গাজী তানজিয়া
।। ছয়।।
দেশ মরি গেল দুর্ভিক্ষের আগুনে
তবু দেশের মানুষ জাগিল না কেনে।
পরিচিত কবিয়ালের গান। কী তার মর্মবাণী। কেন যে দেশের মানুষ জাগে না বুঝতে পারে না ছফা। তবে জাগাতে হবে। বিপ্লবের উদ্দেশ্যইতো ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলা। তাঁরা এমন এক যুগে বাস করছে যখন রক্ত দিয়েই সবার চিন্তা করতে হচ্ছে।
গাছবাড়িয়ায় কমিউনিজম খুব একটা বিস্তার লাভ করতে পারেনি। তবে অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন ও পূর্ণেন্দু দস্তিদার কমিউনিজমের প্রভাব বিস্তারের ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা দুজনে এলাকায় পারিবারিক প্রভাব আছে এমন কিছু তরুণকে দলে ভেড়াবার চেষ্টা করছেন। হেদায়েত আলী তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছেলেকে এই পার্টিতে দেবেন মনস্থির করেছেন। ছেলে অবশ্য তার আগেই স্কুলে হেডস্যারের প্রভাবে পুরো কমিউনিস্ট হয়ে গেছে। এবং ক্রমশ সে কৃষক সমিতির সাংগঠনিক কাজকর্মের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। আর এই অসিলায় ছফার কবি হওয়ার যে একটা সংকল্প ছিল সেটা সিঁকেয় উঠেছে। রাতদিন সে কৃষকের দুঃখ দুর্দশা কিভাবে লাঘব করা যায় সেই চেষ্টায় ব্যস্ত। ছফার তখন বদ্ধমূল ধারণা সামনে কৃষক সমাজের দুঃখ দুর্দশা দূর করার জন্য মহা লড়াই আসছে, আর সে লড়াইকে সফল করতে হবে।
*বাংলায় বৃটিশ অধিকার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কৃষকেরা লড়ছে অকুতোভয়ে, জীবন বাজী রেখে। কিন্তু সে সংগ্রামে তারা ফল লাভ করতে পারেনি। ইতিহাসের অনিবার্যতায় তারা জয়ী হতে পারেনি। তারা লড়েছে এক উন্নত অস্ত্র-শস্ত্রের অধিকারী দক্ষ এক বাহিনীর বিরুদ্ধে। আমাদের দেশের কৃষক তখনো পর্যন্ত সেই শক্তিকে মোকাবিলা করার মতো শক্ত কাঠামো অর্জন করতে পারেনি। কারণ কৃষক সমাজ ছিল খণ্ড-বিখণ্ড, তাদের বিচরণ এলাকা ছিল সীমাবদ্ধ। তার সাংগঠনিক ভিত ছিল দুর্বল। তাই তাদের নেতৃত্ব আধুনিক চিন্তাসম্পন্ন জাতি ও শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ের উপযুক্ত ছিল না।
পূর্ববাংলা হলো কৃষক আন্দোলনের সূতিকাগার। অসংখ্যবার কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে এ অঞ্চলে। তাঁরা বিদ্রোহ করেছেন শোষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। বৃটিশ সরকার, জমিদার, জোতদার-মহাজনদের নির্মম শোষণ আর নির্যাতন–এসবের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রাম করতে হয়েছে বার বার। কৃষক কখনোই ফসলের ন্যায্য দাম পায়নি। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যে যারা লাভবান হয়েছে–সুবিধা ভোগ করেছে, তারা কৃষকদের ঘৃণা করেছে, কৃষকদের ওপর নানাভাবে জুলুম করেছে। কৃষক যাদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে সেই রাজা-বাদশা-মন্ত্রী-আমলা-জমিদার-জোতদার-মহাজন-টাউট শহরের ভদ্রবাবুরা কৃষকদের সর্বতোভাবে ঠকিয়েছে, নির্যাতন করেছে এবং সর্বোপরি ঘৃণাও করেছে। এই অবস্থা এখনো অব্যাহত আছে। কৃষকদের সমস্ত সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে এই ভদ্রবাবুরাই। কৃষকরা বিদ্রোহ করেছে তাদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধেই। এই বিদ্রোহী কৃষকদের ওপর লেলিয়ে দেয়া হয়েছে সৈন্য। পাইক-পেয়াদা-পুলিশ-ইপিআর-আর গুণ্ডা বদমাশদের। শোষকরা চায় কৃষকরা নানা দলে উপদলে বিভক্ত থাকুক। তাতে তাদেরই লাভ। কারণ তারা নির্বিঘ্নে শোষণ করতে পারে। কৃষকের পরিশ্রমের ফল ভোগ করতে পারে।
