নাহার মনিকার কবিতা

সকলি আয়ান ঘোষ, কেউ কেউ রাধা


ছিটমহলের বুকে মধুভাণ্ড নিয়ে নদী কথা বলে ওঠে
চোখের সামনে ভাসে মমীদের শরীরের বাঁক।
তোমাকেও অমাবস্যা পাক, অন্ধকারে নদীকে জড়াও
পানিপোকা হয়ে নেমে যাও, রত হও মূর্ছা যাও
স্নানের বিরহে। পানির শরীরে গুজে প্রলম্বিত কাঁধ
তারপর জেগে ওঠো আহত সম্বিত
কাঁটাতার উলের গোলক হয়ে খুলে যাক পথের কোটরে।


অগস্ত্যের ঠগ খেয়ে বিন্ধ্যের কুর্ণিশে স্থির থাকো
বিরহের গানগুলি নিয়ে তোলো আরেক ঝরায়,
‘মফস্বল- মফস্বল’- রাধার শাড়িতে লেখা নাম
হাঁটু গেড়ে করজোড়ে ডাক পেড়ে যায়
আয় তবে স্রোতের ওপারে— স্রোতের ধারের কাছে ধারি
জলপোকা দ্বিধা ক’রে বেয়ে যাবে মানভাঙ্গা দাঁড়।
অনুপস্থিতির চেয়ে ধারে মারে কেটে যাওয়া ভালো
অপেক্ষায় অন্ধ হবে,  ঝিমিকির চালে দেবে খণ্ড খন্ড আলো।


কী তীব্র সাধ নিয়ে তাঁকিয়েছো তৃণতুচ্ছ সম্পর্কের দিকে
অথচ এটাই সত্যি, এখানে গভীর কাব্য নাই
আছে নাকি-অনতি গম্ভীর সম্পূরক কথার ইঙ্গিত।
আঙ্গুর রসের দিকে সতৃষ্ণ থাকে না কোন সবুজ মরিচ
তবু বলি,
এই যাত্রা কহতব্য কোন রং, রঙ্গের ভুবন দেখা হলো
ভ্রমণ আর ভ্রমের বাসনা বেহুদাই ঘুরে ফিরে আসে!

 

ধুলাভরা ভূগোলের ঘর


এত গৃহস্থালী আসে আগে আগে,
রকমারী বিষয় আশয়, বড় বৃহত্তর।
খুলে গেল পুতুল খেলার পরম্পরা
কেটে গেল দূরাগত শূন্যতার ভার
পুরুষ্ট স্তনের তাপে মানুষের সুখ—
কেঁপে গেল দৈবাৎ ধুলাভরা ভূগোলের ঘর।
তারপরও আমি আর যাইনি সেখানে
ঐ ঘর, ঘরের পৈথান
তবু কেন আমাকেই নাম লিখে ডাকে!


নেহাৎ অভ্যস্থ হাতে আসঙ্গলিপ্সায় ডুবে যাই
নীল চোখে তাপ  দিয়ে খোলা বই পাঠ করা যায়
এখন মলাট বন্দী দুপুরের প্রেম, কার কাছে যায়!
আমি তার পিছে পিছে উড়ি। নিহিত বেলুন
থেমে গেলে, বাতাসে আবার যাদুর সন্ধান করি।

কুয়াশায় মোম মাখা উত্তাপ নিয়ে ঘরে আসি
অন্ধকারে ঘর ভর্তি মাটিচাপা শেকড়ের ঘ্রাণ।
লোড শেডিং এর ফল, ত্বকের নিষিদ্ধ আলো জ্বলে ।
নানান যাদুর মধ্যে ঘুরপাক খাই, আমি
ধাঁধার আলোকবাতি সঙ্গে নিয়ে শহর সাঁতরাই।


