ধ্বস্ত উড়াল ও কতিপয় নাককাটা মানুষ

মাজুল হাসান

পৃথিবীর সব ওয়েটিং রুমের বাহ্যিক অবস্থায় যতোটা বৈসাদৃশ্য ও বৈচিত্র থাক না কেন, তাদের মধ্যে কিছু কমন অভিজ্ঞতা থাকে। তার একটি হলো এর ক্ষণিক প্রেম রচনার ইতিহাস। জানা নেই, শোনা নেই, হঠাৎ করেই হালকা বাতাস ধেয়ে আসে। যেন কোনো তাবিজ গাছে আগে থেকেই বাঁধা ছিল বশীকরণ তাবিজ। হাওয়ায় তাবিজ দোলে আর ওয়েটিং রুমে তৈরী হয় প্রেমাবহ। এমন চকিত চাহনি আর অসম্পূর্ণ প্রেম নিয়ে ঘুরপাক খায় ওয়েটিং রুম। গল্পের শুরু এমন একটি ওয়েটিং রুম থেকে।

জেলা শহরের এই বিমানবন্দরের দৈন্যদশা এর ওয়েটিং রুমেও চোখে পড়ে। আগের দিনের মানুষ বলতেন ছেলের জন্য বৌ দেখতে গেলে দেখতে হয় মেয়েপক্ষের রান্নাঘর। যে পরিবারের রান্নাঘর যতো ফিটফাট সে পরিবার ততো গোছানো। আর সেই পরিবারের মেয়েই নতুন সংসারে এসে আলোকিত করবে ঘরগেরস্ত। তা যা হোক। ওয়েটিং রুমে এক জোড়া চোখের চোরা চাহনি সবার চোখ এড়ালেও নাদের শাহর কাছে ঠিকই ধরা পড়েছে। এমন অনেক দেখেছে, ওয়েটিং রুমের শুভদৃষ্টি গড়িয়েছে বাসর পর্যন্ত। তবে তা পরিসংখ্যানের পাহাড়ে নস্যি মাত্র। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওয়েটিং রুমকে ঘিরে আবর্তিত হয় অসম্পূর্ণ প্রেমাখ্যান। কিন্তু আজকাল আর সহ্য হয় না নাদেরের। পোলাপাইন যেন কেমন ছোঁকছোঁক করে সব সময়। যুগের হাওয়া!  নাদের জানে পাশের অপরিচিত লোকটির সাথে কথা বলার এই এক সুযোগ। জুসি বিষয়।

– বুঝলেন অনেক দেখেছি। এতে কিচ্ছু হবে না–

নাদের শাহর কথায় মনোযোগ আপনা থেকেই কেন্দ্রে মিলিত হয়। প্রায় ঘন্টা খানেক এক রুমে থেকেও কথা হয়নি জমশেদ আলীর। নাদেরের কিউ পেয়ে আলাপচারিতা শুরু হয়। কে কোথায় থাকে, কি করে, রাজধানীতে ব্যবসা নাকি চাকরি, এখানে কোথায় আসা হয়েছিল সব জানা হয়ে যায় কিছুক্ষণের মধ্যে। এমন সময় যা হয় মানুষ নিজেকে গুছিয়ে উপস্থাপন করে, জানান দিতে চায় তিনি ভূ-ভারতে সব থেকে না হলেও অতীব গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। জমশেদও তেমন। এমন সময় সে নিজের পৈতৃক ব্যবসা আর ব্রিটিশ আমলে তাদের দেড় হাজার বিঘা জমির গল্প শোনায়, যদিও এর ছিটেফোঁটাও সে চোখে দেখে নি। তার দাদাজান দেখেছেন কি না সেটাও সন্দেহ।

