ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ১ ।। ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ২ ।। ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৩ ।। ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৪।। ইউ. জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৫ ।। ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৬ ।। ইউ.জী. কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৭ ।। ইউ জী কৃষ্ণমূর্তির সাথে কথোপকথন: ৮
যৌনতা আর প্রেমের প্রবর্ধন
[এটি একজন সেক্স থেরাপিষ্টের সাথে তাঁর আলাপচারিতা।]
বাংলা অনুবাদ: নান্নু মাহবুব
সাক্ষাৎকারগ্রাহক: মনুষ্যসম্পর্কটা হয়ে দাঁড়িয়েছে একধরনের বাণিজ্যিক লেনদেনের মতো─ ‘তুমি আমাকে কিছু দিলে, আমিও তোমাকে কিছু দিবো’। আমরা কি এটা নিয়ে একটু আলোচনা করতে পারি?
ইউ জী: হ্যাঁ। সেটা সত্যি। আমরা সেটা মানতে চাই না কারণ, মনুষ্যসম্পর্ক একটা বিস্ময়কর বা অদ্ভুত কিছু─সেই মিথটাকেই এটা ধ্বংস করে দেয়। ‘‘সম্পর্কটা থেকে আমি কী পাবো?’’ ─এর ওপর ভিত্তি করেই-যে সমস্ত সম্পর্কগুলো গড়ে ওঠে, সেটা মেনে নেবার মতো যথেষ্ট সৎ, সভ্য, শালীন আমরা নই। পারস্পরিক সন্তুষ্টি ছাড়া এটা আর কিছুই নয়। সেটা না থাকলে কোনো সম্পর্কই সম্ভব নয়। সামাজিক কারণে, বা সন্তান, সম্পত্তি আর নিরাপত্তার কারণে তুমি সম্পর্কটা অব্যাহত রাখছো। এই সবই ওই সম্পর্ক ব্যাপারটার অপরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু যখন এটা ব্যর্থ হয় এবং আমরা আসলে যা চাই সেটা দেয় না, তখন যাকে আমরা ‘‘ভালবাসা’’ বলি, সেটা এর ওপর আরোপ করি। তো পারস্পরিক সন্তুষ্টির ওপর নির্ভর না করে কোনো পর্যায়েই কোনো সম্পর্ক থাকা সম্ভব নয়।
সমগ্র সংস্কৃতি, তার নিজস্ব কারণে, তার নৈতিক মূল্যবোধের মাধ্যমে আমাদের জন্যে এই পরিস্থিতিটা সৃষ্টি করেছে। নৈতিক মূল্যবোধের চাহিদাটা হলো সম্পর্কের ভিত্তি হবে ভালবাসা। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো নিরাপত্তা, তারপর অধিকারিত্ব। অন্য মানুষটাকে তুমি অধিকার করতে চাও। নানা কারণে যখন অন্যজনের ওপর তোমার প্রভাবটা দুর্বল হয়ে আসে, তোমার সম্পর্কটা নিঃশেষ হয়ে যায়। সারাক্ষণ তুমি এই প্রেম-প্রেম সম্পর্ক ধরে রাখতে পারবে না।
একজন পুরুষ এবং একজন নারীর মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তিটা হলো, পরস্পরকে নিয়ে তাদের দু’জনের নিজের জন্যে সৃষ্ট প্রতিরূপ। সুতরাং, দু’জন ব্যক্তির মধ্যে প্রকৃত সম্পর্কটা হলো দুইটা প্রতিরূপের মধ্যেকার একটা সম্পর্ক। কিন্তু তোমার প্রতিরূপটা পাল্টে যাচ্ছে, এবং তারটাও পাল্টে যাচ্ছে। প্রতিরূপটা স্থির রাখাটা আসলে সম্ভব নয়। কাজেই অন্য সবকিছু যখন ব্যর্থ হয়, তখন যত বিস্ময়কর আর রোমান্টিক ধারণা দিয়ে মুড়ে, প্যাকের এই চূড়ান্ত, শেষ তাসটা আমরা ব্যবহার করি, ‘‘ভালোবাসা’’।
আমার কাছে, ভালোবাসা মানে দুই [ব্যক্তি]। যেখানেই বিভক্তি সেখানেই দ্বন্দ্ব, তা সে তোমার ভেতরেই হোক আর বাইরেই হোক। ওই সম্পর্কটা দীর্ঘকাল টিকতে পারে না। আমার ক্ষেত্রে, সম্পর্কটা গঠিত হয়েই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই দুইটা ব্যাপারই ঘটছে একই কাঠামোর মধ্যে, কাঠামো শব্দটা যদি ব্যবহার করি। সেটা সত্যিই একটা সমস্যা। তোমার মনে হতে পারে আমি খুব স্থূল ধরনের একটা মানুষ, কিন্তু কেউ যদি আমার কাছে ভালবাসার কথা বলে, সেটা আমার কাছে শুধুই একটা ‘‘চার অক্ষরের শব্দ’’ মাত্র। সেটাই নারী পুরুষের মধ্যে একমাত্র মূলগত সম্পর্ক। কিন্তু তোমার কী ধরনের সম্পর্ক থাকা উচিৎ সেই বিষয়টা আমাদের জন্যে একটা সামাজিক সমস্যা। এই আমাদের যৌবনেও একই উপজাতি না হলে ব্রাহ্মণদের মধ্যেও বিয়েশাদি হতো না। অন্যান্য দেশের জাতপাত থেকেও এটা ছিল আরো খারাপ। তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার একটা অদ্ভুত অভিপ্রায় ছিল। ঐতিহ্যটা আসলে কী? পরিবর্তমান সময়ের সাথে সাথে পাল্টাতে না চাওয়া। পরিস্থিতির চাপে আমরা সামান্যই পাল্টাই। কিন্তু সত্যিটা হলো, পরিবর্তন আমাদের চিন্তাপ্রক্রিয়ার আগ্রহের বিষয় নয়।
দুর্ভাগ্যক্রমে, এই যৌনতা জিনিসটাকে আমরা অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছি। এটা প্রাণীটার একটা সাধারণ জৈবিক প্রয়োজন মাত্র। দেহ শুধু দুইটা জিনিসে আগ্রহী─টিকে থাকা আর নিজের অনুরূপ বংশবিস্তার করা। আর কোনো কিছুতেই এর আগ্রহ নেই। অথচ যৌনতা আমাদের জন্যে একটা সাংঘাতিক সমস্যা হয়ে গেছে, কারণ দেহের এই মূল জৈবিক ক্রিয়াটাকে আমরা একটা ভোগকর্ম বানিয়ে নিয়েছি। চিন্তা না থাকলে দেখ কোনো যৌনতাও নেই।
দ্বিতীয় সমস্যাটা হলো, [আমাদের কাছে] যৌনকর্মটা ঠিক গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ বরং ওই প্রবর্ধনের ব্যাপারটা, প্রেমলীলাকে ঘিরে যে রোমান্টিক কাঠামোটা আমরা গড়ে তুলেছি। যেমন ধরো, তুমি একটা সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকালে, যখনই তুমি বলছো যে এটা একটা সুন্দরী মেয়ে, ইতিমধ্যেই তুমি একটা সমস্যা সৃষ্টি করে ফেলেছো─ ‘‘একটা সুন্দরী মেয়ে!’’ তখন শুধু চোখে দেখার চাইতে তার হাত ধরাটা বেশি সুখকর, আরো বেশি সুখকর হলো তাকে আলিঙ্গন করাটা, এমনকি আরো বেশি সুখকর হলো তাকে চুম্বন করাটা, এইরকম। এই প্রবর্ধনটাই হলো আসল সমস্যা। যখনই তুমি বলছো যে সে একটা সুন্দরী মেয়ে, দৃশ্যপটে সংস্কৃতি এসে হাজির হচ্ছে।
এইখানে [নিজেকে নির্দেশ করে] প্রবর্ধন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত যেহেতু এর [নিজের চোখ নির্দেশ করে] নির্দিষ্ট কোনো জিনিসে ফোকাস করার কোনো উপায় নেই। এমনও হতে পারে, ওই সুন্দরী মেয়েটা যখন তার মুখটা খুললো, তার দাঁতগুলি হয়তো যতটা কুৎসিত হওয়া সম্ভব ততটাই কুৎসিত। তো দেখ, সেটা [চোখ] হয়তো মেয়েটির নড়াচড়ার সাথে সাথে সেখান থেকে এখানে সরে আসছে এবং আবার এখান থেকে অন্যকিছুতে সরে যাচ্ছে। এটা ক্রমাগত এর ফোকাস পরিবর্তন করছে এবং তখন তোমার ওই প্রবর্ধনটা ধরে রাখার কোনো উপায় নেই। সেখানে আছে শুধু শারীরিক আকর্ষণ। যা থেকে তুমি কখনোই মুক্ত হতে পারবে না, কখনোই না। যাবতীয় ওইসমস্ত লোকজন─ওইসমস্ত সন্তরা─এই স্বাভাবিক আকর্ষণ সংযমের ধারণায় নিপীড়িত। কিন্তু ওই স্বাভাবিক আকর্ষণটা এমন একটা জিনিস, যাতে দোষারোপ করা উচিৎ নয়। তুমি একজন সাধু, তুমি একজন আত্মদর্শী, তুমি একজন বোধিপ্রাপ্ত বা সন্ত, এইজাতীয় জিনিস তোমার চিন্তা করা উচিৎ নয়, ─এইসমস্ত তুমি আর নিজেকে বলছো না। ওইটা [নিজেকে এইসমস্ত বলাটা] সত্যিই একটা সমস্যা। তাঁরা সেটা মেনে নেবার মতো যথেষ্ট সৎ নন। তো যখনই কোনো সাধু বা কোনো ব্রহ্মচর্য পালনকারী আমার কাছে আসেন, তাঁর সাথে আমি খুব নিষ্ঠুর আচরণ করি। জিজ্ঞেস করি, ‘‘সত্যিই কি তুমি বুঝাতে চাও তোমার কখনোই সুপ্তিস্খলন হয় নাই?’’ আমি তাঁকে বলি, ‘‘অধ্যাত্ম অন্বেষণের নামে ব্রহ্মচর্য পালন করাটা প্রকৃতির বিরুদ্ধে একটা অপরাধ।’’ লোকটা যদি নপুংসক হয়ে থাকে বা মেয়েটা যদি কোনো কারণে বন্ধ্যা হয়ে থাকে, সেটা আলাদা কথা। মানুষের ধর্মভাবনা কেন তার আধ্যাত্মিক সিদ্ধির ক্ষেত্রে যৌনসংযমে এত গুরুত্ব দিয়েছে সেই জিনিসটা আমি বুঝতে পারি না। হতে পারে ওই পন্থাতেই যেহেতু জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেহেতু যৌনতাই সবচেয়ে শক্তিশালী তাড়না।
তাহলে যৌনতা একটা স্বাভাবিক জিনিস, সেটা অশ্লীল কিছু নয়?
