নিসর্গ সিরিজ ২

শিবলী সাদিক

ল্যান্ডস্কেপ

সৌন্দর্য যে এক প্রকার আয়না আগে বুঝি নাই,
জলে ঢোলকলমির কাব্য পাঠ করে আমি ক্রমে অন্ধ হয়ে পড়ি।
বুঝতে পারছি পাতার আড়ালে সব গান যে লুকিয়ে রাখে জলপিপি,
ফলে ল্যান্ডস্কেপ করা সম্ভবই নয়। পাতা বুঝতে গেলে
গান আর তার অদৃশ্য রং তো আঁকা হবে না। বিকালে পুকুর পাড়ে
নির্জনে দাড়িয়ে আঁকছি মাছের রঙিন বুদ্বুদ। কিছু আগে
গাছে গাছে বাতি জ্বলেছিল, ফলে আলোর তিনশ ডিগ্রি
তাপ জানা গেল, আর ছায়া তো সূর্যঘড়ির প্রপাত থেকে নামছে,
এর কি নাম দেয়া যায়? ছায়াকানন বললে তো আর হবে না,
তাতে জলে ডুবে-থাকা রংধনুগুলি কি করে যাবে
অনুবাদ করা ? আরে, চারপাশে যে কোরাস তা কি গান,
দৃশ্য নাকি এক প্রকারের ধাঁধাঁ,
বাস্তবতার কোন তলে গেলে এসবের আভাস পাব?

মাছরাঙ্গার মতন এখন আমার চোখ নেই,
দৃশ্যে দ্রবীভূত হয়ে গেছে,
জলের গোপন রং এবারই প্রথম জানলাম, জানলাম পদ্ম
আসলে মোল্লাবাড়ির সেজবউ, সে মাঠের কন্যা, ধান গম হতে এসে
সংসারে ব্যর্থ হয়ে জলের পাতালে নেমে গেছে,
রক্তমাখা তার হাত হতে যে রং এখন গড়াচ্ছে দশদিকে,
তার রং ঘোর লাল
যা যজ্ঞের দেবতারা হোমপাত্রে পান করতেন
বা মৃত্যুকূপে নামার মুহূর্ত আগে ভ্যানগগ
রঙের অন্তিম তৃষ্ণায় যা শেষবার দেখলেন।
সব উপস্থিতি ও নৈঃশব্দ্য, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য রং হয়ে গেলে
আমি কি করে এসব আঁকি?

কবি উৎপল কুমার বনে দমকল ঘুরতে দেখতেন।
আর আমি তো কাউয়াগারা বিলের পাশে বসে আছি।
এখানে কি করে রং দাবানল হয়ে যাবে? তবে এই বিলে
নামার প্রস্তুতি থাকা ভাল।
এর জলে ডুব দিলে নাকি পাতালের রাজবাড়ি দেখা যায়।
সোনার শিকল জলে আছে বলে খুব জনশ্রুতি আছে।
আমি এই গ্রীষ্মে পালাবার কথা ভেবে গ্রামে চলে আসি,
সভ্যতার স্মৃতি মুছে যাচ্ছে দ্রুত, রাজবাড়িতে পালিয়ে
যাবার সময় প্রায় হয়ে এল, তার আগে নোট লেখা
শেষ করতেই হবে। কিন্তু মাত্র গতকাল
বড়াল নদীর জলে
বেবিলন হতে ভেসে-আসা শিকারি আর তার
নিহত হরিণ দেখে ছবি আঁকা মনস্থির করি।
বাস্তবতার একটা ছবি তো অন্ততঃ চলে যাবার আগে আঁকা চাই।

আবার বিভ্রান্ত পায়চারি। আলাপ করছি
মাতাল ছাতিম গাছটার সাথে। পুকুরের জলে উবু হয়ে
গত শত যুগে তার নাকি জল আর রং নিয়ে
প্রচুর চিন্তার তালগোল পাকিয়ে আছে।
আমি কিছুটা পুলক বোধ না করে পারছি না, আরে এ যে
সেই সখা যার ডালে লটকে পরে শুধু অপলক তাকিয়ে থাকব,
আর এ তো দেখি সাচ্চা এক বৃক্ষদার্শনিক!
হায় আমি এর সাথে কত দূর আলাপ চালাতে পারি?

কিছু দূর যেতেই আমার ছেলেবেলার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
মেলা থেকে তালপাতার বাঁশি কিনে বাড়ি ফিরছে।
আর তার চুলে তেল চকচক করছে। এক হাতে নাটাই
আর অন্য হাতে ঘুড়ি, মাধ্যাকর্ষণ অগ্রাহ্য করে ঘুড়িসহ উড়ে যাবে।
এই বাঁশি হারিয়ে প্রায়ই আমি কাঁদতাম, যা আজো
বেজে যায় বলে পৃথিবীর ছেলেবেলা কখনো হারিয়ে যায় না,
মাঝেমাঝে দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে যায় গ্রামের বিকালে মাঠে।

