বর্ণালি সাহা
*
“ভাইয়া, ভাইয়া…দেখো পেয়ারাটা কামড় দিলে ভিতরে লাল দেখা যায়!”
আমি দেখলাম সত্যি পেয়ারার ভিতরটা কেমন কা-কা করতে থাকা কাকের হাঁ-করা লাল টাগ্রার মত।
“পেয়ারা কে দিসে? এহ! কেমন একটা পাকা কৎকতা পেয়ারা! এইটা আনছিস ক্যান্? তোর কি হরমুজের মা’র মত সব দাঁত পড়ে গেসে? আরেকটু কচকচা পাস নাই?”
“দাদাজান দিসে। কোচিংএর কে জানি আনসে। ওদের গাছের নাকি!”
“ইস্! কৎকতা! ভ্যাদ্ভেদা! আমি খাব না। তুই খা!”
“তোমাকে আম্মা বলসে না আমাকে তুই-তুই করে না ডাকতে?”
“ছোটদেরকে তুই করে ডাকা যায়। আমি বড় না? দেখিস নাই লিমন ভাইয়া বড় দেখে আমাকে তুই-তুই করে ডাকে?” লিমন আমার বড় চাচার ছেলে।
“তো আমি কাকে তুই-তুই করে ডাকব?”
“কাউকে না! তুই সবচেয়ে ছোট।”
“ইস্! তোমার ছোট বোন থাকবে; তুমি ইচ্ছামত তুই-তুই করে ডাকবা; আর আমার ছোট কেউ কেন থাকবে না? কেন কেন কেন?”
“কেঙ-উ? কেঙ-উ? কেঙ-উ?” আমি ভেংচাই নিজের মুখের নকশা মুচড়ে, “তোর ছোট আর কেউ থাকবে না। দুই সন্তানের বেশি হওয়া নিষেধ। টিভিতে বলসে।”
“তুমি আমার সাথে এরকম কর্সো! আমি দাদাজানকে বলে দিব!” মুমুর মুখ ঠিক কান্নার আগের তিন-বেঁকা চেহারাটা ধরে।
“তুই ‘দাদা’ না বলে ‘দাদাজান’ বলতেসিস। আমি আম্মাকে বলে দিব। যাঃ! ভাগ্!”
এটাই প্যাঁচ। দাদাজানকে ‘দাদাজান’ ডাকলে দাদাজান খুশি হন। আর আম্মা খুশি হয় ‘দাদা’ ডাকলে। দাদাজান অবশ্য কখনো বলতে আসেন নাই আম্মাকে কী ডাকলে উনি খুশি হন। আমি আম্মার সামনে দাদাজানকে ‘দাদা’ ডাকি। মুমু আম্মার সামনে দাদাজানকে কিছু ডাকে না। সময়-বুঝে ভেক পাল্টাতে মনে হয় ওর লজ্জা লাগে।
আমি বুঝতে পারি। তখনো বুঝতে পারতাম।
পরিস্থিতি মেপে এক-মানুষকে দুই-নামে ডাকার কাজ মুমুকে দিয়ে হয় না। আমি জানি মুমুর কেমন কুণ্ঠা আর অস্বস্তি হয় এই ক্ষুদে ঘটনাক্রমের সাক্ষী হতে—
১। দাদাজানের সামনে আম্মা পড়ে গেছে দেখে দাদাজানকে ‘দাদা’ ডাকা হচ্ছে;
২। কেন এই ডাকের বদল, সেটা আবার দাদাজান পরিষ্কার বুঝতেও পারছেন;
৩। আর প্রশ্রয়ে ক্ষমা করে দিচ্ছেন।
মুমুর এসব আলটপকা ক্ষমা পেতে ভাল লাগে না; আরো ভাল লাগে না যেসব ছোটখাট নির্দোষ ভণ্ডামির বিনিময়ে এসব আলটপকা ক্ষমা জুটত, সেসব। মুমুর মধ্যে খানিকটা পাক-পরিষ্কার সততা আছে। আমি অত সৎ না। কেন সৎ না, সেটাও জানি। সৎ থাকার চেয়ে অনেক আরামের হচ্ছে সহজ-সরল থাকা। আর সহজ-সরল থাকার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে দুনিয়ার সহজ নিয়মে বয়ে চলা— অর্থাৎ নিয়মমাফিক ভণ্ডামি করা। “পৃথিবীর সব সহজ-সহজ দুই-নম্বরি হিসাবকে সততার স্বার্থে পেঁচিয়ে কষতেই হবে” —এই এক-নম্বরি গোঁয়ার্তুমি না থাকলে সৎ থাকা যায় না। উত্তর-দক্ষিণে সামান্য চাপা, পেটমোটা কমলালেবুর মত সহজ পৃথিবীটাতে সূক্ষ্ম-জটিল-তিরতিরে-কাতর অনুভূতি না থাকলে সৎ হওয়াই যায় না।
সূক্ষ্ম-জটিল-কাতর অনুভূতি আমার পোষায় না কখনোই। ভাবলেই আড়মোড়া লেগে ঘুম পায়। গোঁয়ার আহাম্মক মুমুটার মত পেঁচিয়ে ভেবে জীবনটাকে অযথা জটিল করে স্বখাত-ঘোলাপানির-পুকুরে স্বচ্ছ বাতাসি মাছ হওয়ার অর্থ কী?