ঠিক। যৌনতা খুব স্বাভাবিক একটা জিনিস। দেখ, যৌনতা না করলে হয়তো মূত্রের মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে তোমার শুক্র বেরিয়ে যাবে। মোট কথা, যৌনগ্রন্থিগুলোর কাজকর্ম চলতেই হবে। সেগুলি যদি স্বাভাবিকভাবে কাজ না করে, তুমি একটা অস্বাভাবিক ব্যক্তি। কিন্তু আমরা এই সত্যিটা মানতে প্রস্তুত নই, যেহেতু এটা মনুষ্যসংস্কৃতির ভিত্তিটাকেই ধ্বংস করে দেয়। আমরা এই সত্যিটা মেনে নিতে পারি না যে আমরা শুধুই একটা জৈবিক সত্তা মাত্র এবং আর কিছুই নই। অর্থনীতির ক্ষেত্রে তুমি চাহিদা-জোগান নীতির দ্বারা চালিত নও, এটা এইরকম বলার মতো। অথচ অর্থনীতির ক্ষেত্রে তুমি আসলে তাই। একইভাবে, রাজনীতির ক্ষেত্রে রাজনীতির আইনকানুনই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু আমরা মূল, মৌলিক সত্যিটা মেনে নিতে প্রস্তুত নই যে, আমরা আসলে একটা জৈবিক সত্তা মাত্র এবং যা-কিছু দেহের ভেতরে ঘটছে সেটা আসলে হরমোনঘটিত কর্মকাণ্ডেরই ফলাফল। সেটা শুধুই একটা রসায়ন। সেখানে [দেহের মধ্যে] যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে, আমার পক্ষে তোমাকে সেটা বলা খুব বাড়াবাড়ি হবে যেহেতু তুমি একজন সেক্স থেরাপিষ্ট। এইক্ষেত্রে সমগ্র দেহের রসায়নে পরিবর্তনের চেষ্টা না করে অন্য কোনোভাবে সমস্যা সমাধান করা যাবে না। আমাদের সমগ্র চিন্তনটাকে বোধহয় অন্যপথে নিতে হবে। হয়তোবা; আমি শুধু ইঙ্গিত করছি মাত্র। আমার ভুলও হতে পারে। আমি এক্ষেত্রে খুব উপযুক্ত নই।
সেই পথটা কীরকম হতে পারে?
সম্পূর্ণ রাসায়নিক। তাঁদের [বৈজ্ঞানিকদের] বক্তব্য অনুযায়ী কামনা-বাসনা যদি হরমোনই হয়ে থাকে, তাহলে সমগ্র নৈতিক মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি, মনুষ্যস্বভাব নিয়ন্ত্রণ করতে শত শত বৎসর ধরে আমরা যা সৃষ্টি করেছি, সে সবই মিথ্যা। যেহেতু কামনা-বাসনা মিথ্যা হতে পারে না। [মনুষ্য] প্রাণীটির ভেতরে যা-কিছু ঘটে চলেছে, সেটা মিথ্যা হতে পারে না।
তুমি বলছো চিন্তা ছাড়াও সর্বদাই যৌনাকাঙ্খা বিদ্যমান থাকবে?
চিন্তা ছাড়া কোনো যৌনতাই নেই। চিন্তাই হলো স্মৃতি। যখন আমি বলি, সব গ্রন্থির থেকে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি হলো থাইমাস, এইসব বিশেষজ্ঞেরা আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। যখন এই নিয়ে কয়েকজন শারীরবিদ আর ডাক্তারের সাথে আলাপ করলাম তাঁরা আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করলেন। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক, যেহেতু তাদের মতে গ্রন্থিটি নিষ্ক্রিয়। যদি কোনো বাহ্যিক পন্থায় এটা সক্রিয় করা হয়, সেটা হবে একটা অস্বাভাবিক অবস্থা। কিন্তু জানো তো, থাইমাসই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থি এবং অনুভূতি সেখানে চিন্তাসূত্র ছাড়াই কাজ করে।
থাইমাস থেকে…?
হ্যাঁ, থাইমাস থেকে। দেখ, বহু বহুকাল চিকিৎসাবিজ্ঞান সেটা উপেক্ষা করে এসেছে। গ্রন্থিটির যেকোনো অন্যরকম অবস্থাকে তারা একটা অস্বাভাবিকতা বলে বিবেচনা করে এসেছে এবং সেটার চিকিৎসার চেষ্টা করেছে। এই কথা সত্যি যে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছুলে এটা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, এবং তারপর থেকে তোমার অনুভূতি নিয়ন্ত্রিত হয় তোমার ধারণার মাধ্যমে।
স্বাভাবিক জৈবিকতার মাধ্যমে না হয়ে সংস্কৃতির মাধ্যমে…
…স্বাভাবিক জৈবিকতার মাধ্যমে না হয়ে। আমার কাছে অনুভূতি জিনিসটা এইরকম: তুমি যখন হোঁচট খাচ্ছো, তোমার সাথে সাথে আমিও যে হোঁচট খাচ্ছি তা নয়; কিন্তু আমার সমগ্র সত্তাই ওই হোঁচট-খাওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট। আমি শুধু এই ধরনের অনুভূতির কথা বলছি; এছাড়া অন্য সমস্ত অনুভূতিই হলো আবেগ আর চিন্তা। অনুভূতি [এইমাত্র যে উদাহরণটা দিলাম সেই অর্থে অনুভূতি নয়] আর চিন্তার ভেতরে পার্থক্যটা আসলে কিছুই নয়…
সেটা স্রেফ কৃত্রিম একটা পার্থক্য।
খুবই কৃত্রিম। সাংস্কৃতিক। ‘‘হৃদয় মস্তিষ্ক থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ’’ ─এইসমস্ত স্রেফ ফালতু কথাবার্তা। একবার যখন এই দুর্দৈব বা বিপর্যয়ের মাধ্যমে এই মানবদেহের হরমোনের ভারসাম্যে এই ধরনের [ইউ জী’র যেমনটি হয়েছিলো] গোলমাল ঘটে, তখন কেবল থাইমাসই সক্রিয় হয়ে ওঠে না বরং পিনিয়াল এবং পিটুইটারির মতো অন্যসমস্ত গ্রন্থিও সক্রিয় হয়ে ওঠে। লোকজন আমাকে বলে, ‘‘তোমার সকল দাবি বৈধ করতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিজেকে সমর্পণ করছো না কেন?’’ আমি তাদেরকে বলি যে, এইসমস্ত দাবি আমি বিপণন করি না।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিপক্ষে আমার বক্তব্য হলো, এইসব জিনিসের ক্রিয়াপদ্ধতিটা তুমি বুঝতে চাইছো একটা উদ্দেশ্য থেকে। এইসব গ্রন্থিসমূহ কীভাবে কাজ করে, কীভাবে এইসব জিনিসের সক্রিয়ণ মানবজাতির কাজে লাগানো যায়, একবার যখন এই বিষয়ে তোমার কিছু ধারণা হচ্ছে, তুমি আর সেটা মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহার করবে না।
এবং সেইজন্যেই তুমি…
…এইসমস্ত গবেষণায় আমার কোনো আগ্রহ নেই। তুমি যদি আমার কথা না মানো, আমার কিছুই যায় আসে না। কোনো বড় ডাক্তার যদি আমার কথা বাতিল করতে চান, সেই লোক বলবেন যে আমি আবোলতাবোল বলছি। কিন্তু আমেরিকায় আজ থাইমাস গ্রন্থি নিয়ে রাশি রাশি বইপত্র লেখা হয়েছে। এই বিষয়ে আমি কোনো বিশেষ প্রাজ্ঞতা দাবি করছি না। আমি যা বলতে চাইছি তা হলো চিন্তাজনিত অনুভূতির চাইতে থাইমাসে অনুভূত অনুভূতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
দেহের একটা স্বাভাবিক ক্রিয়া হিসাবে যৌনতাকে তার যথাযথ জায়গায় রাখতে হবে। এর উদ্দেশ্য শুধুমাত্র, প্রধানত, এবং সম্পূর্ণতঃ এর [দেহটার] অনুরূপ কিছু একটা উৎপাদন বা প্রজনন। দেহের কর্মকাণ্ডে এর আর-কোনো জায়গা নেই।
তাহলে কেউ যদি শুধু প্রজননে আগ্রহী হয়, সে যৌনতার অন্য কোনো ভূমিকাই খুঁজে পাবে না?
আজ আর ফিরে যাবার উপায় নেই, যেহেতু চিন্তা সর্বদাই যৌনতায় হস্তক্ষেপ করে চলেছে। এটা একটা ভোগকর্ম হয়ে গেছে। এর বিপক্ষে আমি কিছুই বলছি না। লোকেদের আমি এ পর্যন্তও বলি যে, কোনো সমস্যা ছাড়াই, কোনো মনস্তাত্ত্বিক বা আধ্যাত্মিক সমস্যা ছাড়াই যদি তোমার মায়ের সাথে তোমার যৌনকর্ম করা সম্ভব হয়, তাতেই তোমার যৌনতার ইতি হয়ে যাবে। সমগ্র জিনিসটাই গড়ে উঠছে দেখ তোমার ধারণার ওপরে। আমি কোনো জীবনপন্থা হিসেবে আদৌ ইনসেস্ট সমর্থন করছি না। এর [দেহের] জন্যে ইনসেস্ট বলে কিছু নেই। শুধু অপরাধবোধের সমস্যা, মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, ধর্মীয় সমস্যাই বলছে যে এটা ওইভাবে নয়, এইভাবে হতে হবে। যদি কোনো মানুষের পক্ষে কোনো দ্বিধা, কোনো আক্ষেপ ছাড়াই তার বোন, কন্যা বা মাতার সাথে যৌনকর্ম করা সম্ভব হতো, তখন এটা [যৌনতা] চিরকালের মতো শেষ হয়ে যেত। এটা এর যথাযথ জায়গায় চলে যেত। কোনো থেরাপি হিসাবে আমি এটা পরামর্শ দিচ্ছি না। প্লিজ আমাকে ভুল বুঝো না।
না, না…
আমি এরকম ইঙ্গিত করছি না যে প্রবর্ধন ছাড়াও কোনোভাবে যৌনকর্ম সম্ভব। আমি যা বলতে চাইছি তাহলো, প্রবর্ধন ছাড়া তোমার স্ত্রী বা তোমার মাতা বা অন্য কারো সাথেই তোমার যৌনতা সম্ভব নয়।
তাহলে যৌনতা সেটা ধাওয়া করতে থাকে…
যৌনতা সেটা ধাওয়া করতে থাকে। তারপর যা থাকে তাহলো শুধু যৌনগ্রন্থির স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্ম। ব্যবহৃত না হলে, শুক্র মুত্রের সাথে বেরিয়ে যাবে। ‘ইহা মূলধারা হইতে সহস্রারে গমন করিবে’, আধ্যাত্মিক গুরুদের এইসমস্ত দাবি সবই ফালতু। এইসমস্ত ছাইভস্মে বিশ্বাস কোরো না। শুক্র ব্যবহৃত না হলে তোমার মূত্রের সাথে সেটা বেরিয়ে যাবে, সে তুমি সাধু, ধার্মিক, পাপিষ্ঠ যাই হও না কেন। তোমার সুপ্তিস্খলন হতে পারে, নাও হতে পারে, কিন্তু তারপরও সেটা বেরিয়ে যাবে।
তারপরেও দেহ ঠিকঠাক কাজ করে যাবে?