এরমধ্যে কেউ একজন এসে জানায়, ফ্লাইট রাজধানী থেকে বিভাগীয় একটি বিমানবন্দরে এসেছে। সেখানে প্রথম দফা প্যাসেঞ্জার নিয়ে আসবে এই হাওয়াই আড্ডায়। তা আরো ঘণ্টা খানেকের মামলা। এই সূত্রে সেই লোকটিও যোগ দিলো খোশ গল্পে। কিন্তু ঘণ্টার কাটা চক্কর কাটার পরও বেসরকারি কোম্পানির বিমানটির দেখা মিললো না। ফলে আবারো চরম হট্টগোল। কেউ কেউ গালাগাল শুরু করলো। কেউ দৌড় লাগালো ইনকোয়ারি ডেস্কের দিকে। বেচারা রিসেপশনিস্ট নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে, জনরোষে দরদর করে ঘামছে। অগত্যা এয়ারপোর্টের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসে কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এমন সময় যা হয়, বাঙালী আরো উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। কোনো কথা না শুনে এক হালকা বয়সের ছেলে কলার ধরে ঝাঁকাতে লাগল অফিসারকে। গাছ হলে নিশ্চিত ৫ কেজি কুল কিংবা পেয়ারা পড়ত। কিন্তু বেচারা তো মানুষ! শেষমেশ না মুখের দাঁতই পড়ে যায়।

– এইসব অফিসাররা কি মানুষ? সাক্ষাৎ ছারপোকা। জ্বালাতন করাই এদের স্বভাব– যারা এমন মনে করেন তারা ছাড়া হাতে গোনা দুয়েকজন ভাবলো– এতো বাড়াবাড়ির কী দরকার? এইসব জটলায় তেমন কোনো সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার থাকে না। তাই যা শোনা যায় তা এক প্রকার কোলাজ:

– এই শালা অফিসার, আর কতোক্ষণ লাগবে?
– সেই সকাল থেকে বসে আছি। এই আসবে অই আসবে
– উনার দোষ কি?
– দেখেন না ভাই, আমার ভাই অসুস্থ। কিন্তু প্লেনের দেখা নাই
– প্লেন ফ্যাক্টরিতে বানানো হচ্ছে। তারপর আসবে।

হো হো করে হাসির রোল পড়ে।
আরেকজন বলে– না, দেখেন কোনো মন্ত্রীর শালীর বিয়ে বাড়িতে গেছে
আবারো হাসির বৃষ্টি।
– আরে ছাড়েন, বেচারার কি দোষ! এই আমাদের সমস্যা, এতটুকু ধৈর্য্য ধরতে পারি না।
– আপনি বুড়া মানুষ, আপনার কাজ নাই বলে কি কারো তাড়া নাই!

এমন জটলার একটি বিশেষ দিকে হচ্ছে, এটা যেমন হুট করেই শুরু হয়, তেমন হুট করেই শেষ হয়। কেউ একজন জানালো, ফ্লাইট বিভাগীয় শহর থেকে ফ্লাই করেছে। ম্যাক্সিমাম ২০-২৫ মিনিট লাগবে। এতে জটলা শান্ত হয়। কিন্তু মাছের বাজারের মতো একটা গুনগুনানি অব্যাহত থাকে। এই যাত্রায় যা হলো আরো কয়েকজনের নাম জানা গেলো, জানা গেলো এই ফ্লাইটেই বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাধর মানুষরা যাচ্ছেন! তাদের কেউ মন্ত্রীর পিএ’র আত্মীয়, কেউ জাতীয় দলে খেলোয়াড়ের দূর সম্পর্কের চাচা, কেউ মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির হর্তাকর্তা। মেয়েরা এর মধ্যে আড়ষ্ঠতা কাটিয়ে নিজেদের ড্রেস আর কসমেটিক নিয়ে আলাপ জুড়েছে। আবেদিন সাহেবের বৌ আর চিংড়ি ব্যবসায়ী ফারুকের শ্যালিকা বয়সের ফারাক সত্ত্বেও যেন ছোটবেলার সই হয়ে গেছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় একটা শুরুর চোরা চাহনির এক জোড়া চোখ বদলে গেছে। প্রথম যে ছেলেটা ঘনঘন পার্পেল কালারের লং-ড্রেসের দিকে তাকাচ্ছিল, এখন সে ছোরা তাক করেছে স্লিভলেস শাড়ীর দিকে। মহিলাও টের পেয়েছেন। কিন্তু কোনো চ্যাতবোধ নেই। যেন ওয়েটিং রুম ফাঁকা। তার ননিগোপাল পার্টনারটা একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে কী যেন ভাবছে। হয়তো ক্লান্ত।

