ছোটগল্প: কেনাবেচা দরদাম

মাহবুব আলী

১.

পোড়া চোখ, সে কিছু দেখেনি। দেখেও কিছু দেখেনি। বুঝেও কিছু বোঝেনি। বুড়ি মানুষ। সবকিছুতে বেশি কৌতূহল থাকা তার কথা নয়।  উচিৎ নয়। ফরহাদ মাস্টার তাই সেদিন রাতে তাকে ডেকে নেয়। তখন ওই মেয়েটিও আছে। ঘরের ভেতরে বসে কার্টুন দেখছে। রঙিণ টেলিভিশন। দেখার খুব মজা। সে কখনো হো হো করে হাসছে। সে হাসি খুব সহজ সরল। সুন্দরী মেয়েরা বেশ বোকা হয়। এই মেয়েটিও বোকা।

সে সবকিছু দেখে। সবকিছু বোঝে। তারপরও কিছু বোঝে না। ঝুঝেও চুপ করে থাকে।  মাস্টার বলে, –

‘দুলুর মা তুমি কিছু দেখ নাই। আর বাইরে কোনো আলাপ করবে না। রুনিকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ওকে বিয়ে করব।’

তখন ও ঘর থেকে মেয়েটি বের হয়ে আসে। চোখদুটো ফোলা ফোলা। রক্তাভ গাল মুখ। সুন্দর করে টপনট খোঁপা বাঁধা। মুখের সামনে দুপাশে কিছু চুল কান ঢেকে ফেলেছে। পরনে পারস্য-নীল রঙের কামিজ। বুকের কাছে এমব্রয়ডারি। মানানসই সাদা পাজামা আর ওড়না। বারান্দার টিউবলাইটের আলোয় নীলকে বেগুনি মনে হয়। রুনিকে অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। সে অনেকটা ঘুমকাতুরে গলায় বলে, –

‘চাচি তুমি কি চলে যাচ্ছ গো? যাওয়ার সময় একটা রিকশা ডেকে দিও ক্ষণ।’

আহ ন্যাকা! বোরখার ভেতরে খেমটা নাচ নাচছো আর একটা রিকশা ডাকতে মেয়ের কি লজ্জা! দুলুর মায়ের মুখে অদ্ভুত বিরক্তির ছাপ। একটি তেরছা হাসি ঠোঁটের কোণায় দেখা দিয়ে খুব দ্রুত মিলিয়ে যায়। মনের কথা মনে থাক। মন খোলার দরকার কি? শুধু মুখে বলে, –

‘এখন যাইনি বেটি, মাছের তরকারি চড়িয়েছি, হতে আধঘন্টা লাগবে। যাওয়ার সময় বলব।’
‘কি মাছ রাধছো?’
‘ইলিশ।’

মাস্টার বাইরে চেয়ার নিয়ে কিছু পড়ছিল। কিছুক্ষণ আগে বসেছে। উজ্জ্বল আলোয় ঝকঝকে বারান্দা। ঘরের পেছনে ঝোপের মতো ঝাঁকড়া লম্বা এক গাছ। সেটি কেন জানি থমকে আছে। একটুও নড়ছে না। দুলুর মা বারান্দায় তাকায়। জায়গাটি ধোঁয়ায় ধোঁয়া। সিগারেটের আবেশমাখা গন্ধ ছড়িয়ে গেছে। মাস্টার তর্জনী দিয়ে পড়া জায়গা আটকে রেখে বই ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ায়। সেখান থেকে বলে, –

‘রুনি ভাত খেয়ে যেও…সরষে ইলিশ। দুলুর মা খুব ভালো রাধে।’
‘হয়েছে স্যার, মায়ের কাছে মাসির গল্প করতে হবে না। ভাত খেতে গেলে রাত হয়ে যাবে। অত রাত অবধি বাইরে থাকার পারমিশন নাই।’
‘সবে তো রাত নটা! একদিন একটু দেরি হলে তেমন সমস্যা হবে না। তোমার দুলাভাইকে জানিয়ে দেব নাহয়।’
‘চাচি তাহলে আমি খেয়ে যাচ্ছি।’

দুলুর মা বেশ ত্বরা করে রান্নাঘরে ঢোকে। তার দুচোখ ভাবলেশহীন। মনের ভেতর নির্বিকার উচ্ছ্বাস। ফরহাদ মাস্টারকে আজ ভালোভাবে খসাতে হবে। সেদিন মাত্র দু শ টাকা দিয়েছে। আজ পাঁচ শ নিয়েই ছাড়বে। এত ভালো মেয়ে জোগাড় করে দিয়েছে কম কথা নয়। এমন কাজ কয়জনে পারে! এসব ভাবতে ভাবতে তার ঝুলে পড়া চোয়ালের দু ধারে বাঁকা হাসি ফুটে উঠে।

২.

কয়েক মাস আগে রুনির সঙ্গে পরিচয়। সে তখন কলেজের গেটে দাঁড়িয়েছিল। শ্রাবণের ফিকে দুপুর। ঝিপঝিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তা প্রায় ফাকা। মেয়েটিকে দেখে বেশ মায়া হয়। ভারি মিষ্টি এক মুখ! সারল্য খেলা করছে সে চেহারায়। পনি স্টাইলে বাঁধা চুল। পরনের গাঢ় গোলাপি কামিজ আর সাদা পাজামা ভিজে কাদায় মাখামাখি। একটি বন্ধ দোকানের সানসেটে খুব কষ্টে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। দুলুর মা কাছে এগিয়ে যায়। বলে, –

‘কি গো বেটি রিকশা মিলছে না? কত দূর যাবে?’
‘বালুবাড়ি চাচি।’
‘ও। একটু দাঁড়াও দেখি, এখানে এক পরিচিত রিকশাওয়ালা আছে।’

সে আর দাঁড়ায় না। একটু সামনে গিয়ে ধরে আনে দেলোয়ারকে। এখানে এক ছোট মাঠ আছে। তার পুবে চকবাজারের এক বিহারির পরিত্যক্ত বাড়ি। সে বাড়ির বারান্দায় ছেলে প্রায় আড্ডা মারে জানা ছিল। আজও তাই। কাজ ফেলে তিন তাশ খেলছে। মাঠের একধারে রিকশা দাঁড় করানো। বৃষ্টিতে ভিজছে। বাধ্যগত ছেলে। কথা বলতেই খেলা ফেলে উঠে দাঁড়াল। আর দুলুর মা সেদিন থেকে রুনির চাচি হয়ে গেল। তারপর কতবার দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। তার কাছে রুনির বাড়ি কোথায়, সংসারে কে কে আছে, কে কী করে, তার কী করা হয় ইত্যাদি সব দরকারি খবর। এখন তো গোপন খবরও তার জানা। আজ তাকেও খসাতে হবে। দুলুর মায়ের ঠোঁট আরও বাঁকা হয়ে যায়।

রুনি বড় বোনের সংসারে থাকে। শহরে থেকে কলেজে পড়ছে। সামনে বছর দুয়েকের মধ্যে পড়ালেখার পাট শেষ হবে। নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান। অবিবেচক বাবার আরও দুই মেয়ে দুই ছেলে আছে। ভগ্নিপতি একটি এনজিওতে কাজ করে। লোকটি ভালো। শ্যালিকার পড়ালেখাসহ যাবতীয় খরচ বহন করে। এসব গল্প হতে হতে একদিন দুলুর মায়ের সাহস বাড়ে। বলে, –

‘বাপে তোমার বিয়ে দিতে পারবে বেটি? অনেক খরচ। আমার হাতে এক ছেলে আছে। বয়স একটু বেশি, এই ধরো ত্রিশ বত্রিশ। তা পুরুষ মানুষের বয়স পঁচিশ কি আর পঞ্চাশ কি, দেখতে হয় টাকা ক্ষমতা আর চরিত্র। টাকা থাকলে সবদিক দিয়ে নিরাপদ। বিয়ায় বসার ইচ্ছা থাকলে কও।’

সেই থেকে ফরহাদ মাস্টারের এখানে আসা। বাণিজ্যিক অর্থনীতি তেমন বোঝে না রুনি। কাছে আসার একটি ছুতো তো থাকা চাই। তাই যেমন শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়া। দুলুর মা একদিন বিকেলে রুনিকে নিয়ে আসে গণেশতলার বিহারিপট্টিতে। এক অর্থশালী বিহারির অনেকগুলো বাসা-ঘর। একাত্তরে পরিবারের প্রায় সকল সদস্য মুক্তিদের হাতে মরেছে। ঘরগুলো ফাঁকা। তারই দুটো কক্ষ নিয়ে উত্তর-পশ্চিম কোণের একটিতে ভাড়া থাকে মাস্টার। টিনের চাল দেয়া দালান বাসাবাড়ি। সামনে একটি কুয়ো। তার পাশে এক বন-পাঁকুড়ের গাছ। সে গাছের ছোট ছোট পাতগুলো রোদে ঝিকমিক করে উঠে। কুয়োর উপরে একটি দেয়াল উঠিয়ে তাকে দু ভাগ করা হয়েছে। অর্ধেক বাসার ভেতর, বাকিটুকু বাইরে। অন্য ভাড়াটিয়ারা বাইরের অংশ ব্যবহার করে। নিরিবিলি চমৎকার ঠাণ্ডা পরিবেশ। এমন বাসাবাড়ি খুব একটা ভাড়া পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

৩.

