ইচ্ছাপূরণের দেশে – ১
মাসুদ খান
লং শট: জনশূন্য শস্যহীন প্রান্তর। খরায় ফেটে চৌচির। সময় – খাঁ-খাঁ দুপুর। নির্মেঘ আকাশ। ঝাঁ-ঝাঁ রৌদ্র। একা একটি ঝাকড়া গাছ। ক্যামেরা জুম ইন করতে করতে ফ্রেমের মধ্যে গাছ, একটি ছোট্ট পুকুর। স্বচ্ছ পানি। পুকুরের চারিদিকের পাড় খরায় পোড়া। তবে পুকুরের কিনারের পানিতে কলমিলতা, হেলেঞ্চা, থানকুনি, শাপলা এসবের লতাপাতা।
জুম আউট। ফ্রেমে আবার সেই বিশাল প্রান্তর। দূর থেকে একজন আলপথে হেঁটে আসছে। ধীরে ধীরে অবয়ব স্পষ্ট হবে। একজন বৃদ্ধা ভিখারিণী, হাতে বহুবক্র একটা লাঠি। পরনে সবজে-নীল রঙের ময়লা শাড়ি, জায়গায়-জায়গায় তালি-মারা। তবে চোখে হাল ফ্যাশনের একটা কালো সানগস্নাস, যা তার চেহারা আর পোশাক-আশাকের সঙ্গে বড় বেমানান লাগবে। হালকা-পাতলা শনের মতো কয়েক গোছা চুল। মুখে বলিরেখা। দাঁত-পড়া বৃদ্ধা। মনে হবে সবসময় কি যেন চিবাচ্ছে। একটানা। আঁচলের নানা জায়গায় কয়েকটা পুটলি-মতো। প্রানত্দরের গাছের নিচে এসে বসবে সে। একটা পুটলি খুলে পান বের করে মুখে দিয়ে চিবাতে থাকবে। আর আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে থাকে। তারপর আঁচলে-রাখা তার ভিক্ষা-করা চাল দেখবে বারকয়েক। লালচে, সাদা, ভাঙা-আভাঙা, মরকুটে, খুদ– সব ধরনের চাল মেশানো।
বৃদ্ধা ভিখারিণীটির মাছভাত খাওয়ার অভিলাষ জাগবে।
খাঁ-খাঁ মাঠে ঝাঁ-ঝাঁ রোদের মধ্যে দূরে শুধু মরীচিকা আর মরীচিকা দেখা যাবে। বৃদ্ধা সানগস্নাস খুলে রাখবে। গর্তে-বসা চামড়া-কোচকানো ঝাপসা চোখে প্রান্তরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবে। হঠাৎ একটা চকচকে মাছের লাফ দেখা যাবে মরীচিকার মধ্যে। তারপর বৃদ্ধা সামনের পুকুরের দিকে তাকাবে। ফ্রেমের ভেতরে শুধু পুকুরটি দেখা যাবে। শান্ত স্বচ্ছ নিসত্দরঙ্গ পানি। পুকুরের দু-এক জায়গায় দু-একটা ছোট্ট ছোট্ট পতঙ্গ উড়ে এসে পড়বে। তাতে দু-একটা ছোট্ট তরঙ্গ উঠেই মিলিয়ে যাবে। তারপর বৃদ্ধা আবার প্রান্তরের দিকে তাকাবে। একটানা মরীচিকার মধ্যে পেছনে আবছাভাবে দূরের গ্রামগুলো দেখা যাবে। ওইটি তাদের গ্রাম। ক্যামেরা কিছুটা জুম-ইন হতে থাকলে দেখা যাবে পাশাপাশি দুটি মাটির হাঁড়ি ওই গ্রামরেখার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে মরীচিকার মধ্যে। একটি ভাতের হাঁড়ি অন্যটা সালুনের। ভাতের হাঁড়ির ওপরের আকাশ থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মতো চাল ঝরতে থাকবে। চাল ঝরা শেষ হলে সালুনের হাঁড়ির মধ্য থেকে ফের একটা চকচকে চাপিলা মাছ লাফ দিয়ে আবার হাঁড়িতেই এসে পড়বে।