২০ মিনিট পেরিয়ে গেছে। আবারো সেই যুবক হম্বিতম্বি শুরু করে দেয়। এখন কেউ আর মধ্যস্থতায় এগিয়ে আসে না। কারণ, এতোক্ষণে জানা হয়ে গেছে যুবকটি এলাকার ক্ষমতাসীন দলের বড় ক্যাডার। ফলে লোকজন আরেকটি বিষয় পায় আলোচনার।

– বুঝলেন, আম বলেন আর কাঠাল বলেন সব সমান, কোনো পার্টি ভাল না।
– তা বলছেন ঠিক, জনগণ খালি বিচি পায়।

চিংড়ি ব্যবসায়ী ফারুক, নাদের শাহ আর দুয়েক জন নিজেদের মধ্যে দেশোদ্ধার করে। বাঙালি রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে, বোঝেও বেশ। কিন্তু রাজনীতি করতে চায় না। যা হোক। অবশেষে বিভাগীয় শহর থেকে প্লেন আসে। লোকজন সব ভুলে উড়ালের প্রস্তুতি নিতে থাকে। আবার একটা চাঞ্চল্য তৈরী হয়। ফ্লাইটে ওঠার। কিন্তু বিপত্তি। ঢাকা থেকে বড় বিমান আসার কথা থাকলেও এসেছে ছোট। তার ওপর বিভাগীয় শহর থেকে কিছু প্যাসেঞ্জার নেয়ার পর তাতে সিট আছে মাত্র ২১টা। কিন্তু অপেক্ষমান যাত্রী যে ৩৩ জন। কে যাবে আর কে যাবে না, কার বেশি জরুরী কাজ আছে এই নিয়ে তর্কাতর্কি বেধে যায়। এতোক্ষণ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যে জনতা এককাতারে ছিল তারা প্রত্যেকে একটি করে রাজনৈতিক দল খুলে বসে। কারো কারো মধ্যে হাতাহাতিও বেধে যায়। এয়ারপোর্টের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা একটু আগে যিনি নাজেহাল হয়েছিলেন তিনি দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেন। হ্যান্ড মাইকে বারবার সমঝোতা ও বিমানে আসন পাওয়ার ফর্মুলা ঘোষণা আসতে থাকে। প্রথমে বলা হয়, যারা বয়স্ক আর অসুস্থ তারা উঠেন বিমানে। কিন্তু অসুস্থ এক যাত্রীর সাথে তার চাকর-বাকর ও পরিজন মিলে ৭ জন, তিনি কাউকে ছেড়ে যাবেন না, আর অন্যরা সেটা মানতে নারাজ। এর মধ্যে ক্যাডার আছে, মন্ত্রীর পিএ’র আত্মীয়, বনেদী পরিবারের উত্তর প্রজন্ম যাদের একদা দেড় হাজার বিঘা জমি ছিল– কেউই ছাড় দিতে নারাজ। সবারই জরুরী কাজ আছে। পরিস্থিতি এমন যেন এই ফ্লাইটে না গেলে তাদের সর্বস্বান্ত হতে হবে।

এই যখন অবস্থা তখন কেউ একজন দৌড় লাগায় রানওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেনটির দিকে। সিঁড়ি বেয়ে পড়িমরি ওঠার চেষ্টা করে। পেছন পেছন পুলিশ। পুলিশের পেছনে হৈহৈ স্বরে বাদবাকি যাত্রী। একটু আগে অসুস্থ মানুষটি যিনি ৭ জনের বিশাল বহর ছাড়া যাবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছিল সেও দৌড়ায়। কোনো মতে গেট আগলে অন্যদের ডাকতে থাকে–এই কাদের, রাফেজা আয় আসতে পারিস না?–কে বলবে এই লোকটা অসুস্থ!