ফরহাদ মাস্টারের ভাগ্য ষোলো আনা পরিপূর্ণ। ব্যাচেলর মানুষ সাবলেট পায় না। সে সামান্য চেষ্টায় পুরো বাসা পেয়ে গেছে। অবশ্য এরজন্য ভাড়া একটু বেশি। টাকা খরচ করতে তার কোনো কার্পণ্য নেই। ভূতে টাকা জোগায়। সে কোনো এক ব্যাংকে চাকুরি করে। অফিসার গোছের পদ। একা একা ভালো লাগে না। তাই শখ করে দু একজন মেয়েকে প্রাইভেট পড়ায়। সপ্তাহে তিনদিন। ছেলেদের পড়ায় না। কী পড়ায় কে জানে, পরিচিতি হয় মাস্টার। এসব নিয়ে কোনো খেদ নেই। বেশ ফুর্তিতে থাকে। কোনো কোনো শুক্রবারে গ্রামের বাড়ি বিরামপুর চলে যায়। মেইলবাসে দেড় ঘন্টার যাত্রা। অন্যান্য দিন ঘরের মধ্যে থেকে অবসর কাটায়। দু একজন ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধু আসে। আসলে তারা বন্ধু কি না কে জানে! কোনোদিন লতা মঙ্গেস্করের বাংলা গান নয়তো মেহেদি হাসানের ফিল্মি গজল শোনে। উঁচু বারান্দায় চেয়ারে বসে গল্পের বই পড়ে। এক প্রতিবেশি মহিলা রান্নাবান্নার কাজে দুলুর মা’কে জুগিয়ে দিয়েছে। সে মহিলাও বিরামপুর উপজেলার। নিজ এলাকার লোক ভিন্ন জায়গায় একসঙ্গে হলে পরস্পরের প্রতি টান তৈরি হয়। বন্ধুত্ব হয়…সম্পর্ক হয় তেমন এক জানাশোনা।

আজ প্রায় ছয় মাস হয়ে গেল দুলুর মা এখানে কাজ করছে। শেষ দুপুরে বা বিকেলের দিকে এসে ভাত তরকারি রেধে দেয়। প্রায় দিন দুপুরে রান্না করতে হয় না। মাস্টার সেটি খালপাড়ার হোটেলে সারে। রাতের খাবার বাইরে খেতে ইচ্ছে করে না। তা ছাড়া এসিডিটি আছে। দুলুর মায়ের রান্নার হাত ভালো। মাঝে মাঝে যে দু একজন বন্ধু আসে। সেদিন দুপুরে রাধতে হয় তাকে। মাস্টার দরজা বন্ধ করে বন্ধুদের সঙ্গে কী সব গল্প করে। হা হা হো হো করে অট্টহাসি দেয়। সিগারেটের ধোঁয়া দরজার ফাঁক গলিয়ে দম ফেটে বাইরে আসে। আরও কিছু খায়। দুলুর মা রান্না ঘরে বসে শুধু টুং-টাং শব্দ পায় না, বিদঘুটে গন্ধও পায়। এ গন্ধ তার চেনা। তবে মাস্টারকে কোনোদিন মাতাল হতে দেখেনি। এ ঘটনাগুলো হয় বিশেষ করে ছুটির দিন আর শুক্রবার। আগের দিন বলে দেয়া হয়, –

‘দুলুর মা কাল একটু সকালে এসো। দু চারদিন হয়ে গেল গরুর গোস্ত খাওয়া হয়নি। দু একজন কলিগকে ডেকেছি।’
‘আচ্ছা ব্যাটা আসব।’

দুলুর মা জানে, কাজে এলে তার লাভ। এটা ওটা রান্নার সঙ্গে তারও ভাগ আছে। এসব বিশেষ দিনে প্রায় বিরিয়ানি রান্না করতে হয়। আরও কিছু অন্যপদ থাকে। একটি উৎসবের মতো আমেজ। সে ফুর্তি তার মনেও দোলা দেয়। যা কিছু রান্না করে সব গামলা ভর্তি করে নেয়। তার দেলোয়ার আর শিখা খুব তৃপ্তি করে খায়। তার জীবনে দুই ছেলেমেয়ে ছাড়া আর কে আছে। তাদের তৃপ্তির খাওয়া দেখে মনে কত শান্তি! অন্যান্য জিনিসপত্র সরানো বা হাতসাফাইয়ে কোনো তাড়া বা দরকার নেই। সবকিছু তার দখলে। এই করে তার নিজের ঘরে সুখের ছোঁয়া লেগেছে। দেখতে দেখতে শিখা ডাঙর হয়ে উঠেছে। ভালো খাবার না পেয়ে মেয়ে তার গায়ে গতরে কাঠ হয়ে থেকেছিল। এখন কি সুন্দর চেহারা! সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তখন তার নিজের যৌবনবেলার গল্প মনে পড়ে যায়। স্মৃতিতে ভেসে উঠে দেলোয়ারের বাপের মুখ।

৪.

মাত্র পনেরো বছর বয়সে একটি নাকফুল আর টকটকে লাল টাঙ্গাইল শাড়ি পরে স্বামীর ঘরে এসেছিল সে। ট্রাকের ড্রাইভার মজিবর মিয়া। কালাপাহাড়ের মতো বিশাল শরীর। ট্রাকের মালবোঝাই একেকটা ট্রিপ নিয়ে যেত দিনাজপুর টু ঢাকা। দিনাজপুর টু চট্টগ্রাম। দু তিন দিন পর ঘরে ফিরে মরার মতো ঘুমুতো। নাক দিয়ে বাঘের গর্জন। মুখ দিয়ে ভুরভুরে গন্ধ। বিকট…বিদঘুটে। তখন থেকেই চিনেছে মদ কাকে বলে।

সেই বয়সে তার এক নাম ছিল, পরী বানু। মজিবরের আদরের পরী। কখনো বানু। মজিবর কাজ শেষে যখন ফিরে আসে, গায়ে ডিজেল মবিলের সঙ্গে মিলেমিশে ঘামের বিকট গন্ধ। সে গন্ধ কত পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। লোকটি সারা রাত বল আর বালিশের মতো লোফালুফি করত তাকে। তেমন নিদ্রাহীন কত রাত যে কেটে গেছে তার কোনো ঠিক নেই। কয়েক বছরের মাথায় দু দুবার গর্ভপাত হয়ে যায়। তৃতীয়বার তেমনই হবে আশঙ্কা ছিল। দুর্ভাবনায় পরিণতি নিশ্চিত ছিল। তার কপালে সন্তান নেই। এ এক মিথ্যে মায়ার খেলা। আগের দুবার পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ মাসে হয়েছিল। এবারও তাই হবে। তার চেহারা সবসময় ভয় আর আশঙ্কায় বিমর্ষ হয়ে থাকত। তার মাঝে তবু একটি বিন্দুর মতো নিবু নিবু আশা। সেই আশা তার সকল বিপদ মিথ্যে করে দেয়। বেশ গাঁট্টাগোট্টা পুত্র সন্তানের মা হয় সে। মজিবরের মনে খুশি আর আনন্দ রাখার জায়গা ধরে ধরে না। খুব খরচ করে ছেলের নাম রাখা হয় দেলোয়ার। সেই দেলোয়ার আস্তে আস্তে হয়ে গেল দুলু আর তার নাম হলো দুলুর মা। পরী বানু হারিয়ে গেল। সে শুধু দুলুর মা। দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও চার-পাঁচটি বছর। সেবার চতুর্থবারের মতো পোয়াতি। শরীর আর চলে না। অনেক কষ্ট শেষে একদিন সন্ধেয় শিখার জন্ম হলো। ঢাকাইয়া পট্টির দু চার বাড়ির বউয়েরা এসে বেশ সোহাগ আর ঈর্ষা করে বলে বসে,-

‘দুলুর মায়ের কপাল! একটি ছেলে একটি মেয়ে। এমন ভাগ্য ক জনের হয়! আর দেখ লতিফাকে, একটা ছেলের আশায় আশায় চার চারটা মেয়ে হয়ে গেল। কি মুসিবত!’

