সাক্ষাৎকার:
আবদুল মান্নান সৈয়দ
_____________________
৫ সেপ্টম্বর ছিল আব্দুল মান্নান সৈয়দের মৃত্যুবার্ষিকী। একাধারে কবি-প্রাবন্ধিক ও গল্পকার তিনি। সকল শাখাতেই সমান পারদর্শী। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ প্রকাশের মধ্য দিয়েই পাঠকমহলে জানান দিয়ে রাখেন, এদেশের সাহিত্যে তিনি একটা পাকাপাকি আসন গড়তেই এসেছেন। এরপর তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘শুদ্ধতম কবি’, দেশের সকল কবির পাঠতালিকায় অপরিহার্য গ্রন্থ হিসেবে ঠাঁই পেয়ে যায়। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা একশত ঊনিশ। তাঁর সামনাসামনি হয়েছিলেন ফরিদ কবির, মাতিয়ার রাফায়েল ও সাখাওয়াত টিপু। এটি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক কাগজের ৫ মার্চ ২০০৮ সংখ্যায়। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে মান্নান সৈয়দের বচন প্রকাশ করা হলো।
______________________
ফরিদ কবির: মান্নান ভাই, ফরমাল ইন্টারভিউ নয়, আমরা ইনফরমালিই শুরু করি, আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’-র আগে আপনার কিছু কবিতা ছিল যেগুলো আপনি গ্রন্থভুক্ত করেননি, কিন্তু পরবর্তীকালে সে সব কবিতার কিছু অন্যগ্রন্থে জায়গা দিয়েছেন, আমার প্রশ্ন, সে কবিতাগুলো জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছে জায়গা দিলেন না কেন?
আবদুল মান্নান সৈয়দ: এহ্, আপনি তো বেশ নিবিষ্ট পাঠক! হ্যাঁ, আমি ছেলেবেলা থেকেই লিখি, যখন স্কুলে পড়ি তখন জগদীশ ঘোষের বাংলা ব্যাকরণ পাঠ্য ছিল, ঐ বইয়ের শেষে প্রবোধচন্দ্র সেনের ছন্দ বিষয়ে একটা অধ্যায় ছিল, ফলে আমার লেখায় শুরুতেই ছন্দ ছিল। তবে তাতে একটু ঝামেলা ছিল। আমার প্রথম কবিতা ‘যাত্রার হরিণ’ ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকে। ডাকে পাঠিয়েছিলাম। প্রথম মুদ্রিত এ কবিতা আমার কোনও বইয়ে নেই। যখন আমি কলেজের ছাত্র, সে সময় ‘মোহাম্মদী’তে কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে। তবে, সে সব কবিতা ছিল মূলত একটা প্রচেষ্টা। আমি প্রথমদিকে যথারীতি গদ্য কবিতার বিরুদ্ধে ছিলাম। তার মানে এই নয় যে আমি ছন্দ জানতাম না। আমার প্রথম বইয়েও গদ্য কবিতা, টানা গদ্য কবিতা ছিল। ঐ কবিতাগুলো শুরু হয়েছে ১৯৬১ সাল থেকে, তখন আমার বয়স ধরেন ঊনিশ কি বিশ হবে। বইটা বেবোয় আমার চব্বিশ বছর বয়সে। ততদিনে আমার বেশকিছু কবিতা ছাপা হয়েছে। সে সময় শামসুর রাহমান আমার একটি কবিতার প্রশংসাও করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো ছিল প্রাথমিক প্রচেষ্টা। হয়ত সে কারণেই সেগুলো জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছে জায়গা পায়নি। তবে, আমি বলব, আমার মাছ সিরিজ-এর কবিতাগুলো আমার মূল চারিত্র্য থেকে লেখা।
ফরিদ : কবিতায় কীভাবে জড়িয়ে গেলেন?
মান্নান: যতটুকু মনে পড়ে, ক্লাস ফাইভে আমার টাইফয়েড হয়েছিল, উপুর্যপরি দু’বার। একবার টাইফয়েড থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এলে, দ্বিতীয়বার যখন হয় তখন তা মারাত্মক। এক রাতে ডাক্তার আমাকে জবাব দিয়ে দেন। তারপর আমি হয়ে গেলাম ডাকঘরের রমণীর মতো, একদম কঙ্কাল। ডাক্তার জবাব দিয়ে গেল। ভিজিট নিল না। তখনকার দিনে ডাক্তার ভিজিট না নেয়া মানে বুঝতেই পারছেন! ডাক্তার ওয়াকিল ছিল ওনার নাম। কোনও অবাঙালি ডাক্তার হবেন। অনেক দূরে থাকতেন, অনেক টাকা ভিজিট ছিল। ঐ ডাক্তার ভিজিট না নেয়ায় আমাদের বাড়িতে তখন কান্নাকাটি পড়ে গেল। এখনও আমার মনে আছে, আমি মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছি। ওটা আমার মধ্যে বহুদিন কাজ করেছে। আবার মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছি, বোধহয় কিছু করার জন্য। তারপর থেকে আমি ছবি আঁকা এবং কবিতা লেখা এসবের মধ্যে ঢুকে যাই। ঐ ডাকঘরের রমণীর মতো দীর্ঘদিন, মানে দীর্ঘদিন একদম বিছানার সাথে মিশে গিয়েছিলাম। এখনও মনে আছে, যখন শরীর ভালো হয়ে উঠছে তখন তো বাড়ির লোকজন অত আসে না। তখন ঐ ঘরের মধ্যে একটা ড্রেসিং টেবিল ছিল। ঐখানে, একটা চড়ুই পাখি ঠোঁকরাচ্ছে আয়নায়– সেটা এখনও মনে আছে, আব্বা যখন কোলে করে তিন মাস পরে নিয়ে এলেন আমাকে বাইরের বারান্দায়, উল্টোদিকে মাঠ ছিল একটা, সে মাঠ দেখে তো আমি চমকে উঠি, আমরা থাকতাম তখন গোপীবাগে। তো, সে মাঠ দেখে বললাম, ‘ঘাস এত সবুজ!’ উচ্চারণ হচ্ছে শিশুর মতো, ‘ঘাস এত সবুজ!’ ঘাস যে সবুজ সেটা আমি বুঝে ফেলেছি। এভাবে আমি কখন ছবি আঁকায়, কবিতা লেখায় নিবিষ্ট হয়ে গেলাম। আমার যতটুকু মনে পড়ে, আমার বড় ভাইকে নিয়ে, বড় ভাইয়ের বাগান করার শখ ছিল, বাড়িতে বাগান করে না অনেকে… এটা নিয়ে একটা বিদ্রুপাত্দক কবিতা লিখেছিলাম। আমার বাড়িতে একটা চল ছিল যে, সবাই পড়ুয়া। আব্বাও কবিতা লিখতেন, তবে উদর্ুতে। তিনি অবশ্য আমাদের সাথে কথাই বলতেন না। আমি পরে লক্ষ্য করেছি যে, আম্মা পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যিনি চিরকাল আমাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। আরেকটি কথা, আম্মা-আব্বা দু’জনে, এই যে আমি সাহিত্য করছি, সাহিত্যে এসেছি, তারা জানতেন। আমার লেখক হয়ে ওঠাটা আমি মনে করি আল্লাহ্র রহমত এবং আম্মা-আব্বার প্রশ্রয়।
আব্বু বুঝতে দিতেন না। পরে আমি বুঝেছি যে আমার জন্য লেখার আলাদা ঘর করে দিয়েছেন। যেটা আমাদের দেশে লেখকদের ক্ষেত্রে খুব একটা হয়নি। আমি ছবি আঁকতে পারতাম ভালো। আমি যখন আইএ পাস করে বাংলায় ভর্তি হতে চাইলাম, তখন তো লোকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারই হতে চাইত… কারণ বড় ভাই ডাক্তার, মেজো ভাই ফার্মাসিস্ট, এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমি এখনও বুঝতে পারি, আম্মা চিরকাল, আব্বা-আম্মা আমাকে যেভাবে চালিত করেছেন, সেটা আমার জীবনে একটা বিরাট সুখ। পরে আমার বিবাহিত জীবনে আমি যেটা পেয়ে গেছি। ফরিদ কবির, আপনার ভাবী বা আমাদের সন্তান, আমরা সবাই যখন যে অবস্থায় থেকেছি, আমাদের মধ্যে জাগতিক মোহ নেই, আমাদের কারণে আমার একমাত্র মেয়েরও নেই। আমার স্ত্রীরও নেই। ফলে আমাদের সুখ-দুঃখেরই জীবন। এই পাগলামি করেই আমার জীবন কেটেছে।
মাতিয়ার রাফায়েল: মান্নান ভাই, আপনাদের সময় থেকে এখন পর্যন্ত যেরকম অক্ষরবৃত্তে লেখা হয়ে আসছে, সেটাকে কি আপনি মনে করেন অক্ষরবৃত্তের নিজস্ব স্বভাবেই লেখা হয়ে আসছে? নাকি তার স্বভাবের বাইরে থেকেই..