হ্যাঁ। এখানে [ইউ জী’র শরীরে] বোধহয় একটা অস্বাভাবিকতা কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তোমরা যাকে এ্যাস্ট্রোজেন বলো, কী সেটা… এইসমস্ত শব্দের সাথে আমি খুব পরিচিত নই…
হ্যাঁ, স্ত্রীজাতীয় হরমোন।
স্ত্রীজাতীয় হরমোন। তারা যা বলে দেখ, প্রথম কয়েক দিনে বা প্রথম কয়েক সপ্তাহে, কোনো ভ্রূণের লিঙ্গ থাকে অনির্ধারিত, তারপর একসময় এটা নির্ধারিত হয়ে…
কেউ হয় পুরুষ…
কেউ হয় পুরুষ। এইখানে [ইউ জী’র ক্ষেত্রে] দেহ সেই জায়গায় ফিরে গেছে যেখানে সে না পুরুষ না নারী। তারা যে উভলিঙ্গ জিনিসটার কথা বলে, এটা তা নয়।
সেটা অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক…
সেটা অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক। কাজেই, এই যৌনতাবিষয়ক আমাদের সমস্ত ধ্যানধারণা সংশোধন করা দরকার। যৌনতায় আমরা সাংঘাতিক গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছি, সেইজন্যেই এর অস্বীকৃতিতে লোকজনের এতো বাতিক। ভারতে তারা আবার ওই অস্বীকৃতির ধারণা পাল্টে যাকে বলে তান্ত্রিক যৌনতা, সেইটা পয়দা করেছিলো। সর্বোচ্চ যে ভোগ মানুষের হতে পারে এটা ছিল তাই। তন্ত্রের মাধ্যমে যৌনতাকেই সর্বোচ্চ যৌনতা গণ্য করা হতো। সেইজন্যেই তারা ব্রাজিলে এবং সম্ভবত আরো কিছু দেশে স্ত্রী ও পুরুষ অঙ্গের কাপলিঙের জন্ম দিয়েছে। আমাদের ভারতে এইজাতীয় সমস্তরকম আবোলতাবোল আছে─মন্দির, তারপর ষাঁড়ের জন্যে একটা মন্দির, সেটা হলো গিয়ে পৌরুষের প্রতীক। এই সবই ভক্তি করা হতো, পূজা করা হতো। এইটা [যৌনতা-অস্বীকৃতির] বিপরীতে-চরম: ইন্দ্রিয়পরায়ণতা হয়ে গেল একটা অধ্যাত্ম অন্বেষণ। তারা যৌনতার মাধ্যমে অধ্যাত্ম লক্ষ্যার্জন, বোধিপ্রাপ্তি, বা আর যা যা আছে সেসব অর্জনের কথা বলে এবং এটাকে বলে তান্ত্রিক যৌনতা। গতানুগতিক যৌনতা বা তান্ত্রিক যৌনতা বা একটা পতিতার সাথে যৌনতা, সবই এক।
তবে আমি বুঝি কেন লোকজন তথাকথিত আধ্যাত্মিকতা অর্জনের উপায় হিসাবে যৌনতায় উৎসাহী। কারণ চরম যৌনসংসর্গ বা রাগমোচনের মুহূর্তে লোকেদের মনে হয় তারা আর সেখানে নেই…
ওই অনুভূতিটা ক্ষণস্থায়ী; খুবই ক্ষণস্থায়ী…
সেটা শুধু এক মুহূর্তের জন্যে মাত্র।
সেটা ঠিক এক মুহূর্তও নয়। এমনকি সেখানেও বিভক্তি অনুপস্থিত থাকে না। চরম যন্ত্রণাতেও তোমার মনে হয় তুমি সেখানে নাই। দেহের অসহ্য যন্ত্রণা হলে কী হয়? তুমি অচেতন হয়ে পড়ো। তখনই দেহ ওই যন্ত্রণা দেখভালের সুযোগ পায়। যদি সে সেটা না পারে, তুমি বিদায়।
তুমি বলতে চাইছো রাগমোচনের মুহূর্তে, যা-কিনা একটা মুহূর্তমাত্র, ব্যক্তি সেখানে বিদ্যমান?
ব্যাপারটা হলো চরম যৌনঅভিজ্ঞতার মুহূর্তেও ব্যক্তি সেখানে খুবই বিদ্যমান। অভিজ্ঞতাটা ইতিমধ্যেই তোমার স্মৃতির মাধ্যমে ধৃত। তা নাহলে সেটাকে একটা চরম মুহূর্ত হিসেবে অনুভব করার কোনো উপায় নেই। চরম মুহূর্তটা যদি চরম মুহূর্ত হিসেবেই থেকে যায়, সেটা হবে স্রেফ যৌনতার ইতি; সেটা হবে সবকিছুরই ইতি।
তোমার মনে আছে যে একটা চরম মুহূর্ত ছিল, কিন্তু সত্যিকারের অনুভূতিটা তুমি মনে করতে পারছো না।
সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল ব্যাপারটা হলো, একটা চরম মুহূর্ত হিসেবে তুমি এটাকে মনে রাখছো এবং বারবার সেটার পুনরাবৃত্তি চাইছো, এর মানেই হলো ইতিমধ্যেই এটা তোমার অভিজ্ঞতাকাঠামোর অংশ হয়ে গেছে। সারাক্ষণই তুমি এটা চাইছো, তারপর এটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সময়ের জন্যে প্রলম্বিত করতে চাইছো। এটা হলো একটা অন্যতম মূর্খ কাজ। কোথায় যেন পড়েছিলাম একবার তারা একটা নারীকে আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা অবিরাম রাগমোচনের উদ্দেশ্যে অত্যাচার করে গিয়েছিল। কিন্তু কেন তাকে এই অত্যাচার নিতে বাধ্য করা? কীসের জন্যে? এত্থেকে আসলে কী প্রমাণ করতে চাও? পশ্চিমাদেরও এটা একটা খ্যাপামি। তারা এটা দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়। এটা মুহূর্তের একটা ভগ্নাংশের জন্যে মাত্র, তা সে নারী পুরুষ যার ক্ষেত্রেই হোক। তুমি একজন থেরাপিস্ট। তুমি হয়তো আমার থেকে অনেক বেশি জানো। কিন্তু আমি মনে করি যে স্বাভাবিক সময়ের চাইতে বেশি সময় রাগমোচন প্রলম্বিত করার সত্যিই কোনো যুক্তি নেই। কিছু কিছু লোকের ক্ষেত্রে এইটা একটা বাতিক হয়ে গেছে─, সেটা না হলে তাদের কাছে যৌনকর্মটা খুব ব্যর্থ বলে মনে হয়।
তাহলে কি এটাও একটা আসক্তি হয়ে গেছে?
অন্য যেকোনো আসক্তির মতোই। আমি নিজেই এইসমস্ত খেয়াল করেছি। কারো কাছ থেকে এইসমস্ত শিখি নাই। আমার নিজের জীবনেই আমি সেটা ঘটতে দেখেছি। আমার স্ত্রীকে আমি এইসমস্ত বলেছিলাম। আমার স্ত্রী আমাকে ভালবাসার কথা বললেই আমি জানতে চাইতাম এইসমস্ত আবোলতাবোলের অর্থ কী? আমাদের সম্পর্কের একমাত্র ভিত্তি ছিলো যৌনতা।
আধ্যাত্মিক লক্ষ্যের অন্বেষণে আমি পঁচিশ বছর ব্রহ্মচর্য করেছি। তারপর হঠাৎ করেই আমার উপলব্ধি হলো, ‘‘আরে, এ তো হাস্যকর! ব্রহ্মচর্যের সাথে এর তো কোনো সম্পর্কই নেই। আমার সুপ্তিস্খলন হতো। আমার ভেতরে যৌনতার দাহন। কী জন্যে আমি ব্রহ্মচর্য করে যাচ্ছি? কেন আমি নিজেকে অত্যাচার করছি?’’ আমার গুরুকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘তুমি নিশ্চিত তোমার কখনোই সুপ্তিস্খলন হয় নাই?’’ তিনি লাল হয়ে গেলেন। আমাকে উত্তর দেবার মতো সাহস তাঁর ছিল না।
তোমারও কি ওইরকম হতো?
ওহ্ হ্যাঁ। তার মানে এই নয় যে আমি চরম বিপরীতে চলে গেলাম আর জীবনধারা হিসেবে নির্বিচার যৌনতা বেছে নিলাম। হল্যাণ্ড, আমেরিকা, সব জায়গার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েগুলো আমাকে ঘিরে থাকতো। আমাকে এটা চাইতেও হতো না। কিন্তু তখন আমার মনে হলো যৌনতার সমস্যাটা বুঝার এইটা পন্থা নয়। ওই সময় আমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্কটাই ছিল আমার একমাত্র সম্পর্ক। যৌনতার প্রতি আমার মনোভাবটা তিনি বুঝতে পারলেন, কিন্তু তখনও ভালোবাসা নিয়ে তাঁর [নিজস্ব] কিছু ধারণা ছিল। সবসময়ই তিনি বলতেন, ‘‘সবচে’ সুন্দরী মেয়েগুলো তোমাকে ঘিরে থাকে, যেকোনো অর্থেই তুমি খুবই সুপুরুষ। কেন তুমি তাদের সাথে মিলিত হও না? তোমার কি অপরাধবোধের সমস্যা নাকি বিশ্বস্ততার সমস্যা?’’ আমি তাঁকে বললাম, ‘‘আসলে আমার দিক থেকে যদি কোনো অবিশ্বস্ততা ঘটে, সমস্ত ব্যাপারটাই পাল্টে যাবে।’’ আমি তাঁকে সতর্ক করলাম, ‘‘এইসমস্ত আবোলতাবোল বোলো না। শুধু কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে এইটা ঠিক আছে।’’ আমার কোনো নৈতিক বা নীতিগত সমস্যা ছিল তা নয়। যৌনতা বিষয়টা আমি বুঝতে চাইছিলাম, এবং আমি বুঝতে পারলাম, আসলে আমার ভোগের জন্যেই আমি তাঁকে ব্যবহার করে যাচ্ছি।
এ ব্যাপারে তুমি খোলাখুলি ছিলে?
হ্যাঁ, সবসময়ই আমরা এটা আলোচনা করতাম।
সেখানে কোনোই প্রেম ছিলো না?
না। যদিও আমি বিয়ে করতে পারতাম এরকম মেয়েদের মধ্যে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ।
‘‘আমি কেবল যৌনতায় আগ্রহী,’’ তুমি এই কথা বললে?
তিনিও বুঝলেন যে সেটাই সব। কিন্তু বাচ্চাকাচ্চার ব্যাপারটাই ছিলো আমাদের একমাত্র সমস্যা। তাঁর জিনগত কারণে তিনি বেশি বেশি বাচ্চা চাইতেন। আমার বাবার দিকে এবং মায়ের দিকে দুইদিকেই প্রচুর সন্তানাদি ছিল। আর আমার স্ত্রী ছিলেন তাঁর মায়ের একুশতম গর্ভ।
একুশতম?
হ্যাঁ, আমার স্ত্রী। আর এই বেশি বেশি বাচ্চা চাওয়াটা ছিল তাঁর একটা জিনগত সমস্যা। সেটাই ছিল আমাদের মধ্যে আসল সমস্যা। এমনকি আমরা লণ্ডনে মেরি স্টোপসের কাছেও গিয়েছিলাম। তুমি হয়তো তাঁর নাম শুনে থাকবে।
এর সুরাহা করার জন্যে?
ব্যাপারটা বুঝার জন্যে। আমার স্ত্রী জন্মনিয়ন্ত্রণ বা ওইজাতীয় ব্যবস্থারও বিরোধী ছিলেন। তিনি এইসমস্তের একটা সুরাহা চাইছিলেন। তিনি আমাকে বলতেন, দীর্ঘ সময় নিয়ে বাচ্চা প্রতিপালন করলে গর্ভধারণ বিলম্বিত হতে পারে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব ধারণা! কোনো ডাক্তারের কাছে গিয়ে গর্ভপাতের মাধ্যমে ব্যাপারটা সেরে ফেলায় তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। তবু একপর্যায়ে তাঁকে একটা গর্ভপাত করাতে হয়, যেহেতু আমরা আর সন্তান চাইছিলাম না।
এইসমস্ত ছাড়াও শুধু একবারের জন্যে একজনের সাথে আমার যৌনমিলন ঘটে। সেটা কোনো সস্তা কলগার্ল বা পতিতার সাথে নয়। সেটা হয় সে সময়কার একজন ধনাঢ্য মহিলার সাথে। এবং সেটাই সমস্ত ঘটনার জের টেনে দেয়। তারপর থেকে আর কোনো যৌনতা নেই। তুমি আশ্চর্য হয়ে যাবে।
তখনও তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক রয়েছে সেই সময়কার ঘটনা?
হ্যাঁ।
ওই ব্যাপারটাই সবকিছু শেষ করে দিল!