দুলুর মা এসব শোনে। মনে মনে অবিমিশ্র তৃপ্তিতে মন ছেয়ে যায়। কিন্তু কথায় বলে, সুখ বেশি দিন থাকে না। একদিন তার কপাল পুড়ল। উপরওয়ালা সুখ কেড়ে নিল। মজিবর যথারীতি ট্রাক নিয়ে কাজে চলে গেছে। যশোরের ট্রিপ। আসতে যেতে সাড়ে তিন দিন। অথচ সাত-আট দিন হয়ে যায়, কোনো খবর নেই। মনের ভেতর কেমন এক আকুলি বিকুলি অস্থিরতা। কখনো কাজ করতে করতে হাত থেকে এটা ওটা পড়ে যায়। মাথা ঘুরে উঠে। ভেবে ভেবে পরে ঠিক করে, আগামীকাল মালিকের কাছে যেয়ে খোঁজ নেবে। ওদিক দিয়ে আবার অন্যকোনো ট্রিপে চলে গেছে কি না? তাকে আর যেতে হয়নি। শুক্রবারে নামাজের পরপর খবর আসে। খুব খারাব খবর…দুঃসংবাদ। রাজশাহীর বানেশ্বরে রাস্তার ধারে ধানের হাট-বাজার বসে। প্রতিদিন বাজার রাস্তার উপর উঠে যায়। ভ্যান ট্রলি নছিমন করিমনে মহাজ্যাম থাকে। লোকটি এক নছিমনকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রাক উল্টে মরেছে। সেই লাশ কেটে কেটে বের করা হয়। দেখার মতো নেই। কয়েকটি টুকরো মাত্র। বীভৎস! দুলুর মা নিজের লোকটিকে শেষ দেখা দেখতে পেল না। দেখা হলো না। সেখানেই পোস্টমর্টেম আর কি কি সব হয়ে মাটি দেয়া হয়ে গেছে। কফিনে পোরা লাশ আনতে অনেক খরচ। সে টাকা কোথায়? এভাবে তার কপালও মাটির নিচে চলে গেল। আছড়ে পড়ল জীবনের কঠিন দিনযাপনে। সেই থেকে এই পনেরো ষোলো বছরের জীবনে সে অনেককিছু দেখে এসেছে। বেঁচে থাকার কত মূল্যই না দিয়েছে! বুঝে গেছে দুনিয়াতে সরল সাদা মানুষ হওয়া এক বড় অন্যায়। এখানে সবকিছু কেনাবেচা হয়। দরদাম হয়। পৃথিবীর এ জায়গা এক দরদাম আর বেচাকেনার বাজার।

৫.

তখন শিখার বয়স ছয় সাত মাস। স্মৃতিতে ফিকে হতে শুরু করেছে স্বামীর চেহারা। হাল্কা হয়ে গেছে দুর্মর শোক। ট্রাকের মালিক আর শ্রমিক সমিতির লোকজন কতবার তার কাছে এলো। কী চমৎকার মিষ্টি কথা। তার জন্য কিছু করা যায় কি না! বড় ভালো লোক ছিল মজিবর মিয়া। নাবালক দুটি ছেলেমেয়ে রয়েছে। ওদের অনেক দায়িত্ব। ওরা যত কথা বলে, দুলুর মায়ের চোখ দিয়ে শুধু অশ্রু গড়ায়। সে হু-হু করে কাঁদতে থাকে। ট্রাকের মালিক হাতে গুঁজে দিল হাজার কয়েক টাকা। সে টাকার কি সুবাস! সমিতির লোক আবু সালেহ বলে, –

‘সমিতির পক্ষ থেকেও কিছু টাকা দেয়া হবে। মজিবরের জমানো টাকাও আছে। সে টাকা তুলে কিছু একটা করেন।’
‘কিছু তো করতে হবে ভাই।’

দুলুর মা আঁচলে দুচোখ মুছে শক্ত হতে চেষ্টা করে। মজবুত হতে হবে। সাহস আনতে হবে মনে। পিতৃকুলে তো কেউ নেই যে এগিয়ে আসবে। সে এখন একা মানুষ। সঙ্গে দুটি সন্তান। তাদের জন্য অনেক কাজ করতে হবে। অনেক দায়িত্ব।

একদিন সমিতির অফিসে গিয়ে সে টাকা তোলে। আবু সালেহ নিজে থেকে এগিয়ে এসে সকল কাজ খুব তাড়াতাড়ি করে দেয়। রিকশা ডেকে ঘরে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে। অবশেষে বাইশ হাজার টাকার মূলধন নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ে সে। জোড়া ব্রিজের এক কোণায় ভ্যানের উপর এক পান-সিগারেটের দোকান খোলে। ঘাগড়ার খালের উপর পাশাপাশি দুটো ব্রিজ…জোড়া ব্রিজ। তার দোকান বসে উত্তরে পূর্ব কোণায়। দোকানে বিস্কুট লজেন্স প্যাকেট জুস আরও কতকিছু রাখে। বিক্রি হতে শুরু করে বেশ। ধীরে ধীরে তার মনে সাহস এসে দাঁড়ায়। নিজেকে আর অসহায় মনে হয় না। মাঝে মধ্যে আবু সালেহ আসে। পরনে লম্বা ঝুল পাঞ্জাবি। জিন্সের প্যান্ট। তার দিক থেকে আতরের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশ। চকচকে দুচোখের দৃষ্টি কি যেন বলতে চায়। নাকের নিচে সরু বাটারফ্লাই গোঁফ। মুখে সবসময় স্মিত হাসি। এই লোকটিকে তার বেশ ভালো লাগে। তার জন্য অনেক করেছে। ভ্যান কেনা দোকান দেয়া সবখানে অকৃপণভাবে সহায়তা। এখনো খোঁজ খবর নেয়। এভাবে কথায় কথায় একটু সখ্যতা জমে। সে তাকে নিজের ঘরের লোক ভেবে নেয়। আবু সালেহ একদিন খুব কাছে এসে ফিসফিস করে, –

‘ভাবী আবার বিয়ায় বসবেন নাকি? আপনার বয়স তো কাঁচা। ইচ্ছা থাকলে একটু সাড়া দেন।’
‘না ভাই, বিয়া বইতে চাইতাম না। আমার দুলু আছে শিখা আছে, তাদেরে বড় করা লাগবে। সৎবাপে সেটা করতে দেবে? দেবে না। পুরুষ মানুষের আর দেখার বাকি নাই।’
‘তারপরও নিজের বলে কিছু তো আছে। মেয়েমানুষের একজন পুরুষ থাকা দরকার। অকর্মা নিষ্কর্মা যাহোক বুকে সাহস আসে। আপনি ইশারা করলেই হলো।’

সে কিছু বলে না। আবু সালেহ মিথ্যে বলেনি। পুরুষ মানুষ থাকলে বুকে আলাদা সাহস থাকে। নিশ্চিন্ত আর নিরাপদ থাকা যায়। কিন্তু মজিবরের স্মৃতি আর সন্তানের কথা ভেবে সে অনড়। না আর বিয়ে করবে না। এভাবেই কাটিয়ে দেবে সারা জীবন। অনেক মেয়ে তো এভাবে একা একা জীবন পার করে দেয়।

আবু সালেহ তবুও মাস কয়েক ঘুর-ঘুর করে। সময়ে অসময়ে এসে দরজায় ডাক দেয়। কোনো কোনো দিন মাছ বা মাংস এনে আবদার করে বসে, –

‘ভাবী আজ আপনার হাতের রান্না খাব।’
‘আইচ্ছা। তা বাজার করলা কেন? আমারে কইলেই হতো।’
‘বোনের কাছে ভাই কি খালি হাতে আসতে পারে?’