মান্নান: না, অক্ষরবৃত্তের স্বভাবেই লেখা হয়। অক্ষরবৃত্তের প্রভাবটা আসলে বিশাল প্রভাব। এবং আমার প্রথম বইটা দেখবেন যে একটা এঙ্পেরিমেন্টাল বই। এতকাল পরে আপনাদের কাছে বলি, ডালিয়া নামে এক কিশোরী, আমিও তখন সদ্য কিশোর, আমার প্রথম অক্ষরবৃত্তের কিন্তু টানাগদ্যে লেখা একটা কবিতা আছে, ‘বেগেনা সেরেনাদ’ নামে, যেখানে ‘তোমার একটি চোখ ফেলে গেছে আমার কৈশোরে, তোমার একটি চোখ ফেলে গেছ আমার কৈশোরে…’ এসব ভাষায় লিখেছিলাম, পুরো কবিতাটা লিখেছিলাম অক্ষরবৃত্তে কিন্তু আমি সেটা সাজিয়েছিলাম টানা গদ্যে। এসব কাজ তখনকার দিনে হয়নি।
মাতিয়ার: দেখা যায়, সাহিত্যে যে কোনো ধারা সৃষ্টিতে পশ্চিমবঙ্গই এগিয়ে থাকে…
মান্নান: আমার মনে হয় না। আমার খারাপ লাগে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে সব রায় দেয়া হয়। ওরা তো বাংলাদেশের খোঁজখবর রাখে না। প্রতিভা বসুর সাথে একবার আলাপ হয়েছে, তখন উনিই বলেছেন আমাকে, আমার দ্বারাই জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ-র কবিতা লেখা সম্ভব। তখন থেকেই আমি আমার সমসাময়িকদেরও প্রভাবিত করেছি। আজকে আমি কিছু কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, কেননা তখন তো সবাই নতুন, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তখন আমাদের এক বন্ধুকে চিঠি লিখেন যে, তোমাদের কাগজে অশোক সৈয়দ নামে যার লেখা দেখলাম তাঁর কবিতা আমার ভাল লেগেছে। পরবর্তীকালে শামসুর রাহমানও আমার কবিতার প্রশংসা করেছেন। অশোক সৈয়দ নামে আমি কিছুকাল কবিতা লিখেছি। উনি বলেছেন, আমার শুধু কবিতাই নয়, সাহিত্য, গদ্য এবং অন্যান্য লেখার প্রভাবও অনেক লেখকের ওপর পড়েছে। দেখবেন, আজকাল যে নতুন কবিরা তাদের অদ্ভুত নাম রাখে, কখনো একটা বাংলা শব্দ আর একটা আরবি শব্দ দিয়ে, সেটা আমার অশোক সৈয়দ নামের প্রভাবের একটা ফল। তাদের নামগুলো এমনই হয় যে অনেকের নাম আমার মনেই থাকে না।
আরেকটা কথা বলি, জীবনানন্দ দাশের সাথে আমার একটা মিল দেখবেন যে, আমি নির্জন মানুষ। ‘নির্জন’ কিন্তু অমিল হচ্ছে, আমি উদ্ধত। এটা ফরিদ কবির ভালো জানেন, আপনারা জানেন না, আমি নির্জন কিন্তু উদ্ধত। কারণ আমি যে বংশ থেকে এসেছি সে বংশ প্রথম থেকেই খুন-খারাবির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। এবং উগ্রতার মধ্য দিয়ে এসেছে। নিজেরাও খুন হয়েছে এবং অন্যদেরও খুন করেছে।
মাতিয়ার: আমি আপনার যে বইটা প্রথম পড়ি, শুদ্ধতম কবি, ছিয়াশি কি সাতাশি সালের দিকে, তো আমার প্রশ্ন হলো জীবনানন্দ দাশ কেন শুদ্ধতম কবি?
