আর না, বলে হ্যাঁ, নীল করে বলে হ্যাঁ, ফেনিল করে বলে হ্যাঁ, আক্রোশে ফুলে উঠে বলে না না এবং না, একটুও স্থির না হয়ে, তুতলিয়ে বলে─ আমার নাম সমুদ্র।)
─ “নাহ। শুনতে পাচ্ছি। বুঝতেও পারছি।” কঁকিয়ে উঠি আমি, যেন বুঝতে পেরে আমার যন্ত্রণা হচ্ছে। আসলে যন্ত্রণা হচ্ছে না ঠিক, পার্সিফোনি একবার বলেছিল নাকি, সে হাসিকান্না-বিমুখ, আর যেসব পুরুষ হাসে-কাঁদে সেসব পুরুষ-বিমুখ? আমার সেইরকম লাগছে। কে জানতো, পাতালের একটিমাত্র ডালিমদানার এমন স্বাদ।
সাইকিয়াট্রিস্টের কানের দুল─গলার হার─হাতের আংটি সব জ্বলজ্বল করছে, পারদের মতন উজ্জ্বল কী একটা ধাতুর গহনা সব। দেখতে ভালই লাগছে আমার, চোখে একটু বিঁধছে। সাইকিয়াট্রিস্টের গলার আওয়াজও পারদের মতন। উজ্জ্বল, নিরেট, শিসের শব্দের মতন ধাতব। কানেও একটু বিঁধছে। শাদা কটনের কাপড়ে আর কুরুশকাঁটায় বোনা লেসের টপ মুড়ে রেখেছে তার কোমল বুক, বিঁধছে না।
(পাথরগুলোকে চাঁটি মেরে মেরেও যখন মানাতে পারে না, তখন আলতো করে চাপড় মেরে মেরে আর ভিজিয়ে দিতে দিতে আর চুমুতে ভিজিয়ে দিতে দিতে)
সাতখানা সবুজ জিভ দিয়ে
সাতখানা সবুজ কুকুরের সাতখানা সবুজ জিভ দিয়ে
নয় সাতখানা সবুজ বাঘের সাতখানা জিভ দিয়ে…
বুকটা থাবড়ে থাবড়ে নিজের নাম তুতলিয়ে বলতে বলতে…)
─ “কি করেছ তুমি? কেন কিভাবে করলে একটু বলবে?”
─ “আহ, এই নিয়ে তিনবার এই ঘ্যানানি শোনাতে হলো…” (মনে মনে)
─ “তোমাকে কি প্ররোচিত করলো এমনটা করতে?”
─ “বলবো না, যা যা।” (মনে মনে)
আরেকটু দেখতে দেখতে আমার মায়া হলো, আমি একটু সুস্থির মাথায় তাকে একটা গল্প বলবার জন্যে তৈরি হলাম। নড়ে চড়ে শুতে গিয়ে হাতের ক্যানোলার সুঁইগুলি-ঘাঁইগুলি বিষম বেদনা করে উঠলো। আর একবার দুলে উঠলো মাথার ভেতরটা।
(এত জোরে মের না,
এত জোরে চেঁচিও না,
তোমার সবুজ পেটিকা খোলো, আর আমাদের হাতে দাও রজত উপহার।)
পিটপিট করে তাকিয়ে আমি তার বুকের কাছে নাম লেখা ফলকটুকুর একটু পড়তে পেলাম, লোপেজ।
─ “হ্যাঁ, মনে পড়েছে, ইয়ে আমার খুব দুঃখ হচ্ছিল।”
─ “কি নিয়ে দুঃখ হচ্ছিল?” ওর মুখটা নুয়ে আসে আমার মুখের কাছে। আমি কোলনের আবছা সুবাস পাই।
─ “অনেককিছু নিয়ে। আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। আমার জীবন আমার কাছে খুব ভার হয়ে উঠেছিল।” (মুরোদ থাকলে এই শোলক ভাঙা। বন থেকে বের হৈল টিয়া / সোনার টোপর মাথায় দিয়া মার্কা উত্তর দেব এখন। পারলে ভাঙা।)
─ “তখন কিছু হয়েছিল নাকি অনেক আগে? নাকি অনেকদিন ধরে?”