তাই আমি ছিলাম ঘাগু-বিন্দাস; আর মুমু ছিল ঘাউড়া-টিঙটিঙা। আম্মার চড়-চাপড়টা জোটে শুধু ওর বরাতে।
আমাদের আব্বার আব্বাকে সম্বোধনের প্রশ্নে আমি হুকুমবরদারের কায়দায় ‘জান’ শব্দাংশের বহুল-ব্যবহাররোধে আম্মার জারিকৃত ফরমান প্রয়োগের হুমকি দেওয়ায় মুমু স্তব্ধ হয়ে যায়। আমার কাছ থেকে এমন নিষ্ঠুরতা পেলে দাদাজানের আদরের নাতনির কান্নাও আসে না। শুধু বড় করে শ্বাস পড়ে। হাতের ভ্যাদভেদা পেয়ারাটা চুপ্সে পড়ে থাকে বারান্দার নাইন-ও-ক্লক ফুলের টবের পাশে। মুমুর কামড়ে খাওয়া লাল গহ্বরটা হাবাগোবার মত হাঁ করে চেয়ে থাকে আমার দিকে।
মাঝেমাঝে মুমুকে আমার অসহ্য লাগে। ওরও লাগে নিশ্চয়ই আমাকে। আমাদের একের পছন্দ-অপছন্দগুলোও অন্যের কাছে প্রায়ই অসহ্য। যেমন—আমার অসহ্য লাগে কৎকতা পেয়ারা; ভাল লাগে কচকচা পেয়ারা। মুমুর পুরো উল্টা। আমরা কথাও বলি আলাদা সুরে— আমি চালাই আকাট-স্বাভাবিক ‘করসি-খাইসি’; আর মুমু ওর কথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় টিভি-বই-দাদাজানের থেকে পাওয়া সুর আর বাণীর ভাণ্ডার। যেমন—আমি হলে যেটাকে বলি “আমার আমসত্ত খাইতে ইচ্ছা করতেসে”, মুমু সেটাকে বলে “আমার আমসত্ত খেতে ইচ্ছে করছে”। “ইচ্ছা”র জায়গায় “ইচ্ছে” শুনলেই আমার গা গুলায় খুব। মনে হয় যেন পুরু-সর-ভাসা এক গ্লাস ঠাণ্ডা দুধ খাচ্ছি। কোথা থেকে একদিন মুমু শিখে এল যে মিষ্টি আলুকে ফারসিতে বলে শকরকন্দ। শব্দটা শুনেই আমার এমন গা গুলিয়ে পিত্ত মোচড় দিল, মিষ্টি আলুর ধার দিয়ে যেতে পারি নি আর কোনো দিন।
তারপরও আমি আর মুমু অনেককিছুই ভাগাভাগি করে ভোগ করি। মহানন্দে। নিশ্চিন্তে। চিলখিল-চিলখিল যুগ্ম হাসিতে ব্যালকনি মাতিয়ে। তেমন করেই ভোগ করেছি দাদাজানের কাছ থেকে পাওয়া স্কেটবোর্ডটা।
*
দাদাজান জনাব মাহবুবর রহমান (বি.এ., বি.টি.) সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। বিপত্নীক মানুষ; সরকারি ইস্কুলের হেডমাস্টার; উস্তা-চিরতা-আদা-তুলসি-মর্নিংওয়াকের কড়া তেতো-ঝাঁঝালো রুটিনের জীবন; অঙ্ক আর ইংরেজির কোচিং করতে ছেলেরা আসে বাড়িতে। দিনমান বাসায় ফুলপ্যান্ট পরা বড়সড় ভাইয়াদের আনাগোনা লেগে থাকে। আমাকে ওদের কতটা পছন্দ ছিল বলতে পারি না; কিন্তু মুমুকে দেখলেই ওরা গাল টিপে ধরে আর নিজেদের কণ্ঠস্বরকে রাবারের মত টেনে টেনে জিজ্ঞেস করে, “কীঈঈঈ?? আপনি কেমন আছেএএএন?”। মুমু টের পায় না ওদের আনাড়ি আঙ্গুলে লেগে থাকে গলির মোড়ে বশিরের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে টানা সিগারেটের গন্ধ। এত বড় বড় ছেলেদের সসম্মান সম্বোধনে আপ্লুত মুমু আমার ওকে ‘তুই’ ডাকার দুঃখ কিছুক্ষণ ভুলে থাকে নিশ্চয়ই। ও প্রায়ই দাদাজানের কোলে বসে থাকে আর ড্যাবাড্যাবা চোখ মেলে ক্লাসের পড়ানো আর মাঝেসাঝে বেতানো দেখে।
কোচিং শেষ হয়ে গেলে বাইরের ঘরের দরজা ঘেঁষে হুড়মুড়ানো শু-জুতা-স্যান্ডেলের দল একে-একে উধাও হয়ে যায়। ঠিক সেইসময় উল্টোদিকের দোতলা বাড়ির বারান্দায় নীলা আপার লম্বা স্কার্টের এক-দুটো প্লিটের ঝলক দেখা যায় প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্য। বড় ছেলেদের দল চলে যাওয়ার সাথে সেটাও অদৃশ্য হয়ে যায় দ্রুত। বিকালের বয়স বাড়ে। দাদাজান কাজা নামায সারেন। তারপর চিনি-ছাড়া চায়ে চুমুক দেন ঘূণে ধরা কাঠের