মান্নান: এটা আমি তখন লিখেছিলাম যে দৃষ্টিকোণ থেকে, সে দৃষ্টিকোণ আর অবশিষ্ট নেই। আমার দৃষ্টিকোণ তো বদলায়, শুদ্ধতম কবি কেন রবীন্দ্রনাথ নয়, কেন নজরুল নয়। তখন আমি যেটা লিখেছিলাম তার একটা হচ্ছে, জীবনানন্দ দাশ শুধু কবিতাই লিখেছিলেন। ‘শুদ্ধতম কবি’ কথাটা বলেছিলেন অন্নদাশংকর রায়, আমি ওটা ব্যবহার করেছিলাম মাত্র। শুদ্ধতা বলতে এখনও জীবনানন্দের যত গদ্যই আবিষ্কৃত হোক না কেন, যত গল্প-উপন্যাসই তিনি লিখে থাকুন, তিনি কবি, আপাদমস্তক কবিই। তো, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একটা তফাৎ হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে সর্বভূমি কবি। জীবনানন্দ দাশের মধ্যে আমরা যে জিনিসটা পেয়েছি, সেটা বোধ হয় কবিতার সারাংশ। সে জিনিসটা আমরা যে কোনোভাবেই হোক, রবীন্দ্রনাথে পাইনি, নজরুলে পাইনি, কিন্তু জীবনানন্দে পেয়েছি। ফলে ‘শুদ্ধতম কবি’ তখনও বিতর্ক উঠেছে, এখনও হবে। এমন কেন নাম দিয়েছি পুরো বলতে পারব না। কেননা আমি নিজেও চলমান, আমার নিজের চিন্তাও কিন্তু এক জায়গায় থেমে থাকেনি।
মাতিয়ার: জীবনানন্দ দাশের কবিতার ক্ষেত্রে দেখতে পাই যে ওনার কবিতার কন্টেন্ট বদল হচ্ছে, কিন্তু কন্টেনার একই জায়গায় থেকে যাচ্ছে, মানে আমি কন্টেনার বলতে বোঝাতে চাইছি ‘আধার’…
মান্নান: ঠিকই বলেছেন, এটাও কিন্তু এক জায়গায় থাকেনি সবসময়। যেমন, বেলা অবেলা কালবেলা… কালবেলায় কি থেকেছে? সেখানে তো তিনি স্বরবৃত্ত ছন্দের নিরীক্ষা করেছেন… কিন্তু আপনি আবার যেটাকে কন্টেনার বলছেন মানে আধার, আবার একদিক থেকে স্বরবৃত্ত ছন্দ জীবনানন্দের ঠিক উপযুক্ত নয়। কেননা ওটা মনে হয়নি যে, ওটা স্বরবৃত্ত ছন্দ। আবার ছন্দের দিক থেকে খুব উৎকৃষ্টও না। জীবনানন্দ দাশের অক্ষরবৃত্ত ছন্দই মাতৃভাষা। আমি যখনই কবিতা লিখি সেটা আমারই কবিতা এবং সেটা আমারই মতো হবে। আপনি হয় পছন্দ করেন, বা না করেন। আমার কবিতার মধ্যে কোথাও একটা আমার চাল চলে আসবেই। এটা ধরেন আমি যখন গদ্যছন্দে লিখেছি, আমি যখন অক্ষরবৃত্ত ভাঙছি, আমার এই যে মাতাল কবিতা, এগুলো লিখেছি একটা ঘোরের মধ্যেই। সেখানে একটা কবিতা আছে এবং একটা গদ্যও আছে, তো, কোনটা গদ্য, কোনটা কবিতা সেটাই প্রশ্ন। আমার বই বেরুবার পরে, এখন মনে হচ্ছে, বইটা লিখেছি একটা ঘোরের মধ্যে, শব্দের তাড়নায়, প্রকাশের তাড়নায়। একটা কথা বুঝে গেছি, পঞ্চাশের দশকের কবিদের মতো মাত্রাগুণে আর চলবে না। এই যে মাত্রাগুণে চলা, এই মাত্রা ওরা ভাঙতে পারেনি। তিরিশের কবিদের চেয়ে আমাদের যেটা মুশকিল তা হচ্ছে, আমাদের পঞ্চাশের কবিরা বড় বেশি বাঁধাধরা। তাঁরা কবিতায় জীবনকে কীভাবে এনেছেন, তা আমার জানার দরকার নেই। শুধু এটুকু বলতে পারি, তাঁরা কবিতায় বড় বেশি বাঁধাধরা। তবুও ওদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ যে, তাঁরা একটা ঐতিহাসিক যোগসূত্র এনে দিয়েছেন। পাকিস্তান হবার পরে, ‘৪৭ হবার পরে, কবিতায় ইসলামি অনুষঙ্গ বিশাল প্রভাব ফেলে। ইসলামে কোনো অসুবিধা নেই, আমি নিজেও ইসলাম বিশ্বাসী। তবে কথা থেকে যাচ্ছে যে, সেটা কবিতায় কতখানি আনতে হবে। কিন্তু তখন রাজনৈতিকভাবে সেটা ব্যবহার করা হয়েছে। তবে, সেখান থেকে আবহমান বাংলা কবিতার সাথে পঞ্চাশের কবিরা নিজেদেরকে যুক্ত করেছেন, এটাতেই আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। তার মানে এই নয় যে, পেছনে চলে যেতে হবে। দশ বা আঠার মাত্রার বাইরে যাওয়া ওদের পক্ষে অকল্পনীয় ছিল। এর বাইরে গিয়ে আমি সব সময় বিতর্কিত হয়েছি…
সাখাওয়াত টিপু: এটা তো ষাটেরই একটা প্রবণতা, এই বিতর্কিত হওয়া…
মান্নান: না, এটা তো আমি ইচ্ছা করে হইনি। ইচ্ছা করে তো কেউ হয় না। এটা রক্তের মধ্যে না থাকলে। আমার তো পাগল গদ্য মাতাল কবিতা এই বই লেখার কথা না। আমার তো এখন আত্দজীবনী বেরুনোর কথা। এর কিছু অংশ কম্পোজ হয়ে পড়ে আছে, আমি প্রুফ দেখার সময় পাইনি। মাঝে এই বই দুটো– মানে, পাগল গদ্য মাতাল কবিতা, আর অঘ্রাণের নীল দিন– এ বই দুটো লিখেছি। আপনারা স্বীকার করবেন কিনা জানি না, আমি মনে করি, পাগল গদ্য মাতাল কবিতাই আমার প্রথম বই, বাকি বইগুলোকে আমি এখন একভাবে অগ্রাহ্য করি। কারণ এখানে আমি কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করেছি।
ফরিদ: স্বাধীনতা কোন দিক থেকে?
মান্নান: স্বাধীনতা মানে, আমি যেটা লিখতে চেয়েছি, সেটা লিখেছি। জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ-তে যে-রকম স্বাধীনতা ভোগ করেছি, তারপর অনেকদিন তো পরাধীনই ছিলাম। তারপর আবার পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এসে একটা বইয়ে স্বাধীন হওয়া, আসলে এগুলো তো কোনো কথা না, নিরপেক্ষভাবে বললে… নিজের লেখাকে বিশ্লেষণ করা অসম্ভব। পৃথিবীতে এর চেয়ে অসম্ভব আর নেই। আসলে এসব নিয়েই শিল্পচর্চা চলতে থাকে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যিনি মেঘনাদবধ কাব্য লিখলেন, তিনি যে এতটা বিপ্লবী তারপরেও কিন্তু তিনি প্রচলিত আট-ছয় মাত্রার বাইরে যাননি। আমাদের দেশে বলা হয়, মাইকেল হচ্ছেন আধুনিক মহাকাব্যের প্রথম রচয়িতা। আমি বলব, মহাকাব্য নয়, মাইকেল হচ্ছেন প্রথম আধুনিক কবি। বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল, এটাই হচ্ছে বড় কথা। মহাকাব্য তো প্রধান কথা নয়, আর মহাকাব্য নিয়ে আমাদের কিছু আসে যায় না। মাইকেল প্রথম আধুনিক কবি। যদি আমার মধ্যে এসে থাকে, যেটা আমি একটু আগে বললাম সেটাও, মাইকেলের আগে যে শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র রায়, তাকে কোনোদিন তিনি কি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন? মাইকেল তো ভারতচন্দ্র রায়ের নামই উচ্চারণ করতেন না। মধুসূদন বলতেন, কৃষ্ণনগরের সেই ভদ্রলোকের চেয়ে আমি ভালো কবিতা লিখেছি…
টিপু: আচ্ছা, মান্নান ভাই, একটু আগে যে বললেন, মানুষ চিন্তায় যতটুক স্বাধীন লেখায় তো ততটুকু স্বাধীন না। এটা কেন বললেন?
মান্নান: শৃঙ্খল তো পায়ের তলায় লাগানো থাকে, মানুষমাত্রই পায়ে শৃঙ্খল পরা। আমি এই সমাজের বাইরের, রাষ্ট্রের বাইরের, দেশের বাইরের কেউ নই। তার মধ্যে আপনি যা বলছেন এতটুকু স্বীকারোক্তি করতে পারি, আমি যা লিখতে চাই, সেই স্বাধীন শক্তি আমার নাই। যদি তাই থাকতো, তাহলে আমার আরও বই বাজেয়াপ্ত হতো। সত্যের মতো বদমাশ বইটা যে কারণে বাজেয়াপ্ত হলো।
মাতিয়ার: তারপরও তো এখানে একটা কথা থেকে যায়, আমি যেটা লিখছি, সেটা কি আসলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে লিখছি, নাকি নিজেকে জাহির করতেই লিখছি?
