‘শিল্প’ নিয়ে বোঝাপড়া

ফারহানা মান্নান

দেশ-জাতি-রাষ্ট্র ভেদে শিল্পের রস আস্বাদনের ভঙ্গিমাও পাল্টে যায়। ইউরোপের শিল্প আয়োজন, জাপানের শিল্প আয়োজন, আমাদের শিল্প আয়োজন – প্রত্যেকটি আয়োজনের একটা আলাদা রঙ, রূপ, রস, গন্ধ রয়েছে। আলাদা আলাদা এই আয়োজনের সমন্বিত রূপও জন্ম দিতে পারে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার একটি শিল্প। কিন্তু প্রশ্ন হল, এটি প্রকৃত অর্থেই কি শিল্প হল? অন্যের শিল্পরসকে নিজের চিন্তার সাথে লালন করে নতুন মাত্রার শিল্পের এই মোড়ক উন্মোচন শিল্পের ঠিক কোন সংজ্ঞাকে সমর্থন করে?

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মনে করেন, “Painting is poetry that is seen rather than felt, and poetry is painting that is felt rather than seen.” আবার, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “Artist- এর অন্তর্নিহিত অপরিমিতি (বা infinity), artist-এর স্বাতন্ত্র্যতা (individuality)- এই সমস্তর নির্মিতি নিয়ে যেটি এল সেইটেই Art। অন্যের নির্মিতির ছাপ, এমনকি বিধাতারও নির্মিতির ছাঁচে ঢালাই হয়ে যা বার হল তা আসলের নকল বই আর তো কিছুই হল না”।

কোনটা প্রকৃত অর্থে শিল্প আর কোনটি নয়, এই পার্থক্যের প্রধান সূচক হল শিল্পরস। অর্থাৎ যেখানে প্রাণ ও রসের সন্ধান পাওয়া যায় সেখানেই শিল্প রয়েছে, আর যা শিল্প নয় সেটি বাহ্যিক বিচারে স্নিগ্ধতার পোশাকে আবৃত বলে মনে হলেও শিল্পের উষ্ণতা অন্তরের অন্তস্থলে পৌঁছয় না। শিল্পের প্রকৃত রস আস্বাদনের ক্ষেত্রে তাই শিল্পীর সাধ ও সামর্থ্য এই দুয়ের মধ্যকার বোঝাপড়া সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সাধ এবং সামর্থ্যের মধ্যকার একটা পরিষ্কার ব্যবধান আছে যা কিনা একজন শিল্পীর শিল্পের উঁচুতা নির্ধারণ করে। সাধের খেয়ালে ক্যানভাসে তুলির আঁচড় শিল্পীর ভাবনার গভীরতাকে অনুসরণ করে; আর ক্যানভাসের বুকে শিল্পীর কেবল মাত্র সামর্থ্যের চর্চার প্রতিফলন, শিল্পীর ভাবনার অগভীরতাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে। কিন্তু যদি এই দুয়ের মিলন ঘটানো হয় তবে কি তা একটি প্রকৃত শিল্প হতে পারে?

এই যেমন ধরা যাক, আদিম কালে গুহার ভেতরে যারা অবলীলায় ছবি এঁকে ফেলেছিল, যাদের অঙ্কন সম্পর্কে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধারনাই ছিল না, সেই সকল শিল্পীদের কথা বলছি না। বলছি তার কথা, যিনি একজন শিক্ষিত আঁকিয়ে– যিনি হাতে-কলমে শিখেছেন, যার রঙতুলির প্রয়োগ সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে। তেমন এক শিল্পীর কথা যদি ধরি, তবে একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে একটি শূন্য ক্যানভাসে তার সামর্থ্যের ছোঁয়া স্পষ্ট। কিন্তু একই সাথে অন্তরের সাধ না থাকলে কেবল এই সামর্থ্যের আদলে শিল্পের রস আস্বাদন সম্ভব নয়। হাতে ধরে দেখিয়ে সামর্থ্য তৈরি করা যায়, কিন্তু সাধ? এ তৈরি করতে গেলে ব্যক্তির একান্ত ইচ্ছের প্রয়োজন। কারণ শিল্পরস আস্বাদনের ক্ষেত্রে এ আয়োজন যে স্বতন্ত্র।