দেশের লাখ লাখ, কোটি কোটি কৃষক কৃষি কাজ করে। এরা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে যে প্রচণ্ড শক্তি তৈরী হবে সেই শক্তির সামনে প্রবল পরাক্রান্ত রাষ্ট্রশক্তি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে। আর রাষ্ট্রশক্তি এটা খুব ভাল করে জানে। তাই তারা চায় কৃষক সমাজ বিভক্ত থাকুক।
এই বিভক্ত শোষিত কৃষকদের তাদের দাবী আদায়ে একত্রিত ও সংঘবদ্ধ করতে ১৯৫৮সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান কৃষি ও কৃষক সম্মেলন আহ্বান করেন। এর আগে ১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ তিনি বাজেটের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, …. ‘দেশের মেরুদণ্ড কৃষক মজুর, যারা দিবারাত্র হাড়ভাঙ্গা খেটে রাজস্ব জোগায় তাদের জন্য কিছুই করেন নাই। শতকরা ৪ জন লোক শহরে বাস করে তাদের পানীয় জলের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছেন কিন্তু ৪ কোটি ৬০ লাখ গ্রামবাসীদের পানীয় জলের কোনো ব্যবস্থা করেন নাই…।’
১৯৫৮ সনে মাওলানা ভাসানী আহুত এই সম্মেলনে তাঁর অনুসারীরা যেমন উপস্থিত হন তেমনি বাম, কমিউনিষ্ট নেতা-কর্মীরাও উপস্থিত হন। এবং তারা কৃষক আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার এক কঠিন ব্রত অবলম্বন করেন। * (বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস: আমজাদ হোসেন।)
দেশের মেরুদণ্ড কৃষক সমাজ আজ চরম দুর্দশা ও সংকটে পতিত। কৃষক সমাজের এই দুর্গতি ও লাঞ্ছনা সমগ্র গ্রামীণ সমাজকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে রেখেছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও কৃষক সমাজের এই সংকটে দেউলিয়া। কিন্তু আবার এ কথাও সত্য যে কৃষক সমাজের মহান সংগ্রামী অতীত রয়েছে। আজ সময় এসেছে কৃষকের আবার জেগে ওঠার। দেশের সমগ্র জনসাধারণও কৃষকের সংগ্রামকে অকুণ্ঠভাবে সমর্থন করছেন।
গ্রামে গ্রামে ঘুরে পার্টির নেতাদের সাথে কিশোর ছফা এইসব বক্তৃতা করে। তারা বাবা হেদায়েত আলী পুত্রের এই বক্তৃতা শোনার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা সমাবেশস্থলে অপেক্ষা করেন। কিশোর পুত্রের এই কৃতিত্বে তাঁর গর্বের সীমা থাকে না। কখনো কখনো দূর দূরান্তে সমাবেশে হেঁটে যেতে না পারলে তাঁর বাবা তাকে কাঁধে তুলে নেন।
ছফা ততদিনে চট্টগ্রামের কলেজের ছাত্র। এবং একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। বিপ্লবের নেশা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইছে। পুরনো স্কুলের বন্ধুরা প্রায়ই বলে, কিরে ছফা কবিতা লেখা কি একেবারেই ছেড়ে দিলি?
দূর! ওসব সাহিত্য দিয়ে সহজে কোনো জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তন করা যায় না। সাহিত্য না বিপ্লবই পরিবর্তনের একমাত্র হাতিয়ার। কিছু একটা করতে হবে। যা এক নিমেষে বদলে দেবে প্রচলিত ধারণা।
কিন্তু সেটা এতো সহজে কীভাবে সম্ভব! বিস্ময়ে প্রশ্ন করে বন্ধুরা।
একটা ঝাঁকুনি দিতে হবে। ঝিমিয়ে থাকা রাষ্ট্র সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি দরকার। এই যেমন ধর মাষ্টারদা সূর্যসেন, তিনি যদি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুট না করতেন তাহলে বিপ্লবের আগুনটা ঠিকভাবে লাগত না।
কিন্তু ওদের উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম স্বাধীন করা সেটা করতে কি তারা সে সময়ে সমর্থ হয়েছিলেন?