মান্নান: মান্নান সৈয়দ কখনোই নিজেকে জাহির করার জন্য লেখে না। প্রশ্নই ওঠে না। সেটা আমার লেখা পড়লেই বোঝা যাবে। পাগল গদ্য মাতাল কবিতা নামে যে বইটি লিখেছি সেটা আমার নিজেকে জাহির করে লেখা না। ঐ বই আমার রক্ত দিয়ে লেখা, আমার অশ্রু দিয়ে লেখা। এই বই আমার ক্রন্দনের ফসল, রক্তের ফসল। বইটা পড়লে আপনি কাঁদবেন। কারণ হচ্ছে, আমার লেখা ঐভাবেই রচিত। এটা আমি বলছি, কারণ ওটার মধ্যে আমার আত্দপ্রকাশিত। শহীদ কাদরীর সাথে তখন আমার তর্ক হতো, আমি তখন স্বীকার করতাম না। শহীদ কাদরী যেটা বলতেন, সেটা হচ্ছে নিজস্ব চিন্তার ভেতর থেকেও একজন কবি বেরুতে পারে। কোনো আসে যায় না। যেমন জীবনানন্দ দাশ। যেমন ছন্দ নয়, চিন্তার মধ্য দিয়েই জীবনানন্দ বেরিয়ে এসেছেন। এখন সব কবি যে জীবনানন্দ হবেন তাও না। কোনো কোনো কবি মাইকেল, কোনো কোনো কবি নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। মেঘনাদবধ কাব্যের কথা লোকে বলে, মানসিকতার কথা বলে, যে মানসিক প্রভাব আরও বেশি, সেটা হচ্ছে প্রথাগত ধারার পদ্ধতি। ওটার ভেতর থেকেই নবীন কবিরা বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, আমরা যে লেখা দেখতে পাই, তাতে নজরুলের নজরুলত্ব কোথায়। নজরুলের অক্ষরবৃত্তের কোনো কবিতাই নাই। স্বরবৃত্তে আর মাত্রাবৃত্তে। তো, এই যে, কোন কবি কোন ছন্দে লিখবে, তার মধ্যে সেটা তার লেখার জ্ঞাতসারে, অজ্ঞাতসারে চলে আসে। আপনি ধরেন যে, আমি সুররিয়ালিজম বিশ্বাস করি… আমি মনে করি যে, সুররিয়ালিজম সত্য, এখনও তাই বিশ্বাস করি। তার কারণ হচ্ছে, আপনার অন্তর্জগৎ থেকে, এই যে আপনি প্রশ্ন করলেন এটা যেমন সত্য, আবার এর ফলে যে সত্যভাষণ বেরিয়ে এল, সেটাও সত্য। শুধু বাক্যই সব নয়, আপনি হাসছেন, আমিও হাসছি, এটাও সত্য এবং এগুলো অন্তর্জগৎকে উন্মোচন করছে। ফলে, এগুলোকেও আমি সত্যের বড় জগৎ বলে মনে করি। অনেকে বলে, সুররিয়ালিজম চলবে না, সুররিয়ালিজম কবে অবসু্যলেট হয়ে গিয়েছে। কোনো কিছুই অবসু্যলেট হয় না। যা পেয়েছে সুররিয়ালিস্টরা তা আপনার গুহাচিত্রের মতো পেয়েছে। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, আপনি কোত্থেকে পেয়েছেন, আমি তো পেয়েছি আমার অন্তর্জগৎ থেকে। আমার সুররিয়ালিস্ট কবিতার বই, বইটা রাহমান ভাইয়ের কাছে ছিল…
ফরিদ: পরাবাস্তব কবিতা?
মান্নান: না, না, না জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ। পরাবাস্তব কবিতা আমি খুব সচেতনভাবে লিখেছি। জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ আমি যখন লিখি আমি জানি না যে আমি সুররিয়ালিস্ট কবিতা লিখছি। বহুদিন পর আমি আবার সুররিয়ালিস্ট বই লিখলাম। আমি যে ইসলামি কবিতা লিখেছি সকল প্রশংসা তাঁর, সেটা সুররিয়ালিস্ট ইসলামি কবিতা, যা পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কেউ লেখে নাই। শামসুর রাহমানকে বইটা দিয়েছিলাম, শামসুর রাহমানের ওটা সম্পর্কে মন্তব্যও আছে। কবি আবুল হোসেন শামসুর রাহমানকে জিজ্ঞেস করেছেন, মান্নান সৈয়দ এই বই লিখল? আমার মধ্যে যদি দুর্বলতা থাকত, আমি সে বই তাঁকে দিতাম না। আমাকে নিয়ে রাহমান ভাই, আবুল ভাই সব সময় কম্পিত থাকতেন। আমি ‘এখন’ বলে একটা পত্রিকার কিছুকাল উপদেষ্টা ছিলাম, ওখানে একদিন আমার সামনে বসেছিলেন এমন দুজন– যেটা আপনারা চিন্তাও করতে পারবেন না। সেটা আবদুল মান্নান সৈয়দ একজনই আছে, যে এটা পারে। তাদের একজন এখনো বেঁচে আছেন। আমার সামনে তখন বসেছিলেন সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ ভাই ও মাওলানা মুহিউদ্দিন খান। একজন ঘোর কমিউনিস্ট, আরেকজন ঘোরতর ইসলামি লোক। এমন দু’জন লোক পাশাপাশি বসে আছে, এটা শুধু আবদুল মান্নান সৈয়দের টেবিলের সামনেই সম্ভব, এটা আর কোনো সম্পাদকের টেবিলে সম্ভব না।
আসলে, সাহিত্যে, আমি যথাসাধ্য নিজের মতো থাকার চেষ্টা করেছি। তিরিশ বছর ধরে বড় কোনো সমঝোতা আমার জানা মতে করিনি। ঐ প্রসঙ্গ থাক, আমরা কবিতা প্রসঙ্গে চলে আসি।
টিপু: আপনি তো সাহিত্যের সব মাধ্যমেই কাজ করেছেন, আপনাকে কি পেশাদার লেখক বলা যায়…
মান্নান: আমার লেখালেখি হচ্ছে টাকার জন্য, এমনই আমার ধারণা। যদিও সায়ীদ ভাই বলেন, মান্নান পকেটে টাকা থাকলেও লিখবে, না থাকলেও লিখবে। আসলে, কাজশূন্য থাকতে আমার ভাল লাগে না। আবার, লেখা ছাড়া আর কোনো কাজও আমি জানি না। এমনকি এক কাপ চাও বানাতে পারি না। আপনার ভাবী যদি না বানিয়ে দেন, আমি না খেয়ে থাকি। তো এই যে, সেদিন একটি টিভি চ্যানেলে প্রশ্নকর্তা একজন লেখককে জিজ্ঞেস করেছেন, কীভাবে লেখক হিসেবে টিকে থাকা যাবে। লেখক হিসেবে টিকে থাকতে হলে, আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বলব, আমি এখনও লিখে যাই, তার একটা কারণ হলো_ আমি অন্য সবকিছুতে অনুপযুক্ত, আর এটাই হচ্ছে লেখক হিসেবে টিকে থাকার উপায়। এ অর্থে আমি ফুলটাইম লেখক।
মাতিয়ার: আপনি কি সুররিয়ালিজম সম্পর্কে জানার পর থেকেই সুররিয়ালিস্টিক কবি?