এ কথায় তার মন ভরে যায়। দেলোয়ার ‘মামা-মামা’ ডেকে আবু সালেহকে পেয়ে বসে। দুলুর মা তখন টিউবওয়েলের পাড় কিংবা আঙিনায় উনুনের কাছে বসে ওদের দেখে। একটু একটু করে আনন্দ তাকেও দোলা দেয়। কখনো অন্যরকম ভাবনায় চুপ করে থাকে। সে হয়তো সবকিছু বোঝে। একলা মেয়েমানুষের পেছনে কোনো পুরুষ এমনি এমনি ঘোরে না। অবশ্যই কিছু স্বার্থ আছে। মতলব আছে। যার কেন্দ্র সে। তার রূপ যৌবন শরীর। দুনিয়া এত ভালো জায়গা নয়। সে তবু কিছু বলে না। বলতে পারে না। সময়ে অনেককিছু বুঝেও মানুষের কিছু বলার ক্ষমতা থাকে না। সে একলা মেয়েমানুষ, মুখে সাহস কোথায়?

৬.

ওইদিন দোকান নিয়ে আর যাওয়া হয় না। রান্না শেষ করে খাবারের উৎসব চলে। আবু সালেহ তাগাদা দিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে বসে খায়। শিখাকে আদর করে কোলে নেয়। মাছের কাঁটা বেছে ওর মুখে ভাত তুলে দেয়। এসব দেখে আর অবিশ্বাস থাকে না। কোনো খারাব চিন্তা আসে না। আসার কথা নয়। হয়তো কিছু মৌন সমর্থনও থাকে। কোনোদিন কোনোরকম খারাব ঘটনা ঘটতে পারে এমন দুর্ভাবনা হয় না। আবু সালেহ আসে। একটু গল্প করে। ছেলেমেয়েকে আদর করে। কোনোদিন মাছ বা মাংস আনে। রেধে খাওয়ানোর আবদার ধরে। লোকটি বিয়ে শাদি করেনি, একলা মানুষ। ভালোমন্দ খেতে শখ করে। তার কাছে আসে। এতে দোষের কি! তাই তার আকস্মিক সকল আবদারে দুলুর মা কিছু বলতে পারে না। কোনো আপত্তি করে না। যত্নে করে রাধে। লোকটি খায়। তাকে ও তার ছেলেমেয়েকে তৃপ্ত করে খাওয়ায়। খাওয়ানোর মাঝে এক সুখ আছে। সে সুখ একান্ত নিজের। কোনোদিন সেসময় দুলুর মা’র স্বামীর কথা মনে পড়ে। আহা লোকটি বেঁচে থাকলে কতকিছু রেধে খাওয়াত। সাধ করত। তার দুচোখ ঝাপসা হতে থাকে। ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে মারে। মুখ সরিয়ে দুচোখ আঁচলে মোছে। আবু সালেহ তা দেখে গম্ভীর হয়। চেহারায় কালো ছায়া পড়ে। খুব আন্তরিক গলায় বলে বসে, –

‘দুঃখ করেন না ভাবী। যে যাওয়ার সে চলে গেছে। উপরে ভালোই আছে। চোখের পানিতে তার কষ্ট বাড়ান কেন?’
‘কাঁন্দি না ভাই কাঁন্দি না, খালি দুঃখ আসে।’

এভাবেই একদিন আবু সালেহর আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। সত্যি বলতে দুলুর মা তখন পাথরের দুনিয়ায় নতুন নেমেছে। আসল নকল বোঝার মতো মন পাকাপোক্ত হয়নি। তারই খেসারত সেদিন দিতে হয় তাকে। ভাবী বলে যে লোক মাথা নিচু করে কথা বলত, দুচোখে সমীহ; সে হিংস্র বাঘ হয়ে থাবা উঁচিয়ে ধরে। দুপুরের নির্জনতায় তার সবকিছু মুখ চেপে ধরে নিঃশেষ করে দেয়। তখন বিছানার একধারে শিখা শুয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে শুধু। এরপর সেই লোক আর ঘুরে আসেনি।

৭.

দুলুর মা মনের ভেতর এক দগদগে ক্ষত নিয়ে ভ্যান ঠেলে জোড়া ব্রিজ আসে। দোকান সাজায়। মাথার উপর বড় এক ছাতা মেলে দেয়। অনেকসময় ছাতার ছায়াকে বাহুল্য মনে হয় তার। সূর্যের তাপ সহ্য করা যায়। জীবনের ছোট ছোট দুঃখ-বেদনা আর আঘাত, সেও সয়ে যায়। নিয়তি তাকে আঘাত দিয়েছে। দুঃখ পায়নি। কিছুদিন শোকাভিভূত থেকেছে। আবার উঠে দাঁড়ায়। মানুষ তাকে প্রতারণা করে আঘাত দিয়েছে। সে আঘাত সহ্য হয় না। সে আঘাতের ঘা শুকাতে চায় না। এভাবে চলছিল। একদিন সন্ধের আগে আগে দু-তিনজন যুবক দোকানে আসে। দেখে কলেজের সিনিয়র ছাত্র মনে হয়। সে তাদের কথা মতো পান বানিয়ে দেয়। পছন্দমতো সিগারেট দেয়। তারা লাইটার নিয়ে তা জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। তার মুখের উপর ফু করে ছড়িয়ে দেয়। বলে, –

‘কার হুকুমে এখানে দোকান দিছিস? বড়ভাই জানে?’
‘বড়ভাই কেডা ভাই?’
‘দে দু শ টাকা দে। এখানে দোকান দিলে প্রতি মাসে দু শ টাকা দিতে হবে।’
‘ভাই সরকারি জায়গা। আমি গরিব বিধবা মানুষ। আপনারা খেদায়া দিলে কী করে বাঁচুম?’
‘তাহলে শোন আমরা কিছু মাল দেব ওগুলো বেচবি। তোকে চাঁদা দিতে হবে না। ফ্রি দোকানদারি করবি।’
‘আইচ্ছা ভাই, দিয়েন।’

পরে দেখে তারা তাকে হেরোইনের পুরিয়া দিচ্ছে। ছোট ছোট শিশিতে ফেন্সিডিল বের করে। সে আতঙ্কে কাঠ হয়ে যায়। বলে, পারবে না। এসব ধান্ধা করতে বুক কাঁপে।

‘ভাই আমারে মাফ করেন। আমি এসব রাখতে পারুম না। ডরে বুক কাঁপে।’
‘বুক কাঁপে মাগি…দেখিস কেমন কাঁপুনি ধরাই।’

কয়েকদিন পর আবার তারা আসে। তখন সন্ধে রাত। দোকান গুটিয়ে ফেরার সময়। এবার সঙ্গে আর একজন আছে। সে কিছু দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে এক আধময়লা কারের ভেতর। সেখানে বসে তাকে দেখতে থাকে। শহরের খুব পরিচিত মুখ। রাজনীতি করে। কে না চেনে তাকে…কে না জানে! অনেকের বড়ভাই সকলের স্যার। ওদের একজন বলে, –

‘চল স্যার ডাকছে কি বলে শুনে দেখ।’
‘চলেন।’

সে যেতে যেতে কারের পেছন দরজা খুলে যায়। পেছন থেকে কে যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে সে সামলাতে পারে না। সম্বিত ফিরে পেয়ে বোঝে, একজন তার মুখ চেপে ধরে আছে। সে চিৎকার করে উঠে। দম বন্ধ হয়ে যায়। তখন লোকভবন হয়ে কার ছুটে চলেছে কালিতলার দিকে। সেখানের এক গলিতে এক দোতালা বাড়ি। তার অন্ধকার কোনো এক ঘরে দ্বিতীয়বারের মতো সব হারায় সে। একে একে কতজন এলো বুঝতে পারে নাই। যখন জ্ঞান ফেরে, দেখে অনেক রাত। সমস্ত শরীরে অসহনীয় ব্যথা। জোড়া ব্রিজের উত্তর পাশে নিচু এক জায়গায় পড়ে আছে সে। সেখান থেকে উঠে বুঝতে পারে, রাত প্রচণ্ড নিশ্চুপ গভীর। সে রাত ভয়ানক কালো। তার চেয়ে আরও ভয়ংকর জীবনের রাত। সে দৃষ্টি ফেলে দেখে ব্রিজের কোণায় তার ভ্যানটি নেই। দোকান হারানোর শোক তাকে কাবু করে না। নিজের জীবন আর বেঁচে থাকার সকল দিনযাপন তাকে ক্লান্ত করে দেয়। সে এক অন্য কথা ভেবে নেয়। এখন থেকে সে এই করবে। কথায় বলে, এক পুরুষে পত্নী, দুই পুরুষে দ্বিচারিণী আর এর অধিক হলে কুলটা। সংসার-ত্যাগিনী। তার কোনো সংসার নেই। সে কুলটা।