এ কথা সত্যি পরিকল্পনায় কিছু ত্রুটি ছিল। তাঁরা অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেছিলেন ঠিকই তবে লুট করার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে, কি ভাবে এটাকে ইউটিলাইজ করতে হবে সেটা বুঝতে পারেননি তাঁরা।
তাহলে এ কথা কি বলা যায় যে পুরো ব্যপারটাই হুইমজিকল ছিল?
না, সেটা ছিল না। একটা সংকল্প ছিল। দেশ থেকে ইংরেজ বিতাড়নের একটা প্রত্যয় ছিল। আর সেটা সম্পূর্ণভাবে সম্ভব না হলেও ওই আক্রমণটা ইংরেজদের ভিত নাড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিধরনের হুমকি, যে অত সহজে এদেশ আঁকড়ে বসে থাকা যাবে না। সাম্রাজ্যবাদের পতন অনিবার্য। ওরকম কিছু একটা করতে হবে।
তার মানে সরকারের অস্ত্রাগার লুট?
না, সেটা এখনই সম্ভব না আমাদের পক্ষে।
আসলে কি জানিস ছফা, এই বাড়িটা ভাড়া নেয়াই আমাদের জন্য ভুল হয়েছে এই বাড়ির– মানে বাড়িটা তো বিপ্লবী লোকনাথ বলের। তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রগার লুটের একজন প্রধান হোতা। তো ওনার ভূতটা এখন তোর মাথায় চড়েছে।
ভূত না হয় আমার মাথায় চড়েছে। তোদের মাথায় তো চড়ে নাই। তা বলে এই বাড়িটা কি তোদের পছন্দ হয় নাই? শত হলেও তিনি এখানকার মেয়র ছিলেন। এরকম দোতলা মাটির বাড়ি পাবি কোথায়? আর তাছাড়া এটা লোকনাথ বলের বাড়ি। এখানে থাকতে পারাটাও তো এক বিশেষ ভাগ্য। হ্যাঁ, ভাগ্যই বটে, শুধু যদি ওই ভূতটা চড়াও না হতো।
না ভূত না আমি সিরিয়াস।
কি ব্যাপারে?
আমরা যে বিপ্লব করছি। কি জন্য করছি, কেন করছি এটা সরকারকে জানান দিতে হবে।
ওরা জানে না মনে করেছিস?
জানে কিন্তু ওদের তৎপরতা কই? মনে হয় যেন ঘুমিয়ে আছে।
কি করে জাগাবি?
জাগাতে হবে। শোন আমরা চট্টগ্রামের এই অঞ্চল স্বাধীন করব। আমাদের বাস যেহেতু কর্ণফুলির এই পাড়ে। তাই এটা অনেক সহজ হবে।
এ আবার কেমন স্বাধীন!
মানে সাময়িকভাবে একটা ঝাঁকুনি দেয়া আর কি। আমরা যদি রেললাইন উপড়ে ফেলি তাহলে ওপার থেকে এপারে ট্রেন আসতে পারবে না সুতরাং বন্দর অচল হয়ে পড়বে, তখনই সরকারের টনক নড়বে। –সত্যি? বিপ্লবটা এতো সহজ অথচ আমরা এখনো ঝিমোচ্ছি কেন?
লেনিন কি বলেছেন? ‘লক্ষ লক্ষ লোক বিপ্লবের এক সপ্তাহে যা শেখেন, অন্য সময়ে অনেক বৎসরেও তা শিখতে পারেন না।’
বিপ্লবের সূত্রপাতটা করে একটা ঝাঁকুনি দিতে হবে। শুধু বক্তৃতা করে বেড়ালেই বিপ্লব হবে না। কিছু রিয়েল লাইফ থ্রেট দিতে হবে। বুঝলি?