মান্নান: হ্যাঁ। তবে, এ সম্পর্কে জানার আগেই আমি ঐ ধরনের কবিতা জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ-এ লিখেছি। পরে ‘আমার আত্দচরিত’ নামে একটা গল্পও লিখেছিলাম ৬৩-৬৪ সালে। ‘সম্প্রতি’ নামে একটা কাগজ বের করছিলাম আমরা। ওখানে একটা মহিলার তিনটা স্তন। যখন আমি গল্প লিখেছি তখন তো আমি সুররিয়ালিজম সম্পর্কে কিছু জানি না। যখন আমি কবিতা লিখছি, গল্প লিখছি, তখন তো আমি নিজেই ঐ জগতে বিরাজ করছি। আমি লোকজনের সাথে মিশতে পারি না। তবে অভিনয় করতে পারি। ঐ সময় অভিনয়টা জানতাম। আসলে আমি কিন্তু অভিনয়ই করে যাচ্ছি। বলতে পারেন, অভিনয়ে মোটামুটি বেশ পারঙ্গম। আসলে ঐ যে আমার রক্তের জীবন যেটা দেখছেন আপনারা, এটা আসলে আমার অভিনয় জীবন। আমার জীবন গভীর নিঃসঙ্গ, নির্জন, একাকী, বিমর্ষ ও আত্মহত্যাপ্রবণ। দু’বার মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছি, কিন্তু এখন মনে হয় খামোখা এই বেঁচে থাকা। আমি আসলেই খুব নিরাশ। এইসব থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমি জটিল মানুষ। আমার লেখা থেকেও প্রমাণ হবে সেটা। আমি পুরো একটা ধারা, যেমন আজকে যেটা বললাম, এর পরে আমি কি কবিতা লিখব? আমি কিছু কবিতা লিখেছি, যেগুলো এখনও প্রকাশিত হয়নি। প্রকাশ করব জীবনের ধাক্কায়। সোজা কথা বলি, প্রেমের ধাক্কায়। আমি আরও অন্য ধারার কিছু কবিতা লিখেছি, যেগুলো এখনও বেরোয়নি। আমার স্বভাবের মধ্যে একটা চলমানতা আছে। যে চলমানতার ফলে আমি কারও প্রিয়পাত্র হতে পারলাম না। ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ লিখেছি, ‘মাছ সিরিজ’ লিখেছি, আবার ‘পাগল গদ্য মাতাল পদ্য’ কবিতা লিখেছি। ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ পড়ে একজন লিখল যে, আব্দুল মান্নান সৈয়দ ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ লিখেছে, প্রেম ও যৌনতা নিয়ে লিখেছে। আমার কাছে পত্রিকাটা এখনও আছে। যৌনতা সম্পর্কে বা প্রেম সম্পর্কে ইসলাম যেমন খোলাখুলি বলেছে, আর অন্য কোনও ধর্ম এভাবে বলেনি। আমি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, আজকে আপনাদেরকেও বলব, আমি আসলে অনুবাদক। অনুবাদক মানে আমার গল্প, উপন্যাস, নাটকে, প্রবন্ধে আমি আমার অনুভূতি, আমার অভিজ্ঞতা, আমার পাঠ সমস্ত কিছুই অনুবাদ করে চলেছি। একটাই কাজ আমার, সেটা হচ্ছে অনুবাদ। আমি মূলত আমার সংবেদন এবং অভিজ্ঞতার অনুবাদক। সেটা কখনও গল্পে, কখনও কবিতায়।
মাতিয়ার: সেইসঙ্গে আপনাকে সেখানে কি অনুঘটকও বলা যায়?
মান্নান: হ্যাঁ, তাও বলতে পারেন।
টিপু: আচ্ছা, মান্নান ভাই আপনি বললেন যে, আপনি খুব নিঃসঙ্গ, এটা কি রবীন্দ্রনাথের গান শোনার পর হয়? মানে, জিনিসটা রবীন্দ্রনাথ থেকে আসছে কিনা?
মান্নান: রবীন্দ্র সঙ্গীতের মর্ম বুঝি তখন, আমি নিজে যখন এসবের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গিয়েছি। আর এখন আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনলে, শুনিও না বেশি, যখন চুপ করে বসে থাকি, রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনলে অন্য কোনও কিছু মাথায় কাজ করে না। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে, আমার বন্ধু, প্রিয়তম বন্ধু, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে একদিন বলেছিলাম, সায়ীদ ভাই এখন বুঝতে পারছি রবীন্দ্রনাথ কেন এত বড়। এবং বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ লেখক। সেটা এখন বুঝতে পারছি। কারণ রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছে, দেখতে সুন্দর ছিলেন, বড় লোকের ছেলে ছিলেন, এসব আমাকে স্পর্শ করেনি। তবে, রবীন্দ্রনাথ নয় আমার প্রিয় বরং অতুল প্রসাদ, তাঁর গান অসম্ভব ভাল লাগতো, অসম্ভব। উনার ব্যাপ্তি, মানে আমার অসুখের পরে যখন প্রথমবার আমাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, উনি আমাকে বললেন যে, আপনি আমার কাছে আগে এলে আপনার এ রোগ হতো না। একথা এ লেখায় আছে। আমি মনে করি, সেটা হচ্ছে আমি যদি ঐ অসুখটা সারাই, তা হলে আমার ধারণা আমার লেখা আমাকে ছেড়ে যাবে। (হাসি) সে জন্যে আমি অসুখটা পুষেই রাখি। পুরো পাগল হইনি, কিন্তু পাগলামির একটা প্রান্ত পর্যন্ত আমি হয়ে গেছি। যে কোনো সময় যে কোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। তো, আমার কথা হচ্ছে, আমার কিন্তু একটা গভীর দুঃখবোধ আছে, শীতলতা, এইসব। মাঝে একদিন ‘প্রথম আলো’তে আমার কবিতা পড়ে ফোন করলেন এক ডাক্তার সাহেব। উনি নিয়মিত আমার কবিতা পড়েন এবং মাঝে মাঝে ফোনও করেন। ফোনেই আলাপ হয় তাঁর সাথে, চাক্ষুষ আলাপ হয়নি। ঐ ভদ্রলোকের বন্ধুরা সব আমার কবিতার ভক্ত, ওরা ‘প্রথম আলো’তে আমার কবিতা পড়েন। তাঁকে যখন এবার অসুখের পর বললাম, আমি অসুস্থ, তারপর বললাম যে, ইদানীং আমি মার্কস ও লেনিন পড়ে বিস্মিত। উনি অবাক হলেন, যখন শুনলেন আমি লেনিনের ওপর একটা লেখার প্রস্তুতি নিয়েছি। এর মানে আমি যে চিন্তা করছি, আমি যদি এসব নিয়ে লেখালেখি করি, চিন্তা করি, তখন মৃতু্যর পরে কিন্তু একটা মুশকিল হয়ে যাবে যে, আমার আসলে কোনটা মত, কী আমার পরিচয়। কারণ আমার তো অনুসন্ধানের কোনো শেষ নেই। আমার সন্ধান এবং শোচনা, আমি এইখানে একটু বলে রাখি, আমার একটা এই বইয়ে আছে… একটা কবিতা বা গদ্যের মধ্যে আছে, আহমদ ছফা একবার আগে আমাকে বলেছিল, আহমদ ছফা তো খুব স্ট্রেইট কথা বলত, ও যে অনেক বড় লেখক, সেটা ওর মৃতু্যর পর ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে। এখন আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, লেখক হিসেবে ও খুবই উৎকৃষ্ট ও ভালো লেখক। আমরা তাঁর মূল্য দেই না। আমরা এদেশে ওকে বুঝতে পারি না। যাই হোক, ও অনেকদিন আগে বাংলা একাডেমীর গেটে আমাকে বলেছিল, আমার সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও ওর মধ্যে আমার ওপর একটা সস্নেহ ভাব ছিল। একটা অভিভাবকত্ব ছিল। ও বলেছিল, শক্তিমান লেখক হতে হলে আমাকে স্বাধীন লেখক হিসেবে লিখতে হবে। এখন আমার সে কথাটা মনে হয়– যে সমাজে, যে মানুষের মাঝে আমি ছিলাম তাদের জন্য আমার যথেষ্ট মমতা আছে, কিন্তু আমার লেখায় ওদের কোনো ছাপ নেই। কিন্তু আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন, পেশাদার যারা সমাজতান্ত্রিক, পেশাদার যারা মানবপ্রেমিক তারা ইসলামি হোক, কিংবা সমাজতান্ত্রিক হোক, তাদের সঙ্গে আমার পার্থক্য হচ্ছে এই, আমার অসুখের পরে, আমার বাড়িতে তারা দেখতে এসেছিল… ওরা আমাকে ভালবাসে, অসম্ভব ভালবাসে। মিন্তিরা আমাকে প্রথম দেখতে এসেছিল, বুদ্ধিজীবীরা নয়। সাধারণ মানুষের ভালবাসা এতোটাই।
মাতিয়ার: আপনি আপনার লেখার মধ্যদিয়ে সাধারণ মানুষের কী উপকার করতে পারতেন? লেখার মধ্যে সাধারণ মানুষের কোনো উপযোগিতা আছে কিনা?
