গীতি ১১.
কোন-বা জাতির জাতক তুমি, কোন-বা প্রাণের প্রাণী
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ।।
কোন-বা জলের জলজ আহা কোন ঝরনায় বাস
কোন অম্লজানের হাওয়ায় নিচ্ছ তুমি শ্বাস
কোন ঝরনার জলে শোধন সারাদিনের গ্লানি
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ।।
কোন ঘটনার অনুঘটক, কোন জারণের জারক
কোন উল্কার গতি তুমি, কোন কৃত্যের কারক?
উল্কারূপে আকাশ-মাটির মধুর কানাকানি
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ।।
ভাব-উচাটন পুরুষ হলে প্রকৃতিস্থ হও।
কিংবা যদি হও প্রকৃতি, পুরুষরত রও।
জীব-পরমে পরস্পরে গভীর জানাজানি
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ।।
কোন ধর্মের ধর্মী ওহে, কোন-বা রূপের রূপী,
রূপ থেকে রূপ-রূপান্তরে ফিরছ চুপিচুপি।
জড় থেকেই জীবে আসো, শিব থেকে শিবানী
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ।।
জন্মান্তর ঘুরে আসি তোমায় দেখার ছলে,
কোন রূপে ফের আকার পেলে? কোন মন্ত্রবলে?
আকার থেকে নিরাকারে, প্রাণ থেকে ফের প্রাণী…
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ।।
কোন মেঘেদের বিজলি তুমি, কোন-সে কুলের কেতু,
কেমন করে তুলব গড়ে যোগাযোগের সেতু?
মাঝে-মাঝে ঝলকে ওঠো হঠাৎ-ঝলকানি
মাঝে-মাঝে পাঠাও তুমি হঠাৎ-হাতছানি
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি ।।
গীতি ১২.
দই পাততে লাগে দইয়ের বীজ
একই মাটি ফলায় তেঁতুল, মধু ও মরিচ ।।
বীজের গুণে একেক গাছে একেক ফল ধরে
ধুতরা ফুলেও মধু থাকে, জানে মধুকরে।
ময়লা জলেও জন্মে কেমন রঙিন সরসিজ!
একই মাটি ফলায় তেঁতুল, মধু ও মরিচ ।।
ফণিমনসায় কাঁটার ফণা, তারই ফাঁকে ফুল
কাঁটার সাথে পুষ্পমিথুন, ভুলে-ভরা মূল।
কাঁটায় কেমন আগলে রাখে ফুলকে অহর্নিশ
একই মাটি ফলায় তেঁতুল, মধু ও মরিচ ।।
মাটির গুণে একেক গাছে একেক ফল ধরে
মাটির টানেই সে-ফল সাধু ফের মাটিতে ঝরে।
কালোয় থেকেও আলো ছড়ায় কোন খনির খনিজ!
একই মাটি ফলায় তেঁতুল, মধু ও মরিচ ।।
গীতি ১৩.
বদলে-যাওয়া দিনে ঝড়বাদলের ক্ষণে
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ।।
বহু বছর আগে গোলকগাঁয়ের বাঁকে
চোখধাঁধানো আলোকধাঁধায় হারিয়ে ফেলি তাকে।
অনেক কাল ধ’রে খুঁজে ফিরছি, ওরে
ভুবনগাঁয়ের মেলা, বাজার, আড়ত, গুদামঘরে।
তোমায় ফেলে গেলাম চ’লে কোন-বা কুলক্ষণে!
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ।।
বহু সময় ধ’রে সওদাপাতি ক’রে
ফিরে এসে পাই না খুঁজে, বিকল লণ্ঠনে…
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ।।
উদ্ভ্রান্ত স্বরে হাহাকার ক’রে
শুধাই আমি জনে জনে, শুধাই মহাজনে।
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ।।
খুঁজে ফিরছি রোজ, কিন্তু তোমার খোঁজ
কেউই দিতে পারছে না এ বেঘোর বরিষণে।
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ।।
আমি তবু ছাড়ছি না হাল
সময় যতই বেতাল-মাতাল হোক না ঝড়ের তোড়ে
খোঁজার ব্রত, খুঁজেই যাব
খুঁজে একদিন ঠিকই পাব প্রবল মনের জোরে।
মগ্ন থাকি নিরন্তর তোমার অণ্বেষণে।
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ।।
অন্য সবাই ভোলে ভুলুক
কিংবা খুঁজে পাক বা না পাক
কিংবা তোমার নামে ছড়াক কালি-কেলেঙ্কারি
যার যা খুশি ভাবে ভাবুক
কিংবা কেউই নিক বা না নিক
আমিই তোমায় ধীরে ধীরে ফিরিয়ে নেব বাড়ি।
ফিরিয়ে আমি নেবই তোমায় আপন সে-ভুবনে।
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে ।।
গীতি ১৪.
ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা
ঢেউপাগলি নদীটা তাই আজন্ম চঞ্চলা ।।
ডাঙার বুকে ঢেউয়ের মরণ স্বেচ্ছা-সমর্পণ
স্মরণকালের সর্বমহৎ আত্মবিলোপন
কেউ কখনো দেখেছে কি কালে কালান্তরে?
লুপ্ত ঢেউয়ের কিছু স্মারক ডাঙায় রাখে ধ’রে।
ডাঙার গন্ধে পাগল-পাগল প্রচণ্ড উচ্ছলা
ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা ।।
ডাঙার দেহে ঢেউ-স্মারকের প্রতীকগুলোর মানে
হচ্ছে লেখা ডাঙা-নদীর প্রেমের উপাখ্যানে।
প্রেম বাড়ে, প্রতীক বাড়ে, বাড়ে চন্দ্রকলা
ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা ।।
ডাঙাটা তো জন্মবোকা, ভোলাভালা, হাবা
নদীটা কি তার কারণেই তরঙ্গ-স্বভাবা?
পূর্ণিমাতে জোয়ার-লাগা নদী রজঃস্বলা
ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা ।।
ওই তো আবার ডাকছে ডাঙা নদীমোহন স্বরে
আধো-আধো নেশায় নদী ফের ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ডাঙার গন্ধে উন্মাদিনী সদাই হরবোলা।
ঢেউয়ের স্বভাব ঢেউয়ের মতো অধিক কথা বলা ।।
গীতি ১৫.
মন না রাঙায়ে যোগী রাঙালি বসন
ভেতর না সাজায়ে তুই সাজালি ভূষণ ।।
জানি না তোর ধর্মধরন
বুঝি না তোর কর্মকরণ
কেমন করে জানব ওরে কেমন যে তোর অন্তকরণ!
মন না রাঙায়ে যোগী রাঙালি বসন ।।
না যদি তুই জ্বালাস আলো
আঁধারে সব অগোছালো
হয়ে যাবে এলোমেলো তোর যত সব সাধের সাধন
মন না রাঙায়ে যোগী রাঙালি বসন ।।
চোখ যাবে তোর যথা-তথা
কান শুনবে ভিন্ন কথা
কেমনে করে হবে তোর এ চোখ ও কানের বিবাদ-মোচন!
মন না রাঙায়ে যোগী রাঙালি বসন ।।