মাইকে আবারো ঘোষণা আসে: আপনারা নিজেরাই ঠিক করে নেন, কারা যাবেন, ১০ মিনিটের মধ্যে প্লেন ছাড়বে। ঢাকায় ভিআইপি বসে আছে। এই বিমান যাওয়ার পর তিনি সিলেট যাবেন। আবারো গুঞ্জন বাড়ে, ক্যাচাল বাড়ে। কেউ বিমান কর্তৃপক্ষের চৌদ্দগুষ্টির পিণ্ডি চটকায়। কেউ বলে– এই দেশের কিছু হবে না।
সবাই চায় উড়াল দিতে। অবশেষে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে যাত্রীরা বিমানে আগুন দেবে। যদিও এই আশঙ্কা কেবল বিমান কর্মকর্তা শহীদের নাকি সবারই তা বোঝা যায় না। পুলিশ ডাকা হয় তড়িঘড়ি। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। বর্ধিত রানওয়েতে প্লেনটা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে কর্ডন করে আছে পুলিশ আর তার বাইরে মারমুখী যাত্রীরা। কেউ একজন বলে–মাত্র ১২ জন বেশি। চাপাচাপি করে বসলেই হয়। চলেন সবাই যাই।

জনতা একটা যুক্তি পায়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকটি যিনি একটু আগে বিশ্বের নামকরা বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের যাত্রী সেবার মান নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন সিস্টেমের কথা, তাকেও প্লেনের সিঁড়ির দিকে হাঁটতে দেখা যায়। কিন্তু বেঁকে বসে বিমান কর্তৃপক্ষ। বলে– মিয়া মশকরা করেন? এইটা লোকাল বাস পাইছেন? ঠিক করেন কে কে যাবেন?

লোকজন মানে না। একটু আগে যে লোকটি বলছিল–এই রুটে সপ্তাহ ৩ দিন যাতায়াত করে, সেও বলে– সমস্যা কি? একটু এ্যাডজাস্ট করলে সমস্যা কোথায়?
– হে হে সমস্যা কৈ?
প্রতিধ্বনি ওঠে।

এই বুর্বক পাবলিকরে কে বোঝায়? এমনিতে ছোট ফ্যামিলি বিমানকে জোড়া দিয়া প্যাসেঞ্জার প্লেন বানানো হইছে, তার ওপর প্রপেলারের একটা পাখা থেকে থেকে ঘটাং ঘটাং শব্দ দেয়। পাইলট নেহাত নতুন আর ক্যারিয়ারের শুরু বিধায় এই প্লেন চলে নইলে ইউএস এয়ারফোর্সেরও সাধ্য নাই একে মাটি থেকে দুই হাত ওপরে ওঠায়। শেষমেশ অবস্থা বেগতিক দেখে ক্যাপ্টেন বিমান নিয়ে দে ফুড়–ৎ!

ঘটনা এ পর্যন্তই। ওয়েটিং রুমে যার শুরু তার সমাপ্তি শূন্য রানওয়েতে। এরপর পত্রিকার বদৌলতে এমনই একটি খবর জেনেছে দেশবাসী। তা খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বলা হয়েছে যাত্রীদের নিজেদের মতবিরোধ আর ‌কেউ যাবে কেউ যাবে না, তা হবে না তা হবে না– স্লোগানের কারণে বিমানটি জেলা শহর থেকে কোনো যাত্রী না নিয়েই রাজধানীতে চলে এসেছে। এরপর দূর্ভোগ যাত্রীদের, পাবলিকের। বিমান কর্তৃপক্ষ বলেছে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তাদের পূর্বনির্ধারিত বড় বিমান সেদিন উড়তে পারে নি। তাই এই বিড়ম্বনা এবং এজন্য তারা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

কোনো কোনো মানুষ অবশ্য বলেছে– বেটারা শোধ নিছে। চাইলেই সবাইকে নিয়ে আসতে পারতো। কিন্তু লোকজন বিশেষত অই ক্যাডার বেয়াদ্দপি করায় ওরা শোধ নিছে।

এই যুক্তি-পাল্টা যুক্তির বাইরে সেদিনের সেই ঘটনার পর যা জানা যায় নি তা হল: সেদিন ৩৩ জন লোক কাটা-নাক নিয়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলেন। কারণ এসব মহাক্ষমতাধর ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা প্রাচীন প্রবাদটির সার্থকতা প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন।

 

Facebook Comments

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top