মান্নান: এটা খুবই ভালো প্রশ্ন করেছেন। কারণ লেখায় যারা সাধারণ মানুষের কথা বলে, তাদের তো দেখি অন্যরকম। কিন্তু দু’টো উদাহরণ আমি বলব, মানে দু’জন আদর্শ মানুষের কথা আমি বলব, যাদের আমি শ্রদ্ধা করি। একজন হচ্ছেন রণেশ দাশগুপ্ত, আরেকজন হচ্ছেন ফররুখ আহমদ। ফররুখ আহমদকে আমি প্রথম দেখেছি রেডিওতে। উনি অবশ্যই আদর্শবাদী ইসলামি, আর রণেশ দাশগুপ্ত আদর্শবাদী সমাজতন্ত্রী। তার সাথে কলকাতায় প্রথম আলাপ। রণেশদা আমার বইয়ের আলোচনা করেছেন। আমিও রণেশদা’র বইয়ের আলোচনা করেছি। আমি ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ নামে ওনার একটা বই আছে না, অনেক আগে একসময় সেটার আলোচনা করেছিলাম। তো রণেশদা’র সাথে কলকাতায় আমার সখ্য। একদিন বললাম, রণেশদা আপনার যেটা আমি বুঝেছি, আপনার সাহিত্য নিয়ে থাকাই উচিত ছিল, আপনি কী ঐসব রাজনীতি-টাজনীতি করেন– দেখুন, আপনার লেখা পড়ে মনে হয়, আপনি সাহিত্যিক, আপনার গদ্য ক্রিয়েটিভ গদ্য, তো উনি শুনে খুব হাসলেন। রণেশদা তো ওই ধানমণ্ডি, গুলশানে বসে সমাজতন্ত্র করতেন না। উনি যেটা করতেন সেটা হচ্ছে অন্তরাত্দা থেকে। এরা এয়ারকুলার গাড়িতে চড়ে সেটা করতেন না। এখন আপনার প্রশ্নে আসি, হ্যাঁ, এইটা কতখানি সম্ভব। একেবারে সম্ভব না– তাতো নয়। দুটো উদাহরণ বলি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর বিষ্ণু দে। বিষ্ণু দে’কে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আক্রমণ করেছেন ড্রয়িং রুম বিলাসী মার্কসিস্ট বা সমাজতন্ত্রী বলে। কিন্তু বিষ্ণু দে কলকাতার মুসলমানদের বাঁচাতে গিয়ে লাঠির আঘাত খেয়েছিলেন। আবার, সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেমন চালাক মানুষ– উনি যখন যেভাবে, মানে, বাতাস যেদিকে ঘুরেছে, সেদিকে উনি চলে গেছেন।
ফরিদ: আসলে আমরা কথা বলছিলাম, লিখে কীভাবে সাধারণ মানুষের উপকার করা যায়…
মান্নান: লিখে সাধারণ মানুষের কীভাবে উপকার করা যায় জানি না। কিন্তু সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি, তা আমার নিজের লেখাতে বলেছি। আমি এইটুকু খোঁজ রাখি যে, ঈদের আগের দিন চাঁদ রাতে যে শ্রমিকটি বাড়ি যায়, তার কথা যদি আমি লিখতে পারি– সেটা তো খারাপ নয়। এর বেশি তো খুব কিছু করা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। আমি আমার জীবন-যাপন থেকে তো বেরিয়ে আসতে পারব না। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি কী? দেখছি, আমরা যারা বিভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী, আমরা বিত্তের জীবনযাপন করি, আমাদের সব সময় চেষ্টা হচ্ছে, আমরা ভালো জীবনযাপন করব। এই যে দেখুন নাম বলতে চাই না, একজন কথাশিল্পী যিনি নিজের জীবনের উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটিয়েছেন, মানে কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি থেকে নিজের গাড়ি-বাড়ি করা, যত বেশি উন্নতি করছে, তত বেশি দরিদ্রের প্রতি তার সহানুভূতি বেড়ে গেছে, এইটা তো অন্ততপক্ষে বিষ্ণু দে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ে দেখিনি।
ফরিদ: আপনি চারিত্র্য নামে একটা কাগজ করতেন, সে কাগজটা থাকতে কেন আরেকটা কাগজ করতে গেলেন।
মান্নান: কাগজ না, এটা আমার লিটল ম্যাগাজিন। ধরেন, আমি যদি কলকাতায় থাকতাম, আমি তো ঐদিককার লোক, কাজেই ওখানে থাকলে আমি হতাম লিটল ম্যাগাজিনেরই লেখক। কিন্তু ফরিদ কবির, আমি ওখান থেকে চলে আসি বাংলাদেশে, ওদের কারো সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিল না, তাই। কারণ আমি এতটাই উদ্ধত যে, আমার কারও সাথে বনিবনা হয় না।
মাতিয়ার: বনিবনা কেন হয় না, আপনি মুসলিম বলে কি?