ছবি আঁকার উদ্দেশ্য কী? অথবা আমরা কেন ছবি আঁকি?  এক কথায় বলা যায়, নান্দনিক বস্তু সৃজনের জন্য। কিন্তু Aristotle ও Plato এর ধারণা অনুযায়ী ছবি আঁকার উদ্দেশ্য বাস্তবতার অনুষঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থাৎ ছবি আঁকার বিষয়বস্তু হল কোনো কিছুর সারবস্তুর প্রতিকৃতি।

ছবি আঁকবার উদ্দেশ্য কিন্তু কেবল মাত্র নান্দনিক বস্তু সৃজন বা বাস্তব অবস্থার অথবা চিন্তার ফলশ্রুতি নয়। ছবি আঁকবার ক্ষেত্রে শিল্পীর বৌদ্ধিক ও মানসিক অবস্থার প্রতিফলনের দিকটিও আমলে আনবার মতন বিষয়। যদি কোনো শিল্পীর শিল্প কোনো তাড়না বা অভাববোধ থেকে সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে শিল্পীর আঁকবার উদ্দেশ্য হবে – অভাব পূরণ। এদিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায়, শিল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেন একজন শিল্পী নিজেই। পূর্ব থেকে চিন্তা করে যেমন আঁকবার উদ্দেশ্য অর্জন করা যায়, ঠিক তেমনি মনের খেয়ালের বশে এঁকে ফেলা ছবিটিও আপনাআপনি উদ্দেশ্য তৈরি করে ফেলতে পারে। অর্থাৎ একজন শিল্পী একটি শূন্য ক্যানভাসে তাঁর নিজস্ব ধারনার প্রতিফলন ঘটান যা অন্য কোনো ধারনার অনুকৃত নয়। যেখানে শিল্পীর সাধ এবং সামর্থ্য উভয়ের মিশ্রণ যেখানে আছে। আছে শিল্পীর অপরিমিতি এবং স্বাতন্ত্র্যতা।

যদি বলা হয় আঁকবার ক্ষেত্রে লক্ষণ বিচার করুন। তবে? অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে Art এর একটা লক্ষণ হল আড়ম্বরশুন্যতা-Simplicity। অর্থাৎ সাধারনের ভেতরে অসাধারনের সন্ধান। কিন্তু ক্যানভাসে যখন রঙ নিয়ে খেলব তখন তাতে রঙের খানিকটা বাড়াবাড়ি না হলে কি ভাল লাগে? পাগলপারা মন আর ক্যানভাসেইতো ভূমিষ্ঠ হবে একটা আলোকিত শিল্প। তবে রঙের এই বাড়াবাড়ি মানে কিন্তু এই নয় যে ইচ্ছে মতন অনর্থক রঙে ক্যানভাস ভরিয়ে তুললাম। রঙ নিয়ে খেলবার মধ্যেও মাত্রা-চেতনা থাকা চাই, শিল্পগুণ ফুটে ওঠা চাই। ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে শিল্পরস অনুসন্ধান সম্ভব হলেও যেমন তেমন আয়োজনে শিল্পের রস উন্মোচন এ যে এক আশ্চর্য ব্যাপার! একজন প্রকৃত শিল্পী শিল্পের উঁচু স্তরে পৌঁছে ঠিক এমনি ভাবেই সৃজনশীল হয়ে ওঠেন। এ না হলে হবে না, ও না হলে হবে না – শিল্পের দিক দিয়ে একথা বলে শুধু সে, যার শিল্প না হলেও জীবনটা চলছে কোনো রকমে।

শিল্পীর ভেতরে রসের তৃষ্ণা জাগলে শিল্পী কোনো প্রকার আয়োজন বা আনুষ্ঠানিকতার কথা ভাবেন না। যেমন করে যে আয়োজনেই হোক শিল্পী রস আস্বাদন করবেনই। একদিন সন্ত কবীর দেখলেন একটা লোক কেবলই নদী থেকে জল আমদানি করছে শহরের মধ্যে চামড়ার থলি ভরে-ভরে! সে লোকটার ভয় হয়েছে নদী কোন দিক দিয়ে শুকিয়ে যাবে! মস্ত বড় এই পৃথিবী নীরস হয়ে উঠেছে, তাই সে রস বেলাবার মতলব করছে। কবীর লোকটার কাছে ডেকে উপদেশ দিলেন-
“পানি পিয়াওত ক্যা ফিরো
ঘর ঘর সায়র বারি।
তৃষ্ণাবংত জো হোয়গা
পীবইগা ঝকমারি।”
এ আয়োজন কেন, ঘরে ঘরে যখন রসের সাগর রয়েছে? তেষ্টা জাগুক, ওরা আপনিই সেটা মেটাবার উপায় করে নেবে দায়ে ঠেকে।