চেয়ারে বসে পা দোলাতে দোলাতে। মুমু তখনো কোলে বসে বসে দোল খায়। দাদাজান ওকে আরবি সিন্ডারেলার গল্প বলেন; সৎমায়ের দু’চোখের বিষ শহরযাদীকে পরী কীভাবে উদ্ধার করে সেই গল্প শতশতবার শুনতে মুমুর ভাল লাগে। আমার একলা লাগে। লিমন ভাইয়ারা আমাকে খেলতে নিতে ট্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করে। আমি ছোট বলে। আমি মুমুকে তোষামোদ করি সেই সময়গুলোতে। মুমু প্রায়ই গড়িমসি করে। মর্জি হলে দাদাজানের কোলস্বর্গ থেকে নেমে আসে মর্ত্যে। মেয়েদের খেলা খেলি আমরা। মাটির ব্যাঙ্ক থেকে খসে পড়া কমলারঙা চাড়া দিনের পর দিন ছুঁড়লেও তিনের ঘর পার হবে না—এরকম অসমাপ্ত এক্কাদোক্কার ঘর টানি। ঘর টানতে টানতে মুমুর ফ্রকের নিচে লাল-গোলাপি ছিটের হাফপ্যান্ট দেখা যায়। আমি বকা দেব কিনা ভাবতে ভাবতে আড়চোখে চট্ করে নিজের বাদামি হাফপ্যান্টের তলার নাজুক সেলাইটা চেক করে নিই। (ওটার ফুটো দেখে মুমু একদিন হি-হি করে হেসেছিল।)। বর্ষায় বাগানে নরম মাটিতে অ্যাক্রোব্যাটিক কেঁচোর নিজের শরীর উল্টেপাল্টে বানানো মাটির গুটলিগুলো দেখে আমাদের গা ঘিন-ঘিন করে, কিন্তু তাও এক্কাদোক্কার ঘর আঁকার সময় মুগ্ধ অপলক চোখে চেয়ে থাকি গুটলিগুলোর দিকে। মুমুর এক খেলা বেশিক্ষণ ভাল লাগে না। আমারও না। আমাদের চারচোখে বিকালের বাসাটা নিজেই তখন ই-য়া-য়া বড় এক খেলার মাঠ; তাই কোনো খেলায় মন না উঠলে আমরা মাটি থেকে বারান্দায় উঠে আবার বারান্দা থেকে মাটিতে নেমে কানা বোলতার মত ঘুরি বোঁ-ও-ও-ও। কখনো আমি হই কুমির, উঠান হয় জল, বারান্দা হয় ডাঙা, আর মুমু হয় দুধভাত। দাদাজানের কোচিং ক্লাসের ঘর থেকে দুপুরবেলা চুরি করে আনা ব্ল্যাকবোর্ডের চক শেষ বিকেলে দুই ভাইবোন ভাগাভাগি করে লুকিয়ে খাই, আর নয়তো সেটা দিয়ে ঘষে ঘষে লাল মেঝে আর টিয়াসবুজ দেয়ালের সীমানায় সার-বেঁধে-চলা পিঁপড়াদের গতিপথ আঁকি সযত্নে। তখন লিমন ভাইয়া ঘরে থাকে না; বন্ধুদের সাথে খেলতে যায়; সেই সুযোগে ভাইয়ার জ্যামিতি বক্স হাতে নিয়ে হাতাই আমরা। লাল-কালো বক্সটার উপর স্কচটেপ দিয়ে আটকানো রুল-টানা কাগজের চিরকুট: “তারিকুর রহমান (লিমন); শ্রেণী—ষষ্ঠ; ক্রমিক নং—১৯”। ওই ঠনঠনে বক্সের ভিতর থেকে কাঁটাকম্পাস চুরি করে এনে বাইরের ঘরের রেক্সিন-মোড়া সোফার গা খুঁচিয়ে দেখি ভিতরের ফোমটা কী রঙের। বড় চাচীর ঘরের নষ্ট দেয়ালঘড়িটা নিজের ভারে একদিকে কেৎরে থাকে; নাগালের বাইরে, কিন্তু ওটার শরীর থেকে মিনিটের কাঁটা-ঘণ্টার কাঁটা ভেঙে এনে মাটি এফোঁড়-ওফোঁড় করতে মন চায় আমার। বেঁকা রোদে আমাদের শরীরের ছায়া ডাকাতের মত বড় হতে থাকে। পানার সাগরে কলমিফুলের গন্ধ ডুবে হারিয়ে যায়। সন্ধ্যামালতি জমকালো গোলাপি কাপড় ছাড়ে। ঘরে মশা ঢুকতে থাকে ঝাঁক বেঁধে। আমি আর মুমু সেই সময় কোনো কথা বলি না কেন যেন। চেয়ে দেখি জানালার বাইরে ডোবা পেরিয়ে দূ-উউ-উউ-রের বাড়িগুলো ওদের যার-যার মধ্যকার দূরত্বকে অম্লানবদনে বুকে ধরে থাকে; হাসিমুখে দিগন্ত জুড়ে সারবেঁধে লাগোয়া অভিনয় সারে। বিকালের শেষ অঙ্কে আমরা আরো এক-দুটো দুঃসাহস করব কিনা ভাবতে ভাবতেই চকচকে সবুজ সরস ডাব-ডুবুশ বিকেলটা নারকেলের ছোবড়ার মত শুকনো মলিন হয়ে আসে।
মাগরিবের ডাকে আমরা হাত-মুখ ধুয়ে আম্মাকে ডাকতে যাই। নাস্তা সেরে পড়তে বসি। সন্ধ্যাও একসময় বুড়ো রাত হয়। নাছোড় ঝিঁঝিঁ আড়াসি দিয়ে পড়ে থাকে। বারান্দার চেয়ারে দাদাজানকে আর দেখা যায় না।