সেটাই ঘটলো। ঘটনাক্রমে ওইরাত্রে আমি ওই মহিলার বাড়িতে ছিলাম। সেইসমস্ত নোংরা খুঁটিনাটিতে আমি যেতে চাই না। সেটা আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগেকার ঘটনা। এটা শেষ হয়ে গেল! সেটাই ছিল আমার জন্যে যৌনতার ইতি। আমার মনে হলো নিজের ভোগের জন্যে আমি ওই মহিলাকে ব্যবহার করেছি। সেটা কোনো নৈতিক সমস্যা ছিল না। ওই মহিলাকে যে আমি ব্যবহার করেছি সেই সত্যিটাই আমাকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিলো। আমি মনে মনে ভাবলাম, ‘‘তিনি স্বেচ্ছাবলি হতে পারেন, এইসমস্ত খেলায় তিনি স্বেচ্ছায় অংশ নিতে পারেন, কিন্তু আমি আর এটা করতে পারি না।’’ সেখানেই এর ইতি, এবং সেটা আমার স্ত্রীর জন্যেও একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল, এই অর্থে নয় যে তিনি আমার ওপর খেপে গেলেন, এই অর্থে যে, আমি তাঁর সাথেও যৌনতা বন্ধ করে দিলাম।
নিজেকে কি তাঁর পরিত্যক্ত মনে হলো?
হ্যাঁ। অতদূর প্ররোচনা দিয়েছিলেন বলে তাঁর অপরাধবোধ হলো। কিন্তু এমন নয় যে তিনিই এটা করিয়েছিলেন। তিনি সেটা করতে বাধ্য করেন নাই। যাই হোক, ওই ঘটনায় আমার যৌনতার সমাপ্তি হয়ে গেল। কিন্তু তাতে করে বস্তুত যৌনতাড়না চলে গেল না, কারণ মেয়েদের যেমন পুরুষদেরও তেমনি স্বাভাবিক একটা উত্থানপতন আছে। আমি দেখলাম কখনো কখনো সেটা তুঙ্গস্পর্শী হচ্ছে, আবার মাসের পর মাস হয়তো এটা টেরও পাচ্ছো না।
মেয়েদেরও তাই হয়।
হ্যাঁ, ঠিক যেমন মেয়েদের ঋতু। নারী পুরুষের একই সময়ে রাগমোচন ঘটাটা অসম্ভব। আমরা ভিন্নভাবে প্রোগ্রামড।
এটা সিনক্রনাইজড হতে পারে না।
সিনক্রনাইজড হলে সেটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার হতো। কিন্তু সেটা করার কোনো উপায়ই তোমার নেই। তো এটা [ইউ জী দৈবাৎ যে সহজ স্থিতিতে এসে পড়েছেন] না ঘটা পর্যন্ত তীব্র [যৌন] তাড়নাটা ছিলই। কিন্তু আমি জানতাম শুক্র মূত্রের মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে বেরিয়ে যাবে। সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না কারণ আমি নিজের জন্যে নিজেই যৌনতার সমস্যাটা বুঝা আর তার সুরাহা করার জন্যে বদ্ধপরিকর ছিলাম। আমি কোনো থেরাপিষ্টের কাছে যাই নাই। কখনোই আমি কোনো চিকিৎসায় বিশ্বাস করি নাই। তো এটা নিজে নিজেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুরাহা হয়ে গেছে। প্রাণীটির ভেতরে যৌনতার অবস্থানটা এমন যে এটা দেহের খুবই সাধারণ একটা ক্রিয়া। এর আগ্রহ শুধু সৃজনে। আমি নিজে নিজেই এইসমস্ত আবিষ্কার করেছি।
তোমাকে আরেকটা উদাহরণ দিই। একবার আমরা মিলিত হতে এগুচ্ছি, তখন আমার দুই বছরের মেয়েটা কেঁদে উঠলো। আমাদের ভঙ্গ দিতে হলো এবং ওই সময় আমার যে কী হিংস্র অনুভূতি হলো তুমি কল্পনা করতে পারবে না। আমি প্রায় বাচ্চাটার গলা টিপে ধরতে যাচ্ছিলাম! নিশ্চয়ই আমি সেভাবে এগুইনি। এগুতে পারতাম। ওইরকমই ছিল আমার মনোভাব। আমি মনে মনে ভাবলাম, ‘‘ও আমার নিজের রক্ত, মূর্খ ভাষায় বললে─আমার অস্থির অস্থি─আমার নিজেরই সন্তান। ওইরকম ভাবনা আমার এলো কীভাবে? এখানে [নিজেকে নির্দেশ করে] কোনো একটা গোলমাল আছে।’’ আমি নিজেকে বললাম, ‘‘তুমি আধ্যাত্মিক নও, তুমি নিজেকে যা ভাবো বা লোকে তোমাকে যা ভাবে, তুমি তা নও।’’ সর্বত্র আমি ধর্মীয় মঞ্চে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতাম। আমি নিজেকে বললাম, ‘‘তুমি ‘এই’, এবং ‘এই’ হলে তুমি। এবং এইসমস্ত সহিংসতাই হলে তুমি।’’
যৌনতা কি সহিংসতা?
যৌনতা সহিংসতা। কিন্তু এটা এই দেহের জন্যে একটা প্রয়োজনীয় সহিংসতা। এটা একটা যন্ত্রণা।
প্রজননের কথা যদি বলি…
সমস্ত সৃষ্টিশীল ব্যাপারই যন্ত্রণাদায়ক। একটা শিশুর জন্ম খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। কিন্তু এটাকে একটা ট্রোমাটিক এক্সপেরিয়েন্স (আঘাতজনিত অভিজ্ঞতা) বলে তার চারপাশে তত্ত্বের একটা বিপুল কাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারটায় আমার কোনো আগ্রহ নেই। এটা কোনো ট্রোমাটিক এক্সপেরিয়েন্স হতে পারে না।
যা বলছিলাম─সেইজন্যেই, যাবতীয় এইসমস্ত সহিংসতার পর, তুমি ঘুমিয়ে পড়ছো। তুমি পরিশ্রান্ত বোধ করছো। প্রকৃতি এইভাবেই কাজ করে। প্রকৃতির সমস্ত সৃজনই এইরকম। আমি একে যন্ত্রণা বা সহিংসতা বলবো না। আগ্নেয়গিরির উদ্গিরণ, ভূমিকম্প, ঝড়-ঝঞ্ঝা, নদ-নদীর জলোচ্ছ্বাস সবই প্রকৃতির অঙ্গ। সেখানে শুধুই বিশৃঙ্খলা বা শুধুই শৃঙ্খলা─এরকমটি বলা যাবে না। বিশৃঙ্খলা আর শৃঙ্খলা ঘটে প্রায় একই সঙ্গে। জন্ম এবং মৃত্যু হলো একটা সমকালিক প্রক্রিয়া।
আমি নির্বিচার যৌনাচারের বিপক্ষে নই, ব্রহ্মচর্যেরও বিপক্ষে নই। তবে একটা মূল বিষয়ে আমি জোর দিতে চাই, সেটা হলো, তোমার আধ্যাত্মিক বিষয়ের অন্বেষণে তুমি ব্রহ্মচর্য করছো না ইন্দ্রিয়পরায়ণতা করে তাকে তান্ত্রিক যৌনতা নাম দিচ্ছো, তাতে সত্যিই কিছু যায় আসে না। কলগার্ল বা পতিতার সাথে যৌনতা নয়, তুমি তান্ত্রিক যৌনতা করছো, এই বিশ্বাসটা স্বস্তিকর। আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যে যৌনতা করলে তাতে বেশি ‘অনুভূতি’, বেশি ঘনিষ্ঠতা, এইসমস্ত চরম ফালতু কথা।
তাহলে তান্ত্রিক যৌনতা আসলে কিছুই না?
একে ফাকিং ক্লাব বলবে না তান্ত্রিক সেন্টার বলবে, সেটা কোনো বিষয়ই নয়। তুমি একটা পতিতালয় চালিয়ে যাচ্ছো যেহেতু এর একটা চাহিদা আছে। বহু মানুষ বোধির নামে এইজাতীয় কাজ করেন। সেটা আমার কাছে ঘৃণ্য। তাঁরা স্বীকার করতে যথেষ্ট সৎ নন যে, তাঁরা এটা [বোধির আকর্ষণ] ব্যবহার করছেন তাঁদের কামচরিতার্থ করতে। সেই কারণেই তাঁরা এইসমস্ত পতিতালয় চালিয়ে যাচ্ছেন। এই ধরনের গুরুরা হলেন পতিতালয়ের দালাল।
মি. রজনীশ তো এইজন্যে বিখ্যাতই হয়ে গেলেন…
হ্যাঁ, আমার কাছে একজন জানতে চাইলো, ‘‘তাঁর [রজনীশের] মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে তুমি কী বলবে?’’ আমি বললাম, দুনিয়া কখনো এইরকম পতিতালয়ের দালালের দেখা পায় নাই, ভবিষ্যতেও কখনো পাবে না। [হাসি]।
তিনি বেশ ভালই ছিলেন। মানে বেশ পেশাদার।
হ্যাঁ, পেশাদার। পশ্চিমা থেরাপি, তান্ত্রিক পদ্ধতি আর পুঁথিপত্রে যা-কিছু পাওয়া যায়, সবই তিনি মিশিয়েছিলেন। এত্থেকে তিনি একটা বিশাল ব্যবসা ফেঁদে বসলেন। তিনি ছেলেদের কাছ থেকে টাকা নিতেন, মেয়েদের কাছ থেকেও টাকা নিতেন, তারপর সেই টাকা নিজের জন্যে রেখে দিতেন। তিনি মারা গেছেন কাজেই আমরা কিছু বলতে চাই না। নিল নিসি বোনাম। [হাসি]
কিন্তু আমরা যদি আবার ফিরে যেতে পারতাম…
আমি যা বলতে চাই তা হলো, দুর্ভাগ্যক্রমে, সমাজ, সংস্কৃতি, বা যা-ই বলো, যৌনক্রিয়াকে প্রাণীটির একটা স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড হিসেবে না দেখে সেটাকে পৃথক করেছে এবং ভিন্ন একটা মাত্রায় স্থাপন করেছে। এটা প্রকৃতির মূলগত একটা বিষয়। টিকে থাকা আর বংশবিস্তার করাটা প্রাণীটির মূলগত একটি বিষয়।
বাদবাকি সবই কৃত্রিম প্রবর্ধন…
তুমি এলাকা পাল্টাতে পারো, ধারণা পাল্টাতে পারো, বইপত্র লিখতে পারো। তাতে কিছুই এসে যায় না। আমার কথা যদি বলো, আমি কাউকেই বলি না তাদের কী করা উচিৎ বা উচিৎ নয়। আমার আগ্রহ শুধু পরিস্থিতিটা দেখানো এবং বলা, ‘‘হয় মেনে নাও নয় বাদ দাও।’’
প্রবর্ধন, সংস্কৃতি, চিন্তা ছাড়াও দেহের যৌন কর্মকাণ্ড থাকবে, অথচ এত্থেকে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করার কেউ থাকবে না?
না, দেখ। আমরা যাতেই হাত দেই, সেটাই একটা সমস্যা বানিয়ে ফেলি; আর যৌনতার ক্ষেত্রে তো সেটা আরো বেশি, যেহেতু এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী তাড়না। তুমি যদি একে [ভোগে] অনুবাদ করে এমন একটা জায়গায় ঠেলে দাও যেটা আসলে তার জায়গাই নয়, যথা, ভোগকর্ম, তাহলে আমরা সমস্যা সৃষ্টি করবো। একবার যখন তুমি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে ফেলছো, তখন ওই কাঠামোর মধ্যেই সমস্যাটার বিহিত করার চাহিদা আসতে বাধ্য। সুতরাং, তুমি হাজির হচ্ছো এসে এইখানে [সেক্স থেরাপি, ইত্যাদির মধ্যে]। সেক্স থেরাপিস্টদের বিপক্ষে আমার কিছুই বলার নেই, কিন্তু সমস্যাটার [ভোগ হিসাবে যৌনতার] সুরাহা লোকেদেরই করতে হবে। নইলে তারা বাতিকগ্রস্ত হয়ে যাবে। তারা জানে না তাদের নিজেদেরকে নিয়ে কী করতে হবে। শুধু সেটা নয়, সবকিছুই─, ঈশ্বর, সত্য, পরমার্থ, মুক্তি, মোক্ষ, এ সবই হলো পরম ভোগ। আমরা সেটা মানতে প্রস্তুত নই।
কিন্তু যৌনতা খুবই মূর্ত।
খুবই মূর্ত। শরীরী। সেইজন্যেই এটা আমাদের জীবনে খুব শক্তিশালী একটা বিষয় হয়ে গেছে। সেইজন্যেই সংস্কৃতির মাধ্যমে, প্রথমত ধর্মের নামে, তারপর পরিবার, আইন, যুদ্ধ, আরো হাজারটা জিনিসের নামে এর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার দাবিও রয়েছে। এটা [যৌনতা সীমায়িত করার দাবি] মানুষের ধর্মীয় ভাবনার টিউমারের মতো বিস্তার ছাড়া আর কিছুই নয়। পার্থক্যটা কোথায়?