─ “অনেকদিন ধরে বেঁচে আছি এইটাই তো মরার যথেষ্ট কারণ, নাকি?” (মনে মনে)
─ “বলো। বলো। অনেক আগের কিছু না ঘটনার দিনই কিছু?”
─ “অনেকদিনের। জমতে জমতে জমতে জমতে…”
─ “তোমার শৈশব কেমন ছিল? আনন্দের? নাকি বেদনার? কোনো ট্রমা?”
হেহে, আমার শৈশব আনন্দের ছিল, বলবে আমার মা, ঠিক ক্যাথরিন্ হেপবার্ণের মতন ইস্ত্রি দিয়ে কাপড় পুড়িয়ে ফেলতে ফেলতে আনমনা হয়ে আনন্দাশ্রু মোচন করে করে বলবে না হয়তো (গেস হুজ কামিং টু ডিনার)। ছোটবেলায় যারা কাঁদেনা তারা নাকি বয়স হবার পর অশ্রুসাগর বায় কেবল… তার ওপর আমি কিনা বুধবারের শিশু। ইংরেজি প্রবাদমতে কেঁদে-কঁকিয়ে জীবন কাটাবার কথা আমার।
─ “বলো, সোনা, তোমার শৈশবে তোমাকে কেউ অ্যাবিউজ করেছিল?”
─ “উঁ?” কোনটা অ্যাবিউজ? হাতের লেখা ভাল হচ্ছেনা বলে বেতের বাড়ি? মামা কিংবা কাকার কোলে বসতে গেলে মারধোর? রাস্তায় রিকশায় লিফলেট বিলি করা লোকের চকিত খাবলা? কোনটাকে বলে অ্যাবিউজ?”
─ “কেউ তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিল? মন কিংবা শরীর, তোমার মন কিংবা শরীরের অসম্মান করেছিল?”
বাহ, বেশ তো। আমার মনের আমার শরীরের সম্মান ছিল তাহলে। আমার রীতিমত পরিতাপ হচ্ছে এটা জানতাম না বলে।
─ “বলো, তুমি যা করেছ, তাতে কি তোমার পরিতাপ হচ্ছে?”
─ “রীতিমত পরিতাপ হচ্ছে। পরিবেদনা হচ্ছে। আর করবো না।” হেহে, একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি…
─ “তোমার বেড়ে ওঠা দুঃখের ছিল? যৌবনকাল?”
─ “ছিল।” এইবার আমার অনেকগুলি কথা মনে পড়ছে, আর সেগুলির প্রত্যেকটির জন্যে আমার চোখে পানি আসছে। যৌবন বড় হাহাকারময় বস্তু…
─ “তুমি কি আবার এইরকম করবে?”
─ “এটা কি রকম প্রশ্ন…আমি রেকারিং ডেসিম্যালের মতন ফিরে ফিরে আসব…একদিন তো ভাগফল মিলবে, কোথাও গিয়ে। তারপর আর আসব না।” (মনে মনে)
ওর পারার মতন গলতে থাকা জ্বলতে থাকা কানের দুলের দিকে চেয়ে বলি─ “নাহ, আর করব না। আর কখনও করব না।” তোমায় কি করে বলি, যার নাম ছিল না, লোক ছিল না, শোক ছিল না, শবযাত্রা ছিল না, আমি তার জন্যে একাই সভা করতে এসেছি। নীরবতা পালন করতে এসেছি। চিরনীরবতা।
আমার চারপাশ থেকে হাসপাতালের দেয়াল গলে গলে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। রৌদ্রে ঝাঁঝাঁ দুপুরে পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছি। বেঞ্চির উপর কে গরম ইস্ত্রির ছাপ বসিয়ে গেছে। এখানে গরম ইস্ত্রি কি করে এলো? আশপাশে উড়ছে কালো ডুমো ভোমরা, জেরুজালেম সেইজের একটা ঝোপ রোদে পুড়ছে, আকাশে শাদারঙ নিঃশব্দ উড়োজাহাজ। লেপার্ডপ্রিন্টের কাপড় পরা একটা পূর্ব-ইউরোপিয়ান মহিলা হেঁটে সামনে দিয়ে চলে গেল, মুখে একেবারে শিকারীবেড়ালের ছাপ, পায়ের ফেটে-পড়া কালো টাইট্স্টা গরুর মাংসের চেকনাইয়ের মতন লাগছে।
৩
প্রথম যেদিন জেলখানায় ঢুকেছিল সে, তার ঠিক কেমন লেগেছিল সেটার আকার নেই। একটা ভয়, একটা সংশয়, মনঃসংযোগ করতে না পারা একটা দোলাচলময় মাথা নিয়ে ঢুকে গেছিল জেলের কবাটের ভিতর। (কিন্তু এভাবেই কি সে সবকিছুর ভেতর প্রবেশ করেনি? সম্পর্ক। সন্দেহ। বিচ্ছেদ। সবকিছু!) আগের রাত থেকে যশুয়া তাকে ভয় দেখাচ্ছিল, “দেখবে ‘সাইলেন্স অভ দ্য ল্যাম্বস’ এর জেলখানার মতন হৈহৈ করছে ভয়ানক সব লোক, কি সব ছুঁড়ে দেবে কূল পাবে না পালিয়ে…” সেসব কিছুই হয়নি। বৃষ্টিভেজা কাদাপ্যাচপ্যাচে একটা ধূসর দিনে একটা বিবর্ণ জেলখানায় ঢুকেছিল সে।
তল্লাশির পর সওয়াল জবাব।
─ “সঙ্গে মোবাইল নাই?”