কলেজ গেট রোডের যৌথবাড়িতে আমাদের সকাল-দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যার দিনগুলোতে আমার সঙ্গী হল একা মুমু; আর মুমুর সঙ্গী হলাম একা আমি। মুমু অজান্তেই আমার ভিতরটাকে জ্যান্ত মানুষের মত লাল-গোলাপি করে রাখে, আর বাড়িভর্তি বাকি মানুষগুলোকে তখন শুধু লাল-গোলাপি রক্তমাংসকে ঢেকে রাখা শুকনো চামড়ার মত মনে হয়। দাদাজান বাদে। দাদাজান মাংস-চামড়া কিছুই না। দাদাজান হল হেড— হেডমাস্টার– মাথা। নাঃ। মাথাও না। দাদাজান হল মেহেদি না দেওয়া ফুরফুরে পাকাচুল। মাথারও উপরে। দাদাজান বাদে বাকিরা— বিধবা বড় চাচী, তাঁর ছেলেমেয়েরা, হরমুজের মা, ছোট চাচা, ফুপু, আম্মা, আব্বা— সবাইকে আমার জীবনের অনুষঙ্গ মনে হয়। থাকলে ভাল, আবার না থাকলেও ভাল। আম্মা হয় ব্যস্ত, নয় জায়নামাজে, নয় কারণ-ছাড়া উদাস। আম্মা যখন আমাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখনি আমরা আম্মাকে সবচেয়ে কম কাছে পাই। আম্মাকে আমাদের লাগে, আবার লাগেও না। আম্মা কি এই কষ্টেই উদাস উদাস থাকে? আব্বা ফিরলে আম্মা হয় তটস্থ, অথবা কী এক কারণে সারাবেলা রোদসী। কোল্ডস্টোরেজের ব্যবসা সামলে এক-দেড়মাস পরপর বাড়িফেরা আব্বাকে মনে হয় ভিনপাড়ার জাদুকর, যার বুড়ো বয়সে হঠাৎ হঠাৎ আমাদের বন্ধু হতে মন চায়। যার থলে ভরা কত কত চমকদার কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক আইটেম আমাদের জন্য! চাবি-দেওয়া পেঙ্গুইন, প্যাকেট-ঠাসা নেতানো বেলুন, ভঙ্গুর বিস্কুট, বার্মিজ আচার, তলানিতে ঠেকা পারফিউমের শিশি, জুতার কালি, আট বছরের ঝুনা আমার ফলপরিচয়ের জন্য সেলোফেন কাগজের আঠামারা ‘নো ইয়োর ফ্রুটস’ বই, মুমুর জন্য ভুলে পাঁচ বছরের মেয়ের আন্দাজে নিয়ে আসা সাইজে ছোট জামা, যেটা মুমুর মাংস কেটে বসে যায়— তবু প্রতিবার আম্মা ওকে পরাতে গিয়ে পিঠের চেইনের দু’ধার শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে। বাজার থেকে দৈবচয়নের মাধ্যমে খপ্ করে ধরে নিয়ে আসা উপহারগুলো আমাদের সাথে একেবারেই যায় না। এমনকি জিনিসগুলো একটা আরেকটার সাথেও ভীষণরকম বেমানান। ওগুলো হাতে নিয়ে নাড়ি, চাড়ি, ইতস্তত করি, আর নিজের ইতস্তত ভাব নিয়ে নিজের উপরই চড়াও হই— “বেমানান মানে কী রে আহাম্মক! হ্যাট আর রুমালের কী সম্পর্ক? পায়রা আর কাঠির কী মিল? পারলি না তো, হাবা? বিরাট মিল! ওরা সব জাদুকরের থলিতে থাকে; আর কোনো মিল না থাকলেও জাদুকররা মিলিয়ে দিতে পারে—রুমালকে হ্যাটে ভরলে পায়রা হবেই! আর পায়রাকে বাক্সে ভরে কাঠি ছোঁয়ালে তো সেটা প্লাস্টিকের ফুলের ঝাড় হতে বাধ্য! তাহলে? মিল্ল কিনা বল্! আব্বা স্যুটকেস খোলার পর ‘কোন্টার সাথে কোন্টার কী সম্পর্ক’, ‘কোন্টা দিয়ে আমি কী করব’— ভেবে যদি না পাস্, তাহলে ভেবে নে যে আব্বা একটা জাদুকর। ব্যস্!” খুশি।
আব্বার দেওয়া খেলনাগুলো খেলতে খেলতে ব্যাটারি-খতম অবস্থায় চলে এসেছে, এমন এক দিনে দাদাজানের কাছ থেকে হাতে পাই সেই স্কেটবোর্ড। কোচিং ক্লাসের কোন্ এক ডাঙ্গুলিবাজ ছেলের কাছ থেকে জব্দ করা মাল। ক্লাসের ভেতর ঐ জিনিস নিয়ে এসে নাকি ইবলিসের দলের সর্দারি করছিল স্কেটবোর্ডের মালিক।