নিজের নিবিষ্ট বুকে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলা জলের প্রপাত
শুখা শূণ্যতার সাপ বসে ছিল ভেজা শিরস্ত্রাণে।
এসো আজ সাপের রহস্যগল্প হোক…
কোনোকালে কেউ থাকে, আছে, তবুও
নিঃসঙ্গ আলো ঘিরে রাখে সন্ধ্যাবেলার ফেরীঘাট,
স্বপ্নের গোলকের মসৃণতা নিয়ে।
চারপাশে পলায়নপর আতশবাজির টোপ
অল্প অল্প ক’রে স্বার্থপর সাজায় চিবুক।
ও আমার দিক জাগানিয়া বুক, তবু একা থাকো।
কথা কও তালাবন্ধ সুখের ভেতরে। তীর্থ, ফাঁকিবাজি
বাইরে ঝুলিয়ে রাখা প্রণয়ের রহস্য কুড়াল
নির্বিরোধে কাটো নালিছাড়া সবিনয় সন্ধ্যার কাল।
রক্তহীন কাটাকাটি জড়িয়েছে কোমরের কাছে
সহস্র বছরের শ্বাস নিয়ে একা বাঁচে সেই সাপ ।

 

হীনাক্ষী পোকাদের নিস্তরঙ্গ গান


পাহাড় দেখিনা বলে মনে হয় বিকেলের মর্ম ভুলে গেছি।
পাহাড়ে বিকেল নামে কলস্বরে।  সদ্য বিবাহিতা আলো
ক্লান্ত হয়ে হাসে, আধশোয়া আমাদের কোমলাঙ্গী খাটে।
তারপর চোরাই সুগন্ধি মেখে চারপাশে সাহস বিছায়।

উঁচু নীচু ঢেউছাড়া জনপথ, ফিরতে হচ্ছে বলে ফিরি
সমতলে জন্ম দিই বহু ব্যবহৃত নীলগিরি।
বিকেলের সঙ্গী হয়ে ব্রীড়ানম্র প্রেম-পাঠ হয়,
বিশদ দিনের ব্যাখ্যা, টীকাভাষ্যে আলোর পংক্তি উড়ে যায়।

রোদের অন্ধ চোখ সবখানে একই ভাবে তীব্র ও কোমল-
পরিচিত ভুলের সংবাদ উঠে আসে শীর্ষতালিকায়।
প্রখর দিনের খোঁজে রাস্তাঘাট ধ্যানমগ্ন রেখে চলে যাই,
বিকেল তাড়িত চোখ বন্ধ হয় মর্ম গাঁথা পাহাড়ের খোঁজে।


বসতবাড়ি ছেড়ে যায় গহীনাক্ষী পোকাদের দল
সেতো রোজ রোজই যায়, ঘর ছাড়ে, বনে যায়
তাদের কথায় অভিবাসী শব্দেরা টুং টাং নাচে,
ঘোর লাগে চোখে আর অন্তরঙ্গ বিষন্নতায়।
ঘোরের পেছনে ঘুরি মন্ত্রমুগ্ধ বেহাল জনতা
একা একা আর কত! যাপনের বেমক্কা কথা
জগৎ কখনো কোন ষড়ঝড় বাঁশীর বাদন!
চোখের গমক নিয়ে থেমে থাকে নদীর কিনার,
কুয়াশা আক্রান্ত চোখে রোয়াবী তারার রাগ দেখি
আমিও তো যেতে চাই, ঘর ছেড়ে, অনভ্যাস ছেড়ে
তুলোয় মুড়িয়ে নিয়ে আমুল সাগর,
পিষ্ট হয়ে ডুবে যাই দুখপাঠ্য রহস্যের কোনা!
গহীনাক্ষী পোকাদের নিস্তরঙ্গ গান
খালি খালি আমাকেও ঘর ছাড়া ছাড়া করে।


কথায় অনাসক্ত হতে দূরে সরে গেছি
মাত্রা থেকে উঠে এসে সোনালু লতার শীষ
বিকশিত প্রশ্নের জামা দিয়ে ঢাকে বাহুমূল
বিচ্ছেদ সংক্রান্ত ভাষা বুকের প্রকোষ্ঠে জমা হয়।

কথায় আসক্ত হয়ে কাছে ফিরে আসি
কাছে থাকি, না ছেড়েও দূরের গন্তব্য ডাকে প্রতি ভোর বেলা,
ঘুমের ঘড়ির কাছে সমর্পিত একজন জেগে উঠি, আরেক মানুষ ।
সমস্ত শহর জুড়ে শব্দের ইকেবানা নাচে
দূরের ভ্রমণ থেকে পিছ-দৌড়ে জয়ী হয়ে ফিরে আসি কাছে।

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top