─ “নাই।”
─ “ইউ এস বি স্টিক? ক্যামেরা? ল্যাপটপ?”
─ “নাই।”
─ “ছেঁড়াফোঁড়া যায় এমন কিছু। এই ধরো গে নেইলকাটার। ছোট ছুরি। সুঁই।”
─ “নাই।”
─ “চুইংগাম?”
─ “নাই।”
─ “গাঁজা? চরস? আফিম? গোলাবারুদ? পিস্তল?” (বেশ মজা পেয়ে)
─ “নাই। ডিনামাইট আছে শুধু, চলবে?”
হাসিখুশি মন্থর কিছু প্রিজন অফিসার গ্রাঁ প্রি নিয়ে জেরবার হচ্ছে। মহিলা প্রিজন অফিসারদের হাতময় উল্কি, কলপ করা চুল, গা চুলকোচ্ছে, ঘ্যানরঘ্যানর করছে বিবাহবিচ্ছেদে যথেষ্ট খোরপোশ পায়নি এই নিয়ে। এইসব সে জলে সাঁতার দেবার মতন পার হয়ে যায়।
একের পর এক করিডোর। তাতে একের পর এক দরজা। প্রতিটা দরজা খুলবার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায় বা বন্ধ করে দিতে হয়, জীবনে আনন্দের উৎসমণ্ডলীর মতন। ‘কোটি করাঘাত পৌঁছুক দ্বারে ভীরুরা থাক’… প্রতিবার দরজার তালা দেবার সময় কেন তার এই লাইনটা মনে পড়ে? (কবেকার সুকান্ত! বেঁচে থাকলে এখন তার বয়েস কত হতো? নাতি আর খোকাপুতুল নিয়ে খেলতো সেও? তাহলে তো আর অপূর্ণ সম্ভাবনার বিষাদ মেখে কেউ গালে হাত দিয়ে বসে থাকত না বইয়ের পাতায়। মৃত্যু কী মহিমময়।)
দেয়ালে দেয়ালে কয়েদিদের হাতের কাজ শোভা পাচ্ছে। ফেজেন্ট আর ময়ূরের পালক সেঁটে করা একটা নীল আর পিঙ্গল চক্র। ফোঁটা ফোঁটা রঙ জুড়ে আঁকা ট্রাইবাল পেইন্টিং। আসান্টি প্রবাদ লেখা─ “দু’খানা ছোট এন্টিলোপ দিয়ে বড় একখানাকে যোঝা যায়।” আর হায় ঈশ্বর, স্তন। ঈশ্বরের হাত থেকে অ্যাডামের হাত স্খলিত হবার বিখ্যাত ছবিতে আদমের বদলে পীনোন্নত পয়োধরা ক্ষীণকটি হবা। গুস্তাভ ক্লিম্পট এর ছবির নকল, তাতে কারুকাজ করা জামার ফাঁকে গোলাপি বিশাল স্তন। কিউবিস্ট পেইন্টিংএ স্তন। প্রির্যাফ্যায়ালাইটদের বিষণ্ন নারীর পেইন্টিংগুলিতেও স্তন। সারি সারি প্রিজনসেল এর দরজায় উঁকি দাও, দেয়ালে পেপারকাটিংএ ফলে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ স্তন। শাদা। কালো। বাদামি। নিষ্পাপ স্বাস্থ্যে ফুল্ল স্তন গভীর স্নেহে গাঢ় চোখে তাকিয়ে আছে কয়েদিদের বিছানায়। (দু’খানা করে ছোট এন্টিলোপ একটা বড় বেদনাকে যুজছে?) সে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল কি?