দাদাজান এই প্রথম ছেলে-ছোকরাদের কাছ থেকে জব্দ করা মাল মুমু বা লিমন ভাইয়ের হাতে তুলে না দিয়ে আমার হাতে দিলেন। যদিও দেওয়ার সময় বলেছিলেন মুমুর সাথে মিলেমিশে খেলতে, আমি জানতাম এটা আমার। আমার। আমারই।
মুমুও জানে। জানে দেখেই শান্তিমত দু’জন মিলে ভাগ করে নিতে পেরেছি স্কেটবোর্ডটাকে। মুমুটার বুদ্ধি গজিয়েছে। ভূস্বামীর তৈরি করা কোনো অসমান ব্যবস্থাকে ন্যায্য বলে মেনে নেওয়া বাধ্য প্রজা হয়ে গেল মুমু। আমাদের দুজনের তাতে লাভ হল। আমরা নির্বিবাদ হয়ে গেলাম।
সদাশয় আমি এখন মুমুকে তুই-তোকারি কম করা ঠিক মনে করি।
*
আমাদের বুয়া, যাকে ডাকা হত ‘হরমুজের মা’ নামে, যার নাম আমাদের ফুপুর নামে হওয়ায় কারণে ‘ফাতেমা’ না ডেকে সবাই ডাকত ‘হরমুজের মা’, তার ছেলের নাম ছিল হরমুজ। হরমুজের গায়ে ছিল শশার গন্ধ। ও পচা ডোবার পানি ঘেঁটেঘুটে ফুটফুটে বেগুনি কচুরিপানার ফুল এনে দিত মুমুকে। ওর কাছে দেখেছিলাম তলায় চাকা লাগানো এক টুকরা কাঠ; যেটাকে লিমন ভাই ডাকত ‘স্লেজ’ নামে, আর হরমুজ ডাকত ‘গড়গড়ি’ নামে। হরমুজকে মাঝেমাঝে দেখতাম আরো এক-দুটো ছেলের সাথে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় গড়গড়ি খেলতে। কখনো সামনে বসে, কখনো পিছনে ঠেলে, কখনো সামনের সওয়ারির উদাম পিঠে উদাম পিঠ ঠেকিয়ে হরমুজরা বিকট শব্দের ঘেউয়ে গড়গড়িটার সাথে পিঠাপিঠি গড়াগড়ি যেত। ওইরকম স্লেজ আমার নেই; ওইরকম ধুলামলিন এস্কিমো আমার হওয়ার কথা না; আমার ওইভাবে শরীর দিয়ে পাথুরে রাস্তার মলিনমর্ম মোছার কথা না; ওইসব খেলার ধারেকাছে যাওয়ার কথা না। কেউ মুখে নিষেধ না করলেও আমি জানি ওইসব আমার নিষেধ। আমার হরমুজের গায়ের শশা-শশা গন্ধকে হিংসা হত।
সেবার রোজার ছুটিতে দাদাজানের দেওয়া স্কেটবোর্ডটা ছিল আমাদের চড়া প্রথম গড়গড়ি। মুমু লম্বায় যতখানি ছিল, স্কেটবোর্ডটা তার চেয়ে কম হবে না। ওর গায়ের রঙ ছিল পিছল-কালোর উপর জংলা-লাল ডোরা-ডোরা। ওকে দেখতে লাগত মাটির উপর ঘাপটি মেরে বসে থাকা শিকারি জন্তু। দুই-জোড়া মুশকো চাকা ঠিক দুই-জোড়া চোখ হয়ে জ্বলত আগে-পিছে। ওর সটান শরীরের চাপা বাঁকগুলো থেকে যখন ফিনকি দিয়ে আলো ঠিকরাতো, আমরা দুই ভাইবোন ওর শরীরের চেকনাই দেখে ভাবতাম এর চেয়ে নাজুক, সুন্দর, বুক দিয়ে আগলে রাখার মত সম্পদ আমাদের আর দু’টি ছিল না। ওকে আমাদের খেলনা লাগত না; মাঝে মাঝে লাগত এক অতিপ্রাকৃত বাহন; কিংবা একটা জাগ্রত জীবন্ত প্রাণী। চড়ে বসে ঢালু পথে ছোটালে ছুটন্ত সশব্দ শ্বাপদের মত জানান দিত সবাইকে “সাবধান! সর সর! হুড় হুড়! সাবধান!” সমতলে আলতো ঠেলা দিলে ও প্রায়-নিঃশব্দে হিসহিস করে সামনে এগিয়ে যেত অনেকখানি। অভিভূত আমাদের একটু ছমছমে ভয়ও লাগত তখন। বেশ অহংকারও হত যখন ভাবতাম ঐ ঝিকিমিকি লাল-আঁধারের বন্য সুন্দরের মালিক ছিলাম আমি আর মুমু। মুমু আর আমি। আমি। আসলে আমি। পোষা কুকুর-বিড়াল-পায়রা-টিয়া আমাদের বাড়িতে কখনোই ছিল না; ছিল না অন্যের কুকুর-বিড়াল ধরার পারমিশনও। কিন্তু আমাদের স্কেটবোর্ডটা হয়ে উঠল আমাদের প্রথম এবং শেষ পোষমানা জন্তু। মুখেই ‘আমাদের’। আসলে আমার স্কেটবোর্ড। আমার পোষমানা জন্তু। আমার।
আমার পোষমানা জন্তটার সাথে হরমুজের গড়গড়ির তুলনা চলে না; তুলনা করলে হরমুজেরটাকে বেওয়ারিশ নেড়ি কুকুর বলে ভাবা যেত আনায়াসে। অবশ্য নেড়ি কুকুর ছাড়া আর কোন্ প্রাণী হরমুজের মায়ের ছেলের পোষ মানবে?