সমস্ত আইনকানুন দিয়েও তো তারা কিছুই করতে পারছে না। এই জিনিস চলছে তো চলছেই…
চলছেই। জীবনের পবিত্রতার কথা বলে তুমি গর্ভপাতের নিন্দা করছো। এ সেই সনাতন মূর্খ খ্রিষ্টীয় ধারণারই গোয়ার্তুমি, যা প্রত্যেকটি নারীকে একেকজন অপরাধী বানিয়ে ফেলেছে। আর তারপর তুমি গিয়ে তোমার পতাকার নামে, স্বাদেশিকতার নামে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে খুন করছো। ব্যাপারটা এইরকমই। এমন না যে এর পরিবর্তনে তোমার আগ্রহ, বরং পরিবর্তন এমন একটা জিনিস যাতে এই কাঠামোর [যথা, চিন্তার] কোনো আগ্রহ নেই। এটা শুধু পরিবর্তনের কথা বলে। অথচ তুমি জানো সবকিছুই নিরন্তর পাল্টে যাচ্ছে।
যৌন উত্তেজনার এই কৃত্রিম প্রবর্ধন আসলে দেহকে ক্ষতিগ্রস্তই করে, কিন্তু বহু লোক মনে করে, যেহেতু উত্তেজনার মুক্তি হচ্ছে এবং তুমি আরো শিথিল বোধ করছো, স্বাস্থ্যের পক্ষে এটা ভালো।
প্রথমে তুমি একটা উত্তেজনা তৈরি করছো। এইসমস্ত সব উদ্ভট কল্পনা, রোমান্টিক ছাইপাঁশ, উত্তেজনাটাকে বাড়িয়ে তুলছে। একবার যখন উত্তেজনাটা তৈরি হয়েছে, সেটা বিলীন হতেই হবে। সেইজন্যেই তখন বিশ্রাম হয়ে যাচ্ছে জরুরী, এবং তুমি ঘুমিয়ে পড়ছো। তুমি ঘুমিয়ে পড়ছো কারণ তুমি ক্লান্ত, অবসন্ন। … পরবর্তী প্রতিক্রিয়াটা হবেই। সেটা ঠিক আছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা তোমাকে পরিশ্রান্ত করে ফেলছে।
পশ্চিমে আজকাল নারী-পুরুষের যৌন আচরণের বহুবিস্তৃত যে ভিন্নতা সে ব্যাপারে কিছু বলবে?
[হাসি] নারীবাদী আন্দোলনের কথা বলছো? সেটা একটা তামাশা।
যৌন সহিংসতা, নারী আর শিশুদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পুরুষের যত যৌন সহিংসতা, বা শিশুদের যতরকম ক্ষতি তারা করে চলেছে, আমার কাজের ক্ষেত্রে আমি সেসব নিয়েও চিন্তিত। নারী আর শিশুদের মধ্যে এই ধরনের যৌন সহিংসতা প্রায় দেখাই যায় না। বহু লোক কেন যৌন সহিংসতার সামগ্রী হিসেবে নারী আর শিশুদের ব্যবহার করে?
সেটা একটা সমাজতাত্ত্বিক সমস্যা। আমার মনে হয় তুমিই সেটা ভালো জানো। কী জানি! আমি বেশি বলতে পারবো না। কিন্তু এটা সত্যিই দুর্ভাগ্য যে শত শত বছর ধরে পুরুষ সবকিছুতেই পার পেয়ে গেছে, যেখানে নারীদেরকে সমাজ অবহেলা করে এসেছে। এই গ্রহের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অবহেলা করা হয়েছে, অবমাননা করা হয়েছে, এবং পাপোশের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি বাইবেলের কেচ্ছাও বলছে নারী সৃষ্টি হয়েছে পুরুষের পাঁজরের অস্থি থেকে। কি অসম্ভব মূর্খামি! তুমি দেখ, এই সংস্কৃতিতে কোনো নারীর মেধা নেই। শুধু এখানে নয়, সর্বত্রই এই একই ব্যাপার।
তো এটা [সহিংসতা] এলো কোথা থেকে? একদম অনাদিকাল থেকে?
অন্যপক্ষটাও এর জন্যে দায়ী। নারীকে তুমি একটা প্রিয়া হিসেবে বন্দনা করছো এবং সে ওই গৌণ ভূমিকাটা মেনে নিচ্ছে। সুতরাং নারীটিও এর জন্যে দায়ী। আজকালকার এইসমস্ত নারীবাদী আন্দোলন নিয়ে আমি মহাউৎসাহী নই। এটা এমন একটা বিদ্রোহ যার আসলে কোনো ভিত্তি নেই। এটা হলো প্রতিক্রিয়ার থেকেও বেশি কিছু।
তুমি বলতে চাচ্ছো উভয়পক্ষই এই পরিস্থিতির জন্যে দায়ী?
উভয়পক্ষই এই পরিস্থিতির জন্যে দায়ী। আমি প্রায়ই এই কথা বলি। নারীবাদী আন্দোলনের এক নেত্রী আমার কাছে এসে জানতে চাইলেন, ‘‘আমাদের আন্দোলন নিয়ে তোমার বক্তব্য কী?’’ আমি বললাম, ‘‘আমি তোমার পক্ষে আছি, কিন্তু খুব মৌলিক একটা বিষয় তোমাকে বুঝতে হবে। যতক্ষণ তুমি তোমার যৌন চাহিদার ক্ষেত্রে কোনো পুরুষের ওপর নির্ভর করছো ততক্ষণ তুমি কোনো মুক্ত মানুষ নও। তোমার যৌনতুষ্টিতে তুমি যদি একটা ভাইব্রেটর ব্যবহার করো সেটা আলাদা কথা। তিনি বললেন, ‘‘তুমি খুব স্থূল।’’ আমি স্থূল নই। আমার কথাই সত্যি। যতকাল তুমি অন্যের ওপর বা কোনো কিছুর ওপর নির্ভর করছো, ততকাল তোমার শোষিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমি নারীবাদী আন্দোলনের বিপক্ষে নই। সমস্ত অধিকারই তাদের থাকা উচিৎ। এখনও আমেরিকায় একই কাজে পুরুষের থেকে নারীকে কম মজুরী দেওয়া হয়। কেন?
হ্যাঁ, সেটাই সংস্কৃতি।
একসময় আমি বিশ্বাস করতাম, নারীরা এই বিশ্ব শাসন করলে, সেটা একটা ভিন্ন কাহিনি হবে। আমাদের ভারতে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, শ্রীলঙ্কায়ও একজন ছিলেন। ইংল্যাণ্ডেও একজন নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জানি না আমেরিকায় সেটা ঘটবে কিনা─যুক্তরাষ্ট্রে কোনো নারী প্রধানমন্ত্রী হবেন কিনা। কিন্তু আমি বলি শোনো, তারাও [নারীরা] আর সবার মতোই নিষ্ঠুর। সত্যিকার অর্থে, বেশিই নিষ্ঠুর। তো আমার স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে গেছে [হাসি]। যখন জেরুজালেমে ওই মহিলাকে দেখলাম, কী যেন নাম…
গোল্ডা মায়ার…
কাজেই, পুরুষ না নারী, কে এই প্রদর্শনীটা চালাচ্ছে, সেটা প্রশ্ন নয়, বরং পদ্ধতিটাই তাকে নষ্ট করে দিচ্ছে।
পুরুষের এই সর্বত্র সার্বক্ষণিক আধিপত্যের প্রবণতায় নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে কোনো সহজাত পার্থক্য নেই?
ক্ষমতার খেলা সংস্কৃতিরই অঙ্গ।
এখানে কোনো জৈবিকতার ব্যাপার নেই?
আজ তাঁরা হরমোনের কথা বলছেন। আমি সত্যিই জানি না। তাঁরা বলছেন হরমোনই সহিংসতার জন্যে দায়ী। তাই যদি হয় তাহলে আমাদের কী করার আছে?