তারপর কত কত দিন। এই জেলখানায় এসেছে সে। জলকাদাময় আস্তাবলটার পাশের রাস্তা দিয়ে, বনের দিকে বেঁকে যাওয়া রাস্তাটা ধরে। জেলখানায় ঢুকে ঠুকে ঠুকে বরফ ফেলেছে বুটজুতো থেকে। রোদের দিনে গুনগুন করেছে। বাড়ির পথ ধরবার সময় দেখেছে মরচেরঙা ওয়ালফ্লাওয়ার ফুটেছে গোছা গোছা। ব্লিজার্ডের দিনে দুঃস্বপ্নের মতন চড়াইয়ের রাস্তা দিয়ে শরীরটাকে টেনে টেনে হাঁটতে গিয়ে দেখেছে আকাশজোড়া বিদেহী মেঘ।
উইংএ কয়েদীদের কেউ একজন এসে দেয়ালে সাঁটা বিশাল আয়নার সামনে চেয়ার টেনে এনে বসেছে, দাড়ি কামিয়েছে, চুল ছেঁটেছে। মুখটা অমায়িক। বিপুল চোখ ভর্তি হাসি।
কারো সাথে একঘন্টা ইন্টারভিউ শেষে করমর্দন শেষে উইং থেকে অফিসে ফিরে জানতে পেরেছে সে, লোকটা লিথুয়ানিয়া থেকে পালিয়ে এসেছে, কাকে যেন ধর্ষণ করে।
নয় ইকুয়েডর থেকে ঝাড়া হাতপা চলে এসেছে কুড়ি বছর আগে, আর ফিরে যায় নাই, জানে না প্রিয় সন্তানদের মুখ এখন কেমন। তারা আর দড়িলাফ খেলে কি না। এখনও গরম মাখনের গন্ধ ভালবাসে কি না।
একদিকে রুমানিয়ার আব্দুল খান ফিচফিচ করে কাঁদছে, সে কিছুতেই পাকিস্তান যাবে না─ না না কী নোংরা মানুষজন, নোংরা বাচ্চারা উদোম হয়ে নোংরা নালার পাশে নোংরা হাগু করছে (পাকিস্তানী কুটনীতিক পরিবার তাকে দত্তক নিয়েছিল রুমানিয়ায়, বলেছিল তারাই তার বাপমা, বলেছিল ‘কল্যাণমস্তু’, নিজেদের মতো করে…), আর একদিকে কেউ বিকারহীন টেবিলটেনিস খেলে চলেছে।
রুপালি চিকচিকে চুল। পাউডার ব্লু টিশার্ট। রোমশ খাটো হাত। চৌকো মুখ। সাকোস্কি তাকে হেসে হেসে বলেছিল─ পোল্যান্ডে পানির পাইপ কেন ভূপৃষ্ঠের তলায় থাকে। এমনকি বাইরে হিসু করতে গেলেও কিন্তু বিপদ। শুনে সে খুব হেসেছিল, সাকোস্কি সগর্বে বলেছিল─ সে ডর্চেস্টার হোটেলে বিয়েটিয়েতে ছবি তুলতো। সে তাতেও খুব হেসেছিল। (পুষিবেড়াল রানীকে দেখতে যায় বটে, ফিরে আসে চেয়ারের তলার ইঁদুর দেখে। সাকোস্কি─ অ্যাডাল্ট ইমপ্রিজনমেন্ট উইদাউট অপশন, ড্রয়ারে রেখে রেখে স্ত্রীর আঙুলগুলি ভেঙে দিয়েছিল লোকটা।)
পুলটেবিলে পোলিশদের ঝগড়া লেগে থাকে অহর্নিশ। মারপিট করবার সময় জামার আড়াল থেকে বেরিয়ে পড়ে অজস্র তিল। গরম চিটাগুড়ের ঝাপটা লেগেছে─ এমন দেখতে সব ক্যারামেলরঙা তিল।