তখন থেকে সে এক অন্ধকার দুনিয়ায় পা রাখে। সময়ে কেটে গেল আরও কয়েক বছর। কখনো কোনো রাতে ঘুম থেকে চমকে উঠে বসে। নিজেকে গাল দেয়। সব তার নিজের দোষ। হয়তো মনের অজান্তে লাই পাওয়া কোনো পাপে তারও দায় ছিল। তা সে যাহোক নিচে যখন নেমে গেছে, সেখানেই থাকবে; উপরে তাকানোর দরকার কি? কেনাবেচা আর দরদামের এই সংসারে সে এক পণ্য মাত্র। ধীরে ধীরে সে কারবারি হয়ে যায়। এতে কার ভালো হলো কিংবা ক্ষতি তা দেখলে চলে না। তা দেখার কোনো নিয়মও নেই।

দুলুর মা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তরকারির ডেকচিতে চামচ নেড়ে দেয়। ইলিশ মাছের চনমনে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশ। সে মাথা উঁচু করে মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকায়। দেখে মাস্টার আবার ঘরের ভেতর চলে গেছে। বেশ জোর ভলিউমে ক্যাসেট বাজছে, ‘জওয়ানি জানেমান হাসিন দিলরুবা।’ তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত হাহাকার বেজে উঠে। ছুড়ি মজেছে বেশ। মাস্টার বিয়ে করবে এমন মানুষ হয়তো সে নয়। রংবাজ লোক। কয়েকদিন মৌজ করবে। তারপর ছুঁড়ে ফেলবে। এ কথা সত্য না হলে কান কেটে কুকুরের গলায় ঝুলিয়ে দেবে সে। জীবনে কম পুরুষ দেখেনি। এ লোকের চোখ তার চেনা হয়ে গেছে।

৮.

কথায় বলে অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর। দুলুর মা পঁচিশ ছাব্বিশ বছরে বিধবা হয়েছিল। আর দু চার বছরে পঞ্চাশের বুড়ি হয়ে গেল। মনের সাধ আহ্লাদ সেই এক্সিডেন্টের সঙ্গে কবরে চলে গেছে। ইচ্ছে করলে কিংবা একটু স্বার্থপর হলে আবার নতুন করে সবকিছু সাজানো যেত। কেউ কেউ তো শ্মশান থেকে ঘুরে এসে মাথায় টোপর দেয়। লাল শাড়ি পরে। সে পারেনি। বৈধব্যের সাদাতে হারিয়ে গেল। তার মনের মধ্যে তেমন তাগিদ ছিল না। ছোট ছোট সন্তান দুটিকে অবলম্বন করে কষ্টের মধ্যে বাঁচতে চেয়েছে। সেখানেও সে বিফল হলো। দেলোয়ার তার বাপের মতো এদিক ওদিক পালিয়ে বেড়ায়। স্কুলের বই-খাতা কোন্ ফাঁকে ঘরে ফেলে রাখে। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ফিরে আসে দু এক মাস পর। তাগাদার কারণে কিছুদিন স্কুলে যেতে শুরু করে। কিন্তু স্কুলের তো নিয়ম আছে। সে নিয়ম তার ইচ্ছেমতো চলে না। তারপর আবার সেই ঘটনা। ব্যাপার কী? সমস্যা কী? না, পড়ালেখা ভালো লাগে না। বেঁচে থাকার এইসব জটিলতার জটে দুলুর মা’র মাথা গুলিয়ে উঠে। বোঝে, রক্তের দোষ। ছেলের শরীরে মাতাল ড্রাইভারের রক্ত বইছে। তার দ্বারা ভালো কিছু হবে না। শেষে একদিন আপনিই ও পাঠ চুকে গেল। এখন দেলোয়ার কত ঠাণ্ডা। বাধ্যগত। দোকানে কাজ করে। কোনোসময় রিকশা চালায়। সংসারে একটু সুবাতাসের ছোঁয়া লাগে। সেই তুলনায় শিখা, বড় আদরের মেয়ে তার; কলেজে ভর্তি হয়েছে। দেখে কে বলবে গরিব ঘরের মেয়ে। এ যেন তার কিশোরী বয়সের ছায়া।

৯.

দুলুর মা চমকে উঠে।  ফরহাদ মাস্টার এত শব্দ করে গলার কফ বের করে জানা ছিল না। নাকি শ্লেষ্মা বমি করছে? মনে হয় বাথরুমের দেয়াল থেকে দেয়ালে পাহাড় ভেঙ্গে পড়ছে। লোকটিকে হয়তো তার আজও চেনা হলো না। রহস্যময়। ছোট ছোট দুচোখের দৃষ্টি ভারি অদ্ভুত। সাপের মতো ঠাণ্ডা আর পলকহীন। পিট পিট করে তাকায়। মাঝে মধ্যে তার নিজেরই গা শিহরে উঠে। এ ধরনের লোকের লক্ষণ নাকি ভালো নয়। মারাত্মক ঘাগু। শুধু ছোঁবল মারা তার কাজ। এই কয়েক মাসে যা দেখল সেও এক অভিজ্ঞতা। তার চোখ ফাঁকি দিতে চাইলে যে কেউ দিতে পারে। কিন্তু সে বোঝে। হয়তো সবকিছু বোঝে। পুরো না হলে কিছুতো বোঝে। কিছুতো দেখে। তবু বুঝেও সে কিছু বোঝেনি। দেখেও সে কিছু দেখেনি। দুনিয়াতে কে কি করছে…কে কিভাবে চলছে, চলুক। অত মাথাব্যথা নেই। একসময় শরীর বেচে এসেছে। এখন অন্যের বেচে। সেখানে দরদাম আছে। দামদর করতে কখনো ঠকেছে। সেই ঠকায় বারো আনা লাভ। শিখেছে কি করে দর হাঁকতে হয়। এভাবেই সে আজ অনেক পটু। এরপর কোথাও হারেনি। যার হারাবার কিছু নেই সে হারে না। তারপর বাসাবাড়িতে কাজ করে চলে। এই তার জীবিকা। এখানে কাজ করতে এসে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সবকিছু ছেড়ে দেয়া। সে তার নিজের ইচ্ছেমতো সকল জিনিস ব্যবহার করে। চুপ করে একটু মশলা কি চিনি বা অন্যকিছু নিয়ে যায়। দেখার কে আছে! সে অনেক স্বাধীন। তাই মনের আবেগ দিয়ে কাজ করে চলে। মাস্টার একা মানুষ। দু একটি গল্প করে। বাড়িতে কে কে আছে, বউ আছে কি না, এতদিনে বিয়ে করে নি কেন ইত্যাদি। শেষে একদিন বলে বসে, –

‘বয়স তো হলো ব্যাটা বিয়া করবেন না? বিয়া করেন। পুরুষ মানুষ একা থাকা চলে?’
‘সেটা তো করতে হবে দুলুর মা। আগে একটু টাকা জমিয়ে ফেলি। খুব ইচ্ছা এখানের কোনো ঘরে আত্মীয়তা করি।’
‘আমার দু একটা বাসায় কাজ আছে। কারও ঘরে বেশ সুন্দর মাইয়া। কইলে আলাপ করতে পারি।’
‘তুমি ঘটকালিও করো নাকি?’

জবাবে দুলুর মা ফ্যাশ ফ্যাশ হাসে। সে ঘটকালি করে। সেটি অন্য এক বিয়ের। সে খবর কেউ জানে না। সে অন্যের খবর রাখে। কে কি করে সে খবর তার নিজের কাছে। কতকিছু যে এই দুনিয়ায় হয়! এক বাড়ির ডেকচিতে ভাত টিপে আরেক বাড়ির রান্না বুঝতে পারে। খবরাখবর পায়। যত খবর তত লাভ। এর আগে জামান মোক্তারের বাড়িতে ছিল। ও বাড়ির তিন নম্বর মেয়ের ঘর আসে। পাত্রপক্ষ তার কাছে খোঁজ খবর নেয়। বেশ গোপনে। সে বলেছে…প্রাণ খুলে বলেছে। ‘মাগি দেখতে রূপসী হলে হবে কি, কথাবার্তায় খুব ঠ্যাঁটা। শোনা যায় কলেজে কোন্ ছেলের সঙ্গে পিরিত ছিল। পালিয়ে ছিল ক দিন।’ এভাবেই সে প্রতিশোধ নেয়। একদিন কি কাজে, মনে নেই মেয়েটি তাকে খুব করে গরম দেখিয়েছিল। এ কাজ করার পর অবশ্য অনুতাপ হয়। ঠিকঠাক বিয়ে হলে কিছু উপরি পাওয়া যেত। যাক তকদিরে নেই তো কি হবে!