মূলকথা হচ্ছে, একজন শিল্পীর তৃষ্ণা জাগলে, তৃষ্ণা মেটাবার চেষ্টা তিনি আপনিই করেন। কোনো প্রকার আয়োজন বা মাধ্যম সেখানে প্রাধান্য পায় না। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে একটা আশ্চর্য সৃষ্টি রচনা করে চলেন। শিল্প প্রকৃতপক্ষে শিল্পীর সৃষ্টি। কিন্তু ঐ যে বলা হল, সকল সৃষ্টি যেমন শিল্প নয় ঠিক তেমনি ভাবে সকল শিল্পীও পাগলপারা শিল্পী নন। অর্থাৎ সাধ, একাগ্রতা, একনিষ্ঠতা, সৃষ্টিশীলতা যেখানে নেই, সেখানে একজন শিল্পী শিল্পের অন্দরে প্রবেশ করতে পারেন না। তেমন শিল্প অমৃত রস আস্বাদনের ক্ষেত্রেও ব্যর্থ। স্রষ্টার আমাদের প্রতি অসীম দয়া তাঁর সৃষ্টিশীলতার খানিকটা তিনি আমাদের দিয়েছেন। অঞ্জলি ভরে   দিয়েছেন ভাবনার আর ভাবনাকে আঙ্গিক রূপ দেবার বর। এমন বর যে, মানব সম্প্রদায়ের আছে তাদের অর্জন ছাড়া হারাবার তো কিছু নাই।

শিল্প তাই মানুষ ভেদে বেশি-কমের ব্যবধানে বিচরণ করলেও কোনো মানবের ভেতরেই এর অবস্থান শূন্য নয়। “Every child is an artist. The problem is how to remain an artist once he grows up.”― Pablo Picasso

পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর বছরের ক্ষণস্থায়ী একটি জীবন আমাদের। শিল্পের আগমন আমাদের এ বিশৃঙ্খল জীবনকে করে তুলতে পারে ন্যায়নিষ্ঠ, শুভ্র, সুন্দর। জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি কেবল মাত্র বাঁচবার তাগিদ আর survival technique গুলো রপ্তকরন। এই ছাড়া এ জীবনে সত্যিই আর কিচ্ছুটি করবার নেই? নিজের মনকে, নিজের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য যে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় তার হাউশ মেটে কি কেবল মাত্র গৃহ, অফিস, সিনেমা হল, আড্ডা আর গরম চায়ের কাপে? শিল্পের ছোঁয়া বিশুদ্ধ বাতাস হয়ে রক্তে মিশে যায় স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে। দেহ, মন, প্রাণ, মস্তিষ্ক শিল্পের অধিকার লাভ করে। প্রশ্ন হতে পারে এই অধিকার পেয়ে কী লাভ? শিল্পের চিন্তা এমন কী পরিবর্তন আনতে পারে এ জীবনে? শিল্পের চর্চা কি না করলেই নয়? শিল্প কেবল আপনার প্রশান্তি বয়ে আনে না, সমগ্র সমাজের প্রতিচ্ছবি হতে পারে শিল্প। নিজের ভেতরকার আবেগ, অনুভূতিকে রঙ ও তুলির আঁচড়ে শূন্য ক্যানভাসে একটি অর্থপূর্ণ বা কাল্পনিক অবয়ব এর মাধ্যমে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে পারার যে সার্থকতা তেমনটি আর কোথায় পাওয়া যেতে পারে? এ কেবল আঁকবার ক্ষেত্রে বলেই বলছি না। শিল্পের চর্চা কাব্য দিয়ে হোক, সংগীতে হোক বা রঙ তুলিতে; প্রত্যকটিতেই সে কিন্তু আপনার ‘আপনি’কে প্রতিফলিত করতে পারে। তেমনটি যদি না হত তবে যুগের পর যুগ ধরে শিল্প চর্চার এই আয়োজন টিকতে পারত না। রূপবিদ্যাকে যারা শখের দিক দিয়ে দেখতে চলে তারা নেশা ছুটলে অন্য কিছুতে লেগে যায়, কিন্তু রূপবিদ্যা যার কাছে সত্য হয়ে উঠল, সে-ই বললে এ খেলা নয়, এ লীলা–

“এ তো খেলা নয়
এ যে হৃদয়-দহন জ্বালা।”

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

Facebook Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top