জেল বড় যৌন আবহে গনগনে স্থান, নির্বিবাদে স্নান সেরে তোয়ালে কাঁধে ফিরছে আদুলগায়ে পুরুষমানুষ, তাদের পরিষ্কার শরীরের, সাবান-ধোয়া কাপড়ের গন্ধে, উইং ভরে ওঠে, স্নানঘর পার হবার সময় গরমজলের ভাপ এসে লাগে নাকে। সে উইংএ চাবি ঘুরিয়ে লোহার ভারি দরজা ঠেলে ঢোকে, বেটাছেলেরা দেখিয়ে দেখিয়েই সিঁড়ির রেলিং ধরে ঝুলতে শুরু করে, হাতের ওপর তুলে নেয় সারা শরীরের ভার, বের হয়ে আসে কোমরের হাড়, উটপাখির ডিমের মতন হাতের পেশী। পেশীর উপর চুলকানির ফলে সদ্য উদ্গত একবিন্দু চুনির মতন রক্ত।
কিন্তু তোমাকে ডাকবে সোহাগ ঢেলে একেবারে কিন্ডারগার্টেনের শিশুর মতন, ‘মিস! ও মিস!’ সে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করতো─ “বলো, তুমি মদ খেয়ে মাতলামো করা ছাড়বে কি না, নইলে আমি এই গেলাম, তোমার আর হস্টেলে সিট পেতে হবে না!” হস্টেল মানে ভবঘুরেদের থাকবার হস্টেল। কাতর চোখে পিটপিটিয়ে তাকিয়ে নিকোনোভ নয় জিনকিয়েভিচ বলতো─ “মিস, তুমি গৃহহীন হয়ে রাত কাটিয়েছ? জানো, মদ-টদ ছাড়া ঘরছাড়ার আর কী থাকে?” “বাড়ি যাও না, নিকোনোভ, (তুমি আর ফাহাদ আশরাফ আর ইরিত্রিয়ার নাম ভুলে যাওয়া লোকটা আর যারা সেলের ভিতর পড়ে দিন গুনছো…কেঁচোর পৃথিবীর মতন মন্থর সময় কাটাচ্ছ…) তোমার মা, তোমার সৎ বোন?” বাড়ির প্রশ্নে রোঁয়া ফুলিয়ে বেড়ালের মতন কুঁজো হয়ে যেত নিকোনোভ─ “তাহলে তুমি আমাকে বাড়ি দিচ্ছ না?” “আহা বাড়ি কি গাছে ধরে? কাকভেজা হয়ে যেখানে ফিরতে ফিরতে গৃহী মানুষের মন একরকম আভায় ঘনিয়ে ওঠে─ ওমে ভরে ওঠে, বলো, সেটা কি গাছে ধরে?”
এডুকেশন ইউনিটে এরা অংক কষে, ইংরেজি শেখে। ইমারত নির্মাণ কৌশল শেখে। পানির পাইপ মেরামত করা শেখে। সে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে─ “ইম্যানুয়েল? আছে এখানে? ম্যাডাম, আপনার ক্লাস থেকে ইম্যানুয়েলকে একটু সময়ের জন্যে নিতে পারি?” ক্লাসের কোনো এক দুষ্টবুদ্ধি পড়ুয়া চিকন গলায় বলে ওঠে─ “একটু সময়ের জন্যে কুলাবে না, সারারাতের জন্যে নাও।”
হর্টিকালচার ক্লাসে চীনারা বড় মনোযোগী। খুরপি দিয়ে কেয়ারির মাটি কোপাচ্ছে। বাঁধাকপি আর আলু তুলছে। ফলাচ্ছে ওয়াটার-ক্রেস আর ল্যান্ড-ক্রেস। তুরতুরিয়ে ঢুকছে আর বেরুচ্ছে গ্রীনহাউজ থেকে। যেন মানুষ-আকারের বীভার ওরা।
লন্ড্রী থেকে পরিষ্কার লিনেনের গন্ধ আসে একদমকা (সেই গন্ধে একাকার হয়ে আছে পালের মতন ফুলে-ওঠা ধোয়া চাদর─নীল আকাশ─বাতাসে উড়ন্ত শনের নুটির মতন ‘বুড়ির-চুল’ আর জেট গুঁড়াসাবানের দাঁত-উঁচু ববচুলো মেয়েটা)। এখানে জেলখানার ভিতরে শীতের দুপুরে রোদে মেলে দেয়া ভেজা কাপড় আর তিব্বত পমেডের গন্ধ পায় সে। দিনমান। কেন যে! (এমন বয়েসে কেন পৌঁছাই মা, যখন ‘উলসিত তটিনী-ঈ-ঈ-ঈ-ঈ-ঈ-ঈ-ঈ’ টান দিয়েও মন ভাল করতে পারি না?)