আজ ফিরে যাওয়ার আগে মাস্টারের কাছে পাঁচ শ টাকা চাইবে। গত শুক্রবার দু শ দিয়েছিল। এখন তার টাকার দরকার। রুনির কাছেও নেয়া যেতে পারে। অবশ্য দিতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে সে যে অনেককিছু জানে, মুখ খুলতে চায় না তার ইঙ্গিত দেয়া যায়। এক মুখ বন্ধ করতে অন্য মুখে কথা আনতে হয়। সে কথা বলবে। একটু শুধু মুখ খুলবে। এখন পর্যন্ত তেমনকিছু বলেনি। বুঝে গেছে ইচ্ছে করলে দুদিক থেকে টাকা কামানো যায়। মানুষের গোপন খবর জানা থাকলে কাবু করা খুব সহজ।

অথচ আজ মাস্টার বলে কি না, দুলুর মা তুমি কিছু দেখনি। আসলে সে কিছু দেখেনি। কিছু বোঝেনি। এখানের কাজে নতুন নতুন এসে সে অনেককিছু দেখেছে। কিন্তু কিছু দেখেনি। দেখার দরকার কি? ওতে মন পোড়ে। পুরনো কথা মনে পড়ে। তা শুধু যন্ত্রণা। অসূয়াকাতর অনুভূতি হয়। কোনো কোনো রাতে দুচোখে ঘুম আসে না। মুখোশে ঢাকা মানুষের কত চেহারা ভেসে উঠে। সবার মুখের উপর একটি অন্যরকম চেহারা। সেঁটে থাকা চেহারার মুখোশ। তার চেহারাতেও একটি মুখোশ আছে। তা দেখতে কেমন? সে জানে না। কখনো কখনো সেই মুখোশ খুলে আসল মুখ বেরিয়ে আসে। খুব অচেনা মনে হয়। এমন তো ছিল না সে! তখন নিজের জন্য, হয়তো অন্যকোনো অপরিচিত মুখের জন্য বুকের ভেতর দুঃখ বেজে উঠে। তীব্র লাগে।

১০.

একবার ফরহাদ মাস্টারের কাছে এক হিন্দু মেয়ে এলো। মেয়ে নয় মহিলা। বেশ অল্প বয়স। সদ্য বিবাহিত মনে হয়। সিঁথির সূচনায় সিঁদুরের টকটকে লাল প্রচণ্ড উজ্জ্বল। শুক্রবারের দিন। মেয়েটি উঁচু বারান্দায় চেয়ারে বসে ছিল। মাস্টার নামাজ শেষে ঘরে ফিরে আসে। দুলুর মা টেবিলে ভাত তরকারি সাজিয়ে দেয়। নিজের জন্য গামলায় আগে তুলে রেখেছে। খাসির গোস্ত আর পায়জাম চালের ভাত। সেই ভাতের ভাঁপের মধ্যে উন্মাতাল সুবাস। মাস্টারের সঙ্গে মেয়েটিও খায়। দুলুর মা রান্নাঘরে বসে বসে সবকিছু দেখে। কিছ কথা কানে আসে। কি সব লোন টোন ইত্যাদি অফিসের কথা। সে তত বুঝতে পারে না। অপেক্ষায় থাকে। এঁটো থালাবাসন পরিষ্কার করে একেবারে যাবে। বিকেলে আবার আসার ইচ্ছে নেই। এখনও নেই। হুট করে একজন চলে এসেছে। তাই এক মগ চাউল উনুনে বসিয়েছে সে। মাস্টারের রাতের খাবার। সেটি হয়েও এসেছে প্রায়। তারপর কি এক অজ্ঞাত আকর্ষণে বসে থাকে। যা ভেবেছিল তাই! মাস্টার একেবারে ভরদুপুরে মেয়েটিকে ঘরে ডেকে নেয়। একটি বন্ধ করে একজোড়া নারী-পুরুষ এমন সময়ে গল্প করতে বসে না। সে সব বোঝে। তার হাত-পা স্থবির হয়ে যায়। খুব বিশ্রী এক অনুভূতি হতে থাকে। কুয়োর পাড়ে থালাবাসন মাজতে মাজতে কতকিছু শোনে। তার চোখদুটো কি আশ্চর্য নির্বিকার। বউটি ফিরে যাওয়ার সময় মাস্টারকে বেশ কাতর গলায় বলে, –

‘স্যার এ সপ্তাহে কাজটা করে দেন। টাকার খুব দরকার।’
‘চিন্তা করবেন না সামনের সোমবার একাউন্টে লোন চলে যাবে।’

দুলুর মা অফিসের কথা তেমন বোঝে না। মেয়েটির অসহায় চেহারা দেখে কেন জানি শুধু কাতর হয়ে পড়ে। হায়রে দুনিয়া!

১১.

সেদিন ভোরবেলা এমন হাতে পায়ে চমকে উঠতে হবে দুলুর মা ভাবেনি। শিখা তখন দু কানে হেডফোন লাগানোর চেষ্টা করছে। মুখে দুষ্টুমির নীরব হাসি। তার প্রজাপতি বেণীর গোড়ায় বাঁধা লাল ফিতের ফুল মুচড়ে গেছে। মেয়ের এ রকম আদুরে কাজকর্মে কোনোদিন অবাক হয়নি সে। ছেলেমানুষ। একটু বেশি আদরে বোকা বোকা…বুঝে-সুঝে কম। আজ মেয়ের প্রচণ্ড খুশি খুশি চেহারা। তারপর সত্যি বলতে বিস্ময়ের এক ধাক্কা খেল দুলুর মা। মেয়ের হাতে মোবাইল এলো কোত্থেকে? তার হাতে ধরা ছোট জিনিসটি থেকে চকচক বর্ণিল আলো বিচ্ছুরিত হয়। শিখা এত টাকা পেল কোথায়? কলেজে কিসের সব টাকা পাবে জানা ছিল। ওই টাকায় কিনেছে? নানান ভাবনা আর প্রশ্নের মাঝে সে খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। এই একটি গুণ তাকে ধৈর্য ধরে থাকার ক্ষমতা দিয়েছে। সে যথাসম্ভব নিস্পৃহ গলায় বলে, –

‘মোবাইল কোনে পাইলি? বেশ দামি তো! গান বাজনা হয়?’
‘আমারে একজন দিছে গো মা।’
‘একজন মানে…তোর সাথে পড়ে না কি? কেডা সে?’
‘না মা তুমি যেহানে কাজে যাও, হেই যে গেল মাসে কি পার্টি হলো, আমারে নিয়া গেলা। বিরিয়ানি বাচছিল অনেক।’
‘হেই ব্যাডা? ওর লগে তুর যোগাযোগ কেমতে হলো?’
‘কলেজে সরকারি টাকা তুলতে হয় না? দেখি উনি সেই ব্যাংকে বসা। জানো মা আমারে খুব তাড়াতাড়ি টাকা উঠায়া দিছে। ব্যাডায় খুব ভালা মানুষ। তুমার কথা কইল। তুমার রান্নার বাখ্যান করল।’
‘নে চুপ যা।’

এরপরের কোনো কথা তার কানে ঢোকে না। মাথার মধ্যে দুর্ভাবনার এক ভয়ার্ত বীজ ডালপালা হয়ে গজিয়ে উঠে। চারপাশে ছড়িয়ে যায়। এমন একজন মানুষের খপ্পরে তার মেয়ে পড়েছে! তার বুকে শত বজ্রপাত আছড়ে পড়তে থাকে। বিবিধ কথা আর ভাবনা জট পাকিয়ে যায়। থিরথির করে হাত-পা কাঁপে। সে কিছু বলে না। বলতে পারে না। মেয়ের মুখের দিকে দৃষ্টি দিয়ে সে দূর কোনো ভাবনায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে। শিখাকে সতর্ক করে দিতে হবে। সামনের মাস পড়লে ও বাসার কাজও করবে না। এই ভাবনায় কতক্ষণ চলে যায় কে জানে।

‘তুরে এমুন দামি জিনিস দিল ক্যা?’
‘আমারে জিগাইল কেমুন আছি, সব বই কিনছি কি না, পড়ালেখা কেমুন হইতাছে এইসব। তারপর নাস্তা খাওয়াইল। শেষে বলে, তুমারে আমার ছোটবোনের মতোন দেখতে লাগে। মায়ের লগে মাঝে মধ্যে বাসায় আইস। উনি আমারে পাঁচ শ টাকা দিলেন। পরশুদিন এই মোবাইল দিছেন।’
‘তুরে দিল আর নিলি? আমারে পুছ করতে পারলি না? আর ওই ব্যাডার লগে কথা কছ তা ক, কিন্তু ঘুরোছ, তাতো কস নাই। হে ব্যাডা ভালা না।’
‘কি যে কস মা, ভালা না হলে তুই ও বাড়ির কামে যাস?’