যেই ভাবনা সেই কাজ। পরদিনই ট্রেনলাইনের কিছুটা অংশ উপড়ে ফেলা হলো। তবে এর পরিণতি যে এতোটা ভয়াবহ হবে ওদের ধারণা ছিল না।
পরদিনই গোটা স্যার অশুতোষ কলেজ প্রায় পাঁচ-ছয়শো মিলিটারি এসে ঘেরাও করে ফেলল। ভাগ্য ভাল তারা তখন কেউ কলেজে ছিল না। গোটা চট্টগ্রাম জুড়ে মিলিটারির তাণ্ডব শুরু হলো। বাড়ি ঘর আস্তানা ছেড়ে যে যার মতো মিলিটারির ভয়ে ছুটছে। ছফার বন্ধুরা বেশির ভাগই বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে। ছফার হয়েছে বিপদ। ইন্ডিয়ায় সে কিছু চেনে না। তাছাড়া কলকাতা তাকে সেভাবে টানে না কখনো। কলকাতা তখনো তার কাছে একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশ। তার চেয়ে বরং বার্মা অনেক কাছের মনে হয়। পরিচিত অনেকেই সেখানে যায় প্রতিনিয়ত নানা কাজের উসিলায়। বার্মা নিয়ে লোকমুখে একটা গানও প্রচলিত আছে।
‘রেঙ্গুন রঙ্গিলা রে
রেঙ্গুনেরো বার্মার মাইয়া কত ঠমক জানে
চুলের আগাত ফুলের কলি ইশারাতে টানে।’
কিন্তু বার্মা সেখানেইবা সে যাবে কীভাবে। তার কাছে টাকা পয়সা বিশেষ নেই। বলতে গেলে কিছুই নেই। এভাবে বিদেশে চলে যাওয়া যায় না। অন্যদিকে বাড়ি যাওয়ারও কোনো উপায় নেই। অগত্যা সে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে যাবে ঠিক করল।
পাহাড়ে যাওয়ার ইচ্ছা তার দীর্ঘদিন ধরে ছিল কিন্তু যাওয়া হয়নি কখনো। তাঁদের এক পূর্ব পুরুষ আজিজ ফকির পাহাড়ে ছিল যাঁর বাস সেই তাঁর প্রতি এক ধরনের কৌতুহলেও কতবার যেতে চেয়েছে–কিন্তু যাওয়া হয় নি। কীভাবে একজন মানুষ সব ছেড়েছুড়ে পাহাড়ে কাটাতে পারে জানার ইচ্ছা ছিল খুব। তবে একবার শুধু গিয়েছিল তার নানার কবরের কাছে সেই ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর। তখন ছিল রমজান মাস। তার ওপরে বর্ষাকাল। হঠাৎ একদিন খেয়াল হলো, তাদের বাড়ির উত্তর দিক থেকে প্রায় এক কিলোমিটার গেলে হামিদ তালুকদারের যে মসজিদ– যেখানে যেতে সবাই ভয় পায়। রাতের বেলাতো দূরে থাকুক দিনের বেলাতেও কেউ যেতে চায় না। একে তো পাহাড় পার হয়ে যেতে হয় তার ওপরে ওখানে ওই মসজিদের পাশে রয়েছে বিশাল কবরস্থান। কবরস্থানটা যথেষ্ট প্রাচীন এবং ঝোপ জঙ্গলে ভরা। অনেকেই মনে করে ওখানে বাঘ লুকিয়ে থাকে। আর ওই কবরস্থান যে জ্বীন পরির আস্তানা সে বিষয়ে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ছফার নানাজানকেও কবর দেয়া হয়েছে ওখানে। কিন্তু কখনো যাওয়া হয়নি সেই কবর জিয়ারত করতে। ছফার হঠাৎ খেয়াল চাপল যেতে হবে সেখানে এবং সেই দিনই। নানাজান তার দরবেশ ধরনের মানুষ ছিলেন। পরীক্ষার রেজাল্টের আগে তাঁর কবর জিয়ারত করতে হবে। তার জন্য ওই মসজিদে বসে কোরআন পাঠও করতে হবে। তবেই না তার রেজাল্ট ভাল হবে। তবে এগুলো হলো সব অজুহাতের কথা। আব্বাজান যদি জানতে চান তখন তাকে এসব বলে বোঝাতে হবে। ছফার উদ্দেশ্য ভিন্ন। আসলে গভীর রাতে ওখানে গিয়ে দেখতে হবে আদৌ সেখানে কোনো ভূত বা জ্বীন-পরি আছে কি না!