ছিঃ! সেই থেকে হরমুজের শশা-গন্ধকে আমি কাছে ঘেঁষতে দিতাম না পারতপক্ষে। কচুরিপানার ফুল হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ানো মুমুকে শক্ত বকা দিয়েছিলাম সেই সময় একবার।
মুমু অবশ্য নিজেও স্কেটবোর্ডের ভাগ পেয়ে ভুলে গেল বেগুনি ফুলের কথা, দাদাজানের কোচিং ক্লাসের কথা; নিটোল সাদা চক, মাটির কলসির কানা, ছ্যাঁৎলা-পড়া ছায়ার বারান্দা আর জানালার গরাদ-গলা রোদের বিকালের কথা। ওর নতুন খেলা হল স্কেটবোর্ড নিয়ে ‘লুলা ফকির’ খেলা। ব্যালকনির এক কোনা থেকে শুরু হত এই খেলা। পা-সহ শরীরের অর্ধেক থাকত স্কেটবোর্ডের উপর, আর শরীরের সামনের অংশ হাতের উপর ভর দিয়ে থাকত মেঝের উপর। দুই হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে একপাটি করে রাবারের চপ্পল গলানো থাকত। হাত-নেই-পা-নেই পথের ভিক্ষুকের মত বিদ্ঘুটে মুখভঙ্গি করে ‘অ্যাল্লাহ্- অ্যাল্লাহ্’ জিকির করতে করতে স্কেটবোর্ডটা নিয়ে ঘরময় ক্রল করত মুমু। রম্যচরিত্রে ওর অভিনয় প্রতিভা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকল না। মাঝে মাঝে ওর যখন একঘেঁয়ে লাগত, তখন স্কেটবোর্ডটার উপর বসে আনমনে চাকার দোলে সামনে-পিছনে দুলত, নয়তো দু’হাতে পুতুলের কাপড় খুলে মনোযোগে দেহব্যবচ্ছেদ করত। দাদাজানের কোলে দোলার মানুষ নেই হয়ে যাওয়াতে দাদাজান হয় পত্রিকা নয় মুড়ির বাটি দিয়ে বিকালের শূন্যতা ভরালেন। সপ্তাহে তিনদিন বিকালে ফুপু-মুমু-নীতু আপুর গান শেখার পাট চালু হল। ওই তিনদিন স্কেটবোর্ড নিয়ে আমি আর লিমন ভাই ওর বন্ধুদের সাথে খেলতে বেরিয়ে পড়ার রুটিন বানিয়ে নিলাম। আম্মা প্রথম প্রথম বাধা দিত যদিও। আমরা পালা করে মাঠের গা-ঘেঁষে স্পিডব্রেকার-ছাড়া রাস্তার উপর স্কেটবোর্ড নিয়ে আইঢাই স্পিডবাজির প্র্যাকটিস করি। হেই-হেই করে বাতাস কেটে পাক খেয়ে মাঝেমাঝে হুমড়ি খেয়ে পড়ি শক্ত পাথুরে রাস্তায়। হাঁটু-কনুই জ্বলতে শুরু করে সন্ধ্যা পার হলে। কে কতক্ষণ চালাবে তা অবশ্য ঠিক করে দিত লিমন ভাই। আমি ভারবাহকের মত বড় ভাইয়ের পিছে পিছে চলতাম স্কেটবোর্ড নিয়ে। সবার সামনে এমন ভাব করতাম যেন স্কেটবোর্ডটা লিমন ভাইয়েরই। লিমন ভাই নীরবে কৃতার্থ হতেন। ছোটতে-বড়তে সাম্যহীন সম্পর্কের অসমান ধারগুলোকে মাঝেমাঝে আরোপিত কৃতজ্ঞতার শিরিশ কাগজ দিয়ে ঘষে সমান করে নিতে হয়। জীবন-জগতেরও একটা ব্যালেন্স লাগে; শুধু স্কেটবোর্ডের নয়।
স্কেটবোর্ডটা আসার পর থেকে আমার দলাপাকানো দিনগুলো লম্বা হয়ে গেল। আমার কলেজ গেট রোডের বাড়ির জীবনের উপর দিয়ে স্কেটবোর্ডটা হেঁটে-দৌড়ে-লাফিয়ে-টেনে-হিঁচড়ে-ছেঁচড়ে চলত অনায়াসে। আটার ডেলাকে রুটির বেলন যেভাবে টানা-মসৃণ পৃষ্ঠ দেয়, সেইভাবে চলতে চলতে সে আমার আজব বিস্তার ঘটাল। ওকে হাতে পাওয়ার পর থেকে আমার সূর্য ডুবত দ্রুত। দিন হয়ে গেল ছোট; রাত হয়ে গেল বড়। ওই সময়েই আমি হুড়হুড় করে লম্বা হতে লাগলাম; কবজি আর বাহুসন্ধির নরম ভাঁজের দাগ মিলিয়ে যেতে থাকল আদিশৈশবের স্মৃতির মত। স্কেটবোর্ড নিয়ে গলির মুখের র্যাম্পে শেষদুপুরের মগজভাজা রোদে লুকিয়ে কসরত জমালাম খুব। সেই কসরতের চোটে সারা গায়ে একপোঁচ গাঢ় বাদামি রঙ লাগল। স্কেটবোর্ডটাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সাহস হয়নি কোনোদিন, কিন্তু ওকে বগলদাবা করে বিকেলে খেলার মাঠমুখো হয়ে প্রতিদিন দেখতাম চারদিক ঘিরে ধরেছে বরফগলা ঈর্ষা আর হিমশৈলের মত কাছে এগোতে থাকা উদগ্রীব পপুলারিটি। ভালবাসাও কি? নাহ্। কই?