আহা, আমার ইন্দ্রিয় মাত্র পাঁচটা, এর মধ্যে চোখ
কোনো কাজে লাগল না, এক পদ্মপুকুরের পাড়ে
আজীবন অন্ধ বোবা হয়ে রইলাম, পদ্ম দেখা হল না।
আমার ভ্রমণ করাও ঠিক হয়ে উঠল না,
আমি পাক খাচ্ছি এক মাঠের ফাঁকা ধূধূ শূন্যতায়–
ঘাস আর পোকাদের জীবনীর রং খুব জানা নেই,
আর জলে ভাসা রক্তমাখা পাত্রে অর্ফিয়ূসের মস্তক বলে
রঙ নিয়ে শেষ প্রশ্ন করা জীবিতের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়।
নিখিলবাস্তবতার রং তাহলে কী করে জানা হবে?
নিজের ছবির মধ্যে ঢোকা পর্যন্ত হল না আমার।
হল না আমার আর মাঠ দেখা।

বস্তুত আমি আঁকতে চেয়েছিলাম হাঁসের কিছু ছবি।
বহুদিন গোপন নজরদারি আর বৃষ্টিবাতাসের সাথে
শলাপরামর্শ করে বুঝতে পারিনি কেন হাঁসগুলো
জ্যোছনা রাতে বার বার আমার মৃত্যুর সাথে এত খেলা করে।
দীঘির কাজল জলে আর বিলে এদেরকে আমি
রূপ আর কুয়াশা বরাবর সাঁতরাতে দেখি।
এমন রূপ-সাঁতারকেই কি মৃত্যু বলে?

চারপাশের বাস্তবতা জানি শেষতক শুধু মৌলকণাদেরই নাচ,
কিন্তু শতকোটি বছর শেষে রূপশালি ধানভানা নারী
এত বিকাশের পর রৌদ্রে রক্ত আর নেশা এঁকে হেঁটে যায়,
তার রূপ দাবি করা যাবে হয়তো বা কালপুরম্নষের কাছে,
আর তাই কলম গুটিয়ে এইবার আমি উঠে পড়ি,
ল্যান্ডস্কেপ রইল পড়ে তিলফুল শর্ষে-আঁকা মাঠে।

তবু বৃষ্টি হয়

কেন বৃষ্টি হয়- এ সরল প্রশ্নে অনেক ভেবেছি
মনোবেদনা শেষে মেঘ ও বাতাস মনে পড়ে
বাগানের শেষে এসে দেখি একান্ত গোলাপ
তার রং চুরি করে পালাবার পথে বৃষ্টি হয়
আর দেখি ময়ূর সৌন্দর্যে মনে মেলে পাখা

আমি কাঠ নিয়ে পালিয়ে যাবার সংকল্প
কষ্টে চেপে যাই, গত বসন্তের গান মনে করে
উন্মাদশালার কাছে সেবার অনেক দিন বাস করি
আমার আগ্রহ ছিল পাখিদের গান শোনা
শ্রীমতী রায়ের পাখি ছিল, তার গানে
অনেকবার বৃষ্টির কথা মনে হত, ভয়ে ভয়ে কাউকে বলি নি
আজ মনে পড়ে পলায়ন হতে বহু লোক বাড়ি ফিরে
বৃষ্টিবাসনায় সিক্ত হয়, আয়নায় ঝড় দেখে
সবাই গোপনে বর্ষার ব্যক্তিগত নোট রাখে
কেউ কাউকে বলতে পারেনি আজো কেন
মহাবরিষণে ভিজে তারা পালাবার কথা পুনঃপুনঃ ভাবে

ফলে বৃষ্টি হয়, তার কারণ অনুদ্ঘাটিত রেখে
আমরা ব্যাকুল হয়ে সরল অনেক প্রশ্ন করি


কমলা বাগানের পথে মেঘবৃষ্টি হতে পারে
কাঠের গোপন বাক্স যারা চুরি করে, তারা জানে
বজ্র ও বিদ্যুত হতে রূপ আর সৌন্দর্যের জন্ম হয়
গাছেরা মেঘ ও বাতাসের সব রূপ লুঠ করে
বনে এক কাঠুরিয়া তা জানলো কী প্রকারে
উন্মাদেরা সবাই দরজা ভেঙ্গে ফেলে চুপিসারে
বর্ষায় পালিয়ে গেলো উন্মাদশালা হতে
তার মানে কমলা বাগানে খুব বৃষ্টি হচ্ছে
কমলা আর তত স্বাস্থ্যপ্রদ নয়
যত কলা আর শিল্প থাকে বোবা কাঠে
উন্মাদেরা দীর্ঘপথে বয়ে নেয় চুরি-করা কাঠ
চুরি করা শিল্প নয়, এ কথা সঙ্গত নয় আর বলা


তারা দেবী, পদ্মের উপর তারা আসন নিতেন
পুরাকালে জলাশয় আলোকিত হয়ে যেত
তারা আজ আর নেই, ব্যথাতুর হয়ে ভাবি
বিগত কালের কথা, সুন্দরের কথা
বৃষ্টি হলে জলে পদ্ম দেখে সেইসব মনে হয়
মনে হয় সুন্দরের দিন শেষ হয়ে এল
ছাতা নিয়ে আজ হেঁটে যাই আর ভাবি
বৃষ্টিজাত হয়ে কোনো দিন আর
দেবী এসে বলবে না শুধু বৃষ্টি হোক
মেঘের পাপড়ি খুলে শুধু বৃষ্টি হোক
মহাকাল ধরে শুধু বৃষ্টি হোক

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top