বৃদ্ধা হা করে অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকবে। তারপর এক সময় দৃশ্যটি মিলিয়ে গেলে সম্বিৎ ফিরে পাবে। একটা ঢোক গিলবে। অল্প একটু জিহ্বা বের করে অন্যমনস্ক ভাব থেকে মনস্কতায় ফিরে আসবে। এরপর আঁচলের চালগুলোকে ফের নেড়েচেড়ে পুঁটলি বাঁধবে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে পুকুরের ধারে যাবে। গোসল করতে পুকুরের পানিতে নামবে। বুকপানিতে দাঁড়িয়ে ঝুপঝুপ করে বেশ কয়েকটা ডুব দেবে। শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত-পা-গা ডলে ডলে গোসল সারবে।
খুবই ছোট ছোট কিছু পোনা মাছের ঝাঁক ইতসত্দত ঘুরে বেড়াতে দেখা যাবে। বৃদ্ধা আঁচলে করে পোনাগুলো ধরার খুব চেষ্টা করবে, কিন্তু কিছুতেই পারবে না। কিছু পোনা আঁচলের মধ্যে একপাশ দিয়ে উঠেই আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে। বৃদ্ধা সামলাতে পারবে না। হতাশার ভাব ফুটে উঠবে চোখেমুখে।
পুকুরের পাড় বেয়ে কলমি, হেলেঞ্চা, থানকুনি ইত্যাদির লতাপাতা পানিতে নেমে এসেছে। বৃদ্ধা পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শাক-লতা-পাতা তুলতে থাকবে। তুলে আঁচলের মধ্যে জড়ো করবে।
এক পর্যায়ে আঁচলের মধ্যে মাছের মতো কিছু একটা নড়ে উঠবে। সচকিত হয়ে তাড়াতাড়ি আঁচল খুলেই বৃদ্ধা অবাক হয়ে যাবে। দেখবে আঁচলের মধ্যে সত্যি সত্যিই কিছু ছোট মাছ। কোনোটা আঙুল-সমান, কোনোটা আরো বড়। শাকলতার ডগাগুলো মাছে রূপানত্দরিত হয়েছে। কোনো কোনোটা তখনো হয়নি, ডগা আকারেই রয়ে গেছে।
এই অতিলৌকিক ঘটনায় বৃদ্ধা রীতিমতো শিহরিত হয়ে উঠবে। ঝট করে আঁচল বন্ধ করে ফেলবে। ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাবে। দেখবে কেউই নাই। আশপাশ জনমানবহীন। আবারও আঁচল খুলে দেখতে থাকবে। দেখা যাবে আরো বেশ কিছু শাকলতার ডগা মাছে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনোটার রূপান্তর চলছে তখনো। মলা, ঢেলা, চেলা, নলা, বাঁশপাতারি ইত্যাদি অনেক রকম মাছ। রূপালি, চকচকে, জ্যান্ত।
মাছগুলো আঁচলে নিয়েই বৃদ্ধা তাড়াতাড়ি পুকুর থেকে উঠে আসবে। মাঝে মাঝে আঁচল মেলে দেখবে। তারপর ভেজা কাপড়েই ক্ষেতের আলপথ দিয়ে লাঠি হাতে সোজা হাঁটতে থাকবে বাড়ির দিকে।
বৃদ্ধার অলক্ষেই আঁচলের ফাঁক দিয়ে একটা নলা মাছ লাফ দিয়ে আলের ওপর গিয়ে পড়বে।
মাছটাকে ফোকাস করবে ক্যামেরা। ক্লোজ শটে দেখা যাবে মাছটা নড়ছে, লেজের অংশটা তখনো হেলেঞ্চা শাকের ডগা…।