চঞ্চলচক্ষু আর শিশুর মতন হাসিতে ভরে যাওয়া মুখের ভিয়েতনামিজরা উদাসমুখে উইংএর করিডোরে হেঁটে বেড়াচ্ছে, এমন যেন ছুটি কাটাতে এসেছে। ছুটি ফুরোলেই যেন কিছু হয়নি তেমনি মুখ করে ফিরে যাবে একবাটি ধুমায়মান ফো’এর কাছে। বেশিরভাগই এসেছে ক্যানাবিস বেচবার অপরাধে, এরা প্রত্যেকে জানে এদের সোজা দেশে চালান করে দেয়া হবে। আচ্ছা, এইরকম নিশ্চিত করে জানলেই কি নির্ভাবনায় থাকা যায়? মাতৃগর্ভে ভ্রু কুঁচকে থাকা ভ্রূণ যখন জানে তাকে হত্যা করা হবে, তখন কি তারও এমন ভাবনাহীন মুখ হয়? সেও অন্ধকার কারাকক্ষে ভাসমান থাকে নির্বিঘ্নে, অন্যের সিদ্ধান্ত সহজে গ্রহণ করবে বলে তার ভ্রুকুটি নিভে আসে? সেও কি একগাল হাসে? পাথরগুলোকে চাঁটি মেরে মেরেও যখন মানাতে পারে না, তখন আলতো করে চাপড় মেরে মেরে আর ভিজিয়ে দিতে দিতে আর চুমুতে ভিজিয়ে দিতে দিতে? (মিসেস লোপেজ, তার জন্যেও কি কোথাও ধুমায়মান বাটিতে সুখাদ্য অপেক্ষা করে আছে? বলো না মিসেস লোপেজ, যার লোক নেই, শোক নেই, শবযাত্রা নেই, তার জন্যেও কি অপেক্ষা করে আছে কিছু?)
৪
অ্যান্ড ডাউন উইল কাম বেবি, ক্র্যাডল অ্যান্ড অল…
আমার সবসময় মনে হতো আদি মহাদেশের মতন অবিভাজ্য হৃদয় নিয়ে শিশুরা জন্মায়। আমার খালাতো বোন ছুটাবুয়ার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রঙপেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতো। কালো তেলতেলে বাচ্চাটা মুখে বুড়বুড়ি কাটতো। কী সুন্দর সে দৃশ্য।
আমি যখন প্রথম লিওনেলের ইন্টারভিউ নিতে আসি, তার মুখে এইরকম অপরিশুদ্ধ-অবিভাজ্য কী যেন ছিল। সেটা বৈদ্যুতিক ছিল না, কিন্তু তা আমাকে স্পর্শ করেছিল খুব। দীর্ঘকায় যুবক, চশমা চোখে (জেলে সহসা দেখা যায় না) আর চশমার পরকলার তলায় উদাস চোখ (জেলে কদাচ দেখা যায় না। জেলখানা তো চকিত চাহনির স্থান, চকিতে তাকিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলবার স্থান।) সদ্য জন্মানো কোনো কিছুর নবীন বিস্ময় তার গায়ে মাখানো। আমার মনে হয়েছিল─ “এই যে, তোমার গল্পটা কি, বলো দেখি?” না, সে অনিচ্ছুক নারীপুরুষ গমন করে নাই, কাউকে আঘাত করে নাই (কী যে মজার আইনের ভাষা, গ্রীভাস বডিলি হার্ম উইথ অ্যান ইনটেনশন টু ডু গ্রীভাস বডিলি হার্ম), শুধু কাকে যেন বলেছে─ “গোপাল, চরাওগে বাছুর!” আশ্চর্য, আমার তার অপরাধের বিন্দুবিসর্গ মনে নাই।
সে যখন কথা বলতে শুরু করেছিল, ধীর-নিবিড় গলার আওয়াজ, আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম─ “তুমি এখানে কেন?” (সাধারণত আমি জিজ্ঞেস করি─ “কি রে, কি করেছিস?” আমার গলায় রগড় থাকে, চোখে থাকে ঝিলিক, পিঠের হাড় শিকারী প্রাণীর মতন আত্মরক্ষার জন্যে তৈরি থাকে।)
আমার প্রশ্নে তার চোখ ছলছল করে উঠেছিল। (যেমন করেছিল ইরান থেকে পালিয়ে আসা নওরোজি আলি রেজার? বা জর্ডান থেকে পাসপোর্ট ছাড়াই প্লেনে উঠে যাওয়া ফাহমাওয়ির? একটি ইংরেজি শব্দ বলতে না পারা লিবিয়ান লোকটার, হাত মেলে দলামোচড়া একটা শিশুর ছবি দেখিয়েছিল আমাকে সে। আমি তো চোখের জল আকছার দেখি। তাহলে?)