তারপরও আমাদের একজন নারীকে প্রয়োজন…
মুহূর্তের জন্যেও যদি ধরে নিই শত শত বৎসর ধরে আমাদের [পুরুষের] যে প্রাধান্য রয়েছে সেটা সংস্কৃতিজনিত নয়, সেটা বরং হরমোনজনিত একটা ঘটনা, তখন ব্যাপারটা তোমাকে ভিন্নভাবে দেখতে হচ্ছে, এবং ওই লোকটাকে আর কাউচে বসিয়ে, বিশ্লেষণ করে, তার আগ্রাসনের জন্যে তার মা না তার দিদিমা দায়ী, এইসমস্ত বলা যাচ্ছে না। সেটা হবে খুবই উদ্ভট আর হাস্যকর। কাজেই আমাদের কোনো একটা উপায় খুঁজে বার করতে হবে। মৌলিক যে প্রশ্নটি আমাদের নিজেদের জন্যে করতে হবে তা হলো: তুমি কেমন মানুষ চাও? কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, আমরা নিজেদের সামনে একটা নিখুঁত মানুষের আদর্শ দাঁড় করিয়ে ফেলেছি। নিখুঁত মানুষটা হলেন একজন সাধু বা একজন আধ্যাত্মিক মানুষ বা একজন অবতার, বা ওইজাতীয় কেউ। কিন্তু সবাইকে ওই একই ছাঁচে ঠেলে দেওয়াটাই হলো আমাদের ট্র্যাজেডির কারণ। সবার পক্ষে ওইরকম হওয়াটা আসলে সম্ভব নয়।
কিন্তু ওইরকম হওয়াটা এতো প্রলুব্ধকর…
একসময় রাজদণ্ড, রাজমুকুট, গীর্জা, বিশপ, সবকিছুই পূজ্য ছিল। পরে রাজারা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তারপর থেকে রাজপরিবার হয়ে যায় শ্রদ্ধেয় আর পূজ্য। আজ তারা কোথায়? বাদবাকিরা এসে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে দিলো, প্রেসিডেন্টের অফিস বানালো। আমাদেরকে বলা হলো রাষ্ট্রপ্রধানকে অসম্মান করা উচিৎ নয়। গতকালও সে ছিলো তোমার প্রতিবেশী আর আজ সে হয়েছে তোমার প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট। কেন তোমাকে কোনো রাজা বা প্রেসিডেন্টকে পূজা করতে হবে? সমগ্র পুরোহিততান্ত্রিক কাঠামো, তা সে অতীতেরই হোক আর এখনকারই হোক, অবিকল একই।
কিন্তু একজন মানুষের বোধহয়, যা সে নিজের থেকে শ্রেয়তর বলে গণ্য করে, সেরকম কিছু একটা অন্বেষণের প্রয়োজন।
ওই কিছু একটা হলো, আমরা যা হতে চাই। সেইজন্যেই আমরা কাউকে ভক্তিশ্রদ্ধা করি, উপাসনা করি। সমস্ত পুরোহিততান্ত্রিক কাঠামোটাই এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। রাজতন্ত্র আর চার্চ তো বটেই, রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেও এটা নিঃসন্দেহে তাই। এমনকি কোনো বড় টেনিস খেলোয়ারও একজন নায়ক। বা কোনো মুভি স্টার। তারা আমাদের আদর্শ। এবং এই পরিস্থিতির জন্যে দায়ী হলো সংস্কৃতি। এটা কেবল শারীরবৃত্তীয় বা হরমোনজনিত পার্থক্য নয়, যদি সেরকম কোনো পার্থক্য থেকে থাকে, (আমি জানি না এবং জানবোও না), অথচ সমস্ত বাণিজ্য-বেসাতিতেই এর প্রভাব। যেকোনো দোকানে যাও বা যেকোনো টেলিবিজ্ঞাপন দেখ; তারা [বিজ্ঞাপনের লোকগুলো] সারাক্ষণ তোমাকে বলে যাচ্ছে কীভাবে কাপড়চোপড় পরতে হবে, কীভাবে তোমার নিজেকে সুন্দর করতে হবে। একজন নারীর সৌন্দর্য নির্ভর করে হেলেনা রুবিনেস্টাইন বা এলিজাবেথ আর্ডেন বা অন্য কারো ধারণার ওপর। আজ এখানে অর্ধেক দোকানে পুরুষদের প্রসাধনী। আমি সেটার নিন্দা করছি না, আমি শুধু দেখাচ্ছি যে এই হলো আমাদের জীবনধারা। তো বিজ্ঞাপনের লোকটা তোমাকে বলছে তোমার কী ধরনের পোষাক পরা উচিৎ, কোন্ রঙের সাথে কোন্ রঙটা মানানসই। সে তোমাকে সারাক্ষণ এইসবই বলে যাচ্ছে। কাজেই তুমি তার কথায় প্রভাবিত। সে তোমাকে যা চাওয়াতে চায় তুমি তাই চাও। কীভাবে আমরা এই সমস্যার বিহিত করবো? আমি জানি না। এটা আমার উত্তর দেবার বিষয় নয়। যাঁরা এই সমস্যা নিয়ে কাজ করতে চান এটা তাঁদের বিষয়।
তুমি একটা ভিন্ন দশায় আছো, এবং তুমি হয়তো একজন স্বাভাবিক মানুষ…
কে স্বাভাবিক মানুষ? স্বাভাবিক মানুষ হলো একটা পারিসাংখ্যিক ধারণা। কিন্তু কীভাবে এটা [ইউ জী যা-ই হোন না কেন] একটা আদর্শ হতে পারে? এর [ইউ জী’র ক্ষেত্রে যা-ই ঘটে থাকুক] কোনো মূল্য নেই এই অর্থে যে, আমি যা-ই হই না কেন, কোনো নৈতিক মূল্যবোধে সেটা মেলানো যাবে না। জগতের জন্যে এটা অর্থহীন। আমার জন্যে এর কোনো মূল্য নেই এবং জগতের জন্যেও এর কোনো মূল্য নেই। তুমি এই প্রশ্ন করতেই পারো, ‘‘তাহলে আমরা এইসব নিয়ে কথা বলছি কেন?’’ যেহেতু আমার প্রতি তোমার কিছু প্রশ্ন রয়েছে এবং আমি যা করছি তা হলো, প্রশ্নগুলোকে তাদের যথাযথ পারম্পর্যে স্থাপন করছি। আমি শুধু বলছি, ‘‘এটাকে এইভাবে দেখ।’’
আমি তোমাকে স্বমতে আনতে আগ্রহী নই, যেহেতু আমার কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। এবং আমাকেও তোমার স্বমতে আনার কোনো উপায় নেই। এমন নয় যে আমি গোঁড়া একজন মানুষ বা সেরকম কিছু। আমাকে স্বমতে আনা তোমার জন্যে অসম্ভব। এইরকম এক আলোচনায় একজন আমাকে বললো, ‘‘এহ্, তুমি খুব ইহা এবং ইহা।’’ ‘‘ঠিক আছে,’’ আমি বললাম, ‘‘এটা আমার দৃষ্টিভঙ্গি, কিন্তু তোমারটা কী?’’ সেটাও তো একটা দৃষ্টিভঙ্গি। তো কীভাবে তুমি ভাবছো যে এই দুইটা দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে নিষ্পত্তি হতে পারে এবং কেনইবা তুমি তাদের নিষ্পত্তি চাইছো? তুমি ভালো বোধ করছো যেহেতু তুমি তাকে স্বমতে এনেছো। তুমি তোমার যুক্তি এবং বুদ্ধি ব্যবহার করছো যেহেতু তুমি আমার থেকে বেশি বুদ্ধিমান। পুরো ব্যাপারটা একটা ক্ষমতার খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।
যারা মানবজাতির সেবা করছে বলে দাবি করে, তাদের মতো তুমিও বেশ ভালো বোধ করছো। সেটাই হলো ‘‘মানবতাবাদীর’’ ঘোর। রাস্তা পারাপারে কোনো বৃদ্ধাকে একটু সাহায্য করে ভাবলে এটা খুব ভালো একটা কাজ হলো। কিন্তু এটা হলো একটা আত্মকেন্দ্রিক কাজ। তোমার আগ্রহ শুধু কিছু ব্রাউনি পয়েন্টে, কিন্তু তুমি বেহায়ার মতো বলছো যে তুমি কিছু সমাজ পরিবর্তন করছো। আমি নৈরাশ্যবাদী নই। আমি শুধু দেখাচ্ছি যে এটা [এই অনুভূতিটা] হলো একটা মানবতাবাদীর ঘোর। এটা অন্য যেকোনো ঘোরের মতোই। যদি এটা মেনে নিই তাহলে বেঁচে থাকাটা হয়ে যাচ্ছে খুবই সহজ। যদি এটা মেনে নাও তাহলে তুমি কীরকম ঘৃণ্য একটা প্রাণী সেটাও দেখা যাচ্ছে। তুমি এটা নিজের জন্যেই করছো, কিন্তু অন্যদেরকে এবং নিজেকে বলছো যে তুমি এটা অন্যদের জন্যে করছো। আমি সিনিক্যাল নই। তুমি বলতে পারো যে আমি একজন নৈরাশ্যবাদী, কিন্তু নৈরাশ্যবাদীতা হলো বাস্তববাদীতা। নৈরাশ্যবাদীর পা শক্তভাবে মাটিতে স্থিত।
কিন্তু আমি এতে মোটেও সিনিক্যাল কিছু দেখছি না। আমার কাছে এটা পরিষ্কার। সেই নৈতিক অন্বেষণের প্রসঙ্গে আসি, তথাকথিত অধ্যাত্ম ক্ষেত্রসহ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে, সারাক্ষণ আমরা যার অন্বেষণ করে যাচ্ছি…
রাজনীতি, অর্থনীতি, যা-ই নাম দাও…
অধ্যাত্ম ক্ষেত্রে কি এটা আলাদা নয়?
আলাদা হবে কেন? এটা অবিকল একই। নিজেদেরকে আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে দেখতে পাচ্ছি যেখানে আধ্যাত্মিকতাই শুধু গুরুত্বপূর্ণ। আর যিশুর জায়গায় এখন মুভি স্টার। বহু লোকের কাছে আদর্শ হলো মুভি স্টার, টেনিস খেলোয়ার, রেসলার, সেটা নির্ভর করে তাদের বিশেষ বিশেষ স্বপ্নের ওপর।
তাদের এইসবই পছন্দ। কিন্তু তোমার কাছে তো কাহিনিটা ভিন্ন।
আমার এক বন্ধুর বাসায় গেলাম। বাথরুমে মুভি স্টারদের ছবি লাগানোয় তিনি তাঁর মেয়েকে বকাঝকা করছিলেন। কিন্তু তাঁর বেডরূমে গিয়ে দেখি তাঁর টেবিলের ওপর আমার ছবি। আমি তাঁকে বললাম, ‘‘এই দু’টোর মধ্যে পার্থক্য কী?’’
একই ব্যাপার।
বোম্বেতে একবার রজনীশের অনেক শিষ্য আমার সাথে দেখা করতে এলেন। আমার নিমন্ত্রণকর্তা ছিলেন একজন বড় সিনেমা পরিচালক। তিনি রজনীশের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। বছরের পর বছর তিনি রজনীশের দেওয়া সব তরিকার চর্চা করেছেন। কিন্তু আমার সাথে দেখা হওয়ার পরে তিনি তাঁকে দুম করে পরিত্যাগ করে বসলেন। তাঁর শোবার ঘরে রজনীশের একটা বিরাট ছবি ছিল। আমার সাথে দেখা হবার পর তিনি সেই ছবিটা সরিয়ে আলমিরার মধ্যে রেখে দিলেন আর সেখানে রাখলেন আমার ছবিটা। কাণ্ডটা দেখ!
একটার বদলে আরেকটা।
হ্যাঁ। ঠিক আমেরিকান তালাকের মতো। তুমি একটা মহিলাকে তালাক দিলে আর তারপর তোমার নতুন বউ এলো। আগের বউ আর বাচ্চাকাচ্চাদের সমস্ত ছবি চিলেকোঠায় রেখে এসে তুমি তার জায়গায় তোমার নতুন বউয়ের বাপ-মা, দাদু-দিদিমা আর বাচ্চাকাচ্চাদের ছবিগুলো রেখে দিলে। [হাসি]।
তুমি এইসবে গুরুত্ব দাও?
না, না। আমি শুধু এর হাস্যকরতাটা দেখালাম। তারা শুধু এ-ই পারে─এক মায়ার বদলে আরেক মায়া, এক বিশ্বাসের জায়গায় আরেক বিশ্বাস। কিন্তু বিশ্বাসের সমাপ্তি হলে সেখানেই সবকিছুর সমাপ্তি।
কিন্তু তুমিই বলেছো যে এর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কারোরই কিছু করার নেই।
কিছুই করার নেই। যথেষ্ট ভাগ্যবান হলে (কী জানি, ‘‘যথেষ্ট ভাগ্যবান’’ কথাটা হয়তো যথাযথ নয়), তুমি নিজেকে এমন একটা অবস্থায় দেখতে পাচ্ছো যেখানে তোমার দিক দিয়ে এই ফাঁদ থেকে বেরোনোর কোনো চেষ্টাই নেই, তখন সেটা একটা ভিন্ন কাহিনি হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে, ফাঁদটা থেকে বেরুনোর জন্যে তুমি যতই জুরাজুরি করছো, ততই গভীরভাবে তুমি ফাঁদটাতে আটকে যাচ্ছো। এই ব্যাপারটা বুঝা খুবই কঠিন।
ফাঁদ থেকে বেরুনোর চেষ্টা─সেটাই হলো ফাঁদ।
হ্যাঁ। কীভাবে নিজেকে অভ্যস্ততামুক্ত করা যায়, কীভাবে একটা অভ্যস্ততামুক্ত মন নিয়ে জীবনযাপন করা যায়, এই প্রশ্ন নিয়ে যত লোক আমার সাথে আলাপ করতে চায় তাদের সবাইকেই আমি বলি যে, তারা যে জিনিসটা করছে সেই জিনিসটাই আসলে তাদেরকে অভ্যস্ত করে তুলছে, ভিন্ন একটি পন্থায় তাদেরকে অভ্যস্ত করে তুলছে। প্রচলিত একটা প্রতিভাষার বদলে তুমি শুধু নতুন আরেকটা প্রতিভাষা খুঁজে নিচ্ছো। এই হলো ব্যাপার। কিন্তু এটা তোমাকে সেই একইভাবে অভ্যস্ত করে তুলছে। এটা শুধু তা-ই পারে। ভৌতদেহ [ইউ জী নিজেকে নির্দেশ করলেন] এমনভাবে অভ্যস্ত যে এটা কাজ করে একটা ধীশক্তিরূপে। অভ্যস্ততাই এখানে ধীশক্তি। তোমার চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই।
কিন্তু দেহের তো কোনো অভ্যস্ততা নেই।
দেহের অভ্যস্ততাই হলো তার ধীশক্তি। সেটা দেহের জন্মগত। আমি সহজাত প্রবণতার কথা বলছি না। দেহের ধীশক্তি তার টিকে থাকার জন্যে জরুরী। আমরা যে বুদ্ধি বিকশিত করেছি তার থেকে এই ধীশক্তি সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের বুদ্ধি ওই ধীশক্তির সমকক্ষ নয়। তুমি যদি কোনো চিন্তা না করো, নিজেকে কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে দেখলে দেহ নিজের দেখভাল করতে সক্ষম। যখনই দেহ কোনো বিপদে পড়ে, সে তার নিজের ওপরেই নির্ভর করে, তোমার বুদ্ধি বা চিন্তার ওপরে নয়। পক্ষান্তরে, শুধু চিন্তা করলেও তুমি ভয় পেয়ে যাচ্ছো। ভয় তোমার জন্যে ক্রিয়া করাটা কঠিন করে দিচ্ছে। লোকজন আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘তুমি গোখরোর সাথে হাঁটো কীভাবে?’’ কোনো বাঘের সাথে বা অন্য কোনো বন্য জন্তুর সাথে আমি কখনো এটা করি নাই। কিন্তু মনে হয় না আমি তাদের সাথেও কোনো ভয় পাবো। তোমার ভেতরে কোনো ভয় না থাকলে তুমি তাদের সাথে হাঁটতে পারো। ভয় কিছু গন্ধ নিঃসরণ করে গোখরো যেটা টের পায়। গোখরো টের পায় তুমি একটা বিপজ্জনক জিনিস। স্বভাবতই গোখরোটাই প্রথম পদক্ষেপ নেবে। অন্যথায় প্রকৃতিসৃষ্ট প্রাণীদের মধ্যে গোখরো সুন্দরতমদের একটি। তারাই সবচে’ প্রেমময় প্রাণী। তুমি তাদের সাথে হাঁটতে পারো। কথা বলতে পারো।
তারাও কি কথা বলবে…?