দুলুর মা কথাতে মেয়ের সঙ্গে পেরে উঠে না। এত কথা বলারও কি প্রয়োজন! সে চুপ করে অন্য কাজে মন দেয়। ভাবনা তাকে ছাড়ে না। ভাবনা নয়, দুর্ভাবনা। কথায় বলে চোরের মন পুলিশ পুলিশ। সে কেনাবেচা দরদামের লোক। এক অজানা আশঙ্কায় তার স্বস্তি হারিয়ে যায়। বারবার ভাবতে থাকে মেয়েকে বোঝাতে হবে। নিষেধ করবে আর যেন না মেশে।

১২.

দুলুর মা’র মনে পড়ে গত মাসের কোনো এক বৃহস্পতিবার। সে উঠোনের উত্তর কোণার উনুনে ডাল সিদ্ধ বসিয়েছে। বটিতে কুটছে সবজি। সেদিন শুধু সবজি ডাল। সঙ্গে ডিম মামলেট। রুটিনমতো হাল্কা খাবার। ফরহাদ মাস্টারের মাঝে-মধ্যে এমন খাবারের বাতিক আছে। দুলুর মা’র হাতের সবজি রান্না নাকি বেশ ভালো হয়। এ কথা শুনে তার ভালো লাগে। বুকের কোণায় কিছুক্ষণ একটু উৎফুল্লতা নেচে বেড়ায়। তার নিজের লোকটিও রান্নার প্রশংসা করত। আঙুল চেটেপুটে খেত। সে সবজি কুটতে কুটতে বিকেল দেখে। আকাশ দেখে। হায় আকাশের কোন্ ঘরে মানুষটি আছে সে জানে না! সে কি তার জীবন আর বেঁচে থাকা দেখে?

আছরের আযান হয়ে যায়। মাস্টার ক্যাসেটের গান বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়। বারান্দায় আসে। বারান্দা উঠোন থেকে তিন ফুট উঁচু। নিচ থেকে উপরের মানুষকে অন্যরকম দেখায়। দুলুর মা নিচের মানুষ। উপরে তাকাতে পারে না। সূর্যের তির্যক রশ্মি চোখে এসে দৃষ্টি ঝিলমিল করে দেয়। সে শুধু দেখে একটি ছায়া। সে ছায়া কালো আর অনেক লম্বা। অনেক বড় লম্বা হাত। ছায়াটির মাথায় খুব দামি সোনালি এক টুপি। মাস্টার মসজিদে যাচ্ছে। লোকটি পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ে। বারান্দা থেকে বেশ জোরে এক কথা হয়। দুলুর মা শোনে, –

‘বুঝলে দুলুর মা একটা প্রমোশন হলো কাল। এখন আমি সেকেন্ড ম্যানেজার। ব্যাংকের কলিগেরা মানে একসাথে কাজ করি, তারা আগামীকাল রাতে এখানে খাবে। এই ধরো পাঁচ সাত জন মানুষ। তোমার ছেলেমেয়েকেও নিয়ে আসবে। তুমি একটু সকাল সকাল এসো। বিরিয়ানি রোস্ট কোপ্তা সালাদ আর কি কি সব করতে হবে। দই মিষ্টি আর যা রেডিমেড পাওয়া যায় তা কেনা যাবে। কাল সকালে কোনটা কতটুকু কেনা দরকার হিসাব করতে হবে।’
‘আইচ্ছা ব্যাটা আইচ্ছা, খুব ভালা খবর।’

মাস্টার তার হাতে একটি গোলাপি নোট তুলে দেয়। হাজার টাকার নোট। টাকা যে কোনো মানুষের মন ভালো করে দিতে পারে। কথায় বলে টাকা হলো ঈশ্বর। ঈশ্বরের ক্ষমতা অনেক। দুলুর মায়ের মন খুব ভালো হয়ে যায়।

১৩.

দুলুর মা পরদিন সকালে সুন্দর করে হিসাব দেয়। দশ জনের আন্দাজে যা কিছু রান্না। সে হিসাবে এতটুকু ভুল নেই। দুই পদের মাংস, ছোট মৃগেল মাছ অথবা ইলিশের ফ্রাই, জিরা কাটারি চাউল, মশলা, একটু জাফরান, আরও কত কি! ফরহাদ মাস্টার একটু বেশি বেশি কিনে নিয়ে আসে। থেকে গেলে অসুবিধা নেই। দুলুর মা খুব মন দিয়ে একটির পর একটি রাধতে বসে। এসব করতে করতে উনুনের তাপে তার চোখে মুখে গরম ভাপ বেরোয়। মরিচ বাটতে হাতে ঝাল ধরে যায়। সে কোনোকিছু ভ্রূক্ষেপ করে না। মাস্টারের চাকুরির উন্নতি বলে কথা! এমন মানুষের দিনকাল খুব ভালো চলে যায়। সবদিকে নজর তাদের সবদিকে উন্নতি। বিকেলে দেলোয়ার আর শিখা চলে আসে। সে একফাঁকে ছেলেকে রান্নাঘরে বসিয়ে খাওয়ায়। অনেক ভালো লাগে তখন। শিখা তাকে কাজে সাহায্য করে।

সেদিন সবকিছু চুকে গেলে অনেক খাবার বেঁচে যায়। যত জন আসার কথা, তারা সকলে আসেনি। ব্যাংক অফিস সপ্তাহে দুদিন ছুটি। কেউ কেউ দেশের বাড়ি চলে গেছে। দুলুর মা রাতে বেঁচে যাওয়া খাবার নিয়ে ছেলের রিকশায় ওঠে। দেলোয়ার বেশ ধীরে ধীরে রিকশা চালায়। তখন বেশ রাত। মায়ের পাশে বসে শিখা ফিসফিস করে, –

‘এই ব্যাডা লোকটা তো বেশ ভালা মানুষ মা! আমারে পাঁচ শ টাকা দিছে। বলে মিষ্টি কিন্যা খাবা। ভাইরেও দিছে। দিছে না ভাই?’
‘কি?’
‘মানুষটা তুমারে টাকা দিছে না?’
‘হ। এ টাকা কাউরে দিমু না।’

দুলুর মা ছেলেমেয়ের খুশি দেখে প্রসন্নতার বাতাসে আন্দোলিত হয়। আসলে মাস্টার লোকটি অত খারাব না। একটু যা এদিক ওদিক…তা পুরুষ মানুষের সামান্য দোষ থাকে। বিয়ে শাদি হলে সব ঠিক হয়ে যায়।

আজ দুলুর মা সেদিনের ওই সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল কি না সেই ভাবনায় দোদুল্যমান হয়ে পড়ে। সেটি নিয়ে আবার অত মাথা ঘামাতেও চায় না। নিজে ঠিক তো দুনিয়া ঠিক। না…না, কথাটি হয়তো ঠিক নয়। সেও তো এমন ভেবে আর বিশ্বাসে জীবনের পথে চলতে চেয়েছিল। শোকের বুকে কাফন চড়িয়ে হাজারও কষ্ট মেনে নিয়েছিল। কী হলো শেষে? সে দায় কে নেবে? চতুরদের শঠতা আর ভ্রষ্ট সময়ে কেউ কারও দায় নেয় না। অন্যের পাপের বোঝা বোকা আর দুর্বল মানুষদের সারা জীবন টেনে চলতে হয়। তাদের জীবনে কোনো সুখ থাকে না। এত আনন্দের পৃথিবীতে তারা নরকের কীটের মতো বেঁচে থাকে। সে নরকের এক কীট। তার সর্বাঙ্গে কুষ্ঠব্যাধীর ঘা। সে ক্ষতে শুধু দুর্গন্ধ। অথচ সেসবের জন্য সে দায়ি নয়। যে কাজ সে করেনি, চিন্তা করেনি প্রবঞ্চক মানুষের কারণে তার জন্য তাকে পেতে হয়েছে এক দুঃসহ শাস্তি। এসব ভাবতে ভাবতে তার মন বিষণ্ন হয়ে পড়ে। অস্থিরতা ছেঁকে ধরে। সিদ্ধান্ত নেয়, মেয়েকে সাবধান করে দিতে হবে।

১৪.