ছফা পাহাড় ডিঙ্গিয়ে যখন মসজিদে এসে পৌঁছেছে তখন গভীর রাত। এতোক্ষণ চারদিকে জ্যেৎস্নার আলো থাকলেও মসজিদে পৌঁছামাত্র চাঁদটা হঠাৎ করে মেঘের নিচে গা ঢাকা দিল। চারদিক তখন ঘুট ঘুটে অন্ধাকার। কিছুই আঁচ করা যাচ্ছে না। পকেট থেকে দেয়াশলাইটা বের করল ছফা। মসজিদে নিশ্চয়ই কেরাসিনের কুপি বাতি বা মোম আছে। দেয়াশলাই জ্বেলে সে সব খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু দেয়াশলাইটা পকেট থেকে বের করা মাত্র কোথা থেকে যেন দমকা বাতাস বইতে শুরু করল আচমকা। সেই বাতাসে কিছুতেই ম্যাচ জ্বালানো যাচ্ছিল না। মসজিদের তিন দিকে জানালা। সেই দিক থেকে ঝড়ের বেগে আসছে বাতাস। আর সেই সাথে বৃষ্টি। ছফা কোনো মতে নিজেকে মসজিদের এক কোণে সরিয়ে নিয়ে গেল। আর একটু হলেই ঝড়ের বাতাসে উড়ে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ মসজিদের দেয়াল থেকে পলেস্তরা খসে পড়ল তার পায়ের ওপর। অন্য যে কেউ হলে একে ভূতের কাণ্ড মনে করত কিন্তু ছফা একে একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাইরে আর কিছুই ভাবতে পারল না। কিন্তু ছফা যতই ভাবছে এখানে কোনো অতি প্রাকৃত শক্তির খেলা নেই ততই তার চারপাশে ঝুপ ঝাপ পলেস্তারা খসে পড়ার শব্দ। কিছু তার পায়ের ওপরও পড়ল। ক্রমে বাতাসের গতি বাড়ছে। ছফার পক্ষে ওই খোলা মসজিদের মধ্যে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আবার ছুটে যে বাইরে যাবে সে উপায় ও নেই, বাইরে তুমুল বৃষ্টি। কিন্তু ভেতরে যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে ওখানে থাকাটা মোটেই নিরাপদ নয়। নিজেকে সে আর স্থির রাখতে পারছিল না। তাই ওই তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই সে মসজিদ থেকে বাইরে বের হয়ে এলো। পাহাড়ী ঢলে বরইগুনি নদীর দু’পাড় তখন ডুবে যাবার মতো অবস্থা। ভেতরে বাইরে কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই। অগত্যা কোনো উপায় না দেখে ছফা প্রাণরক্ষার্থে ওই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই বরইগুনিই হলো তার এখন একমাত্র আশ্রয়। সারাবছর যেমন এই নদী তার তিরতির-করা স্রোতধারা নিয়ে মায়ের মমতার চলে পেঁচিয়ে থাকে লোকালয়গুলোকে। মেটায় তাদের তৃষ্ণা। আজ বরইগুনির কাছে নিজেকে সমর্পণ করল ছফা সেই নির্ভরতার যে তাকে নিরাপদে পৌঁছে দেবে তার বাড়িতে। তারপর স্রোতের অনুকূলে ভাসতে ভাসতে ছফা এক সময় পৌঁছে যায় তার বাড়ির ঘাটে।