এটা একটা একমুখো সেমিনারের মতো। [হাসি] হয়তোবা। একবার এক মুভি স্টার মহিলা আমি যে আশ্রমে ছিলাম সেখানে দেখা করতে এলেন। জানতে চাইলেন, গোখরোরা আমার সাথে দেখা করতে আসে, আমি তাদের সাথে হাঁটি, এইসমস্ত অতিরঞ্জন কি না। আমি বললাম, ‘‘সন্ধ্যা বা রাত্রি পর্যন্ত অপেক্ষা করো, তুমি আশ্চর্য হয়ে যাবে।’’ পরে গোধুলীর সময় যখন আমরা হাঁটতে বেরিয়েছি─হঠাৎ একটা নয়, বউ বাচ্চা নাতিপুতিসমেত পনেরোটার মতো গোখরো আবির্ভূত হলো।
পুরো পরিবারটাই?
পুরো পরিবারটাই। আমার অতিথি ছুটে পালালেন। তুমি যদি এই খেলা করতে চাও [গোখরোর সাথে হাঁটাহাঁটি], তাহলে বিপদ। তুমি যে পরিস্থিতিতে পড়বে তার জন্যে দায়ী তোমার ভয়। তোমার ভয়টাই গোখরোটার জন্যে সমস্যা সৃষ্টি করছে। তখন প্রথম পদক্ষেপটা তাকেই নিতে হয়।
গোখরোটা যদি তোমাকে হত্যা করে, তুমি মাত্র একজন। যেখানে অহেতুক আমরা শত শত হাজার হাজার গোখরো হত্যা করছি। এই গোখরো যদি তুমি বিলুপ্ত করে দাও, ক্ষেতের ইঁদুরদের মচ্ছব হবে, দেখা যাবে তারা সমস্ত ফসল সাবাড় করে দিচ্ছে। প্রকৃতিতে রয়েছে এক অসামান্য ভারসাম্য। আমাদের হঠকারিতাই প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতার জন্যে দায়ী।
আমি যদি দেখি একটা গোখরো কোনো শিশু বা কাউকে ক্ষতি করতে চাইছে, আমি তাকে সেটা জানাবো (গোখরোটাকে আমি হয়তো মারবো না, দেখ) বা গোখরোটাকে হয়তো বলবো চলে যেতে। [হাসি] গোখরোটা চলে যাবে জানো তো। পক্ষান্তরে তোমাকে সেটা হত্যা করতে হবে। কেন তোমাকে অহেতুক শত শত হাজার হাজার গোখরো হত্যা করতে হবে? ভবিষ্যতে তারা আমাদের ক্ষতি করবে এই ভয়টাই ওই ধরনের কাজের জন্যে দায়ী। কিন্তু আমরা প্রকৃতিতে একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছি; এবং এর পরে তোমাকে আবার ক্ষেতের ইঁদুরগুলোও মারতে হবে। বিড়ালটাকে তুমি ভিটামিন বা বিশেষ ধরনের কোনো খাবার খাওয়াচ্ছো, এবং বিড়ালটা যদি কোনো ক্ষেতের ইঁদুর মারতে চায়, কখনো কখনো তুমি ইঁদুরটাকেও বাঁচাতে চাও। কেন? বিড়ালরাও এখন আর ইঁদুর খায় না যেহেতু তারা সুপারমার্কেটের খাদ্যে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তবে এখনও বিড়ালরা ইঁদুরদের সাথে খেলা করে আর কোনো কারণ ছাড়াই তাদেরকে হত্যা করে। তারপর সেটা না খেয়ে মাঠে ফেলে রেখে চলে যায়। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কয়েকবার আমি এটা দেখেছি।
তারা কি নষ্ট বিড়াল?
নষ্ট বিড়াল। আমাদের সঙ্গে থেকে থেকে কুকুর-বিড়ালরাও মানুষের মতো হয়ে গেছে। বিড়ালদেরও তুমি পরিচিতি দিচ্ছো, কুকুরদেরও নাম দিচ্ছো। মনুষ্যসংস্কৃতি ওইসব জন্তুদেরকে নষ্ট করে দিয়েছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমাদের পোষ্যপ্রাণী বানিয়ে বানিয়ে আমরা তাদেরকে নষ্ট করে ফেলেছি।
তুমি কি ক্লান্ত? বাদ দিতে চাও?
না। এটা তোমার ব্যাপার। এটা তোমার সম্পত্তি, আমার নয়। আমি যা বলেছি তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তুমিই এটা আমার ভেতর থেকে বার করে এনেছো। এ নিয়ে তুমি কী করবে সেটা তোমার ব্যাপার। যা-ই বেরিয়ে আসুক তার কপিরাইট তোমার। এটা শুধু বলার জন্যে বলছি না। এটা আসলেই তোমার। আমি মোটেও এখানে বসে বসে এইসমস্ত নিয়ে ভাবছি না। কখনোই আমি সেটা করছি না।
এ নিয়ে তোমার কোনো মাথাব্যথা নেই?
না। এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যাথা নেই। তুমিই এখানে এসে এইসমস্ত জিনিস আমাকে জিজ্ঞেস করছো। আমি আসলে তোমাকে কোন উত্তর দিচ্ছি না। আমি শুধু পুরো ব্যাপারটাকে ফোকাস করার বা স্পটলাইট করার চেষ্টা করছি আর বলছি, ‘‘এইসব জিনিস তুমি এইভাবে দেখছো; কিন্তু সেগুলো এইভাবে [অন্যভাবে] দেখ। তাহলে কারো সাহায্য ছাড়াই তুমি নিজে নিজেই মীমাংসা পেয়ে যাবে।’’ আর কিছু নয়। আমার আগ্রহ শুধু তোমাকে দেখানো যে, তুমি হাঁটতে পারো, এবং দয়া করে ওই ক্রাচগুলো ফেলে দাও। সত্যিই যদি তুমি প্রতিবন্ধী হয়ে থাকো, তাহলে আমি সেটা বলবো না। কিন্তু লোকেরা তোমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে যে তুমি একজন প্রতিবন্ধী, যাতে করে তারা তোমার কাছে ওই ক্রাচগুলো বেঁচতে পারে। ওইগুলো ছুঁড়ে ফেলে দাও এবং তুমি হাঁটতে পারবে। আমি শুধু এইটুকুই বলতে পারি। ‘‘যদি আমি পড়ে যাই…’’ এই হলো তোমার ভয়। ক্রাচগুলো জায়গামতো সরিয়ে রাখো, তুমি পড়ে যাচ্ছো না।
প্রতিবন্ধীত্ব কি শুধুই একটা বিশ্বাস?
যখন আমাদের বিশ্বাস করানো হয় যে আমরা প্রতিবন্ধী, তখন তুমি ক্রাচের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ো। আধুনিক গুরু তোমাকে জোগান দেন কম্পিউটারাইজড ক্রাচ।
কেন তোমার মনে হচ্ছে আমরা প্রতিবন্ধী, কেন এই দ্বন্দ্ব, এই বিভ্রাট?
সমগ্র ব্যাপারটাই সেখানে সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রবিষ্ট।
কিন্তু এটা তো আছেই!
কোথায়? এটা কোথায় আছে?
কোথাও আমি এটা টের পাচ্ছি, এটা অনুভব করছি আর অশান্তি বোধ করছি।
কিন্তু সারাক্ষণ এইসব নিয়ে ভেবে ভেবে তুমি এতে প্রাণসঞ্চার করছো। এই সমস্তকিছুতে রয়েছে তোমার বিশাল বিনিয়োগ। অথচ এই সবই শুধু স্মৃতি, শুধুই ধারণা।
স্মৃতি কী?
স্মৃতি কী আমি সত্যিই জানি না। আমাদের বলা হয়েছে, ‘‘নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জিনিস মনে করতে পারাটাই’’ হলো স্মৃতি। মনোবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমরা এই সংজ্ঞাটাই মুখস্থ করেছি। কিন্তু স্মৃতি তার থেকে অনেক বেশি কিছু। তাঁরা বলেন যে স্মৃতির অবস্থান স্নায়ুকোষে। যদি স্নায়ুকোষেই সবকিছু থেকে থাকে, স্নায়ুকোষের ঠিক কোনখানে তার অবস্থান? মস্তিষ্ক স্মৃতির কেন্দ্র বলে মনে হয় না। দেহকোষেরও বোধহয় তাদের নিজস্ব স্মৃতি রয়েছে। তাহলে, ওই স্মৃতিটা থাকে কোথায়? এটা কী জিনের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়? সত্যিই আমি জানি না। এইসমস্ত কিছু প্রশ্নের এখনো উত্তর মেলে নাই। হয়তো একদিন তাঁরা সেটা আবিষ্কার করবেন।
আমার বিশ্বাস আমাদের হাতে যে বিপুল হাইটেক আর প্রযুক্তি রয়েছে তার মাধ্যমে এই গ্রহের সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু এই অগ্রগতির মাধ্যমে যে সুবিধা আমরা সঞ্চয় করেছি তা এখনো এই গ্রহে বসবাসকারী সকল মানুষ পর্যন্ত এসে পৌঁছায় নাই। প্রযুক্তি কেবল অতিশয় নগন্য-সংখ্যক লোকের উপকারে লেগেছে। হাইটেক আর প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়াই বোধহয় বারোশো কোটি মানুষের আহার যোগানো সম্ভব। প্রকৃতি এত অঢেল দেওয়া সত্ত্বেও আজ কেন তিন-চতুর্থাংশ মানুষ ক্ষুধার্থ? কেন তারা সবাই এত অনাহারী? তারা অনাহারী কারণ তাদের সমস্যার জন্যে আমরাই দায়ী। আজ আমাদের সবার সামনে এইটাই সমস্যা।
এমনকি ইরাকেও ওই একই ব্যাপার। সেখানে যে খেলাটা চলছে সেটা শুধু বিশ্বের সম্পদে আধিপত্য করা, সেটাকে আয়ত্ব করার খেলা। সেটাই নগ্ন সত্য আর বাকি সবই চরম ফালতু। তুমি একটা ইরাকি মারলে না আমেরিকান মারলে সেটা আসলে কোনো ঘটনা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলছেন, ‘‘আমি আমেরিকানদের উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।’’ কীসের জন্যে? আমেরিকায় যখন কফিন আসতে শুরু করবে, তাঁরা অন্য গান গাইবেন। তবে বিষয়টা সেখানে নয়। আমি এই পক্ষে বা ওই পক্ষে নই। পরিস্থিতির বাস্তবতাটা হলো এই।
অন্য সমস্যাটা হলো: কীভাবে একটা মানুষকে আমরা পাল্টাবো, এবং কেনইবা পাল্টাবো? শারীরিক বিকলাঙ্গতা ঠিক করাটা যদি উদ্দেশ্য হয়, আমরা ভাগ্যবান যে চিকিৎসাবিজ্ঞান আমাদের সহায়তা করবে। একটা শিশুর যদি কোনো ধরনের প্রতিবন্ধীত্ব থাকে, সেটা পরিবর্তনের জন্যে কিছু করার আছে। কাজেই চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞ থাকতেই হয়। প্রকৃতি কোনোভাবেই প্রতিবন্ধীত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। জনতায় শুধু আরেকজন যোগ হলো। সুতরাং, মানুষের কোনো পরিবর্তন যদি জরুরী হয়েই থাকে, এবং নৈতিক, সাংস্কৃতিক, আইনগত কাঠামো যা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেসব থেকে মুক্ত করে যদি তাদেরকে ভিন্নভাবে ক্রিয়াশীল করতে চাও, এবং এইভাবে ভিন্ন ধরনের মনুষ্য সৃষ্টি করতে চাও, তখন শুধু জিনপ্রযুক্তিই আমাদের কাজে লাগতে পারে। নীতিশাস্ত্র, নীতিকথা বা আইনী কাঠামো দিয়ে কোনো কাজ হবে না। এখন পর্যন্ত সেসবে কোনো কাজ হয় নাই। সেসব দিয়ে কিছুই হয় নাই। কিন্তু জিনপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আমরা হয়তো মানুষকে চৌর্যপ্রবণতা, সহিংসতা, লিপ্সা, ঈর্ষা থেকে মুক্ত করতে পারবো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কী জন্যে? আমি জানি না কী জন্যে।
জিনপ্রযুক্তিবিদদের কাজটা তাদেরকে শুধু আরো বেশি বেশি ক্ষমতা জোগাবে!