এতকিছুর পর একদিন ঘরে ফেরার পথে সে দ্বিতীয়বার আঁতকে উঠে। তখন সন্ধে রাত। হয়তো সাড়ে আট কিংবা নয়। লোডশেডিং চলছে। চারপাশের দোকানগুলোর কোনোটিতে জেনারেটর বিদ্যুৎ। সেখানে কিছু আলো। বেশিরভাগ এলাকা আলোছায়া অন্ধকার। তারপরও সে ঠিক দেখে। পরিচিত রাস্তা। খুব চেনা অলিগলি। গাছ গাছালি আর মানুষজন। আকাশে শ্রাবণের মেঘ। কিছুক্ষণ আগে সামান্য বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভিজে আছে পিচ কালো রাস্তা। বালুময় মাটি। তখন তার দৃষ্টি দূরের ক্যাফেটারিয়ায় আটকে পড়ে। আকস্মিক হাত-পা ঠাণ্ডা হতে চায়। দেখে তার মেয়ে শিখা। ফরহাদ মাস্টার গোল টেবিলের অপরদিকে বসে। মুখে স্ট্র ধরে অদ্ভুত লম্বা গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। মেয়েকে তার কত সুন্দর দেখায়! একেবারে ফিল্মের নায়িকার মতো। এসব ভাবনার মাঝে খুব দ্রুত শিরশিরে এক ভয়ের স্রোত তার বুকের ভেতর নেমে যায়। সেখানে প্রচণ্ড ঢেউ তুলতে থাকে। মেয়েকে সে চালাক ভেবেছিল, সে তা নয়। শিখা খুব বোকা মেয়ে। তাকে সাবধান করেছে। কত নিষেধ করেছে। শোনেনি। আজ তাকে আবার সাবধান করে দিতে হবে। খুব বকাবকি করবে।

সে দ্রুত ঘরে এসে ছটফট করতে থাকে। ক্লান্ত শরীর মন নিয়ে শুধু অপেক্ষা আর আক্ষেপ। যে ঈশ্বরের প্রতি একদিন অনেক অভিমান করেছিল, দূরে সরে এসেছিল, তাকে কেঁদে কেঁদে ডাকে। অন্তরের সেই কথামালা হাজার গুঞ্জন হয়ে দেয়ালে আছড়ে পড়ে। সে বলতে চায়, এখন আর মিথ্যে কথার বেসাতি করবে না। মানুষের কেনাবেচা দরদাম করবে না। যা করার করেছে, ভুল করেছে; আর করবে না। হে আল্লাহ তুমি মাফ করে দাও। সে আকুল প্রার্থনা ঈশ্বরের কাছে পৌঁছল কি না কে জানে, সে তেমন ভরসা পায় না।

একসময় শিখা ঘরে ফিরে আসে। তখন বেশ রাত। দুলুর মা খুব আদরে মেয়েকে কাছে টেনে নেয়। তার দুটো হাত নিজের হাতে চেপে ধরে কত কথা বলে। সে কথার পিঠে কত শঙ্কা কত আদর লুকিয়ে থাকে, শিখার দুচোখ ঝাপসা হয়ে যায়। তার চোখেও দুর্বোধ্য কান্না নামে। তারপর আবার দুজনে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ। অবশেষে আর একবার সে মেয়েকে বোঝানো চেষ্টা করে। শিখা যেন পিছল পথে কোনোমতেই না হাঁটে। তারা গরিব মানুষ। গরিবদের কোনো শক্তি নেই। কোনো বড় স্বপ্ন দেখতে নেই ইত্যাদি। শিখা মায়ের দুচোখ মুছে দিয়ে জানিয়ে দেয়, সে ঠিকমতো চলবে। কারও সঙ্গে আর মিশবে না।

এভাবে কেটে যায় আরও কয়েকটি দিন। ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে পড়ে সমূহ দুশ্চিন্তা। জীবন চলে যথারীতি জীবনের পথে। সে পথ কেউ জানে…কেউ জানে না।

১৫.

আজ দুলুর মা নিয়মমতো বিকেলে কাজে আসে। দুটো দিন। ফরহাদ মাস্টারের এখানে আর কাজ নয়। মনস্থির করে ফেলেছে। পশ্চিমে ঘরের পাশ দিয়ে সরু গলি পুবে চলে গেছে। সেখানে পা রাখতে থমকে দাঁড়ায়। ভেতরে অদ্ভুত কি সব শব্দ…গোঙানি আর্তনাদ! এ বয়সে এসবের মানে সে খুব জানে। সে খারাব মানুষ। মনের সকল চিন্তা খারাব। আশেপাশে কেনাবেচা দরদাম করে এতকাল চলে এসেছে। এসেছিল। সে সবকিছু বোঝে। আর বুঝতে চায় না। সবকিছু থেকে তোওবা করেছে। তাই একবার ভাবে ফিরে চলে যায়। অসময়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরে নাহয় আসা যাবে। ও বাড়ির বউটির সঙ্গে গল্প করে আসা যাক। তারপর বহুদিনের অভ্যেস। সে এক দুর্দমনীয় কৌতূহলে অতি ধীর পায়ে রান্নাঘরে গিয়ে বসে। সে বুড়ি মানুষ। কিছু দেখে না। বোঝেও না। দেখলেই কী আর বুঝলেও কী! এসব ভাবনায় সে কখন আনমনে এঁটো থালাবাসন নিয়ে কুয়োতলায় বসে। সেখান থেকে কখনো অপাঙ্গে চোখ রাখে দরজায়। অনেকক্ষণ ধরে দরজা বন্ধ। খুব ধীর লয়ে ভেসে আসে কিছু শীৎকার আর কাতর ধ্বনি। সে শব্দ তার বুড়ি মন বিহ্বল করে দেয়। পুরনো দিনের কথা ভেসে উঠে। একসময় তারও বয়স ছিল। যৌবন ছিল।

কতক্ষণ কে জানে! হয়তো অনন্তকাল। সে অনেকগুলো থালাবাসন ঘষেমেজে পরিষ্কার করে। মিটশেফে একটি একটি করে সুন্দরভাবে সাজায়। এসব করতে করতে আকস্মিক দরজার দিকে দৃষ্টি রাখে। তারপর একসময় দরজা খুলে যায় আর একটি মেয়ে বের হয়ে আসে। মেয়েটি খুব দ্রুত বাথরুমে যেতে থাকে। তখন তার পোড়া দুচোখে সেই ছায়া পড়ে। সে কি চিৎকার করে উঠবে নাকি প্রচণ্ড এক আর্তনাদ? দুচোখের সমুখে কে, কে এই মেয়ে…তার বুকের ধন শিখা? তার প্রচণ্ডরকম অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। না…না সে কিছু দেখেনি। তার পোড়া দুচোখ কিছু দেখে না। দেখেও দেখে না। অনেককিছু বুঝেও কিছু বোঝে না। সে এতদিন কত কেনা বেচা করেছে। দরদাম করেছে। কত টাকা আয় করেছে। কত কলংক নিজে মেখেছে। কত কলংক লেপেছে অন্যের গায়। সে সবকিছু ছেড়ে দিয়েছে। পাপের পথ থেকে বেরিয়ে এসেছে। পাপ তাকে বেরোতে দেয়নি। তাকে ছেড়ে যায়নি।

তার পোড়া দুচোখে এক গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে। (জুলাই ’১২)

Facebook Comments

6 Comments

  1. Priyotom Mitra

    গল্পটি বেশ মনোযোগের সাথে পড়লাম। বর্তমান সময়ের যে নৈতিক অবক্ষয, শঠতা এবং অসহায় মানুষের কষ্ট লেখক তা চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন। লেখককে অভিনন্দন এমন সুন্দর একটি কাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তুলে ধরার জন্য। লেখকের প্রতি আরো গল্প দেয়ার অনুরোধ রাখছি।

    • মাহবুব আলী

      আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। খুব উৎসাহজনক মন্তব্য করেছেন। অবশ্যই আরও লেখা দেব, প্রকাশের ভার সম্পাদক/ মডারেটর সাহেবের। শুভেচ্ছা।

  2. এক পুরুষে পত্নী, দুই পুরুষে দ্বিচারিণী আর এর অধিক হলে কুলটা। সংসার-ত্যাগিনী। তার কোনো সংসার নেই। সে কুলটা। … কখনো কখনো মনে হয় আপনার লিখার তুলনা আপনি স্বয়ং।
    সম্ভবত এমন ছায়ার গল্প আমি পড়েছি। আপনারই লেখা।

    আবার পড়তে পেরে ভালো লাগছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top