উত্তম চক্রবর্তী
বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রবর্তক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলা সাহিত্যে প্রথম বিদ্রোহ ও সংগ্রাম তিনিই সূচনা করেন এবং সর্বোতভাবে সফল হন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধীর, অলস ও একমাত্রিক জীবন-যাত্রার তাল-ছন্দ তিনিই ভেঙেছেন, এ তাঁর বৈপ্লবিক কর্মযজ্ঞ।
মধুসূদন নতুন কালের আহবান উপলব্ধি করেছিলেন—আর এজন্যে বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিক আঙ্গিক, ভাব ও বক্তব্যের ক্ষেত্রে তিনি আনলেন জীবন ও জগৎমুখী গতিময় পরিবর্তন। এবং এমন একটি সাহিত্যিক আবহাওয়া থেকেই আমাদের সুসজ্জিত আলোক-উজ্জ্বল সাহিত্যের এই বর্তমানে এসে সিথত হওয়া। মধ্যযুগের সতত আত্মসমর্পণমুখী যুক্তিহীন ভক্তিসর্বস্ব অন্ধকার জগৎ থেকে মানব-আত্মাকে তিনিই জাগিয়ে তুলেছেন, মানব মনে প্রতিষ্ঠা করেছেন জীবন-উপভোগের স্পৃহা, সামান্যে তৃপ্ত বাঙালির হৃদয়ে তিনিই এনেছেন অপার অনুসন্ধিৎসা। বাংলা সাহিত্যে কালবদলের এ বড় কাজটি সম্পন্ন হয়েছে তাঁর হাতেই।
মধুসূদনের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক চিন্তা উনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁস বা নবজাগৃতি সূত্রে গঠিত। সে সময়ে বাংলা সাহিত্যর স্থান জুড়ে কবিগান, পাঁচালি, হাফ-আখড়াই শ্রেণির রচনা ও কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের হালকা রুচির ব্যঙ্গকবিতা প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষিত, রুচিশীল মনের আকাঙ্খার দিকে খেয়াল রেখে এবং নবজাগৃতির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মধুসূদন প্রবর্তন করলেন নতুন এক কাব্যধারা— যা প্রাচীন সকল কাব্যিক আচ্ছন্নতাকে দূরে ঠেলে দিল। তিনি একদিকে গ্রিক মহাকাব্য ও পুরাণকে, অন্যদিকে ভারতীয় মহাকাব্য ও পুরাণ থেকে সমৃদ্ধ হয়ে রচনা করলেন সম্পূর্ণ আধুনিক ধারায় ‘মেঘনাদবধকাব্য’।
জীবনবোধ জীবনের বৈশিষ্ট্য ও ধরনকে নির্ণয় করে বলে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যবোধ ও বৈশিষ্ট্য সে যুগের জীবন-বৈশিষ্ট্যকে সবসময় মান্য করেছে। সে সময়ের সাহিত্যের সকল সংস্কার সে যুগের জীবন-সংস্কার থেকেই উৎপন্ন— মধুসূদন এই সত্যটি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই ক্ষয়িষ্ণু জীবনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পয়ারের গতানুগতিকতা ও আড়ষ্টতা থেকে বাংলা কবিতাকে নিয়ে এলেন মুক্তির পথে, অমিত্রাক্ষর ছন্দের (Blank Verse) সামুদ্রিক অবয়বে।
মধুসূদন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার পরেও পৌরাণিক রাবণ ও মেঘনাদকে নতুন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। যুগোচিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই রাম-লক্ষ্মণকে ‘ভিখারীরাঘব’ হিসেবে প্রতিপন্ন করলেন। মধ্যযুগীয় জীবনাদর্শের প্রতীক, অদৃষ্ট, দৈবশক্তির ক্রীড়নক বলেই রাম-লক্ষ্মণের প্রতি তাঁর এই অবজ্ঞা। আধুনিক মনন চূড়ান্ত বিবেচনায় ঐতিহ্যমুখী। মধুসূদন ছিলেন আপন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এজন্যে সীতার প্রতি তাঁকে সবসময় শ্রদ্ধাবনত থাকতে দেখা যায়। পাশাপাশি প্রমীলা, সরমা, মন্দোদরী, চিত্রাঙ্গদা প্রসঙ্গে তাঁর প্রীতিস্নিগ্ধ মনোভাব প্রকাশিত। উল্লেখ্য, ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের প্রতিচরণে নারীর প্রতি তাঁর সশ্রদ্ধ ও সহৃদয় দৃষ্টি লক্ষ্য করা যায়। মধুসূদনের এ দৃষ্টি আধুনিকতায় ও মানবিকতায় পূর্ণ।
জীবনের শুরুতে মাতৃভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করলেও পরবর্তীতে দেখা যায় বাংলাকেই আকুল আবেগে কবি জড়িয়ে ধরেছেন এবং এ ভাষাকেই নতুন এক গতিপথে চালনা করেছেন। বীরের মতো তাঁর ‘বঙ্গভাষা’ শীর্ষক সনেটে স্বীকার করেছেন ‘মাতৃভাষা রূপ খনি পূর্ণ মনিজালে।’ মধুসূদনের প্রতিটি সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার চরণে চরণে আপন ভাষা, দেশ, প্রকৃতি ও আপন ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য স্পষ্ট— যা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত এক নতুন প্রবাহ।
মধুসূদন নবজাগরণের প্রথম প্রাণপুরুষ, বাংলা ভাষার অসাধারণ প্রতিভাবাণ কবি, মহাকবি। ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সশ্রদ্ধচিত্তে ও বিনম্র কৃতজ্ঞতায় আমরা তাঁকে স্মরণ করি।
মধুসুধনের “নীতিগর্ভ কাব্য” বিচারে তাঁকে বাংলার ঈশপ বলা যেতে পারে।তাঁর কাব্য/সহিত্য আলোচনায়/সমলোচনায় কোন লেখক, সমালোচক বিষয়িটর প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না।”রসাল ওস্বর্ণ-লতিকা” “ময়ূর ও গৌরী” “কুক্কট ও মণি” প্রভৃতি অসংখ্য কবিতায় কাব্য রসের সঙ্গে সঙ্গে যে নীতি শিক্ষার আবতারণা করেছেন তা চির শাশ্বত, চির নিত্য ।মধু কবির কব্য আলোচনায় এ বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে আসা উচিত।