অন্যের ঈর্ষা আর অন্যের ঔৎসুক্য অন্যের ইচ্ছায় নিজের হাতে পাওয়া সহজ কাজ নয়। ভালবাসা পাওয়া বরং অনেকটা সহজ। কারো বুকের ধন হতে বেশি কিছু লাগে না; নিঃস্ব-নিশ্চেষ্ট হলেই যথেষ্ট। যেমন আম্মা বলে আমি তার বুকের ধন। মুমু দাদাজানের বুকের ধন। একদিন বারান্দার জোড়া-দড়ির উপর ঝোলানো সদ্য মাড় দেওয়া সার-সার শাড়ির আড়ালে আমি আর মুমু চোর-পুলিশ খেলেছিলাম। খেলাশেষে মুমুর গালে আদর করতে গিয়ে শুকনো মাড়ের গন্ধ পেয়ে ভেবেছিলাম মুমুও বুঝি আমার বুকের ধন। কীই বা করতে হয়েছিল মুমুকে সেদিন? কিন্তু এখন যেন বুঝে গেলাম কারো বুকের ধন হওয়া আর কারো চোখের মণি হওয়াতে অনেক অনেক পার্থক্য। আমি বড় হচ্ছিলাম। আমার চোখের মণি হতে ভাল লাগত বেশি।
সেই শীতে দাদাজান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বড় চাচী সারাদিন সেবা করেন। মেজাজ তিরিক্ষি। হরমুজের মা তটস্থ। আম্মা আর ফুপু মিলে সারাদিন কী যেন জল্পনা-কল্পনা করেন। আব্বা প্রচন্ড খিটখিটে মেজাজ নিয়ে শহরে ফেরেন। ডাক্তার আর ওষুধপত্র বাছবিচার নিয়ে আব্বা আর বড় চাচীর মধ্যে মন-কষাকষি হয়েছে— এসব গুজুর-গুজুর শোনা যায়। ছোট চাচা প্রায় রাতেই বাড়ি ফেরেন না; ফিরলেই পাড়া-ফাটানো হইচই; উনার দাড়ি উশকো-খুশকো অবস্থা ছাড়িয়ে ঝুলো-ঝুঁপো চেহারা নেয়। এর মাঝে মুমু একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করল ছোট চাচা সত্যি বড় চাচীকে মেরেছে কিনা। আমি অবশ্য দায়িত্বশীল (কিন্তু আসলে বিভ্রান্ত) বড় ভাইয়ের মত এসব নিয়ে ‘জ্ঞান-দিয়াও-দিলাম-না-জ্ঞান’ ধাঁচের বায়বীয় জ্ঞান দেই। দাদাজানের শরীর ভালর দিকে না মন্দের দিকে— সেটাও পরিষ্কার বোঝা যায় না। তাঁর খাটের স্ট্যান্ডে প্রায়ই ঝোলে স্যালাইনের ব্যাগ, গরলসাগরে সারাদিন বিন্দু-বিন্দু অমৃত বিলায় সেটা। লিমন ভাই আর আমি পুরো শীতটা একবারও একসঙ্গে না খেলে কাটিয়ে দেই। শুনলাম ব্যাডমিন্টনের কোর্ট বসেছে লিমন ভাইয়ের বন্ধু টিপু ভাইয়ের বাসায়। এদিকে ফুপির সামনে পরীক্ষা। বিভিন্ন ঘরের দরজা সময়ে-অসময়ে বন্ধ। দমহারা বাড়িটা নানাবিধ ছায়ার ভিড়ে চাপ-চাপ ঘন ঘন অন্ধকার অন্ধকার লাগতে শুরু করে। বিকালের অতৃপ্ত আত্মা প্রতিদিন দরজার বাইরে থেকে ফিরে যায়। সেই অন্ধকার বনভূমিতে আমার পোষমানা জন্তু হঠাৎ যেন বাড়ির সবার কাছে অহংকারী, বন্য, অবাধ্য, অসভ্য হয়ে উঠল। ওর গা গলে-গলে বেয়ে পড়া শুরু হল অসূয়ার আঠা, আর আমার দুই চাচাতো ভাই-বোন সেই আঠায় মাছির মত আট্কে যেতে শুরু করল। সুযোগ পেলেই লিমন ভাই আর নীতু আপু বারান্দায় কি ব্যালকনিতে পড়ে থাকা আমাদের স্কেটবোর্ডটাকে ফুটবল বলে ভুল করতে শুরু করলেন। আচ্ছা, বড় চাচী কি সত্যিই দাদাজানের বুকের ধন?