কিন্তু বাড়ি পৌঁছে হলো আরেক জ্বালা। রোজার সময় সেহরি খেতে উঠে ছফার খোঁজ পড়ল, কোথায় গেল সে? রাতভর সে ছিলই বা কোথায়! ও দিকে ছফা তখন আপাদমস্তক ভেজা। এই অবস্থায় আব্বার সামনে পড়লে খবর আছে। তাই সে গোলাঘরের পেছনে লুকিয়ে পড়ল। ওদিকে সেহরির সময় শেষ হয়ে আসছে। সবাই তখন খানাপিনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কোন দিকে কি ঘটছে সে দিকে কারো খেয়াল নেই। আর সেই মূহূর্তে ছফার মাথায় এক দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল। কেউ যেন টের না পায় সেভাবে বিড়ালের মতো ধীর পায়ে ঘরে ঢুকল সে। এবং আরো সন্তর্পণে সিন্দুক খুলে ফেলল। ভেবেছিল ওখান থেকে কিছু টাকা নিয়ে সে চট্টগ্রাম পাড়ি দেবে। পরীক্ষা শেষ বাড়িতে কোনো কাজ নেই। কোথাও বেড়ানোরও নেই। তাই সে ঠিক করল চট্টগ্রামে তার হোস্টেলের বন্ধুদের বাড়ি বেড়াতে যাবে। কিন্তু সিন্দুক খুলে দেখল কোনো টাকা নেই সেখানে। থাকার কথাও না। বাবা ক্রমশ বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন আর তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও সঙ্গিন হচ্ছে। কিন্তু ছফার সেদিকে খেয়াল নেই। অগত্যা সে সিন্দুকে টাকা না পেয়ে ভেতরে পড়ে থাকা একটা সোনার মোহর তুলে নিল। ওটাই ছিল ওই সিন্দুকের একমাত্র সম্বল। আর সেটা নিয়েই পরদিন ভোরবেলা ঘর ছাড়ল সে।
মোহর বিক্রি করলেও হাতে টাকা পয়সা যথেষ্ট নেই কারণ বানিয়া বেটা তাকে ঠকিয়েছে। সোনার যথাযথ দাম দেয়নি। হাতের কাছে যা ছিল তাই তাকে দিয়েছে। কিন্তু তাতেও ছফা খুশি। অবশেষে সে তো বেড়াতে যেতে পারছে!
কিন্তু চট্টগ্রামে বন্ধুর বাড়িতে দু’দিন থেকে ফেরার পথে বাধল এক বিপত্তি। ছফা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর পিছু পিছু তাকে অনুসরণ করে হাঁটছে ১২/১৩ বছর বয়সী একটা ছেলে। ছফা শুরুতে খেয়াল করেনি, ভেবেছিল এমনি পথচারি কিন্তু সে হঠাৎ সিগারেট কিনতে রাস্তার পাশে মুদি দোকানে দাঁড়ালে ছেলেটাও দাঁড়িয়ে পড়ল। সে সিগারেট কিনল, ধরাল ততক্ষণই ছেলেটা দাড়িয়ে রইল। ছফা হাঁটা শুরু করলে সেও পিছু পিছু হাঁটছে। ছফা কিছুতেই বুঝতে পারছে না ছেলেটা তাকে ফলো করছে কেন? সে বিশেষ কোনো মানুষ না যে তাকে কেউ ফলো করতে পারে। ছেলেটার উদ্দেশ্য কী! ছফা ঘুরে দাড়ালে ছেলেটাও দাড়িয়ে পড়ল। কাচুমাচু ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ছফা অনেকটা ধমকের ভঙ্গিতে জানতে চাইল, কিরে, ব্যাপার কি? তুই আমার পিছু নিয়েছিস কেন? তুই কে?
ছেলেটা এই কথার কোনো জবাব না দিয়ে ছুটে এসে তার পা জড়িয়ে ধরে শুরু করে দিল কান্না।
ঘটনার আকস্মিকতায় ছফা যারপরনাই অবাক হলো। এ কিরে বাবা! বলা নেই, কওয়া নেই এই ছেলে তার পা ধরে কান্না জুড়ে দিয়েছে কেন? আরে, ছাড় ছাড়। কে তুই? কাঁদছিস কেন?
আমারে আপনি বাঁচান ভাই। আমি দুইদিন ধইরা কিছু খাই নাই..।
ছেলেটা যা বলল তার সারমর্ম হলো, সে খুবই অসহায় অবস্থার মধ্যে আছে। তাকে যে করে হোক একটা কাজ জুটিয়ে দিতে হবে।
ছফা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। দেশে এতো মানুষ থাকতে এই ছেলে তার মধ্যে কী এমন দেখল যে তার পা জড়িয়ে ধরল। সে তো খুব বড়সড় কোনো মানুষ না যে তার পকেটে অনেক টাকা থাকবে। আর এই নগরীতে সে এই ছেলেকে কাজই বা পাইয়ে দেবে কোত্থেকে?