প্রযুক্তিবিদরা রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতা পান। তাঁরা রাষ্ট্রের বলি। তাঁরা এটা, তাঁরা যেমনটি দাবি করে থাকেন, সেই মানবিক উদ্দেশ্যে বা কল্যাণের উদ্দেশ্যে করছেন না, করছেন শুধু স্বীকৃতির জন্যে, একটা নোবেল পুরস্কারের জন্যে বা একটা সম্মানজনক পুরস্কারের জন্যে।
তো তাঁরা যদি কোনো মীমাংসা খুঁজে পান, তখন….?
তাঁরা সেটা রাষ্ট্রের হাতে অর্পণ করবেন, এবং তখন রোবটের মতো লোকজনকে যুদ্ধে পাঠিয়ে তাদের দিয়ে নির্বিচারে খুন করানোটা নেতাদের জন্যে অনেক সহজ হয়ে যাবে। এটা অনিবার্য। তাহলে আমরা আসলে করছিটা কী? আমি যেভাবে দেখি─এবং এটাই হলো আমার রোজহাসরের গান─এই সমগ্র ধারাটাকে উল্টোদিকে নিতে তোমার কিছুই করার নেই। ব্যক্তিগতভাবে তুমি হয়তো বাঘের পিঠ থেকে লাফ দিয়ে পড়তে পারো, কিন্তু যে লোকটা লাফ দিয়ে পড়তে ভয় পাচ্ছে এবং বাঘের পিঠে বসে ছুটেই চলেছে, তাকে তুমি যা-ই বলো না কেন, সেটা তার কোনো কাজে আসবে না। আসলে তোমাকেও সেখান থেকে লাফ দিতে হবে না, [হাসি] ভ্রমণটা তুমি চালিয়ে যেতে পারো। কোনো সমস্যা নেই। তুমি সমাজের সাথে কোনো দ্বন্দ্বে নেই যেহেতু জগৎটা কোনোভাবে অন্যরকম হতে পারে না। কেউ যদি ওপরে উঠতে চায়, সেটা যদি তার ক্ষমতার খেলার অঙ্গ হয়, তখন সে দুনিয়াটা পাল্টানোর কথা বলে; পৃথিবীর ওপরে স্বর্গ বা বেহেস্ত রচনার কথা বলে। কিন্তু আমি জানতে চাই, সেটা কখন?
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আমাদের সবাইকে বিশ্বাস করানো হয়েছিলো, সমস্ত যুদ্ধ শেষ করার জন্যেই এই যুদ্ধ। কী কথা! এটা কি যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়েছে? যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। আমাদেরকে বিশ্বাস করানো হয়েছিলো, বিশ্বটাকে গণতন্ত্রের জন্যে নিরাপদ করতেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে। [হাসি] আহাহা! ওইরকম সমস্ত জিনিস আমাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে। যদি তুমি তোমার নেতাকে বিশ্বাস করো, বা খবরের কাগজের লোকটার কথা বিশ্বাস করো, যে-কাউকে এবং যেকোনো কিছুতেই তুমি বিশ্বাস করবে।
কিন্তু এই উপলব্ধিও কি কোনো পরিবর্তন ঘটায় না?
পরিবর্তন… কেন তুমি দুনিয়া আর লোকজন নিয়ে এত চিন্তিত?
কিন্তু স্যার, যখন তুমি উপলব্ধি করছো যে তুমি বাঘের পিঠে উল্টোদিকে বসে আছো…
কিছুই তুমি উপলব্ধি করো নাই। সত্যিই ওই উপলব্ধি হলে সেখানে একটা ক্রিয়াও থাকবে। আমি এই কথা বলাটা পছন্দ করি না─ ‘‘ওই সমস্তকিছু থেকে মুক্ত’’, কিন্তু তুমি আর কোনো দ্বন্দ্বে নেই। তোমার আর দ্বন্দ্ব করার কোনো উপায় নেই। সংস্কৃতি তোমার ভেতরে যে বাতিকগ্রস্ত পরিস্থিতি ঢুকিয়ে দিয়েছে সেইহেতুই এই দ্বন্দ্ব।
এবং সেটা উপলব্ধি করলে…
উপলব্ধি করবে কীভাবে? তোমার হাতে যে অস্ত্র আছে…
আমার বুদ্ধিমত্তা…
ওই বুদ্ধিমত্তাই এই বাতিকগ্রস্ত পরিস্থিতির জন্যে দায়ী। এটাই হলো মনুষ্যপরিস্থিতি। ওই অস্ত্র দিয়ে তোমার সমস্যা সমাধান করার কোনো উপায় নেই। অথচ আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত নই যে এটা শুধু সমস্যাই তৈরি করতে পারে, সেসবের সমাধানে কোনো কাজে লাগে না।
এটা মেনে নিলেও কি কোনো লাভ আছে?
না।
এটা এত স্পষ্ট…
তাই যদি হয়, তাহলে সেটা আর কোনো বিষয় নয়। আমার কাছে এটাই হলো বাস্তবতা। ‘‘এটা এমনই’’ মানেই হলো, সেখানে এ নিয়ে আর কিছু করার সক্রিয়তা নেই। সেখানেই ব্যাপারটার ইতি।
যদি তাই হয়ে থাকে…
তোমার ক্ষেত্রে সেটা এরকম হতে পারে না। তাই যদি হতো, সেখানেই আমাদের সমস্ত কথাবার্তার ইতি। তুমি তখন সম্পূর্ণ একা।
বুঝতে পারছি।
সম্পূর্ণ একা। আমাকে নিয়ে তুমি আর কিছু বলবে না। তুমি যদি আমাকে নিয়ে কিছু বলো, সেটা শুধু তুমি আরেকটা কাহিনি বলছো মাত্র, কোনোখান থেকে সেটা সংগ্রহ করেছো। কাজেই এত্থেকে কী বেরিয়ে আসবে তা কেউ জানে না। সেটা একই জিনিস হবে না। তুমি যেটা বলবে সেটা একই জিনিস হবে না।
আমি বুঝতে পারছি না কেন…
প্রত্যেকটি মানুষের যা-কিছু চিন্তা, অনুভূতি আর অভিজ্ঞতা, এই সমস্ত জিনিসটা তুমি তোমার মনুষ্যদেহ থেকে দূর করে দেবার মতো যথেষ্ট ভাগ্যবান হলে…
আমরা কি সেটা পারি?
পারো না, এবং এ নিয়ে তোমার কিছুই করার নেই। এমনকি ওই বাক্যটাও তুমি সম্পূর্ণ করতে পারো না। পরিস্থিতিটা হলো এরকম যে, এ ব্যাপারে যে তুমি কিছুই করতে পারো না, সেটাও তুমি নিজেকে বলবে না।
তো যখন আমি নিজেকে বলছি যে আমি কিছুই করতে পারি না…
তখনও সেখানে ওই কিছু একটা করতে চাওয়ার চাহিদাটা থাকতে বাধ্য।
…সেটাই হলো সমস্যা।
সেটাই হলো সমস্যা। তুমি একে বলছো নৈরাশ্য এবং বলছো, ‘‘আমি বৌদ্ধিকভাবে বুঝেছি।’’ কিন্তু সেটাই তোমার কোনো কিছু বুঝার একমাত্র উপায়। সেটাই তুমি এখন করার চেষ্টা করে যাচ্ছো। আমি বলতে পারি যে ওটা [চিন্তা] কোনো অস্ত্র নয়, আর-কোনো অস্ত্রও নেই, এবং বুঝার কিছুই নেই। কীভাবে এই উপলব্ধিটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে আমি সত্যিই জানি না। যদি আমি সেটা জানতাম, সেটা অন্য যেকোনো কিছুর মতোই অর্থহীন হতো। সত্যিই আমি জানি না। সুতরাং, তোমাকে এমন একটা অবস্থায় থাকতে হবে যেখানে এই সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কী করতে হবে তুমি সত্যিই জানো না। সমস্ত জিনিসটা তুমি নিঃশেষ করো নাই। যদি একটা নিঃশেষ করো, সবসময়ই সেখানে আরেকটা [পরিস্থিতি], তারপর আবার আরেকটা, এবং তারপরও আবার আরেকটা।
সেটা [পরিস্থিতিটা] নিঃশেষ করার পরিকল্পনাটাও কি একটা বিপর্যয় হয়ে দাঁড়াবে?
হ্যাঁ, সেটা থেকে নিজেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা, আসলেই কী জানো না, এরকম একটা দশায় নিজেকে স্থাপন করার প্রচেষ্টা, সেটাও ওই [চিন্তার] সক্রিয়তারই অংশ।
……………
১. ইনসেস্ট: incest; অজাচার; অগম্যাগমন। (নিকটাত্মীয়ের সাথে যৌনকর্ম।)
২. স্ত্রী ও পুরুষ অঙ্গের কাপলিঙ: (কাপলিঙ; coupling: যুগ্মীকরণ) coupling of the male and the female organ.
৩. সিনক্রনাইজড: synchronized; সমকালিক।
৪. ব্রহ্মচর্য: আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য ইচ্ছাকৃত কৌমার্য-ব্রত।
৫. নিল নিসি বোনাম: nil nisi bonum. (ল্যাটিন শব্দগুচ্ছ ‘de mortuis nil nisi bonum dicendum est’এর সংক্ষিপ্তরূপ। অর্থ অনেকটা এরকম─ ‘মৃতদের নিয়ে গিবত গেয়ো না।’)
৬. মূর্ত: concrete; বাস্তব।
৭. ভাইব্রেটর: vibrator.
৮. পুরোহিততান্ত্রিক কাঠামো: hierarchical structure.
৯. ধীশক্তিরূপে: …acts as intelligence.
[Conversation with U.G. Krishnamurti: 9; এটি No Way Out গ্রন্থের The build-up of sex and love পর্বটির বাংলা অনুবাদ। অনুবাদের স্বত্ব সংরক্ষিত।]