মুমু হিংসা নিতে পারে না; সহজ জীবনে বিশ্বাসী হলে অবশ্য ও হিংসাকে দেখেও দেখত না। আরেকটু সূক্ষ্ম সহজিয়া হলে ভাবত অন্যের হিংসা ওর নিজের মাথাব্যথা না, এমনকী সেই হিংসা স্বয়ং ওকে কেন্দ্র করে হলেও না। আর আমার মত বাড়ন্ত সহজিয়া হলে হিংসাকে হালকা বিনোদন ভেবে সান্ত্বনা পেত। যাই হোক, মুমু যেহেতু আমি নয়, তাই অন্যের হিংসা-লাঘবে মুমুকে বাধ্য হয়ে তৎপর হতে হল। বেশ অনেকদিন ধরেই ঢিল হয়ে আসা ওর হাতের মুঠিকে শেষমেশ আমার লেজ ছাড়তেই হল। স্কেটবোর্ডটাকে ও একরকম ত্যাজ্য-খেলনা করল। ওই চটক দিয়ে নীতু আপুর মন পাওয়া যাবে না, সেটা সে ভালই বুঝেছিল। পুরনো হারমোনিয়াম নিয়ে নীতু আপুর সাথে মুমুর এখন প্রতিদিন প্যাঁ-পোঁ করতে হত। ‘চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে চোখগেল পাখি?’ গান করতে হত চেঁচিয়ে, যাতে হারমোনিয়াম ছাপিয়ে খাদের গলা ছাদে ঠেকে। সকাল-বিকাল ‘চোখ গেল চোখ গেল’, বৈঠকখানায় ‘চোখ গেল চোখ গেল’, ঝিঁঝিঁ-ধরা পা বিছানা থেকে দুলিয়ে ‘চোখ গেল চোখ গেল’। সেই আর্তনাদে মুমুর গলা সত্যি ওর চোখদুটোকে ঠিক্রে বের করে দিত। পাল্লা দিয়ে চলত মাগরিব পর্যন্ত খ্যানখেনে হারমোনিয়ামটার কুলহারা আর্তনাদ; সাথে আরো নতুন যোগ হল হাম্দ–ও-নাত। নাদের সাগরে হাবুডুবু খেয়ে সত্যি মুমুটার চোখ গেল। বেচারি…ও বুঝেও বুঝত না যে বড় চাচী যতদিন আম্মার চোখের মণি হতে পারবে না, ততদিন ও নিজেও নীতু আপুর চোখের মণি হতে পারবে না। চোখের মণি হওয়া কি সহজ কথা?
সেই শুক্রবার আব্বা ফিরল যথারীতি। মুমু হারমোনিয়াম নিয়ে নতুন গান পরিবেশনে লেগে গেল, “যদি তোর হৃদ্যমুনা”। আব্বা হাসল না, কাঁদল। তারপর থেকে সময় যেন শশব্যস্তে ভাগতে থাকল আমাদের সবার হাত গলে। একদিন মুমুর ফ্রকের নিচে বুকে-পেটে-বাহুতে লাল-লাল খামচির দাগ আবিষ্কার হল। ওকে মেরে-ধরেও আম্মা এর কিনারা করতে পারলেন না। আরো কিছুদিন পর মুমু কোথা থেকে যেন মেয়ে-মহিলাদের ‘মাগি’ বলে গাল দেওয়া শিখে এল। রাতে আমি ঘুমিয়ে গেলেও আব্বারা সবাই বাতি জ্বেলে বাড়ি গরম করে কাজিয়া করত। আব্বা আমাকে আর মুমুকে পড়াতে পড়াতে একদিন থুতনি সংহত করে বলল, “স্কেটবোর্ডটা সরা। দূর কর্। অন্যের জিনিস জব্দ করে নিজের থলিতে ঢোকানোর মত ছোটলোকি এ বাড়িতে আর করা যাবে না। ওই জিনিসটার মালিক যে, সে এসে নিয়ে যাবে”। আম্মা আরেকদিন বলল, “তোমাদের দাদা সেরে উঠলেই আমরা চারজন নতুন বাড়িতে উঠব”। নামহীন, রূপহীন, একলা, অবাঙমানসগোচর সেই নতুন বাড়িগুলো গভীর ঘুমের দুঃস্বপ্নে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত দিগন্তের মাটি ফুঁড়ে। ওই দালানগুলোর শরীর নেই, শব্দ নেই, গতি নেই, বুক নেই, হাসি নেই, চাকা নেই। দাদাজান সেরে উঠলেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা চলে যাব? স্কেটবোর্ডটা যার, তার হাতে ছেড়ে দিয়ে? আর দাদাজান অনেক অনেকদিন অসুস্থ থাকলে? থাকুক থাকুক! প্লিজ। অনেকদিন অসুস্থ পড়ে থাকুক। অমর অসুস্থ। না সারুক। না মরুক। জরা নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকুক। মরলেই বাড়ি বদলাবে। মরলেই আমিন এসে জমিতে দাগ দেবে অমোচনীয় চক দিয়ে। মরলেই সবাই মিলে সেই চকের দাগের উপর সওয়ার হবে; ওই দাগকে পা দিয়ে ঘষে ঘষে মিশিয়ে দেবে নিজের ইচ্ছামাফিক। মরলেই স্কেটবোর্ডের মালিক আসবে তার জিনিস নিয়ে যেতে। সারলেও!
অবশ্য এসব আগডুম-বাগডুম আমি ভাবি না। না না, আমি ভাবি না তো একদম। এসব মুমু ভাবে।
মুমু আপ্রাণ চায় দাদাজান থেকে ‘জান’টা বিচ্ছিন্ন না হোক। আমার এসব ব্যাপারে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। সত্যিই নেই! সত্যি তো!
আমি মুমু নই। আমার জীবন সহজ রাখা দরকার। তাই এখন থেকে পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের সাথে আমি এক-স্কেটবোর্ড-সমান দূরত্ব রেখে মিশি। তাতে সমস্যা কী হয়েছে?
একদিন আমার গোঁফ গজাক; ফুলপ্যান্ট ধরি; গলির মোড়ের বশিরের দোকানের মত কোনো এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কাটুক প্রতিটা জরাগ্রস্থ বিকাল। একদিন আম্মা-আব্বা-দাদাজান-হরমুজ-মুমু সবাই জানুক— আমার হৃদ্যমুনায় খেয়া পারের সিস্টেম ছিল না।