কিন্তু ছেলেটার কান্নাকাটি দেখে ছফার মায়া পড়ে গেছে সে তাকে ফেলে যেতেও পারছে না। অগত্যা সে ছেলেটাকে তার এক পরিচিত রেষ্টুরেন্টে নিয়ে গেল। সেখানে তাকে ভরপেট খাওয়ানোর পর তাকে চলে যেতে বললে, ছেলেটা যাচ্ছে না। সে কিছুতেই ছফার পিছু ছাড়েনা। ছফা এবার মহা বিরক্ত হয়ে বলে, তুই আমার পিছে পিছে আসছিস কেন? তুই যাচ্ছিস কোথায়?
ছেলেটি সহজ ভঙ্গিতে জবাব দিল আপনি যেইখানে যান সেইখানে।
মহা জ্বালা তো! আমি তো গ্রামে যাব। সেখানে আমার বাড়ি, কিন্তু তোকে কোথায় নিয়ে যাব বলতো? যাবি গ্রামে?
ছেলেটা মুখ গম্ভীর করে বলে, না; গেরামে যামু না, আমার এইহানে থাকন লাগব। আপনি দয়া কইরা আমারে এইহানে একটা কাজ জুটাইয়া দেন। ছেলেটা আবারো ছফার পা ধরে ঝুলে পড়ে।
আচ্ছা ঝামেলা হলো তো! ওদিকে ছেলেটার জন্য তার মায়াও হচ্ছে। কিন্তু তুই গ্রামে যেতে চাচ্ছিস না কেন? শহরে তোর মজাটা কি? সেখানে গেলে তো তুই থাকা খাওয়া সব পেতিস।
গেরামে যাওনে একটু অসুবিধা আছে।
কি অসুবিধা বলা যায় না?
যায়, যাইব না কেন। আমরা আসছিলাম বহুত দূর থাইকা, কামের সন্ধানে এই খানে। ওই দিন রাইতে ট্রেনের একটা বগির মইধ্যে ঘুমাইছি মা-বাবা আর আমি সকালে উইটা দেহি বাবা মায়ে নাই। অচেনা একটা বগির মইধ্যে আমি একলা পইড়া রইছি। ছফা বুঝতে পারল। ছেলেটা ঘুমন্ত অবস্থায় ওর বাবা-মা হয়ত নিচে নেমেছিল কোনো কাজে সেই ফাঁকে ট্রেনের ইঞ্জিনের সাথে ওই বগি জুড়ে চলে গেছে অন্যস্থানে। ছেলেটা তো সত্যিই ভীষণ বিপদে পড়েছে। ওর এখন ওর বাবা-মাকে খুঁজে বের করতে হবে। একই সাথে নিজেকেও বেঁচে থাকতে হবে। এতোটুকুন একটা বাচ্চা ছেলের মাথার ওপর এতো বড় একটা বিপদ! একে তো যে ভাবেই হোক একটা কাজ জুটিয়ে দিতে হবে।
ছফা আবার ফিরে গেল ওই রেস্টুরেন্টে। চট্টগ্রামে সে এখন পর্যন্ত শুধু ওই রেস্টুরেন্ট মালিককেই চেনে যে এই ছেলেটাকে একটা কাজ দিতে পারে।
ছফাকে ফের রেস্টুরেন্টে ফিরতে দেখে রেস্টুরেন্ট মালিক গোলাম আলী জিজ্ঞেস করল, কি ছফা মিঞা ফের কিছু খাইবা?
না আপনার সাথে একটা জরুরী কথা ছিল।
কি কথা?
আগে বলেন কথাটা রাখবেন!
কি কথা শুনিই-না আগে।
ছফা ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, এই ছেলেটাকে আপনার হোটেলে একটা কাজ দিতে হবে। ও খুব বিপদের মধ্যে পড়েছে।
কিন্তু অরে তো আমি চিনি না, ওরে কি ভাবে কাজ দেই!
ও আমার পরিচিত আপনি কাজ দিয়া দেখেন, কোনো অসুবিধা হবে না ইনশাল্লাহ।
তুমি তো বইলা খালাস। কিন্তু ও যদি কোনো ক্ষতি খারাজ করে! বা এমনো তো হইতে পারে চুরি মারা কিছু করল। আইজ কাইল কাউরে বিশ্বাস নাই।
না আলী ভাই বেচারা সত্যিই বিপদে পড়েছে। ও অমন কিছু করবে না। আর করলে সে জন্য আমি দায়ী থাকব। আপনি তো আমাকে চেনেনই।
ঠিক আছে তুমি যখন কইতাছ তখন ভাইবা দেখি।
না, ভাবলে হবে না, এখুনি কথা দিতে হবে।
কিন্তু ও কি কাজ টাজ কিছু পারে?
