দোলনচাঁপা চক্রবর্তী
১লা সেপ্টেম্বর, ২০১২
আজ শনিবার। সকালবেলায় কথাটা মনে হতে ভারি ভেজা ভেজা লাগল… যেন বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে আছি! ভাদ্র মাস পড়ে গেছে। এখন বাষ্প কোথায় ! বৃষ্টির শেষাংশ পড়ে আছে কিছু। গর্ভপাতের পরেও যেমন কিছুটা রক্ত জমা থাকে। ইচ্ছামত ঝরে।
মাথাটা ধরেছে খুব।
আজ রোদ উঠলে বেশ হয়। অনেকদিন সানগ্লাসটা পরা হয়নি। আমার স্টাইলিশ সানগ্লাস খাপের ভেতর পড়ে আছে। রোদ উঠলে পরতে পারব। সানস্ক্রীন মাখবনা অবশ্য। সানস্ক্রীন মেখে রাস্তায় বেরোলে মনে হয়,নিজেকে ট্যানারিতে টাঙাতে চলেছি। বিদেশীদের চামড়া রাঙানোর ব্যাপারটা আমার এই রকমই লাগে ! কালা ধলা পিলা সব চামড়াই তো আমার পাশাপাশি দেখলে দিব্য সুন্দর মনে হয়। এদের এত রঙবদলের বাতিক কেন, কে জানে।
ট্যানারির ব্যাপারটা ভাবলেই দুরূহ গন্ধ পাই। বাড়ির সামনের শুকনো গর্তটা জলে ভর্তি – মোষ স্নান করে। ওখানে বৃষ্টি পড়লেই কি একটা বাজে গন্ধ জান আকুল করে ছাড়ে। উফ! মাঝে মাঝে রাতেও ঘুম ভেঙে যায়। মোষগুলো নদীতে যায়না। অথচ, নদীতে জল বেশি,জোয়ারও লাগে দুপুরে। আগের থেকে নৌকোর সংখ্যাও বেড়েছে। জোয়ারের জল উঠলে এইসব নৌকাগুলো আরো উপর দিকে চলে যায়। ওখানে মাছ বেশি।
মুম্বাই বা শহরতলিতে বাঙালি মাছের অভাব নেই। আর, প্রচুর অক্টোপাস, স্কুইড, মোরি, ঝিনুক। মোরি মানে, হাঙর। হাঙরের মাখা মাখা ঝাল ঝোল, ঝিনুকের কষা – এইগুলো কোঙ্কনী রান্নার ডেলিকেসি। উপকূলের দিকটায় কোঙ্কনীদের ভাতের হোটেলেও এইসব খাবার দুরন্ত পাওয়া যায়। আর প্রচুর পমফ্রেট।
মাঝে মাঝে মনে হয়,এইসব আদতে ঘটেনা। কেবলই দৃশ্যকল্প। যেমন,তুমিও।
জল… শামিয়ানা… ঘোর – একটা গোল বুদ্বুদের বাড়ি। বাড়ির সামনে অনেক ঘন লোমে ঢাকা কুকুর। দূর থেকে ভালুকের মত দেখায়। ওহ ! তুমি তো আবার কুকুর ভালবাস না ! তাতে কি হয়েছে? এই কুকুরটা দেখতে তো ভালুকের মত – ফলত কিছুটা আপোষ করে নেয়া যায়।
ভাবো, দেখার সাথে আপোষ করছ তুমি
আর, রা থেকে বাংলো খুলে ছড়িয়ে পড়ছে
মরসুমী ফুল উঠে এল বারান্দায়
ওদের কারো কোন নাম নেই
আমরা আমাদের নামগুলি ওদের দিয়ে দিলাম
এখন আমাদের হাত ছাড়া কিছু নেই
আর চোখ
পা
পাতা
নখ
বাসী জলে মিইয়ে গিয়েছে নখগুলো
টানটান করে শুকোতে দিলাম পায়ের পাতায়
এভাবে প্রায় সবকিছুই ব্যবহার হয়ে গেল
আমার মাথাব্যথাও শুকিয়ে যাচ্ছে রোদে
গাঙ্গেয় উপকূলের ধারে ঝড় উঠবে হয়ত আজ। শনিবার তো। শনিবার ঝড় না হলে হাফ-ডে মনে হয়না ! যাক,দু’বার ‘শনিবার’ বললে হাফটা কেমন প্রলম্বিত হল। অথচ ছুটি তো বাড়ে না। ভাবছিলাম আজ সকাল থেকে রোদ উঠবে। শনিবারের অনেক আলো। অনেক কথা জমে থাকে তার। এতটা স্পেস খালি থেকে গেলে তার থেকে কিছু তো বিকিরণ হবেই। এভাবেই শূন্যতা অনেকটা ভরাট হয়ে আসে। সেইমত রোদও উঠেছিল।
পা শুকোতে বসেছিলাম রোদে। প্রাচীন একটি মানুষের মত। দীর্ঘকাল ধরে যে বড়িতে আছে, পাঁচিলেও। জলের আঘাতে নরম হয়ে এসেছে চামড়া। যে কোন মুহুর্তে ফেঁসে যেতে পারে। ফলত জমা জল নিংড়ে, মেলে রেখেছিলাম নখগুলো। বয়সের ভারে ন্যুব্জ নখ দূর থেকে চেনা যায়। পাখিরাও কাছে আসে। দুপুরের ছাতে কত রঙের পাখি মেলা থাকে। তারে,জামাকাপড়ের গায়ে। এবং,এসবের সাথেই দ্যাখো,জলের একটা আত্মিক সম্পর্ক রয়ে যায়। কেননা,পাখিরাও এ সময়ে, জমা জল ঝেড়ে ফ্যালে ডানা থেকে। ঠোঁট থেকে।
অঙ্কেরও বয়স হচ্ছে বোঝা যায়। নইলে স্পেস নিয়ে এত গোলমাল করবে কেন ? আলো নিয়ে … দূরত্ব নিয়ে একাই ঘুরে আসতে পারত। আসার সময় একটু বাদামভাজা নিয়ে আসত ময়দান থেকে। আমি অবশ্য বাদামভাজা খাইনা। জলতেষ্টা পায়। অসীম তৃষ্ণায় শিকড় ছড়িয়ে দিই গভীর থেকে গভীরে। যেখানে যেখানে আমার পা পড়ে,ছাপ থেকে যায় – ডালপালা তৈরি হয় সেখানেই। বাকলের রঙ বদলায়, পাঁপড়িও আগের থেকে ঘন। তাই আমি এখন আর কারো দিদি হতে পারিনা। বোন হতে পারিনা। প্রেমিকা হতে পারি কী? নাহ্। সেটাও আমার খুব বিষণ্ণ লাগে। খোলা আকাশ থেকে অবিরল বৃষ্টিপাতের মত। এতকিছু ক্রমশ দিতে থাকলে কারোরই কি আর নিজস্ব কিছু থাকে?
সবাই সবার থেকে নম্বরের দূরত্বে আছি।
দরজা খুলে দ্যাখো – শনিবার থেকেও কত আলো আসে।
অসাধারণ লেখা। পড়তে শুরু করলে চোখ সরানো যাচ্ছেনা।