বাড়ির প্রশ্নে একবার হেসেছিল সে। লিওনেল হেসেছিল, কারণ তার সন্তান সংখ্যা পাঁচ। একটু অপ্রতিভ হয়ে হেসে ফেলেছিল সে। আমি অবাক হয়ে আমার হাতের ফর্মে তার বয়েস আবার একবার দেখেছিলাম।
বাচ্চার প্রশ্নে হেসেছিল সে (হাসিতে তার চামড়ার তলায় জলের নীচের মনির মতন আলো জ্বলে উঠেছিল!)। দু’টি সন্তান আগের পক্ষের। বাকি তিনটে এখনকার সঙ্গিনীর। আমি সঙ্গিনী শব্দটাও শুনি নাই কেন? সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে বারে বারে গাইতে থাকা রাতের পাখি আমার রক্তে ঢুকিয়ে দিয়েছ তুমি বুড়ো লোকটা, তোমার আর কাজ নাই?
(কেন আমি ভুলে গেছিলাম লাল চেয়ারে সে বসে ভিজিটিং আওয়ার্সে, তাকে ঘিরে নীল চেয়ারে বসবার লোক আছে?)
আমার তাকে প্রথমদিনই কেন এত আবাসিক মনে হয়েছিল? মনে হয়েছিল গুটিপোকা হয়ে ওর পেটে ঢুকে যাই, প্রজাপতি হবার প্রলোভনেও আর বের হবো না। কিংবা ও আমার পেটে ঢুকে যাক। আমার শংকরধাতু হতে ইচ্ছা হয়েছিল। আমার মিথোজীবী উদ্ভিদ হতে ইচ্ছা হয়েছিল। সবরকম নিষেধ ডিঙিয়ে আমার এক মরসুমের জন্যে ওর ডালপালার বাসায় গিয়ে ডিম পেড়ে আসতে ইচ্ছা হয়েছিল। কী হলে জীবিত প্রাণী আরেক জীবিত প্রাণীর সাথে চিরতরে জড়িয়ে যায়, তার সব করতে ইচ্ছা হয়েছিল। কেন? (আমাদের তো উইং থেকে ফিরে জীবাণুনাশক দিয়ে হাত ধোবার নিয়ম, প্রতিবার। যশুয়া তুমি কি খুব অবাক হবে? খুব আঘাত পাবে? যদি জানো আজ সকালের পর থেকেই আমার পৃথিবী এমন করে বদলে গেছে। কিন্তু একটা কথা বলো, প্রেম এবং পরবর্তী প্রেমের মাঝখানে যদি যথেষ্ট সময়ের ফারাক না থাকে, তাহলে আমরা কেন বিচলিত হই? এমনকি মৃত মানুষের জন্যেও তো এই আমরাই নীরবতা পালন করি মাত্র একমিনিট?)
উৎসর্গ: পাবলো নেরুদা, করেস্তেলিয়েভ আর কয়েদখানার নিত্যপ্রহরী চার্লি
লন্ডন ইস্ট,
৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১২
Teebro kichhu bodhke ebhabe sgobde tule anlan apni……apni kono uponnash likhechhen?