ছফা কিছু বলার আগেই ছেলেটি বলল, হ পারমু।
ওকে একটু থাকারও জায়গা দিতে হবে আলী ভাই। ছেলেটার থাকার জায়গা নাই।
থাকার জায়গা কোত্থেকে দিমু?
এই আপনার রেষ্টুরেন্টের এক কোনায় শুইয়া থাকমু। বলল ছেলেটা।
মালিক গোলাম আলী একটু দোনোমোনো করলেও রাজি হয়ে গেল। কারণ রাতে তাররেস্টুরেন্টে আরো দুজন বেয়ারা ঘুমায়, তাদের সাথে সে ও না হয় থাকল। ছফা ছেলেটাকে কাজে ভর্তি করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমি এখন যাই রে কাল আসব। তখন দেখা হবে।
পরদিন সকালে ছফা নাস্তা করতে রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখল সর্বনাশ হয়ে গেছে। ওই ছেলে রাতের বেলা ক্যাশবাক্স ভেঙ্গে টাকা চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে। ছফা বুঝতে পারল ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সবাই তার দিকে কেমন এক নিষ্ঠুর চোখে তাকাচ্ছে। যার অর্থ সে বুঝতে পারছে, আবার তার অবচেতন মন বলছে কিছুই হবে না।
হোটেল মালিক তাকে কড়া ভাষায় জিজ্ঞেস করল, ভাল মানুষেরা বেটা জানতাম, তয় এ চোর পোষার ব্যবসা কবে হইতে শুরু করলা?
আপনি এসব কি বলছেন! আমি চোর পুষতে যাব কেন? ছেলেটা আমাকে বিপদে পড়ে কাজ চাইল তাই!
আর তাই আইন্যা আমার ঘাড়ে তুইল্যা দিলা? ঠিক আছে তুইল্যা যখন দিছ আমিও পুলিশে খবর দিছি পুলিশ আসুক, পেটের ভিতর থিকা সব কথা বাইর হইয়্যা যাইব তখন।
বলেন কি আপনি! এই সামান্য কয়টা টাকার জন্য আপনি পুলিশে খবর দিয়েছেন?
তুমি বড় লোকের পোলা, তোমার কাছে টাকা সামান্য হইতে পারে আমার কাছে না।
ঠিক আছে আমি আপনার টাকা দিয়ে দেব।
এই তো লাইনে আসছ, টাকা দিয়া দিলে তো আর কোনো সমস্যাই থাকে না। থানাপুলিশও করতে হয় না।
ছফা ততক্ষণে তার পকেটে যত টাকা ছিল সব বের করে আনল। কিন্তু টাকার পরিমাণ দেখে তার জিভ শুকিয়ে গেল । এ টাকায় তো হবে না!
অগত্যা তাকে জেলে যেতে হলো।
সেবার জেলে তাকে পনের দিন থাকতে হয়েছিল। ছফাদের গ্রাম দেশের পরিচিত উকিল সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছেলের এই বিপদে পড়ার কথা ছফার বাবাকে জানালে তিনি গিয়ে তাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন।
ছফা মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত ছিল বলাই বাহুল্য, কারণ না বলে সিন্দুক থেকে মোহর নিয়ে আসার শাস্তি তাকে এভাবে পেতে হয়েছিল বলে তার ধারণা। কিন্তু এবার পুলিশ আবার তার পিছু লেগেছে। এবারে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা। পুলিশে ধরলে অত সহজে নিস্তার নেই। আর পনের দিনের জেল জীবনে সে জেনে এসেছে জেল হলো পৃথিবীর হাবিয়া দোজখ। সে আর দ্বিতীয়বার ওখানে যেতে চায় না। তাকে পালাতে হবে। পালিয়ে যেতে হবে দূরে বহু দূরে। আর ওই পার্বত্য অঞ্চলই হলো সেই উত্তম জায়গা।