মান্নান: বনিবনা হয় না, আপনি এতো সরলীকরণ করবেন না। বনিবনা হয় না যে, আমার নিজস্ব ইগো। আমার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য এত বেশি যে, আমি রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করতাম, আপনি মুসলমানকে নিয়ে কেন লিখেন না? আমি নজরুলকে জিজ্ঞেস করতাম, আপনি হিন্দু-মুসলমান মিলনের কথা বলছেন, আবার ঐদিকে আপনি স্বরস্বতী পূজা করেন। জীবনানন্দকে বললাম যে, আপনি তো বাপ বেঁচে থাকা পর্যন্ত এই-এই করেছেন, ব্রাহ্ম-ট্রাহ্ম করেছেন, বাবা মরে যাওয়ার পর আপনি বললেন যে, আপনি নাস্তিক। এগুলো আমি করতাম, আবার আমার নিজের মধ্যেও চলমানতা আছে। আমি নিজেকেও চিনি না। কিন্তু আমার আত্দসম্মানবোধটুকু আছে। লেখক হিসেবে মনে করি, জীবনেতো অনেক কাজই করেছি, কিন্তু লেখক হিসেবে নূ্যনতম সম্মান যতটুকু না হলেই নয়, যতটুকু বনিবনা না হলে নয়, তা বাদ দিয়ে তো কোনো কাজ করিনি। এ কারণেই আমার চলমানতা আছে। এই চলমানতা নিয়েই তো আপনার আগ্রহ। না হলে আপনারা আসবেন কেন। আমার চলমানতা না থাকলে, ঐ নতুন কিছু না লিখলে আপনারা আসতেন না। আমি তো স্রেফ নতুন কিছু লিখার জন্য লিখি না, বরং এটাই আমার অন্তর্গত লেখক সত্তা।
ফরিদ: তো মান্নান ভাই, চারিত্র্য প্রসঙ্গে যা বলতে যাচ্ছিলেন, তা কিন্তু অসমাপ্ত থেকে গেল…
মান্নান: সেটাই তো আমি বলতে চাচ্ছিলাম, প্রসঙ্গটা অন্যদিকে চলে গেছে। হ্যাঁ আমি যদি কলকাতার লেখক হতাম, তাহলে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মতো হতাম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো হতাম না। আমি ঐ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মতো লিটল ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিন করতাম। কমলকুমার মজুমদারের মতো সারাজীবন লিটল ম্যাগাজিনে থেকে যেতাম। কিন্তু বাংলাদেশ ছোট জায়গা, এখানে ওখানকার মতো অত লিটল ম্যাগাজিন কী করে হবে। আমার বয়স হয়েছে। এখন আমাকে সত্য কথা বলতে হবে। যেসব অধ্যাপকের মুরোদ নাই মিডিয়ার ইচ্ছার বাইরে যাওয়া, যাদের অধ্যাপকি করা মানে সারাজীবন শুধু একটি বিষয় নিয়েই বক্তৃতা দেয়া, এই তাদের অক্ষমতার জন্যই তো আমাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডাকে যেতে হচ্ছে। যদি কলকাতায় থেকে যেতাম, তাহলে তো আমাকে এগুলো করতে হতো না।
ফরিদ: দেখা যাচ্ছে আপনার লেখার জন্য এ দেশের সকল কাগজ রয়েছে, তারপরও আপনার কেন আলাদা কাগজ করার প্রয়োজন হলো?
মান্নান: আমি যে লেখাটা লিখতে চেয়েছি, সেই লেখাটাতো আমাকে এই প্রতিষ্ঠানগুলো, এই প্রাতিষ্ঠানিক কাগজগুলো লিখতে দেয়নি। এই যে এই বইটা, এই বইয়ের লেখা পত্রিকায় দিলে ছাপতো কিনা, সে ব্যাপারে আমি খুব সন্দিহান। ফলে আমি লিটল ম্যাগাজিন করতে চেয়েছিলাম এজন্য যে, আমার নিজস্ব যে লেখা সেটা যেন আমি লিখতে পারি। জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ বা ঐরকম কিছু কবিতা যা আমি লিখেছি। কিংবা যেসব গল্প প্রথাগত নয়, সেগুলো তো আপনার তথাকথিত বড় কাগজে ছাপা সম্ভব না। এসব লেখার জন্যই লিটল ম্যাগাজিন। আমি আসলে সব সময় এঙ্পেরিমেন্টাল।
ফরিদ: আপনার লেখা সব সময় সিরিয়াস মনে হয়, কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিঃ যখন পড়ি, তখন আমার মনে হতো, আপনার রসবোধও বেশ প্রবল, ঐখানে কয়েকজন কবিকে নিয়ে বেশকিছু কবিতা লিখেছেন, আমার যদ্দুর মনে পড়ে যে– রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ফররুখ এমনকি বাংলাদেশের আবিদ, শিহাবকে নিয়েও কবিতা আছে বলে আমার মনে পড়ে, সেটা প্রায় পঁচিশ বছর আগে করেছেন, আপনার ইদানীংকার লেখা পড়ে আমার মনে হয়, শ্লেষ বা কৌতুক এটা দেখা যায় না, এর কারণ কি? কবিতাকে কখন প্রাইভেট লিমিটেড মনে হয়েছে?
মান্নান: আমি বিশ্বাস করি, কবিতা সব সময়ের জন্য নয়। সব সময় একই রকম হবে, তাও নয়। দু’টি জিনিস আমি বিশ্বাস করি, জীবনের যে জটিল বাস্তবতা, জীবনের যে জটিলতা, সেটা কবিতায় ধারণ করা প্রায় কঠিন। কিন্তু সংকটকে কবিতায় যেভাবে রূপান্তর করা যায়, সেটা আর কোনো মাধ্যমে সম্ভব না। আমি যেটা বললাম, জটিল বিচিত্র জীবনকে ধরার যেটা উপায় বা মাধ্যম সেটা হচ্ছে উপন্যাস। যে উপন্যাস লেখার সময় আমি কোনোদিনও পাইনি। হয়তো পাবোও না। হয়তোবা পেতেও পারি। আপনারা সবাই যদি আমাকে বর্জন করেন, তখনও আমার হাত থেমে থাকবে না, আমি লিখে যাব। কিন্তু আমি যদি বর্জন করি, তাহলে ঐ প্রতিষ্ঠানগুলো আমার বিকল্প খুঁজে পাবে না। সায়ীদ ভাইকে একবার একটা কথা বলেছিলাম, যত প্রতিষ্ঠান আমাকে বর্জন করবে, এবং আমি যত প্রতিষ্ঠান বর্জন করব সব আমার লাভ, দুদিক থেকে আমার লাভ। কারণ, আমি যে লেখা লিখতে পারছি না, সে লেখা লিখতে পারব। তারপরও আমি একই সঙ্গে মানুষ। আমার বয়স বেড়ে গেছে। আমাকে কেউ ডাকল না, আমাকে কেউ লিখতে বলছে না, তখনতো আমার খারাপ লাগবেই। কলকাতা হলে এই লাভ হতো যে, সেখানে আরও সমমনা লেখকবন্ধু পেয়ে যেতাম, নিঃশর্তে আমার নিজের কাজ করে যেতে পারতাম। তাহলে আমার অনেক বেশি নিজস্ব লেখা, অনেক বেশি অন্তরাত্মার লেখা লিখতে পারতাম। ফলে একথা থেকে আপনার একটা প্রশ্ন বেরুচ্ছে, আপনি যেমন লেখা লিখতে চাচ্ছেন, যেমন কাজ করতে চাচ্ছেন, অনেক পরিকল্পনায় সেটা করতে পারেননি? না করতে পারিনি, পারছি না। দেখবেন, আমাদের অধ্যাপক প্যাকেটজাত কাগজে সাক্ষাৎকার দেখেন, ছবি দেখেন টেলিভিশনে, তারা কি সবাই নিজের অন্তরের কথা বলছে? তারপরও আমাকে লিখে যেতে হচ্ছে, টিভিতে সাক্ষাৎকার দিতে হচ্ছে, টক শো’তে যোগ দিতে হচ্ছে, কারণ এছাড়া তো আমার আর কোনো দক্ষতা নেই।
মাতিয়ার: আমাদের লেখক-সাহিত্যিকদের অনেকে তো এখন কলাম লেখায় ঝুঁকে পড়ছেন, টিভি চ্যানেলে যাওয়ার জন্য প্রসাধনী সেরে নিচ্ছেন…
মান্নান: তাই তো হবে। খ্যাতি হচ্ছে আমাদের দেশে টেলিভিশননির্ভর। আরেকটা হলো, বক্তৃতানির্ভর। বক্তৃতা দিতে সবাই খুব ওস্তাদ। জাড্যের ভারে আর খ্যাতির ভারে তারা কিছু লিখতে পারে না।
মাতিয়ার: জাড্য ও খ্যাতি তো পাশাপাশি থাকতে পারে না?
মান্নান: হ্যাঁ, তবে আমি জাড্য বলতে এখানে বোঝাতে চাচ্ছি যে, তারা খ্যাতির ভারে এমনই স্থবির, জাড্য হয়ে পড়েন যে, তারা সৃষ্টিশীল বা মননশীল কিছু করতে পারেন না। দেখবেন, বয়সে যারা আমার ছোট তারাও এখন সভাপতিত্ব করছে, আর পেপার লেখার জন্য বলা হচ্ছে আমাকে। এখন যাদের আর কিছু করার যোগ্যতা বা সময় নেই, কলাম লেখকে পরিণত হয়েছে। আমিও কলাম লিখেছি। আমারও একটা নির্বাচিত কলামের বই বেরিয়েছে। কিন্তু ওটা বেশি করতে চাইনি। আমাদের দেশের লেখকের মৃতু্যর আগে শেষ মুহূর্ত হচ্ছে কলাম লিখে বেঁচে থাকা। আর টিভি থেকে কখন ডাক আসবে, তার জন্য অপেক্ষা করা।
মাতিয়ার: শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ, সময়ের বিচারে বাংলা কবিতায় এই দুই কবির মধ্যে কাকে এগিয়ে রাখবেন?
মান্নান: সেইটা তো কাল বিচার করবে। কাল বিচার করবে এঁরাও হয়ত কেউ নয়। এত দ্রুত এর সমাধান করা যাবে না। শিল্পের ইতিহাস এত দ্রুত সমাধান করা যায় না। এইটা আপনি কেমন প্রশ্ন করলেন বলেন তো? শামসুর রাহমান লিখেছেন প্রচুর, এত লিখেছেন যে, তাঁকে তো অত সহজে বিশ্লেষণ করা যাবে না। আরও দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। তবে আপনারা জেনে রাখবেন যে, শামসুর রাহমানের কোনো প্রকৃত বন্ধু ছিল না। যারা তাঁকে সবসময় ঘিরে থাকতো, তারা সকলেই ছিল তাঁর স্তাবক, চাটুকার। মেধাহীন সেইসব লোক নিজ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে তাঁকে ব্যবহার করত। তাঁকে নিয়ে স্তুতিভরা লেখা লিখেছে।
টিপু: আপনার সমকালীন ষাট দশকের মধ্যে কার কার লেখা পছন্দ করেন?
মান্নান: কার লেখা বলি, আমার বই পড়ে নেয়া ভালো। এ নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
মাতিয়ার: মান্নান ভাই, আপনাদের ষাট দশকে দেখা গেছে যে, এক ঝাঁক প্রতিভাবান ও মেধাবী কবি-লেখকের উপস্থিতি। কিন্তু একই ভাষার হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়, সেরকম মেধাবী ও প্রতিভাবান কবি-লেখক ওভাবে আসেনি, এর কারণ কী?
মান্নান: না, না, এটা বলতেই হবে। তো এটার কারণ কী বলব, দেখুন পরাধীন ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মতো প্রতিভা জন্মগ্রহণ করল, এটাতো স্বাধীন বাংলাদেশে হলো না। আমি একটা জিনিস বিশ্বাস করি, প্রতিভা শুধু দেশ-কাল-সমাজনির্ভর নয়। তবে হঁ্যা, আবার দেশ-কাল-সমাজেরও একটা প্রভাব থাকে, এটা ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা মুশকিল। তবে ষাটের দশকে আমাদের কবিরা মনে হয় ওখানকার চেয়ে অনেকখানি অগ্রসর।
ফরিদ: আবার উল্টো দিকে দেখা যায় ঐখানকার সত্তর দশকের কবিতা অনেক বেশি উৎকৃষ্ট, মানে নিরীক্ষাপ্রবণ– এখানকার সত্তরের তুলনায়, এটা কেন?
মান্নান: যেটা হয়েছে সেটা হলো– পঞ্চাশের কবিদের যে প্রভাব সত্তুরের ওপর, পঞ্চাশের ব্যাপ্তির জন্য সত্তুর হয়ে পড়েছিল অনেকটা অসহায়, যে-কারণে অস্বীকার করা তো যাবে না যে, পঞ্চাশের ওই ব্যাপ্তির ফলে সত্তুর কিছুটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।
মাতিয়ার: তবে বলা বাড়তি যে, পঞ্চাশের মধ্যে এক রাহমান ভাই-ই সত্তুরের প্রায় পুরোটা গ্রাস করে ফেলেছেন…
মান্নান: তাতো বটেই। হ্যাঁ, শামসুর রাহমানের একটা বড় প্রভাব আছে, এই প্রভাব ষাট-এর দশকে যেমন আছে, তেমনি পরবর্তীকালেও পড়েছে। সত্তুরের কবিদের মধ্যে ষাটের প্রভাব আছে, আশি’র মধ্যেও আছে। যাই হোক, এ নিয়ে আমি বেশি কিছু বলতে চাই না, এটা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন।
ফরিদ: আপনার কি মনে হয় যে, পঞ্চাশের পরে বা আপনাদের পরে, যে কবিতা লেখা হচ্ছে, সেটা পরবর্তী প্রজন্মকে সৃষ্টিশীল কোনো পথ দেখাতে পারবে?
মান্নান: অন্যদের কথা আমি কি বলব, তবে আমি কতটুকু কী করেছি, সে বিষয়ে যদি কোনো কথা আসে, তখন যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করি, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের মধ্যে কী আছে, কতটুকু নিরীক্ষা আছে, আব্দুল মান্নান সৈয়দের তুলনায় কী বলবেন?
ফরিদ: সে আপনিই বলতে পারবেন।
মান্নান: কাজেই যেটা করা উচিত, আমাদের সমালোচনাতো আপনার এ রকম সাক্ষাৎকারনির্ভর করলে চলবে না। প্রকৃত কাজ দিয়ে করতে হবে।
ফরিদ: আজ এ পর্যন্তই থাক, আমরা আজ উঠি।
মান্নান: দেখা হবে তাহলে। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
ফরিদ: আপনাকেও। ♦
প্রিয় মতিয়ার
আপনার লেখার ধারটা আমাকে চকিত করে। আপনি যদি আপনার গল্প এবং একগুচ্ছ কবিতা পলিমাটি’তে প্রকাশের জন্য পাঠান তাহলে খুশি হবো।
তালিব বাশার নয়ন
সম্পাদক
পলিমাটি
ত্রৈমাসিক লিটল ম্যাগ (কৃষি-প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রান্তসমাজ-গণসংস্কৃতি)
৪২ মাগুরা রোড (নিচতলা), ঝিনাইদহ-৭৩০০
মোবা: ০১৭১৫-২৫১ ৭১৯
ইমেইল: [email protected]